রহস্যে অতীতের ধ্বনি – ৫

৷৷ পাঁচ ৷৷

ঝিনুকরা আজই ফিরেছে কলকাতায়। নারান খাখাকেও সঙ্গে এনেছেন দীপকাকু। সুপ্রিয় পাল যে বীরপাড়ায় গিয়েছিলেন তার সাক্ষী হচ্ছে নারান খাখা। শুধু বীরপাড়ায় যাওয়া নয়, কী উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন, তাও জানে নারান। আর জানত ডাবলা। সুপ্রিয় পাল যেহেতু মন্দিরের সামগ্রী কিনতে অতি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, অরিজিনাল জিনিস পাওয়ার আশ্বাস পেতেই, শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে ডাবলাকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছিলেন ওদের গ্রামে। সেই মানুষটিকে ডাবলা মন্দিরের রাস্তা চেনায়নি। সুপ্রিয় পালকে রেখে গিয়েছিল বন্ধু নারানের হেফাজতে। রাতটা ডাবলাদের বাড়িতে কাটালেও নারানের সঙ্গেই গল্পগাছা করে কেটেছে সুপ্রিয় পালের। প্রত্নসামগ্রী এনে দেওয়ার জন্য নারানকেও টোপ দিয়েছিলেন। মন্দিরের ঘন্টাটা নারানের সামনেই হ্যান্ডওভার করে ডাবলা। তাই নারান হল ওই গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে জোরাল সাক্ষী। ডাবলার মা, ভাই, খোরশোলা গ্রামের অন্যান্য লোক সুপ্রিয় পালকে ওখানে যেতে দেখলেও, কেন গিয়েছিলেন, সেটা তারা জানে না। সকাল দশটা নাগাদ ঝিনুকদের ট্রেন পৌঁছেছিল শিয়ালদায়। ট্যাক্সি নেওয়া হল। ঝিনুক নেমে গিয়েছিল টালিগঞ্জে, তাদের চণ্ডী ঘোষ রোডের বাড়িতে। নারান খাখাকে নিয়ে দীপকাকু চলে গিয়েছিলেন। বলে গিয়েছিলেন, সন্ধে সাড়ে ছ’টায় আসব। তিনজনে মিলে যাব সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটে।

এখন সেখানেই যাচ্ছে ঝিনুকরা। ট্যাক্সিতে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন দীপকাকু, যাওয়া হচ্ছে বাবার গাড়িতে। বাবারও খুব যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, দীপকাকু রাজি হননি। দুপুরে বাড়ি ফিরে বাবাকে বীরপাড়ার সমস্ত ঘটনা বলেছিল ঝিনুক। বিপুল উৎসাহে বাবা বলেছিলেন, আমিও তোদের সঙ্গে যাব। আধঘণ্টাটাক আগে বাইকে করে নারান খাখাকে নিয়ে ঝিনুকদের বাড়ি এসেছিলেন দীপকাকু। বাইকে তিনজন অ্যালাউড না বলেই ট্যাক্সিতে যাবেন ঠিক করেছিলেন। বাবা আকৃতি প্লাজায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেছিলেন, চলো আমার গাড়িতেই যাই ।

দীপকাকু বলেছিলেন, আপনার গাড়ি নিতে পারি। আপনাকে নেওয়া যাবে না। আমরা তিনজনে গিয়ে জেরায় জেরবার করে দেব সুপ্রিয় পালকে। বুঝিয়ে দেব ওঁর স্বরূপ আমরা অনেকটাই জেনে গিয়েছি। এই তিনজনের বাইরে আর কেউ থাকলেই, উনি জবানবন্দি দিতে অস্বস্তি বোধ করবেন। কাটছাঁট করবেন তথ্য। সেই কারণে আমি অলরেডি ওঁকে ফোন করে বলে দিয়েছি, সাতটা নাগাদ যাচ্ছি। স্ত্রী এবং মেয়েকে কোনও অজুহাতে ফ্ল্যাটের বাইরে পাঠিয়ে দেবেন। আপনার সঙ্গে প্রাইভেট কিছু কথা আছে।

অগত্যা বাবার যাওয়া হল না। গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার আশু পাশে নারান খাখা। দীপকাকুর পরামর্শে আজ সকাল থেকে আকৃতি প্লাজায় পাঁচ সন্দেহভাজন এবং সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাট এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সার্চ করা হল। বাইরের তিন সন্দেহভাজনের বাড়িও তল্লাশি চালানো হয়েছে। দীপকাকু বীরপাড়া থেকেই ই-মেল করে ন’জনের তালিকা পাঠিয়ে আইও তাপস রায়কে সার্চের কথা বলেছিলেন।

নিজের তদন্তের গতিপ্রকৃতি জানিয়ে, পাঠিয়েছিলেন বৌদ্ধমন্দিরের ঘণ্টাটার ফটো আশা প্রকাশ করেছিলেন তল্লাশির মাধ্যমে এই ঘণ্টা এবং যে পিস্তল দিয়ে ডাবলাকে খুন করা হয়েছে, সেটা পাওয়া যাবে। ওই দু’টো জিনিস তো পাওয়া যাইনি, অন্য কোনও সন্দেহজনক কিছু মেলেনি। আবারও পুলিশের কাছে নিজের অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন দীপকাকু। গোয়েন্দা গল্প-উপন্যাসে ডিটেকটিভরা সব সময়ই পুলিশকে টেক্কা দেয়। দীপকাকুও এক-দু’বার দিয়েছেন। এবার যে কেন এরকম হচ্ছে, কে জানে!

কার যেন ফোন বাজছে। অচেনা রিং টোন। নারান খাখার কি? না, দীপকাকু প্যান্টের পকেট থেকে বার করছেন ফোন। ঝিনুকের মনে পড়ে ফোন সেটটা স্টাফ সুদর্শন কাকার। বিজ্ঞাপনে এই সেটটার নাম্বার দিয়েছিলেন দীপকাকু। কলটা তার মানে কি সেই আড়ালে থাকা ঘণ্টা বিক্রেতার? মনে হচ্ছে তাই, স্ক্রিনে ল্যান্ড ফোনের নাম্বার দেখেই বোধহয় দীপকাকু কানে ফোন সেট নিয়ে অন্য হাতে নিজের গলার কণ্ঠাটা চেপে ধার ‘হ্যালো’ বললেন। আসল গলাটা পালটে ফেললেন আর কি। অপর প্রান্তের কথা শুনতে শুনতে চোয়াল শক্ত হল, নিজে আর একটা কথাও বললেন না। ফোন কেটে কপালে ভাঁজ ফেলে বসে রইলেন। ঝিনুক বলল, ঘণ্টার ফটো যে পাঠিয়েছে নিশ্চয়ই তার ফোন। কী বলছে?

—ধরে ফেলেছে বিজ্ঞাপনটা আমি দিয়েছি। হুমকি দিল। সেই একই। বোঝা যাচ্ছে লোকটা আকৃতি প্লাজাতেই থাকে। আগের বার ওর নাগালের মধ্যে ছিল আমার বাইক, টুক করে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল চিরকুটটা। সিকিউরিটি স্টাফ টের পায়নি।

—কী করে বুঝল বিজ্ঞাপনটা আপনার দেওয়া ?

—সার্চের সময় পুলিশের থেকে জেনে নিয়েছে কী খোঁজা হচ্ছে। ঘণ্টার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছে বিজ্ঞাপনদাতা ইনফর্ম করেছে পুলিশকে। বাইরের লোক বলতে একমাত্র তার কাছেই আছে ঘণ্টাটার ছবি, কিছুটা তথ্য এবং সেটা বিক্রি করতে চাওয়ার খবর। সেটাতে পুলিশের সঙ্গে আমাকে ইনভেস্টিগেট করতে দেখেছে অপরাধী। তদন্তে ইতি টেনেও পুলিশকে ফের সক্রিয় হতে দেখে বুঝে গিয়েছে আমার সার্চ করার এক্তিয়ার নেই বলেই পুলিশকে ঘণ্টার খবরটা দিয়েছি। যেটা জেনেছি বিজ্ঞাপনের ফাঁদ পেতে।

— লোকটা যদি ওই হাউজিং-এর কেউ হয়, তা হলে পাঁচ সন্দেহভাজন এবং সুপ্রিয় পালের মধ্যে কোনও একজন।

—ঠিক তাই। ফ্ল্যাটে সার্চ হতেই বেজায় চটেছে আমার ওপর। ‘চটেছে’ কথাটা মিচকি হেসে এমনভাবে বললেন দীপকাকু, যেন কোনও ঠাট্টা! ওটা যে খুনের হুমকি, ওঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই ।

কিছুক্ষণ হল ঝিনুকরা তিনজন সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছেছে। দীপকাকুর নির্দেশ মতো সুপ্রিয়বাবু একাই আছেন। নারান খাখাকে দেখে ওঁর প্রায় বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো অবস্থা হয়েছিল। তারপর সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েন। দীপকাকুকে বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়নি। নিজের থেকেই সমস্ত অপরাধ কবুল করলেন। তাতে দীপকাকুর খুব যে সুবিধে হয়েছে, তা নয়। বরং কাজ খানিকটা বেড়ে গিয়েছে। কথাবার্তা হচ্ছিল সোফায় বসে। পরবর্তী কর্মপদ্ধতি ভারতে দীপকাকু উঠে গিয়েছেন স্লাইডিং দরজা পেরিয়ে থ্রিলঘেরা বারান্দায়। সিগারেট ধরিয়েছেন। ইদানীং ঘরের মধ্যে স্মোক করেন না। নেশাটাও অনেকটা কমিয়েছেন। দোষ স্বীকারের শুরুতেই সুপ্রিয় পাল বলেছেন, বিশ্বাস করুন আমি খুন করিনি। অন্যায় কাজ একটাই করেছি, ওকে চিনি না বলেছি।

– কেন বলেছিলেন? কিসের ভয়ে ? জানতে চেয়েছিলেন দীপকাকু। উত্তরে সুপ্রিয় পাল সবিস্তারে বলতে থাকেন। বৌদ্ধমন্দিরের ঘন্টা সংগ্রহের পর্ব। ডাবলা গাজির সঙ্গে হংকং মার্কেটেই আলাপ হয়েছিল তাঁর। ওর থেকে অরিজিনাল প্রত্নসামগ্রী পাওয়ার আশ্বাস পেয়ে নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি। ডাবলার সঙ্গে ওর গ্রামে পৌঁছে যান। সুপ্রিয় পাল আন্দাজ করেছিলেন ডাবলা ভুটানের প্রত্নসামগ্রী নিয়ে আসবে, যা একটি মারাত্মক অপরাধ। গুরুতর বেআইনি কাজ। জিনিস কোথা থেকে আনছে, ডাবলা যেমন দেখাতে চায়নি, সুপ্রিয় পালও চাননি সেখানে যেতে। ছদ্ম একটা আগ্রহ অবশ্য দেখিয়েছিলেন। ডাবলা ঘণ্টাটা এনে দেওয়ার পর যা দাম চেয়েছিল, তাই দিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন সুপ্রিয় পাল। তার কিছুদিন বাদে ডাবলা এই ফ্ল্যাটে এসে ঘণ্টাটা ফেরত চাইল। যে টাকাটা নিয়েছিল, তার বিনিময়ে। সুপ্রিয় পাল ওকে ফ্ল্যাটের দরজা থেকেই হাঁকিয়ে দেন। এরপরের ঘটনা সকলেই জানে। যে অংশটুকু সুপ্রিয় পাল গোপন করে গিয়েছেন, তা হল, অঘটনের দিন ফ্ল্যাটে ঢুকে ডাবলাকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখামাত্র সুপ্রিয়বাবু ক্যাবিনেটের দিকে তাকিয়েছিলেন। দেখলেন রাউন্ড পাল্লাটা খোলা। ডাবলা ঘুরে যাওয়ার পর যেটায় লক লাগিয়ে ছিলেন। ঘণ্টাটা উধাও। ডাবলা যে ঘণ্টাটা চুরির উদ্দেশ্যে ঘরে ঢুকেছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। একই অভিসন্ধি নিয়ে অন্য একজনও ছিল ঘরে। ডোরবেলের আওয়াজ পেতেই সে বুঝতে পারে ধরা পড়তে চলেছে। ডাবলাকে গুলি করে ঘন্টাটা নিয়ে পালায়। বাড়িতে নৃত্যতে, গুলির আওয়াজ, সুপ্রিয়বাবু পুলিশ না ডাকলেও কমপ্লেক্সের অন্য বাসিন্দারা ডেকে আনবে। ডেডবডির জামা-প্যান্ট সার্চ করে পাওয়া যাবে মোবাইল ফোন, পার্স। ব্লু পেয়ে পুলিশ খোঁজার চেষ্টা করবে কী উদ্দেশ্যে এই ফ্ল্যাটে এসেছিল ছেলেটা? মরতে হল কেন? তা হলেই সুপ্রিয়বাবু অপরাধ, মানে বেআইনি ভাবে বিদেশি প্রত্নসামগ্রী কেনা ব্যাপারটা ধরা পড়ে যাবে। বিপদটা থেকে বাঁচার একটাই উপায়, ডাবলার মোবাইল ফোন, পার্স সব সরিয়ে ফেলা। সরাতে যান সুপ্রিয় পাল। তোর্সার নজর তখন অসুস্থ হয়ে পড়া সোমাদেবীর দিকে। ডাবলার পকেট হাতড়ে মোবাইল, পার্স না পেয়ে সুপ্রিয়বাবু বুঝে যান চুরি এবং খুনের অপরাধী আগেই আইডেন্টিটি প্রুফগুলো সরিয়ে ফেলেছে। তার মতলব সুপ্রিয় পালের মতোই ছিল, ছেলেটা অজ্ঞাতপরিচয় হলে পুলিশ কেস এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। তদন্ত ধামাচাপা পড়ে যাবে দ্রুত। বেঁচে যাবে অপরাধী। ব্যাপারটাতে বেশ স্বস্তি পেয়েছিলেন সুপ্রিয় পাল। পুলিশ আসতেই বলে দেন ছেলেটাকে চেনেন না।

পুরোটা শুনে দীপকাকু বলেছিলেন, আপনি কিন্তু এখনও একটা ব্যাপার গোপন করে যাচ্ছেন। আপনার দু’টো মোবাইল ফোন। পুলিশকে একটার নাম্বার দিয়েছন। অন্যটা রেখেছেন চোরাই জিনিস কেনার ক্ষেত্রে যোগাযোগের জন্য। ঘণ্টাটা ফেরত পেতে চেয়ে ডাবলা আপনার দেওয়া নাম্বারে কল করেছিল। সেটটা হয় অফ করা ছিল অথবা ডাবলার প্রস্তাবে আপনি রাজি হননি। মরিয়া হয়ে আপনার ফ্ল্যাটে হাজির হয় ডাবলা। ওর থেকে আরও প্রত্নসামগ্রী পাওয়ার আশায় নিজের অ্যাড্রেসটা সঠিক দিয়েছিলেন। আপনার অপর ফোনটির কথা সোমাদেবীকেও জানাননি। বীরপাড়ায় যাওয়ার সময় শিলিগুড়ি পেরোতেই আপনার রেগুলার মোবাইল সেটটা নিষ্ক্রিয় করে দেন। পাছে কোনও কল এসে আপনার কললিস্ট বীরপাড়া যাওয়ার প্রমাণ রেখে দেয়। সোমাদেবীর ফোনের কললিস্টে বীরপাড়ার পাবলিক বুথের নাম্বার পাওয়া গিয়েছে। নির্ঘাত আপনিই করেছিলেন। ফোনে আপনাকে না পেয়ে সোমাদেবী চিন্তিত হবেন বলে। সোমাদেবীকে বলেননি বীরপাড়ায় আছেন। বলেছেন আপনার ফোনটা বিগড়েছে। ডাবলার ফোন নাম্বার আমি নারানের থেকে পেয়েছি। কললিস্ট চেক করে আপনার গোপন নাম্বারটা বার করে ফেলব।

আক্ষরিক অর্থেই সুপ্রিয় পাল কিছুক্ষণ ‘হাঁ’ হয়ে তাকিয়েছিলেন দীপকাকুর দিকে। তারপর বললেন, এই প্রথমবার আমি এভাবে জিনিস কিনেছি। ফোন নাম্বারটাও ব্যবহার করছি সম্প্রতি। আমার ড্রাইভারের ফোন। আমিই কিনে দিয়েছিলাম। মাস খানেক হল চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। যাওয়ার আগে ফেরত দিয়ে গিয়েছে ফোনটা।

দীপকাকু বলেছিলেন, ঠিক আছে, এর সত্যতা না হয় পরে যাচাই করা যাবে। তার আগে বলুন তো এগারোই ডিসেম্বর ডাবলা যখন আপনার কাছে এসেছিল, কতক্ষণ ধরে চলেছিল কথাবার্তা ? ঝগড়ার আওয়াজ মতো হয়েছিল কি? আশেপাশের কেউ শুনেছে?

-একটু বাগবিতণ্ডা হয়েছিল। মিনিট পাঁচেকের বেশি না। ঝগড়ার আওয়াজ ভিতরে গেলে সোমা শুনে ফেলবে। সেই ভেবে আমি দরজা টেনে দিয়ে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে কথা বলেছি। প্যাসেজে কেউ ছিল না। সিঁড়ি দিয়ে কেউ তখন ওঠা নামাও করেনি। বলেছিলেন সুপ্রিয় পাল। দীপকাকু বললেন, আপনি সিঁড়ির নীচে একটা চাতালই শুধু দেখতে পাচ্ছিলেন। হতে পারে তার নীচ থেকে কেউ উঠে আসছিল অথবা ওপর থেকে কেউ নামছিল, চেঁচামেচি শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। যদিও লিফট্ থাকলে এত উঁচু ফ্ল্যাটের লোক একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সিঁড়ি ব্যবহার করে না।

কথা শেষ করে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে বারান্দায় চলে গিয়েছিলেন দীপকাকু। ঝিনুকরা তিনজন চুপচাপ বসে আছে তখন থেকে। সুপ্রিয় পাল মাথা নিচু করে আছেন। আক্রোশ ভরা চোখে তাঁর দিকে চেয়ে রয়েছে নারান খাখা। বন্ধুর অকাল মৃত্যুর কারণ সামনের লোকটা, সেইজন্যই রাগ। ঝিনুক সেন্টার টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে পাতা উলটে যাচ্ছে, পড়ছে না কিছুই।

ঘরে এলেন দীপকাকু। সুপ্রিয়বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনুন আপনার কথার ওপর নির্ভর করে তদন্ত চালিয়ে যাব আমি। আশা করি আর কিছু গোপন করেননি। যতটুকু বলেছেন, সেটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তথ্য গোপন করে পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছেন। এরপরও আইও যদি আপনাকে ফেভার করে রিপোর্ট দেন, তা হলে হয়তো জেল এড়িয়ে শর্তাধীন জামিন পাবেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে বড় কোনও উকিল ধরতে হবে। আর মিথ্যে বলে আমাকে যদি নিসগাইড করার চেষ্টা করেন, রেহাই পাবেন না। সত্য উদ্ঘাটন আমি করবই। তখন আপনার জেলের ঘানি টানা কেউ আটকাতে পারবে না।

সুপ্রিয় পাল ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন দীপকাকুর দিকে। হাতের ইশারায় ঝিনুকদের ডেকে নিয়ে বাইরের দরজা লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলেন দীপকাকু।

আকৃতি প্লাজা থেকে বেরোতে খুব বেশি রাত হয়নি, সাড়ে ন’টা বাজে। শীতকাল বলে রাস্তা এখনই বেশ ফাঁকা। লর্ডসের মোড় পার হল ঝিনুকদের গাড়ি। ড্রাইভার আশুদা দারুণ মুডে আছে। ঝিনুকদের এক্সপিডিশনে গাড়ি চালাতে পারলেই বাড়তি এন্থ পেয়ে যায়। মেজাজ ভাল আছে বলেই পাশে বসা নারান খাখাকে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। জেনে নিয়েছে, নারান ড্রাইভিং জানে। দীপকাকু নিরস্ত করেছেন। বলেছেন, তুমি যেমন পাহাড়ে ওর মতো গাড়ি চালাত পারবে না। ও তেমনি কলকাতার রাস্তায় ড্রাইভিং করতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবে।

এরপর থেকে আশুদা বলে যাচ্ছে তার পাহাড়ে গাড়ি চালানোর এক্সপেরিয়েন্স। শুনতে বেশ ভালই লাগছে ঝিনুকের। রিলিভড় ফিল করছে। কেসটার জটিলতায় মাথা পুরো জট পাকিয়ে গিয়েছিল। আচমকা কানের কাছে বিকট আওয়াজ। চমকে ওঠার মাঝেই ঝিনুকের কোলের উপর কী সব যেন এসে পড়ল। ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে গাড়ি। ভিতরে ধোঁয়া ঢুকে এসেছে। তাতে বারুদের গন্ধ। আশুদা আতঙ্কের গলায় বলে উঠল, গুলি করে পালাল। মোটরবাইক।

ঝিনুক দেখল পাশে দীপকাকু নেই। গাড়ির দরজা খোলা, জানলায় অজস্র ফাটল আর একটা ফুটো। জানলার কাচই এসে পড়েছে ঝিনুকের কোলে। ফের কাঁপা গলায় আশুদা বলে উঠল, দাদা রাস্তায় বসে কী করছে দ্যাখো, আগের বার মিস করেছে লোকটা এবার তো সামনে থেকে গুলি করে দিয়ে যাবে।

ঘোরের মাথায় গাড়ি থেকে নেমে আসে ঝিনুক। রাস্তায় উবু হয়ে বসে দীপকাকু কিছু খুঁজছেন মনে হচ্ছে। কাছে গিয়ে মাথা নামিয়ে ঝিনুক বলে, কী খুঁজছেন? চলে আসুন। আবার যদি ফিরে আসে গুলি করতে !

—আর আসবে না। খুন করার জন্য গুলি চালায়নি। হুমকিটা ফাঁপা নয়, বুঝিয়ে দিয়ে গেল। বুলেটের খোলটা খুঁজছি। খোলটা কী কাজে লাগবে, বুঝতে পারছে না ঝিনুক। এরকম একটা মারাত্মক ঘটনার অভিঘাতে দীপকাকুর মাথাটা বোধহয় ঠিকঠাক কাজ করছে না। ফাঁকা কার্তুজটা পেয়েও গেলেন দীপকাকু। হাতে নিতে গিয়ে বোধহয় গরম ছ্যাঁকা লাগল। রুমাল বার করে ধরলেন। সব শুদ্ধ পকেটে পুরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, কাচ তোলা চলন্ত গাড়িতে বাইক চালাতে চালাতে সঠিক নিশানায় শ্যুট করার মতো শার্প শ্যুটার কলকাতায় হাতে গুনে পাওয়া যাবে। আমাকে ভয় দেখাতে গিয়ে নিজের অপরাধ বাড়িয়ে ফেলল অপরাধী, ফেলে গেল কার্তুজ। আমার ধারণা যে পিস্তল দিয়ে ডাবলাকে খুন করা হয়েছিল এটা সেটারই কার্তুজ। আগের ফাঁকা কার্তুজ পাওয়া গিয়েছে সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটে, এটার সঙ্গে ম্যাচ করাব।

রাস্তা থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে আকৃতি প্লাজায় ফিরে এসেছে ঝিনুকরা। গেটের কাছে দাঁড় করানো হল গাড়ি। দীপকাকু, আশুদা আর ঝিনুক নেমে এল। গুলি চালিয়ে পালিয়ে যাওয়া লোকটার বাইকের মডেলটা আইডেন্টিফাই করেছে আশুদা, নাম্বারটা পড়তে পারেনি। ঝিনুকদের দেখে টুলে বসে থাকা সিকিউরিটি স্টাফটি এগিয়ে এল। দীপকাকুর উদ্দেশে বলল, কী ব্যাপার স্যার, আপনারা তো কিছুক্ষণ আগেই বেরোলেন, আবার ফিরে এলেন!

– আমরা এখান থেকে বেরনোর পর ক’টা বাইক গেট থেকে বেরিয়েছে, তার মধ্যে কোনটাও কি ফিরে এসেছে ইতিমধ্যে?

দীপকাকুর প্রশ্নের সঙ্গে পাশে দাঁড়ানো আশুদা বাইকের মডেলটাও বলে দিল। সিকিউরিটির লোকটা বলল, ওই মডেল তো এখন খুব পপুলার। আপনার চলে যাওয়ার পর চারটে বাইক বেরিয়েছে, তিনটেই ওই মডেলের। একটা ফিরে এসেছে।

-সেটা কার? জানতে চাইলেন দীপকাকু?

লোকটা বলল, সি ব্লকের সান্যালবাবুর। তবে কে চালাচ্ছিল বলতে পারব না। হেলমেট ছিল আর ঠান্ডার জন্য জ্যাকেট ।

—চলো, বাইকটা কোথায় রাখে দেখাও। ওই বাইকটাই কিনা সিওর হয়ে নিয়ে স্যানালবাবুর সঙ্গে কথা বলব।

সিকিউরিটি স্টাফ, দীপকাকু পাশাপাশি হাঁটছেন। পিছনে আশুদা, ঝিনুক। প্রত্যেক কমপ্লেক্সের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ওপেন গ্যারেজ। মোটরবাইক, ফোর হুইলার সব এক জায়গাতেই। দুটো ব্লক পার করার পর একটার গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন দীপকাকু বাইক নয়, কভার ঢাকা একটা গাড়ির দিকে ঠায় তাকিয়ে রয়েছেন। কী দেখছেন বুঝতে পারছে না ঝিনুক। এখনই জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। দীপকাকুর কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে। সিরিয়াস বিষয়।