রাজকন্যা – ৩

জীর্ণ পুঁথির কয়েকটা পাতা এমনভাবে কীটদষ্ট হয়েছে যে পড়া যায় না। অধ্যাপক প্রতাপ অতি সাবধানে সেগুলি উল্টে পরের পৃষ্ঠা থেকে আবার শুরু করলেন :

সেই রাত্রে। অন্ধকার রাজপুরী তখন সুষুপ্ত।

মৃদু পদশব্দে চন্দ্রপালের সজাগ ঘুম ভেঙে গেল। স্তিমিত দীপালোকে কক্ষমধ্যে আলোছায়ার মায়াজাল। সতর্ক দৃষ্টি মেলে চন্দ্রপাল দেখলেন, অস্পষ্ট একটি নারীমূর্তি সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে।

কে?

আমি সুরঙ্গমা।

শয্যার উপর উঠে বসলেন চন্দ্রপাল। বললেন, তুমি এ কক্ষে কেন সুরঙ্গমা? এই নিশীথে?

শয্যাপাশে এসে দাঁড়ালেন সুরঙ্গমা। মুখ থেকে গুণ্ঠন সরিয়ে বললেন, মহারাজ আশ্চর্য হয়েছেন, না? হওয়ারই কথা। দীর্ঘ আঠারো বছর পরে মহারাজ চন্দ্রপালের এই কক্ষে আবার সুরঙ্গমার অভিসার হবে, একথা কি আমিই ভেবেছিলাম?

চন্দ্রপাল একটু বিচলিত হয়ে বললেন, তুমি তো জানো আমি সন্ন্যাসী। কেন এলে?

সন্ন্যাসীর তপোভঙ্গ করতে।

নারীকণ্ঠের একটা সূক্ষ্ম হাসি কক্ষের হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল।

সুগম্ভীর স্বরে চন্দ্রপাল বললেন, পরিহাস রাখো, বলো এ অসময়ে কেন এসেছ?

মহারাজের কাছে আমার একটা আবেদন আছে।

কী আবেদন?

সুরঙ্গমা সহসা হাত বাড়িয়ে চন্দ্রপালের পদস্পর্শ করলেন। কণ্ঠে অনুনয় নিয়ে বললেন, এতখানি অন্যায় তুমি কোরো না মহারাজ! স্বাতী আর ধীমানের বিবাহে বাধা দিও না। ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে।

একটা তুচ্ছ বস্তুর মতো সুরঙ্গমার হাত সরিয়ে দিয়ে চন্দ্রপাল বলে উঠলেন, নিশীথ রাত্রে তুমি কি প্রলাপ বকতে এসেছ? ধীমান শুধু কৃষাণীর গর্ভজাত নয়, বৌদ্ধ—বিরোধী ঘোর তান্ত্রিক মহানন্দের ঔরসে তার জন্ম। তার সঙ্গে আমি দেব স্বাতীর বিবাহ! জানো না মহানন্দ আমার পরম শত্রু!

সুরঙ্গমা বললেন, জানি। কিন্তু একদিন তুমিও ঘোর তান্ত্রিক ছিলে চন্দ্রপাল। আর মহারাজ মহানন্দ ছিলেন তোমার পরম বন্ধু। সে—কথা তুমি ভুলে গেলেও কুশলনগরের এক নটী আজও তা ভোলেনি। সেই নটীর কুঞ্জে প্রতি রাত্রে তোমাদের দুই বন্ধুর পদধূলি পড়ত। আর চলত প্রেমের প্রতিযোগিতা। কেমন, তাই না?

চন্দ্রপাল আর একটু বিচলিত হয়ে বললেন—ওসব কথা থাক সুরঙ্গমা।

কক্ষের হাওয়ায় সূক্ষ্ম একটু কলহাস্য আবার একটু অনুরণিত হয়ে উঠল। সুরঙ্গমা বললেন, ক্ষতি কী? তুমি আমি ছাড়া এই নিশীথে কেউ আর শুনছে না। তোমরা তখন নবীন যুবা, আর নটীরও তখন রূপের অবধি ছিল না। কিন্তু সেই রূপই হল কাল, সেই রূপের নেশায় মহানন্দ নটীকে হরণ করে নিয়ে গেল কাঞ্চনপুরে, তার প্রমোদ—ভবনে। হতাশ প্রেমের জ্বালা ভুলতে হঠাৎ তন্ত্রধর্ম ত্যাগ করে তুমি একদা বৌদ্ধ—সন্ন্যাসীর গেরুয়া ছদ্মবেশ ধারণ করলে।

ছদ্মবেশ! চন্দ্রপাল কুপিত হয়ে উঠলেন, সংযত হয়ে কথা বলো সুরঙ্গমা।

অতি মধুর কণ্ঠে সুরঙ্গমা বললেন, রাগ কোরো না চন্দ্রপাল, কথাটা তো মিথ্যে নয়! তোমার গৈরিকের দোহাই, বলো তো সেদিনের সেই কামনা—বাসনা—ঈর্ষা—হিংসা আজও কি তোমার গেছে? মহারাজ মহানন্দ আজ জীবিত নেই। কিন্তু তাঁর প্রতি তোমার বিদ্বেষ আজও বেঁচে আছে। যাক, যা বলছিলাম। মহানন্দের প্রমোদ—ভবনে নটী কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারল না। মনে মনে সে ভালবেসেছিল কাকে, তুমি তা জানো চন্দ্রপাল। তাই একদিন সে আবার পালিয়ে এল কুশলনগরেই। এবার তার ঠাঁই হল কুশলনগরাধিপতির প্রমোদ—ভবনে নয়, একেবারে দ্বিতীয় অন্তঃপুরে। সে আজ বিশ বছরের কথা। মনে পড়ে চন্দ্রপাল?

চন্দ্রপাল বিরক্তিভরে বললেন, সুরঙ্গমা তুমি যাও!

আর অল্পই বাকি আছে চন্দ্রপাল। বিশ বছর আগে এই কক্ষে এই পালঙ্কে প্রতিরাত্রে পুষ্পশয্যা রচনা হত, আর সেই শয্যায় শুয়ে নটীর কানে—কানে তুমি বহু প্রেমের কথা মধুপের মতো গুঞ্জন করতে। আজ হয়তো সেই প্রেমে বেঁচে নেই। বসন্ত গেলে ভ্রমরের তৃষ্ণাও থাকে না। তবু সেই মৃত প্রেমের দোহাই দিয়ে আবার অনুনয় করছি চন্দ্রপাল, স্বাতী আর ধীমানের মিলনে তুমি বাধা দিও না। স্বাতীকে সুখী হতে দাও—ওর মলিন মুখ আর আমি সইতে পারছি না।

অশ্রুর বন্যায় সুরঙ্গমার মুখ ভেসে গেল।

দারুণ ক্রোধে চন্দ্রপাল গর্জে উঠলেন, না—না—না, তা হয় না, তা হতে পারে না। তোমার মায়াকান্নায় আমাকে ভোলাতে পারবে না সুরঙ্গমা। বিশ বছর আগে সেই মহানন্দের অপমান জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমার বুকে কুশাগ্রের মতো বিঁধে থাকবে। এই আমার শেষ কথা। তুমি যাও সুরঙ্গমা।

সুরঙ্গমার অশ্রুসিক্ত চোখে সহসা একটা জ্বালাময় দীপ্তি দেখা দিল। মনে—মনে একটা কঠিন সঙ্কল্প নিয়ে তিনি বললেন, বেশ, আমিও তবে শেষ কথা জানিয়ে যাই চন্দ্রপাল, কাল প্রভাতেই কুশলনগর এক আশ্চর্য রহস্য জানতে পারবে।

এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে চন্দ্রপাল বললেন, কী রহস্য?

সুরঙ্গমার অধর—প্রান্তে একটু বাঁকা হাসি ফুটে উঠল, অস্ফুট আলোকে চন্দ্রপাল তা দেখতে পেলেন না। শুধু শুনলেন সুরঙ্গমা বলছেন,— আঠারো বছর আগে এক দুর্যোগের রাতে কুশলনগরের মহরানি মণিমালিনী এক মৃত সন্তান প্রসব করেন। সেই রাত্রেই রাজভবনে দ্বিতীয় অন্তঃপুরে নটী সুরঙ্গমার গর্ভে এক কন্যার জন্ম হল। তারপর সেই দুর্যোগের রাত ভোর হবার পূর্বেই সেই নটীর সদ্যোজাত কন্যা কেমন করে প্রথম রাজ অন্তঃপুরে রানি মণিমালিনীর শয্যায় স্থান পেল, আর কেমন করেই বা সেই মৃত সন্তান চলে এল সুরঙ্গমর কোলের কাছে, সে— রহস্য সুরঙ্গমা আর চন্দ্রপাল ছাড়া কেউই জানে না। রানি মণিমালিনীও জানতেন না। কাল প্রভাতে কুশলনগর আঠারো বছর আগের সেই রহস্য জানবে। জানবে স্বাতী কে—কার কন্যা। আশা করি আভিজাত্যের গৌরবে মহারাজ চন্দ্রপালের মুখ তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

দ্বারের দিকে অগ্রসর হলেন সুরঙ্গমা।

কয়েক মুহূর্ত বজ্রাহতের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন চন্দ্রপাল। তারপর সহসা কোমল কণ্ঠে ডাকলেন,—শোনো। কাল প্রভাত পর্যন্ত আমাকে ভাববার অবকাশ দাও সুরঙ্গমা।

পরদিন প্রভাতে চৈতী নদীর জলে সুরঙ্গমার মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেল। কুশলনগর জানল, কোনও অজ্ঞাত কারণে সে আত্মহত্যা করেছে।

 * * *

.

কফির পেয়ালা নিয়ে এল জয়া। অধ্যাপক প্রতাপ পুঁথি থেকে চোখ তুলে তাকালেন।

ইরা কোথায় জয়া?

বেড়াতে বেরিয়েছে?

একা? প্রতাপবাবুর মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়ল।

প্রিয়তোষ সঙ্গে আছে। সারাদিনই সঙ্গে থাকে।

কফির পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে প্রতাপবাবু বললেন, কিন্তু রাতটায় ওর ওপর চোখ রাখিস মা! কী জানি আবার কোন রাতে—

আশ্বাসভরা সুরে জয়া বললে,—আমার চোখ এড়িয়ে ইরাকে আর কোথাও বেরোতে দেব না। কিন্তু সেদিন রাতে একা—একা কেন ও পাতালপুরীতে গিয়েছিল মেসোমশায়?

চিন্তাক্লিষ্ট মুখে প্রতাপবাবু বললেন, সেই কারণের সূত্রটুকুই তো খুঁজে বেড়াচ্ছি পুঁথির পাতায় পাতায়। জন্মান্তরের রহস্য বোঝা সহজ নয় মা। সেনাপতি ধীমান আর রাজকুমারী স্বাতী যে যুগের, সে—যুগটা ছিল ঘোর তন্ত্র—সাধনার যুগ। তখন শব—সাধনা পিশাচসিদ্ধ প্রেতযোনি নামানো—আরও নানারকম অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ চলত। ইরার ওপর হয়তো তারই কু—প্রভাব পড়েছে। ভাবছি এখান থেকে ওকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দি।

কিন্তু ইরা যে এখান থেকে আর কোথাও যেতে চায় না মেসোমশায়।

ও।

ম্লান উদাস দৃষ্টিতে অধ্যাপক প্রতাপ জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলেন। দিনের কাজ শেষ হয়েছে। কুলিরা দলে দলে ঘরে ফিরছে। থেমে গেছে ক্রেনের ঘরঘর আওয়াজ। ভীমপাহাড়ের কোলে ছায়া নামছে ঘন হয়ে।

জুয়েল—ল্যাম্পটা জ্বেলে দিয়ে জয়া চলে গেল। অধ্যাপক প্রতাপ চশমার কাচ মুছে কুশলনগরের ইতিহাসে আবার মন দিলেন :

সূর্যাস্তের আবির চৈতি নদীর জল রাঙিয়ে তুলেছে। তারই তীরে শাল—মহুয়ার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল একটি কিশোরী বেদেনী আর ঝুলি—কাঁধে এক বেদে! এগিয়ে এল তারা একেবারে কুশলনগরের তোরণদ্বারের সামনে।

রঙিন ঘাঘরা ঘুরিয়ে কালনাগিনীর মতো কালো বেণী দুলিয়ে বেদেনী মেয়ে নাচছে আর গাইছে—

লাগ ভেলকি লাগ!

মন্তরে মোর যাদুকরী পাশাবতী জাগ।

 লাগ ভেলকি লাগ।

সঙ্গের ছেলেটি তার গানের সঙ্গে বাজাচ্ছে একটা তুবড়ি বাঁশি।

তোরণশীর্ষে দাঁড়িয়েছিল অনুচরসহ স্বয়ং অশনি। প্রতিদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে সে তোরণশীর্ষে উঠে বহুদূর পর্যন্ত সন্ধানী দৃষ্টি চালিয়ে দেখে, কোথাও কোনও শত্রুপক্ষের ছায়া দেখা যাচ্ছে কিনা। দুটি কিশোর বেদে—বেদেনীকে আসতে দেখে তার দৃষ্টি প্রথমে সন্দেহে কুটিল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাদের নাচ—গান শুনে তার পিঙ্গল চোখে আর সূচ্যগ্র গোঁফের নিচে কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল। কোমরবন্ধনীর মধ্যে থেকে একটা স্বর্ণমুদ্রা বের করে অশনি মেয়েটাকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করলে। বেদেনী মেয়ে ক্ষিপ্রহাতে সেটা লুফে নিয়ে হাসিমুখে বললে, অনুমতি হয় তো ভেতরে গিয়ে গান শোনাই আর খেলা দেখাই।

ছেলেটি বললে, ভালো ভালো যাদুর খেলা—দেখবেন?

অনুচরবর্গ কৌতূহলী হয়ে উঠল। অশনি প্রশ্ন করলে কী নাম তোদের?

মেয়েটি বলল, টিয়া।

ছেলেটি বললে, কেশর।

কোন দেশে ঘর তোদের?

টিয়া বললে—বেদের ঘর সব দেশেই। আমরা পথে—পথে ঘুরি, যাদুর খেলা দেখাই।

কেশর বললে, শুনেছি কুশলনগরে ভোজবাজির আদর আছে। তাই এসেছি কিছু পুরস্কারের আশায়। অনুমতি হয় তো দ্বার খুলে দিন।

অশনির ইঙ্গিতে রক্ষী তোরণদ্বার খুলে দিলে। টিয়া আর কেশর ভিতরের বিশাল অঙ্গনে এসে দাঁড়াল। অঙ্গনের চতুষ্পার্শে চারটি প্রশস্ত রাজপথ। প্রত্যেক পথের ধারে পণ্যশ্রেণী। অঙ্গনের মধ্যস্থলে একটি সুবৃহৎ জলাধার, তার মাঝখানে ঊর্ধ্বায়িত একটি মকরমুখ থেকে জলধারা উৎসারিত হচ্ছে।

তখন সন্ধ্যা হয়েছে। পথপার্শ্বে দীপাধারের রশ্মি পণ্যশ্রেণীর আলোকচ্ছটায় সঙ্গে মিশে অঙ্গনকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। জলাধারের পাশে দাঁড়িয়ে বেদেনী মেয়ে টিয়া গান ধরলে :

লাগ, লাগ ভেলকি লাগ!

মন্তরে মোর যাদুকরী পাশাবতী জাগ!

কাঁধের ঝুলি নামিয়ে কেশর শুরু করে দিলে যাদুর খেলা। এক টুকরো হাড়ের স্পর্শে তার হাতে একটা কাঠের গোলক নিমেষে একটি শ্বেত পারাবত হয়ে গেল। একে—একে দুয়ে—দুয়ে কৌতূহলী নাগরিকেরা তাদের ঘিরে জমতে লাগল। বিচিত্র নৃত্যের ভঙ্গিমায় টিয়া গাইতে লাগল :

(মোর) যাদুর গুণে কত কি হয়, জলে পাথর ভাসে,

(আর) মরা শাখে এক পলকে ফুলের জোয়ার আসে,

 যাদুতে মোর ধুলোর মুঠি হয় যে রাঙা ফাগ।

 লাগ ভেলকি লাগ।।

কেশবের হাড়ের স্পর্শে তখন অঙ্গনে পুঁতে দেওয়া একটা শুষ্ক বীজ থেকে সবুজ একটা পুষ্পতরু গজিয়েছে। তার শাখায় শাখায় গুচ্ছ গুচ্ছ নীলাভ ফুল!

মুগ্ধ জনতার মুখে সহর্ষ প্রশংসাধ্বনি শোনা গেল। বেদে—বেদেনীর পায়ের কাছে বৃষ্টিধারার মতো পড়তে লাগল তাম্রমুদ্রা।

তথাগতের মন্দিরে প্রদীপ দিয়ে ফিরছিল উল্কা। অঙ্গনে জনতার সমাবেশ দেখে কৌতূহলী হয়ে সেও জনতার সঙ্গে মিশে ভোজবাজির খেলা দেখতে লাগল।

একজন নাগরিককে টিয়া বললে,—হ্যাঁ গা, রাজবাড়িটা কোন দিকে? এ—দেশের রাজকুমারীর কাছে আমাদের নিয়ে যেতে পার? বড় সাধ তাঁকে খেলা দেখাই।

কেশর বললে, আর কিছু উপার্জনও হয়।

উল্কা এগিয়ে গিয়ে বললে, এসো আমার সঙ্গে। আমি রাজবাড়িতে নিয়ে যাব।

টিয়া ও কেশরের চোখে চোখে কি যেন কথা হল। তারপরে তাম্রমুদ্রাগুলি কুড়িয়ে নিয়ে দুজনে উল্কাকে অনুসরণ করলে।

.

রাজ—অন্তঃপুরের পাষাণ—চত্বরে চলেছে বাজিকরের খেলা। দাসদাসী প্রতিহারিণীর মাঝে রাজকুমারী স্বাতী নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দৃষ্টি খেলার দিকে বটে, কিন্তু মন যেন বহুদূরে। মুখখানি জুড়ে সকরুণ বিষাদ। এ যেন বনকুরঙ্গীর মতো সেই প্রাণচঞ্চলা স্বাতী নয়, কোনও শিল্পীর হাতে গড়া একখানি মৌন মর্মর প্রতিমা।

উল্কা বললে, কেমন যাদুকর তোমরা? আমাদের এই রাজকুমারীর মুখে একটু কথা, একটু হাসি ফোটাতে পার? তবেই বুঝব তোমরা সত্যিই ভেলকি জানো।

হেসে টিয়া বললে পারি, বইকি।

 লাগ, লাগ ভেলকি লাগ!

 (আমার) পরশমণির পরশ লেগে বোবার ফোটে বুলি,

 বুকে যে তার ডেকে ওঠে পাপিয়া বুলবুলি।

ভ্রূ—ভঙ্গি করে উল্কা বললে,—বটে!

ওদিকে কেশরের হাতে একটা শূন্য ধাতুপাত্র থেকে কখনও স্বচ্ছ জলধারা, কখনও শুভ্র দুগ্ধধারা অনর্গল ঝরতে লাগল। স্বাতীর অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে কৌতূহলের দীপ্তি ফুটল।

রঙিন ঘাঘরা আর সর্পিল বেণী দুলিয়ে টিয়া গাইল :

 আমার কাছে পরশমণি কি আছে এমন,

 কানে কানে বলি তোদের চুপি চুপি শোন—

 (সে যে) একটুখানি ভালোবাসা, একটু অনুরাগ।

 লাগ ভেলকি লাগ!

ঝুলির ভেতর থেকে কেশর একটা অর্ধদগ্ধ মশাল বের করে তাতে অগ্নি সংযোগ করলে। তারপর সেই হাড়ের টুকরোটা অগ্নিশিখার চারপাশে একবার ঘোরাতেই মশাল থেকে অজস্র রক্ত নীল শ্বেত পীত তারা আতস—বাজির মতো ঝরে পড়তে লাগল।

সকলে চমৎকৃত হয়ে হর্ষধ্বনি করে উঠল। আর মুগ্ধ বিস্ময়ের হাসিতে স্বাতীর মুখ হয়ে উঠল উজ্জ্বল।

উল্কাকে টিয়া বললে, ওই দেখুন রাজকুমারীর মুখে আমাদের যাদুর নমুনা।

কেশর বললে, এবারে পুরস্কার দিতে আজ্ঞা হোক!

আপন মণিবন্ধ থেকে একখানি মণিময় কঙ্কণ খুলে স্বাতী বললে, নাও।

অঞ্জলি পেতে এগিয়ে গেল টিয়া। তারপর বললে, আমি ভালো হাত গুনতেও জানি। অনুমতি হয় তো রাজকুমারীর হাতখানি দেখি।

উৎসুক হয়ে স্বাতী বাম করপল্লব এগিয়ে দিল।

মাথা নেড়ে টিয়া বললে, এখানে নয়, কক্ষে চলুন। নিরালায় হাত দেখব।

বেদেনী টিয়াকে নিয়ে স্বাতী কক্ষমধ্যে গেল। প্রিয়সখী উল্কা ছাড়া আর কেউ রইল না।

বাম হাতখানি পুনরায় এগিয়ে দিয়ে স্বাতী বললে, এবার বলো।

টিয়া একবার সতর্ক দৃষ্টিতে দ্বারের দিকে তাকাল। তারপর রাজকুমারীর আরও নিকটবর্তী হয়ে চাপা কণ্ঠে বললে, সে আসবে রাজকুমারী—আজই রাত্রির মধ্যযামে আসবে। তুমি প্রস্তুত থেকো।

কে আসবে?

সেনাপতি ধীমান।

.

কিছুক্ষণ পরে। টিয়া আর কেশরকে সঙ্গে নিয়ে উল্কা উপস্থিত হল অশনির সামনে। বললে, নগরকোটালের কাছে রাজকুমারীর একটা অনুরোধ আছে।

বলো।

এই বিদেশি বাজিকর দুটিকে আজ রাত্রের মতো বিশ্রাম—ভবনে থাকতে দেওয়া হোক।

স্বভাব রুক্ষ স্বরে অশনি উত্তর করলে, রাজকুমারীর বোধ করি জানা নেই যে, অচেনা বিদেশিকে রাত্রে আশ্রয় দেওয়া নিষেধ!

জানা আছে। তবু সদাশয় নগরকোটালের কাছে এটা রাজকুমারীর বিশেষ অনুরোধ।

রাজকুমারীর বিশেষ অনুরোধ? মনে—মনে পুলকিত হয়ে অশনি তার গুম্ফের সূক্ষ্ম অগ্রভাগ আঙুল দিয়ে সূক্ষ্মতর করতে লাগল। কর্কশ কণ্ঠ যথাসম্ভব কোমল করে বললে, আচ্ছা, তাই হবে। কিন্তু কাল প্রভাতেই তোরা চলে যাস, বুঝলি?

টিয়া ও কেশরের চোখে চোখে আর একবার কথা হল। তারপর দুজনেই জোড় হাতে বললে, যে আজ্ঞা।

.

অমাবস্যা তিথি। বিশাল শকুন—পাখার মতো অন্ধকার নেমেছে কুশলনগরের ওপর। সমগ্র নগরী গাঢ় নিদ্রায় মগ্ন।

বিশ্রাম—ভবন থেকে অতি সন্তর্পণে বেরিয়ে এল দুটি প্রাণী। টিয়া আর কেশর। পথের দীপাধারগুলি অধিকাংশই নির্বাপিত। মার্জারের মতো নিঃশব্দ পদে দুজনে এগোতে লাগল।

নগরতোরণের ঘন্টায় রজনীর দ্বিতীয় যাম ঘোষণা করে অবরুদ্ধ তোরণের সামনে রক্ষী পদচারণা করছিল। সহসা থেমে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে হাঁক দিল, —কে ওখানে?

আমি বেদেনী টিয়া।

অন্ধকারের ভেতর থেকে টিয়ার তন্বীমূর্তি এগিয়ে এল। সন্দিগ্ধ স্বরে রক্ষী বললে, এতরাত্রে বাইরে কেন?

ঘুম আসছে না, তাই তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম। এত দেশ ঘুরেছি, তোমার মতন এমন সুপুরুষ চোখে পড়েনি।

স্থূলকায় রক্ষী তার বর্তুলাকার উদরে হাত রেখে বললে, এত রাত্রে পরিহাস করতে এলে নাকি বেদেনী?

একেবারে রক্ষীর দেহলগ্না হয়ে আবেশে গদগদ কণ্ঠে টিয়া বলে উঠল, আমার যাদুবিদ্যার শপথ—পরিহাস নয়, এ আমার মনের কথা।

রক্ষীর জীবনে নারীদেহের সান্নিধ্য বড়—একটা মেলে না। উদ্ভিন্ন যৌবনা কিশোরী টিয়ার দেহের সংস্পর্শে উপবাসীযৌবন তোরণরক্ষীর বুকের রক্ত উত্তাল হয়ে উঠল। বিগলিত চিত্তে বোধ করি একটা প্রণয়—সম্ভাষণ সে করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার পূর্বেই টিয়ার একখানা হাত তীব্র আরকে সিক্ত একখণ্ড রেশমবস্ত্র তার নাকে সজোরে চেপে ধরলে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই রক্ষীর সংজ্ঞাহীন দেহ ভূমিতলে লুটিয়ে পড়ল। আর, সঙ্গে—সঙ্গে যেন অন্ধকার গর্ভে পর্দা ভেদ করে উপস্থিত হল কেশর। নিজের অঙ্গাবরণীর মধ্য থেকে একখানা ছুরিকা বের করে সে এগিয়ে গেল তোরণদ্বারের দিকে। বৃহৎ দুটি অর্গল কপিকলের সাহায্যে আড়াআড়ি ভাবে বিশাল দুটি কপাটের গায়ে সংলগ্ন। কেশর তীক্ষ্নধার ছুরিকা দিয়ে কপিকলের মোটা রজ্জু কেটে দিল। ঘরঘর শব্দে ধীরে—ধীরে নেমে গেল বিরাট অর্গল দুটি।

দ্বারপাশে অন্ধকারে কিছুক্ষণ আত্মগোপন করে রইল টিয়া আর কেশর। না, অর্গলের শব্দে কেউ জাগেনি। তারপর দুজনে প্রাণপণ শক্তি প্রয়োগ করে ধীরে—ধীরে নিঃশব্দে খুলে দিলে কুশলনগরের সেই বিশাল তোরণদ্বার।

কেশর চকমকি ঠুকে একটা মশাল জ্বেলে কয়েকবার শূন্যে আন্দোলিত করল। পর মুহূর্তেই শাল—মহুয়ার জঙ্গলের দিক থেকে অশ্বখুরধ্বনি শোনা গেল। দ্বাদশটি অশ্বারোহী তোরণের সামনে কালো ছায়ার মতো এসে থামল। তারপর অশ্বপৃষ্ঠ থেকে বিদ্যুৎগতিতে নেমে একে একে নগর মধ্যে প্রবেশ করল।

অস্ফুটে হর্ষধ্বনি করে উটল টিয়া আর কেশর। অন্ধকারেও তাদের চিনতে কষ্ট হয়নি, দ্বাদশ অশ্বারোহীর পুরোভাগে দীর্ঘদেহ অসিধারী ব্যক্তিটি স্বয়ং ধীমান!

.

অন্ধকার গর্ভ থেকে যেন একটা প্রেত—কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে :

 ওঁ নীলোৎপলোদলোশ্যামা চতুর্বাহুসমন্বিতা

 খট্টাঙ্গৎ চন্দ্রহারঞ্চ বিভ্রান্তি দক্ষিণে করে।।

মন্ত্রোচ্চচার করছেন বন্দী দর্ভপাণি।

আলোর জগৎ থেকে নির্বাসিত হয়ে যেদিন তিনি এই অন্ধকারায় বন্দী হয়েছেন, সেদিন থেকে চিররাত্রির অন্ধকার তাঁর সঙ্গী। দর্ভপাণির চোখে নিদ্রা আসে না। কখনও হাত—পায়ের শৃঙ্খল বাজিয়ে কারাকক্ষে পদচারণা করে বেড়ান, কখনও বা পাষাণ—কক্ষতলে বসে আপন মনে পূজার মন্ত্রোচ্চচারণ করেন।

শৃঙ্খলিত অবসন্ন পায়ের একটানা ঝণৎকার তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু ভাঙা কর্কশ কণ্ঠের মন্ত্রোচ্চচার পাষাণ—গর্ভের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিহত হয়ে কেমন একটা অস্বস্তিকর অমানুষিক রূপ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। শুনলে ভয়ও হয়, বিরক্তিও ধরে।

লৌহকপাটের বাইরে থেকে প্রহরারত সান্ত্রি রূঢ় কণ্ঠে ধমক দিয়ে উঠল, এই, চুপ করো!

উত্তরে সেই ভাঙা কর্কশ কণ্ঠে অট্টহাসি ভেসে এল, হা—হা—হা—হা—হা—হা!

ঠিক সেই সময়ে দেখা গেল, কিছুদূরে পাষাণ—প্রাচীর বেয়ে একটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে কারাগারের ছাদে উঠছে।

সান্ত্রির লক্ষ সেদিকে পড়ল না। বিরক্ত হয়ে লৌহকপাটের সামনে আবার সে পদচারণা শুরু করলে। ছাদের আলিসার ওপর দিয়ে সেই ছায়ামূর্তি তখন শিকারি মার্জারের মতো গুঁড়ি মেরে অগ্রসর হচ্ছে। হঠাৎ অসাবধানে ছায়ামূর্তির কটিলগ্ন অসি—কোষে একটু শব্দ হল—ঝন।

চকিত হয়ে উঠল সতর্ক সান্ত্রি। কিসের আওয়াজ? তাকাল দক্ষিণে—বামে। লৌহকপাটের পাশে পাষাণ—প্রাচীর সংলগ্ন একটা আংটায় একটা মশাল জ্বলছিল, তারই আলোয় যতদূর দেখা যায়, কেউ কোথাও নেই। তবু সে স্কন্ধে ঝোলানো শিঙাটায় হাত দিল। সময় থাকতে সঙ্কেতধ্বনি করা ভালো। কে জানে যদি অলক্ষ—শত্রু হয়।

শিঙাটা মুখে তুলল সান্ত্রি কিন্তু ফুঁ দেওয়ার আগেই অন্ধকারার গর্ভ থেকে আবার ভেসে এল সেই প্রেত—কণ্ঠস্বর :

 কৃষোদরী দীর্ঘ দংষ্ট্রা অতিদীর্ঘাতিভীষণা।

 লোলজিহ্বা নিম্নরক্তনয়নারাব ভীষণা।।

শিঙাটা খসে পড়ল সান্ত্রির হাত থেকে। লৌহকপাটের সামনে দাঁড়িয়ে তিক্ত বিরক্ত স্বরে ধমক দিয়ে উঠল, চুপ করো বলছি—নৈলে টুঁটি টিপে ধরব!

সহসা ছাদের আলিসা থেকে শিকারলোলুপ কালো নেকড়ের মতো সেই কালো ছায়ামূর্তি এসে নিমেষের মধ্যে কঠিন রজ্জুপাশে বেঁধে ফেলল তার হাত—পা। হতভাগ্য আর্তনাদ করার অবকাশও পেল না।

ক্ষিপ্রহাতে প্রথম ছায়ামূর্তি অচেতন সান্ত্রির কোমরবন্ধনী থেকে বৃহৎ একটি চাবি বের করে নিলে। তারপর প্রাচীর সংলগ্ন আংটা থেকে মশালটা তুলে নিয়ে লৌহকপাটের দিকে অগ্রসর হল।

.

অন্ধকারায় বসে দর্ভপাণি একমনে ধ্যান করছেন,

 ওঁ মহিষঘ্নি মহামায়ে চামুণ্ডে মুণ্ডমালিনী—

সহসা একটা আলোর তির এসে অন্ধকারে অভ্যস্ত তাঁর চোখে বিদ্ধ হল। চিররাত্রির কারাগারে বন্দী দর্ভপাণি আলোয় অন্ধ হয়ে গেলেন।

শুধু আলো নয়, কার যেন পদশব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছে। যে সান্ত্রি প্রতিদিন খাদ্য দিয়ে যায়, এ তো তার পদশব্দ নয়! তবে কে আসে এই অন্ধকারায়?

পদশব্দ আরও কাছে এগিয়ে আসছে। উজ্জ্বল অলোয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে কারাকক্ষের অন্ধকার।

কতক বিস্ময়, কতক বিহ্বলতায় দর্ভপাণি প্রশ্ন করলেন, কে? কে আসে?

আগন্তুক তাঁর পদস্পর্শ করে বললে, আমি ধীমান পিতা।

ধীমান!

আবেগে, উত্তেজনায় শৃঙ্খলিত দর্ভপাণি সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ধীমানকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, আমি জানতাম—আমি জানতাম পুত্র, তুমি একদিন আসবে। মহাদেবীর পূজা আমার বিফল হবে না।

ধীমান ভিষগাচার্যের শৃঙ্খলমোচন করলে। তারপর তাঁর হাত ধরে ধীরে—ধীরে নিয়ে এল লৌহকপাটের বাইরে। রাত্রির শীতল বাতাসে বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন দর্ভপাণি। মুক্তির নিশ্বাস।

ধীমান বললে, আদেশ করুন পিতা, মহারাজ চন্দ্রপালের সমুচিত শাস্তি—

দর্ভপাণি বললেন, আবশ্যক নেই। কৃতঘ্ন চন্দ্রপালের শাস্তিবিধান করবেন মহাদেবী স্বয়ং। তুমি শুধু রাজকুমারী স্বাতীর সংবাদ নিয়ে এসো।

ধীমান এক মুহূর্ত নীরব রইল। তারপর বললে, যদি সে স্বেচ্ছায় কাঞ্চনপুর যেতে চায়?

তার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে! কাঞ্চনপুরে গিয়ে আমি তোমাদের বিবাহ দেব।

অনুচরদের প্রহরায় দর্ভপাণিকে রেখে ধীমান একাকী অন্ধকারে মিশে গেল।

.

নটীর নূপুর শেষ ঝঙ্কার দিয়ে থামল।

কিন্তু নগরকোটাল অশনির সেদিকে আজ মন নেই। নগর পরিক্রমা সাঙ্গ করে প্রতি রাত্রে সে আপন বিলাসকক্ষে এসে বসে। নটী আসে, ভৃঙ্গার পূর্ণ করে দেয়, মৃদঙ্গের তালে তালে নৃত্য করে। লজ্জাকে লজ্জা দিয়ে নৃত্যের ছলে দেহ আমন্ত্রণ জানায় দেহকে। রাত্রির শেষ যাম কামুক অশনির বর্বর ভোগবিলাসের কুলষে নিত্য কালো হয়ে ওঠে। কিন্তু তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। নৃত্য গীত, ভৃঙ্গারের সুরা, পণ্যা নারীর অভ্যস্ত প্রণয়—ইঙ্গিত—কিছুই তাকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। আধো—নিঃশেষিত ভৃঙ্গার হাতে অশনি আজ অন্যমনা।

‘রাজকুমারীর বিশেষ অনুরোধ।’

উল্কার এই কথাটাই বারবার গুঞ্জরিত হচ্ছে তার চিত্তে। অশনির কাছে দর্পিতা স্বাতী আদেশ নয়, বিশেষ অনুরোধ পাঠাল কেন? তবে কী ধীমানের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর স্বাতীর মনের পরিবর্তন ঘটেছে? হবেও বা। নারীর যৌবন কতদিন একা থাকতে পারে? আর, শৌর্যে বীর্যে রূপে অশনিও তো ধীমানের চেয়ে হীন নয়।

অশনির মদিরা—বিহ্বল চোখে স্বাতীর রূপ ফুটে উঠল। মধুর মদিরা—ভরা এই ভৃঙ্গারের মতোই অপরূপ যৌবনবতী স্বাতী! তারই সঙ্গে মিশে আছে কুশলনগরের রাজমুকুটের স্বপ্ন। অশনির কত দিনের কামনার বস্তু!

রাজকুমারীর মন আর একবার পরীক্ষা করে দেখলে হয়। চন্দ্রলগ্নে জন্ম অশনির, বহু কঠিন চিত্ত নারী স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছে তার কাছে। লোকে বলে, নারীচিত্তের জগতে সে দিগ্বিজয়ী। আর স্বাতী তো বালিকা মাত্র।

অশনির ওষ্ঠপ্রান্তে আত্মপ্রসাদের মৃদু হাস্যরেখা ফুটে উঠল। হ্যাঁ, আজই সে রাজকুমারীর মন পরীক্ষা করে দেখবে। এই গভীর নিশীথে অন্তঃপুরে স্বাতী এখন একা—সুরঙ্গমাও আর নেই—এই তো সুযোগ।

ভৃঙ্গার শূন্য করে ঈষৎ স্খলিত পদে অশনি বিলাস—কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।

 * * *

.

আবার সেই ডাক!

‘রাজকুমারী স্বাতী! রাজকুমারী স্বাতী! তুমি কোথায়? কোন জন্মের পারে? আমি ধীমান, কত যুগ ধরে তোমার অপেক্ষায় রয়েছি। তুমি এসো—এসো তুমি।’

বিছানার ওপর উঠে বসল ইরা। শুধু কান দিয়ে নয়, সমগ্র সত্তা দিয়ে সে শুনতে লাগল সেই অশরীরী ডাক। ধীমান ডাকছে।

টেবিলের ওপর সেই আশ্চর্য ধূপদানি থেকে তখন সুগন্ধী ধোঁয়ার অসংখ্য শ্বেতকুণ্ডলী উঠছে। অন্ধকারে যেন অসংখ্য শ্বেতবরণ নাগশিশু ভেসে বেড়াচ্ছে। ইরা তার সমস্ত চেতনা দিয়ে শুনছে সেই অপার্থিব ডাক। কত যুগ, কত জন্মের পারে ইতিহাসের ভগ্নস্তূপের গর্ভ থেকে ধীমান ডাকছে, ‘রাজকুমারী স্বাতী, আর কতকাল তোমার অপেক্ষায় থাকব? আরও কত জন্ম যাবে তোমার দেখা পেতে? এসো স্বাতী, এসো তুমি। আমি ধীমান—তোমারি ধীমান, আজও তোমারি অপেক্ষায় দিন গুনছি।’

চঞ্চল হয়ে উঠল ইরা। দ্রুত হল তার রক্তস্রোত। ধীমান ডাকছে, সে যাবে। তাকে যেতেই হবে যেখানে ধীমান অনন্তকালের প্রতীক্ষা নিয়ে শুয়ে আছে।

ক্ষণকালের জন্যে ইরার মনে পড়ে গেল, বাবাকে সে কথা দিয়েছে, ভূগর্ভের সেই পাষাণ—চত্বরে আর যাবে না। কিন্তু কেন যাবে না সে? কিসের মানা যেতে? সে তো ইরা নয়, সে যে রাজকুমারী স্বাতী! তার জন্মান্তরের দ্বৈত তাকে ডাকছে, আর সে যাবে না?

বিছানা থেকে ধীরে ধীরে নামল ইরা। টেবিল থেকে তুলে নিল সেই আশ্চর্য ধূপদানি। তারপর মন্ত্রচালিতের মতো এক—পা এক—পা করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

আজ কিন্তু ইরা দরজা খুলতে পারল না। শক্ত দুটো কড়ায় জয়া কখন একটা তালা লাগিয়ে দিয়েছে, শোবার আগে সে লক্ষ করেনি।

তালাটা ধরে টানতেই জয়ার সজাগ ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে সে টেবল ল্যাম্পটাকে জ্বেলে দিতেই ভয়ে বিস্ময়ে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল, একি ইরা।

ইরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল দরজার কাছে।

জয়া দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে বললে, এত রাতে উঠেছিস কেন? বল কোথায় যাচ্ছিস?

ইরা নিরুত্তর।

জয়া তার কাঁধ ধরে নাড়া দিয়ে বললে, চুপ করে আছিস যে? হাতে ধূপদানিটা নিয়েছিস কেন? আবার ওই সর্বনেশে জায়গায় যাচ্ছিলি?

উদভ্রান্তের মতো ইরা বললে, শুনতে পাচ্ছ না, ধীমান ডাকছে— আমি যাব—

সন্ত্রস্ত স্বরে জয়া বললে, পাগলামি করিসনে—কে ধীমান? কেউ ডাকেনি!

ইরার মুখ দিয়ে শুধু বেরোল,—দোর খোলো—আমি যাব।

না, তুই যেতে পাবিনে।

ইরা উত্তেজিত হয়ে উঠল, দোর খোলো বলছি—

না।

ধীমান যে ডাকছে।

জয়ার মুখ দিয়ে ভীত আর্তনাদ বেরোল, ইরা!

ইরা হঠাৎ দরজার তালাটাকে ধরে পাগলের মতো নাড়া দিতে দিতে চিৎকার করে উঠল, আমি যাব—আমি যাব—ধীমান ডাকছে—আমি যাব—

আর জয়া—ভয়ে বিহ্বল জয়া কি করবে ভেবে না পেয়ে নিশুতি রাতের স্তব্ধতাকে খান খান করে আরও জোরে চীৎকার দিয়ে উঠল, প্রিয়তোষ! প্রিয়তোষ! মেসোমশাই!

প্রিয়তোষ ছুটে এল পাশের ঘর থেকে, লাইব্রেরি থেকে এলেন অধ্যাপক প্রতাপ। জয়া দরজা খুলতেই ঝড়ের মতো ইরা বেরোতে যাচ্ছিল, সামনে প্রিয়তোষকে দেখে থমকে থেমে গেল মন্ত্রমুগ্ধের মতো। তারপর দু’হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে বুকে মুখ রেখে মুগ্ধ আবেশে বলতে লাগল, ধীমান! তুমি এসেছ! চিনতে পারছ আমাকে? আমি স্বাতী—তোমারি স্বাতী!

বিবর্ণ মুখে অধ্যাপক প্রতাপ বলে উঠলেন, এ তুই কী বলছিস ইরা? কী হয়েছে তোর?

ইরার মাথায় গভীর স্নেহে হাত বুলোতে—বুলোতে প্রিয়তোষ বলতে লাগল, —ইরা আমি প্রিয়তোষ। ভালো করে চেয়ে দ্যাখো, আমি প্রিয়তোষ।

ধীরে—ধীরে মুখ তুলে ইরা কিছুক্ষণ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল প্রিয়তোষের দিকে। যেন সদ্য ঘুম থেকে জেগে উঠল। আস্তে আস্তে বললে, প্রিয়তোষ!

হ্যাঁ, ইরা। তুমি নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছিলে।

স্বপ্ন!

মৃদু হেসে প্রিয়তোষ বললে, স্বপ্ন বইকি। সারাদিন ধরে প্রত্নতত্ত্বের কথাই ভেবেছ নিশ্চয়, ঘুমের মধ্যে তাই তারই ভূত এসে তোমায় ধরেছিল। যাও, শুয়ে পড়ো গে।

কোনও কথাই আর বললে না ইরা। অত্যন্ত ক্লান্তিবোধ হচ্ছিল তার। নীরবে নিজের বিছানার দিকে এগোল। ধূপদানিটা তার হাতে থেকে জয়া নিতে যেতেই ইরা প্রবল আপত্তির সঙ্গে সেটা সরিয়ে নিলে।

প্রিয়তোষ বললে, থাক জয়া, ওটা ওর সখের জিনিস।

জয়া বললে, ওই ধূপদানিটা কিন্তু ভারি অদ্ভুত।

কী রকম?

সেদিন রাতে যখন ইরা বেরিয়েছিল, তখনও ওটা ওর হাতে ছিল, আজও আছে। ওই ধূপদানিটা গুন—তুক কর কিনা কে জানে!

প্রিয়তোষ এবার গলা ছেড়ে হেসে উঠল। বললে, হায় বিংশ শতাব্দীর আধুনিকা, পাড়াগেঁয়ে ঠাকুমাদের মতো তুমিও অবশেষে গুন—তুকে বিশ্বাস করতে শুরু করলে!

অধ্যাপক প্রতাপ কিন্তু জয়ার কথাটা উড়িয়ে দিতে পারলেন না। তাঁর মনের মধ্যে একটা অত্যাসন্ন বিপদের আশঙ্কা মেঘের মতোই ঘনিয়ে উঠতে লাগল। লাইব্রেরি—ঘরে ফিরে যেতে যেতে জয়াকে বললেন, ওসব কথা থাক মা।

প্রিয়তোষ বললে—ইরাকে একটু কফি করে দাও জয়া, বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছে ওকে।

ইরার ঘরের মধ্যে গেল প্রিয়তোষ।

চোখ বুজে শুয়ে আছে ইরা। ঘুমোয়নি। প্রিয়তোষ টেবল ল্যাম্পের শিখাটাকে কমিয়ে দিয়ে তার পাশে বসতেই উঠে বসল। তারপর দু’হাত দিয়ে প্রিয়তোষকে বেষ্টন করে তার বুকে মুখ রেখে হু—হু করে কেঁদে উঠল।

ব্যস্ত হয়ে প্রিয়তোষ বলে উঠল, কী হল ইরা? কী হল আবার?

নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ইরা বললে, আমাকে তুমি কখনও ছেড়ে যেও না প্রিয়তোষ—বলো যাবে না?

একথা কেন ইরা?

তুমি কাছে না থাকলে আমি যেন কেমন হয়ে যাই আজকাল। খালি মনে হয়, তুমি যেন কত দূরে গেছ—আর বুঝি আসবে না—আর বুঝি আসবে না—

ইরার কান্না—ভাঙা গলা কেঁপে—কেঁপে উঠল।

কেন এমন মনে হয় ইরা?

আস্তে আস্তে মুখ তুলে ইরা বললে,—জানি না, কেন এমন মনে হয়। বলো, আমাকে ছেড়ে যাবে না?

ইরার মুখখানি দু’হাতে ধরে প্রিয়তোষ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। শেডে—ঢাকা ল্যাম্পের ফিকে নীল আলোয় খুঁটিয়ে—খুঁটিয়ে দেখল, না, কোনও স্বপ্নের ঘোর, সম্মোহনের কোনও ছায়া নেই ইরার স্বচ্ছ টলটলে দুই চোখে। সেখানে রয়েছে শুধু গভীর অনুরাগ, ব্যাকুল নির্ভরতা, আর সাগ্রহ আত্মসমর্পণ। প্রিয়তোষ বয়সে তরুণ। হয়তো তার নিজেরই মনের এই তিনটি ভাব ইরার চোখের আয়নায় প্রতিফলিত দেখতে পেল। ভালোবাসা নিজেকে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না।

দু’হাতে ইরার মুখখানি ধরে প্রিয়তোষ তার কানে—কানে বলে উঠল:

 তুই তো আমার বন্দী অভাগী, বাঁধিয়াছি কারাগারে,

 প্রাণের বাঁধন দিয়েছি প্রাণেতে, দেখি কে খুলিতে পারে।

.