রাজকন্যা – ১

শোরগোল এল যেখানে খননকার্য চলেছে, সেখান থেকেই। প্রায় ছ’ফার্লং দূরে। বাংলোয় বসে বৈকালি চা খেতে—খেতে প্রতাপবাবুর সঙ্গে ইরা, প্রিয়তোষ আর জয়াও স্পষ্টভাবে শুনতে পেল। প্রতাপবাবু বাংলোর বারান্দা থেকে দু’—একবার তাকালেন ঘটনাস্থলের দিকে। মাঝে কোনও অন্তরায় নেই বলে খননকার্যের জায়গাটা বারান্দা থেকে সোজা দেখা যায়।

এ—অঞ্চলটা বাংলা—বিহারের সীমারেখার ওপরে বললেই চলে। এখানেই এসেছেন দেশ—বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক প্রতাপচন্দ্র সেন মজুমদার, গভর্নমেন্ট থেকে সাহায্য নিয়ে। বহু পুরাতন ইতিহাসের ধূলি—মলিন পৃষ্ঠা ঘেঁটে তাঁর দৃঢ় ধারণা হয়েছে যে, পাল রাজত্বের শেষদিকের কিছু—কিছু কীর্তি, পাল সভ্যতার কিছু—কিছু অবলুপ্ত চিহ্ন এই অঞ্চলেই ভূগর্ভে প্রোথিত হয়ে আছে। বাংলো থেকে সোজা পশ্চিমমুখো তাকালেই ধোঁয়াটে রঙের যে পাহাড়টার গায়ে দৃষ্টি ঠেকে যায়, তারই কোল ঘেঁষে অনেকখানি জায়গা জুড়ে প্রতাপবাবুর নেতৃত্বে লুপ্তোদ্ধারের কাজ চলেছে। কাজটা চলেছে রীতিমতো সমারোহের সঙ্গে। স্ত্রী—পুরুষ মিলে কুলি খাটছে প্রায় শ’দুয়েক। তাছাড়া অন্যান্য স্টাফ তো আছেই।

মাইল খানেক দূরে খরস্রোতা চৈতি নদী। তারই এপারে অস্থায়ী কুলি ধাওড়া তৈরি হয়েছে। খানিকটা তফাতে স্টাফের জন পনেরো বাবু তাঁবু খাটিয়েছেন। আর এই কাঠের বাংলোটা দখল করেছেন প্রতাপবাবু নিজে, তাঁর একমাত্র মাতৃহীন কন্যা ইরা, ইরার দূর—সম্পর্কীয় মাসতুতো বোন জয়া এবং ঠাকুর—চাকর—বেয়ারা। প্রিয়েতোষ ওদের কেউ নয়, তবু আপনজন। এক সময় কলেজে প্রতাপবাবুর প্রিয় ছাত্র ছিল। আজ দিন তিনেক হল এক জোড়া বন্দুক নিয়ে এখানে এসেছে শিকারের নেশায়। প্রিয়তোষের প্রকৃতির মধ্যে চিরকালের একটা যাযাবর রয়েছে, যে তাকে স্থান থেকে স্থানান্তরে ক্রমাগত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। একমাত্র প্রতাপবাবুর ছোট্ট পরিবারেই বারে—বারে তাকে দেখা যায়। কিন্তু এই রাজনগরে সে যেমন হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছে, তেমনি আবার কবে চলে যাবে, তার ঠিক—ঠিকানা নেই।

সুগঠন, সুদর্শন অথচ রুক্ষ চেহারার এই নবীন যুবার প্রতি অধ্যাপক প্রতাপবাবুর বড় স্নেহ। বৈকালি চায়ের টেবিলে বসে প্রিয়তোষকে তিনি পাল—সভ্যতার ওপর বৌদ্ধ—প্রভাব কতখানি পড়েছিল, সযত্নে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন। এ—যাবৎ মাটি খুঁড়ে প্রাচীন স্থাপত্যের যে নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, তার গঠনে ও কারুকার্যে বৌদ্ধ—শিল্পের প্রভাব বিশেষভাবে দেখা গেছে।

প্রিয়তোষ মন দিয়েই শুনছিল। মাঝে—মাঝে তার ঝকঝকে চোখদুটো পুডিং—কাটতে—ব্যস্ত ইরার মুখের ওপর দিয়ে অলসভাবে ঘুরে আসছিল।

প্রতাপবাবু বলেছিলেন,—এই রাজনগর জায়গাটা বেশ কয়েক শতাব্দী আগে কি ছিল জানো প্রিয়তোষ? এর নাম ছিল কুশলনগর, আর ওই চৈতি নদীর ঠিক ওপারে এখন যেটা বিহারের এলাকা—সেখানে ছিল কাঞ্চনপুর। যৌবনে দুই রাজ্যের রাজায় প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। দুজনেই ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক। কিন্তু যৌবন অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুশলনগরের রাজা মহারাজ চন্দ্রপালের কী যে হল, ধর্ম ত্যাগ করে তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিলেন। আর এই নিয়েই বাধল কাঞ্চনপুরের রাজা মহানন্দের সঙ্গে তাঁর বিরোধ। বন্ধু হয়ে দাঁড়াল প্রবল শত্রু। সে—ইতিহাস সবটা আমার জানা হয়নি, তবু যেটুকু জেনেছি বলি শোনো প্রিয়তোষ। শোন মা ইরা। জয়া, তুমিও শোনো মা।

কিন্তু শোনা কারওরই হল না। ঠিক এই সময়েই এল কুলিদের শোরগোল। প্রতাপবাবু একবার সেদিকে তাকিয়ে ইতিহাসের গল্প আবার ফাঁদবার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু কুলিদের সমবেত হল্লা তাঁকে আর সে সুযোগ দিল না। গোলমালাটা ক্রমেই বাড়ছে।

প্রতাপবাবুর সঙ্গে—সঙ্গে এবার বাকি তিনজনও তাকাল যেখানে খননকার্য চলেছে। প্রতাপবাবুর দৃষ্টিতে কিছু জিজ্ঞাসা, কিছু উদ্বেগ। ইরার চোখে ভয়ের ছায়া, জয়ার চোখে একটু সন্দেহ। আর, প্রিয়তোষের ঝকঝকে দুই চোখে নিছক কৌতূহল।

এমন সময় দূরে দেখা গেল শোলা—হ্যাট মাথায় খাকি হাফ শার্ট ও হাফ প্যান্ট পরা একটি মূর্তি এদিকপানে একরকম ছুটেই আসছে।

কপালে হাত রেখে প্রতাপবাবু একাগ্র দৃষ্টিতে দেখলেন। বললেন, সুজনলাল না?

চিনতে ভুল হয়নি তাঁর। একটু পরে বাংলোর বারান্দার নিচে যে এসে দাঁড়াল, সে সুজনলালই বটে। কুলিদের ঠিকাদার। জাতে বিহারি ছত্রি। কিন্তু বিহার তার মাতৃভূমি হলেও সে মানুষ হয়েছে বিমাতা বাংলার কোলে। তাই বাংলা কথা মোটামুটি সে ভালোই বলে। মাঝারি দৈর্ঘ্যের অত্যন্ত বলিষ্ঠ চেহারা। রোদে—জলে কুলি খাটিয়ে গায়ের রঙটা ব্রোঞ্জের মতো গাঢ় তামাটে হয়ে গেছে। ঈষৎ চাপা নাক, চওড়া চোয়াল আর পিঙ্গল চোখ তার মুখে কেমন একটা জেদি চরিত্রের ছাপ এনে দিয়েছে।

বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে সে অভিবাদনের ভঙ্গিতে টুপিটা খুলে নিলে। দেখা গেল, ঈষৎ বাদামি রঙের কুঞ্চিত চুলগুলো তার ঘামে ভিজে উঠেছে।

প্রতাপবাবু বললেন, কী ব্যাপার সুজনলাল?

সুজনলাল রিপোর্ট করলে, মাটি খুঁড়তে—খুঁড়তে গতকাল যে দালানটা বেরিয়েছিল, তারই মাঝখানে একটা বড় চৌকা পাথর শাবলের ঘায়ে সরে যায়। ফণা তুলে বেরিয়ে আসে একজোড়া বিষধর সাপ। কুলিরা অবশ্য তখনই তাদের মেরে ফেলেছে। কিন্তু তার পরই বেরুতে থাকে ফিকে হলুদ রঙের একরকম ধোঁয়া। ধোঁয়াটা বোধ করি বিষাক্ত, যার ফলে পাঁচ—সাতজন কুলি অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। যাই হোক, হলুদ রঙের ধোঁয়াটা বেরিয়ে গেলে সুজনলাল টর্চ নিয়ে দেখে, চৌকো পাথরের নিচে একসার সিঁড়ি সোজা ভূগর্ভে নেমে গেছে।

সিঁড়ি!

উত্তেজনায় কেঁপে গেল অধ্যাপকের গলা।

আজ্ঞে হ্যাঁ। তার ভেতরে কী বা কে আছে, তা একমাত্র রামই জানেন।

সুজনলাল তাই জানতে এসেছে, সদ্য—আবিষ্কৃত সিঁড়ির মুখটা সে খোলা রাখবে, না চৌকো পাথরটা আবার চাপা দেবে।

অধ্যাপক বললেন—আমি নিজে না দেখে কিছুই বলতে পারছি না সুজনলাল। তুমি এগোও, আমি আসছি।

সুজনলাল যাবার জন্যে পেছন ফিরতেই ইরা তাকে ডাকলে। মিষ্টি সৌজন্যের হাসি হেসে বললে, আসুন সুজনবাবু, এক কাপ চা খেয়ে যান। ভারি ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।

সুজনলালের কালো ঠোঁটের ফাঁকে চকচকে সাদা দাঁত দেখা গেল। হেসে বললে, মাপ করবেন দেবীজী! সাপ আর ধোঁয়া দেখে কুলিরা ভয় পেয়েছে। এখুনি গিয়ে না সামলালে তারা হয়তো কাজ ফেলে পালাবে।

সুজনলাল আর দাঁড়ালে না।

অধ্যাপক ডেকে বললেন, আমি যাওয়ার আগে কেই যেন সিঁড়িতে না পা দেয়।

যেতে—যেতে সুজনলাল উত্তর দিলে, তাই হবে স্যার।

পুডিং পরিবেশন করতে করতে ইরা বায়না ধরলে, আমি যাব বাবা তোমার সঙ্গে।

ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে! না মা, তুমি মেয়ে। অজানা বিপদের মধ্যে তোমার গিয়ে কোনও লাভ নেই।

মেয়ে বলে কি আমি মাটির পুতুল? আমি যাবই।

জয়া বলে উঠল, বারে, তাহলে আমিই বা বাদ যাব কেন মেসোমশাই?

অধ্যাপক বললেন, তাহলে প্রিয়তোষ, তুমিই বা বাদ যাও কেন?

দুই চোখে স্নিগ্ধ আগ্রহ নিয়ে ইরা বললে, চলো না প্রিয়তোষ।

নিতান্ত নির্লিপ্তের মতো প্রিয়তোষ জবাব দিলে, সরি! আজ আমার চৈতির ধারে শাল—জঙ্গলে শিকারের প্রোগ্রাম।

ইরার মুখে অভিমানের ছায়া পড়ল।

.

খনন—কার্যের জায়গায় মেয়েদের নিয়ে অধ্যাপক যখন পৌঁছলেন, তখন বেলা পড়ে এসেছে। ধোঁয়াটে রঙের পাহাড়টার রঙ হয়েছে তখন বুনো—ভল্লুকের মতো কালো। তারই আড়াল থেকে সূর্যাস্তের সোনালি আলোর টুকরোগুলো উচু—নিচু লাল মাটির স্তূপের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

সেদিনকার মতো কুলিদের ছুটি দিয়ে সুজনলাল একা অপেক্ষা করছিল।

প্রতাপবাবু বললেন, তুমি ওপরেই থাকো সুজলনাল, সিঁড়ির মুখে একজন পাহারা থাকার দরকার। আমরা নেমে যাই।

এঁরাও যাবেন?—ইরা আর জয়ার দিকে তাকিয়ে সুজনলাল প্রশ্ন করলে।

প্রতাপবাবু বললেন, কিছুতেই ছাড়ল না।

না গেলেই বোধ হয় ভাল হত। ভেতরে গিয়ে কোনও বিপদ ঘটলে কে দেখবে?

আপনার উদ্বেগের কারণ নেই সুজনলালজী। দেখবার লোক আছে।

সকলে তাকিয়ে দেখল, প্রিয়তোষ এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ দেহ সকলের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে। পরনে ব্রিচেস, কোমরে চামড়ার খাপে রিভলভার।

ইরার মুখে সহসা যেন সূর্যাস্তের সোনা এসে লাগল।

সুজনলাল একবার প্রিয়তোষের দিকে, একবার ইরার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। কথাটা প্রিয়তোষ শান্ত বিনীত ভাবেই বলেছিল, তবু সুজনলালের মনে হল যেন একটা চাপা দম্ভ, একটা অনুক্ত তাচ্ছিল্য লুকিয়ে রয়েছে কথাগুলোর মধ্যে।

সুজনলালের মুখভাবের কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না। চওড়া চোয়াল দুটো একটু শক্ত হয়ে উঠল মাত্র।

প্রতাপবাবু ততক্ষণে এগিয়ে গেলেন সুড়ঙ্গের মুখে। তাঁর একহাতে সাত ব্যাটারির টর্চ, আরেক হাতে নিজের পিস্তল। পঞ্চাশ পার হলেও দেহ—মনে অধ্যাপক এখনো যৌবনোত্তীর্ণ হননি। দ্রুত পা চালিয়ে বাকি তিনজন তাঁকে অনুসরণ করলে।

পাথরের সিঁড়ি ফুট চারেকের বেশি চওড়া হবে না। ধাপে ধাপে পাতালের অনিশ্চিত অন্ধকারে নেমে গেছে। ফুরফুরে শীতল হাওয়া খেলছে সুড়ঙ্গের মুখে, প্রতাপবাবু শুঁকে দেখলেন, অতি সামান্য গন্ধকের গন্ধ ছাড়া আর কোনও দূষিত গন্ধ নেই এখন। সাত ব্যাটারির টর্চের তীব্রোজ্জ্বল রশ্মি ধারালো তলোয়ারের ফলার মতো অন্ধকার কেটে—কেটে একেবারে সিঁড়ির শেষ ধাপে গিয়ে পৌঁছাল।

প্রথম ধাপে পা দিয়ে প্রতাপবাবু বললেন, আগে আমি, আমার পেছনে মেয়েরা, তারপর প্রিয়তোষ। সতর্ক হয়ে নামো।

সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে বইকি। দু’পাশের পাথর বসানো দেয়ালের ফাটল দিয়ে জল চুঁয়ে—চুঁয়ে ধাপগুলো অল্পবিস্তর পিছল হয়েছে। কোথাও বা এক—আধখানা পাথরের টুকরো বৃদ্ধের দাঁতের মতো নড়বড়ে হয়ে আছে। সাবধানে নামতে লাগল সবাই।

চলাফেরার সুবিধের জন্যে জয়া পরেছে পাঞ্জাবি মেয়েদের স্টাইলে সালোয়ার আর কামিজ। আরও সুবিধের জন্যে ইরা পরেছে ঘন নীল স্ল্যাকপ্যান্ট আর সাদা সিল্কের ব্লাউজ, গুটিয়ে নিয়েছে প্যান্টের পা। তবু, কয়েকটা ধাপ নামার পর প্রিয়তোষ ধরে না ফেললে ইরার পা যেত পিছলে।

প্রিয়তোষের বাহু আশ্রয় করে নামতে নামতে ইরা তার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললে :

উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান দুর্গম পথ মাঝে

 দুর্দম বেগে, দুঃসহতম কাজে।

 শিকারি হলেও প্রিয়তোষ কাব্যচর্চা করে। সে জবাব দিলে :

 ভাগ্যের পায়ে দুর্বল—প্রাণে ভিক্ষা না যেন যাচি।

 কিছু নাহি ভয়, জানি নিশ্চয়—তুমি আছ, আমি আছি।।

.

জয়া গুনললো মোট বাহান্নটি ধাপ। বত্রিশটা ধাপের পর একটা চাতাল, তারপর বাকি ধাপগুলো খাড়া নেমে গিয়ে শেষ হয়েছে একটা বৃহৎ সমচতুষ্কোণ চত্বরে। তার ছাদটা দাঁড়িয়ে আছে তাঁর কোণে চারটে স্তম্ভের ওপর। ভূগর্ভের অনেক নিচে বলে সমস্ত জায়গাটা স্যাঁতসেঁতে, কিন্তু গুমোট গরম নয়। মাটির এত নিচেও ফুরফুরে হাওয়া খেলছে।

টর্চের আলো ফেলে অধ্যাপক লক্ষ করলেন ছাদের মাঝখানে ঝাঁঝারির মত অনেকগুলি সরু ছিদ্র। এই ছিদ্রপথের সঙ্গে বাইরের বায়ুমন্ডলের সংযোগ আছে নিশ্চয়ই।

চত্বরে পা দিয়েই একটা জিনিস দেখে সকলে অবাক হয়ে গেল। কোথাও কোনও বাতি বা প্রদীপ জ্বলছে না, অথচ স্নিগ্ধ নীলাভ আলোয় চত্বরটা ভরে আছে। সে—আলোয় তাপ নেই, কিন্তু দীপ্তি আছে।

দুই চোখে সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে অধ্যাপক ঘুরে—ঘুরে দেখতে লাগলেন, এই ঢাকা চত্বরের ছাদ, দেওয়াল, মেঝে, স্তম্ভ—সবই মনে হল লাল মর্মর জাতীয় পাথরের। অত্যন্ত সুদৃঢ় ভাবে গাঁথা! শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধাক্কাতেও টলেনি। এক দিকের দেওয়ালের মাঝখানে প্রকাণ্ড একখানা স্ফটিক—স্বচ্ছ পাথরের টুকরো গেঁথে বসানো। রঙ তার নীল হলেও অধ্যাপক লক্ষ করে দেখলেন, নীলকান্ত মণি নয়। নীলাভ আলোর ছটা এই পাথরটা থেকেই বেরোচ্ছে, কাজ করছে অনির্বাণ প্রদীপের মতো। তারই নিচে তাকিয়ে অধ্যাপকের দৃষ্টি উৎসুক হয়ে উঠল। কাছে গিয়ে ঠাহর করে দেখলেন, সেই পাষাণ—ফলকে প্রাচীন শিলালিপির মতো কী যেন সব উৎকীর্ণ। কালের স্পর্শে কিছু—কিছু অস্পষ্ট হয়ে এলেও সুপণ্ডিত অধ্যাপক পড়তে পারলেন। পাষাণ—ফলকে প্রাচীন পালি ভাষায় লেখা রয়েছে :

ধীমান নিদ্রিত, স্বাতী নিদ্রিতা,

মহাদেবীর প্রসাদে

তারা পুনরায় জাগ্রত হোক,

ওঁ হ্রীং শ্রীং চামুণ্ডায়ৈ নমঃ।।

আশ্চর্য হলেন অধ্যাপক। নানা প্রশ্ন এল তাঁর মনে। পরম বৌদ্ধভক্ত চন্দ্রপালের রাজপুরীতে মহাদেবী চামুণ্ডার কথা লেখা কেন? কে লিখেছিল গোপনে? কে ধীমান, স্বাতীই বা কে? কেন তারা নিদ্রিত?

গবেষণার খোরাক পেয়ে অধ্যাপক প্রতাপ মনে—মনে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।

শিলালিপি থেকে চোখ ফেরাতেই অধ্যাপকের চোখ পড়ল আরও দুটি বস্তুর ওপর! চত্বরের দুই দিকে যুগল স্তম্ভের মাঝখানে একটি করে সুবৃহৎ পেটিকা। শক্ত কাঠের তৈরি, জোড়ের মুখে ধাতুময় বন্ধনী, তাতে কারুকার্য করা। পকেট থেকে ছুরি বার করে অধ্যাপক কাঠের একটা ছোট অংশ অতিকষ্টে খুঁটে নিলেন, পরীক্ষা করে দেখবেন কী জাতের কাঠ, যা এখনও লোহার মতো মজবুত রয়েছে।

কিন্তু কী আছে এই দারুময় পেটিকায়? গুপ্ত ধনরত্ন? কুশল—নগরের রাজপুর—ললনাদের অলঙ্কার? না, মহারাজ চন্দ্রপালের সংগ্রহ করা অমূল্য বৌদ্ধ গ্রন্থাবলী? একটা পেটিকার ডালায় হাত দিয়ে প্রতাপবাবু সরিয়ে নিলেন। এর মধ্যে কোনও অজ্ঞাত বিপদ লুকিয়ে থাকাও বিচিত্র নয়। এখন থাক, কাল সকালে যথোচিত সতর্কতা অবলম্বন করে পেটিকা খোলা যাবে।

এবার ফিরে চলুন।

প্রতাপবাবু চমক ভেঙে তাকিয়ে দেখলেন, সিঁড়ির ঠিক নিচে সুজনলাল দাঁড়িয়ে। কখন নেমে এসেছে কে জানে। সেখান থেকেই সে আবার বললে, বাইরে রাত বাড়ছে। ক’দিন ধরে ভীমপাহাড়ের জঙ্গল থেকে বাঘের ডাকও শোনা যাচ্ছে সন্ধের পরে। তাই মনে হয়, আর দেরি না করাই ভালো।

প্রতাপবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, চলো তাহলে ফেরা যাক। বুনো জানোয়ারের উৎপাত—ভালো কথা নয়।

রিভলভার হাতে প্রিয়তোষ অলস দৃষ্টিতে একটা স্তম্ভের গায়ে একটা পাহাড়ি গিরগিটির গতিবিধি লক্ষ করছিল। সুজনলালের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললে,—আছে নাকি বুনো—জানোয়ার এখানে? দেখা পেলে মন্দ হয় না। হাতের টিপ পরখ করে নিই।

উৎসাহে সুজনলালের দিকেই রিভলভার উচিয়ে ধরল প্রিয়েতোষ। জয়া শব্দ করে হেসে উঠল, ওকি প্রিয়তোষ! হাত নামাও। বেচারি সুজনবাবু তোমার শিকার নয়।

কালো ঠোঁটের ফাঁকে সুজনলালের চকচকে দাঁত দেখা গেল। অতি বিনীত ভঙ্গিতে বললে, এমন বুনো—জানোয়ারও আছে, যে শিকারির চেয়েও চালাক। বন্দুক তোলার আগেই ঘায়েল করে দেয়। ভয় তাদেরই করা উচিত।

আর অপেক্ষা করল না সুজনলাল, সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল।

প্রতাপবাবু বললেন, চলো প্রিয়তোষ। মেয়ে দুটো সঙ্গে রয়েছে, আর দেরি করা ঠিক হবে না। আর জয়া, ইরা কই?

কেউ লক্ষ করেনি, দল থেকে ইরা কখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রতাপবাবু যে পেটিকাটিকে পরীক্ষা করছিলেন, দেখা গেল তারই বিপরীত দিকে দুই স্তম্ভের মাঝখানে অপর পেটিকার একান্ত কাছে স্থির হয়ে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে! পিছন ফিরে ছিল বলে তার মুখ দেখা যায় না, তবে চিত্রার্পিতের মতো তার দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে বোঝা যায়, কী যেন তাকে সম্মোহিত করে রেখেছে।

প্রতাপবাবু ডাকলেন, ইরা!

ইরার দেহ এতটুকু নড়ল না।

একটু অবাক হয়ে প্রতাপবাবু এগিয়ে গেলেন তার কাছে। আবার ডাকলেন, ইরা!

ইরা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। ফিরে তাকিয়ে বলল, ওটা কী সুন্দর, দেখেছ বাবা!

সমুখের দেয়ালের দিকে ইরা আবার দৃষ্টি ফেরালে ইরার দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রতাপবাবু দেখলেন। পাথরের দেয়ালে একটা কুলুঙ্গি তারই মধ্যে অদ্ভুত একটা ধাতুপাত্র। অনেকটা ধূপদানির মতো দেখতে। ওপরটা লতাপাতার নকশা—কাটা, সূক্ষ্ম জাল দিয়ে ঢাকা। পাত্রটা ধরবার জন্যে দু’দিকে দু’টো আংটা।

ইরা বায়না ধরলে, এটা আমি নিয়ে যাব বাবা, কিউরিও হিসেবে ঘরে রাখব।

প্রতাপবাবু বললেন, দাঁড়া মা, কাল ফোটোগ্রাফার এসে আগে সব জিনিসের ফোটো নিয়ে যাক, তারপর নিস। এখন চল।

টর্চের আলো দেখিয়ে আগে উঠতে লাগলেন প্রতাপবাবু। তাঁর পেছনে জয়া। সিঁড়িতে পা দিয়ে আরেকবার ফিরে তাকাল ইরা, দুই চোখ তার স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে এল। কতকটা নিজের মনেই বললে, এত চেনা লাগছে জায়গাটা। কবে যেন এসেছিলাম!

কৌতূহল—ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রিয়তোষ বললে,—এই সেরেছে! প্রত্নতত্ত্বের ভূত ঘাড়ে চাপলে এমনই হয়। শিগগির চলো বাইরে।

পাথরের দেয়াল কাঁপিয়ে হেসে উঠল প্রিয়তোষ।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে—উঠতে ভুরু কুঁচকে ইরা বললে, ঠাট্টা কোরো না। সত্যিও তো হতে পারে।

পরদিন সকালে পেটিকা দুটি খোলা হল।

প্রত্যেক ডালায় একটা করে হাঁসকল লাগানো, কিন্তু কুলুপ নেই। যেন কেউ এসে সহজে খুলবে বলেই কুলুপ দেওয়া হয়নি। গুপ্তধন রাখার এ কেমন রীতি।

কিন্তু সহজে খোলার ব্যবস্থা থাকলেও সহজে খোলা গেল না।

শক্ত ধাতুর হাঁসকল বহু শতাব্দীর অব্যবহারে অনড় হয়ে আছে। হাতের শাবল দিয়ে সুজনলাল সাবধানে কয়েকটা ঘা দিতেই মরচে ধরা হাঁসকল কাঠের ডালা থেকে খসে পড়ল। দেখতে ভারী হলেও খুলতে গিয়ে কিন্তু দেখা গেল, ডালাটা তেমন ভারী নয়! প্রতাপবাবু একাই তুলে ধরলেন প্রথম পেটিকার ডালা।

না, গুপ্তধনও নয়, প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থাবলীও নয়। মানুষ—প্রমাণ লম্বা পেটিকার মধ্যে সযত্নে রাখা সুশ্রী প্রিয়দর্শন একটি নবীন যুবার মৃতদেহ। একখানি রেশমের ধুতি ছাড়া দেহে আর কোনও বস্ত্র নেই। আবরণের মধ্যে নিরাবরণ প্রশস্ত বুকে সিঁদুরের মতো টকটকে লাল রং দিয়ে খড়গচিহ্ন আঁকা।

মৃতদেহের সর্বাঙ্গে কীসের যেন অনুলেপন, হয়তো কোনও প্রাচীন আয়ুর্বেদীয় দ্রব্যের। তারই ফলে গায়ের রং হলদে তুলোট কাগজের মতো গাঢ় পীতবর্ণ ধারণ করলেও চেহারা আজও অবিকৃত রয়েছে। বোঝা গেল, ‘মমি’ তৈরি করার পদ্ধতি শুধু প্রাচীন মিশরে নয়, সুদূর বৌদ্ধযুগে বাংলাদেশেও জানা ছিল।

কিন্তু অধ্যাপক প্রতাপের সে—কথা ভাববার অবকাশ হল না। অত্যন্ত অবাক হয়ে তিনি একবার মৃতদেহের মুখের দিকে, একবার প্রিয়তোষের দিকে তাকাতে লাগলেন। মৃত যুবাটির চেহারায় প্রিয়তোষের মুখের অনেকখানি সাদৃশ্য এল কেমন করে? সাদৃশ্য শুধু মুখে নয়, মৃত যুবাটি দৈর্ঘ্যে প্রিয়তোষেরই মতো ছ’ফুটের কাছাকাছি হবে।

অবাক সকলেই হল। প্রিয়তোষ নিজেও। হল না শুধু ইরা। অতি পরিচিত কাউকে দেখবে বলে সে যেন আশা করেছিল। মৃত যুবার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের বদলে বহুদিনের পরিচয়ের আলো জ্বলে উঠল তার চোখে। শুধু নামটাই যেন মনে পড়ছে না।

শান্ত ভাবে ইরা প্রশ্ন করলে, এ কে বাবা?

পেটিকার ডালার ভেতর দিকে খোদাই করা কয়েকটি পালি ভাষার হরফ চোখে পড়ল অধ্যাপকের। তিনি পড়লেন, ‘সেনাপতি ধীমান’।

যেন হঠাৎ স্মরণ হয়েছে এমনিভাবে ইরা উচ্চারণ করলে, ধীমান!

দ্বিতীয় পেটিকার কাছে এগিয়ে গেলেন প্রতাপবাবু। একই উপায়ে খোলা হল সেটা। এটিও একটি শবাধার। ভেতরে শুয়ে আছে অনন্ত নিদ্রামগ্না অপরূপ রূপলাবণ্যবতী একটি যুবতী। রক্তের মতো গাঢ় লাল রঙের সূক্ষ্ম একখানি রেশমি বসন পরনে। সেই রঙেরই রেশমি কাঁচলী গায়ে। হাতে স্বর্ণবলয়, গলায় মণিময় কণ্ঠহার, কানে কর্ণভূষা। ভূষণের মধ্যে সবার আগে চোখে পড়ে, মাথার সিঁথিমৌরের সঙ্গে লগ্ন বড় একখানা হীরে কপালের ওপর সন্ধ্যাতারার মতো জ্বলছে।

যুবতীর গায়ের রঙও অপর মৃতদেহের মতো গাঢ় হলুদ রঙের। অথচ মুখের নবীন লাবণ্য অবিকৃত। পাপড়ির মতো পাতলা বিবর্ণ ওষ্ঠাধর দুটি মৃদু হাসির আভাসে ঈষৎ ভিন্ন। আয়ত চোখ দুটি আধো—নিমীলিত। দীর্ঘ পক্ষরাজির আড়ালে তারা দুটি দ্যুতিহীন।

দেখা গেল যুবতীরও কপালে একটি রক্তবর্ণ ক্ষুদ্র খড়গচিহ্ন আঁকা।

পলক পড়ল না প্রতাপবাবুর চোখে। একটা অজ্ঞাত উদ্বেগের ছায়া ঘনিয়ে এল তাঁর মুখে। কেমন একটা অনির্দেশ্য ভয়ে দুলে উঠল তাঁর মনটা। মনে মনে তিনি বারবার বলতে লাগলেন, এ কেমন করে হয়? কেন হয়?

মৃতা যুবতীর মুখের সঙ্গে ইরার মুখের আশ্চর্য সাদৃশ্য। এমনকী চিবুকের বাঁ—দিকে ছোট্ট কালো তিলটি পর্যন্ত।

স্তব্ধ দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে রইল দ্বিতীয় পেটিকার দিকে। শুধু ইরার মুখ—চোখ বহুদিনের একটা প্রত্যাশিত আনন্দের আলোয় আলো হয়ে উঠল। উৎসুক হয়ে সে প্রশ্ন করলে, কে এ বাবা?

পেটিকার ডালার ভেতরের দিকে তাকিয়ে প্রতাপবাবু বললেন, রাজকুমারী স্বাতী।

স্বাতী!

অস্ফুট স্বরে একবার উচ্চারণ করে ইরা ধীরে—ধীরে এগিয়ে সামনের দেওয়ালের কুলুঙ্গি থেকে সেই ধাতুময় বিচিত্র ধূপদানিটা হাতে তুলে নিল। তারপর স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো আপনমনেই বলে উঠল, ‘মনে হয়, অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম।’

ইরা আজ শাড়ি পরে এসেছে। নতুন ঘাসের মতো কোমল সবুজ রঙের সিল্ক তার সুঠাম দেহলতাকে যেন আবেশে জড়িয়ে ছিল। সাপিনীর মতো দীর্ঘ বেণীতে শোভা পাচ্ছে বনফুলের মঞ্জরী।

একসঙ্গে দুটি পুরুষ তাকিয়ে রইল তার দিকে। প্রিয়তোষ আর সুজনলাল।

 * * *

.

টেলিগ্রাম গেছে কলকাতায়।

অবনী দত্ত, দেবপ্রসাদ ঘোষ, শঙ্করদাস গোয়েঙ্কা, স্যার রামস্বামী প্রমুখ দেশের যত গণ্যমান্য ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক আছেন, সবাইকে সাদরে ডেকে পাঠিয়েছেন অধ্যাপক প্রতাপ। তাঁর স্টাফকে কড়া হুকুম দিয়েছেন আমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গ না—আসা অবধি ভুগর্ভের ওই সিঁড়িপথের মুখে দিনরাত পাহারা থাকবে। কেউ যেন না ঢুকতে পারে।

আর, বন্ধ থাকবে পেটিকা দুটি। দুটি প্রাচীন মৃতদেহ বহন করে।

গবেষণায় আর আগ্রহ নেই অধ্যাপক প্রতাপের। রাজনগরের এই আবিষ্কারের ফলে প্রত্নতত্ত্বের অন্ধকারে হয়তো এক নতুন আলোকপাত হবে। হয়তো বা বৌদ্ধযুগের লুপ্ত ইতিহাসের জগতে দেখা দেবে নতুন দিগন্ত।

কিন্তু তা নিয়ে আজ আর প্রতাপবাবুর কোনও মাথাব্যথা নেই। সমস্ত উৎসাহ, সমস্ত উদ্দীপনা সহসা যেন তাঁর ফুরিয়ে গেছে। আজ সকাল থেকে একটা অজানা উদ্বেগ, একটা অনির্দেশ্য ভয় তাঁর মনটাকে অধিকার করে বসে আছে। আপন সন্তানের এবং আপন সন্তানের দয়িতের শুভাশুভের জন্য তাঁর পিতৃ—হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। সেই একই প্রশ্নের কাঁটা বারবার তাঁর মনকে বিক্ষত করে তুলেছে : ইরা আর প্রিয়তোষের সঙ্গে মৃত যুবক—যুবতীর মুখের আদল দেখা গেল কেন? কেন এমন হয়?

পৃথিবীতে একই চেহারার দুজন লোক কি জন্মায় না? হয়তো জন্মায়। তবু অধ্যাপক জানতে চান, কে ছিল সেনাপতি ধীমান আর রাজকুমার স্বাতী! কী ছিল তাদের জীবন—রহস্য? কোন দুষ্ট গ্রহের চক্রান্তে, কার অমঙ্গল অভিশাপে মৃত্যু হয়েছিল তাদের? সে—মৃত্যুর কালো ছায়া কি শকুনের মতো ডানা মেলে বহু শতাব্দী পার হয়ে এসেছে তাঁর ইরা আর প্রিয়তোষের ওপর অশুভ ছায়া ফেলতে?

জানতে হবে। জানতেই হবে প্রতাপবাবুকে। সকাল থেকে লাইব্রেরির ঘরে বসে বইয়ের পর বই, পুঁথির পর পুঁথি ঘেঁটে চলেছেন প্রতাপবাবু। জয়া কয়েকবার খাবার জন্যে ডাকতে এসে ফিরে গেছে, দেখেছে পুঁথিস্তূপের মাঝখানে সমাধিস্থ হয়ে আছেন মেসোমশাই। শুধু কফির কয়েকটা শূন কাপ জমেছে টেবিলের একপাশে।

কুশলনগর—যার মাটিতে তিনি এখন বসে আছেন, আধুনিক ইতিহাসের পাতায় যার নাম পালটে হয়েছে রাজনগর—তার ইতিবৃত্ত তাঁর চাই। কুশলনগরের কথা তিনি কিছুটা পড়েছিলেন একখানা প্রাচীন পুঁথিতে, তাঁর মনে পড়ছে। পরম ভট্টারক মহারাজ চন্দ্রপালের খানিকটা বিবরণ। কিন্তু সবটা পড়া হয়নি। কোথায় সেই পুঁথি? তাঁর বিরাট গ্রন্থসংগ্রহের মাঝে কোথায় লুকিয়ে আছেন মহারাজ চন্দ্রপাল, রাজকুমারী স্বাতী আর সেনাপতি ধীমান?

অধ্যাপক প্রতাপ তাই আজ সন্ধানী চোখ মেলে পুঁথির পর পুঁথি উল্টে যাচ্ছেন। আছে, আছে, নিশ্চয় আছে তারা। ইতিহাস কাউকে ভোলে না। কেউ হারায় না স্মৃতির জগৎ থেকে। বিস্তৃতির ধূলায় চাপা পড়ে থাকে শুধু।

র্যাকের সবচেয়ে উঁচু তাক থেকে খদ্দরে মোড়া একটা ধুলি—ধূসর মোড়ক নামালেন প্রতাপবাবু। সেই মোড়কে থেকে বেরোল অতিপ্রাচীন একটা পাণ্ডুলিপি। পালিভাষায় লেখা। প্রতাপবাবুর মুখ সহসা হর্ষদীপ্ত হয়ে উঠল। এই তো সেই ইতিহাস! যা আজও পৃথিবীর লোকচক্ষুর আগোচরে রয়েছে। এই পুঁথিখানিই তো তিনি খুঁজছিলেন। তাঁর মনে পড়ল কয়েক বছর আগে তিব্বতের এক মঠ থেকে এই দুর্লভ পাণ্ডুলিপি—পুঁথিখানি তিনি বহু কষ্ট স্বীকার করে সংগ্রহ করে এনেছিলেন। তখন কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন এই পুঁথি তার জীবনে এতখানি সংশয়, এতখানি উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে উঠবে!

অতি জীর্ণ তুলোট কাগজের পাতাগুলির লেখা অনেক স্থলে বিবর্ণ, অনেক স্থলে পোকায় কাটা। তবু বিপুল আগ্রহে কম্পিত হাতে অধ্যাপক সেই জীর্ণ পাণ্ডুলিপির কীটদষ্ট পাতা অতি যত্নে ওল্টাটে শুরু করলেন।

বেলা পড়ে এল। ভীমপাহাড়ের ওপরে সূর্যাস্ত হল। অধ্যাপক তখন পাণ্ডুলিপির একান্ন পৃষ্ঠায় এসে পৌঁছেছেন। দৃষ্টি আর চলে না। উঠে গিয়ে ঘরের কোণ থেকে বড় জুয়েল—ল্যাম্পটা জ্বেলে আনলেন অধ্যাপক। তারপর আবার ঝুঁকে পড়লেন সেই অতিপ্রাচীন পাণ্ডুলিপির জীর্ণ বিবর্ণ পাতার ওপর :

.

পরম ভট্টারক কুশলনগরাধিপতি মহারাজ চন্দ্রপালের একমাত্র কন্যা স্বাতী। অষ্টাদশী বিদুষী রূপলাবণ্যে অনুপমা। সেই রাজকুমারী স্বাতী আজ পীড়িতা, মাসাবধি কাল রোগশয্যায় শুয়ে আছে। গোলাপের মতো রক্তাভ দেহবর্ণ গজদন্তের মতো বিবর্ণ হয়ে গেছে। অন্তঃপুরের পালঙ্কে শয়ান রাজকুমারীর শিয়রে দাঁড়িয়ে যৌবন—প্রান্তবর্তিনী একটি নারী। শ্যামাঙ্গিনী হলেও তার মুখের গঠন আর দেহসৌষ্ঠবের দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায়, এককালে অসামান্য রূপসী ছিলেন। নাম সুরঙ্গমা। প্রশস্ত কক্ষের একধারে গৈরিকাবাস পরিহিত সৌম্যকান্তি মুণ্ডিতমস্তক মহারাজ চন্দ্রপাল অধীরভাবে পদচারণ করছেন। আর মাঝে—মাঝে অস্ফুট স্বরে বলছেন, নমো বুদ্ধায়। তাঁর অন্তরের উৎকণ্ঠা তাঁর প্রতি পদক্ষেপে ফুটে উঠেছে।

সুরঙ্গমা প্রশ্ন করলেন, রাজবৈদ্য কী বলে গেল মহারাজ?

পদচারণা থামিয়ে চন্দ্রপাল একবার স্বাতীর মুখের পানে দৃষ্টিপাত করলেন। তারপর আবার শুরু হল অস্থির পদচারণা।

সুরঙ্গমার মুখ বিশুষ্ক হয়ে উঠল। শঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন, তাহলে কি স্বাতীর জীবনের কোনও আশাই নেই?

কন্যার পাশে এসে দাঁড়ালেন চন্দ্রপাল। নিশান্তের তারার মতো রোগপাণ্ডুর মৃত্যুমুখী কন্যার পানে তাকিয়ে পিতৃহৃদয় তাঁর দুলে উঠল। আবেগ সংযত করে বললেন, আজ প্রভাতে কাঞ্চনপুর থেকে ভিষগাচার্য দর্ভপাণিকে আনতে দূত পাঠিয়েছি। যদি পারেন তো তিনিই পারবেন স্বাতীকে নিরাময় করতে, নইলে—

চন্দ্রপাল সহসা বাতায়নের দিকে এগিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালেন।

সুরঙ্গমার কণ্ঠস্বর আবার কেঁপে কেঁপে উঠল, কই, কোথায় ভিষগাচার্য দর্ভপাণি? সেই কোন সকালে দূত গেছে, এত দেরি হচ্ছে কেন? তিনি আসবেন তো?

ব্যাকুলতার মধ্যেও সুরঙ্গমার গলার স্বরে সংশয় প্রকাশ পেল। পিছন ফিরেই চন্দ্রপাল জবাব দিলেন, পাঁচ সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পারিশ্রমিক দেব বলে জানিয়েছি।

তবু তিনি কাঞ্চনপুরের লোক। কুশলনগর ভিষগাচার্যের শত্রুরাজ্য।

পাঁচ সহস্রে রাজি না হলে দশ সহস্র দেব। অর্থলোভ বড় লোভ।—চন্দ্রপাল উত্তর করলেন।

ব্যাকুল কণ্ঠে সুরঙ্গমা বললেন, কাঞ্চনপুরের পথে তুমি আবার দূত পাঠাও মহারাজ। সে যেন সবচেয়ে দ্রুতগামী অশ্বের পিঠে যায়। আমার মতো বলছে ভিষগাচার্য হয়তো আসবে না!

অশ্রুবাষ্পে সুরঙ্গমার কণ্ঠরোধ হয়ে গেল।

আসবেন না!

মহারাজ চন্দ্রপাল বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়ালেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একজন দ্বাররক্ষী ছুটতে ছুটতে এসে রুদ্ধশ্বাসে জানাল,—কাঞ্চনপুর থেকে শিবিকা ফিরে এসেছে নগরতোরণে।

চন্দ্রপালের হৃৎপিণ্ড দুলে উঠল। প্রশ্ন করলেন—ফিরে এসেছে! শিবিকায় কেউ নেই?

আছেন। ভিষগাচার্য দর্ভপাণি।

চন্দ্রপালের বুক থেকে যেন পাষাণভার নেমে গেল। আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল সুরঙ্গমার শ্যামকান্তি মুখ।

ব্যস্ত হয়ে চন্দ্রপাল দ্বাররক্ষীকে বললেন, যাও, এখুনি নিয়ে এসো ভিষগাচার্যকে।

ভিষকাচার্য এলেন। ভারতের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা—বিজ্ঞানী। আয়ুর্বেদ—শাস্ত্রে অতুলনীয় পণ্ডিত ভিষগাচার্য দর্ভপাণি। টকটকে গৌর বর্ণ, খর্বকায়, পেশিবহুল দেহ। মাথাটা আকারে বৃহৎ। ছোট করে ছাঁটা ধূসর কেশের মাঝে একগুচ্ছ শিখা। ভাস্বর দুই চক্ষু ঈষৎ রক্তাভ। পরনে রক্তাম্বর, গায়ে রক্তবর্ণের পট্টবস্ত্রের উত্তরী। তারই ফাঁক দিয়ে রুদ্রাক্ষের মালা আর ধবধবে উপবীতগুচ্ছ দেখা যায়। দর্ভপাণি ঘোর তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ।

সেই খর্বকায় তান্ত্রিক ব্রাহ্মণের পানে দৃষ্টি পড়তেই প্রবল বিতৃষ্ণায় চন্দ্রপালের মুখ মুহূর্তের জন্যে কুঞ্চিত হয়ে উঠল। তারপরেই প্রসন্ন হাস্যে অভ্যর্থনা করলেন, আসুন ভিষগাচার্য, পথে কোনও ক্লেশ হয়নি?

দ্বারের বাইরে থেকে অত্যন্ত নীরস গম্ভীর স্বরে দর্ভপাণি উত্তর দিলেন, মহাদেবীর প্রসাদে মহারাজের মঙ্গল হোক। পথের ক্লেশ দর্ভপাণি গ্রাহ্য করে না। রোগীণী কোথায়?

এই কক্ষে। এখুনি দেখবেন, না বিশ্রামান্তে?

বৈদ্যের বিশ্রামের জন্যে রোগীর পরমায়ু অপেক্ষা করে না মহারাজ। আমি এখুনি দেখব।

আসুন।

কক্ষমধ্যে এসে দর্ভপাণি পালঙ্কের ধারে বসলেন। মাথার গুণ্ঠন কপাল অবধি টেনে দিয়ে একটু তফাতে সরে দাঁড়ালেন সুরঙ্গমা। ভিষগাচার্য কিছুক্ষণ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন রোগীণীর দিকে। নিমীলিত—নয়না রাজকুমারী স্বাতী শেষ বসন্তের ম্লান পুষ্প—মালিকার মতো রোগশয্যায় লীন হয়ে আছে। নীরক্ত অধরপুট ঈষৎ ভিন্ন। নিশ্বাসটুকু পড়ছে কি পড়ছে না বোঝা যায় না।

মুদিত চক্ষে অতি অস্ফুট স্বরে কী যেন মন্ত্রোচ্চচারণ করে দর্ভপাণি রাজকুমারী স্বাতীর দক্ষিণ হাতখানি তুলে নিলেন আপন মুঠির মধ্যে। মণিবন্ধের একটি বিশেষ ধমণী স্পর্শ করে তিনি চুপ করে বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপরে ধীরে—ধীরে একসময় চোখ মেললেন।

চন্দ্রপাল আর সুরঙ্গমা উৎকণ্ঠায় মুহূর্ত গুনছিলেন। রাজা নয়, পিতা প্রশ্ন করলেন, কেমন দেখলেন ভিষগাচার্য?

তেমনি নীরস গম্ভীর স্বরে জবাব এল, স্পষ্টবক্তা বলে লোকে আমার নিন্দা করে। তবু রোগীর মুখ চেয়েই ভিষগকে সত্য কথা বলতে হয়। রাজকুমারীর দুর্বল নাড়ির গতি অতি বক্র, আজ রাত্রি কাটে কিনা সন্দেহ।

পালঙ্কের একটা বাজু শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলেন সুরঙ্গমা। আর মহারাজ চন্দ্রপালের মনে হল প্রবল ভূমিকম্পে সমগ্র রাজপুরীটা দুলছে। এখুনি বুঝি ভেঙে পড়বে। প্রাণপণে নিজেকে সংযত করে চন্দ্রপাল বললেন, লোকে বলে ভিষগাচার্য দর্ভপাণি সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। কুশলনগরে সে কথা কি আজ মিথ্যা হয়ে যাবে?

আমি ধন্বন্তরি নই। ওটা হল লোকের অতিরঞ্জন। তবে আয়ুর্বেদ হল সমুদ্র বিশেষ, রাজকুমারীর কঠিন পীড়ার চিকিৎসাও তার মধ্যে আছে।

আছে। চন্দ্রপাল যেন অকূলে কূল পেলেন।

নমিত মুখ তুলে সাগ্রহে চাইলেন সুরঙ্গমা।

চন্দ্রপাল জিজ্ঞাসা করলেন, কী সে চিকিৎসা ভিষগাচার্য?

রক্ত—সঞ্চালন। রাজকুমারীর দেহযন্ত্রের মধ্যে রক্তপ্রস্তুত—ক্রিয়া প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে, অবিলম্বে রক্তদান না করলে রক্ত—কণিকার দল একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর তারই ফলে নিভে যাবে রাজকুমারীর আয়ুদীপ। এখন বলুন মহারাজ, কে রক্ত দান করবেন?

মহারাজ চন্দ্রপাল এগিয়ে এলেন দর্ভপাণির সামনে। দক্ষিণ বাহু বাড়িয়ে দিয়ে সাগ্রহে বললেন, আমি। আমার রক্ত নিয়ে আমার কন্যার জীবন রক্ষা করুন ভিষগাচার্য।

ধীরে মহারাজ। রক্ত দিতে চাইলেই নেওয়া চলে না। আগে পরীক্ষা করে দেখতে হয় রক্তের মিল আছে কিনা। আমার পেটিকা আনতে বলুন।

শিবিকা থেকে এল দর্ভপাণির পেটিকা। কতকগুলি অদ্ভুত যন্ত্রপাতির সাহায্যে ভিষগাচার্য রাজকুমারী স্বাতী ও মহারাজ চন্দ্রপালের রক্ত পরীক্ষা করলেন। তারপর বৃহৎ মাথাটি নেড়ে বললেন, হল না মহারাজ। আদৌ মিল দেখা যাচ্ছে না।

এবার সুরঙ্গমা এগিয়ে এলেন দর্ভপাণির সামনে। সঙ্কোচ ত্যাগ করে ব্যগ্র স্বরে বললেন, স্বাতীর জন্যে আমি রক্তদান করব ভিষগাচার্য। দয়া করে গ্রহণ করুন।

সহসা রূঢ় গলায় চন্দ্রপাল ডেকে উঠলেন সুরঙ্গমা!

সে ডাকের মধ্যে প্রচ্ছন্ন তিরস্কার ছিল। লজ্জায় বেদনায় মুখ নত করে সুরঙ্গমা সরে গেলেন। রক্তাভ চোখে বিস্ময় নিয়ে দর্ভপাণি উভয়ের দিতে একবার তাকালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, বাধা কীসের মহারাজ?

একটু ইতস্তত করে চন্দ্রপাল উত্তর দিলেন, রাজকুমারী স্বাতীর দেহে রাজরক্ত ছাড়া অন্য রক্ত যায়, এ আমার অভিপ্রেত নয়।

উনি রাজ পরিবারের কেউ নন?

উত্তর দিলেন সুরঙ্গমা নিজেই। সিক্ত—করুণ কণ্ঠে বললেন, না, কেউ নই। আমি শুধু স্বাতীর ধাই মা। আমাকে মার্জনা করবেন ভিষগাচার্য।

ক্ষণেক স্তব্ধ থেকে দর্ভপাণি প্রশ্ন করলেন, রাজ পরিবারের আর কেউ আছেন যিনি রক্তদান করতে পারেন?

চন্দ্রপাল নীরবে মাথা নাড়লেন।

তবে আর কী করতে পারি মহারাজ? আমাকে বিদায় দিন।

অন্য কোনও উপায় হয় না ভিষগাচার্য?

দর্ভপানির নীরস কণ্ঠ আরও নীরস হয়ে উঠল, না। একটা জীবনের চেয়ে রাজরক্তই যখন আপনার কাছে বেশি মূল্যবান, তখন আমি আসি।

পালঙ্ক ছেড়ে দর্ভপাণি পেটিকা হাতে দ্বারপথের দিকে অগ্রসর হলেন। আর ঠিক সেই সময় দ্বারের বাইরে দেখা গেল, তরুণ শাল—তরুর মতো দীর্ঘতনু একটি প্রিয়দর্শন যুবা হাতে আর একটা ক্ষুদ্র পেটিকা নিয়ে দ্রুত পায়ে আসছে দ্বাররক্ষীর পিছনে পিছনে। তার ঘর্মাক্ত মুখ আরক্তিম, সিক্ত ললাটে আটকে রয়েছে কালো রেশমের মতো অবিন্যস্ত কেশ। বেশভূষা সাধারণ নাগরিকের মতো।

মহাবিস্ময়ে দর্ভপাণি বললেন,—একি, ধীমান!

তাঁর পাদস্পর্শ করে ধীমান বললে, আপনি কেবল শল্যচিকিৎসার পেটিকাই নিয়ে এসেছেন পিতা, ফেলে এসেছেন ঔষধের পেটিকা। আমি তাই দ্রুত অশ্ব ছুটিয়ে নিয়ে এলাম।

দর্ভপাণির কানে সেকথা গেল কিনা সন্দেহ। তাঁর নীরস গম্ভীর কণ্ঠস্বর সহসা প্রফুল্ল শোনাল—হয়েছে মহারাজ চন্দ্রপাল, উপায় হয়েছে! রাজকুমারীর জন্য রাজরক্তই পেয়েছি।

সুরঙ্গমা চকিতে তাকালেন। আর ক্ষণিকের জন্য অভিভূত হয়ে পড়লেন চন্দ্রপাল।

রাজরক্ত পেয়েছেন। কার রক্ত? কে সে?

সে এই ধীমান, আমার পুত্র। মহাদেবী চামুণ্ডাই একে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ধীমানের রক্তে রাজকুমারী স্বাতীর প্রাণ রক্ষা হবে, এই তাঁর নির্দেশ।

সংশয়ের ছায়া ঘনিয়ে এল চন্দ্রপালের মুখে। বললেন, কিন্তু আচার্য, আপনার পুত্রের দেহে কেমন করে রাজরক্ত—

ধীমান আমার পালিত পুত্র। আপনি অনায়াসে বিশ্বাস করতে পারেন মহারাজ, ধীমানের দেহে রাজরক্তই আছে, আর রাজকুমারীর রক্ত—কণিকার সঙ্গে তা মিলবে।

চন্দ্রপালের মুখ প্রসন্ন হয়ে উঠল, বললেন, বেশ, আপনি রক্তসঞ্চালনের ব্যবস্থা করুন। ধীমানের রক্তের জন্য যে কোনও মূল্য দিতে আমি প্রস্তুত।

রক্তাভ চক্ষুতে কেমন একটা অবজ্ঞা নিয়ে দর্ভপানি বললেন, মূল্য। আপনার অঙ্গীকার মনে থাকবে মহারাজ। কিন্তু ও—কথা এখন থাক। ধীমান পথশ্রমে ক্লান্ত, ওকে বিশ্রাম ভবনে পাঠিয়ে দিতে আদেশ করুন। ওর বিশ্রামান্তে রাত্রির প্রথম যাম থেকে রাজকুমারীর দেহে আমি রক্ত সঞ্চালন আরম্ভ করব। আজ কৃষ্ণা চতুর্দশী, বড় শুভ তিথি।

.

কুশলনগরের আকাশে অমাবস্যা রাত্রি কালো পাখা মেলেছে।

আর একটা পালঙ্ক আনানো হয়েছে রাজকুমারীর পালঙ্কের পাশে। পাশাপাশি দুই শয্যায় শুয়ে অছে ধীমান আর স্বাতী। ধীমানের দক্ষিণ বাহুর একটি ধমনীতে বিদ্ধ হয়েছে সূক্ষ্ম ধাতব নলের অগ্রভাগ। সেই নলেরই অপর প্রান্ত বিদ্ধ হয়েছে রাজকুমারীর ধমনীতে। দুই পালঙ্কের মধ্যবর্তী জায়গায় বসে ভিষগাচার্য দর্ভপাণি বিচিত্র প্রক্রিয়া করছেন, আর মাঝে—মাঝে রাজকুমারীর নাড়ির গতি অনুভব করছেন।

ক্লান্ত বীণায় স্তব্ধ রাগিণীর মতো স্বাতী মুদিত নয়নে স্থির হয়ে শুয়ে আছে। প্রাণের কোনও স্পন্দন আছে কিনা সহজে বোঝা যায় না। পাংশু অধর মৃদু—মৃদু কাঁপছে, বিকচ বক্ষ ওঠা—নামা করছে অতি ধীরে—ধীরে।

সেই দিকে তাকিয়ে সুরঙ্গমার চোখে পলক নেই। দ্বারপথের বাইরে দীপ—নেভা প্রশস্ত চত্বরে মহারাজ চন্দ্রপাল একাকী পদচারণা করছেন আর মাঝে—মাঝে জপ করছেন, নমো বুদ্ধায়। সকলেই উৎসুক, উন্মুখ, উৎকণ্ঠিত। শুধু ধীমান কৌতূহলী দুই চক্ষু মেলে পার্শ্ববর্তিনী স্বাতীকে দেখছে। বিধিলিপির লিখন কী অদ্ভুত। কোথায় ছিল সে, কোথায় বা ছিল স্বাতী। কত দূরে, পরিচয়ের বাইরে। অথচ আজ কত সন্নিকটে! একই রক্তধারা বইছে দুজনের দেহে। কিন্তু কাল প্রভাবে যদি রাজকুমারী সুস্থ হয়ে ওঠে, দুজনার মাঝখানে আবার জেগে উঠবে দুস্তর ব্যবধান। বিদেশি ধীমান ফিরে যাবে কাঞ্চনপুরে, আর স্বাতী থাকবে এই কুশলনগরে। মাঝখানে এই এক রাত্রির পরিচয় কি রাজকুমারীর মনে থাকবে? না থাকাই স্বাভাবিক। কাঞ্চনপুরের কঙ্করময় মাটিতে পা দিলে ধীমানও হয়তো ভুলে যাবে। আজকের ঘটনা নিয়তির একটা কৌতুকের খেলা নয় কি?

দূরে নগরতোরণে ঘণ্টাধ্বনি হল। সান্ত্রি ঘোষণা করলে রাত্রির দ্বিতীয় যাম।

বাতায়নের পাশ দিয়ে একটা কালপেচক ডেকে গেল। চমকে উঠলেন সুরঙ্গমা।

দর্ভপাণি স্বাতীর নাড়ির গতি পরীক্ষা করলেন। ক্রমশ দ্রুত হচ্ছে। দেহের তাপ অনুভব করলেন। ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে। রোগিণীর লক্ষণ আশানুরূপ। কক্ষের অখণ্ড স্তব্ধতা ভেঙে ভিষগাচার্য বলে উঠলেন, জয় মহাদেবী।

বাইরে অন্ধকার চত্বরে মহারাজা চন্দ্রপাল উচ্চারণ করলেন,—নমো বুদ্ধায়!

শুধু সুরঙ্গমা নীরবে ভাবতে লাগলেন, এ কালরাত্রি কখন কাটবে! কখন হবে এ দুঃসহ প্রতীক্ষার অবসান।

দ্বিতীয় যামও কেটে গেল। রাত্রির তৃতীয় যামে স্বাতীর নাড়ির গতি দ্রুততর হল, দেহের তাপ বৃদ্ধি হয়ে জ্বর এল। ভিষগাচার্য তার কপালে হিমশীতল জলের পটি লাগালেন, কি একটা বটিকা খলে মেড়ে মুখে দিলেন। তারপর চিন্তাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রোগিণীর দিকে।

দেখতে দেখতে রাজকুমারীর দেহে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যেতে লাগল। পুরাতন গজদন্তের মতো গায়ের হলুদ বর্ণে মিশল লালের আভা, পাংশু অধরে ফুটল ক্ষীণ রক্তিমা, ঘনতর হল নিশ্বাস, কাঁপতে লাগল মুদিত আঁখিপল্লব।

আধো—লুপ্ত আধো—জাগ্রত চেতনার মাঝে রাজকুমারী একবার নড়ে উঠে দক্ষিণে মুখ ফেরাল।

দর্ভপাণির চিন্তাকুটিল ললাট মসৃণ হয়ে এল। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আসন ত্যাগ করলেন। দ্বারপথের দিকে তাকিয়ে উল্লসিত স্বরে বললেন, বিপদ কেটে গেছে মহারাজ। রাজকুমারীর আয়ুদীপ আবার জ্বলে উঠেছে। জয় মহাদেবী!

চন্দ্রপালের বুক থেকে পাষাণভার নেমে গেল। শেষরাত্রির পাণ্ডুর আকাশের দিকে তাকিয়ে আর একবার উচ্চারণ করলেন, নমো বুদ্ধায়।

আর সুরঙ্গমার কপোল বেয়ে অশ্রুর দুটি ধারা নেমে এল। বিহ্বল আবেগে সিক্ত গলায় তিনি ডাকলেন, স্বাতী! আমার স্বাতী!

ধীরে, অতি ধীরে চোখ মেলে তাকাল রাজকুমারী স্বাতী। দুর্বলতার ঘোর এখনো কাটেনি, সূক্ষ্ম একটা তন্দ্রাজাল যেন এখনও চোখের তারায় জড়িয়ে আছে। সেই সূক্ষ্ম জালের মধ্যে দিয়ে স্বাতীর নবজাগ্রত প্রথম দৃষ্টি গিয়ে পড়ল দক্ষিণ পাশে অপর পালঙ্কের ওপর। কৌতূহল ভরে ধীমানও তাকিয়েছিল বাম পাশে।

দু’জোড়া দৃষ্টি—প্রদীপের আলো একত্রে মিলিত হল।

স্বাতীর চোখ দুটি শুধোলে, কে তুমি?

ধীমানের চোখ বললে, তুমি সুন্দর!

কুশলনগরের আকাশে তখন প্রভাত হচ্ছে।

এই পর্যন্ত এসে অধ্যাপক প্রতাপ থামলেন। এরপর সেই প্রাচীন পুঁথির কয়েকটা পাতা নেই। মহাকালের চিরচঞ্চল হাওয়ায় শুষ্ক পত্রের মতো কোথায় উড়ে গেছে কে বলতে পারে!

 * * *