রহস্যে অতীতের ধ্বনি – ৬

৷৷ ছয় ৷৷

আকৃতি প্লাজায় আজ আবার শোরগোল কাণ্ড! পুলিশের বড় একটা দল সার্চ করতে এসেছে। তবে কারুর ফ্ল্যাটে নয়, হাউজিং-এর কম্পাউন্ড জুড়ে চলছে তল্লাশি। পরশু ঝিনুকদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানোর জন্যই পুলিশের এই পদক্ষেপ। যে পিস্তল দিয়ে চালানো হয়েছে গুলি, খোঁজা হচ্ছে সেটাই। পুলিশের কাছে ইনফর্মেশন এসেছে এই ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সের কোনও একজনের কাছে লাইসেন্সবিহীন পিস্তল রয়েছে। ঝিনুকদের গাড়িতে ছোঁড়া বুলেটের খোলের সঙ্গে ম্যাচ করে গেছে ডাবলা গাজিকে মারা বুলেটের খোল। ডাবলার মৃতদেহ যেহেতু পাওয়া গিয়েছে সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটে, পুলিশের অনুমান এই কমপ্লেক্সের লাইসেন্স ছাড়া পিস্তলটা থেকেই ছোঁড়া হয়েছে গুলি দুটো। একই সঙ্গে পুলিশ মনে করছে অপরাধী পিস্তলটা নিজের ফ্ল্যাটে রাখবে না সার্চিং-এর ভয়ে। প্রথমবার গুলি চলতেই এই কমপ্লেক্সের বেশ কিছু ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। দ্বিতীয়বার একই পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে আন্দাজ করতে পারলে, পুলিশ প্রতিটি ফ্ল্যাট সার্চ করবে। এমন আশঙ্কাতেই অপরাধী নিজের নাগালের মধ্যে এই কম্পাউন্ডে কোনও গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখবে পিস্তলটা।

পুলিশের অভিযানে অংশ নিয়েছেন দীপকাকু এবং অবশ্যই ঝিনুক। দীপকাকু পুলিশের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে তল্লাশি চালাচ্ছেন না। উনি আছেন সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটের ড্রয়িং-এ, সেখানে পাঁচ সন্দেহভাজনকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছেন নতুন করে। সন্দেহের তালিকায় তাঁদের অন্তর্ভুক্তির কথা অবশ্য পাঁচজন জানেন না। ঝিনুক রয়েছে পুলিশের তল্লাশি টিমের সঙ্গে। ইতিমধ্যে দেখা হয়েছে ইলেকট্রিক মিটার ঘর, জলের পাম্পের ঘর। এখন পার্কের বেঞ্চের তলাগুলো দেখা হচ্ছে। পুলিশের পিছন পিছন ঘুরছে এই কমপ্লেক্সের কিছু কচিকাঁচা, কয়েকজন বয়স্ক লোক। তারা জানে না আজকের এই পুলিশি অভিযান আসলে একটি প্রহসন। অপরাধীকে প্রমাণ সুদ্ধ ধরার প্ল্যান। প্রহসনের নির্দেশক দীপকাকু। যেহেতু নাটকটা কোনও মঞ্চে উপস্থাপিত হচ্ছে না, তাই প্রয়োজনীয় আলোকসম্পাতের জন্য নির্ভর করতে হয়েছে প্রকৃতির উপর। বিকেলের আলোতে শুরু হয়েছে অপারেশন, ক্লাইম্যাক্সের জন্য বাছা হয়েছে সন্ধেবেলাটা। বাবা এই অভিযানে সামিল হতে চেয়েছিলেন, দীপকাকু রাজি হননি। বলেছেন, ইনভেস্টিগেশনের শেষ পর্যায়ে আপনি প্রথমবার ঘটনার প্রেক্ষাপটে গিয়ে পৌঁছবেন, সন্দেহভাজন, অকুস্থল নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন জাগবে মনে। উত্তর দেওয়ার অবস্থায় থাকব না আমরা। সন্দেহভাজনদেরও আপনাকে দেখে খটকা লাগবে। অপারেশনের ছন্দ কাটবে তাতে। তার চেয়ে এতদিন যখন কেসটার বিবরণ আমাদের থেকে শুনেছেন, শেষটাও জেনে নেবেন।

শুকনো মুখে বাবা মেনে নিলেন দীপকাকুর কথা। গাড়িটা নিয়ে যেতে বললেন। দু’জনের জন্য গাড়ির প্রয়োজন হবে না বলে নেওয়া হয়নি। নারান খাখা তো আজ আর সঙ্গে যাচ্ছে না। সে আছে ডাবলা গাজির মা-ভাইয়ের সঙ্গে তাদের এক দেশওয়ালির কলকাতার ডেরায়। কোর্টে কেস উঠলে সাক্ষী দিতে আসবে তারা।

বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে হতে চলল। পুলিশের দল বাউন্ডারি ওয়ালের দিকে এগিয়ে চলেছে। সঙ্গে ঝিনুকও চলেছে। দেওয়াল বরাবর মরশুমি ফুলের বাগান, টবের গাছও আছে পুলিশ লাঠি দিয়ে আলতো করে গাছগুলো সরিয়ে নীচের দিকটা দেখছে। একজন কনস্টেবল একটা টবের গাছের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আসলে দীপকাকুরই নির্দিষ্ট করে দেওয়া ওই টব। লাঠি দিয়ে টবের গাছ নাড়াচাড়া করে উবু হয়ে বসলেন, টবটা সরাতেই একটি গর্ত। কনস্টেবল বলে উঠলেন, এই তো পেয়ে গিয়েছি !

পুলিশ ছাড়াও উপস্থিত সকলে ঘুরে তাকাল কনস্টেবলের দিকে। উনি ততক্ষণে গর্ত থেকে বার করে ফেলেছেন ট্রান্সপারেন্ট প্লাস্টিক ব্যাগে ভরা একটি পিস্তল। ঝিনুক সহ গোটা তল্লাশির টিম, ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ক’জন এসে ঘিরে দাঁড়াল কনস্টেবলকে। উনি হাতের রবারের গ্লাভস পরে নিয়েছেন, এটাও প্রহসনের প্রয়োজনে আসলে কোনও দরকার নেই। ব্যাগ থেকে পিস্তলটা বার করে ম্যাগাজিন খুলে ফেললেন। কার্তুজগুলো হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, সেম ব্যাচের কার্তুজ। এই পিস্তলটা থেকেই ছোঁড়া হয়েছে গুলি।

—স্যার, পিস্তলের মডেলটা কী? জানতে চাইল ঝিনুক। মুখ তুলে কনস্টেবল বললেন, Beretta M9 ।

—যাই, আমার স্যারকে খবরটা দিয়ে আসি। বলে ঝিনুক দৌড়ল সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। একেবারে টাইম ধরে চলছে প্রহসন। সন্ধে নেমে গিয়েছে পুরোপুরি।

লিফটে করে ছ’তলায় উঠে এল ঝিনুক। সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁপিয়ে গিয়েছে, দম নিচ্ছে। পাঁচ সন্দেহভাজন এবং সুপ্রিয় পালের ফ্যামেলির মাঝে সোফায় বসা দীপকাকুর দিকে তাকিয়ে বলল, পাওয়া গিয়েছে পিস্তল।

কে যেন জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

– বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে একটা টবের নীচে গর্তের ভিতর ছিল পিস্তলটা।

—ওটা থেকেই যে ফায়ার করা হয়েছে, কী করে বোঝা গেল ? জানতে চাইলেন দীপকাকু ।

ঝিনুক বলল, কার্তুজের ব্যাচ ম্যাচ করে গিয়েছে।

—পিস্তলটা কোন মডেলের জেনেছ? ফের দীপকাকুর প্রশ্ন । উত্তরে ঝিনুক বলল, জেনেছি। Beretta M9 |

—চলো তো দেখি। বলে সোফা ছেড়ে উঠে এলেন দীপকাকু। পিছনে বাকিরাও আসছে। এরপরই ক্লাইম্যাক্স। দীপকাকু বলে রেখেছেন ভিড়ের সঙ্গে নীচে নামতে নামতে তুমি লক্ষ্য রাখবে কেউ একজন আলাদা হয়ে গেল। সেই লোকটাই হচ্ছে অপরাধী। তাকে ফলো করবে এমন সন্তর্পণে, যেন টের না পায়।

দীপকাকুর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। ঝিনুক অনুসরণ করে যাচ্ছে লোকটিকে। গ্রাউন্ড ফ্লোরের গ্যারেজ স্পেস ধরে লোকটা তড়িঘড়ি পায়ে এগোচ্ছে। একবার মাত্র পিছন ফিরে তাকিয়েছে। চট করে থামের আড়ালে চলে গিয়েছে ঝিনুক। সন্ধের অন্ধকারটা গোপন অনুসরণে বেশ কাজে লাগছে। প্যাসেজের বাল্বগুলোর আলো খুবই ম্লান। দীপকাকুর আন্দাজ মতো লোকটা একটা কভার দেওয়া গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাইক খুঁজতে এসে লাস্টবার দীপকাকু এই কভার ঢাকা গাড়িটার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। এখন এই স্পটে দীপকাকুর প্ল্যান মাফিক দু’জন পিস্তলধারী কনস্টেবল মোতায়েন রয়েছেন। তাঁরাও ঝিনুকের মতো আড়াল থেকে নজর রেখেছেন লোকটার ওপর। একজন অপরাধীকে ধরতে যাবেন। কোনও কারণে যদি ব্যর্থ বা আক্রান্ত হন, অন্যজন সেই কাজটা করবেন। টেকনিক্যালি যাকে বলে কভার করা। ঝিনুকের দায়িত্ব যদি পরিকল্পনার বাইরে কিছু ঘটতে থাকে, তক্ষুণি দীপকাকুকে ফোনে ইনফর্ম করা। ফোন সেট হাতে ধরে রেখেছে ঝিনুক। লোকটা গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে কভার খানিকটা তুলে ফেলল। পকেট থেকে বার করল চাবি। ডিকিটা খুলতে গিয়ে থতমত খেল, চাবি কাজ করছে না। দু’হাত দিয়ে ডিকির ডালাটি তুলতে গিয়ে দেখল, লক করা নেই। দিব্যি উঠে গেল ডালা। ফিট দশেক দূরে থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে ঝিনুক দেখতে পাচ্ছে লোকটার ঘাবড়ে যাওয়া মুখচোখ ঝুঁকে পড়ে ডিকির ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিল লোকটা। সঙ্গে সঙ্গে পিছনে এসে দাঁড়ালেন এক কনস্টেবল। পিস্তল উঁচিয়ে লোকটাকে বললেন, হ্যান্ডস্ আপ।

লোকটাও তড়িৎ বেগে ডিকি থেকে পিস্তল বার করে তাক করল কনস্টেবলের দিকে। বিদ্রুপের হাসি দেখা দিল কনস্টেবলের মুখে। বললেন, তোকে প্রমাণ সমেত ধরব বলে পিস্তলটা ওখানে রাখা হয়েছে।

কেয়ারটেকার আদিত্য ট্রিগার টিপে দেখল সত্যিই ম্যাগাজিন খালি। মুহূর্তের মধ্যে পিস্তলটা ছুঁড়ে মারল কনস্টেবলের মুখে। এরকম অতর্কিত আক্রমণের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না কনস্টেবল, মুখে হাত চাপা দিয়ে বসে পড়লেন। আদিত্য দৌড় লাগিয়েছে মেন গেট লক্ষ্য করে। রাস্তা ধরে যাচ্ছে না। শর্টকাটের জন্য পার্কের ভিতর দিয়ে দৌড়চ্ছে, ঝিনুক নিজের অজান্তে আদিত্যকে ধরার জন্য স্প্রিন্ট টানতে শুরু করেছে। আন্দাজ করতে পারছে তার পিছনে ছুটে আসছেন কভার করার দায়িত্বে থাকা কনস্টেবল। আদিত্য যদি তাঁর নাগালের বাইরে চলে যায়, পায়ে গুলি করে ওঁর দৌড় থামিয়ে দেবেন। তবু কোনও চান্স নিতে চায় না ঝিনুক, গুলি তো ফসকাতেও পারে। কিন্তু ঝিনুকের দৌড়ের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না আদিত্য। সত্যিই পারল না, যথেষ্ট ভাল দৌড়চ্ছিল, তবুও । আদিত্যর শার্টের কলার খামচে ধরেছে ঝিনুক। সজোরে ডান হাতটা

পিছন দিকে চালাল আদিত্য, হাতটা ধরে ফেলে সামান্য ঝুঁকে ঝিনুক বাঁ পায়ে ক্যারাটে শেখা বিশুদ্ধ স্ট্রোকটি মারল আদিত্যর ডান হাঁটুতে। ভাসমান অবস্থা থেকে আদিত্য আছড়ে পড়ল মাটিতে। ডান হাঁটু ভাঁজ করে ঝিনুক লাফিয়ে পড়ল পিঠে। যাতে আর পালাতে না পারে। চাপা আর্তনাদ বের হয়ে এল আদিত্যর গলা দিয়ে। ঝিনুক মুখ তুলতেই দেখে সামনেই দীপকাকু সমেত গোটা পুলিশ বাহিনী। দীপকাকুর অতটা না হলেও বাকি সবাইয়ের চোখে বিষম বিস্ময় আর বাহবা। লজ্জা পেয়ে যায় ঝিনুক। আদিত্যর পিঠ থেকে সরে এসে পিছিয়ে যায় দু’পা ।

পায়ে গুলি না চালিয়ে অপরাধীকে ধরতে পারা গিয়েছে বলে ঝিনুক পুলিশের থেকে খুবই প্রশংসিত হয়েছে। আহত অপরাধীকে সুস্থ করার দায় থাকত পুলিশের। সুস্থ না হওয়া অবধি কোর্টে তোলা যেত না। পুলিশের ভুল নিশানায় অথবা আহত অবস্থায় হেফাজতে থাকাকালীন অপরাধী যদি মারা যেত, কোর্টে বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হত পুলিশকে। দীপকাকু এখন এ সব গল্পই করছেন বাবাকে। আকৃতি প্লাজা থেকে সরাসরি ঝিনুকদের বাড়িতে আসা হয়েছে। বাবা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন তদন্তের শেষটা শোনার জন্য। দীপকাকু ডিনারটা ঝিনুকদের বাড়িতেই সারবেন। মায়ের রান্নার মস্ত বড় ফ্যান উনি। অপরাধীকে কীভাবে ধরা হল বলে যাচ্ছেন দীপকাকু, আদিত্যর উপর প্রথমে সন্দেহ জাগে, যখন জেনে ছিলেন ওর কোয়ার্টার বাউন্ডারি ওয়ালের ধার ঘেঁষে। গুলির আওয়াজের পর আদিত্য দ্বিতীয় ব্যক্তি, যে সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটে এসেছিল। অতদূর থেকে কী করে এত তাড়াতাড়ি এল? তার মানে সে কাছাকাছিই ছিল। রাত দু’টো নাগাদ কী করছিল বাইরে? ব্যালকনির জানলার ছিটকিনিটা তোলার জন্যই এই তাড়াহুড়োটা করে ফেলে আদিত্য। ছিটকিনিটা খুলে রেখেছিল কে? এটা বার করতে বেগ পেতে হয়েছে দীপকাকুকে। ড্রয়িংস্যার অনুপমের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতেই জট খুলে যায়। কর্পোরেশনের বিল পালটা পালটি হওয়ার কারণে আদিত্য যখন এসেছিল ফ্ল্যাটে, অনুপম তাঁর গলা শুনেছিল, ঘুরে দেখেনি। অর্থাৎ মেঝেতে বসা অনুপমের পিঠ ছিল দরজার দিকে। তোর্সাও ড্রয়িং-এ মগ্ন। দু’জনকে এভাবে আগেও দেখেছে আদিত্য, তাই ওই সময়টাই বেছে নিয়েছিল ছিটকিনি খোলার জন্য। বিলটা সে আগে থেকেই পালটে দিয়েছিল যাতে ওই অজুহাতে সোমাদেবীকে ভিতর ঘরে পাঠানো যায় । … এগারোই ডিসেম্বর সুপ্রিয় পালের সঙ্গে মাত্র পাঁচ মিনিট উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর ডাবলা গাজি বাকি পঞ্চান্ন মিনিট কোথায় ছিল, ভাবতে গিয়ে দীপকাকুর মনে হয় আদিত্য হয়তো উপরের কোনও ফ্ল্যাটের সমস্যা অ্যাটেন্ড করতে গিয়েছিল, এখানে আদিত্যকে মনে করার কারণ, ততদিনে সন্দেহ তার দিকে ঘুরে গিয়েছে। আদিত্য উপরের ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে নীচের ঝগড়া শোনে। ডাবলা গাজি যখন নীচে নেমে এসেছে, আদিত্য আলাপ জমায় তার সঙ্গে। কী কারণে ঝগড়া হল জানতে চায়। ডাবলা গাজি সব কিছু বললেও, কোন জিনিসটা ফেরত নিতে এসেছে বলেনি। ভয় পেয়েছিল। সে চলে যাওয়ার পর যদি আদিত্য জিনিসটা সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাট থেকে চুরি করে নেয়। আদিত্য যখন বুঝতে পারল ডাবলা বলবে না সে কোন জিনিসটা নিতে এসেছে, তখন অন্য প্ল্যান নিল। ডাবলাকে বলল, আমি তোমাকে ওই ফ্ল্যাটে গোপনে ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব, সেই বাবদ তুমি আমাকে কিছু টাকা দিও। ডাবলা রাজি হয়। কেয়ারটেকার হিসেবে ছাদের একটা চাবি আদিত্যর কাছে ছিল, পাইপে দড়ি বেঁধে সে ডাবলাকে সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটে নামার রাস্তা করে দেয়। ব্যালকনির দরজা খোলার ব্যবস্থা বিল দিতে এসে করে রেখেছিল। ডাবলার সঙ্গে আদিত্যও ফ্ল্যাটে নেমে এসেছিল একটাই কারণে, ছেলেটাকে সেলি বের করে আনতে হবে। ডাবলা ধরা পড়ে গেলে আদিত্যর নাম বলে দেবে। ডাবলাকে খুন করে ঘণ্টাটা হাতিয়ে নিতই আদিত্য, তবে সেটা কম্পাউন্ডের বাইরে গিয়ে। তাই পকেটে ছিল পিস্তল, বাইরে গিয়ে গুলি করবে ঠিক করেছিল বলে সাইলেন্সার লাগানোর কথা ভাবেনি। ডোরবেলের আওয়াজ শুনে গুলি করতে হল ফ্ল্যাটেই। ঘন্টাটা এবং ডাবলার মোবাইল, পার্স নিয়ে যে রাস্তা দিয়ে ঢুকেছিল, পালাল ওই ভাবেই। যেহেতু ছাদেই ছিল সে জানলার ছিটকিনি তুলে দিতে তাড়াতাড়ি আসতে পেরেছিল সুপ্রিয়বাবুর ফ্ল্যাটে। গুলির আওয়াজ কোথা থেকে এল, এই অজুহাতে ঢুকে ছিল। … কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘণ্টার হদিশ পাওয়া গেলেও, চোরের নাগাল পাওয়া গেল না। বীরপাড়ায় যেতে হল ঘণ্টাটার উৎস সন্ধানে। আদিত্য ততদিনে ডাবলার ফোন থেকে ভাইয়ের নাম্বার নিয়ে কলকাতায় ডেকে পাঠিয়েছে। তদন্ত যাতে বন্ধ হয় তাড়াতাড়ি, সেটারই চেষ্টা করছিল। ডাবলার গ্রামে মা-ভাইয়ের দেখা না পেলেও জানা গেল সুপ্রিয় পাল জিনিসটা সংগ্রহ করেছেন। কী ভাবে সংগ্রহ করেছেন বাইরের কাউকে বলেননি, স্ত্রীকেও না। বেআইনিভাবে বিদেশী জিনিস পেলেও, সেটা যেহেতু কেউ জানে না, গোপনে বিক্রি করার তাগিদ অনুভব করেননি। ডাবলা ঘুরে যাওয়ার পর লক লাগিয়েছিলেন রাউন্ড শেপের পাল্লায়। তদন্তের শেষ পর্যায়ে দীপকাকু সুপ্রিয়বাবুর কাছে জানতে চান নতুন লকটা দেখার পর আদিত্য কী বলেছিল? সুপ্রিয়বাবুর জানান, আদিত্য লকটা দারুণ বলে, চাবি চেয়ে খোলাবন্ধ করে দেখেছিল। সুপ্রিয়বাবুর সঙ্গে দীপকাকুর এই কথোপকথন ঘটেছিল ঝিনুকের অগোচরে। সুপ্রিয়বাবুর দেওয়া তথ্য থেকে দীপকাকু বুঝে যান লক খোলা বন্ধ করার সময় পকেটে সাবান রেখেছিল আদিত্য। চাবির ছাপ তুলে নেয় তখনই। প্রথম জেরায় আদিত্য বলেছিল দামি জিনিস সুপ্রিয়বাবু ঘরের ভিতরে রেখেছেন। পাল্লার নতুন লকটা আইওয়াশ। কাচের পাল্লা ভেঙেই তো জিনিস চুরি করা যায়।… দীপকাকুর দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য কথাটা বলেছিল। বলে ভুলই করেছিল, সন্দেহ ওর দিকেই চলে গিয়েছিল। চুরি হয়েছে রাতে। ভিতর ঘরে তোর্সা, সোমাদেবী ছিলেন। সুপ্রিয়বাবু ট্যুরে যাবেন আগেই খবর জোগাড় করেছিল আদিত্য। কাচের পাল্লা ভাঙতে গেলে আওয়াজ হত, তাই লকের চাবি নকল করার দরকার হয়ে পড়েছিল।… দীপকাকুকে প্রথম হুমকিটা দিতে কোনও অসুবিধে হয়নি আদিত্যর। কেয়ারটেকার বলে সিকিউরিটি রুমের সামনে তাকে প্রায়ই দেখা যায়। কী করছে না করছে গার্ডেরা খেয়াল করে না। কেন করবে? সে যে এই কমপ্লেক্সের একদম ভিতরের লোক। এই সুবিধেতেই এক ফাঁকে দীপকাকুর মোটরবাইকে হুমকির চিরকুট রেখে দিয়েছিল আদিত্য। এ ছাড়াও সিকিউরিটি স্টাফেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদেই ডাবলার মৃত্যুর পর রেজিস্টার খাতা থেকে এগারোই ডিসেম্বর ওর এন্ট্রির তথ্যটা কেটে দিতে পেরেছিল। ফ্ল্যাটের অন্য কোনও বাসিন্দা সহজে এটা পারত না। কারণ তাদের এন্ট্রির সময় নাম লিখতে হয় না। হঠাৎ কেউ রেজিস্টার খাতা চাইলে গার্ডের মনে প্রশ্ন জাগত খাতা নিয়ে সে কী করবে? তবে ডাবলার নাম কাটতে পারলেও, ভিডিও ফুটেজ সরাতে পারেনি আদিত্য। সেটা ততদিনে কপি হয় চলে গিয়েছে সিকিউরিটি এজেন্সির ব্যাঙ্কিং-এ। আদিত্যকে সন্দেহ করা হচ্ছে বুঝতে না দেওয়ার জন্যই দীপকাকু প্রথমবারের তল্লাশিটা চালাতে বলেন পাঁচজনের ফ্ল্যাটে। কিছু না পাওয়া যাওয়াতে দীপকাকু চিন্তায় পড়ে যান। দ্বিতীয় হুমকিটা দিয়ে ভুল করে বসে আদিত্য। দীপকাকু বাইকের সন্ধানে আকৃতি প্লাজায় ফেরত এসে দেখেন একটা গাড়ির কভারের পিছনটা একটু উঠে আছে, তা হলে কি ওখানেই এই মাত্র গুলি ছুঁড়ে আসা পিস্তলটা রাখা হয়েছে? তখনই সার্চ করেননি দীপকাকু, সান্যালবাবুর ফ্ল্যাটে যান, যে কিছুক্ষণ আগে অপরাধী যে মডেলের বাইক চেপে গুলি চালিয়ে ছিল, একই মডেলের বাইক নিয়ে হাউজিং-এ ফিরেছে। সান্যালবাবু জানাল, সে ওষুধ কিনতে বেরিয়েছিল, প্রেসক্রিপশনও দেখাল। স্যান্যালবাবুর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সিকিউরিটি রুমে এসেছিলেন দীপকাকু। সিসিটিভি ফুটেজ দেখল, আদিত্যকে পায়ে হেঁটেও গেটের বাইরে যেতে দেখা গেল না। আদিত্যর ঘর যেহেতু বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে, দীপকাকু ধরে নিলেন আদিত্য পাঁচিল টপকে চেনা কারুর বাইক নিয়ে কাণ্ডটি ঘটিয়েছে। একই ভাবে ফিরেও এসেছে। তার ঘরে আলো জ্বলছিল, জানলা দিয়ে দেখাও গিয়েছিল তাকে। তার মানে পিস্তলটা সে লুকিয়ে ফেলেছে এমন জায়গায়, যেখানে পুলিশের হাত পৌঁছবে না। সেখানেই নিশ্চয়ই রেখেছে ঘণ্টাটা। সেটা বড় নির্ভরতার জায়গা তার। খুব সম্ভব কভার ঢাকা গাড়িতেই আছে জিনিস দু’টো। দীপকাকু সিকিউরিটি স্টাফের কাছে জেনে নিয়েছিলেন ওই গাড়িটার মালিক এখন বিদেশে, চাবি থাকে আদিত্যর কাছে। গভীর রাতে পুলিশকে নিয়ে এসে দীপকাকু ডিকির তালা ভেঙে দু’টো জিনিস পেয়ে গেলেন। পিস্তল থেকে গুলি সরিয়ে নিয়ে দুটো জিনিসই রেখে দিলেন যথাস্থানে। আদিত্যকে হাতেনাতে ধরার জন্যই রেখেছিলেন। নয়তো আদিত্য বলতে পারত, ও সব আমার নয়। তারপর প্রহসন রচিত হল। পিস্তল পাওয়া গিয়েছে শুনে আদিত্য ঘাবড়ে গিয়ে নিজের গোপন জায়গায় পৌঁছল। ঘণ্টা এবং পিস্তল দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবল যে পিস্তলটা পেয়েছে পুলিশ, সেটা অন্য কারুর। ভাবতে পারেনি পিস্তলে গুলি নেই। পুলিশকে গুলি করতে গিয়ে বামাল ধরা পড়ল। দীপকাকুর কৃতিত্বে সুপ্রিয় পালের ঘাড়ে খুনের দায় চাপেনি বলে উনি স্বস্তি পেয়েছেন । শাস্তি অল্প হবে। দীপকাকুকে রেমুনারেশন দিতে চেয়েছেন সুপ্রিয় পাল। পুলিশও পুরস্কৃত করবে দীপকাকুকে। এত সাফল্য সত্ত্বেও একটা আক্ষেপ রয়ে গেছে ঝিনুকের। জঙ্গলে সেই পরিত্যক্ত বৌদ্ধমন্দিরে যাওয়া হল না। দীপকাকু, বাবার কথাবার্তার মাঝেই অলীক কল্পনায় ঝিনুক পৌঁছে যায় সেই জঙ্গলকীর্ণ বৌদ্ধমঠের পথে। তার হাতে চুরি যাওয়া তিব্বতী ঘরানার ঘণ্টা। রেখে আসবে মন্দিরে। সন্ধে নেমে গিয়েছে, মন্দির পাহারা দিচ্ছে পাহাড় আকৃতির হাতির দল। ঝিনুককে দেখে তারা পথ ছেড়ে দাঁড়াল। শুঁড় তুলে হাঁক দিল, বৃংহন! আসলে ঝিনুককে অভিনন্দন জানাল তারা।