রাজকন্যা – ৫

সেই দিন থেকে ঠিকাদার সুজনলালকে লুধিয়ানা জেলায় কেউ আর দেখতে পায়নি।

গোপনে খবর নিয়েছিল তার নামে সেখানে পুলিশের হুলিয়া বেরিয়েছে কিনা। কিন্তু আশ্চর্য, পুলিশ কোনও সাড়াশব্দই করেনি। তবে কি মাহিন্দার সিং কিছু জানায়নি পুলিশকে? খুঁজে পায়নি তার ফেলে আসা শোলাহ্যাট? হবেও বা।

যাক, নিশ্চিন্ত হল সুজনলাল।

আরও কিছুকাল পরে সে খবর পেল একচোখো মাহিন্দার তাকে খুঁজছে। পুলিশের কাজাটা সে নিজের হাতেই তুলে নিয়েছে। মাহিন্দারের খাওয়া নেই, ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই, দিনের পর দিন সে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দুনিয়ায় কাউকে তার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু একজনকে। সে ঠিকাদার সুজনলাল।

শুনে সে হেসেছিল। দুনিয়াটা তো লুধিয়ানা জেলা নয়। অনেক বড়। অনেক মানুষের ভিড় এখানে। সে—ভিড়ে একটা মাত্র চোখের দৃষ্টি দিয়ে কোথায় তাকে খুঁজে পাবে মাহিন্দার?

কিন্তু কানপুর শহরের বাজারে ফল কিনতে গিয়ে একদিন চমকে উঠেছিল সুজনলাল। দূরে দাঁড়িয়ে একমাথা রুক্ষ চুল, মুখময় দাড়ি গোঁফ, আধবুড়ো একটা পাগলা গোছের লোক তাকে দেখছে।

সুজনলাল চমকে উঠেছিল লোকটার একটা চোখ কানা দেখে।

সেই রাতেই সে কানপুর ছাড়ে।

তারপর আবার এই রাজনগরে। কে জানত শিকারি কুকুরের মতোই গন্ধ শুঁকে শুঁকে মাহিন্দার এই রাজনগরেও এসে হাজির হবে? সুজনলালের গায়ে কি লালীর রক্তের গন্ধ এখনও লেগে আছে? পাঁচ বছর আগে যা চুকে—বুকে গেছে, কে আশা করেছিল আজও তার জের চলবে?

কুত্তার বাচ্চচা! বিড়বিড় করে উঠল সুজনলাল।

হঠাৎ একটা হিমস্রোত শিরশির করে নেমে গেল সুজনলালের মেরুদণ্ড বেয়ে। ভয়টা অবশ্য কানা মাহিন্দরকে নয়। লুধিয়ানা জেলার বোকা বুড়ো পল্টনকে সে থোড়াই কেয়ার করে। তারচেয়ে সে অনেক সেয়ানা। ভয় তাকে নয়, পুলিশকে। পাগলা মাহিন্দার নিজে তাকে ধরতে না পেরে পুলিশকে যদি জানিয়ে দেয়। এসেছে যখন, একটা কিছু করবেই সে। মরা লালীর শোকে সে খ্যাপা জানোয়ার হয়ে আছে। একটু সুযোগ পেলে চোট সে দেবেই।

অতএব—

সুজনলাল বিড়বিড় করে বলে উঠল, রাজনগর থেকে তোমার তাঁবু ওঠাও সুজনলাল। দেরি কোরো না, রাতারাতি সরে পড়ো।

কিন্তু ইরা? এতদিন আশায়—আশায় কাটিয়ে এমনিই ফিরে যেতে হবে? আফশোস করে লাভ নেই। দুনিয়ার বাগিচায় আরও অনেক ইরা—গোলাপ ফুটে আছে। নসিবে থাকলে একটা—না—একটা মিলে যাবেই।

পচাইয়ের বোতলটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে আবার ছুঁড়ে ফেলে দিলে সুজনলাল। খালি হয়ে গেছে। হোকগে, নতুন জায়গায় নতুন করে ভরে নেবে সে। কিন্তু রাজনগরে আর নয়—আর একটা রাতও নয়।

তাই বলে কি খালি হাতে ফিরে যাবে সে? রাজনগর থেকে কি কিছুই নেওয়ার নেই—কোনও ধন—দৌলত? ভাবতে ভাবতে সুজনলালের কটা চোখ আবার চকচক করে উঠল।

আছে বইকি। অনেক দামি দৌলত পড়ে আছে মাটির তলায়। তাই নিজেই সুজনলাল রাজনগরকে আজ সেলাম জানাবে।

 * * *

.

টাইপ—রাইটার মেশিনের আওয়াজ যখন বন্ধ হল, রাত তখন অনেক হয়েছে।

রাজনগরের এই লুপ্তোদ্ধার সম্পর্কে দীর্ঘ রিপোর্ট ছাপা শেষ করলেন অধ্যাপক প্রতাপ। এই রিপোর্ট কলকাতায় পরামর্শ—কমিটির কাছে পাঠাতে হবে। আর পাঠাতে হবে মৃতদেহ সমেত পেটিকা দুটি। আজ সারাদিন ধরে তারই তোড়জোড় করেছেন তিনি। শুধু মৃতদেহ দুটিই বহুমূল্য নয়, স্বাতীর গায়ে বহুমূল্য রত্নালঙ্কারও আছে। তাই সশস্ত্র পাহারায় পাঠাবার ব্যবস্থা হয়েছে। কুশলনগরের মাটি ছেড়ে সেনাপতি ধীমান ও রাজকুমারী স্বাতী আগামী কালই চলে যাবে আধুনিক কলকাতার যাদুঘরে।

এর ফলে সত্যিই কোনও বিপদ ঘটবে কিনা কে জানে! তন্ত্রসাধনার অলৌকিক কাণ্ড সম্বন্ধে কতটুকুই বা জানেন প্রতাপবাবু! তবু তাঁর বিচলিত মন খানিকটা স্বস্তি বোধ করছে। পেটিকা দুটি স্থানান্তরিত হলে ইরার ওপর থেকে তাদের অশুভ প্রভাব হয়তো কেটে যেতেও পারে।

রাজনগরের এই লুপ্তোদ্ধারের ফলে তাঁর গলায় হয়তো যশের মালা দুলবে, ভাবীকালের ইতিহাস হয়তো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতাপ সেন মজুমদারের নাম শ্রদ্ধাভরেই স্মরণ করবে, কিন্তু এসব তো তিনি তাঁর কন্যার শুভাশুভের বিনিময়ে চাননি। প্রত্নতাত্ত্বিকের চেয়ে যে পিতা বড়!

রিপোর্টের কথা ভুলে একমাত্র কন্যার শুভ কামনায় তাঁর পিতৃহৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠল। পেটিকা দুটি চলে গেলে ইরাকেও তিনি মীরাটে তাঁর বোনের ওখানে পাঠিয়ে দেবেন। তারপর একটা শুভ দিন দেখে প্রিয়তোষের হাতে তুলে দেবেন তাঁর আদরিণী কন্যাকে। এ ইচ্ছা তাঁর আজকের নয়, অনেক দিনের।

প্রিয়তোষ এখন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলে হয়। মাথার চোটটা তার গুরুতর না হলেও খুব সামান্যও নয়। কী অশুভ ক্ষণেই তিনি রাজনগরে পা দিয়েছিলেন। এক বিপদ কাটতে না কাটতে কোথাকার এক পাগলের উৎপাত! কিন্তু আকস্মিক বিপদের ওপর কারই বা হাত আছে! সকল বিপদের আসান যিনি, তাঁরই ওপরে ভরসা করে থাকা ছাড়া আর উপায় কী!

টাইপ—রাইটার মেশিনটা বন্ধ করলেন অধ্যাপক। রিপোর্টের ছাপা কাগজগুলো ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখলেন। তারপর জুয়েল—ল্যাম্প নিভিয়ে লাইব্রেরির দরজা বন্ধ করে বারান্দা দিয়ে এগোলেন। আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ালেন ইরার ঘরের খোলা জানলার সামনে। অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে মৃদু গভীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ইরা তাহলে ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজা ঠেলে দেখলেন বন্ধ। ভেতর থেকে জয়া তালা দিয়েছে নিশ্চয়।

যাক, এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে পারবেন তিনি।

.

কুহকিনী রাত্রি আবার ডাকছে। কিন্তু ইরা জানে, রাত্রি নয়, ডাকছে ধীমান। বহু যুগের ওপার থেকে সে ডাক ভেসে আসছে। সেই একই কথা, সেই একই আকুলতা।

ধীমান বলছে, রাজকুমারী স্বাতী! ইতিহাস ভুলেছে, কাল ভুলেছে, তুমিও কি ভুলেছ আমাকে? আর কত দিন, কত যুগ তোমার অপেক্ষায় থাকব? তুমি কি আসবে না স্বাতী?

না, ইরা আজ শুনবে না ওই ডাক। প্রিয়তোষের হাতে হাত রেখে আজই বিকেলে সে শপথ করেছে, আর ভাববে না ওসব কথা। কবেকার কোন ধীমান কাকে ভালোবেসেছিল, তা নিয়ে ইরার মাথাব্যথা কেন? সে প্রেম তো কবে মরে গছে। নব—নব জীবন—জোয়ারের পলিমাটির তলায় কবে সমাধি হয়ে গেছে তার। তবে আর কেন মৃত প্রেমের স্বপ্ন দেখা? সে তো রাজকুমারী স্বাতী নয়, সে শুধু ইরা—প্রিয়তোষের ইরা। যে প্রেম প্রিয়তোষের রূপ ধরে তার জীবনে এসেছে, তাকে ভুলে কেন সে মরা প্রেমের কাছে বারবার ছুটে যাবে?

মনকে শক্ত করলে ইরা।

কিন্তু ডাক তো থামে না। এ যেন অনন্তকালের ডাক, অনন্ত প্রেমের ডাক। জন্ম—জন্মান্তরেও যে প্রেমের মৃত্যু নেই, ক্ষয় নেই।

তেমনি আকুলতা, তেমনি তৃষ্ণা নিয়ে বহু দূর থেকে ডাক আসছে, রাজকুমারী স্বাতী। কত বর্ষা গেল, কত বসন্ত গেল, তবু এলে না তুমি। কত আর ডাকব তোমায়! সেই সরোবরে নৌবিহার—সেই মালঞ্চে অধর ছুঁয়ে অঙ্গীকার—একই বিষে দুজনের সেই মরণ—বাসর—সবই কি ভুলেছ তুমি?

ইরার গায়ে সহসা কাঁটা দিয়ে উঠল। না, না, সে ভোলেনি—কোনও জন্মেও ভুলতে পারবে না। সে তো ইরা নয়, সে যে কুশলনগরের রাজকুমারী স্বাতী। ধীমানের প্রেম তার জীবনে ধ্রুবতারা। কেমন করে সে ভুলবে, কেমন করে সে থাকবে ধীমানের ডাকে সাড়া না দিয়ে?

ইরার সমস্ত অন্তরাত্মা তেমনি আকুলতা নিয়ে বলতে লাগল, যাই ধীমান, যাই। জন্ম—জন্মান্তর ধরে আমিও যে তোমার ডাকের অপেক্ষায় ছিলাম। আর দেরি হবে না ধীমান।

বিছানার ওপর উঠে বসল ইরা। রাশি—রাশি শ্বেত ধূমকুণ্ডলী আর সেই অপূর্ব সুগন্ধে ছেয়ে গেছে ঘরের অন্ধকার। হাত বাড়িয়ে সে তুলে নিল সেই মায়া—ধূপদানি! তারপর বিছানা থেকে নেমে চলতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে পড়ল দরজায় তালা। কী করবে সে এখন? কী করে যাবে? ইরা একবার তাকাল জয়ার দিকে। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। আস্তে আস্তে সে হাত চালিয়ে দিল জয়ার বালিশের নিচে। এই তো রয়েছে চাবি!

চাবি দিয়ে দরজার তালা খুলে ফেললে ইরা। তারপর সাপুড়িয়ার বাঁশি শোনা সাপিনীর মতো দ্রুত লঘু গতিতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে!

পুরানো কাঠের বাংলোর কোন খোপরে বহুপ্রাচীন একটা তক্ষক ডেকে উঠল।

কৃষ্ণপক্ষ পার হয়ে শুক্লপক্ষ পড়েছে। উচু—নিচু প্রান্তর ঝিমঝিমে চাঁদের আলো আর কুয়াশায় মাখামাখি। বুকের কাছে মায়াধূপদানিটি ধরে ইরা সোজা এগিয়ে চলেছে। ডাকিনী রাত্রি যেন মন্ত্রবলে তাকে টানছে। পায়ে—চলা পথের দু’পাশে বুনো আগাছার ঝোপে ঝোপে সরসর মরমর শব্দ হচ্ছে, প্রথম হেমন্তের শিশিরে ভিজে যাচ্ছে শাড়ির প্রান্ত। ভীম পাহাড়ের জঙ্গলে ডাকছে ফেউ, শোনা যাচ্ছে হায়েনার হাসি।

কোনও দিকেই খেয়াল নেই ইরার। জ্যোৎস্না আর কুয়াশায় মাখামাখি শূন্য প্রান্তরের বুকে তার সরল সুঠাম মূর্তি সোজা এগিয়ে চলেছে। হাওয়ায় উড়ছে চুল, পাথুরে মাটিতে পায়ে পায়ে লাগছে হোঁচট, স্ফলিত আঁচল লুটোচ্ছে পেছনে—পেছনে।

স্বপ্নাচ্ছন্ন দুই চোখের দৃষ্টি সামনে মেলে ইরা তবু এগিয়ে চলেছে।

অনন্ত বিরহ যেন যাত্রা করেছে অনন্ত মিলনের প্রত্যাশায়।

.

এক মুহূর্তের জন্যে চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল মহাবল সিংহের। তারপরেই সেলাম করে উঠে দাঁড়াল। বললে, মেমসাব, আপ!

কোনও জবাব না দিয়ে ইরা ভূগর্ভের সিঁড়ির মুখে এগিয়ে গেল। কিরীচ লাগানো বন্দুকের নলটা বাড়িয়ে পথ আটকাল মহাবল। সসন্ত্রমে বললে, অন্দর যানা মানা হ্যায় মেমসাব। বড়ে হুজুরকা অর্ডার।

রানির মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকাল ইরা। রানির মতোই কঠিন স্বরে আদেশ করলে, পথ ছাড়ো।

মাফ কিজিয়ে।

চিৎকার করে উঠল ইরা, আমার হুকুম পথ ছাড়ো।

জী নেহি। মহাবল তেমনি অটল।

ইরার দুই চোখে আগুন খেলে গেল। কিরীচ—লাগানো বন্দুকের নলটা হাত দিয়ে ঠেলে দৃঢ় পদক্ষেপে ইরা নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে।

কয়েক সেকেন্ডের জন্যে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল মহাবল সিং। তারপর হঠাৎ ছুটল যে পথে ইরা এসেছে সেই পথে।

ধাপে—ধাপে স্খলিত আঁচল লুটিয়ে নিচে নেমে এল ইরা। সেই বিচিত্র পাথরের নীলাভ আলোয় ভরে আছে চত্বরটা। মানুষের পায়ের আওয়াজে পাখা ঝটপটিয়ে চত্বরের এ—কোণ থেকে ও—কোণে উড়ে গেল একটা ভীত বাদুড়। এ—দেয়াল থেকে ও—দেয়ালের ফাটলে সেঁধিয়ে গেল একটা পাহাড়ি চন্দ্রবোড়া।

ইরার দেহ এতটুকু কাঁপল না। শান্ত পায়ে সে এসে দাঁড়াল। ধীমানের পেটিকার পাশে। খুলে ফেলল ডালা। তেমনি অনন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে আছে ধীমান, প্রশস্ত বুকে রক্তবর্ণ খড়গচিহ্ন, আধ—খোলা চোখের তারাদুটি স্থির, পাংশু ঠোঁট দু’খানা অল্প খোলা—যেন এইমাত্র ডাকছিল স্বাতীকে।

দেখতে—দেখতে মধুর আবেশ কোমল হয়ে এল ইরার মুখ। ঠোঁটের কোনায় ফুটি ফুটি করে ফুটে উঠল প্রেম, লজ্জা আর ব্যথায় মেশানো অপরূপ এক হাসি। শবের ওপরে ঈষৎ ঝুঁকে, প্রাণের সমস্ত আবেগ ঢেলে ইরা বলতে লাগল, আমি এসেছি ধীমান, জন্ম—জন্মান্তর পার হয়ে আমি তোমার কাছেই এলাম। তুমি ডাকলে আমি তো না এসে থাকতে পারি না। ওঠো, ওঠো ধীমান—স্বাতী এসেছে, তার মুখে পানে চাও, অভিমান করে থেকো না—কথা বলো।

বলতে—বলতে ভারি হয়ে এল ইরার গলার আওয়াজ। টলটল করে উঠল তার অপলক চোখের কোণে তরল মুক্তো। সব কথা হারিয়ে গেল গভীর আবেগের অতলে।

হঠাৎ চমকে উঠল ইরা। এক ধাক্কায় কে যেন তাকে স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে দিল। পাথরের সিঁড়িতে কার পায়ের আওয়াজ হচ্ছে। কে যেন নেমে আসছে নিচে।

আচমকা একটা ভয় এসে জড়িয়ে ধরল ইরাকে। সিঁড়ি দিয়ে যে নেমে আসছে, সে কে? এই গভীর রাতে এখানে তার কী প্রয়োজন? ইরাকে দেখতে পেলে সে কি ভাববে?

চকিতে একবার সিঁড়ির দিকে তাকাল ইরা। পায়ের আওয়াজ আরও কাছে আসছে।

হাতের ধূপদানিটা তাড়াতাড়ি শবদেহের বুকের ওপর নামিয়ে রেখে পেটিকার ডালাটা বন্ধ করে দিলে ইরা। তারপর লুটানো আঁচল কাঁধের ওপর তুলে নিমেষে সরে গেল একটা স্তম্ভের আড়ালে।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়ির কয়েকটা ধাপের ওপর দেখা দিল ঠিকাদার সুজনলাল।

সিঁড়ির শেষ ধাপে পা দিয়ে সুজনলাল একবার সতর্ক চোখে এদিক—ওদিক তাকাল। তারপর একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললে। এত সহজেই এখানে আসতে পারবে ভাবেনি সে। অনেক প্ল্যান করেছিল সে পাহারাদার মহাবল সিংয়ের চোখ এড়িয়ে আসার জন্যে। কিন্তু না, নসিব তার খুবই সুপ্রসন্ন। নইলে ঠিক এই সময়েই মহাবল সিং উধাও হয়ে যাবে কেন?

ক্ষিপ্র পায়ে সে এসে দাঁড়াল রাজকুমারী স্বাতীর পেটিকার পাশে। তারপর একটানে খুলে ফেললে ডালা।

স্তম্ভের আড়ালে নিশ্বাস রোধ করে দেখতে লাগল ইরা। আস্তে আস্তে তার ভয় কমে আসছে। তার বদলে একটা তীব্র সন্দেহ জাগছে মনে। এত রাতে ঠিকাদার এখানে কেন? রাজকুমারীর পেটিকা খুলে কী দেখছে সে? রাজকুমারীর চোখ—ঝলসানো রূপ?

না, সুজনলালের চোখ তার চেয়েও চোখ—ঝলসানো জিনিসের ওপর। স্বাতীর সর্বাঙ্গে রত্নালঙ্কার মৃদু নীলাভ আলোতেও ঝলমল করছে। কত দাম হবে ওই মণিময় কঙ্কণ দুটোয়? আর সিঁথিমৌর—এর ওই মস্তবড় হীরের টুকরোটা—যেটা কালকেউটের চোখের মতোই ঝিলিক দিচ্ছে—ওটা বোধ করি কোহিনুরের জোড়া।

লোভে চকচক করে উঠল সুজনলালের কটা চোখ। বিধাতা যাকে দেয়, তাকে ছপ্পড় ফুঁড়েই দেয়। ভেবেছিল এখান থেকে খালি হাতেই ফিরতে হবে, কিন্তু রাজনগর আজ তাকে রাজা বানিয়ে দিল।

লোলুপ হাত বাড়িয়ে সে শবের দেহ থেকে একে একে খুলতে লাগল মাথার সিঁথিমৌর, গলার রত্নহার, হাতের মণিময় কঙ্কণ। ব্যস, এখানকার কাজ শেষ হয়ে গেল তার। দেনা—পাওনা মিটে গেল রাজনগরের সঙ্গে। রাত ফুরোতে কতটুকুই বা বাকি, ভোরের ট্রেনেই হাওয়া দেবে সুজনলাল। দুনিয়ায় অগুনতি মানুষের ভিড়ে তাকে খুঁজে বার করবার সাধ্য কার। লালীর শোকের চিতা বুকে জ্বালিয়ে পুড়তে থাকুক একচোখা পাগলা মাহিন্দার। সুজনলাল তাকে কলা দেখাবে। প্রতাপবাবু স্যার পুলিশে খবর দেবে নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রমাণ? সুজনলাল কাঁচা কাজ করে না।

অলঙ্কারগুলো ধীরে—সুস্থে তার খাকি শার্টের বুক পকেটে ভরলে। তারপর বন্ধ করার জন্যে পেটিকার ডালাতে হাত দিতেই একটা তীক্ষ্ন আওয়াজ তার কানে এল, গয়নাগুলো রেখে যান!

মানুষের আওয়াজ পাওয়া বুনো জানোয়ারের মতোই চমকে ঘুরে দাঁড়াল সুজনলাল। দেখতে দেখতে তার চোখের আতঙ্ক মিলিয়ে গিয়ে বিস্ময় ফুটে উঠল। স্তম্ভের পাশে ঋজু ভঙ্গিতে ঘাড় বেঁকিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে, এত রাতে এই পাতালপুরীর গহ্বরে তাকে দেখবার কল্পনাও সে করেনি। ভালো করে চোখ মুছে তাকাল সুজনলাল, হ্যাঁ, ইরাই বটে।

দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সুজনলালের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, দেবীজী আপনি। আপনি এখানে কেন?

কঠিন গলায় ইরা বললে,—আপনার চুরি দেখতে। সাহস তো আপনার কম নয়!

বিনীত ভঙ্গিতে চিবিয়ে—চিবিয়ে সুজনলাল বললে, সাহস যে আমার একটু বেশিই, আপনি তো তা জানেন দেবীজী।

থামুন। গয়নাগুলো রেখে দিন আগে।

রাখব বলে নিইনি। গয়নাগুলো আমার পাওনা।

পাওনা।

পাওনা বইকি! একটা চাপা দম্ভের সঙ্গে সুজনলাল বললে, সুজনলালের হাতের মুঠোয় যা আসে, তাই তার পাওনা।

ইরার মুখ—চোখ আরও কঠিন হয়ে উঠল। চিৎকার করে ডাকল, মহাবল সিং!

সুজনলালের কালো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে সাদা দাঁতগুলো ঝিলিক দিল। বললে, মিছে ডেকে হয়রান হচ্ছেন। মহাবল থাকলে কি এখানে আসতে পারতাম? নেই।

নেই! এক পলকের জন্যে থতিয়ে গেল ইরা, তারপর হঠাৎ ছুটল সিঁড়ি লক্ষ্য করে। কিন্তু তার আগেই তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে সুজনলাল।

সরে দাঁড়ান। ইরা ধমক দিয়ে উঠল।

সুজনলাল এক চুলও নড়ল না। বাঁ—চোখটা ঈষৎ ছোট করে চিবিয়ে—চিবিয়ে বলতে লাগল, এত তাড়া কেন? রাত ভোর হতে এখনও ঢের বাকি। দু—দণ্ড নাহয় রইলে, দুটো কথা নাহয় কইলে দেবীজী। ক্ষতি কী?

ইরার মন জুড়ে এবার একটা নতুন ভয় দেখা দিতে লাগল, জগতে যে ভয়টা একমাত্র নারীর। তবু সাহসে ভর করে সে বললে, আপনার বেয়াদবি ক্রমেই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সুজনবাবু— যেতে দিন আমায়।

তেমনি অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে সুজনলাল বললে, দেব বইকি। কিন্তু তার আগে আমার পাওনাটা মিটিয়ে দাও।

কীসের পাওনা?

তোমার জওয়ানিয়।

মুখ লাল করে ইরা চিৎকার করে উঠল, বেয়াদব। তারপরই ঠাস করে একটা আওয়াজ হল সুজনলালের গালের ওপর।

সুজনলালের চোয়াল দুটো একবার মাত্র শক্ত হয়ে উঠেই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। কুৎসিত একটা হাসিতে সাদা সাদা দাঁতগুলো দেখা দিল পুরু কালো ঠোঁটের ফাঁকে। হাসতে—হাসতেই বললে, কী নরম তোমার হাত! যার হাতের স্বাদ এমন, তার গোটা দেহের স্বাদ না জানি কত মিঠা। বড় ইচ্ছে হচ্ছে একটু পেয়ার করতে। ভয় নেই, বেশি সময় নেব না আমি।

দাঁতে দাঁত চেপে ইরা বললে, জানোয়ার!

বুক—পকেটটা বাজিয়ে সুজনলাল বলতে লাগল, ভেবেছিলাম রাজনগরের দেনাপাওনা আমার মিটে গেল, এখন দেখছি পাওনার ওপরে ফাউ রয়েছে আমার কপালে। জড়োয়াগুলো দামি বটে, খুবই দামি, কিন্তু আমার কাছে তার চেয়েও দামি তুমি। তোমায় পেয়ার না করে কি ছেড়ে দিতে পারি দেবীজী?

এক—পা এক—পা করে সুজনলাল এগোতে থাকে, আর এক—পা এক—পা করে পিছু হঠতে থাকে ইরা। সুজনলাল দেখছে তাজা রক্তমাংসের সমারোহ, ইরা দেখছে একটা ক্ষুধিত নেকড়ে।

.

আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল প্রতাপবাবুর। বাইরে কে যেন ডাকছে,—হুজুর! হুজুর!

ধড়মড় করে উঠে বসলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, কে?

মহাবল সিং, হুজুর, জলদি বাহার আইয়ে।

দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন প্রতাপবাবু। এখনও রাত রয়েছে। বারান্দার নিচে পাপড়ি—পরা একটি মূর্তি বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে। কিরীচের ফলাটা অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। প্রতাপবাবুর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।

কী হয়েছে মহাবল?

এক নিশ্বাসে মহাবল বলে উঠল, মেমসাহেব চ্যলা গ্যায়ি হুজুর—মিট্টিকা নিচে উস কবরস্থান মে—মানা নেহি শুনা।

মেমসাব! মানে, ইরা!

জী। একেলি গ্যায়ি।

সদ্য—ঘুমভাঙা প্রতাপবাবুর মাথায় মধ্যে তালগোল পাকিয়ে গেল। তারপরেই হঠাৎ উদভ্রান্তের মতো ডাকতে লাগলেন, প্রিয়তোষ! প্রিয়তোষ! জয়া।

উঠতে গিয়ে প্রিয়তোষের মাথার ব্যান্ডেজে টান পড়ল। যন্ত্রণায় টনটন করে উঠল ঘাড় অবধি। তবু বেরিয়ে এল দ্রুত পায়ে।

ভীম পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রতাপবাবু ব্যাকুল ভাবে বললেন, ইরা ওখানে চলে গেছে প্রিয়েতোষ!

এক সেকেন্ড মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তোষ। তারপর এক ঝটকায় মহাবলের হাত থেকে বন্দুকটা নিয়ে দৌড়ল ভীম—পাহাড়ের দিকে।

জয়াকে নিয়ে প্রতাবাবুও ততক্ষণে মহাবলের সঙ্গে ফটক পার হয়ে পথে নেমে এসেছেন।

.

এক—পা এক—পা করে এগোচ্ছে সুজনলাল, আর এক—পা এক—পা করে পিছু হটছে ইরা।

সুজনলালের রক্তে টগবগ করে ফুটছে কামনার বিষ। আর, অসহ্য ঘৃণা ও ভয়ে পাক দিয়ে উঠছে ইরার দেহের প্রতিটি নাড়ি। হিম হয়ে আসছে ইরার দেহের শিরা—উপশিরা।

সুজনলাল বলছে, ওকি, অত নারাজ হচ্ছ কেন? আমিও তো প্রিয়তোষের মতো জোয়ান পুরুষ, জওয়ানির কদর আমিও জানি। দেখোই না জানি কিনা।

তাড়া—খাওয়া পশুর মতো পিছু হটতে হটতে ইরা যেখানে এসে দাঁড়াল, সেখানে আর পিছোবার জায়গা নেই। পেছনে তার শক্ত পাথরের দেয়াল, তারই অন্ধকার ফাটলের ভেতর থেকে ক্ষণে—ক্ষণে বেরিয়ে আসছে সুরু লকলকে একজোড়া জিব। ইরার সামনে সুজনলাল, পেছনে পাহাড়ি চন্দ্রবোড়া।

সুজনলালের মাংসলোলুপ চোখ দুটো উল্লাসে জ্বলছে। লালসার মদে জড়িয়ে এসেছে তার গলা। জড়িয়ে জড়িয়ে বললে—আর কষ্ট দিও না পেয়ারি। একবার পেয়ার করতে দাও তোমাকে—ব্যস, একটিবার।

দুঃসহ ঘৃণা আর ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল ইরা, খবরদার!

আঃ, কী হচ্ছে ইরা দেবী? এসো, কাছে এসো—

আর এগিয়ো না বলছি—

বেশ, তবে তুমিই এগিয়ে এসো পেয়ারি।

লুব্ধ হাত বাড়িয়ে ইরার একখানা হাত ধরে ফেললে সুজনলাল। আর সঙ্গে—সঙ্গেই চিৎকার করে উঠে তার হাতে দাঁত বসিয়ে দিলে ইরা।

কুৎসিত একটা গালাগালি দিয়ে হাতখানা টেনে নিল সুজনলাল। আর সেই সুযোগে সিঁড়ি লক্ষ্য করে ছুটল ইরা। কিন্তু সুজনলাল নেকড়ের মতোই চতুর আর ক্ষিপ্র। ইরার আগেই সে সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। চিৎকার দিয়ে ইরা আবার উল্টো দিকে ছুটল।

তারপর শুরু হয়ে গেল শিকার আর শিকারির খেলা। এ—কোণ, এ—স্তম্ভের পাশ থেকে ও—স্তম্ভের পাশে। একটা হিংস্র হায়না যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ভয়াতুরা একটা বনহরিণীকে। মানুষের পায়ের আওয়াজে আর ভীত চিৎকারে সেই বাদুড়টা আবার পাখা ঝটপটিয়ে চক্কর দিতে লাগল সারা চত্বরে।

মরিয়া হয়ে উঠেছে সুজনলাল। হাতের মুঠোয় এসে কোনও কিছুই ফসকে যায়নি তার জীবনে। পা টলছে, মাথা টলছে, কপালের রগ বেয়ে ঝরছে ঘাম, তবু দু’হাত বাড়িয়ে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ইরাকে। উঁচু—নিচু পাথরে ঠোক্কর খেয়ে তার শার্টের দুই পটেক থেকে ছিটকে ছিটকে পড়ছে চুরি—করা সিঁথিমৌর, কণ্ঠহার আর মণিময় কঙ্কণ।

হাঁফিয়ে পড়েছে ইরা। ভয়, উত্তেজনা আর ঘৃণার তাড়নায় সে অন্ধের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে একটা আদিম বন্য—বিভীষিকার হাত থেকে মুক্তি পাবার প্রাণপণ ব্যাকুলতায়।

কিন্তু হল না। একটা স্তম্ভের পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে মেঝের আলগা পাথরে পা পড়ে গেল ইরার। পড়ে যাবার আগেই ঘামে ভেজা বলিষ্ঠ দুই হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেললে সুজনলাল। জালে পড়া পাখির মতোই ছটফট করতে করতে বিহ্বল আতঙ্কে ইরা গলা চিরে ডেকে উঠল, ধীমান—আমাকে বাঁচাও ধীমান—বাঁচাও আমাকে—

ইরার সেই ডাক পাথরের খিলানে খিলানে মাথা কুটে কাঁদতে লাগল। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না বহু শতাব্দীর সেই প্রাচীন বন্ধ কাঠের পেটিকার গর্ভ থেকে।

অন্ধ আকুল বিশ্বাসে ইরা আবার চিৎকার করে উঠল, ধীমান—ওঠো—বাঁচাও আমাকে—

তবু কোনো সাড়া এল না বন্ধ অন্ধ পেটিকা থেকে। শব শুধু শব হয়েই রইল, জাগল না। চামুণ্ডা—সাধক তান্ত্রিক দর্ভপাণির সমস্ত তন্ত্র—মন্ত্র বিংশ শতাব্দীর হাওয়ার স্পর্শে মিথ্যে হয়ে গেল।

লালসাসিক্ত দুই হাত দিয়ে ইরাকে তখন বুকের ওপর টেনে নিয়েছে সুজনলাল।

মরণান্তিক যন্ত্রণা আর ঘৃণায় ইরার গা পাক দিয়ে উঠল। সমস্ত শক্তি একত্র করে ইরা এবার চিৎকার করে কেঁদে ডাকল, প্রিয়তোষ!

পাথরের খিলানে খিলানে ধাক্কা খেয়ে এক ইরার কান্না শত ইরার কান্না হয়ে ডাকতে লাগল, প্রিয়তোষ! প্রিয়তোষ! প্রিয়তোষ!

উত্তরে পাখা ঝটপটিয়ে উঠল ভীত বাদুড়, ডেকে উঠল প্রাচীন তক্ষক।

তারপরেই সব চুপ।

অসাড় হয়ে গেছে ইরার দেই। সুজনলালের লোভী কুৎসিত মুখখানা নেমে এল ইরার রক্তহীন ঠান্ডা মুখের ওপর।

হঠাৎ সেই অস্বাভাবিক স্তব্ধতাকে টুকরো টুকরো করে অনেকগুলি গলার মিলিত ডাক শোনা গেল, ইরা! ইরা!

চকিতে ফিরে তাকাল সুজনলাল। আর, তার শিথিল আলিঙ্গন থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল ইরার সংজ্ঞাহীন দেহ।

সিঁড়িতে দ্রুত পায়ের আওয়াজ করে নেমে এল রাইফেল হাতে প্রিয়তোষ আর তার পেছনে পেছনে প্রতাপবাবু, জয়া, মহাবল সিং।

প্রিয়তোষ আর সুজনলাল এক মুহূর্ত পরস্পরকে দেখলে। কিন্তু সে বোধ হয় এক মুহূর্তও নয়। নিমেষে প্রিয়তোষের হাতের রাইফেলের মুখ ঘুরে গেল সুজনলালের দিকে। কিন্তু ঘোড়া টিপবার আগেই সুজনলালের দিক থেকে টুকরো বিদ্যুতের মতো চকচকে ফলাওলা একটা ছুরি ছুটে এল প্রিয়তোষের দিকে।

ডান দিকে এক—পা সরে যেতে গিয়ে প্রিয়তোষ লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। রাইফেলের গুলিটা পাথরের স্তম্ভে একটু চিড় খাইয়ে দিল মাত্র।

সুজনলাল এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ল না। চোখের পলকে তার দেহটা সিঁড়ির ওপরে অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত হতচকিত হয়ে রইল সবাই। প্রিয়তোষ পর্যন্ত। তারপর তীর বেগে উঠে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

ভীম পাহাড়ের আড়ালে চাঁদ ডুবে যাচ্ছে। উঁচু—নিচু পাথুরে ঢিবির আড়াল থেকে ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে আসছে জমাট অন্ধকারের দল। ভূগর্ভের বাইরে এসে প্রিয়তোষ এদিক—ওদিক তাকালে। দুই চোখে তার শিকারির দৃষ্টি অস্পষ্ট অন্ধকার ভেদ করে শিকারকে খুঁজতে লাগল। ওই—ওই তো সুজনলাল! বাঁ দিকের ওই ঢিবির পাশ দিয়ে তাড়া খাওয়া নেকড়ের মতো পালাচ্ছে।

চিৎকার করে উঠল প্রিয়তোষ,—খবরদরা! পালালেই গুলি করব।

শেষ কথাটা প্রতিধ্বনি লুফে নিলে, গুলি করব! গুলি করব! গুলি করব!

থমকে দাঁড়াল পলাতক সুজনলাল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে উঁচু ঢিবির ওপর থেকে একটা জানোয়ারের ছায়ামূর্তি লাফিয়ে পড়ল তার ঘাড়ে। কিন্তু না, জানোয়ার নয়। সুজনলালের মরণান্তিক চিৎকারকে ডুবিয়ে দিয়ে যে উন্মাদ অট্টহাসির রোলে শেষরাত্রির আকাশ—বাতাসকে কাঁপিয়ে তুলল, সে হাসি জানোয়ারের নয়, মানুষের।

সাত ব্যাটারির টর্চ হাতে বিভ্রান্ত প্রতাপবাবু ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে পাগলের মতো বিলতে লাগলেন, কী হল প্রিয়তোষ? কী হল? কী হল?

ঢিবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রিয়তোষ সেই দিকে ছুটল। সঙ্গে সঙ্গে প্রাতাপবাবুও।

সাত ব্যাটারি টর্চের আলোয় দেখা গেল, পাথুরে মাটির ওপর পড়ে আছে সুজনলালের দেহ। আর তার বুকের ওপর বসে তখনও হাঁপাচ্ছে এক অদ্ভুত মূর্তি। মোটা—মোটা হাড়ওয়ালা দীর্ঘ শুকনো দেহ, মাথায় জটবাঁধা কাঁচা—পাকা রুক্ষ চুল, মুখময় দাড়ি গোঁফ, আর পরনে ছেঁড়া কুর্তা আর চোস্ত পায়জামা। তার দুই হাতের শক্ত কঠিন আঙুলগুলো সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেছে সুজনলালের গলা।

আতঙ্কে প্রতাপবাবু বলে উঠলেন, সুজনলাল মরে গেল?

জী হাঁ, খতম!—অদ্ভুত চেহারার লোকটা মুখ ফিরিয়ে বলল। লোকটার একটা চোখ কানা, আর একটা চোখে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। দাড়ি—গোঁফ ভেদ করেও তার মুখে ফুটে উঠেছে পরম তৃপ্তির হাসি। বললে, পাঁচ বছর ধরে এরই অপেক্ষায় ছিলাম বাবুজী।

সবিস্ময়ে প্রতাপবাবু বললেন, তুমি—

লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে মিলিটারি কায়দায় একবার স্যালুট করল। তারপর বললে, সিপাহী মাহিন্দার সিং।

মাহিন্দার সিং দু—পা এগোতেই প্রিয়তোষ তার হাত চেপে ধরে বললে, কোথায় যাচ্ছ?

শান্ত গলায় মাহিন্দার সিং জবাব দিলে, থানায়। থানা থেকে ফাঁসিকাঠে। সেখান থেকে লালীর কাছে।

তারপর এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে হা—হা করে হাসতে হাসতে শেষরাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

প্রিয়তোষ ফিরে চলল ইরার কাছে। আর, অধ্যাঢ়াপক আকের বার টর্চের আলো ফেললেন মৃত সুজনলালের মুখে। পাতা—খোলা আতঙ্কিত চোখের তারা দুটো বীভৎসভাবে ঠেলে বেরিয়ে আসছে। সে তারার রঙ পিঙ্গল।

অধ্যাপকের মনে পড়ে গেল তান্ত্রিক দর্ভাপাণির শেষ কথাগুলি, ‘স্বাতীর হত্যাকারী পিঙ্গলচক্ষু অশনি পৃথিবীর যেখানেই জন্মান্তর গ্রহণ করুক না কেন, তুমি তার দুষ্কৃতির প্রতিশোধ নিও ধীমান।’

দুর্ভাগা সুজনলালই কি সেই অশনি? কে জানে! অস্ফুট স্বরে অধ্যাপক বলে উঠলেন, দর্ভপাণির আত্মা হয়তো আজ তৃপ্ত হল।