রহস্যময় উপত্যকা – ৪

নরনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের চেম্বার খুঁজে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হল না। শিয়ালদা ফ্লাইওভারের নীচে একটা অন্ধকার গলির ভিতর ঘুপচি ঘর। চেম্বারে একটি মাত্র পেশেন্ট।

রুগির চেয়ে ডাক্তারের চেহারা বেশি ঝিমোনো। পান খাওয়া লাল ঠোঁট, টিকলো নাক, ইট-চাপা ঘাসের মতো ফরসা মানুষটাকে দেখে, টিয়াপাখির তুলনা মনে আসে। ঝিনুকরা ঘরে ঢুকতেই নারায়ণবাবু চশমার উপর দিয়ে একবার দেখলেন। কিছু বললেন না। ফের মন দিলেন রুগি দেখায়। ওঁর দৃষ্টি বুদ্ধিদীপ্ত এবং ক্ষুরধার।

দেওয়ালঘেঁষা বেঞ্চে বসল ঝিনুকরা। ঘরটা এতই অন্ধকার দিনের বেলায় বাল্ব জ্বালাতে হয়েছে। হলদেটে আলোয় কেমন যেন ছমছমে ভাব। ওষুধের ঝাঁঝালো গন্ধ, কালচে ফার্নিচার, দরজা জানলার প্যাটার্ন সবই পুরনো দিনের। সশব্দে ঘুরছে কার্জন আমলের সিলিং ফ্যান, যেন অতীতের কথা বলছে।

একমাত্র পেশেন্টটি উঠে যেতে দীপকাকু গিয়ে বসেন চেয়ারে। ঝিনুক পাশে দাঁড়ায়। কবিরাজমশাইয়ের টেবিলে কোনও ফোন নেই। থাকলে বেমানান লাগত। ধরে নেওয়াই যায়, বিপুল নন্দীর হারিয়ে যাওয়ার খবর এঁর কাছে পৌঁছোয়নি।

নারায়ণবাবু একইরকমভাবে চশমার উপর দিয়ে ঠায় তাকিয়ে আছেন ঝিনুকদের দিকে। দীপকাকু সবিনয়ে নিজের পরিচয় দেন, বিপুল নন্দীর অন্তর্ধানের কথাটা বলেন। নারায়ণবাবু যে পোড় খাওয়া লোক, তা বোঝা যায়। দীপকাকুর সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনে নিরুত্তাপ গলায় বললেন, “বিপুল নন্দীকে পাওয়া যাচ্ছে না তো আমি কী করব! আপনারা আমার কাছে এসেছেন কেন?”

“যদি আপনি কোনও হদিশ দিতে পারেন। আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ওঁর।” বললেন দীপকাকু।

উত্তরে নারায়ণবাবু বলেন, “সম্পর্ক একটা ছিল ঠিকই, তেমন গভীর কিছু নয়। উনি গাছপালা নিয়ে পড়াশোনা করেন, মাঝেমধ্যে আমার কাছে আলোচনা করতে আসতেন। ব্যস, এই পর্যন্ত।”

সঙ্গেসঙ্গে দীপকাকুর কুটিল প্রশ্নবাণ, “আপনিও যেতেন ডক্টর নন্দীর বাড়ি, সেটাও কি ওঁরই প্রয়োজনে?”

নির্বিকার ভাবটা ধরে রাখতে পারলেন না নরনারায়ণবাবু। কপালে ভাঁজ পড়ল। সতর্ক কণ্ঠে বলতে লাগলেন, “বিপুলবাবু গাছের বীজ নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন, বাগানে সংকর জাতীয় কিছু উদ্ভিদের চাষ করেছিলেন। সেসব দেখতেই ডেকে পাঠাতেন আমাকে।”

“ওঁর গবেষণার বিষয়টা কী ছিল?”

“সেটা আমায় কখনও বলেননি।”

“আপনি কি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিলেন?”

“না।”

নরনারায়ণ কবিরাজের উত্তর শুনে গুম মেরে গেলেন দীপকাকু। একটু সময় নিয়ে আক্রমণাত্মক অথচ ঠান্ডা গলায় বললেন, “আপনি সত্যি কথা বলছেন না। এতবার আপনার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, এমনকী ঝগড়াও হয়েছে কখনও কখনও, কিছুই আন্দাজ করতে পারেননি, এটা হতে পারে না।’ “”

দীপকাকুর কথায় রেগে যাওয়ার বদলে একটু যেন উদাস হয়ে গেলেন নরনারায়ণবাবু। শূন্যে দৃষ্টি রেখে বললেন, “সত্যি বলতে কী, বিপুলবাবুর গবেষণার বিষয় নিয়ে যে ধারণা আমার হয়েছে, তা এতটাই অবান্তর, অবাস্তব, নিজেরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি।”

“কীরকম?” কৌতূহলী হন দীপকাকু।

নরনারায়ণ কবিরাজ বলতে থাকেন, “আমার মনে হয় উনি এমন কোনও গাছের সন্ধানে ছিলেন, যার পাতা, ফল অথবা ফুল কোনও একটা থেকে আলো বের হয়।”

কথাটা শুনে মনের ভিতর প্রবল ঝাঁকুনি খায় ঝিনুক, এ কী আশ্চর্য গাছের খোঁজে ছিলেন ডক্টর নন্দী!

দীপকাকু অতটা চমকাননি। জানতে চাইলেন, “ওরকম কোনও গাছ পৃথিবীতে কখনও ছিল, নাকি উদ্ভিদকোষে পরীক্ষা করে উনি সৃষ্টি করতে চাইছিলেন?”

“আমি জানি না। যতটুকু বললাম তার চেয়ে বেশি আর কিছুই জানতে পারিনি।” বলে প্রসঙ্গের ইতি টানতে চাইলেন নরনারায়ণবাবু।

দীপকাকু সহজে ছাড়ার পাত্র নন। জিজ্ঞেস করেন, “উনি যেসব গাছ, বীজ নিয়ে গবেষণা করতেন, সেগুলো দেশি না বিদেশি?”

“সবই এদেশি। প্রধানত বিহার, বাংলা, ওড়িশার গাছপালা নিয়ে কাজ করতেন।”

“কোন ধরনের গাছ? বৃক্ষ, গুল্ম, নাকি লতানে?”

“মিলিয়ে মিশিয়ে। এতরকম গাছ, নাম বললে আপনি সব চিনতে পারবেন না।”

“যেগুলো পারব, সেগুলো অন্তত বলুন।

“পেঁপে, কুমড়ো, গাজর, আমলকী, আম … বলতে বলতে থেমে গেলেন নরনারায়ণবাবু। মাথার উপর পুরনো আমলের ফ্যানটা ঘটরঘটর শব্দে ঘুরে চলেছে, হাওয়া লাগছে না গায়ে।

কী একটু ভেবে নিয়ে দীপকাকু জানতে চাইলেন, “যেসব উদ্ভিদ নিয়ে উনি কাজ করতেন, তার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও যোগসূত্র আছে। সেটা কী?

এবার স্পষ্ট বিরক্ত হলেন নরনারায়ণবাবু। আচমকা দীপকাকুকে প্রশ্ন করলেন, “আপনি বোটানিক্যাল গার্ডেনে জীবনে ক’বার গিয়েছেন?”

দীপকাকু চুপ করে থাকেন। প্রশ্নটা যে আসলে বিদ্রুপ, সহজেই বোঝা যায়। নরনারায়ণবাবু নিজেই উত্তরটা দেন। বলেন, “নিশ্চয়ই তিন-চারবারের বেশি নয়। গাছপালা বিষয়ে কোনও আগ্রহ নেই আপনার। তদন্তের স্বার্থে সাধারণ জ্ঞান দিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছেন। উদ্ভিদ জগৎ হচ্ছে অনন্ত সমুদ্র। দু’-চার কথায়, ফাঁকিবাজি করে সবটা কি বোঝা সম্ভব?”

মুখের ভাব বদলে গেল দীপকাকুর, যারপরনাই অপমানিত হয়েছেন। একটু সময় নিয়ে পালটা আক্রমণে যান, “আপনার জ্ঞান অগাধ হতে পারে। পসারের কোনও উন্নতি হয়নি। ডিসপেন্সারির অবস্থা এবং এখন অবধি একটিমাত্র পেশেন্ট দেখে সেটা বোঝা যায়।”

ম্লান হয়ে গেল নরনারায়ণবাবুর চেহারা। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, “কলকাতায় এত কবিরাজ থাকতে আপনাদের ডক্টর নন্দী কিন্তু আমার কাছেই আসতেন।”

“এটা আপনি মোক্ষম কথা বলেছেন। এই ধন্ধটাই এখন অবধি আমার কাটল না।” বললেন দীপকাকু।

নরনারায়ণবাবু চলে গিয়েছেন ওষুধের আলমারির সামনে। একটা শিশি তুলে নিয়ে ফিরে এলেন চেয়ারে।

ঝিনুক তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে শিশির উপর, লেবেলহীন, সাদা মলম মতো কী যেন আছে ভিতরে। আঙুল ঢুকিয়ে কিছুটা মলম বের করে আনলেন নরনারায়ণবাবু। দীপকাকুর দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, “এই ওষুধটা আমি তৈরি করেছি। কপালে, চোখের পাতায়, নাকের নীচে লাগিয়ে নিন, মাথা ভাল কাজ করবে।”

ঝিনুক আশ্চর্য হয়ে দ্যাখে, দীপকাকু নির্দ্বিধায় মলমটা নিয়ে নরনারায়ণবাবুর নির্দেশমতো লাগিয়ে নিলেন! তদন্তের কিনারা করতে না পেরে কি দীপকাকুর মাথার অবস্থা এতটাই কাহিল! এভাবে অনুগ্রহ নেওয়াটা মোটেই ভাল লাগে না ঝিনুকের। ঠিক এই সময় মনে পড়ে রামেন্দুবাবুর সতর্কবাণী, ‘কবিরাজ লোকটা মহা ধড়িবাজ’। আশঙ্কিত হয়ে ঝিনুক ফের দীপকাকুকে লক্ষ করে, চেয়ারে ঘাড় হেলিয়ে চেয়ে আছেন সিলিংয়ের দিকে। কীরকম যেন গা-ছাড়া ভাব। একটু পরেই প্রায় নাক ডাকার কাছাকাছি নিশ্বাস ফেলতে থাকেন। জেগে ঘুমিয়ে গেলেন নাকি? ভয়পাওয়া গলায় ঝিনুক ডাকে, “দীপকাকু ! দীপকাকু!”

“উঁ” বলে সাড়া দেন শুধু। রকমসকম সুবিধের লাগে না ঝিনুকের। নরনারায়ণবাবুর দিকে কড়া চোখে তাকায়। মিটিমিটি হাসছেন কবিরাজ। ঝিনুক ঝাঁঝিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে দীপকাকুর? কী ওষুধ দিলেন?”

খুবই তাচ্ছিল্যের স্বরে নরনারায়ণ কবিরাজ বলেন, “কিছুই না। পাঁচ মিনিট এরকম থাকবেন। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার বিদ্যা নিয়ে উনি কটাক্ষ করছিলেন না, সামান্য নমুনা দেখালাম।”

রাগের চোটে মাথা ঝনঝন করছে ঝিনুকের, মনে হচ্ছে নরনারায়ণবাবুকে মার্শাল আর্টের নমুনা দেখালে কেমন হয়। ওঁর শীর্ণ চেহারা দেখে ভয় করে, যদি মরে যান!

“ডাক্তারবাবু আসব?” দোরগোড়ায় কার যেন গলা। ঘুরে তাকায় ঝিনুক, মলিন চেহারার একটা লোক। হয়তো রুগি।

নরনারায়ণবাবু ডাকেন, “আসুন।” তারপর ঝিনুককে বলেন, “তোমরা এখন আসতে পারো।”

বিস্ময়ের গলায় ঝিনুক বলে, “সেকী, এই অবস্থায় দীপকাকু কী করে যাবেন?”

“অনায়াসে যেতে পারবেন। দেখবে?” বলে নরনারায়ণবাবু দীপকাকুকে বলেন, “ও মশাই, এবার তো আপনাদের উঠতে হয়। আমার অন্য কাজ আছে।”

এককথায় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন দীপকাকু। মুখে-চোখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। দরজার দিকে ঘুরে গিয়ে হাঁটতে থাকেন। স্টেপিংটা যা একটু এলোমেলো পড়ছে। ঘুম চোখে মানুষ যেমন হাঁটে।

ঝিনুক দৌড়ে গিয়ে দীপকাকুর হাত ধরে নেয়। পিছনে খুকখুকে হাসির শব্দ, নিশ্চয়ই নরনারায়ণবাবুর।

আধাজাগ্রত দীপকাকুকে নিয়ে গলি পার হল ঝিনুক। ওষুধের ঝাঁঝালো মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছে। বড় ভয় করছে ঝিনুকের, ডোজ বেশি হয়ে যায়নি তো? কখন সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরবে কে জানে!

গাড়ির কাছাকাছি যেতেই আশুদা দৌড়ে আসে। দীপকাকুর ভ্যাবলা ভাবটা ওর চোখেও পড়েছে।

আশুদার সাহায্য নিয়ে দীপকাকুকে গাড়ির সিটে বসাল ঝিনুক। ঘোর এতটুকু কাটেনি। এই সময় এমন একটা কথা বলল আশুদা, হাসার বদলে রেগে গেল ঝিনুক। আশুদা বলে কিনা, “উনি কি দাঁত তুলে এলেন দিদিমণি?”

প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে জানলার বাইরে তাকিয়ে ঝিনুক দ্রুত ভাবতে থাকে দীপকাকুকে নিয়ে এখন কী করা যায়?

হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। দীপকাকুর বুক পকেটের দিকে চোখ যায় ঝিনুকের। ওখানেই আছে ফোনসেট। দীপকাকুর কোনও হেলদোল নেই। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফোন আসার কথা আছে। ফোন তুলে কী বলবে ঝিনুক! ভাবতে ভাবতে দীপকাকুর পকেট থেকে সেটটা বের করে নেয় ঝিনুক। নম্বরটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত দুর্ভাবনা যায় উবে। সুইচ টিপে কানে ফোন লাগিয়ে ঝিনুক বলে ওঠে, “বাবা!”

তড়িৎগতিতে একটা হাত এসে ছিনিয়ে নেয় ফোনসেট। হাতটা দীপকাকুর। সোজা হয়ে বসেছেন। ফোনে বাবাকে বলেন, “রজতদা, আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, ঘণ্টাদুয়েক পর ফোন করুন।”

ওষুধের প্রভাব কেটে গিয়েছে৷ দীপকাকু এখন সজাগ। ফোন কেটে কপালে ভাঁজ ফেলে বসে আছেন। ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছিল আপনার?”

উত্তরে দীপকাকু বলেন, “নরনারায়ণ কবিরাজের ওষুধ বেশ ভালই কাজ করে দেখলাম। চিন্তাভাবনাগুলো জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠেছিল এতক্ষণ।”

“আপনি এই সময়টা চিন্তার জগতে ছিলেন!” অবাক কণ্ঠে বলে ওঠে ঝিনুক।

“ইয়েস। এবং আমি এখন বেশ কিছু সূত্রের মোটামুটি একটা মানে করতে পারছি।”

যেমন?” জানতে চায় ঝিনুক।

দীপকাকু বলেন, “নম্বর ওয়ান, ডক্টর নন্দীর কেসের সঙ্গে ওড়িশা রাজ্য জড়িয়ে আছে।”

প্রায় আকাশ থেকে পড়ে ঝিনুক। মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, “ঠিক বুঝলাম না।”

দীপকাকু বলতে থাকেন, “রামেন্দুবাবুর বুককেসে ওড়িশার আদিবাসী ও ভূপ্রকৃতি বিষয়ক বই দেখলাম। নরনারায়ণ কবিরাজ বললেন, বিপুল নন্দী বাংলা, বিহার, ওড়িশার গাছ নিয়ে গবেষণা করতেন। এবং সব শেষে বিপুলবাবুর কাজের লোক লালু ওড়িশার লোক। সে এখন দেশে ফিরে গিয়েছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে সব ক্ষেত্রেই কমন থেকে যাচ্ছে এই রাজ্যটা। নম্বর টু, যেসব গাছ নিয়ে গবেষণা করছিলেন ডক্টর নন্দী, ফলগুলোর রং হলুদ। শুধু আমলকী বাদে। তা হলে এটাও বোঝা যাচ্ছে, ওঁর গবেষণায় হলুদ ফলটা কমন। এখন দেখতে হবে, ওড়িশার ভূপ্রকৃতি এবং হলুদ রং বায়োটেকনোলজির ক্ষেত্রে কতটা ও কী কারণে জড়িত। “”

“এ বিষয়ে আমরা কোনও বায়োটেকনোলজিস্টের সঙ্গে কথা বলতে পারি।” পরামর্শ দেয় ঝিনুক।

“সমস্যা আছে। ডক্টর নন্দী যদি নিজের এক্সপেরিমেন্টে অনেক দূর এগিয়ে থাকেন, তাঁর কাজকর্মগুলো অন্য কারও হাতে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না। অপর বিজ্ঞানী বাকি কাজটুকু করে আবিষ্কারটা নিজের বলে চালিয়ে দেবে। সেই কারণেই ফ্লপিগুলো বাপ্পার কম্পিউটারে ফেলে নিজেই দেখেছি। আরও একবার ইন্টারনেট খুলে খুঁজতে হবে হলুদ ফলের গুণাগুণ।”

দীপকাকুর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না ঝিনুক। হলুদ রঙের ফল, ওড়িশা, এসবের সঙ্গে ডক্টর নন্দীর অন্তর্ধানের কী সম্পর্ক কে জানে! গোটাটাই কেমন যেন সংকেতময়। আপশোস হয় ঝিনুকের, সেও যদি নরনারায়ণ কবিরাজের ওষুধ খানিকটা লাগিয়ে নিত, বিষয়টা ধরতে পারত সহজেই।

দীপকাকু অনেকক্ষণ চুপ করে আছেন দেখে, ঝিনুক মুখের দিকে তাকায়, এ মা, নিজের মনেই মিচকি মিচকি হাসছেন!

“কী হল, হাসছেন যে বড়!” বলে ঝিনুক। হাসি চওড়া করে দীপকাকু বলেন, “এই কেসের আর-একটা জট প্রায় খুলে ফেলেছি।”

ঝিনুক প্রশ্ন না করে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকে। দীপকাকু জানতে চান, “আলো ঠিকরোনো গাছ সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা? এটা কোনও আষাঢ়ে গল্প নাকি সত্যিই ওরকম কোনও গাছের সন্ধানে অথবা সৃষ্টিতে ব্যস্ত ছিলেন বিপুল নন্দী?”

“অবশ্যই বোগাস গল্প। নরনারায়ণবাবু আমাদের কনফিউজ্ করতে গল্পটা ফেঁদেছেন।” ঝিনুক তার মতামত জানায়।

মাথা নাড়েন দীপকাকু। একটু চুপ থেকে বলেন, “নরনারায়ণবাবু মোটামুটি ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছেন, ডক্টর নন্দী কী নিয়ে রিসার্চ করছেন। আমাদের সেটা বলেননি। আলো ঠিকরোনো গাছের ব্যাপারে নরনারায়ণবাবু নিজে এতটাই অন্ধকারে যে, মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন আমাদের। এবং নিশ্চিত ছিলেন, আমরা বিষয়টাকে গুরুত্ব দেব না। আমি কিন্তু দিচ্ছি।

আমার ধারণা ডক্টর নন্দী ওই আশ্চর্য গাছের সন্ধানে ছিলেন।”

“এরকম ধারণা হওয়ার কারণ?” জানতে চায় ঝিনুক।

দীপকাকু প্যান্টের পকেট থেকে বের করেন পার্স, ভিতর থেকে বেরোয় ডক্টর নন্দীর সেই নোট যেটা ওঁর টেবিলে রাখা ছিল। দীপকাকু বলেন, “দ্যাখো, কী লেখা আছে, ‘চললাম। পাহাড়ের ওপারে। যেখানে সর্বদা দিন ’ কাগজটা ফের পার্সে রেখে, প্যান্টের পকেটে চালান করতে করতে দীপকাকু বলেন, “লাইনগুলো পড়লেই একটা পাহাড়ি উপত্যকা ভেসে ওঠে চোখে। ‘যেখানে সর্বদা দিন’ বাক্যটা খেয়াল করো, এমন হতেই পারে আলোজ্বলা গাছগুলোর জন্যই সেখানে সর্বদা দিন।”

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছে ঝিনুক। কী করে এমন যোগসূত্র বের করে ফেললেন দীপকাকু! প্রশংসাটা কি নরনারায়ণ কবিরাজের প্রাপ্য? একই সঙ্গে ঝিনুক খেয়াল করে, সূত্রটা দীপকাকুর ধারণাকে নস্যাৎ করছে। পয়েন্টটা তোলে ঝিনুক, “তা হলে যা বোঝা গেল, বিপুল নন্দী স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়েছেন। পাড়ি দিয়েছেন সেই উপত্যকায়।”

“না। যদি তিনি সত্যিই অভিযানে বেরোতেন, সঙ্গে ছোটখাটো লাগেজ থাকত। জামাকাপড়, ওষুধপত্তর, শেভিং কিট, পেস্ট, ব্রাশ কিছুই নেননি।”

ঝিনুক ভাবে, ঠিকই তো, যুক্তি আছে দীপকাকুর কথায়।

আশুদা স্টিয়ারিংয়ের সামনে বসে উসখুস করছে। গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে লাগাতার আলোচনা তার পছন্দ হচ্ছে না। জিজ্ঞেস করে বসে, “এবার কোথায় যেতে হবে?”

ঘড়ি দেখেন দীপকাকু। অধৈর্য হয়ে বলেন, “ফোনগুলো কেন আসছে না বলো তো!”

ঝিনুক সুর মেলায়, “অমিতেশবাবুর কাছ থেকেও তো কোনও ফোন এল না। ধরে নেওয়া যায়, মুক্তিপণ চেয়ে এখনও অবধি কোনও কল আসেনি।”

“অমিতেশবাবু কোনও কম্মের নন। আমার কার্ডটা হারিয়েছেন। যখন ফোন করেছিলাম, আমার নম্বরটা জেনে রাখলেন না। আমিও কিছু কম যাই না, বলতে ভুলে গেলাম।” দীপকাকুর গলায় বিরক্তি। ফের বলেন, “বেশি চিন্তাভাবনা করলে আমার আবার খিদে পেয়ে যায়। বেশ বেলাও হল, চলো, লাঞ্চটা সেরে নিই।”

কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে আশুদা। জিজ্ঞেস করে, “কোন দিকে যাব?”

“কলেজ স্ট্রিট চলো৷” বলেন দীপকাকু। কলেজ স্ট্রিটে লাঞ্চ? সপ্রশ্ন চোখে দীপকাকুর দিকে তাকায় ঝিনুক।

সিটে গা ছেড়ে দিয়ে দীপকাকু বলেন, “কলেজ লাইফে মা সারদা পাইস হোটেলে দুপুরে খেতাম, শুক্তো, মুড়িঘণ্ট, নারকোল দিয়ে ডাল, বড়ির ঝাল, একেবারে মুখে লেগে থাকবে। “

ঝিনুকের মুড অফ হয়ে যায়, এসব রান্না তো বাড়িতেই খায় লোকে। বাইরে এসব খাওয়ার কোনও মানে হয়! আশুদার মুখটাও কেমন যেন ম্যান্ডামারা টাইপের হয়ে গেছে।

হোটেলে বসে ঝিনুক দীপকাকুর আসল উদ্দেশ্য টের পেল। ওড়িশার প্রচুর লোক এ হোটেলে কাজ করে, বালাশোর জেলার একজনকে বেছে নিলেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওই জেলার সম্বন্ধে জানলেন। সব কথায় মন দিতে পারল না ঝিনুক, রান্নার টেস্ট সত্যিই অসাধারণ। একদিন মাকে নিয়ে এসে খাওয়ানোর কথাও ভাবল ঝিনুক। অনেক পুরনো রেসিপি মনে পড়ে যাবে মায়ের।

হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে ঝিনুক প্রথমেই দীপকাকুকে প্রশ্ন করল, “বালাশোর জেলা নিয়ে এত এনকোয়ারি করছিলেন কেন?”

হোটেল থেকে নিয়ে আসা মৌরি মুখে ফেলে দীপকাকু বলেন, “একটু হোমওয়ার্ক করে নিলাম। আমরা এখন যাব বিপুল নন্দীর পাড়ার বন্ধু বিশ্বনাথবাবুর কাছে। উনি ডক্টর নন্দীর সঙ্গে বালাশোর জেলার চাঁদিপুরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ডক্টর নন্দীর কাজের লোক লালুকে ওখান থেকেই নিয়ে আসা হয়। ওড়িশার বালাশোরে গিয়ে আর কী কী করেছিলেন ডক্টর নন্দী, বিশ্বনাথবাবু বলতে পারবেন।”

গাড়িতে গিয়ে বসেছে ঝিনুকরা। আশুদাকে ডোভার লেন যাওয়ার কথা বলে চোখ বুজেছেন দীপকাকু। এত টেনশন, কাজের মাঝে কী করে যে ঘুম আসে কে জানে!

ঘুম অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। ফোন বেজে উঠল। জেগে উঠে ফোন কানে নিলেন দীপকাকু। ঝিনুকদের গাড়ি পৌঁছেছে ধর্মতলা ক্রসিংয়ে। চারপাশে বড্ড হইচই। ফোনে দীপকাকু কী কথা বলছেন ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছে না।

তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল কথোপকথন। একটু নিরাশভাবে ফোনটা পকেটে রাখলেন দীপকাকু। ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, “কার ফোন?”

“ফরেনসিক ল্যাবরেটরি থেকে। অ্যালার্ম ঘড়ির সুইচে কোনও হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। বিপুল নন্দীরও না। তা হলে বোঝা যাচ্ছে, অ্যালার্মের কাঁটা সেট করেছিল অন্য কেউ। খুবই পাকা মাথার লোক সে। সেট করার পর সুইচটা রুমাল দিয়ে মুছে দিয়েছে।”

কথার পিঠে ঝিনুক বলে, “একই সঙ্গে প্রমাণ হল ডক্টর নন্দী নিজের ইচ্ছেয় ভোর পাঁচটায় ওঠেননি। চালাকি করে তাঁকে ওঠানো হয়েছিল।”

ধর্মতলা ক্রসিং পার করে ঝিনুকদের গাড়ি এখন পার্ক স্ট্রিটের দিকে চলেছে। কপাল কুঁচকে কী যেন ভেবে যাচ্ছেন দীপকাকু। হঠাৎই অসহিষ্ণু স্বরে বলে ওঠেন, “রঞ্জনটা যে কেন কলব্যাক করছে না!”

ফের পকেট থেকে ফোনসেট বের করেছেন দীপকাকু, লালবাজারে রঞ্জনকাকুকে ফোন করবেন নিশ্চয়ই। ডক্টর নন্দীর পরিচয় দিয়ে শেষ যে ফোনটা এসেছিল, তার আসল মালিক কে, কোথা থেকে ফোনটা করা হয়েছিল, খোঁজ নিতে বলা হয়েছে।

পাওয়া গেল না রঞ্জনকাকুকে। ফোন অফ করে দীপকাকু রাগের গলায় বলেন, “দরকারের সময় কোথায় যে থাকে!”

ঝিনুক মনেমনে হাসে, খামোখা রাগ দেখাচ্ছেন দীপকাকু। ভাগ্যিস রঞ্জনকাকুর মতো একটা বন্ধু পুলিশে ছিল, কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে।

বারবার ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়াচ্ছে গাড়ি। দীপকাকুর নকল করে সিটে বসে ঘুমোনোর চেষ্টা করে ঝিনুক। চোখ বুজতেই ভেসে ওঠে, অন্ধকার আকাশের প্রেক্ষাপটে আলো জ্বলা অনেক গাছ। আকাশ কালো হলেও, ভূমিতল আলোকোজ্জ্বল। একা হেঁটে যাচ্ছেন ডক্টর নন্দী। মাঝেমাঝে মুখ তুলে দেখছেন গাছগুলোকে, … তাড়াতাড়ি চোখ খুলে ফেলে ঝিনুক।

ঝিনুকরা এখন বিশ্বনাথ সরকারের বাড়িতে। বাড়িটা চেনানোর জন্য অমিতেশবাবুকে ফোনে ডেকেছিলেন দীপকাকু। ডোভার লেন পোস্ট অফিসের সামনে অমিতেশবাবু অপেক্ষা করছিলেন। ওঁর কাছে খবর পাওয়া যায়, এখন অবধি মুক্তিপণ চেয়ে ওঁদের বাড়িতে কোনও ফোন যায়নি। পুলিশ একবার রুটিন ইনভেস্টিগেশনে এসেছিল। দীপকাকুর নাম বলা হয়েছে, পুলিশ বলেছে দীপঙ্কর বাগচী কেসটা হ্যান্ডেল করছেন, লালবাজার থেকে জানানো হয়েছে তাঁদের।

বাবার কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না বলে খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল অমিতেশবাবুকে। ঝিনুকের মনে হচ্ছিল ভান। এই কেসটাতে কাউকেই বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। অমিতেশবাবুও অ্যালার্মের কাঁটা সেট করে থাকতে পারেন। কোনও গ্যাং দিয়ে বাবাকে অপহরণ করিয়ে তুলেছেন গোপন ডেরায়। সম্পত্তি লিখিয়ে নেওয়া অথবা গবেষণার তথ্যগুলো জানা তাঁর উদ্দেশ্য।

ডক্টর নন্দীর ছোটছেলের সঙ্গে দেখাই হল না। তিনি আবার কোন প্রকৃতির কে জানে! দীপকাকুও যে ডক্টর নন্দীর ছেলেদের প্রতি খুব একটা বিশ্বাস রাখতে পারছেন না, বোঝা যায়। বিশ্বনাথবাবুর ড্রয়িংরুমে বসে উনি প্রথমেই ফেরত পাঠালেন অমিতেশবাবুকে। বললেন, “আপনি বাড়ি যান। আমি এখান থেকে বেরিয়ে আপনাদের কাছেই যাব।”

অমিতেশবাবু চলে যেতে বিশ্বনাথবাবুও যেন একটু সহজ হলেন। সামান্য কটাক্ষও করলেন অমিতেশবাবুর প্রতি। বললেন, “এখন বাবা বাবা করে হেদিয়ে মরছে। যখন বাড়ি থাকত বিপুল, একবারের জন্যও তার ঘরে যেত না ছেলেরা।

দীপকাকু কথাটা কানে নিলেন না। সরাসরি প্রশ্নে চলে গেলেন, “আপনারা রোজই একসঙ্গে মর্নিংওয়াকে বেরোতেন?”

“হ্যাঁ।”

“সদ্য নতুন কোনও সঙ্গী জুটেছিল?” “না।”

“কত দূর হাঁটতেন?”

“দেশপ্রিয় পার্ক অবধি। ফেরার সময় মাঝেমধ্যেই বাস ধরতাম।”

পরের প্রশ্নে যাওয়ার আগে দীপকাকু কী যেন একটু ভেবে নিলেন। তারপর বললেন, “ডক্টর নন্দী কি কখনও আপনার কাছে নিরুদ্দেশ হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন?”

“কখনওই না। সে তো এক প্রকার নিজের বাড়িতেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিল। নিজের কাজ নিয়েই মশগুল থাকত সবসময়।”

“কী কাজ?” বিষম আগ্রহে জানতে চান দীপকাকু।

নিরাশ করেন বিশ্বনাথবাবু। বলেন, “সেসব আমি বলতে পারব না। সায়েন্স নিয়ে কোনও ইন্টারেস্ট নেই আমার।”

“তা হলে কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হত আপনাদের মধ্যে?”

“নানারকম। দেশ, কাল, রাজনীতি, খেলাধুলো, ভগবান, জিনিসের দাম, শীত, বৃষ্টি, … বিজ্ঞান ছাড়া বিষয় নেই নাকি!”

“তা ঠিক।” বলে চুপ করে গেলেন দীপকাকু। বোঝাই যাচ্ছে, বিজ্ঞান ব্যাপারটা খুব একটা পছন্দ করেন না বিশ্বনাথবাবু। এঁর কাছে আসাটা কি অর্থহীন হয়ে গেল? ঝিনুককে আশ্বস্ত করে দীপকাকু নতুন উদ্যমে প্রশ্ন শুরু করেন, “আপনারা চাঁদিপুরে নিছক বেড়াতে গিয়েছিলেন, নাকি ডক্টর নন্দী ওখানে গিয়ে বিশেষ কিছু অনুসন্ধান করছিলেন?”

“বেড়াতেই গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে বিপুলকে এ-কথাও বলেছিলাম, কোনও পড়াশোনার কাজ চলবে না। খাবদাব, আর বেড়াব।”

“উনি কি কথা রেখেছিলেন?” জানতে চান দীপকাকু।

‘রেখেছিলই বলা যায়। রাতের দিকে একটু পড়াশোনা করত, রাস্তাঘাটে অচেনা গাছপালা চোখে পড়লে নোটবুক বের করে কী সব লিখত।”

আপাতত কোনও প্রশ্নে না গিয়ে দীপকাকু পার্স বের করে বিপুলবাবুর লাস্ট নোটটা বিশ্বনাথবাবুর হাতে দিলেন।

বললেন,‘দেখুন তো এই কাগজটা চিনতে পারেন কিনা?”

একটু উলটে পালটে দেখে বিশ্বনাথবাবু বললেন, “এটা তো বিপুলের নোটবুকের পাতা।”

“লেখাটা পড়লেন?”

“হ্যাঁ।”

“কী মনে হল?”

নীচের ঠোঁট উলটে, ভ্রু কুঁচকে বিশ্বনাথবাবু বললেন, “বেশ গড়বড়ে ব্যাপার মনে হচ্ছে।”

“গোলমালটা কোথায়?” জানতে চান দীপকাকু।

বিশ্বনাথবাবু বলেন, “বিপুল মাঝেমধ্যে লালুর সঙ্গে কথা বলত আর নোট নিত। এটা সেরকমই কোনও লেখা, কিন্তু এত কাটাকুটি কেন?”

প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে দীপকাকু জিজ্ঞেস করেন, “লালুর সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলতেন ডক্টর নন্দী?”

“লালুর জীবন-অভিজ্ঞতা নিয়ে। আধা বাংলা, আধা ওড়িয়ায় কথা বলত লালু, বিপুল শুদ্ধ বাংলায় লিখে নিত।”

বিপুলবাবুর নোটটা পার্সে ঢুকিয়ে পকেটে পুরলেন দীপকাকু। তারপর বললেন, “লালুর অভিজ্ঞতা নিয়ে কেন এত আগ্রহ ছিল আপনার বন্ধুর?”

বড় শ্বাস টেনে বিশ্বনাথবাবু বলেন, “তা হলে তো লালুকে কীভাবে পাওয়া গেল সেটা আগে বলতে হয়।”

“প্লিজ় বলুন।” কাতর কৌতূহল দেখান দীপকাকু।

বিশ্বনাথবাবু বলতে থাকেন, “চাঁদিপুরে আমি আর বিপুল একদিন সমুদ্রের ধারে বেড়াচ্ছি, মাঝিরা মাছ ধরে ফিরেছে। সিবিচের থেকে একটু দূরে আড়ত। মাঝিরা প্লাস্টিকের বড়বড় ডাব্বায় মাছ নিয়ে জমা করছে। একজনের মাথায় দুটো ডাব্বা দেখে আমরা অবাক হই। অত ভারী বইছে কী করে!

অন্য মাঝিদের তুলনায় লোকটার চেহারা টানটান, সুগঠিত, অবশ্যই চোখে পড়ার মতো। বিপুল অনেকক্ষণ ধরে লোকটার উপর নজর রাখল। যখনই লোকটা একটু ফাঁকা হয়েছে, বিপুল গেল আলাপ করতে।

“আর আপনি?” কথার মাঝে বলে ওঠেন দীপকাকু।

বিশ্বনাথবাবু বলেন, “আমি যাইনি। বেড়াতে গেলে আমি নেচারের প্রতি আকৃষ্ট থাকি, মানুষের উপর নয়।”

“তারপর বলুন।”

“তারপর আর কী, বিপুলের যা স্বভাব, যখন যেটা নিয়ে পড়বে শেষ না দেখে ছাড়বে না। লুলারামকে নিয়ে এল হোটেলে।’ “”

“লুলারাম কে?” এই প্রশ্নটা ঝিনুকের। বিশ্বনাথবাবু হাসতে হাসতে বলেন, “লুলারামই হচ্ছে লালু। কলকাতায় এসে নামটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল বিপুল।”

“কারণ?” ভ্রু কুঁচকে জানতে চান দীপকাকু।

“বলছি, তার আগে বলে নিই, লালুর কিছু বিশেষ ব্যাপার। ১৯১৩ সাল থেকে বালাশোর জেলার ইতিহাস মোটামুটি জানা ছিল লালুর। দাবি করত, বেশ কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সে। অথচ তাকে দেখে চল্লিশের বেশি মনে হবে না।”

“সে কী!” বিস্ময়ের চোটে বলে ফেলেন দীপকাকু। ঝিনুকেরও একই অবস্থা। বিশ্বনাথবাবু বলে যান, “লালুর হিসেব মতো ওর বয়স দাঁড়ায় একশোর উপর। স্রেফ আজগুবি বলে চালিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। প্রমাণ দেখাতে সে আমাদের নিয়ে গেল বুড়িবালামের তীরে, যেখানে ১৯১৫ সালে বাঘাযতীন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ইংরেজ পুলিশের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। যুদ্ধটা স্বচক্ষে দেখেছিল লালু, বিস্তারিত বিবরণ দেয় আমাদের। বাঘাযতীনের বিশেষ সঙ্গী চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরীর ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। মৃতদেহ যেখানে পড়েছিল, সেই জায়গাটাও দেখায় লালু।”

“আপনারা ওর কথা বিশ্বাস করেছিলেন?” জানতে চান দীপকাকু।

“না। তবে এত সুন্দর করে বলছিল, জীবন্ত হয়ে উঠছিল ইতিহাস। আমি আর বিপুল একই সিদ্ধান্তে পৌঁছোলাম। লালু তার বাবার কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো আমাদের বলছে। লালুকে সেকথা বলতে খেপে গেল। মিথ্যে কথা সে নাকি কখনওই বলে না।”একটু দম নিয়ে বিশ্বনাথবাবু বলেন, “আমি আর লালুকে নিয়ে মাথা ঘামালাম না। চাঁদিপুরের প্রকৃতিতে ডুবে গেলাম। বিপুল লালুকে নিয়ে পড়ল, ওদের গ্রামে গেল … “”

কথা কেটে দীপকাকু জিজ্ঞেস করেন, “কোথায় ওদের গ্রাম?” “চাঁদিপুর থেকে তিরিশ-চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, পাহাড়ের উপর পঞ্চলিঙ্গেশ্বর বলে একটা তীর্থস্থান আছে, তার কাছাকাছি। গ্রামটার নাম সোনাটোলি।”

“ওদের গ্রাম থেকে কী কী ইনফর্মেশন নিয়ে এলেন ডক্টর নন্দী?” জানতে চাইলেন দীপকাকু।

উত্তরে বিশ্বনাথবাবু বলেন, “সে নিয়ে আমার সঙ্গে বিশদ কিছু আলোচনা হয়নি। বিপুল শুধু আমায় বলেছিল, গ্রামের লোক বিশ্বাস করে লুলারামের বয়স একশোর উপর। এর সঙ্গে আর-একটা ব্যাপার যোগ হল, লুলারামের মাতৃভূমি ওটা নয়, খুব ছোটবেলায় কার সঙ্গে জানি সে ওই আদিবাসী গ্রামে এসেছিল। যদিও সবারই সেটা শোনা ঘটনা, কোনও সাক্ষী বেঁচে নেই।”

বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছে ঝিনুক। দীপকাকু ক্রমশ উৎসাহিত হচ্ছেন। জিজ্ঞেস করেন, “ডক্টর নন্দী কি গ্রামের লোকের কথা মেনে নিলেন?”

“না। ও আমার মতোই ব্যাপারটা আজগুবি গল্প বলে উড়িয়ে দিল। কিন্তু লুলারামকে ছাড়ল না, নিয়ে এল কলকাতায়। খুব পছন্দ করে ফেলেছিল লোকটাকে। নাম পালটে দিল, ওকে বলে দিল, ভুলেও যেন অতীতের গল্প কারও কাছে না করে। আমিও গোটা ঘটনাটা চেপে গেলাম। লুলারাম দিব্যি লালু হয়ে মানিয়ে নিল বিপুলের বাড়িতে। বিপুল ওকে লেখাপড়া শেখাত, আঁকা শেখাত। বিপুলের সমস্ত পার্সোনাল কাজ করত লালু, ও ছিল বিপুলের সর্বক্ষণের সঙ্গী। বাগান করা থেকে ব্যাঙ্কে টাকা তোলা, সব করতে পারত লালু। কিছুদিন হল লালুর জন্য একটা মোবাইল ফোন কিনেছিল বিপুল।” “

“কেন?” জিজ্ঞেস করেন দীপকাকু।

“কোথাও কাজে গিয়ে ফিরতে দেরি করলে টেনশন হত বিপুলের। মোবাইল ফোন কিনে ওকে অপারেট করতে শেখাচ্ছিল সবে, দেশে চলে গেল লালু।”

” ‘কেন গেল?”

“বিপুল বলছিল, ওর নাকি ক’দিন ধরে মনখারাপ করছিল দেশের জন্য। বিপুল হপ্তাদু’য়েকের ছুটি দিয়েছে।”

একটু থেমে বিশ্বনাথবাবু বলেন, “বেচারা ফিরে এসে বাবুকে না দেখলে ভীষণ ভেঙে পড়বে।”

দীপকাকু আর কোনও প্রশ্ন করছেন না। একমনে কী যেন ভেবে যাচ্ছেন। বিশ্বনাথবাবুর বাড়ি থেকে এখন পর্যন্ত চা-টা কিছু অফার করেনি, করলে মন্দ হত না। ঝিনুকেরই এখন একটু কড়া চা খেতে ইচ্ছে করছে।

বিনা ভূমিকায় উঠে দাঁড়ালেন দীপকাকু। বললেন, “চলি। আপনার বন্ধুর বাড়িতেই যাচ্ছি এখন। পরে আবার আপনাকে আমার দরকার পড়তে পারে।”

“নিশ্চয়ই আসবেন।” বলে, নমস্কার করলেন বিশ্বনাথবাবু। দরজার দিকে এগিয়েও ফিরলেন দীপকাকু। বিশ্বনাথবাবুকে বললেন, “আপনি যেমন লালুর ব্যাপারটা গোপন করে আছেন, থাকবেন। যতদিন না আমি কাউকে বলতে বলছি।”

“ঠিক আছে।” বলে মাথা হেলালেন বিশ্বনাথবাবু।

রাস্তায় এসে দীপকাকু মোবাইল ফোন বের করলেন। চোখ-মুখ ভীষণ সিরিয়াস। নম্বর টিপে কানে দিয়েছেন ফোন। অপর প্রান্তকে পেয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “কী রে, কোথায় থাকিস।”

“জানি। ঝিনুক বোঝে ওপারে রঞ্জনকাকু। দীপকাকু বলছেন, জানি। লোকেশনটা বল, কোথা থেকে ফোন করেছিল?”

….

“ধুস, কী কোম্পানি রে, নাকি পার্টির প্রাইভেসি রাখছে।”

“ঠিক আছে। কাটছি। পরে ডিটেলে বলব।” বলে ফোন অফ , করলেন দীপকাকু।

 দৃষ্টি শূন্যে রেখে বললেন, “এখন যা দাঁড়াচ্ছে আমার আইডিয়া সম্পূর্ণ ভুল।”

“কেন?” খানিক নার্ভাস হয়ে জানতে চায় ঝিনুক।

দীপকাকু বলেন, “রঞ্জন বলছে, মোবাইল ফোন নম্বরটা ডক্টর বিপুল নন্দীর নামে আছে। ফোনটা কোথা থেকে করেছিলেন লোকেট করা যাচ্ছে না। অন্য কেউ যে ডক্টর নন্দীর নাম ভাঁড়িয়ে ফোন নেয়নি, তার প্রমাণ একটু আগে আমরা পেয়েছি। বিশ্বনাথবাবু বলেছেন, কিছুদিন হল সেলফোন নিয়েছেন বিপুল নন্দী। অর্থাৎ ডক্টর নন্দী সত্যিই আত্মগোপন করে আছেন। এত বড় ভুল হল আমার!

“তা হলে কী হবে?” হতাশ কণ্ঠে বলে ওঠে ঝিনুক।

দীপকাকু আচমকা হনহন করে হাঁটতে শুরু করে দিলেন। লক্ষ নিশ্চয়ই ডক্টর নন্দীর বাড়ি। অ্যাডভান্স টাকাটা কি এখনই ফেরত দিয়ে দেবেন অমিতেশবাবুকে?

তেমন কিছু ঘটল না। ডক্টর নন্দীর বাড়ি ঢুকে দীপকাকু প্রথমেই যেতে চাইলেন বিপুল নন্দীর ঘরে। অমিতেশবাবুর সঙ্গে এবার ছোটভাই অম্লানবাবুকে দেখা গেল। দীপকাকুর সঙ্গে ভাইয়ের আলাপ করাতে গিয়েছিলেন অমিতেশবাবু। দীপকাকু গ্রাহ্য করলেন না। ঝিনুকের মনে হল, প্রবল হতাশা থেকেই দীপকাকু এমনটা করছেন। অম্লানবাবুকে একটু পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত ছিল। ছোটছেলেও সন্দেহের তালিকার বাইরে নেই। বিশেষ করে ঝিনুক লক্ষ করছে, এ-বাড়িতে ঢোকার পর থেকে ডক্টর নন্দীর ঘরে আসা পর্যন্ত অম্লানবাবু একটাও কথা বলেননি। হতেই পারে, বাবার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে অম্লানবাবু কথা বলছিলেন দীপকাকুর সঙ্গে। পাছে দীপকাকু গলাটা চিনে যান, তাই এখন চুপ করে আছেন।

মুশকিল হচ্ছে, দীপকাকুকে এখন কীভাবে বলা যায় কথাটা। ডক্টর নন্দীর ঘরে ঢুকে ঝড়ের গতিতে সার্চ করছেন সব কিছু। গোটা ঘর লন্ডভন্ড করে এখন গিয়েছেন আলমারির কাছে। চাবি লাগানোই আছে, খুলে ফেললেন পাল্লা।

দীপকাকুর মূর্তি দেখে বাড়ির লোক এতটাই ঘাবড়ে গেছে, মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে একে অপরের। বারান্দায় ঝোলানো খাঁচা থেকে চন্দনাটা ডেকে যাচ্ছে, “কে এল রে লালু, কে এল…”

আলমারির সব জিনিস একে-একে মাটিতে নামিয়ে দিচ্ছেন দীপকাকু। এ-বাড়ির সবচেয়ে ছোট্ট মেম্বার অনির্বাণ এই মুহূর্তে দীপকাকুর অ্যাসিস্ট্যান্ট। সে এক-দু’বার ‘কী খুঁজছ’ জিজ্ঞেস করে, চুপ করে গিয়েছে।

অবশেষে দীপকাকু বলে উঠলেন, “পেয়েছি।” প্রায় ‘ইউরেকা’র মতো শোনাল কথাটা। ভীষণ কৌতূহলে সবাই তাকিয়ে আছে দীপকাকুর দিকে, কী পেলেন?

দীপকাকু যা বের করলেন, তা দেখে বাড়ির সকলে নিশ্চয়ই হতাশ হল। ঝিনুক হল না। সে জানে, দীপকাকু এখন গভীর জলে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। তদন্তের হাল পুরোপুরি ছাড়েননি।

দীপকাকুর হাতে বেশ কয়েকটা খামে ভরা এক্স-রে প্লেট। এ ছাড়াও কিছু প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট। অমিতেশবাবুকে সেগুলো দেখিয়ে বললেন, “এগুলো কার টেস্ট রিপোর্ট বলতে পারবেন?”

“নিশ্চয়ই বাবার।” বলেন অমিতেশবাবু।

“না। এই দেখুন।” বলে, দীপকাকু দেখান, সমস্ত খামের উপর পেশেন্টের নাম, যে-ডাক্তার রেফার করছেন তাঁর নাম পেন দিয়ে ভাল করে কাটা। শুধু যে-ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষাগুলো হয়েছে, ছাপা নামটা পড়া যাচ্ছে।

ভীষণ অবাক হয়ে অমিতেশবাবু বলেন, “এর মানে?”

“ক্রমশ প্রকাশ্য।” বলে দীপকাকু রিপোর্টগুলো গুছিয়ে নিতে থাকেন। ফের বলেন, “ঘরটা এলোমেলো করে দেওয়ার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। একটু গুছিয়ে নেবেন প্লিজ। এই রিপোর্টগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি, সময়মতো ফেরত দেব।”

ঝিনুক পৌঁছে গিয়েছে দরজার কাছে। দীপকাকু এগিয়ে আসছেন। অনির্বাণ হঠাৎ দীপকাকুর হাত টেনে ধরে। একটু যেন কান্নাছোঁয়া গলায় বলে, “দাদু কবে আসবে আঙ্কল?”

ঘরের আবহাওয়া ভারী হয়ে যায়। দীপকাকুর মুখে কোনও ভাবান্তর হয় না। এখনই কী যেন মনে পড়ল, এই ভঙ্গিতে অনির্বাণের সামনে হাঁটু মুড়ে বসেন। জিজ্ঞেস করেন, “আচ্ছা অনির্বাণ, তুমি যে বলেছিলে দাদু লালুদাকে তাড়িয়ে দিয়েছে, সেটা কি তুমি নিজের চোখে দেখেছিলে, নাকি দাদু তোমায় বলেছিল?”

অনির্বাণ একটু সময় নেয় মনে করতে। তারপর বলে, “আমি যখন দাদুকে খালি জিজ্ঞেস করছিলাম, ‘লালুদা কোথায়, লালুদা কোথায়?’ দাদু বলল, ‘তাড়িয়ে দিয়েছি। ব্যাটা সব জিনিস হারিয়ে দেয় আমার। ওকেই হারিয়ে দিলাম।”

“গুড় বয়।” বলে, উঠে দাঁড়ালেন দীপকাকু। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেশবকে খুঁজে বললেন, “তুমি লালুর একটা আঁকা নিয়ে এসো তো তাড়াতাড়ি।”

কেশব ছুটল। দীপকাকু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। চেয়ে রইলেন বিপুল নন্দীর তৈরি করা বাগানটার দিকে। একটু পরে অমিতেশবাবুর উদ্দেশে বলে উঠলেন, “জলটল দিচ্ছেন তো গাছে?”

এমনভাবে বললেন কথাটা, বাড়ির মালিক যেন দীপকাকু। অমিতেশবাবু শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, রেগুলার দেওয়া হচ্ছে।”

লালুর আঁকা পাতা নিয়ে এল কেশব। দীপকাকু মন দিয়ে আরএকবার ড্রয়িংটা দেখতে থাকলেন।

ঝিনুক হঠাৎ খেয়াল করে, তার একদম পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পামেলা, হাসছে। কিছু বলবে মনে হয়। ঝিনুক হাসি বিনিময় করতেই, পামেলা চাপা গলায় বলে, “এবার তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি।”

ভ্রু কুঁচকে যায় ঝিনুকের। হাসি থমকে থাকে ঠোঁটে। পামেলা ফের বলে, “মিশরের রানির চিঠি উদ্ধার তোমরাই করেছিলে। তখন কাগজে ছবি বেরিয়েছিল তোমার, টিভিতেও দেখিয়েছিল।

আমাদের বাড়িতে প্রথমবার যখন এলে, ঠিক মনে করতে পারিনি তোমাকে। বন্ধুদের কাছে বাড়ির ঘটনা, তোমাদের আসার কথা বলতেই, ওরা মনে করিয়ে দিল। দাদুর ব্যাপারটা নিয়ে আমরা খুবই টেনশনে আছি, তবে তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে আমার খুব এক্সাইটিং…”

“চলে এসো ঝিনুক!” দীপকাকুর ডাকে প্রায় পালিয়ে বাঁচে ঝিনুক। মেয়েটা যা গদগদ হয়ে উঠেছিল, আর-একটু হলে অটোগ্রাফ চেয়ে বসত হয়তো।

ডোভার লেন পোস্ট অফিসের কাছে ঝিনুকদের গাড়ি। বেশ খানিকটা হেঁটে আসতে হল। মাঝপথে একটা ফোনবুথে ঢুকেছিলেন দীপকাকু। সঙ্গে মোবাইল ফোন থাকা সত্ত্বেও ফোনবুথে ঢোকা মানে নিজের পরিচয় লুকিয়ে কাউকে ফোন করলেন মনে হয়। এবারে আর কোনও প্রশ্ন করেনি ঝিনুক। সময়মতো দীপকাকু নিজেই বলবেন। ঝিনুক লক্ষ করছে, খানিক আগে হতাশ হয়েও দীপকাকুর তৎপরতা হঠাৎ বেড়ে গেল। তা হলে কি ওই রিপোর্টগুলোর ভিতর লুকিয়ে আছে রহস্যের আশু সমাধান?

গাড়িতে উঠে দীপকাকু বললেন, “আমি গোলপার্কে নেমে যাব। এই রিপোর্টগুলো ওখানকার এক ল্যাবরেটরিতে করানো হয়েছে। তুমি আপাতত বাড়িতে থাকো। প্রয়োজনমতো ডেকে নেব।”

গাড়ি চালু করে দিয়েছে আশুদা। অভিমানী স্বরে ঝিনুক বলে, “আমি যদি আপনার সঙ্গে ল্যাবরেটরিতে যাই কোনও অসুবিধে হবে?”

“সুবিধে হবে না এটুকু বলতে পারি। ওখানে আমি কতক্ষণ থাকব জানি না। আরও কয়েকটা জায়গায় যেতে হতে পারে। কোথায় কতক্ষণ সময় লাগবে, কোনও ঠিক নেই। তোমার মা ওদিকে চিন্তা করবেন।”

মায়ের কথা উঠতে একটু দমে যায় ঝিনুক। ভেবে ভেবে মা এতক্ষণে বাড়িতে চিন্তার পাহাড় করে ফেলেছেন। এদিকে তদন্ত এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, কৌতূহল দমন করা যাচ্ছে না। ঝিনুক বলে, “ওই রিপোর্টগুলোর মধ্যে আপনি কী খুঁজছেন, জানতে পারি কি? অ্যাটলিস্ট সামান্য হিন্ট?”

“এখনই কিছু বলছি না। সময় হলেই জানতে পারবে। আপাতত একটা ছোট্ট খবর দিই, শুনলে অবাক হয়ে যাবে। এই কেসের আরএকটা জট আমি খুলে ফেলেছি।”

ঝিনুক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দীপকাকু মিটিমিটি হেসে বলেন, “ডক্টর নন্দীর শেষ চিঠিতে লেখা ছিল পাহাড়ের কথা। আশ্চর্যের বিষয়, লালু সব ছবিতেই পাহাড় এঁকেছে। কী অদ্ভুত যোগাযোগ, না?”

জট খোলার বদলে পাকিয়ে গেল ঝিনুকের মাথায়। অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দীপকাকু বলেন, “বুঝলে কিছু?”

ঝিনুক দু’পাশে ঘাড় নাড়ে। গোল পার্কের কাছে চলে এসেছে ঝিনুকরা। আশুদার পিঠে হাত দিয়ে গাড়ি বাঁ দিকে রাখতে বলেন দীপকাকু। তারপর ঝিনুককে বলেন, “তুমি অনেকেক্ষণ নোট নেওয়া বন্ধ রেখেছ, যা-যা লেখা হয়নি সব নোট করে নাও। পরে ভুলে যাবে। ভাল করে একবার পড়ো। কোথাও কোনও খটকা অথবা মেজর কোনও ক্লু আমরা মিস করে যাচ্ছি কিনা দ্যাখো। তেমন জরুরি মনে হলে তখনই ফোন করবে আমায়।”

দীপকাকু নেমে গেলেন। ঝিনুক যেন অথই জলে পড়ে রইল।

“এবার বাড়ি তো?” বলে গাড়ি স্টার্ট দিল আশুদা। বাইরে কী সুন্দর হলুদ বিকেল। ঝিনুকের বয়সি মেয়েরা ড্রেস করে খোলা মনে এদিকওদিক ঘুরছে। দেশপ্রিয় পার্ক থেকে ভেসে আসছে পাখিদের হইচই। জ্বরো রুগির মতো থম মেরে আছে ঝিনুক। হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসে, নাঃ, আর পাঁচটা বন্ধুর চেয়ে আলাদা কিছু করতে চাইলে পরিশ্রমটাও বাড়তি করতে হয়। এখন অবধি এই কেসে ঝিনুকের অবদান বলতে কিছুই নেই। যে-গতিতে এগোচ্ছে তদন্ত, হতেই পারে, কোনও সহজ সমাধান সূত্র ফেলে যাচ্ছে ঝিনুকরা। সেটা খেয়াল করিয়ে দেওয়া হবে ঝিনুকের প্রধান কাজ। কুরিয়ারে ডক্টর নন্দীর চিঠি আসা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে, সব কিছু নিয়ে ভাবতে বসে ঝিনুক।