রহস্যময় উপত্যকা – ৬

ঝিনুকরা চলেছে সোনাটোলি গ্রামে। এখানকার রাস্তা ঝাঁচকচকে। কাছেই রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র। তাই বোধহয় রাস্তার এত যত্ন।

দীপকাকুও জানেন না এই অভিযানটা কতক্ষণের অথবা কতদিনের। ট্যাঙ্ক ফুল করে তেল নেওয়া হয়েছে গাড়ির। নিজেদের জন্য শুকনো খাবার, জল সব মজুত করা হয়েছে।

দুরন্ত গতিতে চলা গাড়ির দু’পাশে অনাবিল প্রকৃতি, ছোটছোট টিলা, জঙ্গল, চাষের জমি, পুকুর… হুহু করে হাওয়া ঢুকছে জানলা দিয়ে। প্রকৃতির রূপে এমনই মুগ্ধ হয়ে পড়েছে ঝিনুক, ভুলেই গেছে অভিযানের লক্ষ্য।

ইতিমধ্যে দীপকাকু আরও কিছু তথ্য দিয়েছেন, এই আদিবাসী অঞ্চলে একসময় ওয়াংগ নামে এক গোষ্ঠী বসবাস করত। অনুর্বর জমি, জমিদারদের অত্যাচার, অসহ্য হয়ে উঠেছিল তাদের কাছে। এসব ১৯০০ সালের গোড়ার কথা, ওই গোষ্ঠীতে ধুনিরাম নামে একটি ভবঘুরে লোক ছিল। সে একবার পাহাড়ের ওপার থেকে ঘুরে এসে খবর দিল এমন একটা জায়গার, যেখানে ভগবান থাকেন, সেখানে কোনও কষ্ট নেই, অত্যাচারও নেই, অজস্র ফল, ফুল, সেখানে সর্বদা দিন। ধুনিরামের কথা গোষ্ঠীর লোক প্রথমে বিশ্বাস করেনি। ওই গোষ্ঠীর এক মহিলার একদিন ভর হল। ঘোর অবস্থায় উনি জানালেন, ধুনিরামের ঘুরে আসা জায়গাটা তিনি দেখতে পাচ্ছেন। ধুনিরাম যা বলেছে সব সত্যি।

দীপকাকু এত দূর এসে মন্তব্য করেছেন, ভর হওয়া বলতে লোকে বোঝে ভূতে পাওয়া। আসলে এক ধরনের মনোরোগ। দুঃখ, কষ্টে জর্জরিত মহিলার মনে ধুনিরামের বর্ণনা প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছিল।

গোষ্ঠীর মাতব্বররা ঠিক করে ধুনিরামকে সামনে রেখে তারা ওই উপত্যকায় যাবে। নিজেদের জমি, বসত ফেলে রেখে পুরো গোষ্ঠীটাই চলে যায় পাহাড়ের ওপারে। তারপর সেই জাতির আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। …দীপকাকু এসব জানতে পেরেছেন রামেন্দুবাবুর বাড়ি থেকে নেওয়া বইগুলো পড়ে। দীপকাকুর ধারণা লুলারাম, ধুনিরামদের কেউ। ওয়াংগ গোষ্ঠীর শেষ প্রতিনিধি। যে ফিরে এসেছিল পাহাড়ের এপারে। খুব ছেলেবেলায়, সঙ্গে হয়তো বাবা ছিলেন। তিনি মারা গিয়েছেন।

সব শুনে ঝিনুক বলেছিল, “আপনি যাই বলুন, একশো পনেরো বছর বাঁচাটা আমার কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছে। তারপর আবার লোকটা নাকি খুবই ইয়ং।”

দীপকাকু বলেছেন, “খুব একটা অসম্ভব কিছু নয়। উজবেকিস্তান, ইজরায়েল এরকম বেশ কয়েকটা দেশের মানুষ আশি, নব্বই বছর অনায়াসে বাঁচে। কারণ তাদের ফুড হ্যাবিট এবং ক্লাইমেট।”

ঝিনুক আর কোনও তর্কে যায়নি। কেসটা নিয়ে সে এখন মাথা ঘামাচ্ছে না। এই সুযোগে বেড়িয়ে নিতে পেরে তার বেশ ভালই লাগছে।

সোনাটোলিতে পৌঁছে গেল ঝিনুকরা। পাথুরে জমি, শালসেগুনের মাঝে পরিচ্ছন্ন একটি আদিবাসী গ্রাম। গাড়ি ঢুকতে দেখে দৌড়ে এল কচিকাঁচার দল এবং কিছু কৌতূহলী মানুষ। দীপকাকু মোড়লের খোঁজ করলেন। ঝিনুকদের ঘিরে থাকা মানুষগুলো নিয়ে গেল মোড়লের বাড়ি।

উঠোনে দড়ির খাটিয়ায় বসতে দেওয়া হল ঝিনুকদের। বৃদ্ধ মোড়ল এলেন। ওঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, লুলারাম বেশ কিছুদিন হল গ্রামে ফিরেছে। কাল দুই বাবু এসেছিলেন, লুলারামের সঙ্গে কথা বললেন। তাঁদের মধ্যে সাদা চুল, দাড়িওলা বাবু আজ সকালে এসে, লুলারামকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন কোথায়, কেউ জানে না।

“তিন মাথা পাহাড় কোন দিকে?” জানতে চান দীপকাকু। কেউ কিছু বলতে পারে না। একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। আশা ছেড়ে দীপকাকু বলেন, “আজ ওরা কোন রাস্তায় গিয়েছে?”

গ্রামের দু’-একজন হাত তুলে দিকনির্দেশ করে। একটুও সময় নষ্ট না করে গাড়ি লক্ষ করে এগিয়ে যান দীপকাকু। কথাবার্তার ফাঁকে ঝিনুক গ্রামের বাচ্চাদের নিজেদের জন্য নেওয়া বিস্কুট, লজেন্স কিছুটা বিলিয়ে দিয়েছে। গাড়ি ছাড়তেই লজেন্স-ভরা হাতে বাচ্চাগুলো টা-টা করে।

রাস্তা আর আগের মতো ভাল নয়। লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে গাড়ি। দু’পাশে জঙ্গলের ঘনত্ব বাড়ছে। ড্রাইভারটি ভাল পাওয়া গিয়েছে, এরকম অনির্দিষ্ট যাত্রায় একটুও বিরক্ত হচ্ছে না।

ঝিনুক হচ্ছে। কাঁহাতক আর গাড়িতে বসে থাকা যায়! কোমর ধরে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে চারপাশটা ঘুরে দেখলে হত। সামান্য অসহিষ্ণু কণ্ঠে ঝিনুক বলে ওঠে, “সবাই বলছে, ‘সাদা চুল, দাড়িওলা লোক’, আপনি কী সূত্রে ধরে নিচ্ছেন, ওই মানুষটাই ডক্টর নন্দী?”

সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে দীপকাকু বলেন, “হোটেলের বেয়ারাকে একফাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনিশ নম্বর রুমে একটা চিনি ছাড়া চা যেত কিনা? সে বলেছে, যেত।”

ঝিনুকের খেয়াল হয়, “ডক্টর নন্দী সুগারের পেশেন্ট। দীপকাকু ভাল বুদ্ধি খাটিয়েছেন তো! কিন্তু এতে সাদা চুল দাড়ির রহস্য পুরোপুরি মিটল না। প্রশ্নটা করে ঝিনুক। দীপকাকু বলেন, “যতদূর মনে হচ্ছে ডক্টর নন্দীর চুল, দাড়ি সাদাই, কলপ করতেন। এই ক’দিন চুল, দাড়ির কোনও পরিচর্যা হয়নি, তাই এ অবস্থা।”

সম্ভবনাটা বাতিল করা যায় না। পরক্ষণেই ঝিনুকের মাথায় আসে আর-একটা পয়েন্ট। জিজ্ঞেস করে, “ডক্টর নন্দীর পক্ষে কি সম্ভব, রামেন্দুবাবুকে ওভাবে পিছমোড়া করে বাঁধা? হোটেলের লোক যখন বলছে, ওঁকে খুব অসুস্থ লাগছিল।”

“রামেন্দুবাবুকে বেঁধেছে লালু। শুনলে না, মোড়ল বলল, গতকাল দুই বৃদ্ধ এসেছিল লালুর সঙ্গে দেখা করতে। সেই সময় সুযোগ বুঝে লালুকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন ডক্টর নন্দী। হোটেলের নাম, রুম নম্বর সব বলে দেন। লালু তার মালিকের আজ্ঞা পালন করে।”

“কাল লালুর কাছে ওঁরা কেন এসেছিলেন ?”

“লালুকে সঙ্গে নিয়ে তিন পাহাড়টা খুঁজতে যাবেন, ঠিক করতে এসেছিলেন টুর প্রোগ্রাম।”

“ডক্টর নন্দী কেন রামেন্দুবাবুকে চেনালেন লালুর গ্রাম?”

“উনি নিরুপায়, একা কিছু করতে পারছেন না। লালুর সঙ্গে দেখা হলে, সাহায্য পেতে পারেন, সেই আশায় এসেছিলেন।”

ঝিনুক এবার চুপ করে যায়, দীপকাকুর চিন্তাভাবনার নাগাল পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। একদিন ঠিক বিদেশ থেকে বড় কোনও ডিটেকটিভ এজেন্সি দীপকাকুকে বিশাল টাকার অফার দিয়ে নিয়ে চলে যাবে। ঝিনুকের কোনও সুযোগই হবে না দীপকাকুর সঙ্গে লেগে থাকার। এসব ভাবতে ভাবতে আর-একটা কথা মাথায় আসে ঝিনুকের। দীপকাকুকে বলে, “আচ্ছা, তিনমাথা পাহাড়ের হদিশ তো কেউ দিতে পারছে না। ডক্টর নন্দী তা হলে লালুকে নিয়ে গেলেন কোথায়?”

উত্তর আসছে না দীপকাকুর কাছ থেকে। হয়তো আর কোনও প্রশ্ন শোনার ইচ্ছে নেই। ড্রাইভারকে বললেন, গান চালাতে।

ড্রাইভার বলল, তার কাছে সব ওড়িয়া গানের ক্যাসেট।

“তাই চালাও।” বলে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকলেন দীপকাকু।

গান শুরু হল। কথা পুরোপুরি না বুঝলেও সুরটা বেশ ভাল লাগে ঝিনুকের।

এভাবে কতটা পথ চলা হল, কে জানে! হাওয়া আর আগের মতো আরামদায়ক নেই। রোদও উঠেছে বেশ। একটু খিদেখিদে পেতে, ঝিনুক ঘড়ি দ্যাখে, দুপুর একটা ! দীপকাকুকে বলতে যাবে, এবার লাঞ্চটা সেরে নিলে হত। …তার আগেই দীপকাকু জানলার বাইরে হাত তুলে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেন, “ওটা কী ফ্যাক্টরি?”

দীপকাকুর আঙুল বরাবর তাকিয়ে ড্রাইভার বলে, “স্টিল প্ল্যান্ট।”

“ওখানে যারা কাজ করে, কোথা থেকে আসে?”

“অফিসাররা কোয়ার্টারে থাকেন। লেবাররা আশপাশের “” গ্রামের।

“কতদিন হল ফ্যাক্টরিটা হয়েছে?”

“অনেক পুরনো দিনের কারখানা। সেই ইংরেজ আমলের। পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে।”

“কী?” দীপকাকু ফের শুনতে চান কথাটা।

ড্রাইভার রিপিট করে। সঙ্গে যোগ করে, “ওই কারখানা তৈরি হওয়ার গল্প আমি ঠাকুরদার মুখে শুনেছি।”

ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গাড়ি দাঁড় করাতে বলেন দীপকাকু। বিশেষ কিছু একটা চোখে পড়েছে।

গাড়ি দাঁড়ায়। ঝিনুক কৌতূহলী গলায় জানতে চায়, “কী হল?” গাড়ি থেকে নামলেন না দীপকাকু, আঙুল তুলে বলেন, “ওই দ্যাখো!”

ঝিনুক প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারে না। টিলা, জঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখার নেই। যা এতক্ষণ ধরে দেখে এসেছে। খুঁটিয়ে লক্ষ করতে গিয়ে টের পায়, দীপকাকু আসলে কী দেখাচ্ছেন। স্টিল প্ল্যান্টের পাশে দুটো ছোটছোট টিলা।

দীপকাকু পাশ থেকে বলেন, “তিন মাথাওলা পাহাড়। একটা পাহাড় ভেঙে ফ্যাক্টরি হয়েছে।’ >>

আরও ঘণ্টাখানেক গাড়ি চলার পর, ঝিনুকরা পৌঁছোল পাহাড় আর স্টিলপ্ল্যান্টের পিছনে। নির্জন বনাঞ্চল। খিদের কথা ভুলেই গিয়েছে ঝিনুক। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের অভিযান সম্পূর্ণ হরে।

এ-জঙ্গলে পথ বের করা বেশ কঠিন, ড্রাইভার সবে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, এবার বোধহয় হেঁটেই যেতে হবে। তখনই চোখে পড়ে সামনে আর-একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে ড্রাইভারের পা। বোধহয় ঘুমোচ্ছে।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দীপকাকু বলেন, “মনে তো হচ্ছে ডক্টর নন্দীর গাড়ি।”

ঝিনুকদের ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করায়। তিনজনেই নেমে আসে গাড়ি থেকে৷ ঘুম ভেঙেছে সামনের গাড়ির ড্রাইভারের। খুবই বিরক্ত। ঝিনুকদের ড্রাইভারের সঙ্গে ওড়িয়া ভাষায় কথা বলে সে। যতটুকু বোঝা গেল, তার দুই প্যাসেঞ্জার একজন বুড়ো, অপরজন জোয়ান,গিয়েছে নীচের জঙ্গলে। বলেছিল, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরবে, আড়াই ঘণ্টা হতে চলল, ফেরার নাম নেই। আর কিছুক্ষণ দেখে সে এবার ফিরে যাবে।

দীপকাকু ড্রাইভারটিকে নিরস্ত করেন। বলেন, “তোমরা দু’জনে মিলে গল্প করো, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের নিয়ে আসছি। আমাকে শুধু দেখিয়ে দাও, তোমার প্যাসেঞ্জাররা কোনদিকে গিয়েছে।’ “”

অপর গাড়ির ড্রাইভার খানিকটা এগিয়ে ঢালুর সামনে দাঁড়ায়।

তারপর আঙুল তোলে। দীপকাকু পকেট থেকে বের করেন তাঁর সেই অসাধারণ বাইনোকুলার। দেখতে ছোট, রেঞ্জ সাংঘাতিক।

চোখে দূরবিন লাগিয়ে নীচের জঙ্গল, উপত্যকা খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন দীপকাকু। ঝিনুক খালি চোখেই দেখতে পায়, দূরে মাঠমতো জায়গায় একটা পোড়োবাড়ি, অনেকটা চার্চ টাইপের। ঝিনুক বলে, “বাড়িটা দেখেছেন?”

“হ্যাঁ, আমাদের গন্তব্য এখন ওখানেই। খাবারের ব্যাগ আর জলটা নিয়ে নাও।” বলেন দীপকাকু।

অনেকটা ঢালু বেয়ে, ঝোপঝাড় মাড়িয়ে, বুনো গাছপালার গন্ধ গায়ে নিয়ে ঝিনুকরা এখন চার্চবাড়ির সামনে। বাড়িটার ভগ্নদশা বললে কম বলা হয়। আশ্চর্যভাবে দাঁড়িয়ে আছে!

দুপুরবেলা বলে ঝিনুক তবু ঢুকতে সাহস পাচ্ছে, দীপকাকু সঙ্গে থাকলেও, রাতের বেলায় ঢুকতে পারত না।

প্রেয়ারের ঘরটায় এসে চোখ যায় জানলায়, এক প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। ঝিনুকদের দিকে তাঁর পিঠ।

দীপকাকু বলে ওঠেন, “ডক্টর নন্দী!”

শব্দের প্রতিধ্বনি হয়। ঘুরে দাঁড়ান ভদ্রলোক, ধবধবে সাদা চুল, দাড়ি। ফোটোয় দেখা বিপুল নন্দীর সঙ্গে মেলানো মুশকিল।

দীপকাকু ফের বলেন, “আমি দীপঙ্কর বাগচী। আপনি আমাকে…”

কথার মাঝে ডক্টর নন্দী বলে ওঠেন, “কনগ্র্যাচুলেশন। আপনার কাজে আপনি সফল। আমি কিন্তু ব্যর্থ।”

“কেন?”

“যে-গাছের খোঁজে এখানে এসেছিলাম, তা নেই।”

“ছিল কি কোনওদিন?” জানতে চান দীপকাকু।

“অবশ্যই ছিল। তার যথেষ্ট প্রমাণ এখনও এই প্রাকৃতিক পরিবেশে ছড়িয়ে আছে।”

কথার ফাঁকে ঝিনুক জানতে চায়, “লালু, মানে লালুদা কোথায়?”

“আছে আশপাশে। ওর খুব মন খারাপ। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।” বলে ডক্টর নন্দী দীপকাকুর উদ্দেশে বলেন, “লালুর বয়সটা নিশ্চয়ই বের করে ফেলেছেন, কী করে এতদিন জরা, ব্যাধি ঠেকিয়ে বেঁচে আছে, তা কি জানেন?”

গাড়িতে আসতে আসতে ঝিনুককে যতটুকু বলেছিলেন দীপকাকু, সেটাই খুব সংক্ষেপে বলেন। একই সঙ্গে জানতে চান, “আমার তিনটে বিষয়ে খুব খটকা আছে, ওরা যাকে ভগবান বলত, তিনি আসলে কে? আর গাছ থেকে আলো ঠিকরোনো কি সত্যিই সম্ভব? তিন, সর্বদা দিন বলতে কী বোঝাতে চাইত লালু?”

স্মিত হাসেন বিপুল নন্দী। বলেন, “ভগবান নন, খুব বড় মাপের কোনও উদ্ভিদবিজ্ঞানী। এখানে এসে ডেরা বেঁধেছিলেন। এই বাড়িটা তাঁর। অবশ্যই সাহেব, তাই চার্চ কাম বাড়ি। তিনিই ওই আশ্চর্য গাছের আবিষ্কর্তা অথবা সৃষ্টিকর্তা। সে গাছের ফল, ফুল, পাতা অথবা শিকড়ের নির্যাস প্রয়োগ করে মানুষের বয়স আটকে রাখা যেত।”

“গাছগুলো গেল কোথায়?” জানতে চান দীপকাকু।

ডক্টর নন্দী বলেন, “ভূমিকম্প, প্লাবন, দাবানল কোনও নাকোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ওয়াংগ জাতি পর্যন্ত। কেউ একজন লুলারামকে নিয়ে পালাতে সমর্থ হয়েছিল। লুলারামের শরীরে ততদিনে প্রয়োগ হয়েছে সেই গাছের নির্যাস, যার প্রভাবে আজও সে সজীব।” একটু দম নেন ডক্টর নন্দী।

তারপর বলেন, “এবার আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিই, আলো ঠিকরোনো গাছ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে অসম্ভব। তবে প্রকৃতির রহস্য ভেদ করা বড় কঠিন। তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরটা হচ্ছে, সাহেববিজ্ঞানী অত বছর আগে সোলার এনার্জি কাজে লাগিয়ে এলাকাটা আলোকিত রাখতেন। তার ভাঙা সরঞ্জাম আমি চার্চে পেয়েছি। ভুল বিশ্বাসে হলেও, ওয়াংগ জাতি এখানে চাষবাস করে ভালই ছিল। বিজ্ঞানী ওদের শরীরের উপর ‘এজিং’-এর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালাতেন। সফলও হয়েছেন।” .

“আমার একটা প্রশ্ন আছে?” বলে ওঠে ঝিনুক।

“নিশ্চয়ই, বলো।” বলেন ডক্টর নন্দী।

“আপনার চুল, দাড়ি এমন সাদা হল কী করে! ফোটোয় তো… “

প্রশ্ন শেষ করার আগেই বিপুল নন্দী অনুযোগের সুরে বলেন, “আর বোলো না, রামেন্দুটা এত বদমাইশ, আমাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখত, কখন এক ফাঁকে চুল, দাড়িতে সাদা কলপ করে দিয়েছে।”

এই ভাবগম্ভীর পরিবেশে এখনই হেসে ফেলত ঝিনুক, চোখ ঘুরিয়ে নেয় জানলার দিকে, দেখে, বিষণ্নতার প্রতিমূর্তি একজন মানুষ ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে সামনের জমি দিয়ে।

ঝিনুক আঙুল তুলে জানতে চায়, “ওই কি লালুদা?”

ডক্টর নন্দী বলেন, “হ্যাঁ। ওর কলকাতায় ফেরার ইচ্ছে নেই। আমাকে অপহরণ করার আগে ওকে দু’বার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখনই লালুকে গ্রামে পাঠিয়ে দিই এবং তোমাদের চিঠি লিখি। সোনাটোলি গ্রামেও লালুর মন টিকছে না। এখানেই থেকে যেতে চায়। ওকে একা এই উপত্যকায় ফেলে যাই কী করে!”

দীপকাকু বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করেন, “লোকটা সময় আর স্মৃতির ভারে ক্লান্ত। কী লাভ এই দীর্ঘ জীবনের!”

দীপকাকুর দার্শনিকতায় ঘাবড়ে যায় ঝিনুক, মানুষটার হল কী। এটাও কি পরিবেশের গুণ?

লালু এসে দাঁড়ায় চার্চের দরজায়। মাথা নিচু করে আছে। ডক্টর নন্দী বলেন, “চল, এবার ফিরি।”

মাথা নাড়ে লালু। অর্থাৎ যাবে না। পরিস্থিতির অচল অবস্থা কাটাতে ঝিনুক এগিয়ে যায় লালুর কাছে। বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে, “অনির্বাণের খুব মন খারাপ, তুমি নেই বলে। অনির্বাণ কে বুঝতে পারছ তো লালুদা?”

মাথা হেলায় লালু। অস্ফুটে বলে, “অনিদাদা!”

ঝিনুক দ্বিগুণ উৎসাহে বলে, “চন্দনাটাও রাতদিন ‘কে এল রে লালু, কে এল রে লালু…বলে ডেকে যাচ্ছে।”

লালুর মুখে হাসি ছড়ায়, বয়স আরও যেন কমে যেতে থাকে।

দুপুরে খাওয়াদাওয়া চার্চেই হল। বিকেল গড়াতেই বেরিয়ে পড়ল ঝিনুকরা। লালু এখন আগে আগে হাঁটছে, ওরই যেন কলকাতায় যাওয়ার তাড়া বেশি।

ঢাল বেয়ে অনেকটা উঠে এসেছে ঝিনুকরা। ছোট্ট চাতালে এসে দম নেয়। কী মনে হতে ঝিনুক একবার পিছন ফিরে দ্যাখে। সঙ্গেসঙ্গে শিহরিত হয়। ফেলে আসা উপত্যকায় এখন শেষবেলার আলো। প্রতিটি গাছ যেন জ্বলছে। আলোজ্বলা গাছ!

আর-একটু হলে দীপকাকুকে ডেকে ফেলতে যাচ্ছিল ঝিনুক, সামলায় নিজেকে।

ডক্টর নন্দী বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির রহস্য ভেদ করা বড় কঠিন।’ এইমাত্র প্রকৃতির আশ্চর্য রহস্য ভেদ করেছে ঝিনুক। এই আনন্দ, এই সাফল্য তার একার। সে কারও সঙ্গে ভাগ করবে না।

***