রহস্যময় উপত্যকা – ৫

পরের দিন সকাল। ড্রয়িংরুমে বসে নিউজপেপার দ্বিতীয়বার পড়ছে ঝিনুক। কোনও খবরই মাথায় ঢুকছে না। দীপকাকু গোলপার্কে নেমে যাওয়ার পর আর যোগাযোগ করা যায়নি। যখনই দীপকাকুর মোবাইলে ফোন করেছে ঝিনুক, শুনেছে, সুইচ অফ। রাতে বাড়িতে করেছিল। কাজের মাসি বলল, “ঘুমোচ্ছেন। ডাকতে মানা।”

গতকাল সন্ধে থেকে ঝিনুক ছটফট করছে। দুটো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এসেছে তার মাথায়। দীপকাকু সেটা জানলে অবশ্যই তদন্ত সঠিক লক্ষ্যে এগোবে। কিন্তু কোথায় দীপকাকু! এক-এক সময় এমন উধাও হয়ে যান, যেন এই গ্রহের বাইরে চলে গেছেন।

বাবা ঝিনুকের অস্থিরতা টের পেয়ে বলেছেন, “অত অধৈৰ্য হোস না। দীপঙ্কর সম্ভবত কেসটা সল্ভ করে এনেছে। জিনিয়াসদের মতোই শেষ মুহূর্তে গভীর মনোনিবেশ করেছে নিজের কাজে। সেই কারণেই বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছোনোর আগে তোকে অবশ্যই ডেকে নেবে।”

বাবার প্রবোধ বাক্যে কাজ হয়নি। পয়েন্ট দুটো বড়ই খোঁচাচ্ছে ঝিনুককে। দীপকাকুকে না বলে শান্তি পাচ্ছে না।

গত কাল সন্ধেবেলা ডক্টর নন্দীর কেসের সমস্ত ঘটনাই বাবাকে বলেছে ঝিনুক। বাবা মন দিয়ে শুনে অল্প কথায় মন্তব্য করেছেন, “যুগান্তকারী কোনও আবিষ্কারের জন্য আত্মগোপন করেছেন ডক্টর নন্দী। তাঁর কাজে খামোখা বাধা সৃষ্টি করছিস তোরা।”

“যুগান্তকারী কেন বলছ?” জানতে চেয়েছিল ঝিনুক।

বাবা বলেছেন, “ওই যে, প্রথম চিঠিতে ছিল না, ‘গোটা মনুষ্যকুল জড়িত’— দ্যাখ, হয়তো ক্যান্সারের ওষুধ বের করে ফেলেছেন।”

বাবার সঙ্গে বেশি আলোচনা করা ঠিক নয়। বাস্তবতার সঙ্গে এমনভাবে কল্পনা মিশিয়ে দেন যে, আলাদা করা যায় না। এই মন নিয়ে বাবা যে কী করে এতদিন মিলিটারিতে কাটিয়েছিলেন, কে জানে! ভাগ্যিস যুদ্ধে যেতে হয়নি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় উদ্ধারকার্যে যেতেন।

ঝিনুক একাই এখন কেসের সমস্ত টেনশন নিয়ে বসে আছে। ডক্টর নন্দীও কোনও অজ্ঞাতস্থানে বন্দি হয়ে অপেক্ষা করছেন ঝিনুকদের।

দীপকাকুর পাত্তা নেই দেখে মা খুব আনন্দিত, এখন পর্যন্ত দু’বার বলা হয়ে গেছে, “তোদের এবারের কেসটা খুব ছোটখাটো, না রে? তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল।”

“শেষ হয়নি মা। আমরা নিজেরাই জানি না রহস্য সমাধানে কতটা এগিয়েছি।” বলেছিল ঝিনুক।

তখনই খেয়াল করিয়ে দেন মা, “কাল গানের ক্লাস নিয়ে যেন কোনও রহস্য করতে না দেখি। এই কেসে যাই হয়ে থাক, গানের স্কুল যেন বন্ধ না হয়।”

গান শুনতে খুবই ভালবাসে ঝিনুক, গাইতে একটু-একটু। তবে একগাদা ছাত্রীর মাঝে বসে একটুও গাইতে চায় না। বিশেষ করে যখন কোনও নেকু সাজগোজ করা মেয়ে পাশে বসে বেসুরো গায়।

ফোন বেজে ওঠে। সচকিত হয় ঝিনুক। সোফা ছেড়ে উঠবে

কিনা ভাবে। সকাল থেকে চারটে ফোন এসেছে, একটাও তার নয়। রিং হয়ে যাচ্ছে। উলটো দিকের সোফায় বসে বাবা কী যেন লেখালিখি করছেন। মুখ তুলে বলেন, “যা ধর, মনে হচ্ছে তোর ফোন।”

“কী করে বুঝলে?”

“ইনটিউশন। বহুদিন ধরে ফোনের রিং শুনে এই ক্ষমতাটা আপনিই তৈরি হয়ে যায়। ফোনের আওয়াজের ভিতরে ঢুকে যায় মন। বোঝা যায়, কোনটা নিজের, কোনটা অপরের।”

শুরু হয়ে গেল বাবার জাস্ট-মেড থিয়োরি। ঝিনুক উঠে যায় ফোন ধরতে। সেটের কাছে পৌঁছোনোর আগেই কেটে গেল। অপেক্ষা করে ঝিনুক। ফের বেজে উঠতেই রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলে। অপর প্রান্ত বলে, “কী হল? ফোন ধরতে দেরি হচ্ছে কেন?”

আশ্চর্য, দীপকাকুরই গলা। ঝিনুক বলে, “একটু দূরে ছিলাম।” “রজতদা অফিস বেরিয়ে গিয়েছেন?” “না।”

“গাড়িটা নিয়ে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হসপিটালের কাছে চলে এসো। কাল যেখানে দাঁড় করিয়েছিলাম। তার খানিকটা আগে রেখো গাড়ি।”

“হঠাৎ?”

“দেখা হলে বলব।”

লাইন কেটে দিতেন দীপকাকু, ঝিনুক ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান’ বলে ওঠে। “তাড়াতাড়ি বলো।”

“দুটো জরুরি পয়েন্ট মাথায় এসেছে।

“ক্যারি অন।”

“এক, হতে পারে ডক্টর নন্দী নতুন মোবাইল ফোন কিনেছিলেন,

কিন্তু আপনার নম্বরটা জোগাড় করলেন কী করে? অর্থাৎ আমাদের আগের সিদ্ধান্তই ঠিক ছিল, ফোনটা ডক্টর নন্দী করেননি।”

অপর প্রান্তে দীপকাকু বলেন, “মোটামুটি ঠিক যাচ্ছে। আমি আর-একটা খুচরো পয়েন্ট অ্যাড করছি, সঙ্গে যদি সেলফোন থাকবে, উনি প্রথমবার আমাকে এস টি ডি বুথ থেকে ফোন করেছিলেন কেন?”

ঝিনুক অবশ্য এত গভীরে ভাবেনি। পরের পয়েন্টে যায়, “ডক্টর নন্দীর শেষ নোটে কেটে দেওয়া অক্ষরগুলোর একটা শব্দ আমি বের করতে পেরেছি।”

“কীরকম?”

ঝিনুক বলে, চিঠিতে লেখা ছিল, “চললাম। পাহাড়ের ওপারে। ‘পাহাড়ের’ আগে একটা শব্দ কাটা হয়েছে। শব্দটা হচ্ছে ‘তিন’। তিন পাহাড়ের ওপারে।”

“ভেরি গুড। আমি কাছে না থাকলেই তোমার মাথা ভাল কাজ করে দেখছি।”

প্রশংসা করে এড়িয়ে যাচ্ছেন দীপকাকু, নিজেই মনে হয় ব্যাপারটা ধরতে পারেননি। ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, “বলুন তো কী করে বের করলাম?”

“লালুর আঁকা সব ছবিতেই তিন মাথাওলা পাহাড়।”

ঝিনুক খুবই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ভাগ্যিস দীপকাকু ওর চেহারা দেখতে পাচ্ছেন না। কোন সাহসে মাপতে গিয়েছিল দীপকাকুর বুদ্ধি! অপর প্রান্ত থেকে দীপকাকু বলেন, “নাউ, গেট রেডি। আধঘণ্টার মধ্যে তোমাকে আমি শম্ভুনাথের কাছে এক্সপেক্ট করছি। ড্রেস আগের দিন যা করেছিলে, তাই যেন থাকে।”

ফোন কেটে দিলেন দীপকাকু। ড্রেসের ব্যাপারটা ঠিক বুঝল না ঝিনুক।

আধঘণ্টার আগেই আশুদাকে নিয়ে ভবানীপুরে চলে এসেছে ঝিনুক। গাড়ি দাঁড় করানো হয়েছে হসপিটালের মেন গেটের অনেকটা আগে। দীপকাকুর দেখা নেই।

বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা আটকেছিলেন, ঝিনুক বলেছে, “দীপকাকু বোধহয় অসুস্থ। খোঁজ না নিলে খারাপ দেখায়। যাব আর আসব।”

মেয়ের দস্যিপনা যেমন মায়ের অপছন্দ, কিন্তু তিনি দীপকাকুর প্রতি খুবই স্নেহপ্রবণ। তাই আর আপত্তি করেননি।

গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় ঝিনুক। ঘড়ি দেখে চল্লিশ মিনিট হতে চলল। কেন যে হঠাৎ এখানে আসতে বললেন !

আজও একটা কালো অলটো কার এসে দাঁড়াল ঝিনুকদের গাড়ির পিছনে। মুখ ঘুরিয়ে নেয় ঝিনুক। সেই গাড়িটাই যদি হয়, ড্রাইভার ঝিনুককে দেখে হাসবে।

হাসপাতালের কাষদ গাছ থেকে হলুদ ফুল টুপটাপ ঝরে পড়ছে ফুটপাথে। তাকিয়ে থাকে ঝিনুক। হঠাৎ কানে আসে, “এদিকে চলে এসো।”

মুখ তুলে ঝিনুক দ্যাখে, ওপারের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দীপকাকু হাত নেড়ে ডাকছেন।

দু’পাশের গাড়ি দেখে রাস্তা ক্রস করে ঝিনুক। দীপকাকুর সামনে যেতেই, আপাদমস্তক ঝিনুককে একবার দেখেন।

ঝিনুক বুঝতে পারে, ড্রেস দেখছেন। একই সঙ্গে ঝিনুকের চোখে পড়ে, কাবলিজুতোর বদলে দীপকাকুর পায়ে জগিং শু। ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, “ড্রেস এক রাখতে বললেন কেন?”

উত্তরে দীপকাকু বলেন, “এখন যে অপারেশনে যাচ্ছি, হাত-পা চালাতে হতে পারে।”

চকিতে শরীরের ভিতর টানটান ভাব চলে আসে ঝিনুকের।

উত্তেজনা চেপে জানতে চায়, “কী ধরনের অপারেশন?”

ফুটপাথে অতিরিক্ত লোক চলাচলের দরুন ধারে সরে যান দীপকাকু। ঝিনুকও এসে দাঁড়ায়। দীপকাকু বলেন, “শোনো, আমার ধারণা রামেন্দুবাবুর বাড়িতেই আছেন ডক্টর নন্দী। তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।”

“আপনি শিয়োর?” ভীষণ অবাক হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে ঝিনুক।

দীপকাকু হাত তুলে বলেন, “আস্তে। ধরে নাও নাইনটি পারসেন্ট।”

“কী করে এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন?”

“সেটা বলতে গেলে এখন অনেকটা মূল্যবান সময় খরচ হয়ে যাবে। শুধু এটুকু বলি, কাল যখন আমরা গলির মুখে দাঁড়িয়ে একজনের কাছে রামেন্দুবাবুর বাড়িটা কোথায় জানতে চাইলাম, রামেন্দুবাবু দোতলার জানলা থেকে আমাদের দেখে নিয়ে, আমার মোবাইলে ফোন করেন। হাসপাতালের গেট থেকেও দোতলার জানলাটা দেখা যায়। কাল সেটা আমি লক্ষ করেছি, পয়েন্টটা মাথায় আসেনি। “”

“তাই আজ দূরে রাখতে বললেন গাড়িটা?”

“ঠিক। ডক্টর নন্দীর ফোনসেট এখন রামেন্দুবাবুর কাছে। নন্দীর পরিচয় দিয়ে গলা পালটে ফোনটা করেন। তারপর থেকে কানেকশনটা এমনভাবে কেটে রেখেছেন, ফোন-কোম্পানি পর্যন্ত ট্রেস করতে পারছে না। মাটির তলায় অথবা কোনও ভল্টে ঢুকিয়ে রেখেছেন হয়তো। সে যাই হোক, আপাতত আমাদের কাজ হচ্ছে, লুকিয়ে রামেন্দুবাবুর বাড়ি ঢুকে ডক্টর নন্দীকে উদ্ধার করা। ,”

“কাজটা তো পুলিশই করতে পারত। আমাদের লুকিয়ে ঢোকার কী দরকার?” বলে ঝিনুক।

“এই যে বললাম, নাইনটি পারসেন্ট চান্স। টেন পারসেন্ট অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে। যদি ডক্টর নন্দীকে না পায় পুলিশ, আমাকে দু’কথা শুনিয়ে দেবে। একটু থেমে দীপকাকু বলেন, “অ্যাকচুয়ালি কালই আমার বোঝা উচিত ছিল, বাসনটা বিড়াল ফেলেনি, শব্দটা হয়েছিল বাসন ছোড়ার। হয়তো কিছু খেতে দেওয়া হয়েছিল ডক্টর নন্দীকে, উনি বাসনসুদ্ধু ছুড়ে ফেলে দেন। শব্দটা বারবার মনে করে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।”

দীপকাকু কিছুটা যেন কল্পনার আশ্রয় নিচ্ছেন, অকাট্য যুক্তি এখনও দেননি। ঝিনুকের ঠিক যেন বিশ্বাস হতে চায় না, ডক্টর নন্দী এখানেই আছেন। তবু সে জানতে চায়, “আমার এখন কী কাজ?” স্পোর্টস ইনস্ট্রাকটরের মতো দীপকাকু বলেন, “ভাল করে শুনে নাও, তুমি এখন গলির ধার ধরে চলে যাবে রামেন্দুবাবুর পাঁচিলের দরজায়। বেল টিপবে। কাজের লোক এসে খুলবে দরজা। তার সঙ্গে কথা চালাতে থাকবে তুমি, আমি পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকে যাব ভিতরে।”

ছবিটা কল্পনা করতে গিয়ে হোঁচট খায় ঝিনুক, কী করে অত উঁচু পাঁচিল ডিঙোবেন! দীপকাকু নিঃসংশয়ে বলে যাচ্ছেন, “তুমি যতক্ষণ ধরে কথা চালাতে পারবে, আমি ততটাই সময় পাব, ভিতরটা ঘুরে দেখার।”

ঝিনুক ভেবে পায় না কাজের লোকের সঙ্গে অতক্ষণ কী কথা বলবে। জিজ্ঞেস করে, “যদি বেশিক্ষণ আটকে রাখতে না পারি?”

“তখনই দরকার পড়বে হাত-পা ছোড়ার। সে ক্ষেত্রে সামনে যদি রামেন্দুবাবুও পড়েন, দ্বিধা কোরো না।”

ঝিনুকের মুঠি আপনিই পাকিয়ে যায়, রামেন্দুবাবু তাকে অঙ্কে ঘায়েল করেছিলেন, সুযোগ এসেছে প্রতিশোধ নেওয়ার। তবে ভদ্রলোকের চেহারাটা চোখে ভেসে উঠতেই, ঝিনুকের কেমন যেন বাধোবাধো ঠেকে, খুবই সম্ভ্রান্ত, বয়স্ক, জ্ঞানী মানুষ। এসব দিয়ে অবশ্য অপরাধের গুরুত্ব কমানো যায় না।

“কী ভাবছ! লেট্স গো।” দীপকাকু বুড়ো আঙুল তুলে সরে গেলেন। ভঙ্গিটাতে দারুণ স্মার্ট দেখাল। পাঁচিলটা স্মার্টলি ডিঙোতে পারলেই ভাল।

গলিতে লোকজন প্রায় নেই, ধার ঘেঁষে ঝিনুক পৌঁছে যায় দরজায়। বেল টেপার আগে দেখে নিয়েছে দীপকাকুকে, পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক ভাব করে আছেন। বেল টেপার বেশ খানিকক্ষণ পর দরজা খুলল। সামনে দাঁড়িয়ে গতকালের সেই কাজের লোক, সনাতন। পালোয়ান টাইপের চেহারাটা আজ ভাল করে মেপে নিল ঝিনুক। পারবে তো ধরাশায়ী করতে, যা ওজন। নকল হেসে ঝিনুক বলে, “চিনতে পারছ?”

সনাতন ঘাড় হেলায়। পরের কথাটা বলার আগেই ঝিনুক আড়চোখে দেখে নিয়েছে, দীপকাকুর অবিশ্বাস্য স্পটজাম্প। পাঁচিলের মাথাটা ধরে নিমেষে ভিতরে চলে গেলেন।

চোখ বড় অবস্থাতেই ঝিনুক কাজের লোককে জিজ্ঞেস করে, “আমার কাকু এসেছেন? যাঁর সঙ্গে কাল এসেছিলাম।” “না তো!”

“সে কী, আমাকে যে আসতে বললেন।” বলে চিন্তার ভান করে

ঝিনুক। ফের বলে, “তুমি শিয়োর, উনি এসে ঘুরে যাননি?”

“না না। বলছি তো কেউ আসেনি।”

আবার ভাবতে থাকে ঝিনুক। এটা ভান নয়। কথা খুঁজে পাচ্ছে

না। কতক্ষণ এভাবে আটকে রাখতে পারবে কে জানে! ঝিনুক জানতে চায়, “রামেন্দুবাবু বাড়ি আছেন তো?”

“না নেই। বাবু আজ সকালেই দিল্লি চলে গিয়েছেন।

খবরটা একটা বড় ধাক্কা। কোনওক্রমে সামলায় ঝিনুক। বলে, “তা হলে কী হবে, জরুরি দরকারে দীপকাকু রামেন্দুবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসছিলেন।”

“দিন পনেরোর আগে বাবু ফিরছেন না। বলে সনাতন।

ঝিনুক ফের কথা খুঁজে বলে, “আমি এখন কী করি! ওয়েট করব কাকুর জন্য?”

“ওয়েট করে কী হবে! আপনার কাকু এলে আমি না হয় বলে দেব, আপনি বাড়ি চলে গিয়েছেন।’ “”

কথা ফুরিয়ে আসছে। ঝিনুক বলে ওঠে, “না, একটু অপেক্ষা করেই যাই। দীপকাকু এলে একসঙ্গে ফিরব।”

‘যেমন আপনার ইচ্ছে। বাড়ির ভিতরে এসেও বসতে পারেন।”

আতিথেয়তা দেখেই ঝিনুক বুঝতে পারে, পাখি উড়ে গেছে। রামেন্দুবাবু, বিপুল নন্দী দু’জনের কাউকেই পাবেন না দীপকাকু। এতক্ষণ কী করছেন তা হলে?

“কী হল, আসুন।” ডাকে সনাতন।

ঝিনুক বলে, “থাক, আমি এখানেই ওয়েট করছি।’

“ঠিক আছে।” বলে ভিতরবাড়ির দিকে ঘুরে যায় সনাতন। ঝিনুক প্রমাদ গোনে। কাজের লোকটা একটাই ভদ্রতা করছে, খোলা রেখেছে দরজা।

বাগান পেরিয়ে বাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে রামেন্দুবাবুর ষণ্ডামার্কা কাজের লোক। দীপকাকুকে দেখতে পেলে, ছেড়ে কথা বলবে না। অর্থাৎ হাত-পা ছোড়ার সময় হয়ে এল।

খুবই সন্তর্পণে সনাতনকে অনুসরণ করে ঝিনুক। দালানে উঠে বাড়ির মধ্যে অদৃশ্য হয় সনাতন। খানিকটা দৌড়োতে হয় ঝিনুককে। এ-বাড়ির একটা ঘরই ঝিনুক চেনে। কাল এসে যেখানে বসেছিল।

বাড়িতে ঢুকে আসে ঝিনুক। সনাতনকে দেখা যাচ্ছে না, দীপকাকুকে তো নয়ই। তার পরিচিত বৈঠকখানার দিকে এগোয় ঝিনুক। দোরগোড়ায় আসতেই চমকে ওঠে! বুককেসের দিকে মুখ করে দীপকাকু বই হাতে নিয়ে পড়ছেন। সনাতন পা টিপেটিপে এগোচ্ছে দীপকাকুর দিকে। ঠিক যেন একটা টিকটিকি আরশোলা ধরতে যাচ্ছে। ঝিনুক ভেবে পায় না, এখন তার কী করা উচিত। দীপকাকুর ঘাড়ের কাছে পৌঁছে গেছে সনাতন, দু’হাত বাড়িয়েছে যেই, দীপকাকু ঘুরে গিয়ে সজোরে রদ্দা মারেন সনাতনের ঘাড়ে।

কাটা গাছের মতো মাটি নেয় রামেন্দুবাবুর কাজের লোক। পুরো অজ্ঞান, বিস্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে গিয়েছে ঝিনুকের, দীপকাকুর গায়ে এত জোর, জানা ছিল না তো!

হাঁটু মুড়ে বসে দীপকাকু সনাতনের শ্বাসপ্রশ্বাস, হার্টবিট, পাল্স পরীক্ষা করছেন। কৌতূহল দমন করতে না পেরে ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, “কী করে টের পেলেন, লোকটা ধরতে আসছে?”

“বুককেসের কাচে ওর ছায়া পড়েছিল।” গম্ভীরভাবে বলেন দীপকাকু। তারপর উঠে দাঁড়ান। সনাতনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন, “আধঘণ্টার আগে উঠবে না মনে হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ যদি আটকে রাখতে পারতে, খামোখা মার খেতে হত না বেচারাকে।”

ঝিনুক মনেমনে বলে, “আপনিই বা কীরকম মানুষ। ডক্টর নন্দীকে খুঁজতে এসেছেন, না লাইব্রেরিতে ঢুকেছেন বোঝা যাচ্ছে না।”

হাতে ধরা বইটা ছাড়াও দীপকাকু আরও দুটো বই বের করে নিলেন র‍্যাক থেকে। দরজার দিকে যেতে যেতে বললেন, “চলে এসো।”

বাগান ধরে দ্রুত হাঁটছেন দীপকাকু। তাল রাখতে প্রায় দৌড়োতে হচ্ছে ঝিনুককে। দীপকাকু যে ফিজিক্যালি এত ফিট, উপর থেকে বোঝা যায় না। কী জবরদস্ত রদ্দাখানা মারলেন রামেন্দুবাবুর কাজের লোককে! ঝিনুকের গল্পের ডিটেকটিভ আদিত্য রায়কে হার মানিয়ে দেবেন দীপকাকু।

রামেন্দুবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে ঝিনুকরা। সদর পেরোনোর পর পাল্লা বন্ধ করে দিয়েছেন দীপকাকু। এখন অন্যান্য পথচারীর মতো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটছেন। ঝিনুক বলে, “বাড়ির মধ্যে তা হলে পাওয়া গেল না কাউকে?”

“না।”

কাজের লোকটা বলছিল, “বাবু দিল্লি গিয়েছেন। “

“ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মিথ্যেই বলছে সম্ভবত।”

“কোথায় যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”

‘এখনই বলা যাচ্ছে না। আরও কিছু ইনফর্মেশন দরকার। সেই কারণেই বইগুলো নিলাম।”

দীপকাকুর হাতে ধরা বইয়ের নাম পড়ার চেষ্টা করে ঝিনুক। ইংরেজি বই, ওড়িশা সংক্রান্ত। এই বইগুলোর কথাই দীপকাকু কাল বলেছিলেন, রামেন্দুবাবুর বিষয়ের বাইরের বই।

“বাড়ির সব ঘর দেখলেন? ওখানেই ছিলেন ডক্টর নন্দী?’ জানতে চায় ঝিনুক।

“তাই তো মনে হল। একটা চোরাকুঠুরি মতো আছে। ঘরের জিনিসপত্তর দেখে বোঝা যায়, কাউকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।” “জিনিসপত্তর বলতে?”

“মাটিতে বিছানা, ঘরে কোনও আসবাব নেই, থালা, গ্লাস, জলের জগ, ঘুমের ট্যাবলেট, ইঞ্জেকশন।”

“ঘুমের ওষুধ কি আচ্ছন্ন রাখার জন্য?”

“হ্যাঁ।”

“আমরা আসছি জেনেই কি ডক্টর নন্দীকে নিয়ে সরে পড়লেন রামেন্দুবাবু?”

“ধরে নেওয়া যায়। তবে ডক্টর নন্দীকে নিয়ে কোথাও একটা যাওয়ার কথা ছিল রামেন্দুবাবুর। আমাদের জন্য একটু আগেভাগে বেরিয়ে পড়তে হল।”

“কে খবর দিল আমরা আসছি?”

“যে অ্যালার্মের কাঁটা পাঁচটায় সেট করেছিল। রামেন্দুবাবুর সঙ্গে তার গোপন আঁতাত।”

“বুঝেছি, ডক্টর নন্দীর বাড়ির কেউ। কিন্তু কে সে?”

“কেশব। ডক্টর নন্দীর ছেলেদের কাজের লোক।”

খুবই অবাক হয় ঝিনুক। জানতে চায়, “কী করে বুঝলেন?” গাড়ির কাছে এসে পৌঁছেছে ঝিনুকরা। দু’জনেই উঠছে না। গাড়ির মাথায় হাত রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দীপকাকু বলেন, “তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, এক্স-রে প্লেট, প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টগুলো নিয়ে আমি যখন ডক্টর নন্দীর বাড়ি থেকে বেরোলাম, সবচেয়ে কাছের ফোনবুথে ঢুকেছিলাম একবার। তখনই বুথ মালিককে বলি, আমি চলে যাওয়ার পর আধঘণ্টার মধ্যে পাড়ার কারা ফোন করতে আসছে এবং কোন নম্বরে ফোন করছে টুকে রাখবেন। আমার কার্ড দেখে লোকটা কাজের গুরুত্ব বুঝেছিল। সঠিকভাবে নির্দেশ পালন করেছে। কেশবের উপর সন্দেহ আমার আগেই হয়েছিল। লালুর জিনিসপত্তর দেখতে যখন ওদের ঘরে ঢুকেছিলাম, কেশবের বেশ কিছু শৌখিন জিনিস আমার চোখে পড়ে। দামি প্যান্ট, শার্টের পিস, নামী কোম্পানির ঘড়ি, ওয়াকম্যান…নিশ্চিত হয়ে যাই কেশবের হাতে উপরি পয়সা আসছে। আমার ধারণা নির্ভুল ছিল। মিনিটদশেকের মধ্যে ওই বুথে ফোন করতে আসে কেশব। রামেন্দুবাবুর মোবাইল নম্বরে ফোন করে।” “”

কথা শেষ না হতেই ঝিনুক বলে ওঠে, “রামেন্দুবাবু সেলফোন নম্বর তো আমাদের দেননি, কী করে খুঁজে পেলেন?”

“ভেরি সিল, কেশব যে নম্বরে ফোন করেছিল, ফোন কোম্পানিকে বলতেই মালিকের নাম, ঠিকানা বলে দিল।”

“কেশবকে তো এখনই অ্যারেস্ট করা উচিত।” বলে ঝিনুক।

“আর-একটু পরেই হবে। রামেন্দুবাবুকে বাড়িতে যখন পেলাম না, বালিগঞ্জ থানার ওসিকে ফোন করে বলেছি অ্যারেস্ট করতে।” “আমরা কি তা হলে এখন বালিগঞ্জ থানাতেই যাচ্ছি?” জিজ্ঞেস করে ঝিনুক।

“না, আমি এখন একবার অফিস যাব। দু’দিন খোলা হয়নি অফিস। রামেন্দুবাবুর বইগুলো অফিসে বসে পড়ে নেব।”

হঠাৎ যেন রণে ভঙ্গ দিচ্ছেন দীপকাকু। ক্যামাক স্ট্রিটের এক বহুতলের ছোট্ট ঘরে দীপকাকুর ডিটেকটিভ এজেন্সি। কোনও স্টাফ রাখার সামর্থ্য হয়নি এখনও। আগে তেমন কেসটেট্স আসত না, ইদানীং আসছে। এদিকে ডক্টর নন্দীর অন্তর্ধান রহস্য চলে এসেছে শেষ পর্যায়। এই সময় ঢিলে দিলেই রামেন্দুবাবু চলে যাবেন নাগালের বাইরে। দীপকাকুকে বিনীত পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে ঝিনুক বলে, “কেশবকে একবার জেরা করলে ভাল হত না? হদিশ দিতে পারত, কোথায় যেতে পারেন রামেন্দুবাবু।”

“কেশব জানবে না। দরকারমতো কিছু কাজে লাগানো হয়েছিল ওকে। শুধু আদেশ পালন করত। আমাকেই ভেবে বের করতে হবে কোথায় ডক্টর নন্দীকে নিয়ে গেছেন রামেন্দুবাবু। মোটামুটি জায়গাটা আন্দাজ করতে পারলেই রওনা দেব।”

ঝিনুকের কল্পনায় ভেসে ওঠে রাতের মেলট্রেন, সে আর দীপকাকু বসে আছে, যে-কোনও মুহূর্তে কিছু একটা ঘটতে পারে… কল্পনা ভেঙে যায়। হাত তুলে চলন্ত ট্যাক্সি দাঁড় করিয়েছেন দীপকাকু। অর্থাৎ আবার যোগাযোগহীন হয়ে যাবেন। ঝিনুকের একটা দরকারি কথা মনে পড়ে, দীপকাকুকে পিছু ডেকে বলে, “প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টটা কার, কী পাওয়া গেল বললেন না তো?”

ঘুরে দাঁড়ান দীপকাকু, মুখে হাল্কা হাসির আভাস। বলেন, “লালুর রিপোর্ট। ওর বয়স সত্যিই একশোর উপর, প্রায় একশো পনেরো।”

এতই অবাক হয়েছে ঝিনুক, মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না। সেই ফাঁকে দীপকাকু ট্যাক্সিতে উঠে উধাও হয়ে গেলেন।

এবারের কেসে রাতের মেলট্রেনে চড়া হল না ঝিনুকের। পরের দিন সকালে ধৌলি এক্সপ্রেস ধরে মাত্র চার ঘণ্টায় পৌঁছে গেল চাঁদিপুর।

দীপকাকু প্রায় নিশ্চিত, চাঁদিপুরের কোনও হোটেলে ডক্টর নন্দীকে তুলেছেন রামেন্দুবাবু। পুলিশের সাহায্য নিয়ে হোটেলটা খুঁজে বের করতে হবে। তারপর রামেন্দুবাবুকে অ্যারেস্ট এবং ডক্টর নন্দীকে উদ্ধার, এই হল কাজ। আজই হয়তো কলকাতায় ফেরা যাবে।

ট্রেনে আসার পথে এই কেসের অন্ধকার দিকগুলো অনেকটাই কাটিয়ে দিয়েছেন দীপকাকু। যতটুকু পড়ে আছে, আশা করা যায় আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সবটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে অটোরিকশায় উঠল ঝিনুকরা। প্রথমে যাবে লোকাল থানায়। এখানকার পুলিশ কতটা সহযোগিতা করে দেখা যাক

ডক্টর নন্দীর গবেষণার বিষয় ‘এজিং’ অর্থাৎ বয়স কীভাবে থামিয়ে রাখা যায়। অবসর জীবনে বাড়িতে বসেই রিসার্চ চালাচ্ছিলেন। চাঁদিপুরে বেড়াতে এসে সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে যান লালুকে। যে-কোনও ভাবে হোক আন্দাজ করেন, একশো বছর পুরনো যেসব ঘটনার কথা বলছে লালু, সবই স্বচক্ষে দেখা।

লালুকে নিয়ে আসেন বাড়িতে। প্রথমে কনুই, দাঁত, মেরুদণ্ডের এক্স-রে করান, যা থেকে মানুষের বয়স বোঝা যায়। সবক’টা রিপোর্টে নির্ধারিত হয় লালুর বয়স চল্লিশের আশপাশে। বয়সের গতি কমে গেলে এমনটাই হওয়ার কথা। তা হলে কী করে বোঝা যাবে লালুর আসল বয়স?

কিছুদিন পর ডক্টর নন্দীর মাথায় আসে লালুর লিভারের কোষ পরীক্ষা করার ভাবনা। লিভারে জমা থাকে খাদ্যের সঙ্গে আসা হেভি মেটাল। যেমন সিসা।

লালুর লিভারে হেভি মেটালের ডিপোজিট দেখে প্রমাণ হয়, ওর বয়স একশো পনেরোর কাছাকাছি। অথচ দেখতে লাগে চল্লিশের কম। কী করে এমন হল? প্রাণিকোষে টলেমার বলে এক বস্তু আছে, যা কোষ বিভাজিত হতে সাহায্য করে। মানুষের আঠারো-উনিশ বছর বয়সের পর থেকে টলেমারের ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। নতুন কোষের অভাবে বয়স্ক হতে থাকে মানুষ। পৃথিবী জুড়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে জিনকোডের অর্ডার বদলে কী করে টলেমারের ক্ষমতা বাড়ানো যায়। অন্যদিক থেকে পরীক্ষা করা হচ্ছে, বাইরে থেকে কোনও কিছু শরীরে প্রয়োগ করে টলেমারকে সজীব রাখা যায় কিনা।

লালুর যে-সময় জন্ম, জিন টেকনোলজির তেমন উন্নতি হয়নি যে, জিনকোডের কারিকুরি করে বয়স থামিয়ে রাখা যাবে। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটার উপর জোর দেন ডক্টর নন্দী। লালু এমন কোনও ড্রাগ নিয়েছে, যার প্রভাবে বয়স বাড়ছে খুব ধীরে। খুব ছোটবেলায় লালু চলে আসে সোনাটোলি গ্রামে। তার আগে কোথায় ছিল লালু? সেখানকার কোনও ফলমূলের গুণেই কি লালু এখনও সটান, সতেজ! কবিরাজমশাইয়ের কাছে জানা গিয়েছে, ডক্টর নন্দীর এক্সপেরিমেন্টে হলুদ ফল একটা ভাইটাল ব্যাপার ছিল। দীপকাকু পড়াশোনা করে জানতে পারেন, হলুদ ফলের মধ্যে থাকে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, যা বয়স বৃদ্ধি রুখতে সাহায্য করে। ডক্টর নন্দীর ধারণা, ওই জাতীয় কোনও খাদ্য খেয়েছিল লালু। ওর ছেলেবেলার কথা মনে করতে বলতেন ডক্টর নন্দী। লালু আঁকত তিন পাহাড়ের ছবি, যার ওপারে ছিল সেই গ্রাম।

লালুকে নিয়ে গবেষণা চলাকালীন ডক্টর নন্দীর কলেজবেলার বন্ধু রামেন্দুবাবু উদয় হলেন। নিছক আড্ডা মারা ছিল তাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য। মানুষের জিন নিয়ে কাজ করা ডক্টর রামেন্দুর চোখ এড়ায় না ডক্টর নন্দীর এক্সপেরিমেন্ট। বিষয়টা আসলে তাঁর। রিসার্চ ওয়ার্কটা আত্মসাৎ করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন।

ডক্টর নন্দীর শেষ চিঠি আসলে লালুর বলা কিছু কথা, নিয়মিত নোট নিতেন বিপুল নন্দী। নোটবুক চুরি করে রামেন্দুবাবু কিছু শব্দ কেটে দিতে লেখাটা চিঠির মতো হয়ে যায়।

রামেন্দুবাবুর উদ্দেশ্য সম্ভবত টের পেয়েছিলেন ডক্টর নন্দী, সেই কারণেই তড়িঘড়ি লালুকে পাঠিয়ে দেন গ্রামে। আমাদের চিঠি লেখেন। রামেন্দুবাবু মরিয়া হয়ে অপহরণ করেন ডক্টর নন্দীকে। ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঝিমিয়ে রেখেছিলেন, সুগারের ওষুধও দিতেন না। ডক্টর নন্দী এখন কেমন আছেন, কে জানে!

ডক্টর নন্দীকে চাঁদিপুরে নিয়ে আসার কারণ, রামেন্দুবাবু এবার বেরোবেন লালুর ছেলেবেলায় ফেলে আসা গ্রামটা খুঁজতে। যেখানে সর্বদা দিন আর আলো ঠিকরোনো গাছ এবং সেই আশ্চর্য ফল, ফুল নাকি অন্য কিছু, যা বয়সের গতি কমিয়ে দেয়!

ঝিনুকরা পৌঁছে গেল থানায়৷ দীপকাকু ওসির কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। জানালেন ডক্টর নন্দীর অপহরণের কথা।

ওসি ইয়ং এবং চটপটে মানুষ। দ্রুত বেশ ক’টা হোটেলে ফোন করে খবর নিলেন, দুই বৃদ্ধ বোর্ডার অমুক, অমুক নামে কোনও রুম নিয়েছে কিনা?

‘সমুদ্র শোভা’ নামের একটা হোটেল জানাল, গতকাল দুই বৃদ্ধ তাদের হোটেলে উঠেছেন, রামেন্দু মল্লিকের নামটা মিললেও, অপর নামটা মিলছে না। তিনি উমেশ প্যাটেল।

ওসির টেবিলের উলটো দিকে বসে থাকা ঝিনুক পাশের চেয়ারের দীপকাকুকে জিজ্ঞেস করে, “ইনি আবার কে?”

দীপকাকু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, “নাম ভাঁড়িয়েছে, উমেশ প্যাটেলই হচ্ছেন ডক্টর নন্দী।”

দীপকাকুর অনুরোধে ওসি ঝিনুকদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রামেন্দুবাবুকে অ্যারেস্ট করতে।

আধঘণ্টার মধ্যেই সমুদ্র শোভা হোটেলে পৌঁছে যায় ঝিনুকরা। পুলিশের জিপে করে আসার সময় ঝিনুক বহু চেষ্টা করেও কোনও বাড়ি বা হোটেলের ফাঁক দিয়ে সমুদ্র দেখতে পায়নি। ঝিনুক শুনেছে, চাঁদিপুরের সমুদ্র ভাটার টানে বেশ কয়েক মাইল পিছিয়ে যায়, জোয়ারের সময় ফিরে আসে। ভীষণ ইন্টারেস্টিং! কে জানে এবার ফুরসত হবে কিনা সমুদ্র দেখার।

হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে দীপকাকু ডক্টর নন্দীর সেই ফোটোটা দেখালেন, ডক্টর নন্দীর অ্যালবাম থেকে যেটা খুলে নিয়েছিলেন, ফোটোয় লালুও আছে।

ফোটো দেখে রিসেপশনের ছেলেটি বলল, এরকম কোনও লোক তাদের হোটেলে ওঠেনি। রামেন্দু মল্লিকের সঙ্গে যিনি আছেন, সাদা চুল, দাড়িওলা অসুস্থ বৃদ্ধ।

ঝিনুক মুষড়ে পড়ল, দীপকাকু আশ্চর্যজনকভাবে নিজের বিশ্বাসে অটল। বললেন, “আমাদের রামেন্দু মল্লিকের ঘরে নিয়ে চলুন।”

রিসেপশনিস্ট একজন বেয়ারাকে ডেকে বলল, “এঁদের উনিশ নম্বর ঘরে নিয়ে যাও।”

রুমের সামনে এসে দরজায় টোকা মারলেন ওসি, আপনিই খুলে গেল।

ঘরে ঢুকে ঝিনুকরা থ। হাতে-পায়ে দড়ি, মুখে রুমাল বাঁধা অবস্থায় খাটে পড়ে আছেন একজন। যদি খুব ভুল না হয়, মানুষটি রামেন্দু মল্লিক।

দীপকাকুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মিলল না তাঁর আন্দাজ। ওসির নির্দেশে বেয়ারা রামেন্দুবাবুকে বন্ধনমুক্ত করে।

হাঁফাচ্ছেন রামেন্দুবাবু। অনেক কষ্টে ও সি-কে বলেন, “উমেশ প্যাটেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ট্রেনে। বয়স্ক, সজ্জন লোক, উনিও আসছিলেন বেড়াতে। আমরা দু’জনেই একাকী মানুষ, জমে গিয়েছিল খুব৷ হোটেলে এসে একটাই রুম নিলাম দু’জনে। তখন কি জানতাম, লোকটার উদ্দেশ্য ছিল, আমার মূল্যবান কিছু কাগজপত্তর হাতানো।’ “

“এত ইমপর্টেন্ট পেপারস নিয়ে আপনি বেড়াতে এসেছিলেন কেন?” ওড়িয়া ঘেঁষা বাংলায় জিজ্ঞেস করেন পুলিশ অফিসার।

রামেন্দুবাবু বলেন, “ওসব আমার রিসার্চ ওয়ার্ক। সঙ্গে থাকে সবসময়। যখন ইচ্ছে হয় কাজ করি।”

রামেন্দুবাবুর কথায় দীপকাকুর কোনও আগ্রহ নেই। অস্থির পায়চারি করছেন ঘরে। কী মনে হতে বেয়ারাকে একবার ডেকে নেন। কিছু জিজ্ঞেস করেন ফিসফিস করে।

পুলিশ অফিসার খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রামেন্দুবাবুকে নিয়ে। জিজ্ঞেস করেন, “আপনি আমার সঙ্গে থানায় যেতে পারবেন? একটা এফ আই আর যে করতে হয়।”

কোনওরকমে বিছানা থেকে শরীর তোলেন রামেন্দুবাবু। বলেন, “চলুন।”

তখনই একবার রামেন্দুবাবুর চোখে চোখ পড়ে যায় ঝিনুকের, কেন জানি মনে হয় সারা শরীরে অসুস্থতা থাকলেও, রামেন্দুবাবুর চোখটা হাসছে। অঙ্কের ধাঁধা দেওয়ার পর যেমন হাসছিল।

রামেন্দুবাবুকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন ওসি, দীপকাকু সৌজন্য রক্ষার্থে সরিটরি চেয়ে নিলেন।

উত্তরে ও সি বললেন, “সরি তো আমারই হওয়া উচিত, আপনার কাজ করে দিতে পারলাম না। বরং আপনি আমায় হেল্প করলেন একজন বয়স্ক মানুষকে বাঁচাতে। এভাবে দড়ি বাঁধা অবস্থায় আর কয়েক ঘণ্টা পড়ে থাকলে অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারত।”

ঝিনুকের বুঝতে অসুবিধে হয় না, অতি মার্জিতভাবে বিদ্রুপ করে গেলেন ও সি। অপমানে ভার হয়ে আছে দীপকাকুর মুখ।

হোটেলের বাইরে পুলিশের জিপের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই দীপকাকু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বেয়ারাকে বললেন, “একটা ভাড়ার গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে ভাই?”

“এখনই দিচ্ছি।” বলে বেয়ারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।