রামের শঙ্খ

রামের শঙ্খ

 গরিব চাষা বেচারার বড় দুরবস্থা। সেবার তার খেতের শস্য এতই কম হয়েছে যে তার দুবেলা পেট ভরে খাওয়াই জোটে না। তার ভাঙা কুঁড়ের পাশেই এক দুষ্টু লোকের বাড়ি; সে অনেক গরিব লোককে ফাঁকি দিয়ে দেদার টাকা আর মস্ত দালান করেছে।

 চাষা সেই লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল; “কি করে টাকা জমায় বলতে পার কি?” দুষ্টু লোকটা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলল, “রাম-নাম জপ কর টাকা তিনিই দেবেন।”

 চাষা বেচারা ভালো মানুষ, সে তো তখন থেকে কেবলই দিন রাত “রাম-রাম-রাম-রাম” বলে। কিন্তু টাকা আর আসে না। শেষটায় ঘরে আর এক মুঠোও চাল রইল না। তখন বেচারা বড়ই মুশকিলে পড়ল। না খেয়ে খেয়ে তার গলার জোর চলে গেছে—রাম-নাম করতে পারে না। অথচ টাকা না হলেও চলে না—রাম-নাম ছাড়বারও জো নেই। বেচারা চিঁ চিঁ ক’রে নাম জপ করছে এমন সময় একজন রোগা টিংটিঙে লোক এসে একটা শঙ্খ দিয়ে চাষাকে বলল, “এই শঙ্খটা নাও। দশবার রাম-নাম করে পুব মুখো হয়ে এই শঙ্খে তিনবার ফুঁ দিয়ে যা চাইবে তাই পাবে।” এই বলেই সে চলে গেল।

 চাষা তো তখনই দশবার রাম-নাম করে পুবমুখো হয়ে শঙ্খে তিনবার ফুঁ দিয়েই বলল, “পোলাও, মাংস, তরকারি, পায়েস, মিঠাই এই-সব চাই।”—অমনি থালা ভরা সুন্দর সুন্দর খাবার এসে হাজির!—বেচারা তখন পেট ভরে খেয়ে বাঁচল। তার পরের দিন যখন সেই দুষ্টু লোকটার সঙ্গে চাষার দেখা হ’ল, তখন সে চাষাকে জিজ্ঞাসা করল, “কি ভাই, তোমার আজ এত ফুর্তি কেন? রাম-নাম করে বুঝি মেলাই টাকা পেয়েছ?”

 চাষা বেচারা ভালো মানুষ সে সব কথা তাকে খুলে বলল, কেবল শঙ্খটা কি ক’রে বাজাতে হয় তা বলল না। দুষ্টু লোকটার বড় হিংসা হ’ল। সে রোজই শঙ্খটার লোভে চাষার বাড়ি যাওয়া আসা করতে লাগল, আর একদিন সুবিধা বুঝে সেটাকে চুরি করল। কিন্তু সেটা চুরি করেও তার কোন লাভ হল না। বাড়ি গিয়ে সেটাকে সে কতরকম করে বাজাতে লাগল আর নানান জিনিস চাইতে লাগল, কিন্তু কিছুই পেল না। শেষটায় খুব জব্দ হয়ে সে চাষার কাছে ছুটে গেল, আর বলল, “তোমার শঙ্খটা আমি চুরি করেছি। তুমি যদি প্রতিজ্ঞা কর যে ভবিষ্যতে তুমি শঙ্খের কাছ থেকে যা কিছু জিনিস নেবে তার দ্বিগুণ জিনিস আমাকে দেবে, তবে তোমাকে সেটা ফিরিয়ে দেবো।” চাষা বেচারা আর কি করে? নাই মামার চেয়েও তো কানা মামা ভালো; তাই সে দুষ্টু লোকটার কথায়ই রাজি হ’ল। তখন থেকে শঙ্খের কাছে সে যা কিছু জিনিস পায়, দুষ্টু লোকটা তার দ্বিগুণ জিনিস পায়।

 শেষটায় একবার সে দেশে ভয়ানক গরম পড়ল; বৃষ্টি বন্ধ হ’ল, আর নদী, পুকুর, কুয়ো সব শুকিয়ে গেল। তখন চাষা শঙ্খের কাছে একটা জলভরা কুয়ো চাইল। অমনি তার বাড়িতে একটা সুন্দর ঠাণ্ডা জলের কুয়ো হ’ল, আর সেই দুষ্টু লোকটার বাড়িতে দুটো সুন্দর কুয়ো হ’ল।

 চাষার এত হিংসা হল যে তার আর রাত্রে ঘুমই হল না। সে কেবল ভাবতে লাগল কি করে দুষ্টু লোকটাকে জব্দ করবে। ভাবতে ভাবতে তার মাথায় একটা বুদ্ধি জোগাল। সে শঙ্খের কাছে চাইল, “আমার একটা চোখ কানা ক’রে দাও!”

 অমনি তার একটা চোখ কানা হয়ে গেল, আর সেই দুষ্টু লোকটা একেবারে অন্ধ হয়ে গেল। অন্ধ হয়ে যেই সে ঘর থেকে বেরোবে, অমনি সে দুটো কুয়োর একটার মধ্যে পড়ে গেল, আর হাবুডুবু খেয়ে ডুবে মরল।

সন্দেশ—১৩২৩