রাজকন্যা – ২

ইরার চোখে ঘুষ নেই। উঠে বসল বিছানায় ওপর।

রাত এখন কত কে জানে। জানলার বাইরে নিঝুম রাত ঝিঁঝির ঝুমঝুমি বাজিয়ে চলেছে একটানা। ঘরের বাতি নেভানো। ওপাশের বিছানায় জয়া ঘুমে অচেতন। ইরার চোখে আজ আর ঘুম আসবে না।

ধীরে—ধীরে উঠে সে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঝিমঝিমে চাঁদের আলো বাইরের উঁচু—নীচু প্রান্তরে কুয়াশার মতো গলে গলে পড়ছে। দূরে ভীম—পাহাড় গাঢ় ধূসর জলরঙ্গে আঁকা ছবির মতো। ওরই কোলে ভূগর্ভের চত্বরে পেটিকার মধ্যে শুয়ে আছে সেনাপতি ধীমান আর রাজকুমারী স্বাতী। আজ সকাল থেকে ওদের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না ইরা। ওরা যেন তার বহুকালের আত্মীয়, একান্ত প্রিয়জন। অথচ ওদের আর ইরার মাঝখানে বহু যুগের ব্যবধান। তবু কেন এমন মনে হয়? কেন ওদেরই ভাবনা উতলা ভ্রমরের মতো সারাটা দিন ধরে তার মনের মধ্যে গুনগুন করে ফিরছে? রাতেও তার বিরাম নেই। কেন তার ঘুম কেড়ে নিল ধীমান আর স্বাতী? যারা ইতিহাসের পাতার শুধু ইতিহাস হয়েই আছে?

না। ওদের কথা আর ভাববে না ইরা। চাইবে না আর ওই ভীম—পাহাড়ের দিকে। জানলার কাছ থেকে সরে আসতেই ইরার চোখ পড়ল ঘরের কোণে একটা কর্নার—স্ট্যান্ডের ওপর। অন্ধকারে ধাতুময় জিনিসটা চিকচিক করছে। দৃষ্টি আটকে গেল ইরার। সেই ধূপদানিটা, যেটা বহু শতাব্দী ধরে রাজকুমারী স্বাতীর শবাধারের পাশে পাথরের দেয়ালের কুলুঙ্গিতে রাখা ছিল। অতি গোপনে, জগৎ—সংসারের চোখের আড়ালে লুকিয়ে রাখা ওই ধাতুময় জিনিসটাকে আজই সকালে ইরা নিয়ে এসেছে নিজের ঘরে। সূক্ষ্ম তারের সুন্দর কাজকরা এই ধূপদানিটি, প্রাচীন শিল্পকাজের একটা নিদর্শন হিসেবেই সে এনেছিল। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে, যতবার সে ওটা দেখছে, ততই তার মনে হচ্ছে, কি যেন একটা আশ্চর্য রহস্য লুকানো রয়েছে ওই বস্তুটার মধ্যে।

আশ্চর্য রহস্যই বটে! ইরা অবাক হয়ে দেখল, ধূপদানিটার সূক্ষ্ম জালের ভেতর থেকে সূক্ষ্মতর অসংখ্য ধূমরেখা শ্বেত গোখরোর বাচ্চচার মতো কিলবিল করে বেরিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে অপূর্ব এক ক্ষীণ সুগন্ধে ঘরের বাতাস আমোদিত হয়ে উঠল। সে—গন্ধ যেন চন্দন, ফুল অর মৃগনাভির সংমিশ্রণ। সে—গন্ধ নিশ্বাসের সঙ্গে রক্তে গিয়ে মিশছে, নেশার মতো কি এক মাতদকতায় আচ্ছন্ন করে ফেলছে সমস্ত চেতনা।

ধূপদানিটার মধ্যে ইরা কোনো সুগন্ধী দ্রব্য তো রাখেনি! তবে এত সুগন্ধী ধোঁয়া বেরোচ্ছে কেমন করে। কৌতূহলী হয়ে ধাতুপাত্রটাকে ইরা হাতে তুলে নিল। আর অমনি হঠাৎ সে শুনতে পেল বহু দূর থেকে কে যেন ক্ষীণ স্বরে ডাকছে, রাজকুমারী স্বাতী! তুমি কোথায়? কোন জন্মের পারে? তুমি কি আমায় চিনতে পারছ আজ? আমি ধীমান—তোমারই ধীমান! যুগযুগান্তর ধরে তোমার অপেক্ষায় রয়েছি। এসো—তুমি এসো।

ধীমান ডাকছে। ডাকছে রাজকুমারী স্বাতীকে। কিন্তু সে—ডাক অর্ফিয়ুসের বাঁশির মতো ইরার রক্তে দোলা দেয় কেন? স্বাতী আর ইরা আজ একাকার হয়ে যাচ্ছে। ধীমান ডাকছে, তাকে যেতেই হবে। ইরা আজ কোনও বাধা মানবে না। এ—ডাকে সাড়া দিতে যদি জীবনের এপার থেকে মৃত্যুর ওপারে যেতে হয়, ইরা আজ তাও যাবে।

নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো এক—পা এক—পা করে ইরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হাতে রইল সেই ধূপদানি। ঘুমে অচেতন জয়া কিছুই জানল না।

ঘর থেকে ইরা বেরিয়ে এল বাংলোর কম্পাউন্ডে। তারপর কম্পাউন্ডের ফটক খুলে মাঠের রাস্তায়। বোবা নিশীথিনী যেন নিশ্বাস বন্ধ করে ইরার আসার অপেক্ষায় ছিল। হিমে ভেজা গলিত জ্যোৎস্নায় পথের রেখা, আশপাশের বুনো ঝোপ, দূরের পাহাড়, তারই কোলে বিরাট মাটির স্তূপ আর খননকার্যের প্রকাণ্ড যন্ত্রপাতি সবই দেখা যাচ্ছে আবছা আবছা।

বাইরে এসেও শোনা যেতে লাগল সেই ডাক : ‘রাজকুমারী স্বাতী, তুমি কোথায়? যুগযুগান্তর ধরে আমি তোমার অপেক্ষায় রয়েছি। এসো, তুমি এসো!’ আর উঁচু—নিচু মাঠের রাস্তা দিয়ে একাকিনী ইরা ধূপতী হাতে নির্ভয়ে এগিয়ে চলল ভীম—পাহাড়ের দিকে, যেখানে কয়েকটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। তার পায়ের খসখস আওয়াজে স্তব্ধ রাত্রি যেন শিউরে শিউরে উঠতে লাগল।

খননকার্যের জায়গায় সারারাতই আলো জ্বলে। আলো জ্বালিয়ে গার্ডের দল পালা করে পাহারা দেয়। প্রতাপবাবুর আদেশে আজ থেকে বিশেষ পাহারা বসেছে ভূগর্ভের সিঁড়ির মুখে। চারজন গার্ডের মধ্যে একমাত্র মহাবল সিং—ই রাইফেল হাতে এত রাত অবধি জেগে আছে। মৃদু খসখস আওয়াজ কানে যেতেই ভাবলে, আশেপাশে কোথাও শুকনো পাতার ওপর দিয়ে সাপ চলে যাচ্ছে। রাইফেলটা মাটিতে ঠুকে দু’বার আওয়াজ করলে সে। কিন্তু তৃতীয়বার তার হাতের রাইফেল অনড় হয়ে গেল বাঁ—দিকে চোখ পড়তেই। ঝাপসা চাঁদের আলোয় সে দেখল, শাড়িপরা একটি নারীমূর্তি হাতে কী একটা নিয়ে ঝজু ভঙ্গিতে সোজা এদিকেই এগিয়ে আসছে। মুক্ত প্রান্তরের দমকা হাওয়া উড়ছে তার খোলা এলোচুল।

এক মুহূর্তের জন্যে মহাবল সিংয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মানুষ, না প্রেতিনী—কে ও? পরক্ষণেই রাইফেলটা কাঁধে তুলে মহাবল হাঁকলে কৌন হ্যায়?

কোনও জবাব এল না। ইরার মূর্তি তেমনি ঝজু ভঙ্গিতে নীরবে এগিয়ে আসতে লাগল।

মহাবল আবার হাঁকল, খবরদার! বোলো কৌন হ্যায়?

পায়ে চলার খসখস আওয়াজ ছাড়া কোনও সাড়া এল না।

ইরা তেমনি এগিয়ে আসছে, হাতে ধূপদানি নিয়ে।

স্তম্ভিত হয়ে মহাবল দেখলে, স্বয়ং প্রতাপবাবু হুজুরের মেয়ে।

বাঈ আপনি! এখানে কেন?

ভেতরে যাব।

একা! সঙ্গে যাব?

দরকার হবে না।

হতচকিত মহাবল আর কিছু বলার আগেই ইরা সোজা গিয়ে দাঁড়াল ভূগর্ভের সিঁড়ির মুখে। তারপ নেমে গেল। চত্বরে পা দেওয়ার আগে ইরা সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে চারদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলে। সেই ফিকে নীল স্ফটিক—স্বচ্ছ মণির নরম স্নিগ্ধ নীলাভ আলোয় ছেয়ে আছে সমস্ত জায়গাটা। ইরার মনে হতে লাগল এই চত্বরে সে বহুবার এসেছে। কত দিন, কত যুগ আগে, সেটা মনে পড়ে না, তবে এই পাষাণ—চত্বরে বহু প্রভাত, বহু সন্ধ্যা তার কেটে গেছে—এটা স্পষ্ট মনে পড়ছে। এই চত্বরে সে কখনও বীণা বাজিয়ে গান গাইত, কখনও বা ওই স্তম্ভে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গৃহবলিভূক কপোত—কপোতীর প্রণয়কূজন শুনত। প্রতি বছর ফাল্গুন—পূর্ণিমায় সখিদের নিয়ে সে হোলি খেলত এখানে। আবীরে কুমকুমে কলহাস্যে আর নূপুরগুঞ্জনে এই চত্বরের পাষাণেও যেন রোমাঞ্চ জাগত।

আজ সব মনে পড়ছে তার! সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে নেমে ইরা চত্বরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। দক্ষিণ দিকে ওই খিলানের তলায় যে প্রবেশ—পথটা মাটি আর পাথরে বন্ধ হয়ে আছে, ওর বাইরে একটা সুন্দর মালঞ্চ ছিল না? ইরার মনে পড়তে লাগল, সেই মালঞ্চের কোলে ছিল টলটলে ফটিক—জলের এক দিঘি। সেই দিঘিতে তার ছোট্ট ময়ূরাকৃতি নৌকা ছিল, কত শ্রাবণদিনে, কত চৈত্ররাতে নৌবিহার করেছে সে।

আশ্চর্য, একে—একে আজ তার সবই মনে পড়ে যাচ্ছে! কেন এমন মনে হচ্ছে তার? তবে কি সে ইরা নয়, রাজকুমারী স্বাতী?

ইরার হাতের ধূপদানি থেকে সেই শুভ্র সুগন্ধ ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখতে দেখতে সমস্ত চত্বর আচ্ছন্ন করে ফেলল, আর তার স্বপ্নাতুর চোখের সামনে দূর অতীতের খণ্ড—খণ্ড দৃশ্য ফুটে উঠে আবার মিলিয়ে যেতে লাগল। ইরা দেখল, স্বাতী আর ধীমান কখনো মালঞ্চের তরুতলে বসে গল্প করছে, কখনও বা স্বাতী তার কক্ষের অলিন্দে দাঁড়িয়ে, আর ধীমান অলিন্দের নিচে পুষ্প—বীথিকায়—পরস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে সে—রাতের মতো বিদায় নিচ্ছে।

সে দৃশ্যগুলি মিলিয়ে গেল। আবার ফুটে উঠল ফটিক—জল দিঘির বুকে ময়ূরপঙ্ক্ষি নৌকা। তাতে ধীমান আর স্বাতী। আকাশে মাধবী জ্যোৎস্না। ধীমান নীরবে নৌকা বাইছে, আর স্বাতী হাতের পদ্মকোরকের পাপড়িগুলি একটি—একটি করে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ তাদের মাথার ওপর দিয়ে সুরলহরী ছড়িয়ে একটা পাপিয়া উড়ে চলে গেল। স্বাতী মুখ তুলে প্রশ্ন করলে, রাত এখন কত?

ধীমান একবার আকাশের দিকে তাকাল। বললে, বোধ হয় রাত্রির মধ্যযাম। ঘাটে নৌকা লাগাব?

আর একটু পরে। কাঞ্চনপুরে তোমাদের ফিরে যেতে কতদিন বাকি?

তুমি তো এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছ। এইবার আমরা ফিরে যেতে পারি। ভিষগাচার্য আগামী পরশু ফিরে যাবার কথা বলেছেন মহারাজকে।

স্বাতী গম্ভীভাবে বলে উঠল, কিন্তু আগামী পরশু তো যাওয়া হতে পারে না।

ধীমান অবাক হয়ে বললে, কেন?

আগামী পরশু আমি আবার পীড়িত হয়ে পড়ব যে! কঠিন পীড়া—চেতনা লোপ পাবে—বিষম জ্বর—বিকার—

ধীমানের মুখে কৌতুক ফুটে উঠল। বললে, তাই যদি হয়, তবে ভিষগাচার্যই থাকবেন। আমি তো ভিষক নই, আমাকে একাই ফিরতে হবে।

কর্ণভূষা দুলয়ে স্বাতী বলে উঠল, একাই ফিরতে হবে! কেন এত তাড়া কিসের শুনি?

পদ্মের আরও দুটো পাপড়ি ছিঁড়ে স্বাতী সবেগে জলে নিক্ষেপ করলে। মৃদু হেসে ধীমান বললে, যেতে যখন হবেই তখন দেরি করেই বা লাভ কি রাজকুমারী? আমি বিদেশি পথিক, তোমার রাজ্যে এসেছিলাম নেহাত দৈবের টানে। কুশলনগরে আমার যেটুকু কাজ ছিল, ফুরিয়েছে। এবার আমি ফিরে যাই।

ধীমানের মুখের ওপর থেকে স্বাতী দৃষ্টি সরিয়ে নিল। চাঁদের ওপর পাতলা মেঘের মতো একটু ম্লান ছায়া পড়ল তার মুখখানিতে। কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে বললে, জীবনে শুধু কাজটাই কি সব? মানুষের সাথে মানুষের পরিচয়—সেটা কি এতই মূল্যহীন, এতই অবহেলার বস্ত?

আমি তা বলিনি রাজকুমারী। তবে তোমার—আমার ক’টা দিনেরই বা পরিচয়—কতটুকুই বা তার স্থায়িত্ব?

তোমার হাতের ওই পদ্মের পাপড়িগুলি ঝরতে ঝরতে যেমন একসময় শুধু মৃণাল—ডাঁটাটুকুই থাকবে, তেমনি আমাদের এই পরিচয়ের স্মৃতিটুকু দিনে দিনে মুছে গিয়ে শুধু তোমর পীড়ার কথাটুকুই মনে থাকবে—আর কিছু নয়।

স্বাতীর অধর স্ফুরিত হয়ে উঠল। জলের দিকে দৃষ্টি রেখে বললে, এটা পুরুষের কথা, নারীর কথা নয়। যার রক্তধারা এই দেহে বইছে, স্বাতী তাকে কোনওদিনই ভুলতে পারবে না। রক্তের ঋণ ভোলা যায় না।

ধীমান বললে, তার পরিবর্তে আমিও তো কিছু পেয়েছি রাজকুমারী—তোমার মধুর সঙ্গ, তোমার সহৃদয় ব্যবহার, তোমার অযাচিত করুণা—

থামো! চকিতে মুখ তুলে তাকাল স্বাতী। ধীমানের মুখের ওপর বড়—বড় কালো চোখের পূর্ণ দৃষ্টি মেলে বলে উঠল, আমার কাছ থেকে শুধু কি সহৃদয় ব্যবহারই পেয়েছ? আর কিছুই পাওনি? ভালো করে চেয়ে দেখো তো আমার পানে। এ—মুখে কি শুধু অযাচিত করুণাই লেখা আছে? একবার নিজের মন দিয়ে আমার মনকে দেখার চেষ্টা করো ধীমান।

স্বাতীর সেই জ্যোৎস্নামাখা অপরূপ মুখের পানে চেয়ে তার সেই কাজলঘন দুই চোখের তারায় ধীমানের সব কথা যেন মুহূর্তে ডুবে তলিয়ে গেল। দুটি তরুণ মনে বাজতে লাগল একই বাঁশি। রাজকুমারীর একখানি করপল্লব নিজের হাতে তুলে নিয়ে মৃদু স্বরে ডাকলে, স্বাতী!

আবেগে, আবেশে, বিহ্বলতায় স্বাতীর মুখখানি ভীরু পাখির মতো আশ্রয় নিল ধীমানের প্রশস্ত বুকে।

কানে কানে কথা বলার মতো ধীমান বললে, কিন্তু এর পরিণাম কী স্বাতী?

পরম সুখে ধীমানের বক্ষলগ্না হয়ে স্বাতী চুপি—চুপি বললে, জানি না, জানতেও চাই না। শুধু জানি যে স্বাবতী আর ধীমানকে জন্মজন্মান্তরেও কেউ বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।

এ দৃশ্য দেখে হিংসুক পাপিয়া সুরে—সুরে আকাশ ভরিয়ে বলে উঠল, চোখ গেল!

শুধু পাখির চোখ নয়, দিঘির তীরবর্তী একটা লতাকুঞ্জের ফাঁকে মানুষেরও একজোড়া চোখ তখন ঈর্ষা আর বিদ্বেষের জ্বালায় দু’টুকরো অঙ্গারের মতোই জ্বলছে।

চাঁদ ঢলে পড়ল পশ্চিমে। শ্বেত পাথরের ঘাটে এসে ভিড়ল ময়ূরপঙ্খি। সোপান বেয়ে স্বাতী আর ধীমান এসে দাঁড়াল একটা বকুলতরুতলে। দু’জোড়া অধর কাছাকাছি হল, তৃষ্ণা এসে মিশল সুধায়। তারপর ধীমানের দীর্ঘ মূর্তি দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই দিকে তাকিয়ে মধুর আবেশে মগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল স্বাতী।

হঠাৎ পুরুষ গলায় কে যেন বলে উঠল, বাঃ, চমৎকার! এমন প্রণয়দৃশ্য রঙ্গশালাতেও দেখা যায় না।

চমকে উঠে স্বাতী বিদ্যুৎবেগে ফিরে তাকাল। দেখলে লতাকুঞ্জের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে নাতিদীর্ঘ বলিষ্ঠদেহ এক সৈনিক—যুবা। নগরকোটাল অশনি। তার ছোট—ছোট চোখের পিঙ্গল তারায় আর তামাটে বর্ণের মুখমণ্ডলে ঝিলিক দিচ্ছে একটা ক্রুর বিদ্রূপের ইঙ্গিত।

স্বাতী ভ্রূকুটি করলে,—তুমি এখানে কেন?

ঠিক আশা করোনি আমাকে, না রাজকুমারী? ধাতব আওয়াজের মতো অশনির কণ্ঠস্বর। সেই গলায় সে আবার বললে, নগরকোটালের কাজই হল চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। কিন্তু এই নিশীথে শত্রুরাজ্যের এক বিদেশির সঙ্গে রাজকুমারী স্বাতীর নৌ—বিহার দেখতে হবে, এতটা আমিও আশা করিনি। প্রেম বড় বিষম বস্তু দেখছি।

স্বাতীর মুখ রক্তাভ হয়ে উঠল। আদেশের সুরে বললে, তুমি এখান থেকে যাও অশনি।

হ্যাঁ, যা দেখবার দেখা হয়েছে, এবার আমি যাই। শুধু একটা কাজ বাকি রইল। কাল প্রভাতে নৌ—বিহারের সংবাদটা মহারাজের গোচর করা।

নগরকোটালের সুচোলো গোঁফের নিচে বাঁকা হাসি দেখা দিল।

তুমি মহারাজকে এই কথা বলবে।—স্বাতীর মুখ থেকে সমস্ত রক্তিমা মুছে গেল।

বলব বইকি! বলা আমার কর্তব্য।

যাবার জন্যে অশনি পা বাড়াল। মুহূর্তের জন্যে কী যেন ভাবলে স্বাতী। তারপর নিজের গলা থেকে সাতনরী মুক্তাহার খুলে ডাকলে, দাঁড়াও অশনি, এই মুক্তাহার দিয়ে কি তোমার মুখ বন্ধ হবে না?

অশনি লোভী দৃষ্টিতে একবার মুক্তাহার, একবার রাজকুমারীর দিকে তাকাল। বললে, অশনির মুখ বন্ধ করতে হলে এর চেয়েও মূল্যবান সামগ্রী দরকার।

কী সে?

রাজকুমারী স্বাতীর প্রণয়।

অসহ্য ঘৃণায় কালো চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। গ্রীবা বাঁকিয়ে চাপা তীব্র স্বরে স্বাতী বলে উঠল নগরকোটাল রাজভৃত্য ছাড়া কিছুই নয়। ভৃত্যের স্পর্ধার একটা সীমা থাকা উচিত।

দ্বিতীয়বার অশনির দিকে না তাকিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে স্বাতী চলে গেল। আর তামাটে বর্ণের মুখে চিতাবাঘের ক্রুরতা। আর পিঙ্গল চোখে শৃগালের ধূর্ততা নিয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইল অশনি।

ধীরে—ধীরে পাতলা হয়ে এল ধোঁয়ার কুণ্ডলি, মিলিয়ে গেল দৃশটা।

.

আজ সব মনে পড়ছে ইরার। জন্ম—জন্মান্তরের স্মৃতি!

চঞ্চল হয়ে সে এল সেনাপতি ধীমানের পেটিকার পাশে। খুলে দিল ডালা। এই তো সেই ধীমান, যে তাকে ডাকছিল একটু আগে। তবে কেন এমন চিরস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে সে? ব্যাকুল হয়ে ইরা ডাকতে লাগল, জাগো ধীমান, জাগো। আমি তোমার স্বাতী, তোমারই চিরকালের সঙ্গিনী। আমি এসেছি, জাগো তুমি।

জাগল না ধীমান, ভাঙল না তার যুগ—যুগান্তরের ঘুম। তবে কেন ডেকেছিল সে জন্মজন্মান্তরের আকুলতা নিয়ে? ডাক শুনে ইরা তো দেরি করেনি এক মুহূর্ত! ইরা কি তবে রাজকুমারী স্বাতী নয়? তাই সাড়া দিল না ধীমান? কে বলে দেবে তাকে?

পেটিকার ডালা আবর বন্ধ করে দিয়ে ক্লান্ত ইরা ফিরে চলল।

.

মস্তবড় মাটির ঢিবিটার পাশ দিয়ে ইরা মাঠের রাস্তায় পা দিতেই ওপাশ থেকে আর একটি মানুষ এগিয়ে এল তার সামনে।

আপনি! এমন সময়ে।

শেষ রাতের নীলচে অন্ধকারেও ইরা চিনতে পারল লোকটা সুজনলাল। তেমনি খাঁকি হাফপ্যান্ট আর হাফশার্ট পরনে। হাতে একটা ছোট বেতের লাঠি। সুজনলাল আবার প্রশ্ন করলে, বেড়াতে বেরিয়েছেন নাকি?

ইরা শুধু ঘাড় নাড়লে।

কিন্তু ভোর হতে এখনো দেরি আছে যে! জংলা জায়গা, শেষ রাতে একা—একা না বেরনোই ভাল, চলুন, বাংলোয় পৌঁছে দিই।

উঁচু—নিচু মাঠের রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি চলতে চলতে সুজনলাল শুধোলে, প্রিয়তোষবাবু আসেননি?

না, তা, কে ডাকিনি।

সুজনলাল একবার চোখের কোণ দিয়ে তির্যক দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকালে। তারপর বললে, দোষ যদি না নেন তো একটা কথা বলি। আপনি ডাকলেও প্রিয়তোষবাবু আসতে পারতেন না। একটু আগে চৈতির ধারে কুলি—কামিনদের ধাওড়ায় তাঁকে ঘুরতে দেখেছি। আপনার বাবা মস্ত মানী লোক, তাই বলছি—

ও—কথা থাক সুজনবাবু। ইরার ভ্রূ—দুটো কুঁচকে উঠল।

সুজনলাল অপ্রস্তুত হয়ে উঠল। আর একবার বাঁকা চোখে ইরাকে দেখে নিয়ে বললে, থাক। তবে একটা কথা দেবীজিকে জানিয়ে রাখি, আর কোনওদিন বেড়াতে বোরোবার ইচ্ছে হলে সুজনলালকে স্মরণ করবেন। আপনার কোনও কাজে লাগতে পারলে নিজেকে আমি বাদশার মতো সুখী মনে করব।

ইরা ছোট্ট করে জবাব দিলে, ধন্যবাদ। দরকার হলে বলব।

ইরার এত কাছে আসবার সুযোগ ইতিপূর্বে সুজনলাল পায়নি। ইরার চারপাশের হাওয়ায় অতি মৃদু একটা মাদক সুরভি মিশে আছে। সেটা তার কেশের, না বেশের, না অঙ্গের, সুজনলাল তা জানে না। সেটা তার কেশের, না বেশের, না অঙ্গের, সুজনলাল তা জানে না। কিন্তু সে—গন্ধে নেশা লাগল তার রুক্ষ যৌবনে। সুজনলাল বললে, দেখুন, আমি ঠিকাদার মানুষ, বিদ্যে—বুদ্ধি তেমন বেশি কিছু নেই। আদব—কায়দাও হয়তো তেমন জানি না। তবে সব মানুষের বুকের ভেতর যেটা থাকে, সেটা আমারও আছে। সেদিক থেকে আমি যে কারও চেয়ে কম নই, কোনওদিন সুযোগ পেলে তা প্রমাণ করে দেব।

ইঙ্গিতটা বুঝতে ইরার দেরি হল না। স্বল্পভাষী এই মানুষটার মুখে হঠাৎ এতখানি উচ্ছ্বাস শুনে সে যেমন অবাক হয়ে গেল, তেমনি বিতৃষ্ণাও কম হল না। তিক্ত গলায় সে বললে, কোথায় কি বলতে হয়, আপনার তা জানা নেই সুজনবাবু।

সুজনলাল একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই একটা চেনা গলার ডাক শোনা গেল : ইরা! ইরা।

অদূরে প্রিয়তোষের দীর্ঘ মূর্তি গেল। পরনে ব্রিচেস, হাতে রাইফেল।

দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল ইরা। সুজনলাল আর এগোলে না। তার কালো ঠোঁটের ফাঁকে চকচকে সাদা দাঁতগুলো দেখা যেতে লাগল।

.

ফটকের কাছে উৎকণ্ঠিত মুখে দাঁড়িয়েছিলেন প্রতাপবাবু আর জয়া। আকাশে তখন লালের ছোপ লেগেছে! যাক, প্রিয়তোষ তাহলে খুঁজে পেয়েছে ইরাকে!

ভয়ানক ক্লান্ত লাগছিল ইরার। মানুষের ওপর হিপনোটিজম—এর প্রভাব পড়লে যেমন লাগে, ঠিক তেমনি অবসন্ন বোধ হচ্ছিল। প্রিয়তোষের বাহুতে ভর দিয়ে সে যখন কাছে এসে দাঁড়াল, তার হাতের সেই ধূপদানিটা লক্ষ করে অধ্যাপক প্রতাপের বুঝতে আর বাকি রইল না, ইরা কোথায় গিয়েছিল। একটা আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল তাঁর পিতৃহৃদয়। তাঁর শিক্ষিত মনেও এই ধারণা হল, একটা দুষ্ট গ্রহ, একটা অশুভ প্রেতাত্মা যেন চক্রান্তের জাল বুনতে শুরু করেছে ইরার চারপাশে।

অধ্যাপক ব্যাকুল হয়ে কন্যাকে বুকে জড়িয়ে বলতে লাগলেন, বল, ওই ভয়ঙ্কর জায়গায় আর কখনও যাবি নে? বল ইরা— শপথ কর—

ক্লান্ত কণ্ঠে ইরা শুধু বললে, আর যাব না।

 * * *

এ বিচিত্র রহস্য জাল ভেদ করতেই হবে। জানতে হবে এ অমঙ্গলের মূল কোথায়? প্রাণময়ী ইরা কেন গিয়েছিল প্রাণহীন মৃতের অভিসারে? কীসের টানে? জানতেই হবে এ—রহস্য!

ধূলিমলিন সেই প্রাচীন তিব্বতীয় পুঁথির কীটদষ্ট পাতায় পাতায় অধ্যাপক প্রতাপ সেই রহস্যের সন্ধান করে চলেছেন। কার্তিকের আকাশ রূপালি রোদে ঝিলমিল করছে। ভীম পাহাড়ের কোলে প্রতিদিনের মতো কুলিরা খননকার্য চালিয়ে যাচ্ছে, ক্রেনের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমবেত গলার একটানা সুর জানলা দিয়ে ভেসে আসছে। একটা বুনো পোকা অদ্ভুত গুঞ্জন তুলে লাইব্রেরি ঘরের কাচের সার্শিতে মাথা ঠুকছে। অধ্যাপক প্রতাপ কিছু দেখছেন না, কিছু শুনছেন না। সমস্ত মন দুই চোখে কেন্দ্রীভূত করে তিনি পড়ে চলেছেন :

কাঞ্চনপুরে ফিরে যাওয়ার দিন সমাগত। বিশ্রাম—ভবনে দর্ভপাণি যাত্রার উদ্যোগ করছেন, এমন সময় দ্বারে দেখা দিল দুজন সশস্ত্র সাস্ত্রি। ভিষগাচার্যকে মহারাজ স্মরণ করেছেন।

তার জন্যে সশস্ত্র সান্ত্রি পাঠাবার আবশ্যক কী! দর্ভপাণি ভ্রূ—কুঞ্চিত করলেন।

মহারাজ চন্দ্রপাল আপন কক্ষে পদচারণা করেছিলেন। কক্ষের একপাশে দাঁড়িয়ে নগরকোটাল অশনি। হাতে চর্ম—নির্মিত কশা। দুই সশস্ত্র সান্ত্রীর মাঝখানে বন্দীর মতো দর্ভপাণি এসে দাঁড়ালেন! চন্দ্রপালের মুখ আজ আর প্রসন্নতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল না।

দর্ভপাণি বললেন,—মহাদেবী চামুণ্ডার প্রসাদে কুশলনগরের কল্যাণ হোক।

চন্দ্রপালের কণ্ঠ রূঢ় শোনাল, প্রভু তথাগতের ভক্ত আমি, দেবদেবীর অনুগ্রহে আমার প্রয়োজন নেই।

দর্ভপাণি একবার তাচ্ছিল্যভরে তাকালেন। স্বাভাবিক নীরস স্বরে বললেন, মায়ের করুণা ছেলের প্রয়োজন—অপ্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে না মহারাজ। যাক, স্মরণ করেছেন কেন?

আপনার শিবিকা প্রস্তুত ভিষগাচার্য!

আমিও প্রস্তুত মহারাজ। কাঞ্চনপুরে বহু দরিদ্র রোগী আবার পথ চেয়ে রয়েছে। ভিষগাচার্যের কাছে রাজার ও প্রজার জীবনের দায়িত্ব সমান।

আপনার পারিশ্রমিক পাঁচ সহস্র স্বর্ণমুদ্রা রাজকোষ থেকে নিয়ে যাবেন। আশা করি কাঞ্চনপুরের ভিষগাচার্যের কাছে কুশলনগরের আর কোনও ঋণ রইল না।

রক্তাভ দুই চক্ষু মেলে ভিষগাচার্য তাকালেন। বললেন, রইল বইকি মহারাজ!

কী সে ঋণ?

ধীমানের রক্তের ঋণ। আপনার অঙ্গীকার নিশ্চয় ভুলে যাননি।

চন্দ্রপালের মুখ স্তব্ধ গাম্ভীর্যে থমথম করতে লাগল। ক্ষণকাল নীরব থেকে বললেন, না ভুলিনি। কিন্তু সেই ঋণের মূল্য নেওয়ার আগে ধীমান যে গুরুতর অপরাধ করেছে, তার শাস্তি নিতে হবে।

দর্ভপাণি বিস্মিত হয়ে বললেন, গুরুতর অপরাধ! ধীমান করেছে?

হ্যাঁ, আপনার পালিত পুত্র ধীমানই করেছে।

কী এমন অপরাধ, শুনতে পাই?

চাপা ক্রোধে আর ঘৃণায় চন্দ্রপালের গৌরবর্ণ মুখ আরক্তিম হয়ে উঠল। যথাসম্ভব সংযত কণ্ঠে বললেন, রাজকুমারী স্বাতীকে ছলাকলায় ভুলিয়ে, দুশ্চরিত্র, লম্পট ধীমান তার সম্ভ্রমহানির চেষ্টা করেছে।

অশনির তামাটে বর্ণের মুখে আর পিঙ্গল চক্ষু—তারকায় একটা ধূর্ত কুটিলতা চিকচিক করে উঠল। সেই দিকে একবার বক্র কটাক্ষে তাকিয়ে দর্ভপাণি প্রশ্ন করলেন, এ অভিযোগ কে করেছে? রাজকুমারী স্বাতী?

না, নগরকোটাল অশনি। নিশীথ রাত্রে তাদের দুজনকে নৌ—বিহার করতে দেখেছে। কুশলনগরের রাজপরিবারের কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা যে করে, চন্দ্রপাল তাকে ক্ষমা করে না। আপনাকে একাই স্বদেশে ফিরে যেতে হবে ভিষগাচার্য।

দর্ভপাণি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, নগরকোটাল যখন দুজনকে একত্রে নৌ—বিহার করতে দেখেছেন, তখন বোঝাই যাচ্ছে যে দুজনে স্বেচ্ছায় মিলিত হয়েছিল। আর পরস্পরের প্রতি অনুরাগ না জন্মালে একের ডাকে অপরে সাড়া দেয় না মহারাজ। যৌবনের ধর্মই হল প্রেম। এর মধ্যে অপরাধটা কোথায়?

যে যৌবন অসংযত, তাকে দণ্ডিত করাই উচিত।

বেশ, তাই যদি হয়, তবে এ—অপরাধের একমাত্র দণ্ড হওয়া উচিত ধীমানের সঙ্গে রাজকুমারী স্বাতীর বিবাহ। এর ফলে ধীমানের কাছে আপনার ঋণও শেষ হয়ে যাবে মহারাজ।

মেঘগর্জনের মতো চন্দ্রপাল বলে উঠলেন, স্তব্ধ হোন ভিষগাচার্য। আপনার ধৃষ্টতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি আমি। স্বাতীর সঙ্গে বিবাহ দেব আমি ওই ধীমানের?

অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক ভাবে দর্ভপাণি উত্তর করলেন, দিলেই বা! যদিও মানুষের পরিচয় তার রক্তে নয়, মনুষ্যত্বে, তবুও আমি পূর্বেই জানিয়েছি, ধীমানের দেহে রাজরক্ত আছে। ধীমান একজন রাজকুমার।

রাজকুমার! সত্য বলছেন ভিষগাচার্য? বলুন, ধীমান কে?

কাঞ্চনপুরের অধীশ্বর মহারাজ মহানন্দের পুত্র।

চন্দ্রপাল যেন সহসা উদ্যত—ফণা সাপ দেখলেন সামনে। মহানন্দের পুত্র ধীমান। তাঁর পরম শত্রু মহানন্দ। কিন্তু বিশ্বাস হল না চন্দ্রপালের। দেখতে—দেখতে সন্দেহের রেখা পড়ল চন্দ্রপালের ললাটে। বললেন, দেশে—দেশে জানে মহানন্দ অপুত্রক, রানি ক্ষণপ্রভার গর্ভে কোনও সন্তান জন্মায়নি। সত্য গোপন করার চেষ্টা করবেন না ভিষগাচার্য!

পুরুষ কণ্ঠে দর্ভপাণি উত্তর করলেন, দর্ভপাণি কুটিল রাজনীতির ব্যবসা করে না। সত্য গোপন করা তার স্বভাববিরুদ্ধ। ধীমান রানি ক্ষণপ্রভার সন্তান নয়। মহারাজ মহানন্দের ঔরসে এক কৃষাণীর গর্ভে তার জন্ম।

কৃষাণীর গর্ভে? বিবাহ হয়েছিল?

হয়েছিল। একান্ত গোপনে।

প্রমাণ?

প্রমাণ এই দীন ব্রাহ্মণ। সে—বিবাহে আমিই পুরোহিতের কাজ করেছিলাম। বিবাহের পাঁচ মাস পরে ধীমানের জন্ম হয়। মহারাজ মহানন্দের জ্ঞাতিরা সিংহাসনের নবজাত উত্তরাধিকারীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করায়, আমি শিশু ধীমানকে নিজের পুত্র বলে পরিচয় দিয়ে পালন করতে থাকি। কাঞ্চনপুরের সিংহাসন অবশ্য আজও সে পায়নি, তবু একথা সত্য যে ধীমানই কাঞ্চনপুরের রাজকুমার।

মহারাজ চন্দ্রপালের গৈরিক সংযমের আড়াল থেকে দ্বিতীয় রিপু তার বন্য রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করল। চিৎকার করে তিনি বলে উঠলেন, থামুন।

তারপর পুনরায় পদচারণা করতে করতে অতিরিক্ত শান্ত কণ্ঠে চন্দ্রপাল বলতে লাগলেন,—সমস্তটা তাহলে আপনারই চক্রান্ত? আপনি জেনে—শুনে একটা নগণ্যা কৃষাণীর গর্ভজাত সন্তানের অপবিত্র রক্তে আমার স্বাতীর রক্ত কলঙ্কিত করেছেন। আপনারই প্রশ্রয়ে ধীমানের দুঃসাহস হয়েছিল রাজকুমারীর সঙ্গে প্রেমাভিনয় করতে। কাঞ্চনপুরের সিংহাসনের আশা যখন নেই, তখন কুশলনগরের রাজমুকুটই বা মন্দ কী! কেমন, এই উদ্দেশ্য নিয়েই কাঞ্চনপুর থেকে আপনি এসেছিলেন, না ধূর্ত ব্রাহ্মণ?

দর্ভপাণির ভাস্বর রক্তাভ দুই চক্ষু ধিক করে একবার জ্বলে উঠল। স্বভাব—নীরস কণ্ঠে তিনি বললেন, মহাদেবী চামুণ্ডার প্রসাদে বহু রাজমুকুট এই দীন ব্রাহ্মণের পদতলে লুটায়। দর্ভপাণির কাছে তার মূল্য ধূলির চেয়ে বেশি নয়। রাজকুমারীর জীবন রক্ষা ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে আমি আসিনি। কিন্তু ঘটনাচক্রে যা দাঁড়াল, তাতে আপনারও যেমন হাত নেই, আমারও তেমনি নেই। সেটা শুধুই নিয়তির খেলা। রাজমুকুটের লোভে নয়, দুটি তরুণ—তরুণীর ভবিষ্যৎ সুখের মুখ চেয়ে তাই আমি রাজকুমারী স্বাতী ও ধীমানের বিবাহের প্রস্তাব করেছিলাম।

সাধু! সাধু!—মহারাজ চন্দ্রপালের ওষ্ঠপ্রান্তে নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের হাসি খেলে গেল। তিনি আবার বললেন,—এই উদার প্রস্তাবের জন্যে আপনার ঘটক—বিদায় পাওয়া উচিত ভিষগাচার্য, তাই নয় কি? আপনার উপযুক্ত পুরস্কার আমি ভেবেই রেখেছি। অশনি!

পিঙ্গল চোখের তারায় বর্বর উল্লাস নিয়ে অশনি সামনে এগিয়ে এল।

দর্ভপাণির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে চন্দ্রপাল আদেশ করলেন, নিয়ে যাও—চিরান্ধ কারাগারে—

অশনির ইঙ্গিতে ভীমকায় দুই সশস্ত্র সাস্ত্রি দর্ভপাণির দুই বাহু ধরে আকর্ষণ করলে।

মহাকালের ত্রিনয়নের মতো দর্ভপাণির রক্তাভ চক্ষু ধক ধক করে জ্বলতে লাগল। চন্দ্রপালের মুখের ওপর সেই অগ্নিময় চক্ষু রেখে বললেন, ভালো কৃতজ্ঞতার পরিচয় দিলেন মহারাজ! ইতিহাসে লেখা থাকবে।

অশনির হাতের কশা সশব্দে গিয়ে পড়ল দর্ভপাণির মুখের ওপর। রক্তাক্ত মুখে বীভৎস হেসে দর্ভপাণি বললেন, ন্যায়ের বিচার বড় সূক্ষ্ম মহারাজ! অন্যায়ের শাস্তি তোলা থাকে। সেই অমোঘ শাস্তি ধীমানের হাত দিয়েই একদিন আসবে।

চন্দ্রপাল উত্তর করলেন, তার আগে ধীমানের রক্তে কুশলনগরের রাজপরিবারের কলঙ্ক মুছে দেব।

অশনির ইঙ্গিতে সান্ত্রিরা দর্ভপাণিকে টেনে নিয়ে চলে গেল। কেউ দেখল না কক্ষের একটি গবাক্ষের পাশ থেকে একটি নারীমূর্তি ছায়ার মতো সরে গেল। সে উল্কা, রাজকুমারী স্বাতীর প্রিয়সখী।

.

রাজপুরীর পেছনে তখন আর এক দৃশ্য।

প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে রাজকুমারী স্বাতী। আর, তারই নিচে কালো অশ্বপৃষ্ঠে বসে আছে ধীমান।

স্বাতী বলছিল,—কাঞ্চনপুরের জন্য বড় মনকেমন করছে বুঝি?

মৃদু হেসে ধীমান বলল,—মন তো আমার কুশলনগরেই রইল। শুধু দেহটাই যাবে কাঞ্চনপুরে।

কুশলনগরের এই ক’টা দিন আর রাত্রি স্মরণ থাকবে কি? কাঞ্চনপুরে তোমার কত প্রিয়জন—

প্রিয়জন আমার অনেক বটে, কিন্তু প্রিয়তমা শুধু একটি।

স্বাতীর কপোলে কিংশুকের আভা লাগল। একটু ম্লান স্বরে বললে, তুমি পুরুষ, সেখানে তোমার কত কাজ, তাই নিয়েই তোমার দিন কেটে যাবে। কিন্তু আমার দিন কাটবে কী নিয়ে? না—হয় আর দু’দিন পরে যেও ধীমান।

ধীমান উত্তর দেওয়ার আগেই উল্কারই মতো ছুটে এল উল্কা। রুদ্ধশ্বাসে বললে, সর্বনাশ হয়েছে রাজকুমারী।

কী হল উল্কা? অমন করছিস কেন?

মহারাজের আদেশে নগরকোটাল ধীমানকে বন্দী করতে আসছে। এইমাত্র ওরা ভিষগাচার্যকে চিরান্ধ কারাগারে টেনে নিয়ে গেল।

পিতাকে কারাগারে নিয়ে গেল? ধীমানের চোখের দৃষ্টি ইস্পাত ফলকের মতো ঝকঝক কর উঠল।

উল্কা বললে, হ্যাঁ। এবার তোমার পালা।

বিহ্বল ব্যাকুল স্বাতী বলে উঠল, আর এক মুহূর্ত নয় ধীমান, তুমি যাও—অশনি আসবার পূর্বে তুমি এখুনি পালাও।

পালাব?—ধীমানের মুখ কঠিন হয়ে উঠল।

স্বাতীর কণ্ঠে মিনতি ঝরে পড়ল—তোমাকে পালাতেই হবে ধীমান। বর্বর অশনির অনুচরদের সঙ্গে তুমি একা পেরে উঠবে না। তুমি যাও।

মুহূর্তকাল কী যেন ভাবল ধীমান। কী এক কঠিন প্রতিজ্ঞায় তার মুখভাব কঠোর হয়ে উঠল। তারপরে বললে,—বেশ, আমি যাচ্ছি। কিন্তু নগরতোরণ যদি ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে থাকে?

আমার এই অঙ্গুরি দেখালেই তোরণরক্ষী দ্বার খুলে দেবে।

নিজের আঙুল থেকে নীলকান্তমণির অঙ্গুরিটি খুলে স্বাতী ধীমানের দিকে নিক্ষেপ করলে। সেটা নিয়ে ধীমান বললে, আমি আবার আসব স্বাতী, তুমি অপেক্ষা কোরো।

মুহূর্তে অশ্বের মুখ ঘুরিয়ে ধীমান তাকে কশাঘাত করলে। কালো বিদ্যুতের মতোই কালো অশ্ব ধূলিজাল উড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আর, সেই ধূসর ধূলিজালের দিকে সজল উৎকণ্ঠায় চেয়ে রইল স্বাতী।

.