রহস্যে অতীতের ধ্বনি – ২

৷৷ দুই ৷৷

ছ’দিন কেটে গেল। বাবার কথা মেলেনি। ‘আকৃতি প্লাজা’ থেকে ফিরে বাবাকে সব ঘটনাই বলেছিল ঝিনুক। বাবা বলেছিলেন, এই কেসে দীপঙ্করের সাহায্য ছাড়া পুলিশ এক পাও এগোতে পারবে না। দেখ না, কালই হয়তো ডেকে পাঠাবে।

ডেকে পাঠানো হয়নি। দীপকাকু আজ সকালে নিজে থেকে ফোন করেছিলেন ইনভেস্টিগেটিং অফিসার তাপস রায়কে। তদন্তের খবরাখবর নিয়ে, অনুমতি চাইলেন সুপ্রিয় পালকে বিশদে জিজ্ঞাসাবাদ করার এবং আরও একবার সিকিউরিটি রুমে গিয়ে সিসি টিভি ফুটেজ দেখার। অনুমতি পাওয়া গিয়েছে। দীপকাকু ঝিনুককে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছেন ‘আকৃতি প্লাজা’য়। প্রথমেই ঢুকেছেন সিকিউরিটি রুমে।

আগের বার যেদিনের ফুটেজটা দেখেছিলেন কম্পিউটার স্ক্রিনে আবারও দেখলেন অনেকক্ষণ সময় নিয়ে। নতুন কিছু পেলেন না বলেই হয়তো পিছিয়ে গেলেন আর একটা দিন। রিওয়াইন্ড, করোয়ার্ড করে দেখতে লাগলেন। দেখা যেন শেষ হয় না। আবার একটা দিন পিছোতেই, ঝিনুক নিঃশব্দে সিকিউরিটি রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে দীপকাকুর মতো অত ধৈর্য তার নেই। সামনের লনে পায়চারি করতে করতে চারপাশে চোখ বোলাচ্ছে ঝিনুক, পার্ক, বাগান, ছোট ছোট ওয়াটার বডি নিয়ে হাউজিংটা সত্যিই সুন্দর। বিশ্বাসই হয় না এখানকার এক ফ্ল্যাটে খুনের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গিয়েছে। পুলিশের দিক থেকে দেখলে, দীপকাকুকে তদন্তে হেল্প করার জন্য না ডেকে তারা অন্যায্য কিছু করেনি। ফরেনসিকের জন্য যে টাস্কগুলো উনি রেখে গিয়েছিলেন, তাতে পাওয়া যায়নি উল্লেখযোগ্য কোনও সূত্র ক্যাবিনেটের কাচে নেই কোনও হাতের ছাপ। মাঝের হাফ রাউন্ড পাল্লাটার হোল্ডারে ফ্ল্যাট মালিকের আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে, সেটাই স্বাভাবিক। ওঁর ক্যাবিনেট, উনি তো খুলবেনই। ব্যালকনির পর্দায় দেওয়ালের রং বা ওই জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব নেই। পাওয়া গিয়েছে কয়েকটা মাথার চুল, নারী ও পুরুষের। এই ব্যাপারটাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। চুলগুলো সুপ্রিয় পাল এবং তার স্ত্রী-মেয়ের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কাজের লোকেদেরও হতে পারে। ব্যালকনি যাওয়া আসার সময় পর্দায় এক দু’টো রয়ে গিয়েছে। পর্দা সে সময় হয়তো পুরোটা টানা ছিল। ছাদের পাঁচিলের ওপর পাইপের যে অংশটা দেখিয়ে দীপকাকু বলেছিলেন, দড়ির দাগ আছে। ওটা দড়ির নয়, ধাতব ব্রাশ টাইপের কিছুর আঁচড়। তার নীচে জুতোর কোনও ছাপ পাওয়া যায়নি। ছাপ নেই ব্যালকনি সংলগ্ন দেওয়ালে। একদিন বাদে ইনভেস্টিগেটিং অফিসার তাপস রায় ফরেনসিকের সমস্ত রিপোর্ট দীপকাকুকে ফোন করে জানিয়েছেন। রিপোর্টে জানা যায়, ছেলেটি রাত দু’টো নাগাদই মারা গিয়েছে। ফিট পাঁচেক দূর থেকে পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়েছিল। এই তথ্যে দীপকাকুর কোনও অবদান নেই। পুলিশ আগেই অনুমান করেছিল। দীপকাকুর কথা মতো সুপ্রিয় পালের স্ত্রীর ফোন নাম্বার নিয়ে কোনও লাভ হয়নি। কললিস্ট চেক করে মেলেনি কোনও ক্লু। ব্যর্থতার লম্বা ফর্দ শোনার পরও হতাশ হননি দীপকাকু। তাপস রায়কে বলেছিলেন, পর্দায় লেগে থাকা চুলগুলো কি বাড়ির লোকের সঙ্গে ম্যাচ করানো হয়েছে?

—না, হয়নি। প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বলেছেন অফিসার।

দীপকাকু জানতে চেয়েছিলেন, চুলগুলো ফেলে দেওয়া হয়নি তো?

—ঘটনাস্থলের কোনও এভিডেন্সই আমরা ফেলে দিই না, প্রিজার্ভ করি। বলা তো যায় না, কখন কোনটা কাজে লাগে।

অফিসারের কথার পিঠে দীপকাকু বলেছেন, অপরাধীকে চিহ্নিত করতে চুলগুলো কাজে লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস। বাড়ির লোকজনকেও আমরা সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে পারি না।

ঝিনুকের বিশ্বাস দীপকাকুর কথা শুনে ফোনের ওপ্রান্তে থাকা অফিসার নিঃশব্দে হেসেছেন। দীপকাকু কত কিছু দেখতে বলে এসেছিলেন, পাওয়া গিয়েছে গুটি কয়েক মাথার চুল। চক্ষুলজ্জায় ওটাকেই আঁকড়ে ধরেছেন এখন। তাপস রায়ের সঙ্গে দীপকাকুর ফোনালাপটা ঝিনুকের সামনে হয়নি। পরের দিন সন্ধেবেলা ঝিনুকদের বাড়ি এসে দীপকাকু গোটা ব্যাপারটা বললেন। খুবই দমে গিয়েছিলেন বাবা, ঝিনুকের অবস্থাও তাই। শোক পালনের মতো নীরবতা নেমে এসেছিল ঘরে। এরপরই দীপকাকু সঙ্গে নিয়ে আসা ‘আজ সকাল’ খবরের কাগজটা বার করেছিলেন। কাগজটা সেদিনের নয়, আগের দিনের। ফ্রন্ট পেজের ছবি দেখে বুঝেছিল ঝিনুক। ‘আজ সকাল’ তাদের বাড়িতেও নেওয়া হয়।

দীপকাকু শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনের পাতাটা বাবার সামনে গুলে ধরেছিলেন, ঝিনুক ঝুঁকে পড়ে দেখেছিল একটা বিজ্ঞাপন লালকালি দিয়ে গোল করা আছে। বাবার পর ঝিনুক চোখ বুলিয়ে ছিল বয়ানে বোল্ড লেটারে হেডিং, “অ্যান্টিক দ্রব্যসামগ্রী কিনতে ইচ্ছুক।” নীচে ছোট হরফে লেখা, “দেব-দেবীর মূর্তি, তালপাতার পুথি, লিপি এবং চিত্র উৎকীর্ণ টালির প্রতি বিশেষ আগ্রহ।” এরপর একটা মোবাইল নাম্বার দেওয়া রয়েছে। বাবা প্রশ্ন করেছিলেন, কেন দেখাচ্ছ অ্যাডটা? এর মানে কী?

পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বার করে দীপকাকু বলেছিলেন, এই ফোন সেটের নাম্বারটাই দেওয়া আছে বিজ্ঞাপনে। কাগজে অ্যাডটা আমিই দিয়েছি। সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটটা খুঁটিয়ে দেখে আমার মনে হয়েছে কোনও অ্যান্টিক জিনিস চুরি গিয়েছে ওই রাতে। সম্ভবত কোনও পুজো-অর্চনার বস্তু। জিনিসটা যাতে চোরা বাজারে বিক্রি না হয়ে যায়, তার জন্যই বিজ্ঞাপনের নামে ওই টোপটার বন্দোবস্ত। একবার যদি হাতবদল হয়ে যায় তা হলে জিনিসটা পাওয়া এবং চোরকে ধরা দুটোই বেশ কঠিন হয়ে যাবে।

দীপকাকু থামতেই বাবা বলে উঠেছিলেন, ফ্ল্যাট থেকে কোনও কিছু খোয়া গিয়েছে, একথা তো সুপ্রিয় পাল পুলিশকে জানাননি

—হয়তো সুপ্রিয় পাল এখনও খেয়াল করেননি, জিনিসটা নেই অথবা পুলিশকে জানতে দিতে চান না চুরিটা।

ঝিনুক জিজ্ঞেস করেছিল, কেন চান না জানতে দিতে?

—কারণটা খানিক আন্দাজ করতে পারছি। তবে যতক্ষণ সিওর হচ্ছি, উনি জেনেবুঝে চুরিটা গোপন করছেন, তার আগে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না।

দীপকাকুর কথার পর বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন, চুরিটা হল কী ভাবে? চুরির সঙ্গে খুনেরও নিশ্চয়ই কোনও সম্পর্ক আছে।

দূরমনস্ক গলায় দীপকাকু বলতে থাকলেন, খুন এবং চুরি একই ব্যক্তি করেছে, নাকি আলাদা দুটো লোক, সেটা এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। অজ্ঞাত পরিচয় ছেলেটি পার্স, মোবাইল ছাড়াই উপরে উঠে এসেছিল, নাকি খুন করার পর পকেট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে, তাও বুঝতে পারছি না। চুরি, খুন এবং পরিচয়পত্র সরানো, তিনটে কাজ সুপ্রিয় পাল একাই সারতে পারেন। দেখা গেল ওই ছেলেটি ছাড়া বাইরের কেউ ঢোকেইনি ঘরে। ছেলেটিই বা কোন রাস্তা দিয়ে ঢুকল? গোটা ব্যাপারটাই জটিল একটা ধাঁধা হয়ে আছে। একমাত্র চুরি যে হয়েছে, এটা খানিকটা জোর দিয়ে বলা যায়।

—তুমি কিন্তু একটা জায়গায় গোলমাল করে ফেলছ। মার্ডার করা, আইডেন্টিটি প্রুফ সরানো, এই দুটো কাজ সুপ্রিয় পাল করলেও, নিজের জিনিস নিজে চুরি করতে যাবে কেন? প্রশ্ন রেখেছিলেন বাবা।

উত্তরে দীপকাকু বললেন, ঠিক চুরি নয়, হয়তো পাঁচ জনের সামনে থেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছেন জিনিসটা। হতে পারে জিনিসটার আসল মালিক উনি নন। ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেই সরিয়ে রেখেছেন।

—আপনি এমন কী দেখলেন, যা থেকে মনে হচ্ছে ওই ফ্ল্যাটের কিছু খোয়া গিয়েছে ওই রাতে? জানতে চেয়েছিল ঝিনুক।

দীপকাকু বলেছিলেন, ক্যাবিনেটের মাঝখানে যে হাফ রাউন্ড কাচের পাল্লা আছে, তার ভিতর কাচের তিনটে র‍্যাক, বেসের কাঠের র‍্যাকটাকে ধরলে চারটে। উপরের তাকে বিভিন্ন দেশের ঘণ্টা, হাতে ধরে যে ঘণ্টা বাজানো হয়। তার নীচের র‍্যাকে আছে বৌদ্ধদের জপযন্ত্র এবং ক্যান্ডেল স্ট্যান্ড। থার্ডে, গণেশ মূর্তি। বেসে, নানান আকারের শাঁখ। যেখানকার জিনিস সেখানেই ছিল, এমনটা নয়। একটু ওলট পালট করা ছিল। আমি দেখলাম উপরের র‍্যাকে বেমানান ভাবে খানিকটা জায়গা ফাঁকা, টর্চ জ্বেলে ভাল করে লক্ষ্য করতে চোখে পড়ল ধুলোর গোল ছাপ। যেহেতু পাল্লা বন্ধ থাকে ধুলো ঢোকে কম, ছাপ খুব স্পষ্ট নয়। আমার মনে হল ওখান থেকে খুব সম্প্রতি কোনও জিনিস তুলে নেওয়া হয়েছে। কয়েকদিন আগে তুললে, জায়গাটা ফাঁকা রাখা হত না। সামঞ্জস্য রাখতে অন্য কোনও শো-পিস দিয়ে ভরাট করা হত।

—তোমার অবজার্ভেশনটা পুলিশকে দেখালে না কেন? ডিে করেছিলেন বাবা।

দীপকাকু বললেন, ওই ছাপটা তো হাত বা পায়ের চাপের মতো অকাট্য নয়, জিনিসটা যদি কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য সরিয়ে থাকেন ফ্ল্যাট-মালিক, ‘ভেঙে গিয়েছে’ কিংবা ‘ওই জিনিসটা এখানে রেখেছি’ বললে আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না। জিনিসটা যে কী, তাই তো জানি না। ঘণ্টার র‍্যাকটাতে দু’একটা অন্য আইটেমও ছিল। এমনও হতে পারে সুপ্রিয় পাল সত্যি কথাই বলছেন। অর্থাৎ ক্রু হিসেবে বিষয়টা তেমন জোরালো নয়। উল্টো দিক থেকে ঘটনাটা যদি চুরির হয়, তা হলে ইমিডিয়েটলি জিনিসটা আমার নাগালের মধ্যে রাখার বন্দোবস্ত করতে হবে। চোরের কাছে পৌঁছানো সহজ হবে তখন। সেইদিনই আমি বিজ্ঞাপনটা লিখে কাগজের অফিস জমা দিই। বয়ানে পুঁথি, টালি এ সব ক্যামোফ্লেজ, চোর যাতে ফাঁদটা বুঝতে না পারে।

থেমে মূল প্রসঙ্গে ফিরতে যাচ্ছিলেন দীপকাকু, ঝিনুক বন্ধে উঠেছিল, আচ্ছা, এই কাগজটা তো আমরাও বাড়িতে নিই। অ্যাডটা আমাদের কারুর চোখে পড়েনি। আপনি কীভাবে ধরে নিলেন চোরের নজরে পড়বে?

—অ্যাডের বিষয় যদি ক্যারাটে, ড্রেস মেটেরিয়ালে হিউজ ডিসকাউন্ট কিংবা এডুকেশনল ট্রেনিং নিয়ে কিছু হত, চোখ আপনিই টেনে নিত তোমার। খবরের কাগজে চোখ বোলানোর সময় নিজের পছন্দসই বিষয়টা বেছে নেওয়ার জন্য মানুষের অবচেতন সদাই প্রস্তুত থাকে।

দীপকাকুর কথায় একটু বুঝি খোঁচা ছিল ঝিনুকের প্রতি, গা করেনি ঝিনুক। মজার ছলে এমনটা উনি করেই থাকেন। মূল কথায় ফেরাতে চেয়ে বাবা প্রশ্ন করেছিলেন, তারপর, চোর কি ফাঁদে পা দিল শেষ পর্যন্ত?

এই সময় মা সকলের জন্য চা-স্ন্যাকস নিয়ে ঢুকেছিলেন ঘরে। খাওয়া চলাকালীন দীপকাকু যা বলেছিলেন, মোটামুটি এরকম, বিজ্ঞাপনে দেওয়া নাম্বারে সকাল আটটা থেকেই পরের পর ফোন আসতে শুরু করে। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে তো কম বনেদি পরিবার নেই। বাড়িতে বাড়িতে এক সময় পূজা-অর্চনার চল ছিল খুব। সেই ধরনের অনেক সামগ্রী এখন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। লোকে বিক্রি করে দিতে চায়। এর মাঝেই ইনভেস্টিগেটিং অফিসার তাপস রায়ের ফোন এসেছিল দীপকাকুর আসল নাম্বারে। ফরেনসিকের রিপোর্ট দিলেন। অনুমান বিফলে গিয়েছে শুনে একটু বুঝি আত্মবিশ্বাসে টান পড়েছিল দীপকাকুর। তবু বিশেষ ফোন কলটার আশা ছাড়েননি। রাত ন’টা নাগাদ বিজ্ঞাপনে দেওয়া নাম্বারে এসেছিল সেই কল। লোকটি বলল, ‘আমার কাছে একটা তিব্বতী ঘরনার বৌদ্ধ মন্দিরের প্রাচীন ঘণ্টা আছে। কত দাম পেতে পারি?’ দীপকাকু বলেছিলেন, ‘জিনিসটা না দেখে কী করে বলব! ঘণ্টাটা আপনি নিয়ে আসুন, দেখি আগে।’ তাতে রাজি হয়নি লোকটা। তার বক্তব্য, জিনিসটা যে যথেষ্ট মূল্যবান, তা সে জানে। বিজ্ঞাপনদাতার পক্ষে সেই পরিমাণ অর্থ দেওয়ার ক্ষমতা আছে কিনা, জানতে চায় সেটাই। অত দামি অ্যান্টিক পিস নিয়ে ঘোরাঘুরির ঝুঁকি লোকটা নিতে চায় না। বিক্রির সময়, ওই একবারই জিনিসটা নিয়ে আসবে। তার আগে ঘণ্টাটার একটা ফটো পাঠাতে পারে। দীপকাকু বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে, আমি ই-মেল আইডি এস এম এস করে দিচ্ছি, ফটো পাঠিয়ে দিন।’ লোকটা বলেছে, ‘আমি কম্পিউটার ভাল বুঝি না। অন্য কাউকে বলে তার মেল অ্যাড্রেস দিয়েও পাঠাতে চাই না ফটোটা। আপনি আগামীকাল সকল দশটায় মেট্রো সিনেমার নীচে দাঁড়াবেন। পেয়ে যাবেন ফটো।’ দীপকাকু তখন বলেছিলেন, ‘কাল নয়, আপনি আগামীকাল ওই সময় আমার অন্য কাজ আছে।’

ওটা পরশু করুন। লোকটি সম্মত হয়েছিল প্রস্তাবে। দীপকাকু মাঝের সময়টা নিয়েছিলেন লোকটার ফোন নাম্বার ট্র্যাক করার জন্য। ল্যান্ডলাইন থেকে এসেছিল ফোন। পরের দিন লালবাজারের রঞ্জনকাকুর সাহায্যে দীপকাকু জানতে পারলেন ফোনটা এসেছে ভবানীপুরের একটা জেরক্সের দোকান থেকে। সেই দোকানে পৌঁছে গিয়েছিলেন দীপকাকু। দোকানিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘গতরাতে ন’টার সময় যে লোকটা ফোন করতে এসেছিল, তার চেহারাটা কেমন?’ দোকানি জানায়, ‘লোকটা চাদরমুড়ি দিয়ে এসেছিল। চেহারাটা ঠিক ঠাহর করা যায়নি। আমি তখন ব্যস্তও ছিলাম। জেরক্স করছিলাম মোটা একটা বইয়ের।’ ক্ষীণ সূত্রের প্রত্যাশায় দীপকাকু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘লোকটা বয়স্ক, না কমবয়সি, সেটা কিছু বোঝা গেল?’ জেরক্সের দোকানের লোকটা জানায়, ‘কাল যেরকম জব্বর ঠান্ডা পড়েছিল, সব বয়সের লোকেরাই ওভাবে চাদর মুড়ি দেবে। তবে লোকটাকে খুব একটা কমবয়সি বলে মনে হয়নি। হাঁটা চলায় ধীরস্থির ভাব। কথা বলেছিল একটাই, ‘কত দিতে হবে?’ সেটাও খুব আস্তে। পরনে সাদা পাজামা ছিল। দীপকাকুরও ফোনে কথা বলার সময় মানুষটির গলা শুনে বয়স্ক মনে হয়েছে। ফোন নাম্বার ট্র্যাক করেও লোকটির সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। সমস্ত বৃত্তান্ত শোনানোর পর দীপকাকু বাবাকে বলেছিলেন, ‘রজতদা, আপনার একটা হেল্প লাগবে। আগামীকাল সকাল দশটায় আপনিও গিয়ে দাঁড়াবেন মেট্রো সিনেমার লাউঞ্জে।’ বাবা জানতে চেয়েছিলেন, ‘আমি কেন?’ দীপকাকুর বক্তব্য ছিল, ‘লোকটা নিজেকে অধরা রাখতে চায়। তাই কোনও মেল অ্যাড্রেস থেকে ফটোটা পাঠাতে চাইছে না। ফোন করেছিল বাইরের বুথ থেকে। আমিও চাই না বিজ্ঞাপনদাতাকে সে চিনে ফেলুক। সেই কারণে অ্যাডে সুদর্শনের ফোন নাম্বার দিয়েছি।

সুদর্শনদা দীপকাকুর অফিসের একমাত্র স্টাফ। দীপকাকু আরও বলেছিলেন, ‘লোকটা যেহেতু অপরাধী, কেসটার দিকে অবশ্যই নজর রেখেছে। তদন্ত করতে দেখেছে আমাকে। যদি দেখে সেই আমি ফটো নিতে গিয়েছে, ওখান থেকে পিঠটান দেবে। তাই ছদ্মবেশ নেব। আপনি থাকবেন আমার থেকে একটু দূরে। লোকটা আমাকে খাম জাতীয় কিছু একটা দেবে। যার ভিতরে থাকবে ফটোটা। খামটা হ্যান্ডওভার করে লোকটা যখনই এগিয়ে যাবে, আপনি মারবেন ধাক্কা, সেটা যেন ইচ্ছাকৃত মনে না হয়। লোকটাকে খুব করে সরি-টরি বলবেন। শুশ্রূষার ভান করে এমন ভাবে গায়ে মাথায় হাত বোলাবেন, যদি ছদ্মবেশ নিয়ে থাকে, সেটা যেন খসে যায়। লোকটাকে চিনে রাখতে পারব আমি।

কেসটাতে নিজের অবদান কমে যাচ্ছে দেখে ঝিনুক বলেছিল, কাজটা তো আমিই পারব। বাবাকে দরকার পড়ছে কেন? দীপকাকু বললেন, অবশ্যই তুমি পারবে। কিন্তু রজতদার মতো রেজাল্ট পাব না। কোনও মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে লোকটাই সরি-টরি বলতে থাকবে। তুমি লোকটাকে শুশ্রূষা করার সুযোগ পাবে না। মেয়ে হিসেবে ওটা করতে যাওয়াটাও বাড়াবাড়ি মনে হবে। সেক্ষেত্রে তোমাকে পুরুষের মেকআপ দিতেই পারি, ধাক্কা মারার পর কথা বলতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবে, গলার স্বর লুকোতে পারবে না। তুমি মেয়ে, বুঝে নেওয়ার পর সে যদি তোমার বয়স, আদলের সঙ্গে গোয়েন্দার অ্যাসিস্ট্যান্টের মিল খুঁজে পায়, আমার সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে যাবে। এই কেসে তদন্ত করতে আমার সঙ্গে তোমাকেও দেখেছে সে। আমি সামান্যতম কোনও ক্লু রাখতে চাই না তার কাছে। তবে চিন্তা করো না। ওই সময় তোমার জন্যেও একটা সিরিয়াস কাজ রেখেছি। আমাদের দু’জনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর লোকটা যেদিকে হেঁটে যাবে, দূর থেকে ফলো করতে থাকবে তুমি। দেখে আসবে লোকটার গন্তব্য। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে ছদ্মবেশ থাকবে তোমার বাই এনি চান্স লোকটা ঘাড় ফিরিয়ে পিছনটা দেখে, যথেষ্ট দূরত্ব এবং ছদ্মবেশের কারণে তোমাকে আইডেন্টিফাই করতে পারবে না অল্প ছদ্মবেশ রজতদাকেও নিতে হবে। বাবা বলেছিলেন, আমাকে আবার কেন? দীপকাকু বললেন, তদন্ত চলাকালীন লোকটা যদি কখনও আমাকে, আপনাকে একসঙ্গে দেখে নেয়, খটকা লাগবে তার বিজ্ঞাপনটা যে ফাঁদ ছিল, ধরে ফেলতে পারে। তখনই নিজেকে আরও আড়াল করে ফেলবে। তদন্তে বেশ খানিকটা এগিয়েও ফের গোড়ায় ফিরে আসতে হবে আমাকে। এত কথা শোনার পরও ঝিনুকের মনে একটা খচখচানি রয়ে গিয়েছিল। বিষয়টা পরিষ্কার করে নিতে চেয়ে দীপকাকুকে প্রশ্ন করেছিল। আচ্ছা, অত ক’টা ফোনকলের মধ্যে এটাই যে চোরের ফোন, এতটা সিওর আপনি কী করে হচ্ছেন? চুরিটা যে হয়েছে, সেটাই হলফ করে বলতে পারবেন না। হাত কোনও ঠাস প্রমাণ নেই। সমস্তটাই অনুমান।

ভাবুক গলায় দীপকাকু বলেছিলেন, অনুমানকে অত ছোট করে দেখো না। জানবে, প্রমাণের চেয়েও জোরালো বিষয় হচ্ছে অনুমান। প্রমাণ অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্তর দিকে নিয়ে যায়। যে কারণে বহু নিরপরাধ ব্যক্তি বছরের পর বছর জেল খাটে। অনুমান চলে যুক্তির রাস্তা মেনে। প্রমাণের ভুলটা অনুমানই ধরিয়ে দেয়। এরপর স্বাভাবিক মেজাজ ফিরে এসে স্বপক্ষের যুক্তিগুলো দিয়েছিলেন, ওপরের র‍্যাকে ফাঁকা জায়গা আর ধুলোর গোল ছাপ দেখে চুরির ব্যাপারটা প্রথম মাথায় আসে তাঁর। লোকটি ফোন করে ঘণ্টার কথা বলেছে, ওই র‍্যাকটা ঘণ্টার জন্য নির্দিষ্ট। তিব্বতী ঘরানার ঘণ্টার কথা বলছে লোকটা, যে ছেলেটি খুন হয়ে পড়েছিল ঘরে চেহারা মঙ্গোলিয়ান টাইপ। অর্থাৎ তিব্বতের সঙ্গে যোগ আছে। তিব্বতটা কমন হয়ে গেল। জড়িয়ে গেল চুরি আর খুন। সব শেষে লোকটা নিজেকে এতটা আড়ালে রাখার চেষ্টা করছে কেন? অপরাধী বলেই তো। এরপর কি বুঝতে বাকি থাকে, সেটা চোরের ফোন। এমনকি চুরিটা যে হয়েইছে, সেটাও প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। দীপকাকুর পয়েন্টগুলো শুনে সংশয় দূর হয়েছিল ঝিনুকের। পরের দিন সকাল দশটায় বাবা এবং দীপকাকুর নির্দেশ মতো ঝিনুকও মেট্রো সিনেমার সামনে নিজের পজিশন নিয়েছিল। পরনে উলটো আঁচল করে পরা শাড়ি। আধ ঘোমটা টানা, চশমা, দু’হাতে কাচের রঙিন চুড়ি বেশ কয়েকগাছি। পুরো মাড়োয়ারি, গুজরাটি লুক। মায়ের এত ভাল লেগেছে সাজটা বলেছেন, সামনের জন্মদিনে এরকম করেই শাড়ি পরবি। বাবার ছদ্মবেশ ছিল ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, পাজামা-পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা। দীপকাকুর ব্লেজার, ট্রাউজার্স। মাথায় সাদা উইগ, গোঁফটাও সাদা করে নিয়েছিলেন, পেটে কাপড়ের প্যাক দিয়ে বানিয়েছিলেন ছোট মতো ভুঁড়ি। ঝিনুকদের বাড়িতেই মেকআপ নেওয়া হচ্ছিল। মেট্রো সিনেমার সামনে কার কোথায় পজিশন হবে তখনই বলে দিয়েছিলেন দীপকাকু। নিজের মেকআপ নিয়ে একটাই আপত্তি তুলেছিল ঝিনুক। শাড়ি পরে দৌড়োদৌড়ি করবে কী করে? একেবারেই অভ্যেস নেই শাড়ি পরার। দীপকাকু বলেছিলেন, দৌড়নো, মারামারি কোনওটাই করতে যাবে না। সেফ ডিসট্যান্স থেকে ফলো করবে। নাগালের বাইরে চলে গেলে খোঁজার চেষ্টাই করবে না। ফিরে আসবে। লোকটা যেন কোনওভাবে টের না পায়, তাকে ফলো করা হচ্ছে।… এই যে এত আয়োজন, সমস্তটাই বৃথা গিয়েছে। লোকটার টিকিটুকুও দেখা যায়নি। ফটোটা কিন্তু সে দিয়েছে, দীপকাকুকে পুরোপুরি বোকা বানিয়ে। দশটা পনেরোয় ফোন করে দীপকাকুর কাছে জানতে চেয়েছিল, আপনি এসে গিয়েছেন? হ্যাঁ বলে দীপকাকু নিজের চেহারার (ছদ্মবেশ) বর্ণনা দিতে যাচ্ছিলেন, লোকটার যাতে চিনে নিতে সুবিধে হয়। দীপকাকুকে মাঝ পথে থামিয়ে লোকটা বলে উঠেছিল, সিনেমা হলের কোলাপসেবল গেট লাগোয়া যে অটোমেটিক ওয়েইং মেশিনটা আছে, তার পিছনে একটা খাম পাবেন। এর ভিতরে আছে ফটোটা। আপনি ভাল করে দেখে নিন, আমি রাতের দিকে ফোন করব। ইন্সট্রাকশন শোনার পর দীপকাকু মোবাইল সেট পকেটে রেখে ওজনযন্ত্রের কাছে গেলেন, পিছন থেকে বার করলেন খাম। ঘটনার ওপর নজর রেখে বাবা, ঝিনুকের বুঝতে অসুবিধে হয়নি, লোকটা ধোঁকা দিয়েছে। বাবা এগিয়ে যাচ্ছিলেন দীপকাকুর কাছে, ঝিনুকও ভাবছিল, আর ছদ্মবেশে দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে? ঘটনা কী হল দেখা যাক! দীপকাকু দ্রুত দু’জনকে ফোন করে কাছে আসতে বারণ করেছিলেন। কারণটা বলেছিলেন পরে, ফটোটা কে নিল, নিশ্চয়ই আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখবে লোকটা। যদি দেখে প্রাপক সঙ্গে দু’জনকে নিয়ে এসেছে, খটকা লাগবে তার।

ফটো পাওয়ার পর পরিকল্পনা মতো দীপকাকু পাতাল রেল ধরেছিলেন। ঝিনুক ফিরছিল বাবার গাড়িতে। ফেরার পথে বাবা আফশোস করছিলেন নিজের বোকামির জন্য। দীপকাকুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার বোকামি নয়, তার চেয়েও বড় গণ্ডগোল পাকিয়ে ছিলেন নিজের পজিশন নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই। একটা রোগী পাতলা ছেলে হ্যান্ডবিল বিলি করতে করতে এগিয়ে আসছিল, বাবা খেয়াল করেননি, দীপকাকুর দিকেই ছিল নজর। ছেলেটা ছদ্মবেশী দীপকাকুকে হ্যান্ডবিল দিয়ে যেই না এগিয়েছে, বাবা এসে মেরেছিলেন রামধাক্কা। বাবার ভুল দেখে ঝিনুকের তো কপালে হাত। ছেলেটা ফুটপাত থেকে ছিটকে গিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। অগুনতি হ্যান্ডবিল হাওয়ায় উড়তে উড়তে তার উপরই এসে পড়ছিল। ছেলেটা নাকি প্রবল বিস্ময়ে আর ভীষণ অসহায় হয়ে তাকিয়ে ছিল বাবার দিকে। ঝিনুকের সেই এক্সপ্রেশন দেখার সুযোগ হয়নি। বাবার মুখে শুনেছে। ঝিনুক দেখেছিল বাবা সত্যিকারের শুক্রবার জন্য এগিয়ে গিয়েছেন ছেলেটার দিকে। দীপকাকু খানিক দূরে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে হাসি চাপছেন। সে যাই হোক, রাতে লোকটা ফোন করেছিল দীপকাকুকে বিজ্ঞাপনে দেওয়া নাম্বারে। কোনও একটা ল্যান্ড লাইন থেকেই এসেছিল কলটা। তার আগে দীপকাকু দু’টো কাজ সেরে রেখেছিলেন, মেট্রো সিনেমার নীচে দাঁড়িয়ে থাকার সময় যে নাম্বার থেকে ইন্সট্র্যাকশন এসেছিল, সেটা ল্যান্ডলাইনের ভবানীপুরের নাম্বারটা নয়, দীপকাকু ট্র্যাক করে দেখেছেন দুপুরের নাম্বার ধর্মতলার এক জেরক্সের দোকানের। দোকানিকে জিজ্ঞেস করে লোকটার চেহারার বর্ণনা পাওয়া যায়নি। দশটা পনেরো মানে অফিস আওয়ার্স, দোকানে ভিড় ছিল খুব। নাম্বার ট্র্যাক করে লোকটার হদিশ পাওয়া যে বেশ কঠিন, মেনে নিয়েছেন দীপকাকু। আর ওই রাস্তায় হাঁটবেন না ঠিক করেছেন। দীপকাকুর ওপর নজর রাখার জন্যই লোকটা মেট্রো সিনেমার কাছাকাছি ধর্মতলায় দোকানটা থেকে ফোন করেছিল। এমন আশঙ্কা দীপকাকুর ছিলই, তাই খামটা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা এবং ঝিনুককে ফোন করে কাছে আসতে বারণ করে দেন। রাতের ফোনালাপের আগে দীপকাকুর দ্বিতীয় কাজটা ছিল, ইন্টারনেট সার্চ করে ফটোর ঘণ্টার বিষয়ে জানা। জেনে নিয়েছিলেন দীপকাকু, লোকটা মিথ্যে বলেনি, ফটোর ঘণ্টাটা তিব্বতী ঘরানার। বৌদ্ধধর্মের মহাযান ধারার। বৌদ্ধধর্মে প্রধানত দুটি ধারা, মহাযান এবং হীনযান। তিব্বতের দিকে মহাযানের প্রসার ঘটেছে। লোকটি ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল, ফটো দেখে কী মনে হল? কিনতে আগ্রহী আপনি? দীপকাকু বলেছেন, অবশ্যই আগ্রহী, তবে দেখে নিতে হবে ঘণ্টার হ্যান্ডেলে, মানে যে অংশটাকে দর্জি বলে, সেখানকার মুক্তোগুলো অরিজিনাল কিনা? তা যদি হয়, অবশ্যই “

জিনিসটা অ্যান্টিক পিস হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। লোকটা আশ্বস্ত করে বলেছিল, মুক্তোগুলো কালচার করা নয়, একদম অরিজিনাল এবং প্রাচীন। যদি কেনেন, পরীক্ষা করে নেবেন। এবার বলুন দাম দেবেন কত? দীপকাকু বলেছিলেন, সব যদি ঠিকঠাক থাকে লাখ চারেক দিতে পারি। ও প্রান্তে লোকটা প্রায় আঁতকে ওঠা গলায় বলেছিল, কী বলছেন আপনি! এই জিনিস মাত্র চার লাখ টাকায় ? যে কোনও কিউরিওশপে গেলে আমি অনায়াসে দশ-বারো লাখ টাকা পাব। নেহাত প্রকাশ্যে এটা আমি বিক্রি করতে চাই না বলেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে দীপকাকু প্রশ্ন করেছিলেন, কেন প্রকাশ্যে বিক্রি করতে চান না? ফোনের ওপার থেকে উত্তর এসেছিল, এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনার কেনার ইচ্ছে থাকে তো বলুন। দীপকাকু বলেছিলেন, কিনতে অবশ্যই চাই। কিন্তু অত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। বড়জোর ছ’লাখ দিতে পারি। তাও আমাকে অন্তত এক সপ্তাহ সময় দিতে হবে বাকি টাকাটা জোগাড় করার জন্য। লোকটা বলেছিল, আপনি সময়টা দু’ সপ্তাহ নিন, টাকাটা আট লাখ করুন।

দীপকাকু রাজি হয়েছেন। এটাই চেয়েছিলেন, জিনিসটা যেন কিছুদিনের জন্য হাতবদল না হয়। ইত্যবসরে চোরকে তিনি ধরে ফেলবেন। লোকটার দেওয়া সময় থেকে চারদিন খরচ হয়ে গিয়েছে। তদন্তে এগোবার কোনও রাস্তাই খুঁজে পাননি দীপকাকু। পুলিশও ডাকছে না ইনভেস্টিগেশনে সাহায্য করতে। কেসটাতে নিজের অগ্রগতি দেখানোরও সুযোগ পাচ্ছেন না দীপকাকু। বৌদ্ধ মন্দিরের ঘণ্টার ফটোটা নিয়ে গিয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না, সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাট থেকে এটা চুরি হয়েছে। সুপ্রিয় পাল নিজেই যেখানে বলছেন কিছু খোয়া যায়নি তার। পুলিশ দীপকাকুর কথা মানবে কেন? দীপকাকুর হাতে কোনও প্রমাণ নেই যে বলবেন, এটা সুপ্রিয় পালেরই। ফটোটা কত বুদ্ধি খাটিয়ে সংগ্রহ করেছেন, পুলিশকে জানিয়ে লাভ নেই। কেসটার সঙ্গে ফটোটার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। চোরের হদিশ পাওয়া যায়নি, কী ভাবে চুরি হয়েছে, সেটাও দীপকাকু বলতে পারবেন না। ফটোটা কোনও গুরুত্ব বহন করবে না পুলিশের কাছে। এই ক’দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়েছে দীপকাকুকে। বাবা ফোন করে খবর নিতে গেলে, আক্ষেপ করেছেন কেসটা নিয়ে। আজ রবিবার। সকালে ঝিনুকদের বাড়িতে দীপকাকুর আসার চান্স ছিল। ফাঁকা থাকলে বাবার সঙ্গে দাবা খেলতে চলে আসেন সকালের দিকে। আজ এলেন ঠিকই, তবে মুড পুরো অফ। দাবার বোর্ড সাজাতে সাজাতে বাবা বলেছিলেন, কী ব্যাপার, মুখটা এমন বেজার করে আছ কেন? দীপকাকু বললেন, আজকের কাগজটা দেখেছেন? বাবা জানতে চেয়েছিল, কেন, আজ আবার কী বেরলো? খবরের কাগজটা সোফার উপরে ছিল, ঝিনুক এনে দিয়েছিল দীপকাকুর হাতে। পাতা উলটে দেখালেন পুলিশের দেওয়া ‘সন্ধান চাই”-এর বিজ্ঞাপন। সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটে খুন হওয়া ছেলেটির চোখ বন্ধ মৃত মুখের ছবি। পরনে যা যা ছিল তার বর্ণনা। বিজ্ঞাপনে চোখ বুলিয়ে দীপকাকুর মতোই মনের অবস্থা হল ঝিনুক আর বাবার।

খবরের কাগজটা ভাঁজ করে কোলের ওপর রেখে দীপকাকু বলেছিলেন, হাত ধুয়ে ফেলল পুলিশ। ছবি দেখে কেউ যদি খোঁজ না নিতে আসে ছেলেটার, পুলিশ বড়ি পুড়িয়ে ফেলবে। খুনি কোনও দিন ধরা পড়বে না। এত বড় একটা অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে। এরপর বাবা-ই দীপকাকুকে বলেন, ইনভেস্টিগেটিং অফিসারকে ফোন করে কেসটা আর একবার খতিয়ে দেখবার অনুমতি নিতে। অনুমতি পাওয়ার পর দীপকাকু আকৃতি প্লাজায় এসে সেই যে সিকিউরিটি রুমে এসে ঢুকেছেন, এখনও বেরোলেন না। বাইরে পায়চারি করতে করতে ঝিনুকের পা ব্যথা হয়ে গেল। এবার একটু বসতে হবে।

সিকিউরিটি রুমের দিকে ঘুরতে যাবে ঝিনুক খেয়াল করে বিল্ডিং কমপ্লেক্সের দিক থেকে একজন হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছেন। সম্ভবত তাকে লক্ষ করেই। কাছাকাছি পৌঁছতেই ভদ্রলোককে চিনতে পারে ঝিনুক, সুপ্রিয় পাল। পরনে ট্র্যাকস্যুটের লোয়ার আর টি শার্ট। চোখে মুখে একটু বুঝি উদভ্রান্ত ভাব। সামনে এসে বললেন, এই তো, ঠিক আন্দাজ করেছি দূর থেকে। ইন্সপেকশনের প্রথম দিন আপনিও ছিলেন না?

ঝিনুক চুপ করে থাকে। একেবারে মন্তব্যহীন। দীপকাকুর শিক্ষা, তদন্তের সময় কেউ কোনও প্রশ্ন করলে চট করে উত্তর দেবে না। আগে বোঝার চেষ্টা করবে, কেন প্রশ্নটা করা হচ্ছে? উত্তরের তোয়াক্কা না করে সুপ্রিয় পাল অধৈর্যের গলায় বললেন, আপনি একা কেন? আপনার স্যার কোথায়? এবার ঝিনুক অর্ধেক উত্তর দিল, উনি আছেন।

—কোথায় আছেন? সেই কখন থেকে ওয়েট করছি। প্রায় দু’ঘণ্টা হয়ে গেল। থানার আই ও বলেছেন উনি আমার কাছে আসছেন, যেন বাড়ি থাকি। এদিকে বাইরে কিছু কাজ আছে আমার। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আপনাকে দেখতে পেয়ে নেমে এলাম।

—উনি সিকিউরিটি রুমে। বলেই ঝিনুকের মন হল ভুল হয়ে গেল। দীপকাকু ওখানে কী খুঁজছেন, সুপ্রিয়বাবুর জেনে যাওয়াটা ঠিক হবে না। সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে উনি প্রথম দিকে।

সিকিউরিটি রুম লক্ষ্য করে এগিয়ে যাচ্ছেন সুপ্রিয় পাল, ঝিনুক লম্বা লম্বা পা ফেলে ওঁকে ক্রস করে দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা দীপকাকু টেবিলে চাপড় মেরে বলে উঠলেন, ইয়েস, আই গট ইট।

ঝিনুক তাড়াতাড়ি দীপকাকুর চেয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, আড়াল করে রাখে স্ক্রিন। দীপকাকু কী পেলেন, সুপ্রিয়বাবুকে তো দেখতে দেওয়া যাবে না। চেয়ারের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটির লোকটি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে। সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজ স্ক্রিনে পজ দিয়ে রেখেছেন দীপকাকু। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা ইয়াং ছেলে ‘আকৃতি প্লাজা’র গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পিছনটাই দেখা যাচ্ছে ছেলেটার। দীপকাকুর উদ্দেশে ঝিনুক বলে ওঠে, সুপ্রিয় পাল এসেছেন।

–কে সুপ্রিয়? জানতে চেয়ে ঝিনুকের দিকে ঘাড় ফেরালেন দীপকাকু। এই এক মুশকিল, মাঝে মাঝে ছোটখাটো ব্যাপার এমন ভুলে যান। ঝিনুক বলল, আমরা যাঁর কাছে এসেছি।

চাকা দেওয়া চেয়ার পিছিয়ে দরজার দিকে তাকালেন দীপকাকু। সুপ্রিয় পালকে চিনতে পেরে বললেন, সরি, এখানে একটু আটকে গিয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার ফ্ল্যাট যাচ্ছি।

—আসলে বাইরে কিছু কাজ ছিল, বুঝতেই পারছেন, একটাই ছুটির দিন। বিনয়ের সঙ্গে বললেন সুপ্রিয়বাবু। বাইরের মেজাজ দীপকাকুর সামনে এসে পালটে গিয়েছে।

–কতক্ষণের কাজ ?

—ঘণ্টা খানেকের মতো।

সেরে আসুন। আমরা ততক্ষণ আপনার ফ্ল্যাটে অপেক্ষা করব। ফ্ল্যাটে কেউ আছেন তো? আপনার মেয়ে অথবা মিসেস…

– মেয়ে নাচের স্কুলে। সোমা আছে, আমি বলে রাখছি, আপনারা আসুন। কথা শেষ করে রুমের দরজা থেকে নেমে গেলেন সুপ্রিয় পাল।

দীপকাকু প্যান্টের পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বার করে চেয়ার আগের পজিশনে নিয়ে গিয়ে সিপিইউতে গুঁজলেন। সম্ভবত ভিডিও ফুটেজের খানিকটা অংশ নিজের পেনড্রাইভে লোড করবেন।

পজ দিয়ে রাখা ভিডিওটা মাউসের সাহায্যে চালু করলেন দীপকাকু, ফুটেজের ছেলেটা গেট পেরিয়ে ক্যামেরা জোনের বাইরে চলে গেল। ফের পজ দিয়ে ভিডিওটা ফাস্ট রিওয়াইন্ড করলেন। থামলেন সেখানে, ছেলেটা যখন গেট দিয়ে ঢুকছে। চমকে উঠল ঝিনুক, খুন হয়ে যাওয়া ছেলেটা ঢুকছে, যাকে গেট দিয়ে বেরোতেও দেখা গেছে স্ক্রিনে। ঝিনুক বিষম বিস্ময়ের দীপকাকুকে জিজ্ঞেস করে, এটা কবেকার ফুটেজ?

-মারা যাওয়ার ছ’দিন আগের। এগারোই ডিসেম্বর, রবিবার ছিল। বলার পর দীপকাকু ফের ছেলেটা ঢোকার আগে অবধি ছবি রিওয়াইন্ড করে পজ দিলেন। নির্দিষ্ট কমান্ড দিয়ে কপি অপশন চালু করে, তুলে নিলেন পজ। চলতে শুরু করল ছবি। ঝিনুক জিজ্ঞেস করল, এই হাউজিং-এ কার কাছে এসেছিল ছেলেটা?

—সেটাই খুঁজে বার করতে হবে। বলে দীপকাকু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটির লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, বাইরের লোক গেটের রেজিস্টারে সই করে ঢোকে তো ?

খানিক ইতস্তততার সঙ্গে লোকটি বলল, যারা রেগুলার আসে মানে যাদের আমরা চিনে গেছি, সই করাই না। একদম অচেনা লোককে করাই। লিখতে হয় কার কাছে যাচ্ছে। লোকটাকে যদি তেমন সুবিধের না ঠেকে, যে ফ্ল্যাটে যাচ্ছে, সেখানে ফোন করে জেনে নিই। লোকটাকে পাঠাব কিনা?

দীপকাকু ফাস্ট ফরোয়ার্ড করেছেন ছবি এবার নিশ্চয়ই ছেলেটার গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার অংশটা কপি করবেন। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে সিকিউরিটির লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলেটাকে কি চেনা ঠেকছে? আগে কখনও এসেছে হাউজিং-এ?

– —চেনা বলতে ওর বডি দেখেছি। সেদিন আপনারাও দেখেছেন। আগে কখনও আসতে দেখিনি। এলেও আমার ডিউটির সময় আসেনি। তবে এত জোর দিয়ে বলা যায় না, সারাদিন কত লোক যাচ্ছে, আসছে! সবাইকে কি মনে রাখা সম্ভব? নিয়মিত এলে মুখ চেনা হয়ে যায়।

কপি করা শেষ হল দীপকাকুর। সিপিইউ থেকে পেনড্রাইভ বার করে নিয়ে সিকিউরিটির লোকটিকে বললেন, রেজিস্টার খাতাটা নিয়ে আসুন তো। ডেট আর টাইম যখন জেনে গিয়েছি, সই করে ঢুকেছে কিনা দেখতেই পাব।

লোকটি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। রেজিস্টার খাতা থাকে গেটের থামের সঙ্গে লাগানো শেডের নীচে। একটা টেবিলের উপর, সামনে সিকিউরিটি স্টাফের চেয়ার। দু’দিনের একদিনও সই করতে হয়নি ঝিনুকদের। প্রথম দিন তো সই করার পরিস্থিতিই ছিল না। খাতা নিয়ে এল লোকটা। খোলা অবস্থায় আছে, মনে হচ্ছে এগারোই ডিসেম্বর পাতাটা খুলেছে। দীপকাকু ওর থেকে খাতাটা নিয়ে কম্পিউটারের পাশে রাখলেন। দীপকাকুর মতো ঝিনুকও ঝুঁকে পড়েছে খাতার উপর, লাইন টানা খাতা। প্রত্যেক লাইনে ভিজিটারের নাম আর সময় লেখা। দীপকাকু খাতায় আঙুল নির্দেশ করে বলছেন, ভিডিওতে রেকর্ড হয়েছে ছেলেটা ঢুকেছে দুপুর এগারোটা পাঁচে। এখানে সাড়ে দশটায় সই করেছে একজন। পরের লাইনে কিছু লেখা হয়েছিল, পেন দিয়ে কেটে দেওয়া হয়েছে। তার পরের লাইনে যে সই করেছে এন্ট্রি টাইম সাড়ে বারোটা, মানে কী দাঁড়াল?

মানেটা এতই পরিষ্কার, ঝিনুকের আর মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করল না। সিকিউরিটি স্টাফ বলে উঠল, অনেকে কিন্তু লেখা খারাপ হয়ে গেলে কেটে দিয়ে পরের লাইনে লেখে।

কোনও উত্তর না দিয়ে দীপকাকু মোবাইল ফোন বার করে ক্যামেরা অপশনে গেলেন। ওঁর এখন স্মার্টফোন হয়েছে। ইন্টারনেটের সুবিধার জন্য নেওয়া। ছবিও ভাল ওঠে। এগারোই ডিসেম্বরের পেজটার ফটো তুলে নিলেন কয়েকটা। ঝিনুককে বললেন, চলো, ওদের ফ্ল্যাটে এবার যাই।

সিকিউরিটি রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে ঝিনুকরা। দীপকাকু নিজের মোটর বাইকের দিকে এগোচ্ছিলেন, ঝিনুক বলল, এইটুকু যাব, বাইকের কী দরকার।

—তাই তো! বলে দাঁড়িয়ে গেলেন দীপকাকু। সিকিউরিটির রুমের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা স্টাফটিকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। লোকটি বলে উঠল, এখানে থাক। কোনও চিন্তা নেই। আমরা তো আছি।

‘আমরা” বলতে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আর একজন সিকিউরিটি স্টাফের কথা বলল লোকটা। দীপকাকু এগিয়ে চলেছেন। সেই বিল্ডিং লক্ষ্য করে, যেটায় সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাট। ঝিনুক চলেছে একটু পিছনে। দীপকাকু মোবাইল বার করে কাকে যেন কল করছেন। ফোন সেট নিলেন কানে। অপর প্রান্ত কল রিসিভ করার পর বললেন, একটা ট্যাক্সির নাম্বার বলছি, নোট করতো।

ঝিনুকের বুঝতে অসুবিধে হল না লালবাজারের রঞ্জনকাকুকে ফোনে ধরেছেন দীপকাকু। নাম্বারটা বলা হয়ে গেল। ফের বললেন, তুই একবার বল।… ঠিকঠাক লেখা হল কিনা, তার জন্যই শুনতে চাওয়া। শুনে নিয়ে দীপকাকু বললেন, এগারোই ডিসেম্বর, দুপুর এগারোটা নাগাদ ট্যাক্সিটা কে চালাচ্ছিল খোঁজ নে। ড্রাইভারের সঙ্গে আমার কথা বলানোর ব্যবস্থা কর ।

অপর প্রান্তে রঞ্জনকাকু কিছু বললেন। উত্তরে দীপকাকু জানালেন, না না, নতুন কেস নয়। আকৃতি প্লাজার কেসটা নিয়েই আছি। খুবই ইন্টারেস্টিং কেস। থানা তেমন গা করছে না কেন, কে জানে! অবশ্য ওদের দোষ দেওয়া যায় না, একটার পর একটা কেস এসে যাচ্ছে। কাজের পাহাড়। তবে আমাকে সব রকম হেল্প করছে।

থেমে ওপ্রান্তের কথা শুনলেন দীপকাকু । হাসতে হাসতে বলছেন, টাকা তুই দিবি। তুই তো কেসটা এক্সপেরিয়েন্স করতে পাঠিয়েছিলি। এখন তুই আমার ক্লায়েন্ট।

এবার রঞ্জনকাকুর কথা শুনে শুধু হাসলেন দীপকাকু। বললেন, এখন ছাড়ছি। পরে কথা হবে।

দীপকাকু ফোন সেট পকেটে ঢোকালেন। ঝিনুক পাশে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলার দরকার পড়ছে কেন? ট্যাক্সির নাম্বারটাই বা কোথা থেকে জোগাড় করলেন? —মাথাটা একটু খাটাও, ঠিকই বুঝতে পারবে।

—ডেট এবং টাইম যেটা বললেন, তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে অজ্ঞাত পরিচয় ছেলেটার এই কমপ্লেক্সে আসার তথ্য। খানিক আগে ভিডিও ফুটেজ থেকে যেটা পাওয়া গেল।

– – এই তো, খানিকটা হলেও লিঙ্ক করেছ। খুশি হওয়া গলায় বললেন দীপকাকু। হাঁটার গতি কমিয়ে ফের বলেত থাকলেন, সিসি টিভি ক্যামেরার জোনে প্রথমে একটা ট্যাক্সির সামনে টুকু দেখা গেছে। নাম্বার পেলাম ওখান থেকেই। ট্যাক্সির গা ঘেঁষেই ছেলেটি জোনে ঢুকল, আন্দাজ করা যায় ওই গাড়িতেই এসেছে। পিছিয়ে গেল ট্যাক্সি। অনুমান যদি ভুল না হয়, ওই ট্যাক্সির ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারব, কোথা থেকে ছেলেটাকে তুলেছিল। এতে ছেলেটির আসল ঠিকানার দিকে কিছুটা অন্তত এগিয়ে যাব।

কথাগুলো শুনে ঝিনুকের মনে হল এই প্রথম একটা তদন্তে দীপকাকু যেমন এগোচ্ছেন, একই গতিতে কেসটাও তাঁকে ডেকে নিচ্ছে।

ঝিনুক, দীপকাকু এখন ছাদে। নীচ থেকে লিফটে চড়ে সুপ্রিয় পালের ফ্ল্যাটেই যাওয়া হয়েছিল। ডোরবেল বাজাতে দরজা খুলেছিলেন সোমাদেবী। স্নিগ্ধ চেহারা। পরনে ম্যাক্সির উপর ফ্লোরাল প্রিন্টের হাউসকোট। বলেছিলেন, মিস্টার বাগচী তো? আসুন। ও বলে গিয়েছে এক ঘণ্টার আগেই ফিরে আসার চেষ্টা করবে।

সুপ্রিয়বাবুর স্ত্রীকে প্রথমবার দেখা গেল। আগের দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ঘটনার ধাক্কায়। ভিতরের ঘরে ছিলেন। আজ ওঁর অভ্যর্থনার উত্তরে দীপকাকু বললেন, ছাদটা একবার ঘুরে আসি। চাবিটা দিন তো।

বিনা বাক্যব্যয়ে চাবি এনে দিয়েছিলেন সোমাদেবী। ছাদে এসেই দীপকাকু এগিয়ে গেলেন পাঁচিলের ধারে, যেখানে হ্যান্ডরেস্টের পাইপের উপর দড়ি বাঁধার দাগ ছিল। ওখানে দাঁড়িয়ে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে জায়গাটা দেখে যাচ্ছেন। পিছনে ঝিনুক। ফরেনসিক টিম এখানে কোনও দড়ির বাঁধার দাগ পায়নি। ধাতব কিছুর আঁচড় পেয়েছে। বড় করে শ্বাস ছেড়ে সোজা হলেন দীপকাকু। বললেন, দড়ির দাগটা যাতে চিহ্নিত না করা যায়, তার জন্য স্ক্রু কিংবা ছুরি দিয়ে স্ক্রাচ করে দেওয়া হয়েছে। এবং সেটা করা হয়েছে আমরা দড়ির দাগ দেখে যাওয়ার পর, আর ফরেনসিকের লোক আসার আগে। নীচে পায়ের ছাপও মুছে ফেলা হয়েছে। কনস্টেবল ঘোষবাবু ছাদের দরজায় তালা মেরে আমাদের সঙ্গেই লিফটে উঠেছিলেন। যে এই কাজগুলো করল, ছাদের চাবি পেল কোথা থেকে?

– বোঝাই যাচ্ছে লোকটা এই বিল্ডিঙের কেউ অথবা এখানকার কারুর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ আছে। কেননা প্রত্যেক ফ্ল্যাটেই একটা করে চাবি দেওয়া আছে ছাদের। লোকটা মূল অপরাধী অথবা অপরাধীর নিয়োগ করা কেউ। আগের দিন সে আমাদের আশেপাশেই ছিল, নজর রাখছিল আপনার কাজকর্মের উপর।

ঝিনুক শেষ করতেই দীপকাকু বললেন, অপরাধ যে এই রাস্তা দিয়ে হয়েছে, সেটা ক্লিয়ার। তাই প্রমাণ লোপের চেষ্টা। খুন হয়ে যাওয়া ছেলেটি এখানে বাঁধা দড়ি বেয়ে নেমেছে পায়ে মোজা দেখে সেটা বোঝা যায়। জুতো পরে নামতে অসুবিধে হবে বলে খুলে রেখেছিল। দড়ির দাগ মোছা তার পক্ষে সম্ভব নয়, খুন হয়ে গিয়েছে নীচে নেমে। অপরাধী উঠে এসেছিল দড়ি বেয়ে। প্রমাণ লোপের কাজটা করে যাচ্ছে এখন। অপরাধী দু’জন হওয়ারও চান্স আছে, খুন এবং চুরি হয়তো আলাদা আলাদা লোক করেছে।

—খুনের প্রমাণ তো চোখের সামনেই ছিল। খুনির তালিকায় সুপ্রিয় পালকে রাখা যেতেই পারে। চুরির ব্যাপারটায় আপনি কি নিশ্চিত?

—অলমোস্ট। সুপ্রিয় পালও করে থাকতে পারেন চুরি অথবা অন্য কেউ। এতক্ষণে যুক্তির রাস্তা থেকে পা ফসকালো দীপকাকুর। এমনটা হওয়ারই কথা, চূড়ান্ত জটিল পর্যায়ে চলে গিয়েছে ভাবনা-চিন্তা। ভুল শুধরে দিতে ঝিনুক বলল, সুপ্রিয় পাল হলে তো আপনি ফোনের গলা শুনেই চিনতে পারতেন। চোর বার কয়েক ফোন করেছে আপনাকে।

– –যে লোকটা এত সযত্নে নিজেকে আড়াল করে যাচ্ছে, আসল কণ্ঠস্বর সে আমাকে চিনিয়ে দিতে যাবে কেন? নির্ঘাত রিসিভারে রুমাল রেখে অন্য রকম গলা করে কথা বলছে। আমিও নিজের গলা লুকিয়ে কথা বলছি।

বুঝল ঝিনুক। তারপর বলে, ধরে নিলাম সুপ্রিয় পাল ফোন করেছেন। কিন্তু নিজের জিনিস এত গোপনীয়তা রক্ষা করে বিক্রি করতে চাইছেন কেন? কারণটা কী?

—কারণ এখনই কী করে বলব! সুপ্রিয় পাল সম্বন্ধে কতটুকুই বা জানতে পেরেছি? মৃতের পরিচয়, কেন সে সুপ্রিয়বাবুর ফ্ল্যাটে এসেছিল। কেনইবা খুন হতে হল তাকে… এরকম আরও অনেক কিছুই জানা বাকি। বলে দীপকাকু ছাদের দরজার দিকে পা বাড়ালেন ।

সুপ্রিয় পালের ড্রয়িং স্পেসে বসে আছে ঝিনুকরা। দু’জনের জন্য চা, বিস্কিট, ডালমুট সেন্টার টেবিলে রেখেছেন সোমাদেবী। ঝিনুক ‘চা খাই না’ বলে ওঁকে আর বিব্রত করতে চায়নি। দীপকাকু এমন স্বচ্ছন্দে মুঠো করে ডালমুট তুলে নিচ্ছেন প্লেট থেকে, যেন এ বাড়িতে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত আছে। ফ্ল্যাটে ঢুকেই দীপকাকু চলে গিয়েছিলেন সুপ্রিয়বাবুর সংগ্রহগুলো দেখতে। ক্যাবিনেটের মাঝখানে এসে একটু বেশি সময় দাঁড়ালেন। আসলে তো দেখতে এসেছেন ওই জায়গাটাই। ঝিনুকও এটা সেটা দেখতে দেখতে চোখ বুলিয়েছে ঘণ্টার র‍্যাকে, না, এখন কোনও ফাঁকা জায়গা নেই।

ঝিনুকরা সোফায় বসার আগেই সোমাদেবী চা স্ন্যাকস সাজিয়ে দিয়েছিলেন টেবিলে। দীপকাকু কাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠেছিলেন, দারুণ চা!

খুশি ছড়িয়ে পড়েছিল সোমাদেবীর মুখে। ঝিনুকদের বড় সোফার কোনাকুনি সিঙ্গল সোফায় বসেছেন সোমাদেবী। অপেক্ষা করছেন দীপকাকুর প্রশ্নের। ঝিনুকও করছে। দীপকাকুর মন খাওয়ার দিকে। সোমাদেবী একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। নিশ্চয়ই সুপ্রিয়বাবুর ফেরার প্রত্যাশায়। দেওয়াল ঘড়িটাও বেশ অন্যরকম, অ্যান্টিক পিস বলা যায়। চায়ের কাপ-প্লেট টেবিলে নামিয়ে দীপকাকু এবার সোমাদেবীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, আপনি একটু ভাল করে ভেবে দেখুন তো, সেদিন প্রথমে গুলির আওয়াজ শুনেছিলেন, নাকি ডোর বেলের আওয়াজ ?

—ডোর বেলের আওয়াজটাই প্রথমে শুনি। বেশ কয়েকবার বাজিয়ে ছিল সুপ্রিয়, ঠিক কত বার বলতে পারব না। বেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙেনি আমার। গুলির আওয়াজে পুরোপুরি ঘুম ভেঙেছে। ওটা যে গুলির আওয়াজ সেটাই বুঝতে পারিনি। কখনও শুনিনি তো আগে। কী জোর আওয়াজ! বেডরুম থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে দেখি, ছেলেটা পড়ে আছে এখানে। আঙুল নির্দেশ করে জায়গাটা দেখালেন সোমা।

দীপকাকু জিজ্ঞেস করলেন, লাইট জ্বালানো ছিল?

– নাইট ল্যাম্পের মতো একটা আলো জ্বালানো থাকে ড্রয়িঙে।

-তারপর? বলে দীপকাকু পরবর্তী অংশ শুনতে চাইলেন। সোমাদেবী বললেন, ছেলেটাকে দেখার পর আর কিছু মনে নেই। তোর্সা, মানে আমার মেয়ে আর সুপ্রিয় বলছে আমি নাকি খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। সেটা পর্যন্ত আমি মনে করতে পারছি না ।

— ছেলেটাকে তো সামনে থেকে আপনি দেখেননি। পুলিশ বডি নিয়ে যাওয়ার সময়েও না। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

সোমাদেবী মাথা নেড়ে সায় দিলেন। দীপকাকু ফের বললেন, আজ কাগজে ‘সন্ধান চাই’ কলামে পুলিশ ছবি দিয়েছে ছেলেটার দেখেছেন?

—দেখেছি। সুপ্রিয় দেখিয়েছে।

-ছেলেটাকে আগে কখনও দেখেছেন বলে কি মনে হচ্ছে? –না, কোনওদিন দেখিনি।

দীপকাকু একটু চুপ করে রইলেন। এবার গেলেন প্রসঙ্গান্তরে। বললেন, এই যে শো-পিস সংগ্রহের ঝোঁক, এটা সুপ্রিয়বাবুর কতদিনের?

—চাকরি পাওয়ার পর থেকে পৃথিবীর নানান দেশে পাঠাত কোম্পানি। সব জায়গার বেশ কিছু করে মেমেন্টো নিয়ে আসত। বিয়ে হয়ে আসার পর খুব বেশি দেখিনি আমি। তখন আমরা টালিগঞ্জের বাড়িতে থাকতাম। ওর পৈতৃক বাড়িতে, শো-পিসগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার মতো স্পেস ছিল না। মেয়ে হওয়ার পর এই ফ্ল্যাটটা কেনা হয়। ওর কালেকশন সাজাবে বলে এখানকার বিল্ডারকে একটা রুম কম দিতে বলা হয়। বেড়ে যায় আমাদের ড্রয়িং স্পেস। সাজানোর জায়গা পেয়ে ওর কালেকশনের ঝোঁকটা এখন নেশায় পরিণত হয়েছে।

—শুধুমাত্র শো-পিস কালেকশনের জন্য সুপ্রিয়বাবু কখনও ট্যুরে যান?

–না, সে সময় কোথায়! অফিসে যা কাজের প্রেশাব। ট্যুরে যায় কোম্পানি পাঠালে, আর বছরে একবার অন্তত ফ্যামিলি ট্যুরে। বেড়াতে গিয়ে সিনিক বিউটির দিকে নজর থাকে না ওর। লোকাল হ্যান্ডিক্রাফটসের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। বলে থমকে গেলেন সোমাদেবী। ভ্রূ জোড়া ঘনিষ্ঠ হল তাঁর। জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এসব কথার সঙ্গে আমাদের ফ্ল্যাটের দুর্ঘটনার কী সম্পর্ক?

থতমত খেলেন দীপকাকু। প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। সোমাদেবীকে নিরীহ, ভাল মানুষ পেয়ে আড্ডার ছলে জেরা করে যাচ্ছিলেন। এখন বললেন, না না, ওই ঘটনার সঙ্গে এ সবের সম্পর্ক খুঁজছি না। এত রকম হ্যান্ডিক্রাফটস দেখে ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানার কৌতূহল হল।

বাইরে থেকে ঘরে ঢুকলেন সুপ্রিয়বাবু। ওঁর অপেক্ষাতেই দরজার ছিটকিনি লাগানো হয়নি। ভেজানো ছিল। দীপকাকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, অ্যাই অ্যাম সো সরি। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি আপনাদের। আসলে আমার এল আই সি এজেন্টের শরীরটা খারাপ। প্রিমিয়ামের লাস্ট ডেট চলে এসেছে। কুঁদঘাটে গিয়ে ওকে দেখেও এলাম, চেকটাও দেওয়া হল। আজ সানডে দেখেই রেখেছিলাম কাজটা।

—ইটস অল রাইট। আমরা তো দিব্যি চা-টা খাচ্ছি, গল্প করছি। স্মিত হাসিসহ বললেন দীপকাকু।

অপর সিঙ্গল সোফাটায় এসে বসলেন সুপ্রিয়বাবু। সোমাদেবী উঠে পড়ে সুপ্রিয় বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, চা খাবে তো?

-হ্যাঁ, করো। এঁদেরও আর একবার দাও।

আমি আর না। সোমাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলল ঝিনুক।

উনি জোর করলেন না। সৌজন্যের হাসি হেসে ভিতরে চলে গেলেন।

সোফায় বসা অবস্থায় একটু নড়ে চড়ে সুপ্রিয়বাবু সম্ভবত নিজের কথা গুছিয়ে নিলেন। বললেন, একটা ব্যাপার আগে একটু ক্লিয়ার করে দিন তো। থানা থেকে মিস্টার রায় আমাকে জানালেন ইন্টারোগেট করতে আপনি আসছেন।

প্রথমদিন আপনি ইন্সপেকশনে ছিলেন, অল্প জিজ্ঞাসাবাদও করেন আমাকে। যেহেতু সিভিল ড্রেসে ছিলেন, আপনার পোস্ট, ডিপার্টমেন্ট আন্দাজ করতে পারিনি। আজ আবার আসছেন জেনে অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সিআইডি’র লোক কিনা? অফিসার বললেন, আপনি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। পুলিশের হয়েও অনেক কাজ করেন। এ কথাটার মানে কী ?

– মানেটা আপনি যা বুঝেছেন, সেটাই। এবার যদি স্থির করেন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের সঙ্গে কথা বলবেন না, আমি ফোর্স করতে পারি না। আমাকে চলে যেতে হবে।

নো নো, আই ডিড নট মিন দ্যাট। ইনফ্যাক্ট তদন্তটা দ্রুত শেষ হোক, আমি সেটাই চাই। আজ কাগজে ছেলেটার ফটো দিয়েছে পুলিশ, নিশ্চয়ই দেখেছেন?

-দেখেছি। কোনও পরিচয় সূত্র খুঁজে না পেলে, পুলিশ তো এমনটাই করে।

-এবার আমার কী সমস্যা হবে বলি, ফটোটা দেখে ছেলেটার আত্মীয় বন্ধুরা যাবে থানায়। পুলিশ বলবে, আমার ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া গেছে বডি। ওরা এখানে আসবে, আমার কোনও দোস আছে কিনা, খতিয়ে দেখবে না। যেহেতু এখানেই মারা গিয়েছে ছেলেটা আমাকেই দোষী ঠাওরে অকথা কুকথা বলবে। এমনকি টাকাও চাইতে পারে ক্ষতিপূরণ হিসেবে। ছেলেটার চেহারা দেখেই আন্দাজ করা গিয়েছে, শিক্ষিত সম্পন্ন পরিবারের সে নয়। এদের কাছে টাকাটাও ছেলের মতো বড় ব্যাপার। আমি চাইব ওরা এখানে আসার আগেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে রাখতে। আমার স্বার্থ অনুযায়ী আপনি আলাদা করে তদন্ত চালিয়ে অপরাধীকে যদি ধরে দেন, তাতে আমারই লাভ। এর জন্য আমি আপনাকে পে করতেও রাজি।

–আমার পেমেন্ট নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। শুধু ইনভেস্টিগেশনে কো-অপারেট করলেই হবে। বললেন দীপকাকু

ধন্দ তবু কাটল না সুপ্রিয়বাবুর, চোখে মুখে সেটা প্রকাশ পাচ্ছে। আসলে উনি জানতে চাইছেন দীপকাকুকে অ্যাপয়েন্ট করল কে? সুপ্রিয়বাবুর কোনও শত্রু কি? কোনও পেশাদার লোক বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে না। দীপকাকু কেন করতে যাবেন ? পুলিশের অত দক্ষ গোয়েন্দা বিভাগ থাকতে, তারা কেনইবা বাইরের গোয়েন্দাকে দিয়ে কাজ করাতে যাবে? টাকা দেওয়া তো অনেক দূরের কথা।

-আমরা কি এবার কেসটা নিয়ে কথা বলতে পারি? কপট সৌজন্যে বললেন দীপকাকু।

সুপ্রিয়বাবুর যেন সম্বিত ফিরল। বললেন, ওই সিওর।

শুরু করলেন দীপকাকু, ঘটনার আগের দিন সকাল থেকে কে কে এই ফ্ল্যাটে এসেছিল মনে করে বলতে পারবেন?

–আমি সাড়ে আটটা নাগাদ অফিস বেরিয়ে যাই। তার আগে কাজের মহিলাটি আসে। সেদিনও এসেছিল। তারপর কারা এসেছে বলতে পারবে সোমা…

কথা অসমাপ্ত রইল। চা নিয়ে এসেছেন সোমাদেবী। নিজে জনাও এক কাপ এনেছেন। আর এনেছেন এক প্লেট ডালমুট । নির্ঘাত দীপকাকুর কথা ভেবেই, আগের প্লেট প্রায় একটি সাবাড় করেছেন। প্রশ্ন এবং উত্তর কানে গেছে সোমা দেবীর, সোফায় বসে চায়ে চুমুক দিয়ে বলতে থাকলেন, সকালে মঙ্গলাদি কাজ করে গেল শটা নাগাদ। তারপর আমার ভাই এসেছিল বিকেল তিনটেয়।

– – ভাই কী করেন? কেন এসেছিলেন? জানতে চাইলেন দীপকাকু।

— সন্তু যাদবপুর থেকে হিস্ট্রিতে পিএইচডি করছে। সময় পেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে চলে আসে।

সোমাদেবী থামতেই দীপকাকু বলে উঠলেন, তারপর? কে কে এসেছে, পর পর বলে যান। থামবেন না।

ইনফর্মেশনগুলো দীপকাকুর কেন দরকার, আন্দাজ করতে পারছে না ঝিনুক। নিজের ডিউটিটা অবশ্য করে যাচ্ছে, পয়েন্টগুলো লিখে নিচ্ছে নোটবুকে। চা খাওয়ার ফাঁকে একটু ভেবে নিয়ে সোমাদেবী বললেন, সাড়ে চারটেয় এল অমৃতা। গুজরাটি, নতুন বিয়ে হয়েছে। এইটথ ফ্লোরে থাকে। বাঙালি ডিশ শিখতে এসেছিল। তোর্সা স্কুল থেকে ফিরল পাঁচটায়। ওর ড্রয়িং স্যার এল সাড়ে পাঁচটায়।

-ড্রয়িং স্যারের নাম, থাকেন কোথায়? দীপকাকুর প্রশ্ন।

সোমাদেবী বললেন, অনুপম ঘোষাল। বেকবাগানে থাকেন, পুরনো পৈতৃক বাড়ি। গর্ভনমেন্ট আর্ট কলেজে ফাইনাল ইয়ার। একটু থেমে ফের বলতে থাকলেন, তারপর এসেছিল আদিত্য, আমাদের হাউজিং এর কেয়ারটেকার। সেকেন্ড ফ্লোরের সুজনবাবুর ট্যাক্সের বিল ভুল করে আমাদের দিয়ে ফেলেছিল, বদলে নিয়ে গেল।

—বিলটা নেওয়ার সময় আপনারা দেখে নেননি? খানিক বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন দীপকাকু ।

সুপ্রিয়বাবু বলে উঠলেন, ওদের টাইটেল পাত্র। সুজন পাত্র। আমি সুপ্রিয় পাল, নামের মিলের জন্য হামেশাই চিঠিপত্র পালটা পালটি হয়ে যায়। কর্পোরেশনের ট্যাক্সের বিল তিনমাস অন্তর আসে, দেখতে সেই একই রকম, নতুন করে পড়তে ইচ্ছে হয় না। নাম বিভ্রাট তাই চোখে পড়েনি।

—আদিত্য যখন এসেছিল, ড্রয়িং স্যার তখনও নিশ্চয়ই যান নি? ড্রয়িং শেখাচ্ছিলেন কোথায় বসে? প্রশ্নটা দীপকাকু সোমাদেবীর দিকে তাকিয়ে করলেন।

সিটিং এরিয়া থেকে সামান্য দূরে আঙুল নির্দেশ করে সোমাদেবী বললেন, ওইখানে। চেয়ার টেবিলে বসে ড্রয়িং শেখাতে চান না অনুপম। মেঝেতেই ওঁর সুবিধে হয়। একটা ম্যাট পেতে দিই।

—ট্যাক্সের বিল খুঁজতে কতক্ষণ সময় লেগেছিল আপনার? বিলটা নিশ্চয়ই বেডরুমের আলমারিতে ছিল?

দীপকাকুর আন্দাজে অবাক হলেন না পাল দম্পতি, খুবই সাধারণ অনুমান। সোমাদেবী বললেন, হ্যাঁ ভিতরের ঘরের আলমারিতেই ছিল, খুঁজতে হয়নি। এক চান্সেই পেয়েছিলাম। আদিত্যকে ঘরে ঢুকে বসতেও হয়নি। দরজা থেকেই চলে গিয়েছিল।

—তারপর কে এল? জিজ্ঞেস করলেন দীপকাকু ।

— সাড়ে ছ’টার মধ্যে ও (সুপ্রিয়বাবুকে নির্দেশ করে) ফিরে এল। রাতের ফ্লাইট ধরবে বলে তাড়াতাড়ি ফিরে ছিল অফিস থেকে। তার মিনিট দশেকের মধ্যে এলেন আমাদের বিল্ডিঙের তারাশংকরদা, শিলাদ আর রুদ্র। এক সঙ্গে।

– কেন এসেছিলেন ?

—প্রত্যেক শীতে আমাদের বিল্ডিঙের সকলকে নিয়ে একটা পিকনিক হয়, সে ব্যাপারে কিছু দরকারি আলোচনা করে নিতে এসেছিলেন।

–বাই প্রফেশন এঁরা কে কী করেন?

এবার উত্তর দেওয়ার ভার নিলেন সুপ্রিয়বাবু। বললেন, তারাশংকরদা সদ্য ব্যাঙ্ক থেকে রিটায়ার করেছেন। শিলাদ আমারই মতো একটা কর্পোরেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। রুদ্রর একটা অ্যাড-এজেন্সি আছে, ছোটখাটো। স্ট্রাগল করছেন বিজনেসটা দাঁড় করানোর জন্য ।

– আচ্ছা, সেদিন তিনজন এখানেই বসে ছিলেন, নাকি ফ্ল্যাটের এদিক ওদিক গিয়েছিলেন ওদের মধ্যে কোনও একজন? বেডরুম বাদ রেখে বলছি। বাইরের কেউ অতটা প্রাইভেসি ব্রেক করবে না, জানি।

সোমাদেবী বললেন, ওঁরা প্রায় আমাদের ঘরের লোক হয়ে গিয়েছেন। বেডরুমেও চলে যান। ওঁদের ফ্ল্যাটেও আমাদের অবাধ গতিবিধি। সেদিন প্রথমে সোফায় এসে বসেছিলেন তিনজন। তারপর কে কখন কোথায় গিয়েছেন খেয়াল করিনি। আমি কিচেনে ব্যস্ত ছিলাম ৷

—আমার যতদূর মনে পড়ছে রুদ্র একবার উঠে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখা বোতল থেকে জল খেয়েছিলেন। তারাশংকরদা গিয়েছিলেন তোর্সার ঘরে, গল্পগাছা করতে, লেখাপড়ার খবর নিতে। তারাদার সঙ্গে তোর্সার খুব জমে। বললেন সুপ্রিয়বাবু।

দীপকাকু হঠাৎ সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন। এগিয়ে গেলেন শো-পিসের র‍্যাকের দিকে। কালেকশনে চোখ বোলাতে বোলাতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, আপনার ওই তিনবন্ধু এই সব কালেকশনের ব্যাপারে কতটা আগ্রহী ?

সুপ্রিয়বাবুও সোফা থেকে উঠে দীপকাকুর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, ওরা আমার হবিটাকে খুবই অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। শিলাদ তো হ্যান্ডিক্র্যাফস কালেকশন করা শুরু করেছেন। কোম্পানি থেকে আমার মতো অত ট্যুর পায় না। তারাদাও এখন ঘরের জন্য যা কিছুই কেনেন, আর্টভ্যালু রাখার চেষ্টা করেন। রুদ্র আর্টের জগতের লোক, ওঁর টেস্ট সব সময় ভাল। তবে কালেকশনের ঝোঁক নেই।

দীপকাকু এখন কাঠের ক্যাবিনেটের মাঝামাঝি। পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন সুপ্রিয়বাবু। দীপকাকু বললেন, আপনাদের পাশের ফ্ল্যাটটা তারাশংকরদার, তাই না?

এবার অবাক হলেন দম্পতি। পরস্পরে চোখাচোখি হল। সুপ্রিয়বাবু বললেন, হ্যাঁ, আপনি খবর নিয়েছেন ?

মাথা নেড়ে দীপকাকু বললেন, গেস করলাম ।

, ডিটেকটিভকে ‘কী ভাবে অনুমান করলেন?’ জিজ্ঞেস করা যায় না বলেই চুপ করে রইলেন সুপ্রিয়বাবু। মাথায় নিশ্চয়ই প্রশ্নটা খোঁচা মারছে। ঝিনুক এটুকু আন্দাজ করতে পারছে, ওই তিনজনের একজন পাশের ফ্ল্যাটের মালিক। কারণ, ঘটনার পরের সকালে পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের সময় হাবিলদার চা এনেছিল পাশের ফ্ল্যাট থেকে। ওঁরাই নিজে থেকে করে দিয়েছিলেন। শৌখিন সার্ভিং ট্রে, কাপ দেখে দীপকাকু কমেন্ট করেছিলেন, ‘এই ফ্ল্যাটের রুচি পাশের ফ্ল্যাটেও প্রভাব ফেলেছে দেখছি!’ সুপ্রিয়বাবুর শখ অল্পবিস্তর প্রভাব ফেলেছে তিন বন্ধুর ওপরেই। পাশের ফ্ল্যাটটা যে তারাশংকরবাবুরই, এটা দীপকাকু কীভাবে গেস করলেন, কে জানে! নাকি সত্যিই ইনফর্মেশন জোগাড় করেছেন আগে থেকে? ক্যাবিনেটের হাফ রাউন্ড কাচের পাল্লার হ্যান্ডেলে হাত রেখেছেন দীপকাকু, খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। র‍্যাকটা খানিকটা দীপকাকুর আড়ালে চলে গিয়েছে। ওখানে ওঁর অ্যাকটিভিটি কী হবে, দেখার জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছে ঝিনুক !

সোমাদেবীর সামনে থেকে উঠে যেতে পারছে না। কারণ তদন্তের কেন্দ্রস্থল যে ওখানেই, ডিটেকটিভ এবং অ্যাসিস্ট্যান্টের আগ্রহ দেখে বুঝে ফেলতে পারেন স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই। ঝিনুক তাই ওদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে কান খাড়া করে রাখে। দীপকাকু বলে উঠলেন, ক্যাবিনেটের অন্য পাল্লাগুলোর লক পুরনো, এটার মনে হচ্ছে নতুন, কবে লাগানো হল?

—রাউন্ড শেপের পাল্লার লক সহজে পাওয়া যায় না। সমস্ত ক’টা লক ক্যাবিনেট বানানোর পর বানিয়েছি। রাউন্ড পাল্লার লক পেলাম সেদিন।

– কোনদিন?

-এই তো, এ মাসের প্রথম দিকে।

—লক লাগাচ্ছেন মানে আপনার কালেকশন ক্রমশ মূল্যবান হয়ে উঠছে?

—না না, সেরকম দামি কিছু হয়ে ওঠেনি। লোকজন এসে জিনিসগুলো হাতে নিয়ে দেখে, বেশ কিছু কাচের জিনিসও তো আছে, যদি ভেঙে টেঙে ফেলে, তাই লকের ব্যবস্থা করেছি।

—হাফ রাউন্ড পাল্লাটার লক কোথায় পেলেন শেষ পর্যন্ত?

-কাছেই, একটা হার্ডওয়ারের দোকানে বলে রেখেছিলাম। ওরাই এনে দিয়েছে।

—লকটা লাগানো কে? আপনাদের চেনা কোনও কাঠের মিস্ত্রি ? – না, দোকানের মিস্ত্রিই লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে, বললেন, সুপ্রিয়বাবু।

দীপাকাকু পাল্লা সামান্য খুলে হাসতে হাসতে বললেন, লক লাগানোর পরও পাল্লা খোলাই আছে, আপনার পারপাস তো সার্ভড্ হচ্ছে না।

—যা হয় এই সব শো কেসে, কাউকে হয়তো জিনিসগুলো হাতে নিয়ে দেখিয়েছি, লক লাগাতে ভুলে গিয়েছি নিজেই।

হালকা চালে পাল্লা খুলে রাখার ভুলটা ধরিয়ে দিলেও দীপকাকু কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন। সেটা হল, এই র‍্যাকে যে দামি জিনিসটার জন্য আপনি লক করে রাখার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, সেটা এখন নেই বলে পাল্লা খোলা রাখা হয়েছে। দীপকাকু এখন অন্যান্য শো-পিসগুলো দেখেছেন। জিনিসগুলো কোন দেশ থেকে কখন, কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে জানছেন সুপ্রিয়বাবুর কাছে।

ডোরবেল বেজে উঠল। সুপ্রিয়বাবু ঘরে ঢুকে দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়েছিলেন। সোমাদেবী দরজা খুলতে উঠে যাচ্ছেন। বললেন, তোর্সা ফিরল মনে হচ্ছে।

দরজা খোলার পর মায়ের পাশ দিয়ে ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল তোর্সা। ভারী সুন্দর দেখতে, মুখে মায়ের আদল। ঝিনুককে অবাক হয়ে দেখছে তোর্সা, ঘাড় ফেরাল দীপকাকুর দিকে। সোমাদেবী মেয়েকে বললেন, চল, হাত-মুখ ধুয়ে নে। কিছু খাবি এখন?

তোর্সা কোনও উত্তর করল না। এগিয়ে গেল ভিতর ঘরের দিকে। ওর এক হাতে ঝুলছে নূপুরের বটুয়া। ঝিন ঝিন শব্দ উঠল। মেয়েকে অনুসরণ করলেন সোমাদেবী। সিটিং এরিয়ায় ঝিনুক এখন একা। ভাবছে, দীপকাকুর কাছে উঠে যাবে কি না? সুপ্রিয়বাবুর কোনও অফিসিয়াল ফোন এসেছে, দীপকাকুর পিছনে দ্রুত পায়ে পায়চারি করতে করতে উত্তেজিত গলায় কথা বলছেন। উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে সামনের পরিস্থিতি। ফোনের কথা শেষ হোক, তারপর ঝিনুক ওদিকে যাবে।

—হাই! আমি তোর্সা।

অল্প চমকে উঠল ঝিনুক। খেয়ালই করেনি কখন সুপ্রিয়বাবুর মেয়ে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখ ছিল দীপকাকুদের দিকে। প্রত্যুত্তরে হাসি সহযোগে ঝিনুক বলল, হ্যালো, আমি আছি। আঁখি সেন।

কাউকে পরিচয় দিতে হলে ভাল নামটাই বলা রীতি। তেমনটাই বলল ঝিনুক।

—নাইস নেম! বলে ঝিনুকের পাশে সোফায় বসল তোর্সা। বাইরের ড্রেস বদলে ফেলেছে।

ঝিনুক বলল, তোমার নামটাও খুব সুন্দর!

হাসল তোর্সা। ক্লাস সিক্সের তুলনায় মেয়েটি যথেষ্ট স্মার্ট। ঝিনুককে বলল, তুমি ডিটেকটিভের অ্যাসিস্ট্যান্ট ?

ভিতরে মায়ের থেকে জেনে এসেছে। ঝিনুক মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝাল।

তোর্সা বলল, ডিটেকটিভ গল্পে তোমার মতো ইয়াং অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকে। ভাবতাম, বানানো। এখন দেখছি সত্যি!

এর আর কী উত্তর দেবে ঝিনুক ! মুখটা হাসিহাসি করে রাখল। ফের তোর্সা বলল, তুমি সুইমিং, সাইকেলিং, হর্সরাইডিং, জুডো-ক্যারাটে জানো?

একেই বলে ছেলেমানুষ, হর্সরাইডিং মাথায় ঢুকে বসে আছে। ইনভেস্টিগেশনে যার এখন আর কোনও প্রয়োজন পড়ে না। ঝিনুক অবশ্য ঘাড় হেলিয়ে সবেতেই হ্যাঁ করে। খুশি হবে মেয়েটা।

তোর্সার জানা শেষ হয়নি। জিজ্ঞেস করল, মোটর বাইক চালাতে পারো? তারপর ফোর হুইলার? বন্দুক, মানে গান চালাতে জানো ?

এবারও ঝিনুক ঘাড় হেলিয়ে দেয়। মোটরবাইক চালাতে সে পারে। গাড়ি চালানো শিখছে আশুদার কাছে। বাবার গাড়ি চালায় আশুদা। বন্দুক কখনওই চালায়নি ঝিনুক ।

– জানো আঁখিদি, বাপিকে কবে থেকে বলছি, ড্রাইভিংটা শেখাতে, বাপি দারুণ গাড়ি চালায়…

কথা বলে যাচ্ছে মেয়েটা, ঝিনুকের চোখ চলে গিয়েছে দীপকাকুর দিকে, মোবাইলের স্ক্রিনে আঙুল চালাচ্ছেন। কাউকে ফোন করবেন। কিন্তু এতক্ষণ সময় লাগছে কেন নাম সার্চ করতে? ভুলে গেলেন নাকি যাকে ফোন করবেন তার নাম? ঝিনুক কি উঠে গিয়ে হেল্প করবে? ওদিকে সুপ্রিয়বাবু এখনও কথা বলে যাচ্ছেন ফোনে। তবে আগের থেকে অনেক শান্ত গলায়।

–তোমরা কি জানতে পারলে যে লোকটা আমাদের ড্রয়িং-এ মার্ডার হয়ে পড়েছিল, সে কে? তোর্সার প্রশ্ন ।

ঝিনুক ঘাড় না ফিরিয়ে উত্তর দিল, খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারব। মেসেজ টোন বেজে উঠল ঝিনুকের মোবাইলে। সেটটা জিনস-এর পকেট থেকে বার করে স্ক্রিনে চোখ রেখে ভীষণ অবাক হল ঝিনুক, দীপকাকু মেসেজ পাঠিয়েছেন। খানিক আগে তার মানে এস এম এস টাইপ করছিলেন। এত কম দূরত্বে এস এম এস করার দরকার পড়ল কেন? অন্য কাউকে পাঠাতে গিয়ে ঝিনুককে পাঠিয়ে ফেললেন না তো? না, ঝিনুকেই পাঠিয়েছেন। তোর্সাকে আড়াল করে এস এম এস ওপেন করেছে ঝিনুক। লেখা আছে, কথার ছলে জানতে চাও র‍্যাকে ঘণ্টার সংখ্যা কত ?

দীপকাকু, সুপ্রিয়বাবু এগিয়ে আসছেন, বসবেন সোফায়। ঝিনুক তোর্সাকে বলল, চলো, তোমাদের শো-পিসগুলো দেখি।

—চলো, বাপির তো হিউজ কালেকশন। আমাদের বাড়ি যারাই আসে, এগুলো দেখতেই থাকে! তুমি তো আগে একদিন এসেছিলে, দেখোনি?

ঝিনুক কোনও উত্তর দেয় না। তোর্সা নিজের থেকেই বলতে থাকে, সেদিন কী করে দেখবে। যা একটা মিসহ্যাপ হল। ওই নিয়েই বিজি ছিলে। আমিও মাকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। ঘর ছেড়ে বেরোইনি। নয়তো সেদিনই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত।

ক্যাবিনেটের সামনে চলে এসেছে দু’জন। ঝিনুক একটু সময় নিয়ে শো-পিসগুলো দেখছে। দীপকাকু কেন কাজটা দিলেন বুঝতে অসুবিধে হয়নি ঝিনুকের। উনি যদি সুপ্রিয়বাবুকে জিজ্ঞেস করতেন, আপনার কালেকশনে ক’টা ঘণ্টা আছে? এখন যা আছে, সেটাই বলতেন সুপ্রিয়বাবু। চুরি যাওয়া অথবা নিজের সরিয়ে রাখা ঘণ্টাটার কথা উনি প্রথম থেকেই গোপন করে যাচ্ছেন। এই গোপনীয় কাণ্ডকারখানা স্ত্রীকে জানালেও, নিজের ছোট্ট সন্তানটিকে নিশ্চয়ই বলতে যাবেন না। বলেও লাভ হবে না। ছোটরা গোপন কথাটা সবচেয়ে আগে প্রকাশ করে দেয়। তোর্সা নিশ্চয়ই জানে বাবার কালেকশনে ক’টা ঘণ্টা আছে। সংখ্যাটা সঠিক বলবে। তার থেকে যদি একটা কম থাকে র্যাকে, দীপকাকুর অনুমান মিলে যাবে। তদন্তের একটা পর্যায়ে গিয়ে দীপকাকু প্রয়োজন বুঝে সুপ্রিয়বাবুকে চার্জ করতে পারবেন এই বলে, কেন আপনি একটা ঘণ্টার কথা গোপন করে গেছেন? ঝিনুক কথার জাল বুনতে শুরু করে। ক্যাবিনেটের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে তোর্সার উদ্দেশে বলে, এখানে অনেক আর্ট-পিস দেখছি বাইরের দেশের। শুনলাম অফিস-ট্যুরে তোমার বাবাকে প্রায়ই দেশের বাইরে যেতে হয়, তখনই এগুলো কালেকশন করেন। তুমি কখনও গিয়েছ বাবার সঙ্গে বিদেশে?

—একবারই মাত্র গিয়েছি। সিঙ্গাপুর। আমি, বাপি আর মা । সেটা ফ্যামিলি ট্যুর। অফিসের কাজে গেলে বাবা ঘোরা বেড়ানোর সময়ই পায় না।

—আচ্ছা, এই যে গণেশের মূর্তিগুলো, এর কোনওটা নিশ্চয়ই বিদেশের নয়? ভারতেই তো ভগবান গণেশের খুব চল।

– না না, মালেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের গণেশের মূর্তি আছে এখানে। ট্যাগগুলো দেখো।

ঝিনুক ঝুঁকে পড়ে গণেশের র‍্যাকটা দেখতে থাকে। জিজ্ঞেস করে, ক’টা মূর্তি আছে?

– — থার্টিওয়ান। লাস্ট ওয়ান বাপি শ্রীলঙ্কা থেকে নিয়ে এসেছে ! এই যে এইটা। বলে একটা মূর্তির দিকে আঙুল দেখালো তোর্সা।

ঝিনুক সময় নষ্ট না করে উপরের র‍্যাকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ঘণ্টাগুলোও তো দেখছি নানান দেশের। টোটাল কালেকশন কত ?

— টোয়েন্টি ফাইভ।

হতাশ হল ঝিনুক। পঁচিশটাই আছে, ঝিনুক গুনেছে একটু আগেই। দীপকাকুর কৌশল কাজে লাগল না। তা হলে কি কোনও ঘণ্টা সরানো হয়নি এখান থেকে? তেমনটা হওয়ার কথা নয়। দীপকাকু যেভাবে নিশ্চিত হয়ে এগোচ্ছেন, ফটোতে দেখা বৌদ্ধমন্দিরের ঘণ্টা এখানে ছিলই। ঠিক ওরকম দেখতে ঘণ্টা একটাও দেখা যাচ্ছে না। যদি দেখা যেত, ধরে নেওয়া হত ঘণ্টাটা গোপনে বিক্রি করতে চেয়ে সুপ্রিয়বাবু বিজ্ঞাপন দাতার কাছে ফটো পাঠিয়েছেন। তখন তদন্তের বিষয় হত, জিনিসটা কেন তিনি গোপনে বিক্রি করতে চান? এখন দেখা যাচ্ছে ঘণ্টা এখান থেকে সরলেও, অঙ্কটা মিলিয়ে রেখেছেন সুপ্রিয়বাবু। কীভাবে মেলালেন ? ঝিনুক কালেকশনে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। দীপকাকুর গলা ভেসে আসে। সুপ্রিয়বাবুদের উদ্দেশে বলছেন, ঘটনার আগের দিন এই ফ্ল্যাটে যারা এসেছিলেন বললেন, তাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে ভাল হত।

—চারজনকে এখনই ডেকে দিতে পারি। রবিবার যেহেতু শিলাদ আর রুদ্র ফ্ল্যাটে আছেন নিশ্চয়ই! তারাশংকরদা রিটায়ারড পার্সন, রোজ ছুটি। আদিত্যকে সব সময় পাওয়া যাবে এই কমপ্লেক্সে। গোটা হাউজিং-এর দায়িত্ব তাঁর। বললেন সুপ্রিয়বাবু।

আবার দীপকাকুর গলা, আপনাদের কাজের মহিলাটির সঙ্গে প্রথমে কথা বলে নিতে পারলে সুবিধে হত আমার।

—তাকে তো এখন পাবেন না, দশটায় কাজ সেরে চলে গিয়েছে। এটা বললেন সোমাদেবী।

মায়ের গলা কানে গিয়েছে তোর্সারও। বলে ওঠে, পাওয়া যাবে মঙ্গলামাসিকে। পূজাদের ফ্ল্যাটে বারোটার সময় কাজ করতে দেখেছি। ওদের ফ্ল্যাটে ফোন করলেই জানতে পারবে।

সোমাদেবী সোফা থেকে উঠে ল্যান্ডফোনের দিকে এগোলেন। এঁদের ঘরের ফোন সেটটাও একটা অ্যান্টিক পিস।

কালেকশন দেখায় ক্ষান্ত দিয়ে ঝিনুক ফিরে আসছে সিটিং এরিয়ায়, সঙ্গে আসছে তোসাও। দীপকাকু সুপ্রিয়বাবুকে বলছেন, ফ্লাইট লেট করার কারণে চেন্নাই ট্যুর ক্যানসেল হল আপনার। তার আগের ট্রিপ কোথায় ছিল?

—মুম্বাই ।

তোর্সা শুধরে দিল, না বাপি, এন জে পি। বাগডোগরার ফ্লাইট ধরলে না?

— সেটা মুম্বাইয়ের আগে।

–হতেই পারে না। এনজেপি থেকে একটা দারুণ বেল এনে ছিলে। ভেঙে গেল সেটা, খুব আপসেট হয়ে গিয়েছিলে তুমি।

মুখ সাদা হয়ে গিয়েছে সুপ্রিয়বাবুর, দু’বার ঢোঁক গিললেন। কণ্ঠার নড়াচড়া দেখে বোঝা গেল। মনে পড়ার ভান করে, বললেন, ইয়েস, ঠিক বলেছিস। মুম্বাইয়ের পর এনজেপি। এত ট্যুর করি গুলিয়ে যায়।

—এনজেপি থেকে আনা ঘণ্টাটা কীভাবে ভাঙল? প্রশ্নটা সরাসরি তোর্সাকে করলেন দীপকাকু ।

তোর্সা বলল, আমি তখন ছিলাম না, মা-ও ছিল না। আমরা শপিং মল-এ গিয়েছিলাম।

ফোন সেরে ফিরে এলেন সোমাদেবী। সোফায় বসে বললেন, আসছে মঙ্গলাদি।

—ফাইন। বলে দীপকাকু সুপ্রিয়বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, ভেঙে যাওয়া ঘণ্টাটার টুকরোগুলো কি আছে?

–না, রেখে কী হবে? ফেলে দিয়েছি।

– সোমাদেবী, তোর্সা আসার আগেই?

—হ্যাঁ, কেন বলুন তো? ভাঙা টুকরোগুলো দেখে ওদের মন খারাপ হত বলেই ফেলে দিয়েছি।

দীপকাকু চুপ করে আছেন। ঝিনুক স্পষ্ট টের পাচ্ছে, অঙ্ক কী ভাবে মিলিয়েছেন সুপ্রিয়বাবু। দীপকাকু ফের জানতে চাইলেন, এন জে পি’র কোথা থেকে কিনে ছিলেন বেলটা? কেমন দেখতে ছিল? —শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট থেকে কিনে ছিলাম। দারুণ দেখতে ছিল।

—বুদ্ধিস্টদের ঘণ্টার মতো?

ফের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল সুপ্রিয়বাবুর। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি জানলেন কী করে ?

– – আন্দাজ করা খুবই সহজ। উত্তরবঙ্গে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব আছে। বৌদ্ধদের জপযন্ত্র, ঘণ্টা আরও অনেক কিছুর রেপ্লিকা পাওয়া যায় হংকং মার্কেটে।

ডোরবেল বেজে উঠল। সোমাদেবী বললেন, মঙ্গলাদি এল।

ছুটে গিয়ে দরজা খুলল তোর্সা। বছর পঁয়তাল্লিশের মহিলাটির পরনে অনুজ্জ্বল শাড়ি, চেহারায় পরিশ্রমের ছাপ। ঘরে ঢুকে সোমাদেবীকে বলল, হ্যাঁ বউদি, কী বলছ, বলো ?

চোখের ইশারায় দীপকাকুকে দেখিয়ে সোমাদেবী বললেন, থানা থেকে ওঁকে পাঠিয়েছে। তোমার সঙ্গে কথা বলবেন।

মুহূর্তের মধ্যে মহিলার চেহারায় একটা জড়সড় ভাব এসে গেল। থানা-পুলিশ শুনলে সাধারণ মানুষের যা হয়। পিঠের আঁচল এক হাতে টেনে দীপকাকুর উদ্দেশে আলতো করে নমস্কার সারল। দীপকাকু বললেন, তোমার পুরো নাম, কোথায় থাকো, বাড়িতে কে কে আছে, কী করে তারা? এক এক করে বলে যাও।

-মঙ্গলা দাস। বালিগঞ্জের স্টেশন ধারের কলোনিতে থাকি। বাড়িতে আমি, এক ছেলে, এক মেয়ে, আর ওদের বাবা। ছেলে অটো চালায়, মেয়ে আমার মতোই লোকের বাড়ি কাজ করে। ওদের বাবা রং মিস্ত্রি।

মেয়ের বিয়ের চেষ্টা চালাচ্ছ তো?

—হ্যাঁ, দেখাশোনা চলছে। পাত্রপক্ষ আসছে অনেক। কিন্তু সকলের যা খাঁই! আমরা গরিব মানুষ, এত টাকা জোগাব কোথা থেকে?

-ক’টা বাড়িতে কাজ করো তুমি?

— আটটা।

–তার মানে তো অনেক! সব বাড়িতেই তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হয়। এ বাড়িতে ব্যালকনিটা ঝাড়া পৌঁছা করো রোজ?

দীপকাকু হঠাৎ পরের বাড়ির কাজের লোকের ফাঁকি ধরতে বসলেন কেন বুঝতে পারছে না ঝিনুক। মঙ্গলাদি বলল, পেটের দায়ে এত বাড়ি কাজ করি। ফাঁকি কোথাও দিই না। এ বাড়ির বউদিকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন ।

-এ বাড়িতে যে বাজে ঘটনাটা ঘটেছে, জানো নিশ্চয়ই। তার আগের দিন ব্যালকনি ঝাড়পোঁছের পর দরজাটা ভাল করে বন্ধ করেছিলে?

—করেছিলাম।

—দরজার দু’পাশের জানলা খুলে পরিষ্কার করেছিলে তো?

চট করে ঘাড় কাত করল কাজের মহিলাটি। সোমাদেবী বলে উঠলেন, ওমনি ঘাড় নেড়ে দিলে! শীতকালে জানলা দু’টো তুমি খোলোই না। ধুলো জমে গেলে আমাকেই খুলে ঝেড়ে নিতে হয়।

ঘরোয়া কাজিয়া সামাল দিতে সুপ্রিয়বাবু বলে উঠলেন, আসলে ওদিকটা তো নর্থ। শীতকালে জানলা দু’টো খোলাই হয় না। দরজাটাও বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। ভালই ঠান্ডা আসে ওদিক থেকে। উপরের দিকে ফ্ল্যাট তো আমাদের।

এতক্ষণে ঝিনুকের কাছে ক্লিয়ার হয়েছে দীপকাকু আসলে কী জানতে চাইছেন। অপরাধীর ঢোকার রাস্তায় কোনও ফাঁকফোকর ছিল কিনা, বুঝে নিচ্ছেন সেটাই।

-তোমার মোবাইল নাম্বারটা বলো তো। পরে কথা বলার দরকার পড়তে পারে। মঙ্গলাদিকে বললেন দীপকাকু।

কাজের মহিলা বলল, আমার তো মোবাইল ফোন নেই। ছেলের নাম্বারটা দেব? যে সব বাড়িতে কাজ করি, কোনও খবর দেওয়ার থাকলে ছেলেকেই জানিয়ে দেয়।

– দ্যাখো, মিথ্যে কথা বলো না। ফোন তোমার আছে। এটা থানা-পুলিশের ব্যাপার। পরে ধরা পড়লে বিরাট মুশকিলে পড়ে যাবে।

দীপকাকুর দেখানো ভয়ে কাজ হল। মঙ্গলাদি গড়গড় করে বলে গেল নাম্বার। সোমাদেবীর চোখ বড় বড়। দীপকাকু মোবাইলে নাম্বারটা সেভ করে মঙ্গলাদিকে বললেন, ঠিক আছে, এবার তুমি আসতে পারো।

মঙ্গলাদি চৌকাঠ পেরোতেই, দীপকাকুর দিকে তাকিয়ে সোমাদেবী রাগের চেয়েও বেশি বিস্ময়ে বলে উঠলেন, দেখেছেন, কত বড় মিথ্যেবাদী। আমি ওকে একটা ফোন দিতে চেয়েছিলাম, তখন বলেছিল মুখ্যু মানুষ, ফোন চালাতেই পারব না ।

দীপকাকু হেসে ফেলে বললেন, কাজের বাড়ি থেকে যখন তখন ডাক আসা আটকাতে আর নিজের হঠাৎ ডুব মারার কারণ লুকোতে নাম্বারটা দেয়নি। ছেলেকে ফোন করলে দায়সারা উত্তর দেবে। ও নিজে সেটা পারবে না। যে যে বাড়িতে কাজ করে, একটা পারিবারিক বন্ধন তৈরি হয়ে যায় যে। আমি অবশ্য আন্দাজেই ঢিল ছুঁড়ে ছিলাম, লেগে গিয়েছে।

–ওর ফোন নাম্বারটা কেন নিলেন জানতে পারি? বললেন, সুপ্রিয়বাবু।

মাথা নেড়ে দীপকাকু বললেন, ইনভেস্টিগেশন চলাকালীন বলা যাবে না।

নিশ্চয়ই আহত হলেন সুপ্রিয়বাবু। সেটা প্রকাশ না করে চলে অন্য প্রসঙ্গে। বললেন, আর চারজনকে তাহলে ডেকে নিই?

গেলেন – না, আমি তাঁদের ফ্ল্যাটে গিয়ে কথা বলব। কথা বলার সঙ্গে তাঁদের বাসস্থানের ওপরেও চোখ বোলাতে চাই। আপনি আমাকে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে ওদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাবেন। এমন কিছু প্রশ্ন ওদের আমি করব, যা আপনার সামনে করা যাবে না ।

—ওকে। নো প্রবলেম। চলুন তা হলে। সোফা ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন সুপ্রিয় পাল ।

দীপকাকু হাতের ইশারায় বসতে নির্দেশ করে বললেন, একটা ব্যাপার জিজ্ঞেস করব করব ভেবেও ভুল যাচ্ছি, আচ্ছা, সে রাতে গুলির আওয়াজের পর এই আবাসনের কে কে এসেছিল আপনার ফ্ল্যাটে? প্রথম যে এসেছিল, তার থেকে শুরু করবেন।

—এই রে, এটা তো আমার পক্ষে বলা মুশকিল। তখন যা মনের অবস্থা, একবার ছেলেটাকে দেখছি। পরের বার সোমাকে। অনেকেই তখন আমার আশেপাশে। কে কখন এসেছে, খেয়ালই করিনি।

সুপ্রিয়বাবু থামতেই তোর্সা বলে উঠল, প্রথমে এসেছিলেন তারা জেঠু আর জেঠিমা। তারপর আদিত্য আঙ্কল, শিলাদ আঙ্কল আর আন্টি। শিবাজী জেঠু এলেন তার খানিক পরে। সুজন জেঠুও এসেছিলেন। তারপর আরও অনেকে এসে পড়ল।

—রুদ্রবাবু? তোমার বাবার বন্ধু। তোর্সার কাছে জানতে চাইলেন দীপকাকু।

তোর্সা বলল, এসেছিলেন হয়তো পরে, খেয়াল করিনি। মাকে ততক্ষণে বেডরুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি মায়ের সঙ্গে ছিলাম। —রুদ্র ছিলেন কিনা, আপনিও মনে করতে পারছেন না? সুপ্রিয়বাবুকে প্রশ্নটা করলেন দীপকাকু।

সুপ্রিয়বাবু বললেন, রাতে রুদ্র এসেছিল কিনা, বলতে পারব না। পরের দিন ফ্ল্যাটে ইনভেস্টিগেট করার পর পুলিশ যখন থানায় নিয়ে গেল আমায়, রুদ্রও গিয়েছিল, সঙ্গে তারাশংকরদা। শিলাদ আদিত্য ছাড়াও আরও কয়েকজন ছিল।

—ঠিক আছে। চলুন এবার। তারাশংকরবাবুর ফ্ল্যাট থেকে শুরু করা যাক। বলে সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন দীপকাকু। দেখাদেখি উঠলেন সুপ্রিয়বাবু, ঝিনুক ।

ঝিনুক ভেবেছিল সাক্ষাৎকার পর্বটা বেশ দীর্ঘ হবে। চার ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন দীপকাকু। তা কিন্তু হয়নি। চারজনকে চারটে করে প্রশ্ন করেছেন দীপকাকু। একই প্রশ্ন। ঝিনুকের মনে হয়েছে প্রশ্নগুলো যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বোধহয় দীপকাকুর বেশি দরকার ছিল ওঁদের ফ্ল্যাটের ভিতরটা দেখার। কথা বলতে বলতে চারপাশে চোখ বোলাচ্ছিলেন। নিশ্চয়ই ব্লু খুঁজছিলেন এই কেসের। কিছু পেলেন কিনা, এখনই জানা যাবে না। পরে বলবেন। পাশের ফ্ল্যাটের তারাশংকরবাবুর সঙ্গে দীপকাকুর ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিয়ে সুপ্রিয়বাবু বলেছিলেন, আমি বাকি তিনজনকে জানিয়ে আসি, আপনি আসছেন। তারা যদি কাছাকাছির মধ্যে বাইরে কোথাও গিয়ে থাকে, ফোন করে ডেকে নেব।

তারাশংকরবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা সারার পর ঝিনুকরা বাইরে এসে দেখেছিল, সুপ্রিয়বাবু তাদের নিতে চলে এসেছেন। এরপর যাওয়া হয়েছিল সুপ্রিয়বাবুদের ঠিক উপরে শিলাদ রায়চৌধুরীর ফ্ল্যাটে। তারপর রুদ্রপ্রতাপ সেন, সুপ্রিয়বাবুর ফ্ল্যাটের নীচের তলার বাঁ দিকে। কেয়ারটেকার আদিত্য মজুমদার থাকেন কোয়ার্টারে, সিকিউরিটি রুম থেকে খানিকটা দূরে বাউন্ডারি ওয়ালের ধার ঘেঁষে। ওটাকে কোয়ার্টার না বলে অফিস ঘর আর কিছুটা স্টোররুম বলা ভাল। চতুর্দিকে ছড়ানো বিল বই, হিসেবের খাতা। বাথরুম আর ইলেট্রিকের নানান ফিটিংস। একা থাকেন। বয়সে বাকি তিনজনের চেয়ে অনেকটাই ছোট, চেহারায় বেশ একটা করিৎকর্মা ভাব। আদিত্যবাবুর কোয়ার্টারে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়েছেন সুপ্রিয়বাবু। ঝিনুকরা এখন সেখান থেকে বেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গেটের দিকে। ওখানে দীপকাকুর বাইক।

দীপকাকু চারজনকে যে প্রশ্নগুলো করেছেন, তা এই রকম, এক, খুন হয়ে পড়ে থাকা ছেলেটি কীভাবে ঢুকেছিল ঘরে, আমরা যেমন ভাবছি, আপনিও নিশ্চয়ই কিছু একটা ভাবছেন, কোনও রাস্তা দেখতে পেয়েছেন কি? উত্তরে চারজনই বলেছেন, পাননি। দ্বিতীয় প্রশ্ন, ছেলেটি কী কারণে ঢুকেছিল বলে মনে হয়? তিনজনের উত্তর ছিল, জানি না। একমাত্র আদিত্যবাবু বলেছেন, আমার তো মনে হয় চুরি করতে। তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, সুপ্রিয়বাবুর কালেকশনে বিশাল দামি কিছু আছে বলে কি মনে হয় আপনার? তারাশংকরবাবু আর শিলাদ রায়চৌধুরীর বক্তব্য, তেমন দামি কিছু নেই। সুপ্রিয় অবশ্য নিজের কালেকশনের সব কিছুকেই রেয়ার মনে করেন। মানে, ভেবে আনন্দ পান। রুদ্রবাবুর বললেন সম্পূর্ণ বিপরীত, কালেকশন দামি হয়ে উঠছে বলেই তো প্রায় সব পাল্লায় লক লাগাচ্ছে। আদিত্যবাবুর বক্তব্য আবার অন্যরকম। বলেছেন, বাইরের ক্যাবিনেটের লকগুলো লোক দেখানো। আইওয়াশ। দামি কালেকশন যদি কিছু থাকে, আছে ঘরের আলমারিতে। সেখান থেকে নজর ঘোরাতেই ক্যাবিনেটে লক-এর ব্যবস্থা। কাচের পাল্লায় তালা লাগানোর কী দরকার বলুন তো! চোর কাচ ভেঙেই চুরি করে নেবে। পয়েন্টটা যথেষ্ট ভ্যালিড মনে হয়েছে ঝিনুকের। শেষ প্রশ্নটা ছিল সবচেয়ে চমকপ্রদ, সুপ্রিয়বাবুর সংগ্রহে কোনও অ্যান্টিক পিস্তল কখনও কি দেখেছেন আপনারা? এক্ষেত্রে চারজনই বলেছেন, দেখেননি। ফ্ল্যাট থেকে বেরনোর সময় প্রত্যেকের ফোন নাম্বার নিয়েছেন দীপকাকু। মোটরবাইকের কাছে এসে পড়ল ঝিনুকরা। দীপকাকু বললেন, লাঞ্চ টাইম তো পেরিয়ে গেল। ভীষণ খিদে পেয়ে গিয়েছে। তোমার পায়নি?…উত্তরের অপেক্ষা না করে ফের বললেন, চলো, কাছেই একটা ভাল রেস্টুরেন্ট আছে। জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করি, মাথা ভাল কাজ করবে।

বাইকের হ্যান্ডেলে ঝোলানো হেলমেট দুটো নিতে গিয়ে থমকে গেলেন দীপকাকু। স্পিড মিটারের উপর থেকে তুলে নিলেন একটা চিরকুট। পড়ে নিয়ে ঝিনুকের দিকে বাড়িয়ে দিলেন কাগজটা। বললেন, এই নাও সার্টিফিকেট। আমাদের কাজের প্রাথমিক স্বীকৃতি। চিরকুটটা নিল ঝিনুক।

কম্পিউটারে বাংলা অক্ষরে লেখা, কেসটা খুনের। আপনারও খুন হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। সাবধান।