রাজমহিষী
হংসেশ্বর রায় খুব ধনী লোক। রাধানাথপুরে তাঁর যে জমিদারী ছিল তা এখন সরকারের দখলে গেছে, কিন্তু তাতে হংসেশ্বরের গায়ে আঁচড় লাগে নি। কলকাতায় অফিস অঞ্চলে আর শৌখিন পাড়ায় তাঁর ষোলটা বড় বড় বাড়ি আছে, তা থেকে মাসে প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা আয় হয়। তা ছাড়া বন্ধকী কারবার আর বিস্তর শেয়ারও আছে। হংসেশ্বরের বয়স পঞ্চাশ। তাঁর পত্নী হেমাঙ্গিনী সংসারে অনাসক্ত, বিপুল শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে ঔষধ আর পুষ্টিকর পথ্য খেয়ে গল্পের বই পড়ে দিন কাটান আর মাঝে মাঝে বাড়ির লোকদের ধমক দেন—যত সব কুঁড়ের বাদশা জুটেছে। এঁদের একমাত্র সন্তান চকোরী, সম্প্রতি এম. এ. পাস করেছে।
কলকাতা হংসেশ্বরের ভাল লাগে না। তাঁর যেসব শখ আছে তাঁর চর্চার পক্ষে রাধানাথপুরই উপযুক্ত স্থান, তাই ওখানেই তিনি বাস করেন। তাঁর প্রকাণ্ড বাগান আছে, গরু আর হাঁস—মুরগিও আছে। কৃষিজাত দ্রব্য আর পশুপক্ষীর যত প্রদর্শনী হয় তাতে তাঁর আম কাঁঠাল লাউ কুমড়ো গরু হাঁস মুরগিই শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পায়। সম্প্রতি তিনি পশ্চিম পঞ্জাবের গুজরানওআলা থেকে একটি ভাল জাতের মোষ আনিয়েছেন, তার জন্যে তাঁর এক পাকিস্তানী বন্ধুকে প্রচুর ঘুষ দিতে হয়েছে। তিনি মোষটির নাম রেখেছেন রাজমহিষী। কিছু দিন আগে তার প্রথম বাচ্চা হয়েছে। আগামী ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্যাটল শো—তে তিনি এই মোষটিকে পাঠাবেন। তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন তালদিঘির রায়সাহেব মহিম বাঁড়ুজ্যে, তাঁর একটি মুলতানী মোষ আছে। হংসেশ্বর আশা করেন তাঁর রাজমহিষীই রাজ্যপাল গোল্ড মেডাল পাবে।
হংসেশ্বরের মেয়ে ‘চকোরী কলকাতায় তার মামাদের তত্ত্বাবধানে থেকে কলেজে পড়ত। এখন পড়া শেষ করে রাধানাথপুরে তার বাপ—মায়ের কাছে আছে, মাঝে মাঝে দু—দশ দিনের জন্যে কলকাতায় যায়। চকোরী লম্বা রোগা, দাঁত বড় বড়, চোয়াল উঁচু, গায়ের স্বাভাবিক রঙ ময়লা। সর্বাঙ্গীণ পরিপাটী মেক—আপ সত্ত্বেও তাকে সুন্দরী বলে ভ্রম হয় না। চকোরীর হিংসুটে সখীরা বলে, রূপ তো আহামরি বিদ্যাধরী, গুণে মা মনসা, শুধু ওর বাপের সম্পত্তির লোভে খোশামুদেগুলো জোটে।
মেয়ের বিবাহের জন্যে হেমাঙ্গিনীর কিছুমাত্র চিন্তা নেই, হংসেশ্বরও ব্যস্ত নন। তিনি বলেন, চকোরী হুঁশিয়ার হিসেবী মেয়ে, বোকা—হাবার মতন চোখ বুজে বাজে লোকের সঙ্গে প্রেমে পড়বে না, চটক দেখে বা মিষ্টি—মধুর বুলি শুনেও ভুলবে না। তাড়াহুড়োর দরকার কি, আজকাল তো ত্রিশ—পঁয়ত্রিশের পরে মেয়েদের বিয়ের রেওয়াজ হয়েছে। চকোরী সুবিধে মতন নিজেই যাচাই করে একটা ভাল বর জুটিয়ে নেবে।
.
চকোরীর প্রেমের যত উমেদার আছে তার মধ্যে সবচেয়ে নাছোড়বান্দা হচ্ছে বংশীধর। সম্প্রতি সে পি—এচ. ডি. ডিগ্রী পেয়ে টালিগঞ্জ কলেজে একটা প্রোফেসারি পেয়েছে, বটানি আর জোঅলজি পড়ায়। তার বাবা শশধর চৌধুরী দু বছর হল মারা গেছেন। তিনি উকিল ছিলেন, হংসেশ্বরের কলকাতার সম্পত্তি তদারক করতেন। বংশীধরের মামার বাড়ি রাধানাথপুরে, সেখানে সে মাঝে মাঝে যায়। চকোরীর সঙ্গে ছেলেবেলা থেকেই তার পরিচয় আছে, হংসেশ্বরকে সে কাকাবাবু বলে।
পূজোর ছুটিতে বংশীধর রাধানাথপুরে এসেছে। একদিন সে চকোরীকে বলল, আর দেরি কেন, তোমার লেখাপড়া শেষ হয়েছে, আমারও যেমন হক একটা চাকরি জুটেছে। এখন আর তোমার আপত্তি কিসের? তুমি রাজী হলেই তোমার বাবাকে বলব।
চকোরী বলল, ব্যাপারটি যত সোজা মনে করছ তা নয়। আমার তরফ থেকে বলতে পারি, তোমাকে আমার পছন্দ হয়, বেশ শান্তশিষ্ট, যদিও নামটা বড় সেকেলে, বংশীধর শুনলেই মনে হয় সাপুড়ে। কিন্তু প্রেমে হাবুডুবু খাবার মেয়ে আমি নই। বাবাকে যদি রাজী করাতে পার তবে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই। তবে বাবা লোকটি সহজ নন, নানা রকম ফেচাং তুলবেন। তোমার যদি সাহস আর জেদ থাকে তাঁকে বলে দেখতে পার।
পরদিন সকালে হংসেশ্বরের কাছে গিয়ে বংশীধর সবিনয়ে নিবেদন করল যে তার কিছু বলবার আছে। হংসেশ্বর তখন তাঁর মোষের প্রাতঃকৃত্য তদারক করছিলেন। বংশীধরকে বললেন, একটু সবুর কর। তারপর তিনি রাজমহিষীর পরিচারককে বললেন, এই গোপীরাম, বেশ পরিষ্কার করে গা মুছিয়ে দিবি, খবরদার একটুও কাদা যেন লেগে না থাকে। একি রে নাকের ডগায় মশা কামড়েছে দেখছি, ওর ঘরে ডিডিটি দিস নি বুঝি?
গোপীরাম বলল, বহুত দিয়েছি হুজুর, কিন্তু দিদি দিলে মচ্ছাড় ভাগে না। আপনি যদি হুকুম করেন তবে আমার গাঁও থেকে চারঠো বগুলা মাঙাতে পারি।
—বগুলা কি জিনিস?
—বগ—পাখি হুজুর। গোহালে রাখলে মখখি মচ্ছড় পতিংগা মকড়া সব টপাটপ খেয়ে ফেলবে, ভঁইসী আর তার বচ্ছা বহুত আরাম সে নিদ যাবে।
—না হুজুর, ওদের পংখ একটু ছেঁটে দিব, উড়তে পারবে না। পনদ্র দিন বাদ গাঁও সে আমার এক চাচা আসবে, বলেন তো বগুলা আনতে লিখে দিব, চার বগুলায় বিশ টাকা অন্দাজ খর্চ পড়বে।
—বেশ, আজই লিখে দে।
গোপীরামকে আরও কিছু উপদেশ দিয়ে হংসেশ্বর তাঁর অফিসঘরে বংশীধরকে নিয়ে গেলেন। প্রশ্ন করলেন, তারপর বংশী, ব্যাপারটা কি হে।
মাথা নীচু করে হাত কচলাতে কচলাতে বংশীধর বলল, কাকাবাবু, অনেক দিনের একটা দুরাশা আছে, তাই আপনার সম্মতি ভিক্ষা করতে এসেছি।
হংসেশ্বর বললেন, অ। চকোরীকে বিয়ে করতে চাও এই তো?
বংশীধর সভয়ে বলল, আজ্ঞে হাঁ।
হংসেশ্বর বললেন, শোন বংশী, আমি স্পষ্ট কথার মানুষ। পাত্র হিসেবে তুমি ভালই, দেখতে চকোরীর চাইতে ঢের বেশী সুশ্রী, বিদ্যাও আছে, যতদূর জানি চরিত্রও ভাল। কিন্তু তোমার আর্থিক অবস্থা তো সুবিধের নয়। কলকাতায় একটা সেকেলে পৈতৃক বাড়ি আছে বটে, কিন্তু সেখানে তোমার মা দিদিমা ভাই বোন ভাগনেরা গিশগিশ করছে ; সেই ভিড়ের মধ্যে চকোরী এক মিনিটও টিকতে পারবে না। তার পর তোমার আয়। মাইনে কত পাও হে? দু শ? পরে আড়াই শ হবে? খেপেছ, ওই টাকায় চকোরীকে পুষতে চাও? তার সাবান ক্রীম পাউডার পেণ্ট লিপস্টিক সেণ্ট এই সব খরচই তো মাসে আড়াই শ—র ওপর। তুমি হয়তো ভেবেছ মেয়ে—জামাই—এর ভরণপোষণের জন্যে আমি মাসে মাসে মোটা টাকা দেব। সেটি হবে না বাপু।
বংশীধর বলল, আমি গরিব হলেই ক্ষতি কি কাকাবাবু? চকোরী আপনার একমাত্র সন্তান, সে যাতে সুখে থাকে তার জন্যে আপনি অর্থসাহায্য করবেন এ তো স্বাভাবিক। আপনার অবর্তমানে ওই তো সব পাবে।
—অবর্তমান হতে ঢের দেরি হে, আমি এখনও চল্লিশ বছর বাঁচব, তার আগে এক পয়সাও হাতছাড়া করব না। মেয়ে যদ্দিন আইবুড়ো তদ্দিন আমার খরচে নবাবি করুক আপত্তি নেই, কিন্তু বিয়ের পর সমস্ত ভার তার স্বামীকে নিতে হবে। আর যদিই বা তোমাদের খরচ আমি যোগাই তাতে আমার মাথা হেঁট হবে না? বাপের মাইনের গোলাম স্বামীর ওপর কোনও মেয়ের শ্রদ্ধা থাকে না। আমিই বা চ্যারিটি—বয় জামাই করতে যাব কেন?
বংশীধর কাতর স্বরে বলল, তবে কি আমার কোনও আশা নেই?
—আশা থাকতে পারে। তুমি উঠে পড়ে লেগে যাও যাতে তোমার রোজগার বাড়ে। তোমার মাসিক আয় আড়াই হাজার হলেই আমার আর আপত্তি থাকবে না।
—অত টাকা আয়ের তো কোনও আশা দেখছি না। আর, চকোরী কি ততদিন সবুর করবে?
—সবুর করবে কিনা আমি কি করে বলব। তুমিই তার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে পার। হাঁ, আর একটা কথা তোমার জেনে রাখা দরকার। চকোরীকে ভাঁওতা দিয়ে রাজী করিয়ে যদি আমার অমতে তাকে বিয়ে কর তবে আমার সমস্ত সম্পত্তি হরিণঘাটায় দান করব, গো—মহিষ—ছাগাদি পশু আর হংস—কুক্কুটাদি পক্ষীর উৎকর্ষকল্পে। আর, চকোরী আমার সম্পত্তি পেলেই বা তোমার কি সুবিধে হবে? সে অতি ঝানু মেয়ে, কাকেও বিশ্বাস করে না, ব্যাঙ্কের চেকবুক তোমাকে দেবে না, বিষয় যা পাবে তাতেও তোমাকে হাত দিতে দেবে না। বড় জোর তোমার সিরারেটের খরচ যোগাবে আর জন্মদিনে কিছু উপহার দেবে, এক সুট ভাল পোশাক, কি রিস্টওয়াচ, কিংবা একটা শার্পার—নাইণ্টি কলম। চকোরীকে বিয়ে করার মতলব ছেড়ে দেওয়াই তোমার পক্ষে ভাল।
বংশীধর বিষণ্ণ মনে চলে গেল। বিকাল বেলা তার কাছে সব কথা শুনে চকোরী বলল, বাবা যে ওই রকম বলবেন তা আমি আগে থাকতেই জানি।
বংশীধর বলল, চকোরী তোমার বাবার সম্পত্তি তাঁরই থাকুক, আমার তাতে লোভ নেই। তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালবাস তবে ত্যাগ স্বীকার করতে পারবে না? প্রেমের জন্যে নারী কি না ছাড়তে পারে? যদি ভালবাসা থাকে তবে আমার সেকেলে ছোট বাড়িতে আর সামান্য আয়েই তুমি সুখী হতে পারবে।
চকোরী হেসে বলল, শোন বংশী। প্রেম খুব উঁচুদরের জিনিস, আর তোমার ওপর আমার তা নেহাত কম নেই। কিন্তু টাকাহীন প্রেম আর চাকাহীন গাড়ি দুইই অচল, কষ্টের সংসারে ভালবাসা শুকিয়ে যায়। ‘ধনকে নিয়ে বনকে যাব থাকব বনের মাঝখানে, ধনদৌলত চাই না শুধু চাইব ধনের মুখপানে’—এ আমার পোষাবে না বাপু। তোমাকে ভয় দেখিয়ে তাড়াবার জন্যে বাবা অবশ্য অনেকটা বাড়িয়ে বলেছেন, আমাকে একেবারে হার্টলেস রাক্ষুসী বানিয়েছেন। কিন্তু আমি অতটা বেয়াড়া নই। তবে বাবা নিতান্ত অন্যায় কিছু বলেন নি। আমি বলি কি তোমার ওই প্রোফেসরি ছেড়ে দিয়ে কোনও ভাল চাকরির চেষ্টা কর। বাবার সঙ্গে মন্ত্রীদের আলাপ আছে, ওঁকে ধরলে নিশ্চয় একটা ভাল পোস্ট তোমাকে দেওয়াতে পারবেন। প্রথমটা মাইনে কম হলেও পরে আড়াই—তিন হাজার হওয়া অসম্ভব নয়।
—ততদিন আমার জন্যে তুমি সবুর করে থাকবে?
—গ্যারাণ্টি দিতে পারব না। অক্ষয় প্রেম একটা বাজে কথা, ভবিষ্যতে তোমার আমার দুজনেরই মতিগতি বদলাতে পারে। যা বলি শোন। একটা ভাল সরকারী চাকরির জন্যে নাছোড়বান্দা হয়ে বাবাকে ধর। কিন্তু এখনই নয়, ওঁর মাথার এখন ঠিক নেই, দিনরাত ওই মোষটার কথা ভাবছেন। বাবার গুপ্তচর খবর এনেছে, তালদিঘির সেই মহিম বাঁড়ুজ্যের ফুলতানী মোষ নাকি রোজ সাড়ে কুড়ি সের দুধ দিচ্ছে, আমাদের রাজমহিষীর চাইতে কিছু বেশী, যদিও দুটোই সমবয়সী তরুণী মোষ। বাবা তাই উঠে পড়ে লেগেছেন, রাজমহিষীকে কাপাস বিচির খোল, চীনাবাদাম, পালং শাগ, কড়াইশুঁটি, গাজর, টমেটো, নারকেল—কোরা, কমলালেবুর রস, এইসব পুষ্টিকর জিনিস খাওয়াচ্ছেন, ভাইটামিন বি—কমপ্লেক্সও দিচ্ছেন। এগজিবিশনটা আগে চুকে যাক। রাজমহিষী যদি গোল্ড মেডাল পায় তবে বাবা খুব দিল—দরিয়া হবেন, তখন তাঁকে চাকরির জন্যে ধরবে।
আর এক মাস পরেই পশ্চিমবঙ্গ—গবাদি—পশু—প্রদর্শনী, কিন্তু হংসেশ্বর মহা বিপদে পড়েছেন, রাজমহিষী খাওয়া প্রায় ত্যাগ করেছে, দুধও নামমাত্র দিচ্ছে। যত নষ্টের গোড়া ওই গোপীরাম, রাজমহিষীর প্রধান সেবক। সে তার ইয়ারদের সঙ্গে রাসপূর্ণিমায় মেলায় গিয়ে খুব তাড়ি খেয়ে হাঙ্গামা বাধিয়েছিল, পুলিস এলে তাদের সঙ্গে বীরদর্পে লড়ে একটা কনস্টেবলের মাথা ফাটিয়েছিল। তার ফলে তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় চালান দেওয়া হয়। খবর পেয়ে তাকে খালাস করবার জন্যে হংসেশ্বর অনেক চেষ্টা করলেন, কলকাতা থেকে ভাল ব্যারিস্টার পর্যন্ত আনালেন। আদালতে তিনি প্রার্থনা করলেন, মোটা জরিমানা করে আসামীকে ছেড়ে দেওয়া হক। কিন্তু হাকিম তা শুনলেন না, ছমাস জেলের হুকুম দিলেন। তখন ব্যারিস্টার বললেন, ইওর অনার, এই গোপীরাম যদি জেলে যায় তবে শ্রীহংসেশ্বর রায়ের সর্বনাশ হবে। তাঁর বিখ্যাত চ্যাম্পিয়ান বফেলো রাজমহিষী গোপীরামের বিরহে খাওয়া বন্ধ করেছে। না খেলে সে আগামী ক্যাটল শো—তে দাঁড়াবে কি করে? অতএব ইওর অনার, দয়া করে মোটা জামিন নিয়ে আসামীকে এক মাসের জন্যে ছেড়ে দিন, প্রদর্শনী শেষ হলেই সে জেলে ঢুকবে। কিন্তু হাকিমটি অত্যন্ত একগুঁয়ে আর অবুঝ, কোনও আবদার শুনলেন না। তাই গোপীরাম এখন জেলে রয়েছে।
হংসেশ্বর পূর্বে বুঝতে পারেন নি যে মোষটা গোপীরামের এত নেওটা হয়ে পড়েছে। এখন তিনি অকূল পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছেন। গোপীরামের সহকারীরা কেউ ভয়ে এগোয় না, কাছে গেলেই রাজমহিষী গুঁতুতে আসে। শুধু হংসেশ্বরকে সে কাছে আসতে আর গায়ে হাত বুলুতে দেয়, কিন্তু তিনি খুব সাধাসাধি করেও তাকে খাওয়াতে পারলেন না।
হংসেশ্বরের এই সংকট শুনে বংশীধর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল। তিনি তখন এক ছড়া সিংগাপুরী কলা মোষের নাকের সামনে ধরে লোভ দেখাচ্ছেন আর খাবার জন্যে অনুনয় করছেন, কিন্তু মোষ ঘাড় ফিরিয়ে নিচ্ছে।
বংশীধর বলল, কাকাবাবু, আমি কোনও সাহায্য করতে পারি কি?
হঠাৎ বংশীধরের মাথায় একটা মতলব এল। হংসেশ্বরের কাছ থেকে সরে এসে সে গোপীরামের সহকারীদের সঙ্গে কথা কয়ে রাজমহিষী সম্বন্ধে অনেক খবর জেনে নিল। তার পরদিন ভোরের ট্রেনে সে বর্ধমান জেলে গোপীনাথের সঙ্গে দেখা করতে গেল। তার উদ্দেশ্য শুনে জেলার খুশী হয়ে অনুমতি দিলেন।
রাধানাথপুরে ফিরে এসেই হংসেশ্বরের কাছে গিয়ে বংশীধর বলল, কাকাবাবু, ভাববেন না, আপনার মোষ যাতে খায় তার ব্যবস্থা আমি করছি।
হংসেশ্বর বললেন, ব্যবস্থাটা কি রকম শুনি? তুমি ওকে খাওয়াতে গেলেই তো গুঁতিয়ে দেবে।
—আমি নয়, আপনিই ওকে খাওয়াবেন। গোপীরামের সঙ্গে দেখা করে আমি সব হদিস জেনে নিয়েছি। ব্যাপার হচ্ছে এই। —মোষটাকে খাওয়াবার সময় গোপীরাম তার গায়ে হাত বুলিয়ে একটা গান গাইত। সেই গানটি না শুনলে রাজমহিষীর আহারে রুচি হয় না।
—এ তো বড় অদ্ভুত কথা।
—আজ্ঞে, রুশ বিজ্ঞানী প্যাভলভ একেই বলেছেন, কণ্ডিশণ্ড রিফ্লেক্স। আপনাকে গানটি শিখে নিতে হবে।
হংসেশ্বর বললেন, গান—টান আমার আসে না। যাই হোক, গানটা কি শুনি?
বংশীধর বলল, কাকাবাবু, আমারও একটা কণ্ডিশন আছে। আগে কবুল করুন—মোষ যদি আগের মতন খায় তবে আমাকে খুব মোটা বকশিশ দেবেন।
—কি চাও তুমি? চকোরীর সঙ্গে বিয়ে?
—চকোরীর কথা পরে হবে। আপনার তিনখানা বাড়ি আমাকে দেবেন, ব্রার্বোন রোডের সেই আটতলাটা, চৌরঙ্গীর ছতলাটা, আর সাদার্ন অ্যাভিনিউ—এর তেতলাটা।
—ওঃ, তোমার আস্পর্ধা তো কম নয় ছোকরা! ওই তিনটে বাড়ি থেকে মাসে আমার প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার আসে তা জান?
—আজ্ঞে জানি বইকি। কিন্তু ওর কমে তো পারব না কাকাবাবু। ওই আয় যখন আমার হবে তখন চকোরীর সঙ্গে বিয়ে দিতে আপনার আর আপত্তি থাকবে না। আপনারও কিছু সুবিধে হবে, ইনকম ট্যাক্স আর ওয়েলথ ট্যাক্স কম লাগবে।
—তুমি এত বড় শয়তান তা জানতুম না। যাই হ’ক, যখন অন্য উপায় নেই তখন তোমার কথাতেই রাজী হলুম। রাজমহিষী যদি পেট ভরে খায় তবে তোমাকে ওই তিনটে বাড়ি দেব। কিন্তু যদি না খায় তবে তুমি এ বাড়ির ত্রিসীমায় আসবে না।
—যে আজ্ঞে।
—কথা তো দিলুম, এখন গানটা কি শুনি?
—আজ্ঞে, শোনাতে লজ্জা করছে, গানটা ঠিক ভদ্র সমাজের উপযুক্ত নয় কিনা। কিন্তু অন্য উপায় তো নেই, আমার কাছেই আপনাকে শিখে নিতে হবে। গোপীরামের গানটা হচ্ছে—
সোনামুখী রাজভঁইসী পাগল করেছে
জাদু করেছে রে হামায় টোনা করেছে।
ঝমে ঝমে ঝঁয় ঝঁয়, ঝমে ঝমে ঝঁয়।
—ও আবার কি রকম গান?
—গানটার একটু ইতিহাস আছে। গোপীরাম আগে দারভাঙ্গায় থাকত। সেখানে একটা পাগল বাঙালীদের বাড়ির সামনে ওই গানটা গাইত, তবে তার প্রথম লাইনটা একটু অন্য রকম—সোনামুখী বাঙালিনী পাগল করেছে। এই গান শুনলেই বাড়ির লোক দূর দূর থেকে পাগলটাকে তাড়িয়ে দিত। গোপীরাম সেই গানটা শিখে এসেছে, শুধু বাঙালিনীর জায়গার রাজভঁইসী করেছে। আপনি আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইতে শিখুন, আজ রাত দশটা পর্যন্ত রিহার্সাল চলুক।
অত্যন্ত অনিচ্ছায় রাজী হয়ে হংসেশ্বর গানটা শেখবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
বংশীধর বার বার সতর্ক করে দিল—রাজমহিষী নয় কাকাবাবু, বলুন রাজভঁইসী, আমায় নয়, বলুন হামায়। উচ্চারণটা ঠিক গোপীরামের মতন হওয়া দরকার। হাঁ এইবার হয়ে এসেছে। আর ঘণ্টাখানিক গলা সাধলেই সুরটি আয়ত্ত হবে।
সকাল বেলা হংসেশ্বর বললেন, দেখ বংশী, রাজমহিষীকে খাওয়াবার সময় তুমি আমার পিছনে থেকে প্রমট করবে, আমার সঙ্গে থাকলে তোমাকে গুঁতিয়ে দেবে না। আর একটা কথা—শুধু তুমি আর আমি থাকব, আর কেউ থাকলে আমি গাইতে পারব না।
বংশীধর বলল, ঠিক আছে, অন্য কারও থাকবার দরকারই নেই।
দু বালতি রাজভোগ বংশীধর রাজমহিষীর জন্যে বয়ে নিয়ে গেল, হংসেশ্বর তা গামলায় ঢেলে দিলেন। বংশীধর পিছনে গিয়ে বলল, কাকাবাবু, এইবার গানটা ধরুন।
মোষের পিঠে হাত বুলুতে বুলুতে হংসেশ্বর মধুর স্বরে বললেন ; লক্ষ্মী সোনা আমার, পেট ভরে খাও, নইলে গায়ে গত্তি লাগবে কেন, দুধ আসবে কেন, সেই মুলতানীটা যে তোমাকে হারিয়ে দেবে। হঁ হঁ হঁ—
সোনামুখী রাজভঁইসী পাগল করেছে,
জাদু করেছে রে হামায় টোনা করেছে—
মোষ ফোঁস করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল। বংশীধর ফিসফিস করে বলল, থামবেন না কাকাবাবু, বেশ দরদ দিয়ে বারবার গাইতে থাকুন, শেষ লাইনের সুরে ভুল করবেন না, ঝমে ঝমে ঝঁয় ঝঁয় ঝমে ঝমে ঝঁয়—নিনি ধাপপা পা মা মাগগা গা রে সা।
তাল—মান—লয় ঠিক রেখে হংসেশ্বর তিনবার গানটা শেষ করলেন, তারপর চতুর্থবার ধরলেন—সোনামুখী রাজভঁইসী ইত্যাদি।
সহসা মোষ মাথা নামিয়ে গামলায় মুখ দিল। তারপর সেই নির্জন প্রাঙ্গণের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে মৃদু মন্দ আওয়াজ উঠল—চবৎ চবৎ চবৎ। রাজমহিষী ভোজন করছেন।
পরবর্তী ঘটনাবলী সবিস্তারে বলবার দরকার নেই। পনরো দিনের মধ্যেই রাজমহিষীর বপু গজেন্দ্রাণীর তুল্য হল, গায়ে স্বল্প লোমের ফাঁকে ফাঁকে নিবিড় আলতা, কালির রঙ ফুটে উঠল, বিপুল পয়োধর থেকে প্রত্যহ পঁচিশ সের দুধ বেরুতে লাগল। পশ্চিমবঙ্গ—গবাদি—পশু—প্রদর্শনীতে সে মহিম বাঁড়ুজ্যের মুলতানী এবং অন্যান্য প্রতিযোগিনীদের অনায়াসে হারিয়ে দিল। রাজ্যপাল তার গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দিলেন, কৃষিমন্ত্রী সন্তর্পণে এক ছড়া রজনীগন্ধার মালা তার গলায় পরিয়ে দিলেন। রাজমহিষী প্রসন্ন হয়ে সেই অর্ঘ্যটি গ্রহণ করে চিবুতে লাগল।
বংশীধরের নতুন আবদার শুনে হংসেশ্বর বললেন, আবার চাকরির শখ হল কেন? আমার বুকে বাঁশ দিয়ে তো যত পেরেছে বাগিয়ে নিয়েছ।
বংশীধর বলল, আজ্ঞে, একটা ভাল পোস্ট না পেলে সে আমার সেলফ—রেসপেক্ট থাকবে না। লোকে বলবে, ব্যাটা শ্বশুরের বিষয় পেয়ে নবাবি করছে।
১৮৭৯ শক (১৯৫৭)
(একটি ইংরেজি গল্পের প্লটের অনুসরণে। লেখকের নাম মনে নেই।)