রহস্যে অতীতের ধ্বনি – ৪

৷৷ চার ৷৷

এই অভিযানে দীপকাকু পুলিশকে এড়িয়ে চলবেন, এমনটাই ধারণা হয়েছিল ঝিনুকের। কার্যক্ষেত্রে তা ঘটল না। দলগাঁও স্টেশনে নেমে প্রথমে বীরপাড়া বাসস্ট্যান্ডে গেলেন দীপকাকু, কাছেই। পায়ে হেঁটে যাওয়া হয়েছিল। ওখানে চার-পাঁচটা হোটেল, মান খুবই সাধারণ। ‘ভ্যালি ইন’ হোটেলটা বাইরে থেকে দেখে মন্দের ভাল মনে হয়েছিল। দীপকাকু রিসেপশনে গিয়ে দু’টো ঘর বুক করলেন। ঝিনুক এবং নিজের জন্য। ঝিনুককে বলেছিলেন, ঠিক একঘণ্টা বাদে বেরব। এর মধ্যে যতটুকু রেস্ট নেওয়ার নিয়ে নাও। লাঞ্চ করব বাইরে। বর্ডারের গ্রামগুলোতে বেশি সময় থাকা যাবে না। সবই প্রায় জঙ্গলের ভিতরে। সন্ধের আগেই ফিরে আসতে হবে।

রেস্টের টাইম আর একটু বেশি পাওয়া গেলে ভাল হত। যতই আরামদায়ক কোচে যাত্রা করা হোক, ট্রেনের ঝাঁকুনিতে শরীর ক্লান্ত হবেই। এদিকে ঝিনুকদের হাতে সময় খুবই কম, ফেরার টিকিট কাল । উপর মহলের কাউকে ধরে ভি আই পি কোটায় রিজার্ভেশন পেয়েছেন দীপকাকু। কাল যদি ট্রেন না ধরা হয়, জেনারেল কম্পার্টমেন্টে বসে দাঁড়িয়ে ফিরতে হবে। একঘণ্টার মধ্যেই গরম জলে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে গিয়েছিল ঝিনুক। এরই মাঝে দীপকাকু সার্ভিস বয়কে দিয়ে কফি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রুমে।… হোটেল থেকে বেরোতেই সার সার ভাড়ার গাড়ি। দীপকাকু একটা ছোট এবং নতুন মডেলের গাড়ি হায়ার করলেন সারাদিনের জন্য। কাঁধে নিয়েছেন ঝোলা ব্যাগ, হয়তো জল-বিস্কুট আছে।

প্রথমে যাওয়া হল লোকাল থানায়। ঢোকার মুখে ঝিনুক দীপকাকুকে জিজ্ঞেস করেছিল, হাতে সময় কম, তবু আমরা এখানে কেন? উত্তরে দীপকাকু বলেছিলেন, ছেলেটার সম্বন্ধে এরা কতদূর কী খোঁজ খবর করেছে দেখে নিই। হয়তো গত দু’দিনে কোনও ইনফর্মেশন পেয়েছে। সেরকম কনক্রিট কিছু নয় বলে হেড কোয়ার্টারে জানায়নি।

ওসি সুখদেও কুমারের সঙ্গে কথা হল দীপকাকুর। নিজের পরিচয় দিয়ে পুলিশের সঙ্গে তিনিও যে এই কেসের তদন্ত করছেন জানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ছেলেটার ফটো থানায় এসেছে কিনা? ওসির মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ফটোটা প্রথম দেখছেন। তবু বললেন, এসেছে, মনে হচ্ছে। কথাবার্তা সব হিন্দিতে হচ্ছিল। ওসি হিন্দিভাষী। হাবিলদারকে দিয়ে ফাইল আনালেন সুখদেও কুমার। ফটো পাওয়া গেল। কম্পিউটার প্রিন্ট আউট। মেল করে পাঠানো হয়েছে। ওসি বললেন, এর সম্বন্ধে কোনও ইনফর্মেশন নেই আমাদের কাছে নেই। দীপকাকু জানতে চাইলেন, এ ধরনের ফটো এলে আপনারা কী পদ্ধতিতে খোঁজখবর করেন? ওসি জানালেন, তাঁরা প্রথমে নিজেদের থানার ক্রাইম রেকর্ড দেখে নেন। অপরাধী হিসেবে ছেলেটার নাম এবং ছবি নথিভুক্ত আছে কিনা। তারপর থানার সোর্সদের দেখান ফটোটা। সোর্সরা থাকে জনগণের মধ্যেই। নানান তথ্য এনে দেয় পুলিশকে। বিনিময়ে টাকা পায়। কোনও সোর্সই এই ফটো দেখে এখন অবধি কোনও খবর এনে দিতে পারেনি।… এটা বলার পর সুখদেও কুমার একটা ন্যায্য প্রশ্ন তুলেছিলেন, এই ছেলেটার খোঁজ আপনি এই থানাতে নিতে এলেন কেন? আপনার কাছে কি বিশেষ কোনও ইনফর্মেশন আছে ?

পাশ কাটানো উত্তর দিয়েছিলেন দীপকাকু, ছেলেটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে এই এলাকার। তাই জানতে এসেছি। সুখদেও কুমার দুপাশে মাথা নাড়ছিলেন, সন্তুষ্ট হননি উত্তরে। বলেছিলেন, এরকম চেহারার ছেলে আপনি শিলিগুড়ি থেকে কোচবিহার, এমনকী আসাম পর্যন্ত পাবেন। সব থানায় খোঁজ নেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষ কোনও তথ্যের উপর ভিত্তি করে আপনি এখানে এসেছেন।

দীপকাকু আর কথা ঘোরাননি। সংক্ষেপে জানালেন ছেলেটা দলগাঁও থেকে ট্রেনে উঠেছিল, এরকম একটা খবর আমার কাছে আছে। এরপরই থানার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন দীপকাকু। ওসিকে খানিকটা বিস্মিত এবং অপ্রতিভ দেখিয়েছিল। যথার্থ কৌতূহলে দীপকাকুর কাছে জানতে চান, আপনি এখন কীভাবে খোঁজ করবেন ছেলেটার।

— দেখি, বাজার, বাসস্ট্যান্ডের লোকেদের কাছে খোঁজ নিয়ে। কথা সেরে গাড়িতে এসে বসেছিলেন দীপকাকু। ঝিনুক পাশে গিয়ে বসতেই বলেছিলেন, এরা কোনও খোঁজ খবর করেনি। ফাঁকি মেরেছে।

ঝিনুক বলেছিল, পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে খুঁজতে গেলেই ভাল হত না? সহজ হত আমাদের কাজ। এলাকাটা চেনে পুলিশ।

দীপকাকু বলেছিলেন, না, পুলিশ দেখলেই ডাবলা গাজির বাড়ির লোক সতর্ক হয়ে যেত। আমাদের মতো সাধারণ পোশাকের লোকের কাছেই ওরা খোলা মনে কথা বলবে।

গাড়ি এখন গুমটু শহরের দিকে চলেছে। ড্রাইভার রুট চেনে। যদিও ট্যুরিস্টরা এদিকে বড় একটা আসে না। গুমটু গুম্ফার কথা জানেই না অনেকে। খানিক আগে সাদামাঠা হোটেলে লাঞ্চ সেরেছে ঝিনুকরা। এখন মাকড়াপাড়া রোড ধরে চলছে গাড়ি। দু’পাশে গ্রাম তেমন সজীব নয়, কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। দূরে জঙ্গলরেখা। দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছে সীমান্ত এলাকায় চলে এসেছে ঝিনুকরা। ডাবলা গাজির বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা হলেই এই কেস অনেকটা টার্ন নিয়ে নেবে, হয়তো পৌঁছে যাবে সমাধানের শেষ পর্যায়। দীপকাকুর ইনভেস্টিগেশন প্রসেসে লক্ষ্য রেখে ঝিনুকের মনে অনেক জিজ্ঞাসা জমা হয়েছে। কেস সলভড় হয়ে গেলেই সেই সব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর পেয়ে যাবে। নিজের অনুমান ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবে না। এইবেলা প্রশ্নগুলো করে নেওয়া ভাল। দীপকাকু জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন। চুল উড়ছে হাওয়ায়। ঝিনুক বলে, এই কেসটার ব্যাপারে কয়েকটা জিনিস জানার আছে আমার।

-বলো।

— তারাশংকরবাবুর ফ্ল্যাট যে সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটের পাশেই, আগে থেকে জানলেন কী ভাবে?

—ওটা সত্যিই অনুমান। তবে ওয়াইল্ড গেস নয়। পিছনে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আছে। ওই বিল্ডিঙে সুপ্রিয়বাবুর ঘনিষ্ঠ লোকেদের মধ্যে তারাশংকরবাবুর বয়স বেশি। বয়স্ক বাঙালিদের স্বভাবে এখনও আতিথেয়তা ব্যাপারটা রয়ে গিয়েছে। পাশে থাকেন বলেই অফিসারের চায়ের অর্ডারটা কানে গিয়েছে। আতিথেয়তার সুযোগটা ছাড়েননি।

ঝিনুক পরের প্রশ্নে যায়, প্রথম দিন সুপ্রিয়বাবুর ফ্ল্যাটে গিয়ে আপনি নানা জিনিস অবজার্ভ করতে করতে স্লাইডিং দরজার পর্দার নীচটা একটু বেশি সময় ধরে দেখলেন। কী খুঁজছিলেন?

—খুনির ফুটপ্রিন্ট। খালি পা, জুতো কিংবা মোজার ছাপ। আমি অনুমান করেছিলাম ছেলেটি যে পদ্ধতিতে ঘরে ঢুকেছে, খুনিও এসেছে সেই পথে। সঙ্গে পিস্তল রেখেছিল খুন করার জন্য নয়, যদি প্রয়োজনে লাগে, সেই ভেবে। খুন করাটাই উদ্দেশ্য হলে, পিস্তলে সাইলেন্সার লাগত। ফায়ারিং-এর আওয়াজে অত লোক জমা হতে দিত না। আমার ধারণা ডোরবেল বেজে উঠতেই, ভয় পেয়ে যায় লোকটি। নিজেকে বাঁচাতে ডাবলাকে গুলি করে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। লুকানোর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ছিল ওটাই। ফায়ারিং-এর আওয়াজ শুনে লোকজন ঘরে ঢুকবেই, খোলা দরজা দিয়ে খুনি পালিয়ে যাবে অথবা মিশে যাবে ভিড়ে।

— পর্দার নীচে কোনও ছাপ পাওয়া যায়নি। খুনি তাহলে পালাল কোনও রাস্তা দিয়ে? এদিকে আবার কোনও দরজা খোলা ছিল না। ডাবলা গাজি কীভাবে ঢুকে ছিল, সেটাও তো একটা রহস্য!

—রহস্যের চাবিকাঠি ব্যালকনির দরজার ছিটকিনি। বাইরে থেকে ওটা খোলা বন্ধ করতে পারলে কেল্লাফতে। ডাবলা এবং খুনি ছাদের পাইপে দড়ি বেঁধে নামতে পারবে। খুনি ডাবলাকে খুন করে ওই রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজার ছিটকিনি তুলে দড়ি বেয়ে উঠে যাবে ছাদে ।

—বাইরে থেকে ছিটকিনি খোলা বন্ধ করা কী করে সম্ভব?

—সম্ভব। ঘটনার আগের দিন সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটের যারা যারা এসেছিল তাদের মধ্যে কোনও একজন দরজা লাগোয়া ডানদিকের জানলার ছিটকিনিটা যদি সকলের অলক্ষে নামিয়ে দিয়ে রাখে, তাহলে ঠেলে হাত গলিয়ে দরজা খোলা যাবে, বন্ধও করা যাবে। তারপর জানলার পাল্লা টেনে দড়ি ধরে উঠে যাবে উপরে এবং ফায়ারিং-এর আওয়াজ শোনার পর সকলের সঙ্গে সুপ্রিয়বাবুর ফ্ল্যাটে ঢুকে এক ফাঁকে তুলে দেবে ব্যালকনির সেই জানলার ছিটকিনি। পুলিশ এসে দেখবে সব দিক বন্ধ অথচ মৃতদেহ পড়ে আছে ফ্লোরে। বিরাট একটা ধাঁধাঁ তৈরি হয়ে যাবে।

দীপকাকুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ঝিনুক। উত্তেজনায় শ্বাস নেওয়া ছাড়ার রেট বেড়ে গিয়েছে। বলে ওঠে, খুনি তার মানে ঘটনার আগের দিন সুপ্রিয়বাবুর ফ্ল্যাটে যারা এসেছিল তাদের মধ্যে কেউ?

– সরাসরি খুনি না হয়ে, সাহায্যকারীও হতে পারে এবং সেটা শুধু একজন নয়, দু’জন হওয়ারও সম্ভাবনা আছে।

—কীরকম? কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চায় ঝিনুক।

দীপকাকু বলতে থাকেন, যে আটজন ঘটনার আগের দিন ফ্ল্যাটে এসেছিল, তাদের মধ্যে তিনজন পুলিশ আসার আগে ওই ফ্ল্যাটে এসেছিল, কাজের মহিলা, ড্রয়িং স্যার, সোমাদেবীর ভাই। রান্না শিখতে আসা গুজরাটি মহিলা অমৃতা যেহেতু ওই বিল্ডিঙেই থাকে গুলির শব্দ শুনে উপরের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল ধরে নিচ্ছি, যদিও এখনও অবধি তার কোনও প্রমাণ পাইনি। মানে যা দাঁড়াল, আটজনের মধ্যে পাঁচজন জানলার ছিটকিনি খোলা বন্ধ করতে পারবে, বাকি তিনজন শুধু খুলে রাখতে পারবে। খুনি যদি বাইরের কেউ হয়, তিনজনের একজনকে দিয়ে ছিটকিনি খুলিয়ে রেখেছিল। পাঁচজনের (একজন কে) দিয়ে বন্ধ। পাঁচজনের একজন যদি খুনি হয়, জানলার ছিটকিনি খোলা বন্ধ করতে তাদের কোনও অসুবিধে হয়নি। যেহেতু এতজন সন্দেহভাজন। তাই আমি খুনের মোটিভ নিয়ে ভাবছি। সেক্ষেত্রে সন্দেহের তীর একজনের দিকেই, সুপ্রিয় পাল।

থেমে গেলেন দীপকাকু। কেন ‘সুপ্রিয় পাল’, বলছেন না। গাড়ির জানলার বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন! ঝিনুক জানতে চাইতে যাবে, দীপকাকু মুখ ফিরিয়ে নিজেই বলতে শুরু করলেন, যেহেতু বৌদ্ধ মন্দিরের ঘণ্টা খোয়া যাওয়া আর খুনের মধ্যে একটা যোগ সূত্র আছে, তাই সন্দেহের তীর সুপ্রিয় পালের দিকেই যায় । খুনটা করাও তার পক্ষে খুব সহজ, ছাদে দড়ি বেঁধে, ব্যালকনির দরজা খোলা রেখে ডাবলা গাজিকে তিনিই ঘরে ঢোকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। প্ল্যানটা হয়তো মুখোমুখি দেননি, কারুর দ্বারা অথবা ফোনে গলা পালটে। কেন না, মালিক নিজের ফ্ল্যাটে ঢোকার রাস্তা নিজেই দেখিয়ে দিলে, যে লুকিয়ে ঢুকছে, বুঝে যাবে এটা ফাঁদ। ডাবলাকে ঢুকিয়ে নেওয়ার পর সুপ্রিয় পাল নিজের কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলেছিলেন, ডাবলাকে গুলি করে দরজার বাইরে যান, তারপর ডোরবেল টেপেন। সেই জন্যই আমি সোমাদেবীকে মনে করতে বলেছিলাম, আগে গুলির শব্দ শুনেছেন, না ডোরবেলের। উনি বলছেন ডোরবেল, যদি মিথ্যেও বলেন, তবু সুপ্রিয় পালকে খুনি হিসেবে ভাবতে গিয়ে বেশ খটকা লাগছে। এখন যে খুনের পদ্ধতিটা বললাম, ঠান্ডা মাথার খুন। এরপর কেন সুপ্রিয় পাল দরজা জানলার ছিটকিনি তুলে নিজের ঝামেলা বাড়াবেন? ব্যালকনির রাস্তা খোলা থাকা মানে, খুনি, ডাবলা দু’জনেই ব্যবহার করেছে ওই পথ। তাতে সুপ্রিয় পাল পুরোপুরি সন্দেহের বাইরে থেকে যেতেন। এখন যদি সুপ্রিয় পালের কোনও শত্রু, যে পুলিশ আসার আগে ঢুকেছিল ফ্ল্যাটে, দরজা-জানলার ছিটকিনি তুলে দিতে পারে সে। সেক্ষেত্রে সুপ্রিয়বাবু প্যাঁচে পড়ে যাবেন। সেরকম যদি কেউ থেকে থাকে, তা হলে বলতে হবে গোটা ঘটনার উপর নজর ছিল তার এবং সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান ।

— তার মানে এই অপরাধের পিছনে অন্তত দু’জনের যোগসাজশ আছেই। সেই কারণেই আপনি আটজনের মোবাইল নাম্বার নিয়েছেন। চেক করেছেন কললিস্ট। ঘটনার আগে পরে কে কাকে ফোন করেছে, দেখছেন। আপনি মঙ্গলাদির ফোন নাম্বার নিতে ছাড়েননি। কারণ, তাকে দিয়ে জানলার ছিটকিনি খুলিয়ে রাখা যায়। ছাদের পাইপে দড়ির দাগ মোছানো যায়। মঙ্গলাদির টাকার প্রয়োজন কতটা জানার জন্যই, মেয়ের বিয়ের চেষ্টা চলছে কি না জিজ্ঞেস করেছিলেন।

ঝিনুক থামতেই দীপকাকু বলে উঠলেন, বাঃ, তুমি তো দেখছি খুব মন দিয়ে অবজার্ভ করেছ আমার ইনভেস্টিগেশন। ভেরি গুড। হবে, মনে হচ্ছে তোমার হবে।

কমপ্লিমেন্ট গায়ে মাখল না ঝিনুক, তার আরও জানার আছে। জিজ্ঞেস করল, কললিস্ট থেকে কিছু পেলেন ?

—নাঃ সোমাদেবীর ফোনে ওই যা দু’টো বীরপাড়ার কল। তাও ঘটনার অনেক আগে।

– আচ্ছা, ব্যালকনির পর্দায় যে সব মাথার চুল পাওয়া গিয়েছে, আট-ন’জনের সঙ্গে ম্যাচ করালে হয় না? ওর মধ্যে এমন কারুর চুল পাওয়া যেতেই পারে, যার ওই পর্দার তলা দিয়ে যাওয়ার কথা নয়। তাকে খুনি হিসেবে সন্দেহভাজনের তালিকায় প্রথমে রাখা যেতে পারে।

—খুনি ওই পর্দার তলা দিয়ে গিয়েছে মানেই তার চুল ওখানে লেগে থাকবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। পুলিশকে দিয়ে আটজনের সঙ্গে পর্দায় লেগে থাকা চুল ম্যাচ করাতে গিয়ে যদি সন্দেহ করার মতো কাউকে না পাওয়া যায়, আবার অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ব আমি। আগে যেমন ফরেনসিক টেস্টগুলো করতে দিয়ে ফলস্ পজিশনে পড়েছিলাম। তাছাড়া খুনি যদি বাইরের কেউ হয় আটজনের সঙ্গে চুল ম্যাচ করবে না। তাই আমি ঠিক করেছি আগে খুনিকে ধরে, পরে চুল ম্যাচ করাব। যদি মিলে যায়, তার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোরাল হবে।

দীপকাকুর বলা শেষ হতেই ড্রাইভার বিনোদ তামাং সামনে আঙুল তুলে বলল, ওই দেখুন কালী মন্দির। ওটাই বর্ডার। ওপারে গেলেই ভুটান।

খানিক আগেই একটা চেকপোস্ট পেরিয়ে এসেছে ঝিনুকরা। রাস্তার দু’পাশে বি এস এফ-এর কাঠের ঘর, চলতি কথায় যাকে বলে ‘চৌকি’। চেক পোস্টের বাঁশের গেটটা পর্যন্ত ফেলা নেই। বর্ডার এতই অবাধ। তামাং শুধু গাড়িটা একটু স্লো করেছিল জায়গাটা পার হওয়ার সময়। তারপর শুরু হয়েছে চড়াই। কালী মন্দিরের সামনে গাড়ি পৌঁছতেই, দীপকাকু থামাতে বললেন। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করল বিনোদ তামাং। বলল, গুমটু গুম্ফা এখান থেকে হাফ কিলোমিটার। টাউন অ্যানাদার হাফ ।

—ঠিক আছে, এখানে একবার নামি। বলে সাইড ব্যাগ কাঁধে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন দীপকাকু। তারপর ঝিনুক। সমতল থেকে জায়গটা অনেকটাই উঁচু। লাল রঙের কালী মন্দির আরও উঁচুতে। উপরে ওঠার জন্য চওড়া বাঁধানো সিঁড়ি। আশপাশে লোকজন চোখে পড়ছে না। মন্দিরের সিঁড়ি থেকে একটু দূরে ছিটে বেড়ার চা দোকান। জিনিসপত্র তেমন কিছু নেই। বৃদ্ধ দোকানিকে দেখা যাচ্ছে, উনুনে কিছু বসিয়েছে। লোকটার মুখ চোখে মঙ্গোলিয়ান আদল। দীপকাকু এগিয়ে যাচ্ছেন দোকানটা লক্ষ করে। দোকানের পিছনে বাড়িঘর, গাছ-পালা কিছু নেই। মনে হচ্ছে ওর পরেই খাদ । দূরে পাহাড় শ্রেণীর মাথায় সাদা মেঘ।

দোকানের একপাশে বাঁশের বেঞ্চে গিয়েছে বসলেন দীপকাকু। দোকানিকে দুটো চা দিতে বললেন। ঝিনুকও বসল বেঞ্চে। ড্রাইভার তামাংও এসেছে। সে রইল দাঁড়িয়ে। মোবাইলে টাইম দেখাচ্ছে দু’টো দশ। ফোনের টাওয়ারও আছে। দীপকাকু সাইড ব্যাগ থেকে একগাদা ফটো বার করলেন, সবই ভিডিও ফুটেজের স্টিল ভাল করে নজর করে ঝিনুক দেখল আর্ট সন্দেহভাজনের এবং ডাবলা গাজি জীবত্ব অবস্থার ফটো। দোকানি কাচের গ্লাসের চা নিয়ে এল। দীপকাকু একটা গ্লাস নিলেন। ঝিনুককে দ্বিতীয় গ্লাসটা এগিয়ে দিতে যাচ্ছি দোকানি, ইশারায় ঝিনুক ড্রাইভারকে দেখিয়ে দিল। সে খাবে না জেনেই দীপকাকু দু’টো চায়ের অর্ডার করেছিলেন। দোকানি ফিরে যাচ্ছিল, দীপকাকু ডাকলেন, ইধার শুনো।

এগিয়ে এল দোকানি। ডাবলা গাজির ছবিটা দেখিয়ে দীপকাকু জিজ্ঞেস করলেন, ইসকো পহেচানতেহো?

—হাঁ। ডাবলা। কলকাত্তা মে নোকরি ঢুঙনে গ্যায়া থা। অ্যাক্সিডেন্ট পে মর গ্যায়া। ধাক্কা মারা এক গাড়ি।

ঝিনুক এতটাই অবাক হয়েছে, বেঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল। এতদূর উজিয়ে যে দুঃসংবাদ তারা দিতে এসেছে, সেটা অলরেডি এখানে পৌঁছে গিয়েছে। তবে একটু মোড়কে ঢেকে, খুনের বদলে অ্যাক্সিডেন্ট।

দীপকাকু জিজ্ঞেস করলেন, কব হুয়া অ্যাক্সিডেন্ট? কিসনে খবর ভেজা? পুলিশ?

—উতনা নেহি মালুম স্যার। ডাবলা কা ভাই ডম্বর কা পাস ফোন আয়া থা পরশো। উসি দিনহি আপনা মাকো লেকর কলকত্তা চলা গায়া ডম্বর ।

—ডাবলাদের বাড়িটা কোথায়? জানতে চাইলেন দীপকাকু। দোকানি রাস্তার ওপারে ঢালুর দিকে আঙুল তুলে বলল, থোড়া পয়দল যানা পড়েগা। সামনে একঠো গাঁও হ্যায় খারশোলা। গাড়ি যানে কা রাস্তা নেহি হ্যায়।

থেমে গিয়ে ফের দোকানি বলল, ঠহরিয়ে, আপ কো সাথ লড়কা দে দেতে হ্যায়। উহ লেকর জায়েগা আপ লোগোকো।

কথা শেষ করে দোকান ছেড়ে খানিক এগিয়ে গেল বৃদ্ধ । মন্দিরের দিকে মুখ তুলে কারুর একটা নাম ধরে হাঁক পাড়ল । বার দুয়েক। একটু অপেক্ষার পরই দেখা গেল মন্দিরের সিঁড়ি ধরে নেমে আসছে দু’টো বাচ্চা ছেলে, তাদের একজনের কোলে সাদা-কালো ছাগল বাচ্চা। মন্দিরের চাতালে হয়তো খেলছিল ওরা। নীচ থেকে দেখা যায়নি।

নুড়ি পাথরের রাস্তার ঢাল বেয়ে ঝিনুকরা এখন ডাবলা গাজির বাড়ির উঠোনে। ড্রাইভার তামাং গাড়ি ছেড়ে আসেনি। হেঁটে আসতে আসতে দীপকাকু দু’টো ফোন করেছেন। ফোনের একপ্রান্ত শুনেই ঝিনুককে অপর প্রান্তের কথা আন্দাজ করে নিতে হয়েছে। এ সময় দীপকাকুকে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না । ভীষণ সিরিয়াস হয়ে আছেন। ঘটনা এরকম অপ্রত্যাশিত বাঁক নেবে ভাবতে পারেননি। প্রথম ফোন করলেন আইও তাপস রায়কে। কথপোকথন থেকে ঝিনুক বুঝতে পারল, থানা থেকে ডাবলা গাজির ভাইকে ফোন করা হয়নি। অন্য কেউ ফোন করে ঘটনাটা জানিয়েছে তাদের। অফিসার সেই ফোন নাম্বার চেক করে দেখেছেন, পাবলিক বুথ থেকে করা হয়েছে কল। কলকাতাতেই ডাবলার অন্ত্যেষ্টি সেরেছে মা, ভাই। ফোন কেটে দীপকাকু বলে উঠেছিলেন, কেসটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই বাড়ির লোক ডেকে পাঠিয়ে শেষকৃত্য সেরে ফেলা হল। ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছি দেখে ভয় পেয়েছে। অজ্ঞাত অপরাধীকে মনে করে কথাগুলো বলেছিলেন দীপকাকু। পরের ফোনটা করলেন সুপ্রিয় পালকে। এক প্রান্তের কথা শুনে যা বোঝা গেল। সুপ্রিয় পালকে থানা থেকে জানানো হয়েছে ডাবলা গাজির মা, ভাই এসেছে। অস্বস্তিবোধ থেকে সুপ্রিয়বাবু ওদের সঙ্গে দেখা করতে যাননি। …

অফিসারকে রিকোয়েস্ট করেছিলেন তাঁর ফ্ল্যাটে যেন ওদের পাঠানো না হয়। কথা শুনেছেন অফিসার।

এই ফোনটার পর দীপকাকুর মুখ আরও থমথমে হয়ে গেল। ডাবলা গাজির বাড়ির উঠোনে ঝিনুকদের ছেড়ে দিয়ে উধাও হয়েছে বাচ্চা দু’টো! বাড়িটা কাঠ আর টিনের চালের। অর্ধেকটা দোমড়ানো মতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এমনটা হয়েছে বলেই মনে হয়। তবু কেমন যেন একটু অদ্ভুত ঠেকছে। একটা ঘর অক্ষত, দরজায় তালা দেওয়া। শহুরে লোক দেখে ডাবলা গাজির প্রতিবেশীরা কৌতূহলী মুখ নিয়ে ঘিরে রয়েছে ঝিনুকদের। দীপকাকু ওদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছেন। চা-দোকানি ডাবলা গাজি সম্বন্ধে যা বলেছিল, এরা একই কথা বলছে, কলকাতায় চাকরি খুঁজতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে ডাবলা। ফোন এসেছিল ওর ভাইয়ের মোবাইলে। দীপকাকু এখন সাইড ব্যাগ থেকে আট সন্দেহভাজনের ফটো বার করে প্রতিবেশীদের দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এদের মধ্যে কেউ এখানে এসেছিল কি না?

এক চান্সে সুপ্রিয় পালের ফটো শনাক্ত করল সকলে। বলল, বেশ কিছুদিন আগে ইনি একরাত ডাবলার বাড়িতে কাটিয়েছেন। ঘুরতে এসেছিলেন এখানে। এক বৃদ্ধ প্রতিবেশীর কাছে একটু বেশি খবর পাওয়া গেল। সে বলল, এই ভদ্রলোকের কাছেই চাকরি খুঁজতে গিয়েছিল ডাবলা। গ্রামবাসীরা হিন্দি বাংলা মিশিয়ে এমন একটা ভাষায় কথা বলছে, ঝিনুকের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে বেশ। দীপকাকু ওদের জিজ্ঞেস করলেন, ডাবলা গাজি এখানে কী কাজ করত?

এদের একজন বলল, চাষের কাজ আর বর্ডারের ওপার থেকে মাল এনে শিলিগুড়ির মার্কেটে বিক্রি করত।

—কী মাল আনত? জানতে চাইলেন দীপকাকু উত্তর দেওয়ার বদলে লোকটি আঙুল তুলল দূরে দাঁড়ানো এক যুবকের দিকে। বলল, ওই তো নারান। ডাবলার বন্ধু। ওকে জিজ্ঞেস করুন, সব জানে।

চকরাবকরা টিশার্ট, জিনস পরা ছেলেটাকে অনেক আগেই খেয়াল করেছে ঝিনুক। বেশ খানিকটা দূরত্ব রচনা করে ঝিনুকদের কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছিল। এখন ওর দিকে আঙুল উঠতেই, ঘুরে গিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করেছে। দীপকাকু ঝিনুকের দিকে তাকালেন । চোখের ভাষা পড়ে নিয়ে ঝিনুক দৌড়ে গিয়ে ছেলেটার মুখোমুখি দাঁড়াল। দু’পাশে দু’হাত ছাড়িয়ে বলল, ওঁর কাছে পিস্তল আছে। পালানোর চেষ্টা করো না, পায়ে গুলি করবেন।

দীপকাকু এগিয়ে এসেছেন। ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বললেন, পুরো নাম কী?

–নারান খাখা ।

—চলো নারান, তোমার সঙ্গে একটু গল্প করা যাক। বলে ছেলেটার কাঁধে হাত রেখেই সামনের দিকে হাঁটতে লাগলেন দীপকাকু ।

মেন রাস্তার দিকে না গিয়ে দীপকাকু নারান খাখার সঙ্গে চলে এসেছেন ছোট একটা মাঠে। সেখানে দুটো পাথরখণ্ড। দু’জন দু’টোতে মুখোমুখি বসে আছেন। ঝিনুক দাঁড়িয়ে। নারান খাখা নিজের বন্ধুর ব্যাপারে অনেক ইনফর্মেশন দিল। সে সব এতই গুরুত্বপূর্ণ এবং চমকপ্রদ, দীপকাকু চুপ করে গিয়েছেন। চিন্তার ঝড় চলছে মাথায় । নারান খাখা জানাল, ডাবলাদের জমি খুবই কম। চাষের কাজটা করত মূলত ওর ভাই। বর্ডার পেরিয়ে গিয়ে ডাবলা ভুটানের হ্যান্ডিক্রাফট নিয়ে আসত, ব্যাগ, সোয়েটার, জ্যাকেট ছাড়াও বৌদ্ধমন্দিরের নানান জিনিসের রেপ্লিকা, জপযন্ত্র, বুদ্ধিমূর্তি, বিভিন্ন টাইপের ঘণ্টা। চায়নার ইলেকট্রনিক্স গুডস্ আনত। বিক্রি করত শিলিগুড়ির হংকং মার্কেটে।

এভাবে জিনিস আনা বেআইনি, বিশেষ করে চায়নার প্রোডাক্টের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে। সেই কারণে গভীর জঙ্গলের রাস্তা ধরে বর্ডার পেরোত ডাবলা এবং ওর সঙ্গীসাথী। নারান বেশ কয়েকবার সঙ্গে গিয়েছে। সে অবশ্য চাষ নিয়েই থাকে। তাদের প্রচুর জমিজমা। সুপ্রিয় পালের সঙ্গে ডাবলার দেখা হয়েছিল শিলিগুড়িতে। ডাবলার রেপ্লিকা দেখে সুপ্রিয় পাল বলেছিলেন, তুমি আমাকে এগুলোর এক-দু’টো অরিজিনাল এনে দিতে পারবে? অনেক টাকা দেব। ডাবলা টাকার লোভে রাজি হয়। জঙ্গলের যে রাস্তা দিয়ে ডাবলারা গোপনে মালপত্র নিয়ে আসত, তার চেয়ে বেশ খানিকটা গভীরে বহু পুরনো ভাঙাচোরা বৌদ্ধমন্দির আছে। সেই মন্দিরের অস্তিত্ব এ গ্রামের লোকেরা জানে না। হয়তো এখনকার ভুটান সরকারও অবহিত নয়। তাই সংস্কার হয়নি। ডাবলা অরিজিনাল জিনিস দেবে শুনে সুপ্রিয় পাল ওর পিছন ছাড়েননি। চলে এসেছিলেন এই গ্রামে। তবে ডাবলা ওকে মন্দিরে নিয়ে যায়নি। চেনায়নি রাস্তা। যদি পরে এসে সুপ্রিয় পাল বৌদ্ধ মন্দিরের আরও সব জিনিস চুরি করে নিয়ে যান। মন্দির থেকে জিনিস চুরি করা নিয়ে ডাবলার মনেও খচ্‌খচানি ছিল। এখানকার সকলে ভগবান বুদ্ধকে খুব মানে। ডাবলাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। টাকার জন্যই ওই মন্দিরের একটা ঘণ্টা এনে দিয়েছিল সুপ্রিয় পালকে। উনি চলে যাওয়ার পরই ডাবলাদের পরিবারে বিপর্যয় নেমে এল। ডাবলাদের জমির সমস্ত ফসল নষ্ট করল হাতির পাল। অন্যদেরও করেছে, ডাবলাদের মতো পুরোটা নয়। ডাবলাদের বাড়ি ভেঙে দিয়ে গেল। এই অংশে এসে ঝিনুক বুঝতে পারল বাড়িটা কেন তার ওরকম অদ্ভুত রকমের দোমড়ানো লেগেছিল। হাতিতে ভেঙে দিয়ে যাওয়া বাড়ি আগে তো কখনও দেখেনি।… একদিন হংকং মার্কেটে মালপত্র বিক্রি করে ট্রেনে ফেরার পথে ডাবলার সব টাকা লুঠ করল ডাকাত দল। খুব ভেঙে পড়েছিল ডাবলা। ওর মনে স্থির বিশ্বাস জন্মাল মন্দিরের ঘণ্টা চুরি করার সাজা দিচ্ছেন ভগবান। সব কথাই আলোচনা করত বন্ধু নারানের সঙ্গে। ঠিক করল কলকাতায় গিয়ে ঘণ্টা ফেরত এনে মন্দিরে রেখে দেবে। কলকাতার বাবুর দেওয়া টাকা ততদিনে শেষ। মহাজনের কাছে টাকা ধার করল কলকাতার বাবুকে দেওয়ার জন্য। কলকাতা গেল। জানত না শেষ সাজা ভগবান এখানেই বরাদ্দ করে রেখেছেন। অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল। … কথা শেষের দিকে গলা কেঁপে গিয়েছিল নারান খাখার। কঠিন হৃদয় পাহাড়ি ছেলের চোখ ভরে উঠেছিল জলে। ডাবলা গাজি অন্যায় কাজ করলেও, ওর এরকম করুণ পরিণতি শুনে মন ভার হয়ে গেছে ঝিনুকেরও। নারানকে ধাতস্ত হতে দিয়েছেন দীপকাকু। এতক্ষণে বলে উঠলেন, তুমি আমাদের মন্দিরটায় নিয়ে যাবে? এখনই যাব ।

চমকে মুখ তুলল নারান খাখা, চোখে অনিচ্ছা আর অবাক ভাব । দীপকাকু বললেন, চিন্তা নেই, মন্দির থেকে কিছু চুরি করব না আমরা। আর একটা ব্যাপার শুনে রাখো, তোমার বন্ধু গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়নি। তাকে খুন করা হয়েছে। কেসটার ইনভেস্টিগেশনে এসেছি আমি। মন্দিরের ব্যাপারটা যদি তোমার বানানো হয়, আমার তদন্ত ভুল পথে চলে যাবে। সেই কারণেই একবার নিজের চোখে দেখতে চাই মন্দিরটাকে।

—ডাবলা খুন হয়েছে! গলায় অবিশ্বাস আর পড়ল নারানের। দীপকাকু সাইড ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা খবরের কাগজ বার করলেন। নারান খাখাকে দেখালেন পুলিশের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে মৃত ডাবলার ফটো।

বেশ কিছুটা সময় নিয়ে বিজ্ঞাপনটা দেখল নারান খাখা। বাংলা পড়তে পারে বলেই মনে হচ্ছে। কোলে কাগজটা রেখে চারপাশটায় একবার চোখ বোলালো । বলল, আলো কমে আসছে এখনই। অনেকটা যেতে হবে। জঙ্গলের রাস্তা। ফিরতে ফিরতে অন্ধকার।

— কোনও অসুবিধে নেই। তুমি চলো। আমার সঙ্গে টর্চ, পিস্তল সব আছে। বললেন দীপকাকু।

জঙ্গল এত ঘন, বাইরের আলো প্রায় পৌঁছচ্ছে না। আবছা অন্ধকার। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছে তিনজনে। মাঝে মাঝেই চড়াই উৎরাই। হাঁপ ধরে যাচ্ছে ঝিনুকের। রাস্তা বলে কিছু নেই। নারান খাখা হাঁটছে সামনে, কাস্তে চালিয়ে ঝোপঝাড় কেটে রাস্তা তৈরি করে দিচ্ছে। জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে নানান জীবজন্তু, পাখির ডাক। কর্কশ ঘণ্টা ধ্বনির মতো একটা আওয়াজ হঠাৎ শুরু হয়ে যাচ্ছে আশেপাশে। নারানকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, পোকার আওয়াজ। জার্নিটা এত বোরিং ঝিনুক বেশ খানিক আগে দীপকাকুকে জিজ্ঞেস করে বসেছিল, এই কেসের জন্য মন্দিরটা দেখা কি খুবই ইম্পর্টেন্ট ?

দীপকাকু বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই জরুরি। যে ঘণ্টার ফটোটা আমার কাছে এসেছে, তার সময় কাল জানতে হলে বৌদ্ধমন্দিরের স্থাপত্যটা দেখা দরকার। ঘণ্টাটায় তিব্বতী প্রভাব স্পষ্ট। ভুটানের প্রকৃত রূপকার নাওয়াঙ নামগিয়াল এসেছিলেন তিব্বত থেকে। অনেক বিদ্রোহ, সংঘাত পেরিয়ে ১৬৩৯ সালে নামগিয়াল ভুটানের একমাত্র শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপরই মাত্ৰ, কুড়ি-বাইশ বছরের মধ্যে ভুটানের সমস্ত প্রবেশ পথের উপর দুর্গ নির্মাণ করে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন দেশের। আমার মনে হচ্ছে ঘণ্টাটা সেরকমই কোনও দূর্গের ভিতর লাখাং-এর মধ্যে ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভেঙে গিয়েছে দূর্গ। পথটাও আর প্রচলিত নয়। জঙ্গলে ঢেকে গিয়েছে জায়গাটা। ভুটানবাসীর অগোচর চলে গিয়েছে দুর্গটা। লাখাং-এ থাকে বৃদ্ধের নানান রূপের মূর্তি। স্থানীয় দেবতার বিগ্রহ। পদ্মসম্ভবের মূর্তি। এরকমই কোনও দেববিগ্রহের হাতে ছিল ঘণ্টাটা। সেটা যদি ষোলোশো সাতেরোশো সালের হয়। ঘণ্টাটার ঐতিহাসিক মূল্য বিরাট।… ঘণ্টাটার গুরুত্ব অনুধাবন করার পর থেকে ঝিনুক হাঁপ ধরে আসা শ্বাসটাও আস্তে করে ফেলছে। দীপকাকু যেন ওর কষ্টটা টের না পান। জঙ্গলে অনেকক্ষণ হল মোবাইলের টাওয়ার নেই। এমনটা হবে আন্দাজ করে দীপকাকু যাত্রার শুরুতেই নারানকে বলেছিলেন, ডাবলার নিশ্চয়ই মোবাইল ছিল, নাম্বারটা দাও তো।

নাম্বার নিয়ে কল করেছিলেন দীপকাকু। ‘নাম্বার ডাজ নট এগজিস্ট’ বলছে। ঝিনুকের উদ্দেশে দীপকাকু বলেছিলেন, দেখছিলাম কেউ কলটা ধরে কিনা। ডাবলার মৃত্যুর পর যে ওর মোবাইল সরিয়েছে, সেটটা থেকে ভাইয়ের নাম্বার নিয়ে ফোন করেছিল এখানে। সুপ্রিয় পাল মোবাইল সরালেও, ভাইয়ের নাম্বার সেই সেট থেকে নেওয়ার দরকার পড়বে না। নিজেই এসেছিলেন এই গ্রামে। ডাবলার নাম্বারের কললিস্ট চেক করতে হবে। দেখতে হবে কলকাতায় কার কার সঙ্গে কথা হয়েছে ওর। তাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে খুনি।

জঙ্গলের ঘনত্ব কমে এসেছে। সন্ধে নেমে গিয়েছে পুরোপুরি। একটা চড়াইয়ে উঠে নারান খাখা আঙুল দেখিয়ে বলে ওঠে, ওই দেখুন মন্দির।

অনতিদূরে সিলুয়েটে মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। পিছনের আকাশ দেখে বোঝা যাচ্ছে সূর্য ডুবেছে ওই দিকেই। হ্যারিকেনের তেল শেষ হয়ে যাওয়ার মতো আলো। মন্দির মাঝে রেখে অনেকটা চত্বর জুড়ে ভাঙা পাঁচিল। দীপকাকুর আন্দাজ মনে হচ্ছে সঠিক, ষোলোশো- সাতেরোশো সালের কোনও দূর্গের খণ্ডাংশ। উত্তেজনায় জোরে পা চালিয়েছেন দীপকাকু ।

ঢালু বেয়ে নেমে ঝিনুকরা আবার জঙ্গলে প্রবেশ করল। কিছুদূর যাওয়ার পরই পাখির ডানার মতো দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল নারান। ঝিনুকদের এগোতে বারণ করছে। কিছু একটা দেখেছে। চাপা গলায় বলে ওঠে, ওই দেখুন!

সামনের দিকে তাকিয়ে ঝিনুকের প্রথমে মনে হয় বেশ কিছু চলমান পাহাড়। মূহূর্তে ভ্রম কাটে, ফিট তিরিশ দূরে হাতির দল। এত বিশাল লাগছে কেন? হাঁটা চলা রাজার মতো। চিড়িয়াখানা, সার্কাসের হাতির সঙ্গে এদের তুলনাই চলে না। অজান্তেই ঝিনুকের হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে। নারান বলল, আর এগোন ঠিক হবে না। তাড়া করলে এঁদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারব না আমরা।

—হুঁ, ফিরেই যেতে হবে। একবার যখন দাঁড়িয়ে পড়ে পায়চারি শুরু করেছে। এখান থেকে কখন যাবে, কোনও ঠিক নেই। দু’তিনদিনও থেকে যেতে পারে বললেন, দীপকাকু। হঠাৎ একটা হাতি শুঁড় তুলে ডেকে উঠল। ধড়ফড় করে ওঠে ঝিনুকের বুক। হাতির ডাককে বলে বৃংহন, ছড়িয়ে পড়ল দূর দূরান্তে। কাকে কী বার্তা পাঠাল, কে জানে! কেন যেন ঝিনুকের মনে হচ্ছে ঘণ্টা চুরির পর ইতিহাসের গোপন নির্দেশে এরা পাহারা দিচ্ছে প্রাচীন এই বৌদ্ধমন্দির। মানুষ আর এদিকে আসার সাহস করবে না ।