রহস্যে অতীতের ধ্বনি – ১

।।এক।।

দীপকাকুর সঙ্গে মোটরবাইকে করে ঝিনুক চলেছে কসবার দিকে। শীতের সকাল। ন’টা মতো বাজে। রাস্তায় ব্যস্ত ট্রাফিক। সকলের অফিস যাওয়ার তাড়া। সাড়ে সাতটা নাগাদ দীপকাকুর কল এসেছিল ঝিনুকের মোবাইলে। সে তখন রোজকার মতো পাড়ার জিম-এ ওয়ার্ক আউট করছে। দীপকাকু বললেন, জলদি রেডি হয়ে নাও। আধ ঘণ্টার ভিতর তোমাদের বাড়ি পৌঁছচ্ছি। পিকিউলিয়ার একটা খুনের ঘটনা ঘটেছে। দেখতে যাব একসঙ্গে।

ঝিনুক জিম-এ আর সময় নষ্ট করেনি। প্রায় দৌড়ে চলে এসেছিল বাড়িতে। অনেকদিন পর খুনের কেসে দীপকাকুকে অ্যাসিস্ট করতে চলেছে। সদ্য কলেজে পা রাখা ঝিনুককে খুনের মতো বীভৎসতার সামনে আনতে চান না দীপকাকু, তার উপর সে আবার মেয়ে। এতদিনে দীপকাকু বোধহয় মনে করছেন ঝিনুক এখন যথেষ্ট ম্যাচিওর্ড, এই ধরনের কেসে সঙ্গে রাখাই যায়।

আশা কিন্তু আজও পূরণ হল না। দীপকাকু বাড়িতে এসে জলখাবার খেতে খেতে জানালেন খুনের পিকিউলিয়ারিটির জন্যই তিনি অকুস্থলে যাচ্ছেন। তদন্ত করতে তাঁকে ডাকা হয়নি। দীপকাকুর বন্ধু রঞ্জনকাকু। যিনি লালবাজার কন্ট্রোলে আছেন। সকালে দীপকাকুকে ফোন করে জানান কসবার এক কমপ্লেক্সের চ তলায় আশ্চর্যজনক খুনের ঘটনা ঘটেছে। ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে এমন একজন খুন হয়ে পড়ে আছে যাকে ফ্ল্যাট-মালিক কোনও দিনও দেখেননি নিহত ব্যক্তির থেকে পাওয়া যায়নি কোনও আইডেন্টিটি কঙ্ক লোকাল থানার পুলিশ ইনভেস্টিগেশনে গিয়েছে। রঞ্জনকাকুর ইচ্ছে দীপকাকুও যেন একবার ঘটনাস্থল প্রত্যক্ষ করে আসেন, মনের খোরাক পাবেন। দীপকাকু যাচ্ছেন, ইনভেস্টিগেটিং অফিসারকে বলে রেখেছেন রঞ্জনকাকু।

মানে যা দাঁড়াল, দীপকাকু শুধু দর্শক। ব্যাপারটা বাবার পছন্দ হয়নি। বলেছিলেন, তুমি একজন প্রফেশনাল ডিটেকটিভ, তদন্ত ভার ছাড়া তোমার ওখানে যাওয়া ঠিক দেখায় না। দর কমে যাবে। দীপকাকুর বক্তব্য ছিল, রহস্যটার টানেই উনি ওখানে যাচ্ছেন শুধু রহস্য বললে খাটো করা হবে। এ হচ্ছে মহারহস্য। সামনে থেকে দেখার লোভ সামলাতে পারছেন না।

কসবা অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে ঝিনুকরা। ইস্টার্ন বাইপাসের কাছাকাছি এসে বাঁ হাতি রাস্তা ধরতেই ঝাঁ চকচকে কমপ্লেক্সের বিশাল গেট। মাথার উপর লেখা ‘আকৃতি প্লাজা’। গেটের কাছে একজন পুলিশ, দু’জন সিকিউরিটি গার্ড। পিছনে সিকিউরিটির রুমটা বেশ বড় রীতিমতো ফার্নিশড। কম্পিউটার, ফোন দীপকাকু গার্ডেদের সামনে বাইক থামিয়ে জানতে চাইলেন, কোন বিল্ডিং-এ ঘটেছে ঘটনাটা কমপ্লেক্সে ছ’টা বহুতল। থমথমে মুখে একটার দিকে আঙুল তুলল একজন গার্ড। বাইকের স্টার্ট চালুই ছিল, গতি বাড়িয়ে এগিয়ে চললেন দীপকাকু।

কমপ্লেক্সের বিল্ডিংগুলো দশতলার। নির্দিষ্ট বহুতলের লিফটে চেপে ছ’তলায় এসে দেখা গেল চারটে ফ্ল্যাট। একটার দরজায় থিকথিকে ভিড়। সবাই প্রাণপণ উঁকিঝুঁকি মারছে। বোঝাই যাচ্ছে পুলিশ এদের ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। দীপকাকু কর্তৃত্বব্যঞ্জক এবং গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, সরুন। সরে দাঁড়ান। ভিতরে যেতে দিন।

সঙ্গে সঙ্গে ভিড় দু’ভাগ হয়ে গেল। প্রয়োজনে ছোটখাটো চেহারাতেই দীপকাকু অনায়াসে এমন ব্যক্তিত্ব এনে ফেলেন যে, বাঘা বাঘা লোক পর্যন্ত থতমত খেয়ে যায়।

দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন এক কনস্টেবল। দীপকাকু তাকে বললেন, অফিসারকে বলুন দীপঙ্কর বাগচী এসেছেন। লালবাজারের রঞ্জন…।

বাকিটা বলতে হল না, ভিতর থেকে সম্ভবত ইনভেস্টিগেটিং অফিসার বলে উঠলেন, রেফারেন্স দিতে হবে না। আপনাকে আমরা চিনি। আপনার কাজকর্ম নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়।

পথ ছেড়ে দিলেন কনস্টেবল। ঘরটা, মানে ড্রয়িং রুম বিশাল বড়! এতজন পুলিশের উপস্থিতিতেও বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অফিসার দীপকাকুর দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, সুঠাম চেহারা। বয়স আন্দাজ বত্রিশ-চৌত্রিশ। দীপকাকুর থেকে খানিক ছোটই হবেন। ঝিনুকের এবার চোখ গেল মেঝের দিকে, ভীষণ চমকে উঠল। মেঝেতে চিৎ অবস্থায় একটা বডি। বুক ফুটো হয়ে বেরনো রক্তের দাগ। তবু ভাল মৃতদেহের মুখ উলটো দিকে ফেরানো। চোখ সরিয়ে নিল ঝিনুক। এ ঘরে ঝিনুকদের বাদ দিলে একজনই শুধু পুলিশের উর্দি ছাড়া, ড্রয়িংরুমের শেষপ্রান্তে মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছেন। চেহারায় বিধ্বস্ত ভাব। সম্ভবত ইনি ফ্ল্যাটটার মালিক, বয়স চল্লিশের ওপরই হবে। দীপকাকু আর অফিসারের মধ্যে কেস নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছে। একটা অংশও মিস করা চলবে না। ঝিনুক এগিয়ে গিয়ে দীপকাকুর পাশে দাঁড়াল। দীপকাকু জানতে চাইছেন। খুনটা কী কী কারণে বিস্ময়কর মনে হচ্ছে আপনার?

অফিসার বলতে থাকলেন, এক নম্বর, মৃত ছেলেটির থেকে আমরা পার্স বা মোবাইল কিচ্ছু পাইনি। ফলে পরিচয় জানা যাচ্ছে না। ফ্ল্যাটের লোকজনও চিনতে পারছে না একে। অবশ্য তারা যদি আমাদের সত্যি বলে থাকে।

একথার পরই ঝিনুকের চোখ যায় সোফায় বসে থাকা ভদ্রলোকের দিকে, অসহায় দৃষ্টিসহ মুখটা একবার তুলে অফিসারকে দেখে, ফের নামিয়ে নিলেন। ঝিনুকের অনুমান তার মানে সঠিক, ইনি ফ্ল্যাটের কর্তা অথবা কর্তাস্থানীয়। অফিসার তাঁর কথা বিশ্বাস করেননি বলে হতাশ হলেন। ফের পুলিশ অফিসারের কথায় মন দেয় ঝিনুক। উনি বলে যাচ্ছেন, সেকেন্ড থিং হল, ছেলেটা এখানে কীভাবে এল, যে একে গুলি করেছে সেইবা কোন উপায় ঢুকল ফ্ল্যাটে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে এই ফ্ল্যাটের কেউ যদি খুন করে থাকে, আলাদা কথা; তার প্রমাণ অবশ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

ঝিনুক লক্ষ্য করল এবার আর ফ্ল্যাটের বাসিন্দাটি মুখ তুললেন না। পুলিশের থেকে সহানুভূতির আশা ছেড়ে দিয়েছেন। দীপকাকু অফিসারের কাছে জানতে চাইলেন, বডিটা এখানে কীভাবে এল মানে? দরজা-জানলা সব বন্ধ ছিল?

-সব বন্ধ। এমনকি ওদিকের গ্রিলও কাটা হয়নি। বলে অফিসার যে দিকে তাকালেন, সেখানে কাচের স্লাইডিং দরজা, বাইরের বারান্দাটা পুরো গ্রিল দিয়ে ঘেরা। কাচের দরজার সামনের পর্দাটা এক ধারে সরিয়ে রাখা। দীপকাকু বলে উঠলেন, বডিটা এখানে কী করে এল সে না হয় পরে দেখা যাবে। গুলিটা এ ঘরেই করা হয়েছে, তার কি কোনও প্রমাণ আছে? মৃত্যুর পর এখানে এনে ফেলা হয়নি তো?

– খুন এ ঘরেই করা হয়েছে। ফায়ার করা বুলেটের খোল এখানেই পেয়েছি আমরা। বলে বাঁ দিকের দেওয়ালের কাছাকাছি ফ্লোরের ওপর সাদা চকের গোল দাগ দেখালেন অফিসার। ফের বললেন, আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোক জানিয়েছে ফায়ারিং-এর আওয়াজ পেয়েছে। এ ফ্ল্যাটে যারা ছিল তারা তো পেয়েইছে। বলছে ফায়ারিং হয়েছে এই ঘরেই।

দীপকাকু চুপ করে রইলেন। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, সবটাই সাজানো হতে পারে। বডিটা এখানে এনে ফেলল, স্লাইডিং দরজাটা ঠেলে সরিয়ে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করল বাইরে। বুলেটের খোলটা পড়ে থাকতে দিল ঘরে।

—এরকম করার কারণ? প্রশ্নটা না করে পারল না ঝিনুক। দীপকাকু বললেন, খুনের দায়টা এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের ঘাড়ে ফেলা যাবে।

—সম্ভাবনাটা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সহমত প্রকাশ করে অফিসার নতুন সূত্র যোগ করলেন, ফায়ারের পর বুলেটের খোল যে ওখানেই পড়ে ছিল, তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। আমাদের আসার আগে এখানে প্রচুর লোকজন জমা হয়ে গিয়েছিল। কারুর পায়ে লেগে বুলেটের খোল ওখানে চলে যেতে পারে।

-লোকজন ঢুকে পড়ার কারণে আপনারা মৃতের এবং খুনির ফুটপ্রিন্ট পাননি, বডিটা বাইরে থেকে টেনে এনে এখানে ফেলা হয়েছে কিনা, তারও কোনও প্রমাণ পাচ্ছেন না।

দীপকাকুর কথার পিঠে অফিসার বললেন, এগ্‌জ্যাক্টলি। কিন্তু তার আগে তো আমায় বুঝতে হবে বড়িটা এখানে ঢুকল কী ভাবে? প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে দীপকাকু বললেন, কার্তুজের খোলটা একবার দেখতে পারি?

– ওহ, সিওর। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের জন্য রেখে দিয়েছি। ওঁরা আর কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বেন। বলার পর অফিসার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলকে ইশারায় বুলেটের খোলটা আনতে বললেন।

ট্রান্সপারেন্ট ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেটে রাখা খোলটা নিয়ে এসে অফিসারের হাতে দিল কনস্টেবল। উনি সেটা দীপকাকুকে দিলেন। প্লাস্টিক প্যাকেটটা তুলে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে দীপকাকু বললেন, নাইন এম এম বুলেট। তার মানে পিস্তল। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ফায়ার করা হয়েছে, না কি দূর থেকে, বডিতে ইনজুরি দেখে কী বুঝলেন? গুলি পিঠে করা হয়েছে, সেটা বুকের স্পট দেখে বোঝা যাচ্ছে।

—ঠিক ধরেছেন, পিঠেই গুলি করা হয়েছে। তবে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক থেকে নয়, গোল পোড়া মতো দাগ থাকত। কতটা দূর থেকে ফায়ার করা হয়েছে, ফরেনসিক এক্সপার্টরাই ভাল বলতে পারবেন। বললেন অফিসার।

বুলেটের খোল রাখা প্লাস্টিক প্যাকেট কনস্টেবলের হাতে দিয়ে দীপকাকু চিৎ হয়ে থাকা মৃতদেহর দিকে এগোলেন। ঝিনুকও অনুসরণ করল। মুখ যে পাশে ফেরানো, সেখানেই উবু হয়ে বসলেন দীপকাকু। ঝিনুকের এখন আর ততটা অস্বস্তি হচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে ফেলার ফলে নার্ভাসনেস মোটামুটি উধাও হয়েছে। মৃত ছেলেটির বয়স চব্বিশের বেশি হবে না। মঙ্গোলিয়ান মুখ। মাথার চুল খুব ছোট করে কাটা। চোখ বোজা। শান্তিতে ঘুমোচ্ছে যেন!

ছেলেটার আপাদমস্তক জরিপ করছেন দীপকাকু। বলে উঠলেন, আচ্ছা, মিস্টার রায়, ছেলেটার প্যান্ট-জামার স্টিকার দেখে বোঝা যাচ্ছে না কোন অঞ্চলের?

‘মিস্টার রায়’ সম্বোধনটা অফিসারের উদ্দেশে। পুরো নাম তাপস রায়। ওঁর বুক পকেটের ওপরে কালো নেমপ্লেটে লেখা আছে নামটা। দীপকাকুর প্রশ্নের উত্তরে অফিসার বললেন, আজকালকার দিনে বেশিরভাগ লোক ব্র্যান্ডেড ড্রেস পরে, এর শার্ট ট্রাউজার্সও তাই। কলকাতায় কেনা, না গুয়াহাটিতে বোঝার কোনও উপায় নেই। উবু হয়ে বসা অবস্থায় দীপকাকু মুখ তুললেন অফিসারের দিকে।

বললেন, ছেলেটার চেহারায় নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ার ছাপ আছে, গুয়াহাটি সেই কারণেই বললেন, তাই না?

মাথা ওপর-নীচ করে সম্মতি জানালেন অফিসার। দীপকাকু ফের মন দিয়ে মৃতদেহটা পর্যবেক্ষণ করছেন। প্যান্টের পকেট থেকে বার করলেন ম্যাগনিফায়িং গ্লাস। ওঁর জামা প্যান্টের ভিতর আরও অনেক কিছুই আছে, যা ইনভেস্টিগেশনের প্রাথমিক পর্যায়ে কাজে লাগে। হাইপাওয়ারের চশমার সামনে আতস কাচ রেখে মৃতদেহের ওপর ঝুঁকে পড়েছেন দীপকাকু, ছেলেটার মুখ, বুকে গুলির ক্ষত, জামার কলার, কোমরের বেল্ট… সবই দেখছেন ঘাড় কাত করে, শরীর বেঁকিয়ে। বড়ি ছুঁচ্ছেন না। নিয়ম নেই। ফরেনসিক টিমের কাজ ব্যাহত হবে। ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়া থাকে। প্রথমে এসে তাঁকেই তো দেখতে হয়, দেহে প্রাণ আছে কি না? বড়ি নাড়াচাড়াও করতে হয়। এক্ষেত্রে যেমন তাপস রায়কে মৃতদেহটিকে পাশ ফিরিয়ে পিঠের ক্ষতটা দেখতে হয়েছে। শার্ট আর ট্রাউজার্সের স্টিকার দেখেছেন। ব্যস, এর বেশি না। বাকিটা ফরেনসিক গ্রুপের এক্তিয়ার।

উঠে দাঁড়ালেন দীপকাকু। মৃতদেহের ওপর চোখ রেখে খানিক ধন্দের গলায় বললেন, মিস্টার রায়, একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছেন? ছেলেটার হাতে রাবারের গ্লাভস, পায়ে মোজা। কিন্তু জুতো নেই। কেন?

-এতে আশ্চর্যের কী আছে! হাত-পায়ের ছাপ লুকনোর জন্য ওগুলো পরেছে। বললেন অফিসার। দীপকাকু বললেন, জুতো পরে থাকলেও তো ফুট প্রিন্ট পাওয়া যেত না। জুতোটা তা হলে খুলে রাখল কেন?

উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না অফিসার। অপ্রতিভ হয়ে দীপকাকুর দিকে চেয়ে আছেন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দীপকাকু বললেন, কারণ তো একটা থাকবেই। খুঁজে বার করতে হবে।

দু’পা এগিয়ে এসে দীপকাকু অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন, বডিটা প্রথমে কে দেখে, তার পর কী কী হয়, আমাকে একটু বলতে পারবেন?

—বডি প্রথমে দেখেন এই ফ্ল্যাটের কর্ত্রী। এমনই সেটব্যাক হয়েছে তাঁর, কথা বলার অবস্থায় নেই। ওঁর হাজবেন্ড, মানে ফ্ল্যাট মালিকের সঙ্গে কথা বলে আপনি গোটা ঘটনাটা জেনে নিতে পারবেন। বলে অফিসার সোফায় বসা বিধ্বস্ত মানুষটিকে নির্দেশ করলেন।

অফিসারের কথা কানে গিয়েছে ফ্ল্যাট-কর্তার, সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। দীপকাকু ইশারায় ওঁকে বসতে বলে এগিয়ে গেলেন। ঝিনুকও এগোল। ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে বসলেন দীপকাকু। জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম কী? বাই প্রফেশন কী করেন?

— সুপ্রিয় পাল। মার্কসম্যান কোম্পানির কলকাতার অফিসে আছি। চিফ ইঞ্জিনিয়ার। নিচু এবং ক্লান্ত স্বরে কথাগুলো বললেন ফ্ল্যাট মালিক। ঝিনুক সোফায় বসেনি। সিটিং এরিয়ার কার্পেটের ওপর দাঁড়িয়ে নোট বুক, পেন বার করেছে। দু’জনের কথোপকথন থেকে দরকারি পয়েন্টগুলো লিখে নেবে। প্রত্যেক কেসে তদন্ত চলাকালীন নোট রাখতে দীপকাকুই বলে রেখেছেন। ছোটখাটো তথ্য ভুলে গিয়ে অনেক সময় গোল পাকিয়ে ফেলেন। তখন ঝিনুকের থেকে জেনে নেন। পয়েন্ট নোট করা থাকলে ঝিনুকেরও কেস নিয়ে ভাবতে সুবিধে হয়। ফ্ল্যাট-মালিকের উদ্দেশে দীপকাকু বললেন, ঘটনাটা গোড়া থেকে বলুন দেখি। কখন টের পেলেন আপনার ফ্ল্যাটে বডিটা পড়ে আছে। একেবারেই অজ্ঞাত পরিচয়। যাকে আপনি জীবনে প্রথম দেখছেন। তাই তো?

চশমার ওপর দিয়ে দীপকাকুর মুখটা একবার দেখে নিয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়লেন সুপ্রিয় পাল। ফ্লোর-কার্পেটের ওপর চোখ রেখে বলতে শুরু করলেন, অফিসের কাজে কাল আমার চেন্নাই যাওয়ার কথা ছিল। রাত একটায় ফ্লাইট। ডিনার সেরে দশটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোলাম। অন্তত ঘণ্টা দুয়েক আগে রিপোর্টিং করতে হবে এয়ারপোর্টে। বোর্ডিং পাস নেওয়া হয়ে গেছে, প্লেন ছাড়তে তখন চল্লিশ মিনিট বাকি। জানিয়ে দেওয়া হল বিশেষ কারণে ফ্লাইট ক্যানসেলড্। সকাল ছ’টার ফ্লাইটে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। কিন্তু তাতে আমার কোনও কাজ হবে না। চেন্নাইয়ে অফিসের মিটিং সিডিউলড় সকাল নটায়। বাড়ি ফিরে আসব বলেই স্থির করলাম।

– এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে ফোন করে জানালেন, ফিরে আসছেন। নিশ্চিত হয়ে বললেন দীপকাকু।

সুপ্রিয়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, না, জানাইনি। আমার স্ত্রী, মেয়ে ততক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাবলাম, দু’বার করে ঘুম ভাঙিয়ে কী লাভ! আমি ফিরে এলে ওদের ঘুম ভাঙবেই। ফ্ল্যাটে এসে ডোরবেল টিপেছি, হয়তো তিরিশ সেকেন্ডের মতো। ঘরের ভিতর থেকে গুলির আওয়াজ। প্রথমে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না, ভাবছি ঠিক শুনলাম কি? তার পরই আমার স্ত্রীর প্রচণ্ড ভয় পাওয়া চিৎকার ! বুঝতে পারছি ফ্ল্যাটে মারাত্মক কোনও বিপদ ঘটেছে। দরজা ধাক্কা দিচ্ছি, সোমা! সোমা! বলে ডাকছি, আমার স্ত্রীর নাম…

—এক মিনিট। সুপ্রিয়বাবুকে থামালেন দীপকাকু। বললেন, আপনি ডোরবেল টিপলেন কেন? ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি আপনার কাছে ছিল না?

—ছিল। সোমা দিয়ে রেখেছে। হামেশাই ট্যুর করতে হয় আমাকে। চাকরি বা অন্য কোনও প্রফেশনে নেই সোমা। ও শুধু সংসার সামলায়। তবু এমন তো হতেই পারে, কোনও দরকারি কাজে বাইরে যেতে হল ওকে, আমি তখন ট্যুর সেরে ফিরে আসছি। সে ক্ষেত্রে ডুপ্লিকেট চাবিটা কাজে লাগবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেরকম ইন্সিডেন্স আসেনি। কাল ওদের ঘুম না ভাঙাতে চেয়ে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকতেই পারতাম, মাথায় আসেনি কথাটা। ফ্ল্যাটে ফিরে বেল টেপাটা এমন অভ্যেসের মতো হয়ে গিয়েছে…

—তারপর কী হল বলুন? সুপ্রিয়বাবুকে ঘটনার বিবরণে ফেরাতে চেয়ে বললেন দীপকাকু।

সুপ্রিয়বাবু বলতে থাকলেন, দরজা মেয়ে খুলে দিল। ঘরে পা দিয়ে দেখি, ছেলেটা ওখানে ঠিক ওইভাবে পড়ে আছে, সোমা পড়ে আছে এই কার্পেট এরিয়ায়।

নিজের পা থেকে ফুট চারেক দূরত্বে আঙুল নির্দেশ করলেন সুপ্রিয়বাবু। ফের বলতে লাগলেন। মেয়ে থর থর করে কাঁপছে, কোনও কথাই বলতে পারছে না। আমার প্রথমে মনে হয়েছিল সোমাও মারা গিয়েছে। নাকের কাছে আঙুল নিয়ে গিয়ে দেখলাম শ্বাস পড়ছে। তার মানে সেন্সলেস। ছেলেটার বুকে গুলির ফুটো দেখে বুঝলাম শেষ।

–তারপর আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোকেদের ডাকলেন। বললেন দীপকাকু।

সুপ্রিয়বাবু জানালেন, ডাকতে হয়নি। গুলির আওয়াজ কোথা থেকে এল, খুঁজতে বেরিয়ে আমার ফ্ল্যাটে চলে এসেছিল কমপ্লেক্সের অনেকেই। ওরা আমাকে সাহস জোগাল। বলল, লোকাল থানায় ফোন করতে।

দীপকাকুর জিজ্ঞাসাবাদ শুনতে অফিসার তাপস রায় সমেত অন্যান্য পুলিশ কর্মী সোফার কাছাকাছি চলে এসেছেন। আগ্রহের কারণ নিশ্চয়ই দীপকাকুর নতুন অ্যাঙ্গেলের প্রশ্ন নিয়ে। এবার দীপকাকু জানতে চাইলেন, আপনার মেয়ের বয়স কত?

প্রশ্নটা আদৌ কতটা প্রাসঙ্গিক ধরতে পারে না ঝিনুক। তার ধারণা দীপকাকু ছাড়া এ ঘরের আর কেউই বলতে পারবে না কেন তথ্যটা জানতে চাওয়া হচ্ছে? সুপ্রিয়বাবু কৌতূহলী না হয়ে বাধ্য ছাত্রর মতো উত্তর দিলেন, বারো বছর। ক্লাস সিক্সে পড়ে।

—তার মানে যথেষ্টই ম্যাচিওরড্। ওর থেকেও তো ঘটনার কিছু বিবরণ পাওয়া যেতে পারে। যা হয়তো আপনার চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। কথা বলা যাবে ওর সঙ্গে?

এবার বোঝা গেল বয়স জানতে চাওয়ার কারণ। সুপ্রিয়বাবু খানিক ইতস্ততার সঙ্গে বললেন, তোর্সা মাকে নিয়ে ভীষণ টেনশড। মাথার কাছে বসে রয়েছে। এই সময় কি ওর সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে?

—আচ্ছা, আপাতত থাক। বলে দীপকাকু অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, গোটা ফ্ল্যাটটা নিশ্চয়ই আপনাদের সার্চ করা হয়ে গিয়েছে?

‘হ্যাঁ’ বুঝিয়ে ঘাড় কাত করলেন অফিসার। ফের দীপকাকু বললেন, কোনও পিস্তল নিশ্চয়ই পাননি। পেলে এতক্ষণে আমাকে বলতেন। পিস্তল থাকার কোনও সম্ভাবনাও কি দেখা গিয়েছে?

—না, সেরকম কিছু তো চোখে পড়েনি।

অফিসারের উত্তর শুনে নিয়ে দীপকাকু সুপ্রিয়বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কাছে কি বন্দুক রাখার লাইসেন্স আছে?

—না, নেই। সত্যিকারের রাইফেল বা পিস্তল আমি কোনওদিন হাতে নিয়ে দেখিনি। নিরীহ গলায় জানালেন সুপ্রিয়বাবু।

প্রয়োজনীয় পয়েন্টগুলো নোটবুকে লিখে নিচ্ছে ঝিনুক। সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন দীপকাকু। তাপস রায়কে বললেন, আমি একবার ফ্ল্যাটটা ঘুরেফিরে দেখি? যদিও আপনারা সবাই দেখেছেন। বাই এনি চান্স কোনও ক্লু পেয়ে যেতে পারি।

—যদি পান, প্লিজ জানাবেন। কেসটা ভোগাবে মনে হচ্ছে। আপনি আপনার মতো দেখতে থাকুন। বলার পর অফিসার এক হাবিলদারের উদ্দেশে বললেন, বাইরে গিয়ে একটু চায়ের ব্যবস্থা করো তো। মাথা একেবারে ধরে যাচ্ছে।

ঘরের এই পরিবেশে মাথা ধরে যাওয়ারই কথা। ঝিনুকেরও গিয়েছে। এ সময় চা পেলে দীপকাকুরও ভাল লাগবে। এমনিতে ঝিনুক চা খায় না, ডেডবড়ি পড়ে থাকা ঘরে তো কোনও প্রশ্নই নেই। সে তার যতই মাথা ধরুক। স্লাইডিং ডোর ঠেলে দীপকাকু পৌঁছোলেন গ্রিল ঘেরা বারান্দায়। ঝিনুকও এল। এখান থেকে কমপ্লেক্সের পিছন দিকটা দেখা যাচ্ছে, প্রায় দেড়—মানুষ উঁচু পাঁচিল। তার ওপর কাঁটাতারের বেড়া। পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢোকা প্রায় অসম্ভব, যদি না বাউন্ডারির কোনও অংশে বড় গাছ-টাছ থেকে থাকে। কসরৎ করে সেটায় উঠে ঘরে পড়ে থাকা ছেলেটা পাঁচিল টপকাতে পারে, নতুবা মেন গেট দিয়েই আসতে হয়েছে তাকে।

দীপকাকু গ্রিল ধরে টানাটানি করে দেখছেন, কাটা হয়েছে কি না। যদিও একবার দেখেছে পুলিশ, সিওর হয়ে নিচ্ছেন। ফ্লোর থেকে সানশেড অবধি গ্রিল, জুতো ছেড়ে খানিক দূর উঠে গিয়ে দেখতে লাগলেন টেনেটুনে। তিন দিক দেখার পর নেমে এলেন। পুলিশের কথাই ঠিক, কাটা হয়নি গ্রিল। জুতো গলিয়ে নিয়ে দীপকাকু ফের ঘরে ঢুকলেন। চলে গেলেন সিটিং এরিয়ার অপজিটে দেওয়াল জোড়া সুদৃশ্য কাঠের ক্যাবিনেটের সামনে। ঝিনুক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ক্যাবিনেটের নীচ থেকে ওপর অবধি সব পাল্লাই কাচের। কোনওটা স্লাইডিং, কোনওটা আবার মুখোমুখি খোলার ব্যবস্থা। ডানদিকের দেওয়ালে অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমে কাচ বসানো ওপেন র‍্যাক। এত তাক জুড়ে শুধুই শো-পিস। দেওয়ালের ফাঁকা অংশে ঝুলছে বিভিন্ন ধরনের মুখোশ, জাপানি পাখা, কাগজ বা কাপড়ের ওপর আর্টওয়ার্ক। এ সবের নীচে ফ্লোরের উপরে বড় বড় ফ্লাওয়ার ভাস, বাঁকুড়ার ঘোড়া, কাঠের কালো নানান সাইজের বক্সের ওপর পোড়ামাটি, ডোকরার বিভিন্ন মূর্তি বা মোটিফ। বোঝাই যাচ্ছে শুধুমাত্র ঘর সাজানোর জন্য জিনিসগুলো এখানে রাখা হয়নি। কালেকশনের ঝোঁক কাজ করেছে। রুমাল বার করে বাঁ হাতে জড়িয়েছেন দীপকাকু। ডানহাতে নিয়েছেন পেনসিল টর্চ। ক্যাবিনেটের কাচের পাল্লা সরানোর চেষ্টা করছেন রুমাল জড়ানো হাতে কোনওটা খুলছে, কোনওটা না। লক করা আছে। পাল্লার এমন জায়গায় রুমাল সমেত আঙুল রাখছেন দীপকাকু। সচরাচর সেখানে হাত দিয়ে কেউই পাল্লা খুলবে না। অর্থাৎ কিনা কাচের পাল্লায় যে সব হাতের ছাপ আছে, অটুট রাখতে চাইছেন। তাতে ফরেনসিক টিমের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে না।

কালেকশনের আইটেম দেখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে ঝিনুকের! প্রত্যেকটা র‍্যাকে আলাদা আলাদা বিষয় রাখার চেষ্টা হয়েছে। এলোমেলো হয়ে রয়েছে একটু। কেউ হয়তো এক র‍্যাক থেকে জিনিস তুলে দেখে, ভুল করে রেখেছে অন্য র‍্যাকে। বিভিন্ন ধরনের চাবির রিং, চামচ, আনকমন আকারের পট, নানান ডিজাইনের ঘণ্টা সামুদ্রিক শাঁখ, সেরামিক এবং অন্যান্য ধাতুর বিভিন্ন ভঙ্গির গণেশ মূর্তি, বৌদ্ধদের জপযন্ত্র, বিচিত্র সব পেপারওয়েট, নানান দেশের কয়েন, এমনকী মথ, প্রজাপতিও কেমিকাল দিয়ে সংরক্ষণ করা।

সংগ্রহের নির্দিষ্ট কোনও সাবজেক্ট নেই। বেশ কিছু শো-পিসের সঙ্গে সাদা সুতো দিয়ে ছোট্ট চিরকুট বাঁধা, লেখা আছে জিনিসটার পরিচয় সেগুলো পড়ে জানা যাচ্ছে এখানে বহু বিদেশের জিনিসও রয়েছে। আন্দাজ করা যায় সংগ্রহের ঝোঁকটা সুপ্রিয় পালের। কারণ, অফিসের কাজে ট্যুরে যেতে হয়। এখন বোঝা যাচ্ছে বিদেশেও যান। স্মারক হিসেবে জিনিসগুলো নিয়ে আসেন। এটা প্রায় স্মারক সংগ্রহশালা হয়ে উঠেছে। ঝিনুকেরও কেন যেন সন্দেহ হয়, এই সংগ্রহশালার কারণেই কি এই ফ্ল্যাটে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল? একই সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে, খুব দুর্মূল্য বা দুষ্প্রাপ্য জিনিস এগুলো নয়। যদি হত, এত খোলামেলাভাবে রাখতেন না ফ্ল্যাট মালিক। ক্যাবিনেটের অধিকাংশ কাচের পাল্লাই খোলা যাচ্ছে। একটু আগে যেমন দীপকাকু ক্যাবিনেটের মাঝখানে নীচ থেকে ফিট তিনেক ছেড়ে যে হাফ রাউন্ড কাচের পাল্লাটা আছে, রুমাল জড়ানো আঙুল দিয়ে খুলে ছিলেন। টর্চ জ্বেলে ভিতরের জিনিসগুলো দেখলেন। এত সহজে যেখানে পৌঁছনো যায় তার জন্য খুনের মতো ঘটনা ঘটবে কেন?

ক্যাবিনেট, ওপেন র‍্যাক, ফ্লোরে রাখা সব শো-পিসই দেখা হয়ে গেল দীপকাকুর। মুখ থমথমে, বোঝা যাচ্ছে না কোনও কু পেলেন কিনা। এবার চলে এলেন সেই পরিচিত ভঙ্গিতে। চশমার সামনে আতসকাচ নিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছেন শো-পিস সংগ্রহের ঠিক সামনেটায়। আশা করছেন কোনও ব্লু যদি পাওয়া যায়, অপরাধীর পায়ের ছাপ অথবা অন্য কিছু। দীপকাকুকে এবার ভঙ্গিটা পালটাতে বলতে হবে। কেমন কেমন যেন লাগে! বড় অস্বস্তি হয় ঝিনুকের। একবার পুলিশদের দিকে তাকায় সে, যা ভেবেছিল তাই, সকলের দৃষ্টি দীপকাকুর ওপর। চোখের কৌতূহল কৌতুকে পরিণত হতে সময় লাগবে না। মুখ ফিরিয়ে নেয় ঝিনুক। দীপকাকু পৌঁছে গিয়েছেন স্লাইডিং দরজার পর্দার কাছে। পর্দার নীচের ফ্লোরটার একটু বেশি সময় ধরে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। প্যান্টের পকেটে রুমাল, আতসকাচ, চালান করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, কপালে চিন্তার ভাঁজ। অফিসার এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, পেলেন কিছু?

দীপকাকু অফিসারের দিকে তাকালেনই না। এক মনে ভেবে যাচ্ছেন। হাবিলদার চা নিয়ে এল। হাতে সুন্দর ট্রে, দারুণ ডিজাইনের সব কাপ। চায়ের রংটাও খাসা। দীপকাকুকে অফার করতে হল না। নিজেই একটা কাপ তুলে নিয়ে ডিজাইনটা দেখছেন। অফিসারের উদ্দেশে বললেন, আপনি বাইরে থেকে চা আনতে বলেছিলেন না? কোন দোকান থেকে এত দামি কাপে চা পাঠিয়েছে?

উত্তরটা দিল হাবিলদার। বলল, আমি বাইরে থেকেই আনতে যাচ্ছিলাম। পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক যেতে দিলেন না। ওঁরাই বানিয়ে দিলেন।

কাপে চুমুক মেরে দীপকাকু বললেন, এই ফ্ল্যাটের রুচি পাশের ফ্ল্যাটেও প্রভাব ফেলেছে দেখছি।

কথাটা শৌখিন কাপ, ট্রের জন্য বলা। হাবিলদার বাকি পুলিশদের চা দিতে গেল। দীপকাকু চা খেতে খেতে অফিসারকে বললেন, সামনের ব্যালকনিতে একবার যাব।

—যান না। আমরাও গিয়েছিলাম। ফ্ল্যাট মালিক বলছেন ব্যালকনির দরজাটা রাতে বন্ধই ছিল। ওদিক থেকে কারুর ঘরে ঢোকার সম্ভাবনা নেই। তবু একবার দেখে এসেছি। ফ্ল্যাট-মালিক যে সত্যি বলছেন তার তো কোনও মানে নেই। সেরকম কোনও ব্লু অবশ্য চোখে পড়েনি। বলে চা খাওয়ায় মন দিলেন অফিসার। খানিক বিরতিতে চা খাওয়া শেষ হল দু’জনেরই। হাবিলদার ফাঁকা ট্রে নিয়ে এল। দীপকাকু কাপ নামিয়ে ব্যালকনির দরজার দিকে এগোলেন। সঙ্গে চলল ঝিনুক। খেয়াল করল অফিসারও আসছেন। দরজা এখনও বন্ধ করাই আছে। ছিটকিনি খোলার আগে দীপকাকু খানিকক্ষণ দরজার দিকে চেয়ে রইলেন। দরজার দু’পাশে জানলা, –

কাঠের ফ্রেমে কাচ দেওয়া পাল্লা। ছিটকিনি দিয়ে রাখা সে দুটোতেও দরজার ছিটকিনি খুলে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন দীপকাকু। সঙ্গে অফিসার এবং ঝিনুক। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে পুলিশের জুতোর ছাপ ব্যালকনি জুড়ে। শীতকাল, ধুলো ওড়ে বেশি। ব্যালকনির জন্য ধুলোর কারণে বুটের ছাপ স্পষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে অন্য কারুর পায়ের ছাপ পাওয়া দুষ্কর। তাই হয়তো সেই চেষ্টায় না গিয়ে দীপকাকু আতসকাচ দিয়ে কোমর সমান রেলিং, ওপরে হাত রাখার ব্ল্যাক কালারের পাইপ, ব্যালকনি সংলগ্ন বিল্ডিঙের দেওয়াল, গাছের টবগুলো দেখছেন। বিল্ডিঙের ব্যালকনিগুলো খুব সুন্দর। কমপ্লেক্সে ঢোকার সময় চোখ টেনে ছিল ঝিনুকের। প্রায় সব ব্যালকনিতেই টবের গাছে বাগান করার প্রয়াস। রেলিঙে বাঁধা একটা নাইলনের দড়ি হাতে তুলে নিয়েছেন দীপকাকু, যার শেষ প্রান্তে সাধারণ একটা বাজারের ব্যাগ। উঁচু ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের এটা কমন ব্যবস্থা, নীচ থেকে দুধের প্যাকেট, খবরের কাগজ আরও নানান জিনিস তুলে আনার জন্য। দড়ি ছেড়ে দিয়ে দীপকাকু এখন রেলিং ধরে ঝুঁকে একবার নীচটা দেখছেন, পরের বার ওপরটা। এই ভাবেই প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন রেলিঙের আগাগোড়া। কী দেখছেন, উনিই জানেন। অনুমান ক্ষমতা দিয়ে নাগাল পাচ্ছে না ঝিনুক। পর্যবেক্ষণ মনে হচ্ছে এবার শেষ হল। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে আসছেন দীপকাকু অফিসারকে বললেন, এখানে যা দেখার মোটামুটি হয়ে গিয়েছে। একবার ছাদটায় যাব।

—ছাদে! বলে থমকালেন অফিসার। ফের বললেন, ছাদে আমরা যাইনি। আপনি যান, ঘুরে আসুন, ছাদের দরজা বন্ধ না খোলা, তাও তো জানি না। দাঁড়ান দেখছি।

ঘরের দিকে ঘুরে গিয়ে অফিসার হাঁক পাড়লেন, ঘোষবাবু, ছাদের দরজায় তালা দেওয়া কিনা দেখুন। বন্ধ থাকলে চাবি জোগাড় করে মিস্টার বাগচীকে নিয়ে যান।

কথা শেষ করে অফিসার মুখ ঘোরাতেই দীপকাকু বললেন, ফ্ল্যাট মালিকের মোবাইল নাম্বার নিশ্চয়ই নিয়েছেন, কললিস্ট চেক করার জন্য?

—নিয়েছি। এই কেসে উনি একজন সম্ভাব্য অপরাধী।

—রাইট। ওঁর ক’টা মোবাইল ফোন?

—একটা।

একটু ভেবে নিয়ে দীপকাকু বললেন, ওঁর স্ত্রীর মোবাইল নাম্বারটাও নিন। ওটারও কললিস্ট বার করে রাখুন।

–কেন বলছেন একথা? বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন তাপস রায়।

দীপকাকু স্বগতোক্তির ঢঙে বললেন, মনে হচ্ছে স্ত্রীর মোবাইল নাম্বারটা তদন্তের কাজে লাগবে।

ভ্রূ জোড়া ঘনিষ্ঠ হল অফিসারের, সুপ্রিয় পালের স্ত্রী মোবাইলের সঙ্গে এই কেসের যোগসূত্র খুঁজছেন নিশ্চয়ই। ফের দীপকাকু বলে উঠলেন, ফরেসিক টিম এলে বলবেন কাঠের বড় ক্যাবিনেটটা একবার চেক করতে, অপরাধীর হাতের ছাপ পাওয়া গেলেও যেতে পারে।

—কী করে পাওয়া যাবে? ডেডবডির হাতে তো গ্লাভস, বললেন তাপস রায়।

চোখ থেকে চশমা নামিয়ে জামার খুঁটে কাচ মুছতে মুছতে দীপকাকু বলতে থাকলেন, ছেলেটা একা ছিল না, খুনিও ছিল ঘরে। তার হাতে গ্লাভস ছিল কিনা আমরা জানি না। এটা যে মার্ডার, সেটা পরিষ্কার। নিজের পিঠে ওভাবে গুলি করে সুইসাইড করা যায় না।

পুলিশের লোক হয়ে সূত্রগুলো জোড়া লাগানো মোটেই কঠিন নয় তাপস রায়ের কাছে। ক্ষণিকের জন্য ভাবনাটা বোধহয় গুলিয়ে গিয়েছিল। চশমা পরে নিয়ে দীপকাকু বললেন, রাতে ব্যালকনির দরজা বন্ধ ছিল কি না, সে ব্যাপারে আমরা যখন সিওর নই, ত হলে ধরে চলা ভাল অপরাধী কিংবা অপরাধীরা ঘরে ঢুকেছিল এই পথ দিয়েই। কোনওভাবে উঠে এসেছিল বারান্দায়। ফরেনসিক টিমকে বলবেন ব্যালকনি লাগোয়া দু’পাশের দেওয়ালও যেন পরীক্ষা করে। এখানে আসার জন্য দেওয়ালটাকে হাত এবং পায়ের সার্পেট হিসেবে ব্যবহার করার কথা আর এই পর্দাটা চেক করতে বলবেন।

ব্যালকনির দরজার পর্দাটাকে নির্দেশ করলেন। দীপকাকু। পূর্ব এখন একপাশে টেনে রাখা। অফিসার জানতে চাইলেন, পর্দা চেক করে কী পাওয়া যাবে?

—কিছু ক্লু থেকে যাওয়ার চান্স আছে। আশা করা যায় রাতে পর্ন পুরোটাই টানা ছিল। দুষ্কৃতী পর্দা সরিয়ে ঢুকেছে। এতদূর বেয়ে ওঠার কারণে দেওয়াল কিংবা অন্য কিছুর রং, ধুলো-ময়লা হাতে অযথা গ্লাভসে লেগে থাকতে পারে, যার প্রমাণ পর্দাটায় রয়ে গিয়েছে এছাড়াও কিছু না কিছু ক্লু সে বা তারা এখানে রেখে যাবেই।

দীপকাকুর বলা শেষ হতেই অফিসার বলে উঠলেন, পর্দা টানাই ছিল। আমরা সরিয়েছি।

-তা হলে তো হয়েই গেল। এখান দিয়েই যদি ঢোকে, পদাটা পরীক্ষা করা মাস্ট। বললেন দীপকাকু। –

একজন কনস্টেবল এসে দাঁড়ালেন চৌকাঠে। অফিসারের উদ্দেশে বললেন, স্যার, ছাদের চাবি এনেছি।

ইনি তার মানে ঘোষবাবু। অফিসার এঁকেই চাবি জোগাড় করতে বলেছিলেন। এখন ঘোষবাবুকে বললেন, চাবি কার কাছে ছিল?

—এই বিল্ডিঙের প্রত্যেক ফ্ল্যাটেই ছাদের চাবি একটা করে দেওয়া আছে। এ ফ্ল্যাট থেকেই পেলাম চাবি। মালিকের মনের অবস্থা তো ভাল নয়, চাবিটা খুঁজতে সময় লাগল, বললেন ঘোষবাবু। –

অফিসার নির্দেশ দিলেন, যান, এঁদের নিয়ে ছাদে যান।

—ইয়েস স্যার। বলে অ্যাবাউট টার্ন নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন ঘোষবাবু। ঝিনুক দ্রুত পায়ে অনুসরণ করল। বড়ি পড়ে থাকা ঘর থেকে বেরোতে পারলে যেন বাঁচে। দীপকাকু আসছেন হেলেদুলে। তবে এরকম একটা দমচাপা মর্মান্তিক কেসের আবহে ঝিনুকের ভাললাগার মতো ব্যাপার ঘটেছে একটাই, দীপকাকুর কাছে কেউ তার পরিচয় জানতে চায়নি। প্রত্যেকটা কেসেই চায়। একে মেয়ে, বয়সও এত কম, গোয়েন্দার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ভাবতেই পারে না কেউ। ঝিনুকের উপস্থিতিতে কেস নিয়ে আলোচনা করতে ইতস্তত করে। প্রতিবারই দীপকাকুকে বলতে হয়, ‘ও আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, কোনও অসুবিধে নেই, আপনি বলুন’। ইনভেস্টিগেটিং অফিসার তাপস রায় ঝিনুকের পরিচয় জানতে না চাওয়ার কারণ কি দীপকাকুর সম্বন্ধে জানতে গিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্টের কথাও জেনে গিয়েছেন? তার মানে অপরাধ জগতে ঝিনুকের নামটাও এন্ট্রি হয়ে গেল!

ঘোষবাবুকে নিয়ে তিনজন এখন ছাদে। দরজায় তালা দেওয়া ছিল ঘোষবাবু খুলেছেন। দীপকাকু ছাদে পা দিয়ে চলে গিয়েছেন পাঁচিলের সেই অংশে, যার নীচে বিল্ডিঙের ডানদিকের ব্যালকনি। যার একটা সুপ্রিয়বাবুর ফ্ল্যাটের। দীপকাকু খুঁটিয়ে দেখছেন এলাকাটা। ঝিনুক এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গিয়ে ‘আকৃতি প্লাজা’র গোটা বাউন্ডারিটা দেখার চেষ্টা করেছে। দশতলার ওপর থেকে ভারী সুন্দর লাগছে নীচের এলাকাটা ! বিল্ডিংগুলোর সামনে পিছনে নানান আকৃতির বাগান, বাচ্চাদের দুটো পার্ক, রেলিং ঘেরা চারটে ওয়াটার বড়ি, যেন ঝুলনের পুকুর। বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে কোথাও বড় গাছ নেই, মৃত ছেলেটি তার মানে মেন গেট দিয়েই ঢুকেছিল। দীপকাকুর দিকে চোখ যায় ঝিনুকের, উবু হয়ে বসে মার্কার দিয়ে পাঁচিলের নীচের ফ্লোরে হাফ রাউন্ড আঁক কাটলেন। পাশে দাঁড়ানো ঘোষবাবুকে বললেন, এখানে কয়েকটা জুতোর দাগ দেখতে পাচ্ছি পাচ্ছেন আপনি?

মাথা নাড়লেন ঘোষবাবু। অর্থাৎ উনি পাচ্ছেন না দেখতে দীপকাকু দেখেছেন ম্যাগনিফায়িং গ্লাসের সাহায্যে, সেটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এবার আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন পাঁচিলের ওপর হ্যান্ডরেস্টের পাইপটা, ব্যালকনির রেলিঙের নাগর এরকমই পাইপ আছে। দীপকাকু বললেন, এখানে আছে বড় বাঁধার দাগ, মোটা দড়ি। টান পড়েছে ভালই। পাইপের রং কিছুট উঠে গিয়েছে। ফরেনসিক টিমকে এই দু’টো জায়গা ভাল করে দেখতে বলবেন।

—এটা আপনি স্যারকে বলে দিন। আমার কথা শুনবে দে ফরেনসিক, আমি তো অথরিটি নই। বললেন ঘোষবাবু।

পকেট থেকে সেলফোন বার করে দীপকাকু বললেন, তাপসবাবুর নাম্বারটা বলুন। ঘোষবাবুর মুখস্থ নেই, নিজের ফোন দেখে বলতে হল। দীপকাকু অফিসারকে কল করে প্রথমে বললেন, দীপঙ্কর বাগ বলছি। নাম্বারটা সেভ করে রাখুন। এরপর ছাদের ব্যাপারট বললেন, সঙ্গে রাখলেন আরও একটা অনুরোধ, আপনি কাইন্ডলি মেন গেটে সিকিউরিটি রুমে ফোন করে দিন, গতকালের সিসি টিভির ফুটেজটা দেখব আমি।

ফোনের অপর প্রান্তে তাপস রায় কিছু বললেন। শুনে নিয়ে দীপকাকু বলে উঠলেন, জানি, আপনারা দেখেছেন। ইট্স ন্যাচারাল। মৃত ছেলেটা মেনগেট দিয়ে ঢুকেছে কিনা, সেটা জানার জন্যই দেখেছেন। ফুটেজে ঢুকতে দেখা যায়নি। গেলে, আমাকে বলতেন জানি। তবু আমি আর একবার দেখতে চাই।

মনে তো হচ্ছে সম্মত হলেন অফিসার। দীপকাকু ফোন পকেটে পুরে ঘোষবাবুকে বললেন, ফরেনসিককে জায়গাটা ভাল করে দেখিয়ে দেবেন। এখন যদি নীচে নামেন, ছাদের দরজায় তালা দিয়ে রাখবেন আগের মতোই।

ঘোষবাবু ঘাড় কাত করলেন। ঝিনুকের উদ্দেশে দীপকাকু বললেন, চলো, চলে এসো।

লিফটে করে গ্রাউন্ডে নেমে এসেছে ঝিনুকরা। সিকিউরিটি রুম লক্ষ্য করে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছেন দীপকাকু। ঝিনুক পা মিলিয়েছে। মেনগেট আগের মতোই হাটখোলা। ‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো একটা গাড়ি ঢুকে এল, সেলাম ঠুকল গেটে দাঁড়ানো হাবিলদার। ঝিনুকদের ক্রস করে গাড়িটা সোজা গিয়ে থামল সুপ্রিয়বাবুদের বিল্ডিঙের নীচে। হাতে ব্যাগপত্র নিয়ে সিভিল ড্রেসের কয়েকজন নেমে এলেন। মনে হচ্ছে ফরেনসিক টিম এসে পৌঁছোল। দীপকাকু নিশ্চয়ই খেয়াল করেননি গাড়িটাকে। একবারের জন্যেও ঘুরে দেখলেন না। যেন আত্মমগ্ন সায়েন্সের কোনও প্রফেসার, ফরেনসিকের টাস্ক দেওয়া হয়ে গিয়েছে, এখন চলেছেন অন্য ক্লাস নিতে।