দশ
খানসামা লোকটা ফের দৃষ্টি ফেরাল ঝাঁপিয়ে পড়া বিপুল জলরাশির উদ্দেশে, এবং আবারও হুডওয়ালা স্পিকারের সুবিধা নিয়ে ক্যামোফ্লেজ করল। কিশোরের বুকের ভেতরে ধড়াস ধড়াস করছে, সাবধানে সরে পড়ল ও, আশা করছে ওকে চিনতে পারবে না লোকটা।
অপর সুড়ঙ্গটার দিকে হন্তদন্ত হয়ে পা বাড়াল কিশোর।
‘ফ্রেডি,’ চেঁচিয়ে উঠল ও, একের পর এক অবয়বের কাছে গিয়ে অবশেষে খুঁজে পেল তাঁকে। ‘আমি এইমাত্র জনকে দেখলাম!’
হতবিহ্বল দেখাল ফ্রেডিকে।
‘কী বলছ? ঠিক দেখেছ তো?’
‘হ্যাঁ! ওটা ও-ই, চিবুকে শেভিঙের কাটাকুটিও পরিষ্কার দেখেছি। অন্য সুড়ঙ্গটায় আছে ও!’
মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেলেন ফ্রেডি। এবার অন্যান্য পর্যটকদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন কিশোর আর টিনাকে।
‘মন দিয়ে শোনো,’ বললেন। ‘এখন সত্যি কথাটা বলার সময় এসেছে। আমি একজন মাউন্টি, কাসা লোমা কেসে ছদ্মবেশে কাজ করছি। পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। তোমাদের সাহায্য না পেলে শয়তানগুলো হয়তো সটকে পড়তে পারে!’
‘ওয়াও! কী করতে হবে বলুন!’ উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
‘আমার নায়াগ্রা ফলসে আসার মূল কারণ জনের ওপর নজর রাখা, ও যাতে হীরেগুলো নিয়ে সীমান্ত পেরোতে না পারে। ভাগ্যিস ও তোমার চোখে ধরা পড়ে গেছে, কিশোর, এখন ওকে পাকড়াতে হবে।’
কিশোর আনন্দে আটখানা। টিনা ওর পিঠ চাপড়ে দিল।
‘আমি ওকে একা সামলাতে পারব না, ওর কাছে হয়তো অস্ত্র আছে, গুলি-টুলি করে বসলে কেউ আহত হতে পারে।’ চটপট একটা পরিকল্পনা ছকে ফেললেন ফ্রেডি। পরমুহূর্তে, জনকে যে সুড়ঙ্গটায় দেখেছিল সেখানে দৌড়ে ফিরে গেল কিশোর।
টুরিস্টে গিজগিজ করছে ওটা, এবং জনে-জনে খুঁজেও যখন জনকে পেল না, রীতিমত মুষড়ে পড়ল কিশোর। সন্দেহভাজন লোকটা এত জলদি পালিয়ে গেল? এবার আচমকাই লোকটাকে দেখে ফেলল কিশোর।
‘জন! প্লিজ, আমাকে সাহায্য করুন!’
হতভম্ব লোকটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিশোরের দিকে।
‘জলদি আসুন!’ আর্তস্বরে চেঁচাল কিশোর। ‘টিনার খুব বিপদ!’
দৌড় দিল কিশোর। কাঁধের ওপর দিয়ে চকিতে চেয়ে দেখল পেছন-পেছন ছুটছে জন, এবার পর্যটকদের ভিড় ভেদ করে সোজা দৌড়তে লাগল টিনার উদ্দেশে। মেয়েটি ওখানে গর্জনশীল পানির কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।
উল্টো ঘুরল ও, জলবিন্দুতে ভিজে গেছে মুখ, জনকে দেখামাত্রই চিল চিৎকার ছাড়ল। এবার হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল গর্জনশীল জলপ্রপাতটির পাশে, পাথুরে জমিনে।
‘আসুন!’ চেঁচাল কিশোর।
কিশোরকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে, টিনার ওপর ঝুঁকল জন। ঠিক এমনিসময়, স্লিকার পরা দশাসই দুই লোককে নিয়ে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এলেন ফ্রেডি।
‘ওই যে লোকটা,’ বাজখাঁই কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন, জনের দিকে তর্জনী দেখালেন। ‘দেখুন, মেয়েটাকে কীভাবে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেছে। ধরুন ওকে!’
ঝট করে চোখ তুলে চাইল জন, হতবাক, এবার শক্তিশালী লোক দুটো বাহুজোড়া চেপে ওকে পাথুরে দেয়ালে ঠেসে ধরতেই বিস্ময়ের চিৎকার বেরোল ওর গলা চিরে। টিনা হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর সুড়ঙ্গ ধরে ত্বরিত কিশোরের পিছু নিল। পেছন থেকে জনের প্রতিবাদী চিৎকার কানে এল ওদের, কিন্তু পানির গুম-গুম শব্দের মাঝে হারিয়ে গেল ওর কথাগুলো।
ফ্রেডি এলিভেটরে মিলিত হলেন ওদের সঙ্গে, চোখজোড়া উজ্জ্বল।
‘সাবাস, বাছারা! আমরা পুলিস নিয়ে না ফেরা পর্যন্ত ওরা জনকে নিজেদের জিম্মায় রাখবে।’
এলিভেটরের দরজা লেগে গেল উন্মাতাল জলপ্রপাতটির মুখের ওপর। কোলাহল থেমে গিয়ে নেমে এল অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ফ্রেডির উদ্দেশে চাইল কিশোর।
‘আপনার দু’নম্বর সাসপেক্ট কে?’
‘কী?’
‘খবরের কাগজে লিখেছে চুরিটার পেছনে দু’জন আমেরিকানের হাত রয়েছে।’
‘ওহ।’ ফ্রেডি থমকে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়া দিয়ে পানি ঝরালেন। ‘সরি, ইনফর্মেশনটা এখন তোমাদের দিতে পারছি না।’
‘ওটা কি আমাদের পরিচিত কেউ?’
মৃদু হাসলেন ফ্রেডি।
‘ওকে…স্বীকার করছি তোমরা তাকে চেন।’
‘তাহলে…’
একটা হাত তুললেন ফ্রেডি।
‘আর কোন প্রশ্ন নয়।’
পাহাড়ের ভেতরে এলিভেটরটা ধীর লয়ে উঠে যাচ্ছে, অধৈর্য কিশোর পা ঠুকল।
‘ওটা পুরুষ না মহিলা?’ ফ্রেডিকে প্রশ্ন করল ও।
এসময় চুড়োয় পৌঁছল এলিভেটর। শীঘ্রি ওরা পার্কিং লটের ভিড়ের ভেতর দিয়ে ফ্রেডির গাড়ির উদ্দেশে ছুট লাগাল। তীব্র গতিতে পার্কিং লট থেকে গাড়ি নিয়ে ছিটকে বেরিয়ে, পর্যটন নগরীটির জনবহুল রাস্তা দিয়ে যথাসম্ভব গতি তুললেন ফ্রেডি।
‘থানাটা কোথায়?’ চিৎকার করে উঠল কিশোর, গাড়িটা প্রায় উড়ে এক কোনা ঘুরতেই শক্ত হয়ে বসে থাকল ও।
‘কাছেই।’
ফ্রেডির দিকে চাইল টিনা।
‘সামনে ওটা রেইনবো ব্রিজ না?’
মাথা ঝাঁকালেন ফ্রেডি।
‘আমরা আমেরিকান অংশে যাচ্ছি এফবিআইকে বর্ডার গার্ড বাড়ানোর জন্যে সতর্ক করতে। আমি শিয়োর জনের পার্টনার এখানেই রয়েছে।
সেতুর মাঝ বরাবর পৌঁছে, কানাডা, জাতিসংঘ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাগুলো পেরোল ওরা। কিশোর পতাকাগুলোর ওপাশে, সুদূরের হর্সশু ফলসের দিকে তাকাল, এবার সরাসরি বহু নিচে গিরিসঙ্কটের ঘূর্ণিজলের উদ্দেশে।
‘হপিং হর্নটোড্স্! লম্বা পতন।’ বলল ও।
হেসে ফেললেন ফ্রেডি।
‘আঁটোসাঁটো টাঙানো রশির ওপর দিয়ে হেঁটে এই গিরিসঙ্কট পেরোতে চাও?’
‘না, ধন্যবাদ! দুনিয়ার সব হীরের বিনিময়েও না।’
‘দ্য গ্রেট ব্লনডিন এই গিরিসঙ্কটের ওপরে অনেক টাইটরোপ স্টাণ্ট করেছেন।’ সেতুর ওপর গতি মন্থর হলো ওদের, সীমান্ত চেকপয়েন্ট দিয়ে পেরনোর জন্য যানবাহনের সারিতে যোগ দিল ওরা। ‘দ্য গ্রেট ব্লনডিন উল্টো ডিগবাজি খেয়েছেন, বাইক চালিয়ে পাড়ি দিয়েছেন, এমনকী এখানে একটা ডিম পর্যন্ত ভেজেছেন।’
পনিরের না মাশরুমের?’ টিনা জিজ্ঞেস করল।
ফ্রেডি হেসে উঠলেন, তারপর অধৈর্য ভঙ্গিতে বললেন, ‘এত সময় লাগলে হয়?! গাড়িগুলো নড়ে না কেন?’
‘আপনি সাইরেন বাজিয়ে সবাইকে পেরিয়ে যান না,’ প্রস্তাব করল কিশোর।
‘এই স্পোর্টস কারটায় সাইরেন নেই।’ দাঁতে নখ কাটলেন ফ্রেডি, এবার ওরা চেকপয়েন্টের উদ্দেশে এগিয়ে গেলে খানিকটা সহজ হলেন। ‘আর চিন্তা নেই, বাছারা! আমরা নিরাপদেই পার হয়ে যাব।’
‘দ্য গ্রেট ব্লনডিন কি কখনও পড়ে গেছেন?’ শুধাল টিনা।
‘না। তবে পড়ার দশা হয়েছিল, এক লোককে যখন পিঠে নিয়ে পার হয়েছিলেন। রশিটা ভয়ানকভাবে দুলছিল। তবে নিরাপদেই পৌঁছতে পেরেছিলেন তিনি।
মাথা নাড়ল টিনা।
‘হায় রে, পুরুষ! ওদের মাথার স্ক্রু ঢিলে!’
‘এক মহিলাও স্টাণ্ট করেছিলেন। রশির পেছনদিকে হাঁটেন তিনি, তারপর ব্যাগে মাথা ঢেকে পার হন। আরেকবার পিচের ঝুড়িতে পাজোড়া ঢুকিয়ে রশি পেরিয়েছিলেন।’
‘টাকা কামানোর কতরকমের ফন্দি!’
‘ঠিক কথা, টিনা,’ খুশির হাসি হাসলেন ফ্রেডি। ‘আমি অনেক টাকা কামাচ্ছি, তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নয়।’
এক সার বুথের দিকে গাড়ি এগিয়ে চলল ওদের, বাতাসে পতপত করে বহুবর্ণ পতাকা উড়ছে ওখানে। উর্দি পরা কর্মকর্তারা সেতু থেকে নেমে আসা যানবাহনের চালক আর যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
‘তোমরা কোন কথা বোলো না, যা বলার আমি বলব,’ বললেন ফ্রেডি, এক বুথের কাছে গাড়ি থামালেন। বেরিয়ে, এক অফিসারের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপ সারলেন। গাড়ির ভেতর থেকে ওরা শুধু তাঁর দিলখোলা হাসির শব্দটাই শুনল।
‘এটা হাসির ব্যাপার নয়,’ বলল টিনা। ‘জন হয়তো ইতিমধ্যেই পালিয়েছে।’
‘কীভাবে পালাবে ওই দুই পালোয়ানের হাত থেকে? কিন্তু ফ্রেডি এত দেরি করছেন কেন!’
শেষমেশ গাড়িতে এসে বসলেন ফ্রেডি, এবং কাছের এক পার্কিং লটে চালিয়ে নিয়ে গেলেন।
‘আমাকে কাস্টম্স অফিসে ডেকেছে। এখুনি আসছি। তোমরা থাকো এখানে।’
‘জনের পার্টনারের ব্যাপারে অফিশিয়ালরা কিছু জানাল?’
‘না। ওকে এখনও ধরতে পারেনি।’
কাস্টম্স্ অফিসে ঢুকলেন ফ্রেডি। দীর্ঘ মুহূর্তগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে, তাঁর ফেরার নাম নেই। এত দেরি হচ্ছে কেন? অবশেষে কাস্টম্স্ বিল্ডিং থেকে বেরোলেন তিনি, মুখে চওড়া হাসি, এদিকেই আসছেন এক অফিসারের সঙ্গে।
‘বেরিয়ে এসো, বাছারা! তোমাদেরকে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।’
বেরনোর সময় টিনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চাইল কিশোর। কর্মকর্তাটি তাঁর ক্লিপবোর্ড দেখে নিলেন, এবার খুঁটিয়ে নিরীখ করলেন ওদের মুখগুলো।
‘তোমার জন্ম কোথায়?’ প্রশ্ন করলেন টিনাকে।
‘উইনিপেগ।’
‘যুক্তরাষ্ট্রে কোন কিছু নিয়ে এসেছ?’
‘না, স্যর।’
‘চব্বিশ ঘণ্টার বেশি থাকছ?’
‘না।’
একই প্রশ্ন করলেন কিশোরকেও। ওদেরকে আরও দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করে, ফ্রেডির গাড়িতে চিরুনি তল্লাশী চালালেন কর্মকর্তাটি। এবার মাথা ঝাঁকিয়ে, সন্তুষ্ট হয়ে হেঁটে চলে গেলেন।
‘আর চিন্তা নেই,’ খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলেন ফ্রেডি। ‘চলো।’
সগর্জনে ইঞ্জিন চালু করে, রীতিমত ধোঁয়া তুলে সবেগে পার্কিং লট থেকে ছিটকে বেরোলেন গাড়ি নিয়ে।
‘এটা সত্যিই আমেরিকা?’ বলল টিনা, প্রশস্ত রাস্তার পাশে সারবাঁধা হোটেল আর দোকানগুলো দেখে হতাশা বোধ করল ও। ‘একদম কানাডার মতই তো।’
ফ্রেডি মুচকি হাসলেন।
‘হতে পারে, তবে এটা আমার দেশ। আমি এখানে এলে স্বস্তি পাই।’
‘ও, হ্যাঁ, ভুলেই গেছিলাম। আপনি তো আমেরিকান,’ বলল কিশোর।
স্পোর্টস্ কারটা সাঁই করে বাঁক নিতেই সিটে আরও চেপে বসল টিনার হাতের আঙুলগুলো। ভ্রূ কুঁচকে গেছে ওর।
‘আপনি আমেরিকান, জানতাম না তো,’ বলল ও।
‘হ্যাঁ, আমার জন্ম স্যান ফ্রান্সিসকোয়। দেশে যখন এসেই পড়েছি, সবার আগে ওখানেই যাব আমি।’
‘আপনি আর কানাডায় ফিরবেন না?’
‘অবশ্যই ফিরব। আমি তো স্রেফ ছুটি কাটানোর কথা বলছিলাম।’
দালানগুলো পেছনে ফেলে, এক পার্কে গাড়ি নিয়ে ঢুকল ওরা। বছরের এসময়টায় পার্ক প্রায় ফাঁকা। দু’একজনকে হঠাৎ- হঠাৎ চোখে পড়ছে, কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে, এছাড়া পার্কটাকে নির্জনই বলা যায়। এক রাস্তা দিয়ে চওড়া এক নদীর কাছে চলে এল গাড়িটা।
‘এটা কি নায়াগ্রা নদী?’ কিশোরের প্রশ্ন।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালেন ফ্রেডি।
‘এটা উতরাইগুলো দিয়ে বইছে, তারপর গিয়ে পড়ছে জলপ্রপাতে। নদীর ওপারে, ওই যে গাছগুলো দেখছ, ওটা কানাডা।’
টিনা নদীটার উদ্দেশে এক ঝলক চেয়ে, দৃষ্টি ফেরাল ফ্রেডির দিকে।
‘পার্কে এফবিআই অফিস, কেমন অদ্ভুত না! যাকগে, আপনি ওদেরকে তো একটা ফোন করতে পারতেন।’
‘ঠিকই বলেছ, টিনা।’ ফ্রেডি স্টিয়ারিং হুইল ঘোরালেন এবং গাড়িটা এক ফাস্ট-ফুড স্ট্যাণ্ডের পেছনে থেমে দাঁড়াল। লট-এ আর কোন গাড়ি নেই। ‘তোমরা বসো, আমি ফোন করে আসি। কিছু খাবে?
‘আমার জন্যে একটা হট ডগ, প্লিজ,’ কিশোর বলল।
টিনা মাথা নাড়ল।
‘আমার কিছু লাগবে না, ধন্যবাদ।’
ফ্রেডি চলে গেলে, চিন্তামগ্ন টিনা গাল ঘষল।
‘মনে আছে হীরেগুলো আবিষ্কারের ব্যাপারে তখন আমার সন্দেহের কথা বলেছিলাম? এখন আবার কেমন-কেমন লাগছে যেন।’
‘এই ট্রিপটার পেছনে কোন রহস্য আছে ভাবছ?’
মাথা ঝাঁকাল টিনা।
‘আমারও তাই ধারণা। ফ্রেডি আমাদের সাথে ভাল ব্যবহার করছেন, কিন্তু তারপরও মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। ফ্রেডি যদি মাউণ্টিই হবেন, তাহলে কাস্টম্স অফিসাররা আমাদেরকে ব্রিজে অতক্ষণ আটকে রাখলেন কেন?’ বলল কিশোর। চিমটি কাটল নিচের ঠোঁটে।
‘আরেকটা প্রশ্নও আছে: এই স্ট্যাণ্ডে আমরাই একমাত্র কাস্টোমার কেন? এখানকার খাবার কি এতই বাজে?’
‘হয় তা-ই, আর নয়তো বন্ধ।’
‘তাহলে ফ্রেডি এত দেরি করছেন কেন?’
‘হয়তো সাঁতরে এফবিআই অফিসে যাবেন ঠিক করেছেন।’
‘ফ্রেডির পক্ষে সবই সম্ভব।’ টিনা দরজাটা খুলল। ‘এসো, একটু ঘুরে দেখি।’
এসময় শীতল বাতাসের ঝাপটায় নদীতে ঢেউয়ের মাথায় ফেনার মুকুট দেখল ওরা, কিশোর আর টিনা আলগোছে স্ট্যাণ্ডের সামনের দিক লক্ষ্য করে এগোতেই গাছগাছালির পাতাহীন ডালগুলো খটখটিয়ে উঠল। স্ট্যাণ্ডটা বন্ধ পেল ওরা। এক নোটিশ ঝুলছে: সামারে দেখা হবে! কোথাও ফ্রেডির ছায়াও দেখা গেল না।
‘তাহলে গেলেন কোথায় উনি?’ টিনা বলল।
‘মনে হয় বনের ভেতরে,’ বলল কিশোর। ‘দেখো।’
ঘন ঝোপ-ঝাড় ভেদ করে কেউ একজন এগিয়ে আসছে ওদের উদ্দেশে। ফ্রেডি বেরিয়ে আসতেই, পার্ক করে রাখা এক গাড়ির ছাদ দেখল ওরা পলকের জন্য। এবার ঝোপগুলো ফ্রেডির পেছনে বুজে যেতেই, স্মিত হাসলেন তিনি।
‘অপেক্ষা করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ?’ হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকাল টিনা।
‘কী ঘটছে বলুন তো, ফ্রেডি? আপনি তো আসলে মাউন্টি নন, তাই না?’
‘তোমরা আমাকে বিশ্বাস কর না?’
‘করতে চাই, ফ্রেডি, কিন্তু আপনার হাব-ভাব কেমন যেন অদ্ভুত।’
‘ওকে, বন্ধুরা, এখন সত্যি কথাটা বলার সময় এসেছে।’ ফ্রেডি সামনে এগোলেন, হাসছেন দাঁত বের করে, দু’হাত রাখলেন ওদের কাঁধে। ‘কল্পনাও করতে পারবে না তোমরা আমার কতখানি উপকার করেছ।’
খুশির হাসি হাসল টিনা।
‘তাই? এ তো সুখের কথা।’
‘চলো, হাঁটতে-হাঁটতে সব খুলে বলি।’
গাছপালা ভেদ করে চলে-যাওয়া এক সরু পথ ধরে ওদেরকে পেছনে নিয়ে হাঁটা দিলেন ফ্রেডি।
‘সত্যসন্ধানীরা, এসো, খুশিয়াল কণ্ঠে চিৎকার ছেড়ে, গোড়ালীতে গোড়ালী ঠোকার চেষ্টা করলেন।
কিশোরের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চাইল টিনা।
‘ওঁর মাথাটা বোধহয় গেছে, কিশোর,’ ফিসফিস করে বলল। ‘এসো, আমরা ফিরে যাই।’
‘আমার মনে হয় না উনি আমাদের কোন ক্ষতি করবেন। মানুষটা একটু পাগলাটে, তবে বিপজ্জনক নন।’ ওকে আশ্বস্ত করল কিশোর।
আচমকাই ফুরিয়ে গেল পথটা। একপাশ দিয়ে এক মেটে রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে বনভূমির সেই অংশে, কিশোর যেখানে পার্ক করা গাড়িটা দেখেছিল; অপর দিকটায় জমি ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীতীরে। হুইলচেয়ারে বসা এক মহিলাকে দেখা গেল ছোট্ট ডকটার ওপরে, পাইলিং ঘিরে ছোট-ছোট ঢেউ ভাঙতে দেখছেন।
মহিলা এবার ঘাড় কাত করে চেয়ে খোশমেজাজে হাত নাড়তেই, বিস্ময়ে শ্বাস চাপল কিশোর।
‘আরিহ, রেজিনা!’
‘অ্যাই,’ গলা ছেড়ে ডাকলেন মহিলা। ‘তোমরা এত দেরি করলে যে?’
ওরা ডকের উদ্দেশে এগোলে মৃদু হাসলেন ফ্রেডি।
‘ওরা ফলসের পেছনদিকটায় যেতে চেয়েছিল, তাই আমরা টে রক হাউসে গেছিলাম। ওরা আমাদের এতবড় উপকারটা করল, তার বিনিময়ে ওটুকু তো ওদের প্রাপ্য।’
‘তা ঠিক, ফ্রেডি। কিশোর অপরাধীদেরও বিনোদনের দরকার আছে।’
রেজিনার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিশোর, বোঝার চেষ্টা করল কী বলছেন তিনি। মহিলা এবার তাঁর হুইলচেয়ারের কুশনের নিচে হাত ঢোকালেন, এবং কিশোর চমকে গেল তাঁর হাতে ছোট্ট এক পিস্তল দেখে।
‘কেউ নড়বে না,’ কঠোর কণ্ঠে আদেশ করলেন তিনি। মুখের চেহারা থমথমে। ‘আমি কিন্তু গুলি চালাতে দ্বিধা করব না।’