রহস্যে অতীতের ধ্বনি – ৩

৷৷ তিন ৷৷

ট্রেনটা অনেকক্ষণ হল খুব আস্তে চলছে। সাইড আপার বার্থে উপুড় হয়ে বই পড়ছে ঝিনুক। ভুটানের ওপর বই। দীপকাকুর পড়তে দিয়েছেন। কাল লাগেজ নিয়ে ঝিনুককে বাড়ি থেকে নিতে এসেছিলেন, বইটা দিয়ে বলেছিলেন, সঙ্গে নিয়ে নাও। ট্রেনে যেতে যেতে পড়ো।

বইটার নাম দেখে ঝিনুক বলেছিল, আমাদের কি বর্ডার ক্রস করে ভুটানের ভিতরে চলে যাওয়ার চান্স আছে?

—তা হয়তো নেই। তবু একটা দেশের অত কাছাকাছি যখন যাচ্ছ, দেশটার সম্বন্ধে জেনে রাখা ভাল। বলেছিলেন দীপকাকু। ঝিনুক বইটা নিজের লাগেজে নিয়েছিল। ট্রেনে পড়ার জন্য কোনও একটা বই তো নিতই, না হয় এটাই পড়বে। রাতে বেশিক্ষণ পড়ার সুযোগ হয়নি। ট্রেনের শিডিউল টাইম ছিল সাড়ে আটটা। মাত্র পাঁচ মিনিট দেরিতে ছেড়েছে ট্রেন। সাড়ে ন’টা বাজতে না বাজতে কমপার্টেমেন্টর প্যাসেঞ্জাররা কুপ, করিডোরের লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। যেহেতু রাত সাড়ে আটটার ট্রেন, অনেকেই ডিনার করে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে। ঝিনুকরাও তাই। যারা দূর থেকে শিয়ালদায় এসে ধরেছে ট্রেন, তাদের ডিনার করার সময়টুকু আলো জ্বালা ছিল। তারপরই যে যার সুখে নিদ্রা দিয়েছে। মাথার উপর রিডিং লাইট জ্বেলে বইটার পাতা ছয়েক পড়েছিল ঝিনুক, নিস্তব্ধ প্ৰায়ন্ধকার কমপার্টমেন্ট, ট্রেনের দুলুনিতে কখন যেন ঘুম এসে গিয়েছিল। ভুটান সম্বন্ধে ওইটুকু পড়েই সে বেশ অবাক হয়েছে, যে দেশটাকে এতদিন সে জানত শান্তির প্রতীক হিসেব। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ বলে যাকে গণ্য করা হয়। অতীতে সেখানে প্রচুর হানাহানি হয়েছে, গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকত। পার্শ্ববর্তী রাজ্য কোচবিহার, আসাম, বাংলার ওপর সুযোগ পেলেই আক্রমণ চালাত তারা। মোগল আমল থেকে ইংরেজরা পর্যন্ত যথেষ্ট সমঝে চলত ভুটান রাজাদের। ভুটান নিয়ে ঝিনুকের বরাবর একটা খটকা ছিল। এমন শান্ত দেশটার জাতীয় পতাকায় মুখ দিয়ে আগুন বেরনো ড্রাগনের ছবি কেন? বইটা পড়তে পড়তে উত্তর পেয়ে গিয়েছে সে। ভুটান এখন যুদ্ধ বিগ্রহে একেবারেই বিশ্বাস করে না। পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা দেশটা জুড়ে শোনা যায় বৌদ্ধমঠের অচঞ্চল ধীর মন্দ্র ঘণ্টাধ্বনি, পাখির ডাক। গাড়ির হর্ন বাজানোর প্রায় দরকারই পড়ে না।

ট্রেন এন জে পি পৌঁছেছিল সকাল সাতটা নাগাদ। লোকজনের হইচইয়ে ঘুম ভেঙে ছিল ঝিনুকের। প্রচুর প্যাসেঞ্জার নেমে গেল। এরা বেশিরভাগ দার্জিলিং, গ্যাংটক যাবে। ঝিনুকরা এই ট্রেনেতেই যাবে আরও খানিকটা। নিউ জলপাইগুড়ি ছাড়তেই দীপকাকু নিজের জন্য চা ঝিনুকের কফি কিনেছিলেন হকারের থেকে। কফি খেয়ে ফের বইটা পড়তে শুরু করেছিল ঝিনুক। পড়ছিল বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে কোন সময়, কীভাবে তিব্বতে গিয়েছিল। তিব্বত থেকে এসেছিল ভুটানে। বই পড়ার মাঝে টয়লেটে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেছে ঝিনুক। ব্রেকফাস্টও খেয়েছে। রেল ক্যান্টিনের সার্ভিস বয়ের থেকে ব্রেকফাস্ট কিনলেন দীপকাকু। ট্রেনটা বেশ ভাল স্পিডেই চলছিল, নিউ মাল জংশনের পর থেকে গতি কমতে কমতে এখন গরুর গাড়ির দশা! পড়ায় মন বসছে না ঝিনুকের। ট্রেনের হলটা কী? ঘন ঘন হুইসেল দিচ্ছে! সাইড আপার থেকে ঝুঁকে ঝিনুক নীচের বার্থের দিকে তাকায়। দীপকাকু খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছেন নিবিষ্ট মনে। কখন কিনেছেন, খেয়াল করেনি ঝিনুক। গলা ঝাঁকি দিয়ে ঝিনুক দীপকাকুর উদ্দেশে বলে উঠল, ট্রেনটা এত স্লো চলছে কেন ?

—হাতির জন্য। এই রুটে হামেশাই হাতি কাটা পড়ে ট্রেনের চাকায়। হুইসেলটাও হাতিদের সতর্ক করার কারণে।

দীপকাকুর কথায় রীতিমতো এক্সাইটেড হয়ে পড়ল ঝিনুক। সবিস্ময়ে বলে উঠল, ট্রেন তার মানে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে! আপার বার্থে আছি বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

বাঙ্ক থেকে নামার উদ্যোগ নিল ঝিনুক, পা দু’টো ঝোলাতেই দীপকাকু নীচ থেকে বললেন, পুল ওভারটা গলিয়ে নাও। বাইরের সিনারি দেখতে হলে খোলা দরজায় গিয়ে দ্যাখো। বন্ধ জানলা দিয়ে ভাল দেখতে পাবে না। কাচে ধুলো জমে গিয়েছে।

ঠান্ডা লাগার আশঙ্কায় সোয়েটারটা পরতে বললেন দীপকাকু। এসি কামরার কারণে উত্তরবঙ্গের শীত সে ভাবে মালুমই হচ্ছে না। পুলওভারটা মাথার কাছে রেখেছিল রাতে, পরে নিয়ে নেমে এল ঝিনুক।

এন জে পি’র পর নিউ মাল জংশন-এও অনেক প্যাসেঞ্জার নেমেছে। ঝিনুকদের এসি টু টায়ার এখন একেবারেই ফাঁকা। করিডোর ধরে এগিয়ে যায় ঝিনুক। কামরার ভিতরের দরজা খুলে প্যাসেজে দাঁড়ায়। বাইরের দরজা খুলতেই মনে হল কে যেন বরফ ছুঁড়ে মারল। কাঁপুনি ধরে গেছে শরীরে। এদিকে সামনের দৃশ্য থেকে চোখ সরাতে পারছে না ঝিনুক, প্রায় রেললাইনের গা থেকেই শুরু হয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত চা-বাগান। কচি পাতায় সকালের রোদ পড়ে তৈরি হয়েছে অনন্য সুন্দর প্রাকৃতিক গালিচা। চা-বাগান শেষ হয়ে আসছে। শুরু হল জঙ্গল। বড় বড় নাম না জানা গাছ। ট্রেনের আওয়াজের ফলে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে যাচ্ছে পাখি। জঙ্গল একটু পাতলা হল, এখন নদীখাত। তির তিরে জল আর ভর্তি নুড়ি পাথর। ঘন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে নদীটা। দূরে কুয়াশা মাখা পাহাড়। এটাকেই বলে বোধহয় ভুটান পাহাড়। ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে জঙ্গল-নদী। ঝিনুকের মনে হচ্ছে কেসের ব্যাপারে এখানে না এসে, বেড়াতে এলেই ভাল হত। ইচ্ছে মতো ঘোরা যেত নানান জায়গায়। তদন্তের প্রয়োজনে দীপকাকু একটা নির্দিষ্ট রুট মেনে চলবেন। টাইমও থাকবে ধরা বাঁধা। একমাত্র যাত্রাপথে কোনও বিশেষ ঘটনা দীপকাকুর রুটিন পালটে দিতে পারে।

কেসে এতটা দূরে আসতে হবে, একবারও ভাবেনি ঝিনুক। দ্বিতীয়বার ‘আকৃতি প্লাজা’ থেকে ফিরে দীপকাকু দু’দিন কোনও যোগাযোগ রাখেননি ঝিনুকের সঙ্গে। সেদিনের ইনভেস্টিগেশনের পর্বটা বাবাকে বলেছে ঝিনুক। সব শুনে বাবা বলেছিলেন, কেসটা খুবই জটিল ঠিকই, কিন্তু রহস্য যেহেতু হাউজিং-এর বাউন্ডারি ওয়ালের ভিতরেই লুকিয়ে আছে, সলভ করতে বেশি সময় নেবে না দীপঙ্কর। দুচার দিনের মধ্যেই ফোন আসবে, ‘রজতদা, চলে আসুন । আজ ধরা পড়বে অপরাধী।’… এই কেসটাতে ঝিনুক অবশ্য এতটা আশাবাদী হতে পারেনি। মনে হয়েছে দীপকাকু এখনও তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছেন। ফোনে যোগাযোগ রাখছেন না, মানে ডুবে রয়েছেন ভাবনা-চিন্তায়। এই সময় ঝিনুক যদি ফোন করে কেসের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চায়, বিরক্ত হবেন দীপকাকু। তা ছাড়া ঝিনুক ঠিক কী জিজ্ঞেস করবে? এই কেসে তো প্রশ্নের শেষ নেই। দু’দিন বাদ দিয়ে ফোনের বদলে দীপকাকু নিজেই সন্ধেবেলা ঝিনুকদের বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন। বাবা বললেন, কী! কেস সলভড্ তো? আমি ঝিনুককে আগেই বলেছিলাম।

সোফায় বসে বড় করে শ্বাস ছেড়ে দীপকাকু বলেছিলেন, কেসটা এত সহজে সলভড্ হওয়ার নয় রজতদা। এক বা একাধিক পাকা মাথার অপরাধী এর পিছনে আছে। অপরাধের কোনও সলিড প্রমাণ রাখেনি। প্রথমবার ইনভেস্টিগেশনে গিয়ে যদিও এক দু’টো কু আবিষ্কার করেছিলাম, সেটাকেও নষ্ট করে দিয়েছে। অপরাধ বিজ্ঞান বলছে হাজার চেষ্টা করেও সমস্ত ক্লু নষ্ট করা যায় না। কিছু না কিছু তথ্য-প্রমাণ থাকেই। গোয়েন্দার কাজ হচ্ছে সেইগুলো খুঁজে বার করা। এই কেসে আমি দুটো ব্লু খুঁজে পেয়েছি। অপরাধীও টের পেয়েছে ব্যাপারটা। তাই আমাকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

বাবা জানতে চেয়েছিলেন, কোন দু’টো ব্লু-এর কথা বলছ তুমি? দীপকাকু বলেছিলেন, খুন হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে ছেলেটা হাউজিং-এ এসেছিল, তার প্রমাণ এখন আমার হাতে। রেজিস্টার খাতায় ছেলেটার নাম কেটে দিয়ে অপরাধী ভেবেছিল ভিতরে আসার কোনও প্রমাণ রইল না। তখন হয়তো অপরাধী আন্দাজ করেনি ছেলেটা এই হাউজিং-এ খুন হবে। মৃত ছেলেটির সঙ্গে এই হাউজিং-এর সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে দেখা হতে পারে পুরনো ফুটেজ। ব্যাপারটা যদি জানা থাকত, সিসিটিভি ফুটেজ তখনই নষ্ট করার চেষ্টা করত সে। কেন না দিনের দিন ফুটেজটা ডেসট্রয় করা তার পক্ষে সহজ হত। সিকিউরিটি রুমের কম্পিউটারে ছিল প্রমাণটা । একটা দিন পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের দিনের ফুটেজ সিডিতে কপি হয়ে সিকিউরিটি এজেন্সির ব্যাঙ্কিং-এ চলে গিয়েছে। আমি যদিও সিকিউরিটি রুমের কম্পিউটারের মেমোরি থেকে ফুটেজটা দেখেছি, কপিও করেছি। যেহেতু ঘটনাটা বেশি দিনের নয়, তাই ওখানে পাওয়া গিয়েছে। এক মাসের পুরনো হলে পাওয়া যেত না। হার্ডডিস্ক ফাঁকা রাখার জন্য ইরেজ করে দিত সিকিউরিটি স্টাফ। তখন আমাদের এজেন্সি থেকে সিডি নিয়ে দেখতে হত। ছেলেটা খুন হওয়ার পর অপরাধীর মাথায় নিশ্চয়ই এসেছিল ফুটেজের প্রমাণ লোপ করার কথা। কিন্তু ততদিনে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রমাণ সিডি আকারে চলে গিয়েছে সিকিউরিটি এজেন্সির লকারে। অতদূর পর্যন্ত হাত পৌঁছবে না অপরাধীর। অযথা সিকিউরিটি রুমের কম্পিউটার থেকে ফুটেজটা ইরেজ করার চেষ্টা করেনি সে। কারণ, একটা প্রমাণ লোপের চেষ্টা, আরও নতুন কিছু প্রমাণ রেখে যায়। আমার পাওয়া সেকেন্ড ক্লু সম্বন্ধে অপরাধী সম্ভবত কিছু জানে না। ওই ফুটেজটা থেকেই পেয়েছি সূত্রটা, ট্যাক্সির নাম্বার। আমার দেখার আগে পরে অপরাধী যদি ফুটেজটা দেখেও থাকে, ক্যামেরার জোনে ট্যাক্সির সামনেটুকু ঢুকে আসা সে লক্ষ্য করবে না। তার নজর থাকবে ছেলেটার ওপর।

কথার মাঝখানে বাবা বলে উঠেছিলেন, এখানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার। হাউজিং-এর সিকিউরিটি রুমে অবাধ যাতায়াত আছে অপরাধীর। নয়তো সে ইচ্ছে করলেই ফুটেজটা দেখতে পারবে কেন? কিন্তু সিকিউরিটি এজেন্সির অফিসে গিয়ে তার পক্ষে সিডিটা নষ্ট করা কঠিন। সেই অথরিটি তার নেই। অফিসটা ‘আকৃতি প্লাজা’ থেকে অনেকটাই দূরে, কোনও পার্সোনাল রিলেশন তৈরি করে উঠতে পারেনি লোকটা।

—ঠিক তাই। বলে দীপকাকু চলে গিয়েছিলেন সেকেন্ড ক্লু ধরে কীভাবে এগিয়েছেন তার বর্ণনায়। রঞ্জনকাকুর সাহায্যে এগারোই ডিসেম্বর দুপুরে যে ট্যাক্সির নাম্বার দেখা গিয়েছিল ক্যামেরার জোনে, তার ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা করেন। ভিডিও ফুটেজটা দেখান। ছেলেটা কোথা থেকে উঠেছে জিজ্ঞেস করেন। মনে করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে ড্রাইভারকে। মাঝে অনেকটা দিন চলে গিয়েছে। কত প্যাসেঞ্জার উঠেছে নেমেছে গাড়ি থেকে। অবশেষে মনে পড়েছিল ড্রাইভারের, ছেলেটাকে তুলেছিল লোটাস সিনেমা হলের কাছে, যেখানে সোয়েটার বিক্রি করে ভুটানিরা। ট্যাক্সি নিয়েই ড্রাইভার দেখা করতে এসেছিল, দীপকাকু ওই গাড়িতে চেপেই স্পটে পৌঁছন। সোয়েটার বিক্রেতাদের ছেলেটার ছবি দেখান। পুলিশের বিজ্ঞাপনে থাকা মৃত মুখের ছবি নয়, ভিডিও ফুটেজ থেকে ছেলেটার জীবন্ত মুহূর্তের কিছু স্টিল ফটো। দীপকাকু প্রিন্ট করেছেন। সেগুলো দেখিয়ে বিক্রেতাদের কাছে জানতে চান, ছেলেটিকে চেনে কিনা? চিনতে পারে তারা। ওদের মধ্যে থেকে মদন লোহার নামের ইয়াং ছেলেটি জানায়, দীপকাকু যার ফটো দেখাচ্ছেন, সে ডাবলা গাজি। ডাবলার সঙ্গে তার আলাপ বেশিদিনের নয়। শীতের পশরা নিয়ে মদন যখন এবার আলিপুরদুয়ার থেকে ট্রেনে চেপে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল, ডাবলা সেই কমপার্টমেন্টে উঠল কয়েকটা স্টেশন পরে, দলগাঁও থেকে। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল প্রথমবার বড় শহরে যাচ্ছে। জেনারেল কমপার্টমেন্টের ভিড়ের মধ্যে ঘাবড়ে যাওয়া ভাব নিয়ে বসেছিল। মদন লোহারই এগিয়ে গিয়ে আলাপ জমায়। জিজ্ঞেস করে কোন শহরে যাচ্ছে সে? শিলিগুড়ি, মালদা না কলকাতায় ? ডাবলা বলে কলকাতায় যাচ্ছে। মদনের আন্দাজ মাফিক প্রথমবার। কলকাতার এক বাবু তাকে চাকরি দেবেন বলেছেন। থাকেন কসবায় । সেই জায়গা কোথায়, মদনের কাছে জানতে চেয়েছিল ডাবলা। মদন লোহার কলকাতা মোটামুটি চেনে। গত ছ’বছর ধরে শীতের আগে সোয়েটার বিক্রি করতে আসে এই শহর। কসবা কীভাবে যেতে হবে বলে দিয়েছিল ডাবলাকে। শিয়ালদায় নেমে ডাবলা গিয়েছিল কসবায়। যিনি চাকরি দেবেন, তাঁর বাড়ি খুঁজে পায়নি। ফিরে আসে মদনের ডেরায়। ক্রিক-রোতে একটা বাড়ির একতলাটা ভাড়া নিয়ে মদন সমেত দশজন সোয়েটার বিক্রেতা একসঙ্গে থাকে। রাতটা ওখানেই কাটায় ডাবলা। পরের দিন যে ফুটপাতে সোয়েটার বিক্রি করে মদন, সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি ধরিয়ে দেয় ডাবলাকে। যাঁর কাছে যাবে, তাঁর ঠিকানা, ফোন নাম্বার লেখা একটা চিরকুট ছিল ডাবলার কাছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার ঠিকানা দেখে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল ডাবলাকে। ঘণ্টা চারেক বাদে ফের মদনের কাছে ফিরে এসেছিল ডাবলা। বলেছিল ভদ্রলোক দিন দশেক বাদে আসতে বলেছেন। হয়ে যাবে চাকরি। এই ক’টা দিন সে মদনের কাছেই থাকতে চায়। দশদিন হোটেলে কাটানোর মতো টাকা তার কাছে নেই । এই ক’দিনের জন্য দেশে গিয়ে আবার ফেরত আসার কোনও মানে হয় না। মদন নিজের আস্তানায় রেখেছিল ডাবলাকে। ছেলেটিকে ভাল লেগে গিয়েছিল তার। দু’জনে প্রায় একই অঞ্চলের মানুষ। একে অপরের অসুবিধায় পাশে দাঁড়ানো উচিত। সাতদিনের মাথায় ডাবলা গাজি হঠাৎ উধাও। আগের দিন পর্যন্ত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মদনের সঙ্গে সোয়েটার বিক্রি করেছে সে। তারপর থেকে ডাবলা গাজির আর কোনও খবর নেই।

দীপকাকু বুঝতেই পেরেছিলেন, পুলিশের বিজ্ঞাপন এদের চোখে পড়েনি। খবরের কাগজ বড় একটা দেখে না এরা। দীপকাকু মদনকে সেই ভদ্রলোকের ঠিকানাটা মনে করতে বলেন, ডাবলার কাছে থাকা চিরকুটে যে ঠিকানা সে দেখেছিল। ব্যর্থ হয় মদনের স্মৃতিশক্তি। সে শুধু বলতে পেরেছে, কোনও একটা হাউজিং হবে।… সমস্ত বিবরণ দেওয়ার পর দীপকাকু বাবাকে বলেছিলেন, চলুন রজতদা, দুটো দিন বীরপাড়ায় ঘুরে আসি বাবা অবাক হয়ে জানতে চান, সেটা আবার কোথায়? কেসের মাঝপথে হঠাৎ ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে হল কেন তোমার?

ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে দীপকাকু বলেছিলেন, যাহা দলগাঁও, তাহাই বীরপাড়া। যেখান থেকে ডাবলা গাজি ট্রেনে উঠেছিল। ভারতীয় রেলে এরকম অনেক স্টেশন আছে, জায়গার নামের সঙ্গে যার মিল নেই। বীরপাড়ার আগেই আছে মালবাজার, স্টেশনের নাম নিউ মাল জংশন।

এরপর বাবার বক্তব্য ছিল, ছেলেটা ওই স্টেশন থেকে উঠেছে মানেই ওখানকার বাসিন্দা, এটা বলা যায় না। অন্য জায়গা থেকে এসেও উঠতে পারে ট্রেনে। এরপর অনিশ্চিত তথ্য সম্বল করে অত দূর যাওয়া কি ঠিক হবে? তাছাড়া ছেলেটার ঠিকানায় পৌঁছে তদন্তের কোনও সুবিধে হবে কি? ছেলে মারা গিয়েছে, এই জরুরি খবরটা অবশ্য পাবে বাড়ির লোক। বীরপাড়া থানায় ফোন করেও কাজটা করানো যেতে পারে।

উত্তরে দীপকাকু জানিয়েছিলেন কেন বীরপাড়ায় যাওয়াটা দরকার। পুলিশের নিয়ম অনুযায়ী অজ্ঞাত পরিচয় মৃতদেহের ছবি রাজ্যের সব থানায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। যাকে বলে ‘অল ওসি কনসার্নড়’। স্বাভাবিক ভাবেই বীরপাড়া থানাতেও গিয়েছে ছেলেটার ফটো। কোনও খবর আসেনি, সাড়া মেলেনি অন্য সব থানা থেকেও। তারপরই পুলিশ খবরের কাগজে ‘সন্ধান চাই’-এর বিজ্ঞাপনটা দিয়েছে। দীপকাকু মনে করছেন ডাবলা গাজি বীরপাড়া প্রত্যন্তের বাসিন্দা অথবা ভুটানের নাগরিক। বীরপাড়া থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে ভুটান বর্ডার। ওপারে সিমেন্ট কারখানা আর ‘গুমটু’ শহর। বর্ডারে কোনও বেড়া নেই। দু’দেশের মানুষ অবাধে যাতায়াত করে। পুলিশের সঙ্গে ওই এলাকার মানুষের যোগাযোগ বেশ ক্ষীণ। সীমান্তরক্ষীরাই তাদের রক্ষাকর্তা। প্রত্যন্তে থাকা গরিব গ্রামগুলোতে হয়তো খবরের কাগজও পৌঁছয় না। কেনার মতো লোক নেই। যদি পৌঁছত কাগজ, ডাবলা গাজির ছবি দেখে পরিবারের লোক এতদিনে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করত বীরপাড়া থানায়। ছেলেটার বাড়ি ওই অঞ্চলেই মনে করার পিছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে, গুমটু শহরে একটা বৌদ্ধমন্দির আছে। যদিও সেটা খুব পুরনো নয়। তবে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ওই এলাকায় প্রবল। এই কেসে চুরি গেছে বৌদ্ধমন্দিরের ঘণ্টা। ছেলেটার পদবী ভুটান সংলগ্ন এলাকা। কলকাতায় আসতে হলে ডাবলা গার্জি নিয়ারেস্ট স্টেশন দলগাঁও থেকেই ট্রেন ধরবে। ডাবলার পরিবারের সঙ্গে দেখা করে দীপকাকু জানতে পারবেন, কেন সে কলকাতায় গিয়েছিল? এমনকি প্ৰথম দিন আকৃতি প্লাজায় গিয়ে এক ঘণ্টা কার সঙ্গে কাটিয়েছে, সেটাও হয়তো জানা যাবে। এগারোই ডিসেম্বরের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে ছেলেটি আকৃতি প্লাজায় ঢোকার এক ঘণ্টা বাদে বেরোচ্ছে। দীপকাকু নিশ্চিত ডাবলা গাজির পরিবারের সঙ্গে কথা বললেই এই রহস্যের জট অনেকটাই কেটে যাবে।

ঝিনুক বলেছিল, ডাবলা গাজির সঙ্গে সুপ্রিয় পালের চেনাজানা হওয়ার চান্স কিন্তু একটা আছে। সুপ্রিয় পালের লাস্ট অফিস ট্যুর ছিল শিলিগুড়িতে, অর্থাৎ উত্তরবঙ্গে। জেরায় তিনি একথাও স্বীকার করেন ওই ট্যুরে বৌদ্ধমন্দিরের একটা ঘণ্টার রেপ্লিকা নিয়ে এনেছিলেন বাড়িতে। বলছেন বটে কিনেছিলেন শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট থেকে, মিথ্যেও হতে পারে। হয়তো বীরপাড়াতে এসে ডাবলা গাজির থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন। হংকং মার্কেটেও ডাবলা গাজির সঙ্গে দেখা হয়ে থাকতে পারে তাঁর। ডাবলা গাজি হয়তো হংকং মার্কেটে মাল সাপ্লাই দেয় অথবা দোকানদার। সুপ্রিয় পাল ঘণ্টাটা কিনেছিলেন গাজির থেকেই। সে ক্ষেত্রে কিন্তু ডাবলা গাজি বাড়িতে যতক্ষণ না বলছে, কলকাতায় আমি অমুক লোকের কাছে যাচ্ছি তার আগে পর্যন্ত তারা কিছুই জানতে পারবে না। বীরপাড়ায় গিয়ে বিশেষ কোনও তথ্য পাব না আমরা। তবে একটা ব্যাপারে যেমন নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে, সুপ্রিয় পাল উত্তরবঙ্গে এসে বৌদ্ধমন্দিরের ঘণ্টা সংগ্রহ করেছেন। জিনিসটা অরিজিনাল না রেপ্লিকা, সেটা এখনও জানা যায়নি। ঘণ্টাটা যে ভাঙেনি এ বিষয়েও সিওর হওয়া যেতে পারে। ভাঙার কোনও প্রমাণ সুপ্রিয়বাবুর স্ত্রী, কন্যার চোখে পড়েনি। সুপ্রিয়বাবু বলছেন ভেঙেছে ওদের অবর্তমানে, টুকরোগুলো ফেলে দিয়েছেন স্ত্রী, কন্যার মন খারাপ হবে বলে। ভেঙে পড়ার মতো মনখারাপ সোমাদেবী, তোর্সার হত না। কেন না, শো-পিস সংগ্রহের নেশাটা তাদের নয়, সুপ্রিয় পালের। বাকি দু’জনের বড়জোর একটু আফশোস হত। জিনিসটা সুপ্রিয় পাল হয় সরিয়ে রেখেছেন অথবা চুরি যে হয়েছে জানতে দিতে চান না। ভেঙে যাওয়ার ঘটনাটা উনি বানিয়েছেন।

ঝিনুকের বিশ্লেষণে খুশি হয়ে দীপকাকু বলেছিলেন, বাঃ, মাথা তো বেশ ভাল কাজ করছে দেখছি! বাবা গর্বের দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিয়েছিল ঝিনুক। দীপকাকু বলতে শুরু করেছিলেন, সুপ্রিয় পাল বীরপাড়ায় এসেছিলেন, এমন কোনও তথ্য আমার হাতে নেই। সোমাদেবীর মোবাইলের কললিস্ট পুলিশকে চেক করতে বলেছিলাম একটাই কারণে, যেটা দেখে বোঝা যাবে সুপ্রিয় পালের গতিবিধি। যেখানেই যান না কেন, স্ত্রীর সঙ্গে নিশ্চয়ই যোগাযোগ রাখবেন। ট্র্যাক করে আমরা জানতে পারব কলটা কোথা থেকে এসেছে ।

কথার মাঝে ঝিনুক বলে উঠেছিল, সেই ইনফর্মেশনটা তো সুপ্রিয়বাবুর মোবাইলের কললিস্ট থেকেও পাওয়া যাবে। কল চেক করার জন্য পুলিশ ওঁর নাম্বার নিয়েছিল। এর পরেও সোমাদেবীর মোবাইলের কললিস্ট দেখার কী দরকার ?

বাবা এবং ঝিনুককে অবাক করে দিয়ে দীপকাকু বলেছিলেন, আমি সোমাদেবীর কললিস্ট থেকে বুঝতে চাইছিলাম সুপ্রিয়বাবুর প্রাইভেট কোনও নাম্বার আছে কিনা, যা তিনি পুলিশের কাছে লুকিয়ে যাচ্ছেন, ওই নাম্বার থেকে কখনও না কখনও স্ত্রীকে নিশ্চয়ই ফোন করেছেন।

এরকম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দীপকাকুর থেকে আগেও পেয়েছে ঝিনুকরা। তবু বারেবারেই আশ্চর্য হতে হয়! বিস্ময় ঘোর কাটিয়ে বাবা জানতে চেয়েছিলেন, সেরকম কোনও প্রাইভেট নাম্বারের অস্তিত্ব কি সোমাদেবীর কললিস্ট থেকে পাওয়া গেল ?

দীপকাকু জানিয়েছিলেন, পাওয়া যায়নি। কললিস্টটা ইনভেস্টিগেটিং অফিসার তাপস রায়কে অনুরোধ করে মেল মারফত পেয়েছিলেন দীপকাকু। চেক করে দেখেন সুপ্রিয় পাল যে নাম্বার পুলিশকে দিয়েছেন, সেই নাম্বারেই বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে স্ত্রীর সঙ্গে, শিলিগুড়িতে থাকাকালীন। এর মাঝে কল লিস্ট ঢুকে আছে বীরপাড়ার চারটে কল, যার একটা ল্যান্ড নাম্বার থেকে। রঞ্জনকাকুর মারফত দীপকাকু জেনেছেন ল্যান্ড নাম্বারটা পাবলিক বুথের। বীরপাড়া থেকে কে ফোন করেছিল? এই প্রশ্নটা সোমাদেবীকে করে কোনও লাভ হবে না। যদি এর পিছনে কোনও ষড়যন্ত্র থাকে, সোমাদেবী অনায়াসে এড়িয়ে যেতে পারবেন। বলবেন, বীরপাড়া থেকে ফোন এসেছিল, জানি না তো! হয়তো কেউ নাম্বার টিপতে ভুল করে আমাকে ফোন করে ফেলেছিল। আমি তো আর জিজ্ঞেস করতে যাব না, কোথা থেকে ফোন করছেন? রং নাম্বার বলে লাইন কেটে দিয়েছি।… প্রশ্নটা করলে ষড়যন্ত্রকারীরা সতর্কও হয়ে যাবে, দীপকাকু তাই ওই রাস্তায় হাঁটেননি। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন স্পষ্ট একটা যোগসূত্র, বীরপাড়ার ফোন, বীরপাড়ার সীমান্তে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব, বৌদ্ধমন্দিরের ঘণ্টা খোয়া যাওয়া, ডাবলা গাজির দলগাঁও (বীরপাড়া) থেকে ট্রেনে ওঠা, আকৃর্তি প্লাজায় যাওয়া, দ্বিতীয়বার সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকা। অতএব বীরপাড়া এই কেসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেখানে যাওয়াটা একান্তই দরকার। বাবা একমত হয়েছিলেন। দীপকাকুকে বলেছিলেন, তোমার সঙ্গে যাওয়ার খুবই ইচ্ছে হচ্ছে। উপায় নেই সামনের দু’দিন অফিসে বেশ ক’টা ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে। তুমি আর ঝিনুক চলে যাও এবং অবশ্যই নিজের পিস্তলটি সঙ্গে রেখো। মনে রাখবে, কেসটা খুনের। হুমকিটা খুন হওয়ার পেয়েছ।

উত্তরে দীপকাকু মৃদু হেসে বলেছিলেন, থাকবে পিস্তল। ওটা আমার সঙ্গে বেশির ভাগ সময় থাকে, টের পান না আপনারা ।

ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে ঝিনুক ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, দীপকাকুকে যেন এই অভিযানে পিস্তল না বার করতে হয়। কোনও ধরনের রক্তপাতের ঘটনা এই ট্যুরের স্মৃতিকে দুঃখজনক, ভারবাহী করে না তোলে।

জঙ্গল পাতলা হয়ে আসছে। দেখা যাচ্ছে আদিবাসী গ্রাম । সাতপুরনো চাদর গায়ে উঠোনে দাঁড়ানো এক কিশোরী ট্রেনের যাত্রীদের উদ্দেশে হাত নাড়ছে। ঝিনুকও ওকে দেখে হাত নাড়ে মেয়েটি আলাদা করে ঝিনুককে নির্মল হাসি উপহার দেয়।

—মিনিট খানেকের মধ্যে দলগাঁওতে ঢুকবে ট্রেন। লাগেজ প্যাক করে নাও। দীপকাকুর গলা। পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ট্রেনের বাইরে এখন একটা দু’টো পাকা বাড়ি চোখে পড়ছে। ব্যাগ গোছানোর জন্য তাড়াতাড়ি দরজার সামনে থেকে সরে আসে ঝিনুক।