রাজকন্যা – ৪

ঘুমও নয়, জাগরণও নয়, দুইয়ের মাঝামাঝি একটা বিচিত্র অবস্থা। তারই মাঝে ইরার চেতনা সেই মিশ্র সৌরভে আবিষ্ট হয়ে পড়ল। ফুলের নয়, চন্দনের নয়, মৃগনাভিরও নয়, অথচ কেমন একটা মিশ্র অপার্থিব সুগন্ধ। সেই সুগন্ধের প্রভাবে আস্তে—আস্তে তার অবচেতনার দ্বার যেন খুলে গেল। বহুদূরসন্ধানী আলোর রশ্মির মতো একটা আশ্চর্য দৃষ্টি এল তার আধো—নিমীলিত দুই চোখে। বিছানায় শুয়ে ইরা দেখতে পেল, ধূপদানির অজস্র সাদা সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলিতে ঘরের অন্ধকার ভরে গেছে। আর দেখতে—দেখতে সেই ধোঁয়ার অন্ধকার মিলিয়ে গিয়ে যেন জন্মান্তরের যবনিকা উঠে গেল। বিস্মৃতির অন্ধকারে ঢাকা তারই আরেক জীবনের একটি দৃশ্য আস্তে আস্তে ফুটে উঠল ইরার চোখের সামনে :

কুশলনগরের রাজ অন্তঃপুর যেন রূপার কাঠির স্পর্শে নিশ্চেতন। দাসীরা সুপ্তিমগ্ন, প্রতিহারিণী তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। শুধু নিদ্রাহীন একজোড়া শুকসারী সোনার পিঞ্জরে মাঝে মাঝে পাখা ঝাপটাচ্ছে। দালানের সারি—সারি স্তম্ভের গায়ে দীপাধারগুলি আলোকহীন। অন্ধকারে খিলানের পর খিলান পার হয়ে একটি ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। দালানের শেষপ্রান্তে সোপানশ্রেণীর মুখে একটি মাত্র দীপাধারে তখনও স্তিমিত আলোক জ্বলছে। তারই রক্তিম আভায় ছায়ামূর্তির হাতের মুক্ত বাঁকা অসি ঝলসিত হয়ে উঠল অগ্নিনাগের লেলিহ জিহ্বার মতো।

একবার এদিক—ওদিক তাকিয়ে ছায়ামূর্তি সোপান বেয়ে উঠে গেল।

সোপান অতিক্রম করে সে এসে দাঁড়াল এক নির্জন চত্বরে। চত্বরের মধ্যস্থলে শ্বেতপাথরের অনন্তনাগের ফণার মণির মতো একটি প্রকাণ্ড ঘৃতদীপের শিখা অতি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। অগ্রসর হতে গিয়ে ছায়ামূর্তি সহসা থেমে গেল। চত্বরের ওপাশে কে যেন চকিতে সরে গেল না? ছায়ামূর্তির সতর্ক চোখের সন্ধানী দৃষ্টি চত্বরের চারিদিকে ঘুরে এল। না, কেউ না। ও বোধ হয় দৃষ্টিবিভ্রম।

দুই পাশের কক্ষগুলি দীপহীন, নিস্তব্ধ। কেবল পূর্বপ্রান্তের একটি কক্ষে ঈষৎ উন্মুক্ত দ্বারের মধ্য দিয়ে একটি আলোকরেখা এসে পড়েছে চত্বরে। সেই আলোকরেখার দিকে তাকিয়ে ছায়ামূর্তির রক্তে দোলা লাগল।

স্বাতী জেগে আছে! প্রহর গুনছে তারই প্রতীক্ষায়!

.

অতন্দ্র রাত্রি যেন স্বাতীর দুই চোখে জেগে আছে।

টিয়া বলে গেছে, ধীমান আসবে। সেই কথাটি স্বাতীর প্রতিটি হৃদস্পন্দনে প্রতিফলিত হচ্ছে। কত শুক্লসন্ধ্যা, কত অমানিশা তার ব্যর্থ প্রতীক্ষায় কেটে গেছে, সে—কথা কে জানে! ধীমানও জানে না। এক—এক পল মনে হয়েছে এক—এক এক—এক যুগ। স্বাতীর জীবনটাই বুঝি এক দীর্ঘ দুঃসহ প্রতীক্ষা।

বাতায়ন—পাশে স্তব্ধ প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে স্বাতী ভাবছে আরেক অমানিশার কথা। যেদিন মৃত্যুর কূল থেকে ফিরে এসে নবজীবনের তোরণদ্বারে দাঁড়িয়ে প্রথম দৃষ্টিপাতেই দেখেছিল তরুণ সুন্দর ধীমানকে। প্রতীক্ষার সূচনা তো সেইদিন থেকেই। স্বাতীর প্রণয়রাগরঞ্জিত হৃদয়পদ্মের গন্ধ নিবেদন কবে গ্রহণ করবে ধীমান, সেই প্রতীক্ষা! তারপর দিনে দিনে দুটি হৃদয় ক্রমশ কাছে এসেছে, পরস্পরকে জেনেছে, চিনেছে। আরও পরে সেই এক শুক্লা রাতে সরোবরের তীরে দাঁড়িয়ে পরস্পরের কাছে ধরা দেওয়া। আত্মদানের সমস্ত ভাষাই সে—রাতে হারিয়ে গিয়েছিল দুজনের অধরসঙ্গমে।

সব মনে পড়ে স্বাতীর। মনে পড়ে, আর পদ্মপলাশ দুই চক্ষু অশ্রুতে ঢেকে যায়। কিছুই ভুলতে পারে না স্বাতী। কেমন করে ভুলবে? আপন দেহের রক্তকে কি ভোলা যায়? স্বাতীর রক্তধারায় যে ধীমান জেগে আছে।

নারীর প্রেম বড় নিরুপায়। সে ভুলতেও পারে না, অথচ মনে পড়লেও কষ্ট। সে পারে শুধু গোপনে সজল প্রতীক্ষায় দিনের পর দিন রাতের পর রাত কাটাতে।

কিন্তু টিয়া বলেছিল, এ দুঃসহ প্রতীক্ষার অবসান হবে। ধীমান আসবে। আজই রাত্রির দ্বিতীয় যামে আসবে। সেই থেকে স্বাতীর সমস্ত চেতনা যেন কান পেতে আছে প্রিয়—পদধ্বনির আশায়। কিন্তু কই, কোথায় ধীমান? এখনো তো এল না? পথ চেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেল আঁখিপল্লব, ক্ষীণ হয়ে এল দীপশিখা, মলিন হয়ে এল মালার ফুল, ধীমান তবু এল না।

তবে কি টিয়া মিথ্যা বলে গেছে? স্তোক দিয়ে ভুলিয়ে গেছে স্বাতীকে? না ধীমানই ভুলে গেছে কুশলনগর থেকে যাবার বেলায় তার সেই অঙ্গীকার, ‘আমি আবার আসব স্বাতী, তুমি অপেক্ষা কোরো।’

হতাশায় আর অভিমানে স্বাতী দুই হাতে মুখ ঢাকল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন স্বপ্নে ডেকে উঠল—বড় পরিচিত, বড় মধুর কণ্ঠে ডেকে উঠল, স্বাতী!

চকিতে মুখ ফিরিয়ে তাকাল স্বাতী। দেখলে, মুক্ত দ্বারপথে এসে দাঁড়িয়েছে ধীমান। অঙ্গে কৃষ্ণবর্ণ পরিচ্ছদ, হাতে ঝলসিত বাঁকা অসি। প্রত্যাশিত মিলনের সুখে বিবশ হয়ে এল স্বাতীর সারা দেহ। শরতের আকাশের মতো তার মুখে একই সঙ্গে রৌদ্র—বর্ষার খেলা।

ধীমান আবার ডাকলে, স্বাতী!

বিহ্বলের মতো স্বাতী বলে উঠল, এলে তুমি ধীমান!

কক্ষমধ্যে এসে ধীমান বললে, আর এক মুহূর্তও বিলম্ব নয় রাজকুমারী। তোরণদ্বারে আমার অশ্ব অপেক্ষা করছে। তুমি প্রস্তুত তো?

হ্যাঁ ধীমান।

তবে এসো।

পালঙ্কের ওপর থেকে ঘন নীল বর্ণের একখানি ওড়না টেনে নিয়ে স্বাতী আপন মুখ অবগুণ্ঠিত করে ফেলল। খুলে ফেললে পায়ের নূপুর। তারপর এগিয়ে এসে ধীমানের হাত ধরে নিশ্চিন্তে বললে, চলো।

মৃদু হেসে ধীমান বললে, কোথায় যাচ্ছ জানতে চাইলে না?

স্বাতী তার আয়ত চক্ষু ধীমানের মুখের দিকে তুলে ধরে বললে, তোমার সঙ্গে আমি স্বর্গেও যেতে পারি, পাতালেও নামতে পারি।

মৃদু হেসে ধীমান বললে,—না, অতদূর যেতে হবে না। আমরা যাব চৈতি নদীর ওপারে—

কাঞ্চনপুরে!

হ্যাঁ, স্বাতী। আমাদের মিলনের স্বপ্ন এবার সফল হতে চলেছে। ভিষগাচার্য বলেছেন, কাঞ্চনপুরেই আমাদের বিবাহ…

সহসা তীব্র একটা চিৎকার করেই ত্বরিত গতিতে স্বাতী ধীমানের পিঠ আড়াল করে দাঁড়াল। আর তৎক্ষণাৎ একখানা তীক্ষ্নধার অতি ক্ষুদ্র ছুরিকা এসে বিদ্ধ হল তার বক্ষের বাম পঞ্জরে।

এক লহমার জন্য হতচকিত হয়ে গেল ধীমান। তারপর বিদ্যুৎবেগে দ্বারপানে ফিরে তাকাতেই প্রায়ান্ধকার চত্বরে কার অস্পষ্ট পদধ্বনি দূরে মিলিয়ে গেল।

স্বাতীর দেহ তখন কক্ষতলে লুটিয়ে পড়েছে।

উন্নত্তের মতো চিৎকার করে উঠল ধীমান, কে—কে এ—কাজ করলে?

ঘৃতদীপের ক্ষীণ আলোকেও স্বাতীর চিনতে ভুল হয়নি তাম্রবর্ণ কুটিল একখানি মুখ আর জ্বলন্ত একজোড়া পিঙ্গল চক্ষু। যন্ত্রণা—বিকৃত স্বরে সে উচ্চারণ করলে, অশনি।

পলকে ধীমানের মূর্তি আহত শ্বাপদের মতো বন্য হিংসায় নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। হাতের বাঁকা অসি বজ্রমুষ্টিতে ধরে সে দ্বার অভিমুখে অগ্রসর হতেই তার কানে এল স্বাতীর কাতরোক্তি, আমার সর্ব অঙ্গ জ্বলে গেল ধীমান!

আর যাওয়া হল না ধীমানের। ভিষগাচার্যের পালিত পুত্র সে, বুঝতে বিলম্ব হল না, অশনির ছুরিকার অগ্রভাগে নিশ্চয় সর্পবিষ মাখানো ছিল। স্বাতীর রক্তে সেই মারাত্মক বিষ মিশেছে।

কী করবে এখন ধীমান? কী কর্তব্য তার? ভিষগাচার্যকে ডেকে আনবে? কিন্তু কী হবে তাঁকে এনে? কোথায় তাঁর ঔষধ পত্রের পেটিকা। অথচ স্বাতীকে বাঁচাতেই হবে। তার প্রাণরক্ষা করা এখনো সম্ভব, যদি তার দেহ থেকে বিষটুকু তুলে নেওয়া যায়।

হাতের অসি ফেলে দিয়ে ধীমান নতজানু হয়ে বসে পড়ল কক্ষতলে লুণ্ঠিতা স্বাতীর পাশে। রেশমি নিচোল ভেদ করে বিষাক্ত ক্ষুদ্র ছুরিকাখানা আমূল বিদ্ধ হয়ে আছে বিষধর সাপের বিষদন্তের মতোই। ক্ষিপ্রহাতে সেখানা উন্মোচিত করতেই অতসী বর্ণের নিচোল রক্তজবার রঙে রঞ্জিত হয়ে গেল। ক্ষণমাত্র বিলম্ব করলে না ধীমান। রেশমি নিচোল দু’হাতে ছিন্ন করে স্বাতীর ক্ষতমুখে মুখ দিয়ে বিষাক্ত রক্ত শোষণ করতে আরম্ভ করলে।

অতীত ভবিষ্যৎ ভুলে গেছে ধীমান। ভুলে গেছে দর্ভপাণি অপেক্ষা করছেন, ভুলে গেছে শত্রুপুরীতে সে একা। যতবার রক্তে ভরে ওঠে ধীমানের মুখ, ততবার সে ফেলে দেয়। ধীমানের মনে হল স্বাতী বুঝি তার রক্তের ঋণ এমনি করেই আজ শোধ দিচ্ছে।

চম্পকবরণী স্বাতীর দেহ অপরাজিততার মত নীল হয়ে আসছে। গাঢ় সুপ্তি নামছে তার নিমীলিতপ্রায় আঁখিপল্লবে। আশ্চর্য, ধীমানের চোখের পাতাও ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে কেন? এক জ্বালাময় যন্ত্রণায় কেন আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে তারও সর্ব অঙ্গ? আর সে পারছে না কেন স্বচ্ছন্দে নিশ্বাস নিতে?

বিদ্যুৎচমকের মতোই ধীমানের মনে পড়ে গেল, পাষাণ—কারার প্রহরীকে অতর্কীতে আক্রমণ করার সময় তার ওষ্ঠাধরে সামান্য রক্তপাত হয়েছে। তবে কি সেই ক্ষতপথে স্বাতীর বিষাক্ত রক্ত তার দেহেও বিষক্রিয়ার সূচনা করেছে!

পরম তৃপ্তির হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ধীমানের মুখ। স্বাতীর দেহ নাড়া দিয়ে সে ডাকতে লাগল, স্বাতী! স্বাতী!

অবসন্ন আঁখিপল্লব প্রাণপণে মেলবার চেষ্টা করে ক্ষীণ সাড়া দিলে স্বাতী।

ধীমানের কণ্ঠ শুষ্ক, জিহ্বা কে যেন কণ্ঠনালীর মধ্যে টেনে নিচ্ছে! তবু সে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে বললে, শুনে যাও স্বাতী, আজ আমাদের বাসর রাত্রি—মৃত্যু—বাসর। আর আমাদের বিচ্ছেদ হবে না।

বাইরের চত্বরে অনন্তনাগের মাথার মণি সহসা অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

.

ধূপদানির সাদা ধোঁয়ার সর্পিল কুণ্ডলী মিলিয়ে গেল। কালো শ্লেটের ওপর সাদা সাদা খড়ির দাগগুলি কে যেন মুছে দিল নিশ্চিহ্ন করে। ইরার ঘরে স্পষ্ট হয়ে উঠল নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে আধো—জাগ্রত আধো—স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থায় পাগলের মতো ইরা কেঁদে উঠল, না—না—না, মরব না, জীবনের সাধ যে কিছুই মেটেনি আমার—তোমাকে যে পেয়েও পাওয়া হল না ধীমান।

ধড়মড় করে উঠে পড়ল জয়া। বাতিটা জ্বাললে। ইরার গায়ে হাত দিয়ে ব্যাকুল ভয়ে ডাকতে লাগল, কী হল ইরা, কী হয়েছে?

ইরার কান্না থেমে গেল। শান্ত হয়ে এল তার সমস্ত উচ্ছ্বাস।

চিত্রকরা দুই চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল জয়ার মুখের পানে।

জয়া বললে, কেঁদে উঠলি কেন? আবার স্বপ্ন দেখছিলি বুঝি?

ইরার সর্বাঙ্গ ভরে গাঢ় অবসাদ নেমেছে। ক্লান্ত কণ্ঠে শুধু বললে, হ্যাঁ।

কী স্বপ্ন দেখলি?

আমাকে একজন খুন করেছে।

অবসন্নভাবে ইরা চোর বুজলে।

আর এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের কথা শুনে জয়ার দেহ বারবার শিউরে উঠতে লাগল। শিয়রে বসে ইরার মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে ভাবলে, মেসোমশাইকে ডেকে দরকার নেই। রাত এখনও বাকি। ইরা একটু ঘুমোক।

.

প্রাচীন পাণ্ডুলিপির পাতা শেষ হয়ে এসেছে। শেষ হয়ে এসেছে কুশলনগরের অভিশপ্ত ইতিহাস। আর মাত্র কয়েক পৃষ্ঠা বাকি।

ভীমপাহাড়ের জঙ্গলে ঝাঁ—ঝাঁ করছে রাত।

জুয়েল—ল্যাম্পের শিখাটা আরও একটু বাড়িয়ে দিলেন অধ্যাপক প্রতাপ। চশমার কাচ আরেকবার মুছে, ঝুঁকে পড়লেন জীর্ণ পুঁথির শেষ পাতাগুলির ওপর :

সেই কালরাত্রির শেষভাগে রাজপ্রাসাদে তখন আর এক দৃশ্য।

হূং হূং হ্রীং হ্রং কালিকে ঘোরদ্রংষ্ট্রে

প্রচণ্ডে চণ্ডনায়িকে দানবান দারয়

হন হন শবশরীরে মহাবিঘ্নং ছেদয় ছেদয়

স্বাহা হূং ফড়িতি।।

রাজপুরীর এক নিভৃত পাষাণ—চত্বরে বসে সুগম্ভীর কণ্ঠে বীরার্দন মন্ত্র উচ্চারণ করছেন দর্ভপাণি। ললাটে রক্তচন্দন, পরনে রক্তাম্বর, রক্তাভ চক্ষুতে অসহ্য দীপ্তি। তাঁর উভয় পাশে ধীমান আর স্বাতীর সদ্যস্নাত নগ্ন শবদেহ কুশশয্যায় শোয়ানো। সমুখে প্রজ্বলিত সমিধ, মাষভক্ত, শ্বেত আকন্দের প্রদীপ, বীরার্চনার আরও নানা উপচার। বিচিত্র একটি ধূপদানি থেকে শ্বেতবর্ণের ধূমকুণ্ডলী সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। সে গন্ধ ফুলের নয়, চন্দনের নয়, মৃগনাভিরও নয়—অথচ সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত মিশ্র সুগন্ধ।

কৃষ্ণা চতুর্দশীর রাত্রি যেন পা টিপে—টিপে এসে দাঁড়িয়েছে সেই নিভৃত পাষাণ—চত্বরে। নিশ্বাস রোধ করে দেখছে তান্ত্রিক দর্ভপাণির ক্রিয়াকলাপ। আর দেখছেন চত্বরের দূর অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে মহারাজ চন্দ্রপাল। বজ্রাহত এক বনস্পতি যেন। তাঁর পাশে অশ্রুমুখী উল্কা।

মাঝে মাঝে বহু কণ্ঠের মিলিত কোলাহল বাইরে থেকে অতি ক্ষীণ হয়ে ভেসে আসছে। সে—কোলাহল সান্ত্রিদলের। মশাল জ্বালিয়ে তারা সমগ্র নগরী তোলপাড় করে পলাতক অশনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সেই বিষাক্ত ছুরিকার বিশেষ ধরনের নির্মিত গজদন্তের বাঁট বিশ্বাসঘাতকতা করেছে অশনির সঙ্গে। মহারাজ চন্দ্রপাল বুঝতে পেরেছেন স্বাতীর হত্যাকারী অশনি ছাড়া আর কেউ নয়।

কিন্তু অশনির ছায়ামাত্রও কোথাও নেই।

দর্ভপাণি প্রথমে ইন্দ্র অগ্নি যম নির্ঋত বরুণ বায়ু কুবের ঈষাণ ব্রহ্মা ও অনন্ত—এই দশ দিকপালের পূজা সমাপন করলেন। পরে যথাবিধি পূজা করলেন চতুঃষষ্টি ডাকিনী ও যোগিনীগণের। তারপর চন্দনের সঙ্গে বিচিত্র একপ্রকার লতার রস আর নানাপ্রকার আয়ুর্বেদীয় দ্রব্য মিশিয়ে দুটি মৃতদেহের সর্বাঙ্গে অনুলেপন শুরু করলেন।

আর, মধ্যে মধ্যে উচ্চারণ করতে লাগলেন, ওঁ হঁ) মৃতকায় নমঃ ফট।

দেখতে দেখতে নীলবর্ণের দুটি বিষাক্ত মৃতদেহে ধীরে ধীরে পীত আভা ফুটে উঠল। দর্ভপাণি ধীমানের শবের নিম্নাঙ্গে একখানি রেশমবস্ত্র জড়িয়ে দিলেন, স্বাতীর অঙ্গে দিলেন রক্তবর্ণ চেলী আর কাঁচুলী। সীমন্তে দিলেন সিঁথিমৌর, কণ্ঠে রত্নহার, মণিবন্ধে মণিময় কঙ্কণ।

মনে হল, নববধূর সজ্জা পরে লজ্জাস্ফুরিত অধরে স্বাতী যেন হাসছে!

মহারাজ চন্দ্রপাল মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। অসহ্য শোকাবেগে থরথর করে কাঁপতে লাগল তাঁর সারা দেহ। আর উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ল উল্কা।

সিঁদুরের সঙ্গে কী একটা দ্রব্য মিশিয়ে দর্ভপাণি ধীমানের প্রশস্ত বক্ষে একটি রক্ত—খড়গচিহ্ন আঁকলেন, স্বাতীর ললাটেও এঁকে দিলেন অনুরূপ একটি ক্ষুদ্র চিহ্ন। তারপর ধীমানের শবের অঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি দিতে—দিতে বলতে লাগলেন :

বীরেশ পরমানন্দ শিবানন্দ কুলেশ্বর।

আনন্দ ভৈরবাকার দেবীপর্যঙ্কশঙ্কর।

বীরোহ হং তাং প্রণম্যামি উত্তিষ্ঠ চণ্ডিকার্চনে।।

দর্ভপাণির কণ্ঠ ভয়ঙ্কর গম্ভীর হয়ে উঠল। শব—অঙ্গে বারবার পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে ভয়াল কণ্ঠে তিনি মন্ত্রপাঠ করতে লাগলেন। ধীরে, অতি ধীরে ধীমানের শব অক্ষিপল্লব মেলে তাকাল। অল্প—অল্প কাঁপতে লাগল তার বিবর্ণ ওষ্ঠাধর।

মহারাজ চন্দ্রপাল যেন পাষাণে পরিণত হলেন। ভয়বিহ্বল উল্কা দু’হাতে চোখ ঢেকে ছুটে পালিয়ে গেল। আর ঘোর তান্ত্রিক বীরাচারী দর্ভপাণির অলৌকিক ক্রিয়া দেখে অন্ধ তামসী রাত্রি যেন আতঙ্কে শিউরে উঠতে লাগল।

মন্ত্রপাঠ থামিয়ে দর্ভপাণি স্বভাব—কঠোর স্বরে আদেশ করলেন, পেটিকা আনো।

মহারাজ চন্দ্রপাল সহসা সম্বিত ফিরে পেলেন। তাঁর মাথার ওপরকার খিলান থেকে একটি রৌপ্যঘণ্ঠা ঝুলছিল। মহারাজ ঘণ্ঠাধ্বনি করতেই আটজন রাজভৃত্য দুটি দারুময় পেটিকা বহন করে এনে চত্বরের দু’পাশে রাখলে।

দর্ভপাণি প্রথমে পেটিকা দুটি শোধন করে নিলেন। তারপর রাজকুমারী স্বাতীর লঘু দেহবল্লরী অবলীলাক্রমে দুই হাতে তুলে একটি পেটিকার মধ্যে শুইয়ে দিলেন। এবার দর্ভপাণি ধীমানের অঙ্গে শেষবার পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে বললেন,

ওঁ বশো মে ভব দেবেশ মম বীরসিদ্ধিং দেহি দেহি

 মহাভাগ কৃতাশ্রয়পরায়ণ

ধীমানের শব আবার চক্ষু মেলে চাইল, আবার অল্প—অল্প কাঁপতে লাগল তার ওষ্ঠাধর। দর্ভপাণির রক্তাভ মুখ—চোখ ভয়াল আনন্দে যেন জ্বলতে লাগল। ধীমানের শব জাগ্রত হয়ছে। পূর্ণ হয়েছে দর্ভপাণির অভীষ্ট।

বৃদ্ধ হলেও ভিষগাচার্য দুর্বল ছিলেন না। দুই পেশিবহুল বাহুতে ধীমানের শব তুলে নিয়ে তিনি পরম যত্নে অপর পেটিকায় রাখলেন। তারপর সেই বিচিত্র ধূপদানিটি হাতে দিয়ে ধূপদানিটি হাতে নিয়ে পেটিকার পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, নিদ্রা যাও ধীমান, নিদ্রা যাও। পরজন্মে বা আগামী যে কোনও জন্মে রাজকুমারী স্বাতী এই মায়া—ধূপতী নিয়ে যদি তোমার বক্ষে স্পর্শ করায়, তুমি আবার জাগ্রত হয়ো। স্বাতীর হত্যাকারী পিঙ্গলচক্ষু অশনি পৃথিবীর যেখানেই জন্মান্তর গ্রহণ করুক না কেন, তুমি তাকে ক্ষমা কোরো না, তুমি তার দুষ্কৃতির প্রতিশোধ নিও।

দর্ভপাণির মুখের এই ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ—কামনা মনে হল যেন হাহাকার করতে—করতে পাষাণ—চত্বরের ছাদ ফেটে অন্ধকার নৈশ আকাশে মিশে গেল।

দর্ভপাণি সিঁদুর দিয়ে পাষাণ—চত্বরের দেয়ালে লিখলেন :

স্বাতী নিদ্রিতা, ধীমান নিদ্রিত

মহাদেবী চামুণ্ডার প্রসাদে

তারা পুনরায় জাগ্রত হোক,

ওঁ হ্রীং শ্রীং চামুণ্ডায়ৈ নমঃ।।

মহারাজ চন্দ্রপালের দিকে ফিরে তিনি আদেশ করলেন, এই লেখাগুলি যেন পাষাণফলকে উৎকীর্ণ করা হয়। আর, এই পাষাণচত্বরে কোনওদিন কোনও কারণেই যেন মানুষের পদচিহ্ন না পড়ে। বিপদ হতে পারে।

তারপর তান্ত্রিক দর্ভপাণি একে একে পেটিকা দুটির ডালা বন্ধ করলেন।

.

অধ্যাপক প্রতাপও ধীরে—ধীরে প্রাচীন পুঁথিখানি বন্ধ করলেন। আর পড়ার প্রয়োজন নেই। পাল বংশের অন্যতম নৃপতি চন্দ্রপালের বংশের মর্মান্তিক সমাপ্তি এইখানেই।

অভিশপ্ত সেই কুশলনগরের ওপর থেকে বহু শতাব্দীর বিস্মৃতির যবনিকা আবার উঠেছে এই রাজনগরের মাটির তলায়! কে জানে, আবার কোন মর্মান্তিক জীবননাট্যের খেলা শুরু হবে। ভিষগাচার্য দর্ভপাণির সেই ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ কামনার বীজ আজও কি রাজনগরের বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে আছে? রাজকুমারী স্বাতীর অতৃপ্ত আত্মা কি জন্ম—জন্মান্তর পার হয়ে সত্যই আজ ইরার দেহ—মনকে আশ্রয় করেছে? জন্মান্তরবাদ কি তাহলে মিথ্যা নয়? আর ধীমান? জন্মান্তরের জিঘাংসা বুকে নিয়ে তার যে শব পেটিকার মধ্যে শুয়ে রয়েছে, তান্ত্রিক দর্ভপাণির শব—সাধনার প্রভাবে সে যদি সত্যই কোনওদিন জেগে ওঠে! কে জানে, কী মহা অনর্থ হবে সেদিন। অধ্যাপকের ব্যাকুল পিতৃহৃদয় চিন্তায় চিন্তায় যেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। বারবার তাঁর মনে হতে লাগল, কী অশুভ ক্ষণেই তিনি প্রত্নতত্ত্বের কাজে এই রাজনগরের মাটিতে পা দিয়েছিলেন! বিস্মৃতির গর্ভে যা চাপা ছিল এতকাল, কেন তিনি তাকে টেনের বার করলেন? কিন্তু আর এখন উপায় নেই। তাঁর মন বলছে, কুশলনগরের রাজপুরীর ভগ্নাবশেষ আবার মাটি চাপা দিলেও তার অশুভ প্রভাব আর চাপা থাকবে না। কী করবেন তিনি? কী করতে পারেন? রাজনগর থেকে জোর করে সরিয়ে নিতে যেতে গেলে ইরা যদি একটা অনর্থ বাধিয়ে বসে? সে তো প্রকৃতিস্থ নয়।

বাইরে কোথায় যেন একটা বুনো মোরগ ডেকে উঠল। অধ্যাপক জানলার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ভীমপাহাড়ের মাথায় ভোর হচ্ছে। জুয়েল—ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিলেন তিনি, চশমাটা খুলে রাখলেন টেবিলের ওপর। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

বারান্দা দিয়ে এলেন তিনি ইরার ঘরের পাশে। খোলা জানলা দিয়ে দেখতে পেলেন, ইরা অঘোরে ঘুমোচ্ছে, আর তারই শিয়রে চুপ করে বসে আছে জয়া। কিছুটা নিশ্চিন্ত হল তাঁর অস্থির মন।

ভীমপাহাড়ের মাথায় তখন সূর্যের প্রথম লাল আভা ঝলমল করছে। সেই দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ অধ্যাপকের হাত দুটি বুকের কাছে জোড় হয়ে এল। গভীর আবেগে অস্ফুট স্বরে তিনি উচ্চারণ করলেন, হে জবাকুসুমসঙ্কাশ, হে তিমির বিদারি জ্যোতির্ময়, সর্ব অকল্যাণের অন্ধকার দূর করে দাও! আমার কন্যাকে সর্ব বিপদ থেকে রক্ষা করো।

 * * *

.

এর পরদিনই ওঁরা এলেন। অবনী দত্ত, দেবপ্রসাদ ঘোষ প্রমুখ ভারতের জনাকয়েক অগ্রগণ্য ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক। রাজনগরের মাটির নিচে অধ্যাপক প্রতাপের আবিষ্কার দেখে তাঁরা চমৎকৃত হলেন। আর, অবাক হলেন ধীমান ও স্বাতীর সঙ্গে প্রিয়তোষ আর ইরার দেহাবয়ব ও মুখের গঠনের আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখে। রাত্রে ইরার অদ্ভুত আচরণের কথাও শুনলেন সবাই।

রাজনগরের ডাকবাংলোয় ওঁদের থাকার ব্যবস্থা হল। বাংলোর হাতায় বসল পরামর্শ—বৈঠক। অধ্যাপক প্রতাপের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকের দল মত প্রকাশ করলেন, প্রাচীন শবদেহ দুটিকে ভূগর্ভে ফেলে না রেখে কলকাতা বা দিল্লির যাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো। সেখানে আরও যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নইলে, প্রাচীন আয়ুর্বেদ—বিজ্ঞানের এই পরমাশ্চর্য কীর্তির বিষয় গবেষণার সুবিধা হবে না।

প্রস্তাবটা যুক্তির দিক থেকে ঠিকই। কিন্তু যুক্তির ওপরেও আর একটা বস্তু আছে জগতে, সাধারণ জ্ঞান বা বুদ্ধি দিয়ে যার নাগাল পাওয়া যায় না। লোকে যাকে বলে অলৌকিক। প্রতাপবাবু তার পরিচয় পেয়েছেন বলেই পরামর্শ—কমিটির প্রস্তাবটাকে এককথায় মেনে নিতে পারলেন না। ধীমানের শব নিয়ে তান্ত্রিক দর্ভাপাণির শবসাধনার বিবরণ জানিয়ে তিনি বললেন, দর্ভপাণির প্রতিশোধ কামনা ধীমানের শবের মধ্যে হয়তো আজও বেঁচে আছে। তাকে নাড়াচাড়া করতে গেলে কোনও বিপদ ঘটবে কিনা কে বলতে পারে। এক্ষেত্রে মমি দুটিকে মিউজিয়ামে পাঠানো উচিত হবে বলে আমি মনে করি না।

পরামর্শ—কমিটি হেসে উড়িয়ে দিলেন কথাটা। অবনী দত্ত বললেন, প্রত্নতত্ত্ব ছেড়ে অধ্যাপক প্রতাপ যে তন্ত্রের ভক্ত হয়ে পড়েছেন, এ খবরটা আমাদের জানা ছিল না। এরপর হয়তো শুনব, তিনি ভৌতিক কাহিনি লিখতে শুরু করে দিয়েছেন!

ব্যঙ্গটা হজম করে অধ্যাপক প্রতাপ বললেন, কিন্তু মাঝে মাঝে রাত্রে ইরার ব্যাপারটা—

ওটা অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ মনের লক্ষণ। আপনার মেয়ের মানসিক চিকিৎসা দরকার।

অধ্যাপক প্রতাপের আপত্তি টিকল না। পরামর্শ—কমিটি রায় দিলেন দিন সাতেকের মধ্যেই শবদেহ দুটিকে পেটিকা সমেত মিউজিয়ামে পাঠানো হবে। সেই সঙ্গে এও বলে গেলেন যে, খননকার্য যেন বন্ধ না থাকে, কেননা এতে গভর্নমেন্টের আর্থিক ক্ষতি।

রাত্রের ট্রেনেই অবনী দত্তের দল রাজনগর ছেড়ে গেলেন।

.

পরামর্শ—কমিটির হুকুম রদ করার উপায় নেই। ঠিকাদারকে ডেকে পাঠালেন প্রতাপবাবু।

সুজনলাল এসে বলেন—আমি নিজেই আসছিলাম আপনার কাছে। কুলিদের একটা আর্জি আছে স্যার।

প্রতাপবাবু বললেন, কী ব্যাপার?

আসছে কাল তাদের পরব। একটা দিনের জন্যে তারা ছুটি চায়।

প্রতাপবাবু দ্বিধায় পড়লেন। বললেন, আমার ওপর অর্ডার হয়েছে মাটি—খোঁড়ার কাজ ফের শুরু করতে, অথচ কুলিরা ছুটি চাইছে।

বিনীত ভঙ্গিতে সুজনলাল বললেন, এটা ওদের ধর্মের ব্যাপার কিনা।

বেশ, ছুটি যখন ওরা চাইছে, দিয়ে দাও। কিন্তু পরশু থেকে কাজ আবার চালু করা চাই। নইলে গভর্নমেন্টের লোকসান।

তেমনি বিনীতভাবে সুজনলাল বললে, কাজ চালু করা মুশকিল হবে স্যার। মাটির নিচেকার ওই চত্বরের আশপাশ খুঁড়তে গেলে কাঠের সিন্দুক দুটোর ক্ষতি হতে পারে।

প্রতাপবাবু বললেন, সেইজন্যেই কমিটির অর্ডার হয়েছে সিন্দুক দুটো কলকাতার মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দেওয়ার। দু’তিনদিনের মধ্যেই ব্যবস্থা করতে হবে। বুঝতেই পারছ, এ—বিষয়ে তোমার সাহায্যটা আগে দরকার।

ঠিক আছে স্যার, আমি সব সময় হাজির।

সুজনলালের কটা রঙের চোখ দুটো বাংলোর বারান্দার এদিক—ওদিক ঘুরছিল। শোলাহ্যাটটা কোলের কাছে ধরে একটু ইতস্তত করে সে বললে, কাল সন্ধের পর নদীর ধারে কুলিদের উৎসব হবে। আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে ওরা ভরসা পায় না। দেবীজী যদি যান, ওরা ভারি খুশি হবে।

বেশ তো, ইরাকে পাঠিয়ে দেব’খন। প্রতাপবাবু আশ্বাস দিলেন।

অভিবাদন করে সুজনলাল চলে যাচ্ছিল, প্রতাপবাবু হঠাৎ ডাকলেন। বললেন, আজ একটা ব্যাপার ঘটেছে সুজন।

জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল সুজনলাল।

ভোর বেলায় স্টেশনের দিক থেকে আমি যখন বেড়িয়ে ফিরছি, একটা লোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়। একমাথা রুক্ষ চুল, মুখময় একরাশ গোঁফদাড়ি। পরনে ময়লা ছেঁড়া চোস্ত পায়জামা আর কুর্তা। একটা চোখ কানা, আর একটা চোখ যেন তার জ্বলছে। লোকটা হঠাৎ আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলে, ‘ঠিকাদার সুজনলাল আপনার কাজ করে? বললাম, হ্যাঁ, কেন? সে বললে, ‘তাকে আমার দরকার। কোথায় থাকে সে?’ আমার কেমন সন্দেহ হল। বললাম, কী দরকার না বললে, বলব না।’ শুনে হা—হা করে হেসে উঠল। তারপর বললে, ‘বেশ, না—ই বললেন। দেখা হলে তাকে শুধু বলবেন, লুধিয়ানা থেকে তোমার যম এসেছে।’ বলে পাগলের মতো হাসতে—হাসতে চলে গেল।

সুজনলালের মুখখানা যেন দপ করে নিভে গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সে প্রশ্ন করলে, কোত্থেকে সে এসেছে বললে? লুধিয়ানা থেকে?

হ্যাঁ। লোকটা কে বলোতো?

শুকনো গলায় সুজনলাল বললে,—ও কেউ নয়; একটা পাগল।

আর একবার অভিবাদন করে সুজনলাল একটু দ্রুত চলে গেল।

.

চৈতি নদীর ধার থেকে বাজনার আওয়াজ আসছে। মাদল নয়, কাড়া—নাকাড়ার মতো আওয়াজ। সে—আওয়াজের অদ্ভুত একটা ছন্দ আছে, আর তারই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে বাঁশির সুর আর আদিবাসীদের দুর্বোধ্য ভাষার গান।

রাজনগরের এই খননকার্যে যেসব কুলিরা কাজ করছে, তাদের অধিকাংশই কোল আর মুণ্ডা। আজ তাদের পরব—’বোঙার’ পূজা। চৈতি নদীর ধারে কুলি—ধাওড়ায় তাই উৎসব লেগেছে।

অমাবস্যা পার হয়ে শুক্লপক্ষ পড়েছে। আকাশে সরু একফালি চাঁদের ইসারা। নদীর ধারে খানিকটা খোলা জায়গায় নাচের আসর বসেছে। প্রকাণ্ড একটা ঢাকের চারদিকে গোল হয়ে বসে জনাকয়েক তরুণ ছেলে হাত চাপড়ে ছন্দ তুলছে, আর দুটি ছেলে বাজাচ্ছে বাঁশের বাঁশি। তিন—চারটি পর্দা বারবার ঘুরে ঘুরে সুরের একটা মোহ সৃষ্টি করেছে। আর, তাদেরই ঘিরে একদল তরুণ মেয়ে তালে তালে শরীর দোলাচ্ছে। প্রত্যেকের খোঁপায় রঙিন বুনো ফুল, পরনে রঙিন শাড়ি, আর হাতে একটা করে জ্বলন্ত মশাল। আলো—ছায়ার বিভ্রমের মাঝে কালো কালো সুঠাম দেহগুলি কালিন্দীর ঢেউয়ের মতো একই সঙ্গে উঠছে—নামছে, হেলছে—দুলছে।

বেশ লাগছে দেখতে ইরা আর প্রিয়তোষের। কুলিরা খাতির করে খানিকটা তফাতে দুটো মোড়া পেতে দিয়েছে। তারই ওপরে বসেছে ওরা, প্রিয়তোষের ডান হাতে বন্দুক আর পায়ের কাছে গোটাকয়েক রক্তমাখা বুনো হাঁস।

প্রিয়তোষের দিকে একটু ঝুঁকে ইরা বললে, কী সুন্দর দেখছ?

প্রিয়তোষ ঘাড় নাড়লে।

ইরা আবার বললে, আচ্ছা, কলকাতার নিউ—এম্পায়ারে কত নামকরা আর্টিস্টের নাচ তো দেখেছি, সেগুলো এত ভালো লাগেনি, কেন বলো তো?

প্রিয়তোষ একটু হেসে বললে’ কাগজের ফুলে এসেন্স মাখিয়ে দিলে কি বনের ফুল হয়? এরা মাটির ছেলেমেয়ে। এরা নাচে প্রাণের আনন্দে, আর তারা নাচে হয় পেশার তাগিদে, নয় সুনামের লোভে।

কথাগুলো ইরার কানে গেল কিনা বোঝা গেল না। মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে সে নাচ দেখতে লাগল। তারপর একসময় আপন মনেই বলতে লাগল, দোল—পূর্ণিমার রাতে, ঝুলনের রাতে আমরাও নাচতাম—আমি আর আমার সখিরা। কত বাঁশি, কত বীণা বাজত—সরোবরের ধারে আমার সে মালঞ্চে কত ফুল ঝরে ঝরে পড়ত। সে কতদিনের কথা—সব মনে পড়ছে আমার!

প্রিয়তোষ চমকে তাকাল ইরার মুখের দিকে। সে—মুখে আবার স্বপ্নের ঘোর নেমেছে, ইরা যেন জেগে—জেগেই স্বপ্ন দেখছে। প্রিয়তোষ প্রমাদ গুনলে, রাত ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের প্রেত বুঝি আবার ভর করেছে তার কল্পনাপ্রবণ মনে।

তার বাহুতে নাড়া দিয়ে প্রিয়তোষ ডাকলে, ইরা।

ঘুম—ঘুম চোখে ইরা ফিরে তাকাল। তারপর ধীরে—ধীরে তার দৃষ্টি হয়ে এল স্বাভাবিক স্বচ্ছ। বললে, কিছু বলছ?

রাত হয়েছে, চলো ফেরা যাক।

ছেলেমানুষের মতো ইরা বললে, না, আর একটু থাকি। বেশ লাগছে দেখতে।

হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল সুজনলাল। বোঝা গেল কাছাকাছি কোথাও ছিল। তার সেই পরিচিত বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আপনার কি বিশেষ তাড়া আছে প্রিয়তোষবাবু।

তা আছে বইকি। পায়ের কাছে শিকার—করা হাঁসগুলো দেখিয়ে প্রিয়তোষ আবার বললে, এগুলো রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে তো।

তা বটে। আপনি তাহলে বরং এগিয়ে যান।

ইরাকে একলা রেখে?

রাখলেই বা। আমি আমার লোক দিয়ে দেবীজীকে ঘরে পৌঁছে দেবে।

তার দরকার হবে না।

নিঃশব্দ হাসিতে সুজনলালের পুরু কালো ঠোঁটের ভেতর থেকে সাদা দাঁতগুলো দেখা গেল। বললে, ভয় পেলেন নাকি? এখানে বাঘ—ভল্লুক নেই।

সুজনলালের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রিয়তোষ বললে, তার চেয়েও মারাত্মক জীব থাকতে পারে।

সুজনলালের চোয়াল দুটো একটু শক্ত হওয়া ছাড়া মুখের আর কোনওরকম ভাব—পরিবর্তন হল না। কাটা—কাটা ভাবে বললে, আপনার কথাগুলো বাঁকা শোনাচ্ছে প্রিয়তোষবাবু। বন্দুক নিয়ে দেবীজীকে পাহারা দেওয়ার জন্যে প্রতাপবাবু স্যার আপনাকে কত মাইনে দেন জানি না, তবে আমারও তাঁবে অনেক লোক খাটে।

চোপরাও! বন্দুকের কুঁদোটা মাটিতে ঠুকে স্প্রিংয়ের মতো উঠে দাঁড়াল প্রিয়তোষ।

ইরা সভয়ে ডেকে উঠল, প্রিয়তোষ!

আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেল। চকিতে সরে দাঁড়াল সুজনলাল, আর প্রিয়তোষের পিছনে অন্ধকার থেকে একটা পাথরের চাঁই এসে পড়ল তার মাথায়। পড়তে—পড়তে প্রিয়তোষ ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্ধকার লক্ষ করে পরপর দুটো ফায়ার করলে।

প্রত্যুত্তরে হা—হা করে একটা অট্টহাসি দূরে মিলিয়ে গেল।

চিৎকার করে উঠে ইরা দু’হাতে প্রিয়তোষকে জড়িয়ে ধরলে। মুহূর্তে থেমে গেল ঢাকের আওয়াজ, বাঁশির সুর আর গান। আদিবাসীদের দুর্বোধ্য ভাষার ভীত কোলাহলে সমস্ত উৎসব যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।

প্রিয়তোষ আর দাঁড়ালে না। ইরাকে নিয়ে বাংলোর পথে দ্রুত পা চালিয়ে দিলে। তার পিঠের কাছে সাদা শার্ট তখন লাল হয়ে উঠেছে।

আর, সুজনলালের মুখ থেকে তখন সমস্ত রক্ত কে যেন নিংড়ে নিয়েছে। আর কেউ না জানুক, সে জানে ওই পাথরের টুকরোটা তাকেই লক্ষ্য করে আসছিল। অন্ধকারের মধ্যেও সে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে একমাথা রুক্ষ চুল—একরাশ গোঁফ—দাড়ির ভেতরে একটা মাত্র জলন্ত চোখ।

মাহিন্দার সিং তাহলে সত্যিই এসেছে লুধিয়ানা থেকে।

.

ঝুমনি বললে, তুর কি হল রে ঠিকেদারবাবু? অমন গুম হয়ে রইছিস কেনে?

চোখ তুলে তাকাল সুজনলাল। সকাল থেকে অনেকখানি পচাই খেয়ে চোখ দুটো তার রাঙা হয়েছে। বললে, না, কিছু না।

ঝুমনি তার গালার চুড়িপরা কালো বাহু দিয়ে সুজনলালের গলা বেষ্টন করে বললে, তবে রা কাড়ছিস না কেনে?

গলা থেকে হাতাখানা ছাড়িয়ে নিয়ে সুজনলাল বললে, তুই এখন যা ঝুমনি।

ঝুমনি ঠোঁট ফুলিয়ে বললে, অ খালভরা, ঝুমনিতে আর মন উঠছে না! বুঝেছি, বন্দুকওলা সাহেববাবুর সঙ্গে সেই গোরাপানা পেতনিটা তুর ঘাড়ে চেপেছে।

আঃ, দিক করিস নে—যা—

ইঃ। ভারি আমার বাবু রে!

পা দিয়ে মাটির ভাঁড়টা ঠেলে দিয়ে ঝুমনি রাগ করে বেরিয়ে গেল ঠিকাদারের ঘর থেকে।

পচাইয়ের বোতলটা তুলে নিয়ে সুজনলাল আরও খানিকটা গলায় ঢেলে দিলে। অনেক খেয়েছে, তবু নেশা তার হয়নি। কাল পরবের রাতের শেষ ঘটনাটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে। ঘুরে ঘুরে কেবলই মনে পড়ছে সেই একমাথা রুক্ষু চুল, মোটা মোটা হাড়ওয়ালা শক্ত দীর্ঘ দেহ, আর একমুখ দাড়ি—গোঁফের মাঝে কোটর—গত একটা চোখ। সে চোখে শুধু অমানুষিক প্রতিহিংসার আগুন।

মাহিন্দার সিং সত্যিই তাহলে এসেছে এই রাজনগরে। আশা করেনি সুজনলাল, একেবারেই আশা করেনি।

হারামির বাচ্চচা! হারামজাদা কুত্তা!

বিড়বিড় করে আপনমনে বকতে লাগল সুজনলাল। আর তার নেশায় রাঙা চোখের সামনে থেকে এক ঝটকায় সরে গেল দীর্ঘ পাঁচ বছরের পুরাতন একখানা পর্দা।

লুধিয়ানা জেলার ছোট একটি গ্রাম। গ্রাম ঠিক নয়, আধা শহর। সেখানে একটা কনট্রাক্ট নিয়ে গিয়েছিল সুজনলাল। একটা কারখানার সেড তৈরি হবে। আর, তারই লাগোয়া স্টাফ কোয়ার্টাস। শ’খানেক দেহতি মজুর জোগাড় করেছিল সে। তাদের মধ্যে ছিল ওই একচোখো মাহিন্দার সিং। জাতে সে জাঠ, লড়াইয়ের জমানাতে সে ছিল পল্টনের দলে। একটা চোখ সেখানেই খোয়ায়। মোটা—মোটা হাড়ওয়ালা বিশাল চেহারা তার। বয়সে সুজনলালের চেয়ে বেশ কিছু বড়ই হবে। যুদ্ধ শেষ হবার পর লোকটা বেকার হয়ে পড়ে। নিজস্ব জমিজমাও বিশেষ কিছু ছিল না যে চাষবাস করে খাবে। ঠিকাদার সুজনলালের কাছে কাজ পেয়ে সে যেন বর্তে গেল।

কারখানার শেড যেখানে তৈরি হচ্ছিল, সেখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে তার ঘর। সেইখান থেকে পায়ে হেঁটে মাহিন্দার কাজ করতে আসত।

মাহিন্দারের ঘরের খবর সুজনলাল জানত না। ঠিকাদার সাহেবকে একদিন সে রাতে নিজের কুঁড়েতে দাওত দেয়। নাছোড়বান্দা সে, যেতেই হল সুজনলালকে তার ঘরে। সেইখানে প্রদীপের আলোয় লালীকে সে প্রথম দেখে। মাহিন্দার সিং—এর বউ লালী। নিটোল স্বাস্থ্য, জ্বলন্ত রূপ। মাহিন্দারের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট।

তারপর থেকে পিয়াস লাগলেই সুজনলাল পাঁচ মাইল পথ সাইকেলে পার হয়ে যেতে মাহিন্দারের ঘরে। জল চাইতে লালীর কাছে! তাদের কুঁয়ার জল নাকি ভারি মিঠা। রসি—বাঁধা বালতি নামিয়ে লালী জল তুলতি, সুজনলাল তাকিয়ে—তাকিয়ে দেখত।

মাহিন্দারকে একদিন সে জানালে, খাওয়া—দাওয়ার ভারি অসুবিধা হচ্ছে তার। মাহিন্দার যদি তার ঘরে দুপুরের খাওয়াটার বন্দোবস্ত করে দেয়—অবশ্য খরচা যা লাগে সুজনলাল দিতে প্রস্তুত।

মাহিন্দার হেসে বলেছিল, খাবেন তো দু’খানা তন্দুরের রুটি আর শুখা গোস—তার আবার খরচা কী!

সুজনলাল সেদিন মনে—মনে হেসেছিল। লোকটা ফৌজি সিপাহী হলে কী হয়, আসলে নিরেট বোকা।

দুপুরে মাহিন্দার যখন ভারি—ভারি লোহার কড়ি বইতো, সুজনলাল তখন তার ঘরে বসে তাকিয়ে—তাকিয়ে লালীকে দেখত।

লালী বলত, কাজে যাবে না, ঠিকাদার সাহাব? তোমার মজুরেরা ফাঁকি দিচ্ছে যে!

সুজনলাল বলত দিক গে। তুমি যেন আমায় ফাঁকি দিও না।

সরল দেহাতি মেয়ে লালী ইঙ্গিতটা বোধ করি বুঝত না। জিজ্ঞেস করত রান্না কেমন হয়েছে?

খুব মিঠা। তবে আরও মিঠা জিনিসের স্বাদ পেয়েছি আমি।

আরও মিঠা জিনিস। কী? বড়বড় চোখে তাকায় লালী।

তুমি।

হঠ। আসমানী দোপাট্টা উড়িয়ে লালী চলে যায়।

এমনি করে খেলা চলে দিনের পর দিন। শিকার নিয়ে শিকারির খেলা। কিন্তু দোষ সুজনলালের, না মাহিন্দার সিংয়ের? নেকড়ের কাছে কেন সে হরিণীকে নিয়ে এল। সে তো খাবেই। মেয়েলোকের জওয়ানি তো জোয়ান পুরুষের জন্যেই। লালীর মতো খুবসুরত লেড়কি দুনিয়ায় পয়দা হয়েছে কি ওই আধ—বুড়ো জাঠ মাহিন্দার সিংয়ের ভোগের জন্যে? ফুঃ!

সুজনলালের রক্তে কামনার বিষ টগবগ করে ফুটতে থাকে। লালীকে তার চাই।

সেদিন আকাশে ছিল বাদল। সকাল থেকেই ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি নেমেছে। এমন লোভনীয় বৃষ্টি লুধিয়ানা জেলায় খুব কমই দেখা যায়। মজুরদের কাজে লাগিয়ে, বর্ষাতিটা গায়ে চাপিয়ে সুজনলাল সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

কুঁয়াতলায় সাইকেলটা রাখতেই শুনতে পেল, লালী বর্ষার ছড়া গাইছে। আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। লালী আজ সবুজ রঙের দোপাট্টা জড়িয়েছে, বেণীতে গুঁজেছে সবুজ গমের শিস। হেসে বললে, আজ এত সকাল—সকাল যে ঠিকাদার সাহাব?

সুজনলাল বললে, ঘরে চলো, জরুরি কথা আছে।

ঘরে গিয়ে সুজনলাল ভিজে শোলাহ্যাটটা ছুঁড়ে ফেললে। খুলে ফেললে বর্ষাতিটা। তার কান তখন ঝাঁ ঝাঁ করছে, মাথা টলছে অসহ্য রক্তের চাপে।

অবাক চোখে চেয়ে লালী জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছে তোমার?

কোনও জবাব দিলে না সুজনলাল। ঘরের দরজাটা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে সে।

.

কতক্ষণ পরে সুজনলাল যখন দরজা খুলল, লালী তখন মড়ার মতো ঘরের মেঝের পড়ে আছে। সবুজ গমের শিষটা থেঁতলে গেছে।

বর্ষাতিটা তুলে নিয়ে সে বেরোতে যাচ্ছিল, লালী ডাকলে, দাঁড়াও—

সুজনলাল ঘুরে দাঁড়াল।

আস্তে—আস্তে উঠল লালী। লালীর সেই মূর্তিটা সুজনলাল আজও মনে করতে পারে। চোখের ‘কজরা’ গালে লেগেছে, নিচের ঠোঁট রক্তাভ, হলুদ—রঙ ছোপানো গায়ের কামিজ ছিন্ন—ভিন্ন, তারই ফাঁকে ফাঁকে নখের আঁচড়ের লাল দাগ। ক্লান্ত নিশ্বাসে নাকের ফুটো দুটো ফুলছে। মরা হরিণের চোখের মতো বোবা দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর চোখের নিমেষে ঘরের চাল থেকে চকচকে একখানা টাঙি টেনে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুজনলালের ওপর।

হঠাৎ আক্রমণের জন্যে তৈরি না থাকলেও সুজনলালের চোখ ছিল লালীর দিকে। খপ করে তার ডান হাতখানা সে চেপে ধরল বটে, কিন্তু লালী তখন পাগল হয়ে উঠেছে। শক্ত থাবায় তার হাতখানা চেপে ধরে সুজনলাল ক্রমশ মোচড় দিতে লাগল, আর ধস্তাধস্তির মধ্যে টাঙির চকচকে ফলাটা কখন যে লালীর নরম পেটে বসে গেছে, সে খেয়াল করেনি।

খেয়াল যখন হল, তখন লালী উপুড় হয়ে পড়ে আছে মাটিতে, আর রক্তের একটা ধারা মেঝেতে গড়িয়ে চলেছে।

বাইরে তখনও ঝুপঝুপ বৃষ্টি। শনশন হাওয়া।

আর ভাববার সময় ছিল না। বর্ষাতিটা তুলে নিয়ে সুজনলাল নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল।

কারখানার শেডের কাছাকাছি এসে হঠাৎ মনে পড়ল ভিজে শোলাহ্যাটখানা পড়ে আছে লালীর ঘরে। কিন্তু তখন আর ফেরবার উপায় ছিল না।

.