রহস্যময় উপত্যকা – ৩

ঝিনুকরা এখন ট্যাক্সিতে। বাড়ি ফিরছে। দীপকাকুর বুকপকেটে অমিতেশবাবুর দেওয়া চেক। ট্যাক্সির জানলা দিয়ে আসা হাওয়ায় প্রজাপতির ডানার মতো ফরফর করে উঠছে চেকটা। ধড়ফড়ানি তৈরি হচ্ছে ঝিনুকের বুকে। দীপকাকুর ধারণা যদি ভুল প্রমাণিত হয়! ডক্টর নন্দীর অপহৃত হওয়ার কোনও সূত্রই দেখতে পাচ্ছে না ঝিনুক। এমন তো নয়, পসার ভাল যাচ্ছে না বলে কিছু টাকা পকেটে পুরে নিলেন দীপকাকু। এই মুহূর্তে ওঁর বসে থাকার মধ্যেও কেমন একটা নিশ্চিন্ত ভাব। চিন্তায় নাজেহাল ঝিনুক খুবই নিরীহ গলায় দীপকাকুকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি অ্যাডভান্স ফেরত দেন?”

মুখ ফেরান দীপকাকু। কপালে বিরক্তির রেখা। বলেন, “হঠাৎ এ কথা কেন?”

“না, মানে ধরা যাক, আজ রাতের মধ্যেই ফিরে এলেন ডক্টর নন্দী। তখন তো আপনার অ্যাডভান্সটা ফেরত দেওয়া উচিত।” যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে কথাটা বলে ঝিনুক।

মিহি হাসি ফুটে ওঠে দীপকাকুর ঠোঁটে। বলেন, “আমি খুঁজে না দিলে ওঁকে পাওয়া খুব মুশকিল। যে বা যারা কিডন্যাপ্ করেছে, খুবই পাকা মাথার লোক। শুধু একটাই মেজর ব্লু ফেলে গিয়েছে।”

“কী সেটা?” ভীষণ আগ্রহে জানতে চায় ঝিনুক।

“তুমি তো অনেক কিছুই নোট করলে, আসল জিনিসটা চোখ এড়িয়ে গেল!”

ঝিনুক চুপ করে থাকে। অপেক্ষা করে দীপকাকুর পরের কথার জন্য। জানলার বাইরে তাকিয়ে দীপকাকু বলেন “টেবিল ক্লকের অ্যালার্মের কাঁটা পাঁচটায় সেট করা ছিল।”

ঘড়িটা দূর থেকে দেখেছে ঝিনুক, অত সূক্ষ্ম ব্যাপার লক্ষ করা সম্ভব নয়। দীপকাকুকে আর সে কথা বলে না ঝিনুক। মাথায় ঘুরছে একটাই কথা, অ্যালার্মের কাঁটার সঙ্গে অপহরণের কী সম্পর্ক? প্রশ্নটা করেই ফেলে ঝিনুক। দীপকাকু ভর্ৎসনার সুরে বলেন, “ভাবো, অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়েছ, এটুকু বুদ্ধি প্রয়োগ করতে পারছ না?”

দীপকাকু তাকে অ্যাসিস্ট্যান্টের স্বীকৃতি দিচ্ছেন শুনে, এতটাই আপ্লুত হয়ে গেল ঝিনুক, কোনও ভাবনাই এল না মাথায়। দীপকাকু নিজেই বলতে শুরু করেছেন, “অমিতেশবাবুর কাছে আমরা শুনেছি, ডক্টর নন্দী সকাল ছ’টায় হাঁটতে বেরোতেন, অ্যালার্ম কেন পাঁচটায় দেওয়া থাকবে? কেউ নিশ্চয়ই কাজটা করেছে, অন্ধকার থাকতেই নির্জন রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন ডক্টর নন্দী। অপহরণ করতে দুষ্কৃতীদের অসুবিধে হয়নি।”

তক্ষুনি পালটা যুক্তি দেয় ঝিনুক, “ডক্টর নন্দী নিজেও তো অ্যালার্মটা আগে সেট করে রাখতে পারেন, সবার অলক্ষে নিরুদ্দেশ হবেন বলে।”

“সেটা ধরে নেওয়া যেত, তদন্ত করতে গিয়ে এমন কিছু বিষয় চোখে পড়ল, সম্ভবনাটা বাতিল করে দেওয়া যায়। ঘড়িটা সঙ্গে নিলাম ফরেনসিক টেস্ট করানোর জন্য। দেখতে হবে অ্যালার্মের সুইচে কার হাতের ছাপ আছে?”

কেসটা গুরুতর হয়ে উঠছে দেখে, ট্যাক্সির সিটে সোজা হয়ে বসে ঝিনুক। মাথায় ঘুরতে থাকা পুরনো একটা প্রশ্ন করে নেয়, “আচ্ছা, আমাদের জন্য লেখা চিঠি আর বাড়িতে রেখে যাওয়া নোটের হাতের লেখা কি এক? আপনি শিয়োর?”

“উপর-উপর দেখে তাই তো মনে হল, আরও খুঁটিয়ে দেখতে হবে। ফ্লপি দুটো কম্পিউটারে ফেলে দেখলে হয়তো আরও কিছু সূত্র পাওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে ভাল হত নোটবুকটা যদি পেতাম।”

“কেন?” সাগ্রহে জানতে চায় ঝিনুক।

দীপকাকু বলেন, “আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, নোটবইয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল, ইচ্ছে করেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নোটবুকের পাতায় লেখা চিঠিটা অজস্র কাটাকুটিতে ভরা, এরকমটা অভ্যেস নয় ডক্টর নন্দীর। আমাদের যে চিঠি লিখেছেন, তাতে কোনও কাটাকুটি নেই। ভাষাও স্পষ্ট, সাবলীল।”

কথার পিঠে ঝিনুক বলে, “তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, অক্ষর এবং লাইনগুলো কেটেছে অন্য কেউ?”

“হ্যাঁ। আমি ঠিক এটাই সন্দেহ করছি।”

ভ্রু কুঁচকে একটু ভেবে নেয় ঝিনুক। বলে, “এটা কি অমিতেশবাবুর কাজ? চিঠিটা আনতে বেশ দেরি করছিলেন।”

দীপকাকু মাথা নেড়ে নাকচ করে দেন ঝিনুকের আন্দাজ। বলেন, “কাটাকুটি করে চিঠিটার অন্য মানে তৈরি করার মতো সময় নেননি। কাজটা আগেই কেউ করেছে। অমিতেশবাবুও আগে থেকে করে রাখতে পারেন।”

“তা হলে যা দাঁড়াল, ডক্টর নন্দীর হারিয়ে যাওয়ার পিছনে বাড়ির কারও হাত আছে।”

“এজ্যাক্টলি।”

ফের একটু ভেবে নিয়ে ঝিনুক বলে, “ছোটছেলেকে নিশ্চয়ই সন্দেহের বাইরে রাখতে পারি আমরা। কেননা সে এখন টুরে।”

“না। তাকেও সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে। সে টুরে গেছে কাল, অ্যালার্ম সেট করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। চিঠিটা টেবিলে পেপারওয়েট দিয়ে চাপা রাখাটা হয়তো সে অন্য কাউকে দিয়ে করিয়েছে।”

দীপকাকুর ভাবনা তেমন যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না ঝিনুকের। বলেই ফেলে, “নিজের বাবাকে অপহরণ, ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে না? উদ্দেশ্যটা কী?”

“হয়তো সম্পত্তিগত বিষয়। কোনও এক ছেলের চাহিদা মেটাচ্ছেন না ডক্টর নন্দী। অন্য কোনও কারণও থাকতে পারে। এখন অবধি পরিষ্কার ধারণা করে উঠতে পারিনি। তবে ইনভেস্টিগেশনে অনেক অস্পষ্ট ইঙ্গিত পেলাম।’ “

কেসটাকে নিয়ে বেশ গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছেন দীপকাকু, অ্যাডভান্স নিয়ে অন্যায় কিছু করেননি। এই সময় ঝিনুক নিজের সংগৃহীত তথ্যটা দেয়, “ডক্টর নন্দীর নাতনি পামেলার সঙ্গে কথা হল। বলছিল, বাবা-কাকার সঙ্গে দাদুর একদম পটত না। আপনার ধারণাই মনে হচ্ছে ঠিক, দু’ছেলের কোনও একজন…’

কথার মাঝে দীপকাকু বলে ওঠেন, “ধারণা নয়, প্রমাণ চাই। বাবার সঙ্গে ছেলেদের যে বনিবনা ছিল না, আলাদা ফোন, কাজের লোক দেখেই সেটা আন্দাজ করা যায়। কাউকে জিজ্ঞেস করে জানতে হয় না।”

তথ্যটা গুরুত্ব পেল না বলে হতাশ হয় ঝিনুক। ট্যাক্সির জানলা দিয়ে দ্যাখে, টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন পার হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আর মিনিটখানেকের মধ্যেই বাড়ি। ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঝিনুক দীপকাকুর কাছে জানতে চায়, “কাল আমাদের তা হলে কী প্রোগ্রাম?”

“একটা ফোনের উপর সেটা নির্ভর করছে।”

“মানে?”

“যারা অপহরণ করেছে, তারা ফোন একটা করবেই। তোমার বাড়ির ফোনে অথবা আমার মোবাইলে হুমকি দিতে পারে।” কেসটা ছেড়ে দিতে বলবে। অমিতেশবাবুর ফোনে মুক্তিপণ চাইতে পারে। ওই ফোন কলটার পরই ঠিক করব আমাদের কাজ।”

‘ফোনটা যদি না আসে?”

কথাটা দীপকাকু শুনলেন কিনা বোঝা গেল না। জানলার বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন! ঝিনুকদের পাড়ায় ঢুকে পড়েছে গাড়ি।

রাত কেটে গিয়ে সকাল হয়ে গেল, ঝিনুকদের বাড়িতে হুমকি দিয়ে কোনও ফোন এল না। কাল থেকে যতবার ফোন বেজেছে, সচকিত হয়েছে ঝিনুক। ছুটে গিয়ে রিসিভার তুলেছে, সবই আত্মীয়বন্ধুর ফোন। ঝিনুকের হতাশ গলা শুনে দু’-একজন তো বলেই বসল, “তোর কিছু হয়েছে?”

রাতে একটা বিচ্ছিরি স্বপ্নও দেখে ফেলল ঝিনুক। তদন্তের কারণে সে আর দীপকাকু ডক্টর নন্দীর বাড়িতে গিয়ে দ্যাখে, ফিরে এসেছেন বিপুল নন্দী। বাড়ির লোকের সঙ্গে বসে দিব্যি গল্প করছেন। ঝিনুকরা ঢুকতে, একে অপরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসছেন।

ইতিমধ্যে দীপকাকুর মোবাইলে দু’বার ফোন করেছে ঝিনুক, সুইচ অফ। দীপকাকুর মোবাইল দিনের বেশির ভাগটা ঘুমিয়ে কাটায়। রাতে তো কথাই নেই। হুমকি দিতে চাইলে দুষ্কৃতীরা দীপকাকুর নাগাল পাবে না।

কিছুক্ষণ আগে বাবা একবার জিজ্ঞেস করেছেন, “কী রে, তোদের কেসের কতদূর?”

“এগোচ্ছে।” বলে, কথা এড়িয়ে গেছে ঝিনুক।

“গাড়ি রেখে যাব নাকি? তোদের লাগবে?”

“যাও রেখে।” বলে, ঝিনুক নিজের ঘরে চলে এসেছে। নতুন কেসের ব্যাপারে মা এখন অবধি কিছু জানেন না। সকাল থেকে ঝিনুকের আচরণ দেখে সামান্য সন্দেহ হয়েছে, জিজ্ঞেস করেছেন, “তুই এরকম আনচান করছিস কেন?”

উত্তর দেয়নি ঝিনুক। এখন নিজের চেয়ার-টেবিলে বসে গল্পের খাতাটা টেনে নিতে যাবে, শুনতে পায় ফোনের শব্দ। এই ফোনটা ঝিনুক ধরবে না। বাবা ধরুন।

ড্রয়িং থেকে বাবার গলা ভেসে আসে, “ঝিনুক তোর ফোন।” চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে ঝিনুক। তা হলে সত্যিই কি এল সেই ফোন? কোনও তাড়াহুড়ো না করে ধীর পায়ে ড্রয়িংয়ে এসে রিসিভার তোলে ঝিনুক। “হ্যালে৷” বলে, অপেক্ষায় থাকে অচেনা কর্কশ কণ্ঠের।

“কোনও ফোন পেলে?” অপরপ্রান্তে দীপকাকুর গলা। একটু যেন হতাশ হয় ঝিনুক। বলে, “না, আপনি পেলেন?” “পেয়েছি।”

মুহূর্তে চাঙা হয়ে ওঠে ঝিনুক। সোৎসাহে জানতে চায়, “কী বলল ফোনে?”

ওপ্রান্তে খানিক নীরব থাকার পর দীপকাকু বলেন, “ফোনটা করেছিলেন ডক্টর নন্দী নিজে।”

“সে কী!” বলে প্রায় চিৎকার করে ওঠে ঝিনুক। উত্তেজনা সামলে জানতে চায়, “কী বললেন উনি?”

“খুঁজতে বারণ করলেন ওঁকে। বিশেষ প্রয়োজনে কিছুদিনের জন্য আত্মগোপন করেছেন। দরকার মিটলেই বাড়ি ফিরবেন। ডেকে পাঠাবেন আমাদের। এভাবে বিব্রত করার জন্য ক্ষমা চাইলেন বেশ কয়েকবার।”

ঝিনুক এতটাই দমে যায়, মুখ দিয়ে কথা সরে না। ওপ্রান্ত থেকে দীপকাকু বলেন, “রজতদার গাড়িটা কি আজ পাওয়া যাবে?”

“যাবে। আমি বাবাকে বলে রেখেছি। কিন্তু কেন?” বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চায় ঝিনুক।

“আজ বেশ কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে। সঙ্গে গাড়ি থাকলে ভাল হয়। কখন, কোথায়, কতক্ষণ সময় লাগবে, আন্দাজ করা যাচ্ছে না।”

“যাবেন কোথায়?”

“আপাতত ডক্টর নন্দীর ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুর বাড়ি। যাঁরা ওঁর সম্বন্ধে বিশেষ তথ্য দিতে পারবেন।”

“কী হবে ওঁর বিষয়ে জেনে?”

“ওঁকে খুঁজে পেতে সুবিধে হবে।”

ঝিনুক একটু থমকায়। তারপর অবাক সুরে বলে, “এই তো আপনি বললেন, খুঁজতে বারণ করেছেন উনি, তাও কেন…”

কথার মাঝে দীপকাকু ওপার থেকে বলে ওঠেন, “ফোনটা উনি করেননি, অন্য কেউ আমাদের ঠকাচ্ছে। যাতে আমরা আর ডক্টর নন্দীকে না খুঁজি।”

“কী করে বুঝলেন?” অধীর আগ্রহে জানতে চায় ঝিনুক। অপর প্রান্ত বলেন, “খুবই সোজা, মিনিট কুড়ির মধ্যে তোমাদের বাড়ি পৌঁছোচ্ছি। ততক্ষণে ভেবে রাখো।”

ফোন কেটে দিলেন দীপকাকু। ঝিনুক পড়ল গভীর গাড্ডায়। কিছুই যে মাথায় আসছে না। রিসিভার নামিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে দ্যাখে, সামনে মা। রাগ, বিরক্তি একসঙ্গে নিয়ে মা বলেন, “দীপঙ্করের সঙ্গে কথা বলছিলি মনে হল। “

ঝিনুক চুপ করে থাকে। মা ফের বলেন, “তোমাকে আমি সাফ কথা বলে দিচ্ছি শোনো, আর নতুন কোনও কেসে তুমি জড়াবে না। মেয়েদের যা মানায় তাই নিয়ে থাকো।”

“কোথায় কেস মা, সে তো ধরাই দিচ্ছে না। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে!” কপট হতাশায় বলে ঝিনুক।

মা বলেন, “ওসব হেঁয়ালিমার্কা কথা ছাড়ো। আমি যা বলে দিলাম তার যেন অন্যথা না হয়।”

ইতিমধ্যে বাবা ঘরে ঢুকে এসেছেন। যেন কিছুই শোনেননি এমনভাবে মাকে বলেন, “অফিস যাওয়ার আগে আমাকে একটা জিনিস মনে করে সঙ্গে দিয়ো তো।”

“কী?” জানতে চান মা।

“ওই যে, ঝিনুকের ছবি দিয়ে কাগজে রানির চিঠি উদ্ধারের খবরটা বেরিয়েছিল না, তার কাটিং। অফিসে দু’জন স্টাফ নতুন জয়েন করেছে, তারা দেখতে চায়।”

“ঠিক আছে দিয়ে দেব। বলে ঘর থেকে বেরোতে যাবেন মা। বাবা হাসতে হাসতে বলেন, “কাটিংটা তো খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছ, পাঁচজনকে দেখিয়ে বেশ গর্ব হয়, মেয়েকে তা হলে বাধা দিচ্ছ কেন কাজে যেতে?”

বাবার কথার প্যাঁচে মা আরও রেগে যান। বলেন, “ঠিক আছে, আজই ওই কাটিংটা আমি নষ্ট করে দেব।”

” হোমে ঘি দেওয়ার মতো ঝিনুক বলে ওঠে, “পারবেই না।”

মা গেলেন আরও রেগে, চেঁচামেচি করছেন, এদিকে নিউজ কাটিংটা ছিঁড়তে পারছেন না। ঝিনুক জানে আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতে বেড়াতে গেলে, মা ওই কাগজটা নিজের টাকাপয়সার ব্যাগে রাখেন।

দীপকাকু এসে মাকে শান্ত করলেন। আবহাওয়া বুঝতে সময় নিলেন সেকেন্ডখানেক, বললেন, “বউদি, বাড়িতে না খেয়ে আপনার হাতের জলখাবার খেতে এসেছি।”

মা তাতেই অর্ধেক গলে জল। বাকিটা দীপকাকু ম্যানেজ করলেন এই বলে, “এবারের কেসটা একদম মিয়োনো, ঠান্ডা। মারপিট, মৃত্যুর হুমকি কিচ্ছু নেই। দু’-চারজন বয়স্ক, জ্ঞানী মানুষ এই রহস্যের পাত্রপাত্রী। এখানে শুধুই মাথার কাজ। ঝিনুক সঙ্গে থাকলে ওর ব্রেনটাও শার্প হবে।”

গোবেচারা চেহারা হলেও, দীপকাকুর মধ্যে আছে অদ্ভুত কনভিন্সিং পাওয়ার। মা রাজি হয়ে গেলেন ঝিনুককে ছাড়তে। বেরোনোর সময় দীপকাকুকে বললেন, “দীপঙ্কর, তুমি বলেই ছাড়লাম। মেয়েটাকে চোখেচোখে রাখবে। যা চঞ্চল!”

বাধ্য ছাত্রের মতো ঘাড় নাড়ছিলেন দীপকাকু। ওঁর মোটা গ্লাসের চশমার দিকে তাকিয়ে আর একটু হলে হেসে ফেলছিল ঝিনুক, যে-মানুষটা এই চশমা পরেও নিজের মাথাটা ঠিক মতো আঁচড়াতে পারেন না, সিঁথি আঁকাবাঁকা হয়ে যায়, তাঁকে কিনা মা বলছেন, চোখেচোখে রাখতে!

ঝিনুকরা এখন চলেছে ভবানীপুরে। আশুদা চালাচ্ছে গাড়ি। নিজেদের গাড়িতে থাকলে ঝিনুকের বেশ একটা আত্মবিশ্বাস জাগে। যদিও গাড়িতে ওঠার পরই সেই বিশ্বাসে একটা বড়সড় ধাক্কা লেগেছে। দীপকাকু জানতে চেয়েছিলেন, “ভেবে বের করতে পারলে, কী করে বুঝলাম ফোনটা ডক্টর নন্দীর নয়?”

খুবই কুণ্ঠিত হয়ে দু’পাশে মাথা নেড়েছিল ঝিনুক। দীপকাকু বলেছিলেন, “জানতাম পারবে না। ধড়ের উপর যে বস্তুটা আছে, তার পরিচর্যা বাইরের দিকে হয় বেশি। ভিতরটা তাই তেমন কাজ করছে না, বসে যাচ্ছে।”

খোঁচাটা হজম করে ঝিনুক। ফোনের ব্যাপারটা জানতে ভীষণ আগ্রহ হচ্ছিল। দীপকাকু বলতে শুরু করেন, “পয়েন্ট নম্বর ওয়ান, ডক্টর নন্দী আমার ফোন নম্বর জানেন না বলেই তোমার ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়েছিলেন। আত্মগোপন করেই যদি থাকবেন, ফোন নম্বর জোগাড় করে আমাকে বিরত থাকতে বলার কী দরকার! আমি যদি তাঁকে খুঁজেও পাই, গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসতে তো

বলব না। বিষয়টা ওঁর ব্যক্তিগত। পয়েন্ট টু, যে ফোন করেছিল, জানে, ডক্টর নন্দীর কণ্ঠস্বর আমার পরিচিত নয়। তাই সে নির্দ্বিধায় ফোনটা করে। একটু সাবধানতা নিয়েছিল, রিসিভারে রুমাল চাপা দিয়ে বলছিল কথা। এর থেকে আর একটা জিনিস প্রমাণ হয়, লোকটির সঙ্গে ভবিষ্যতে আমার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাই ওই সতর্কতা। আমি কথা চালিয়ে যেতে চাইলেও, সে অল্প শব্দ খরচ করে ফোনটা কেটে দেয়। আমার সেল ফোনের স্ক্রিনে উঠেছিল ফোন বুথের নম্বর। খবর নিয়ে জানলাম, ধর্মতলা অঞ্চলের বুথের নম্বর এটা। এখন কথা হচ্ছে লোকটি কে? ডক্টর নন্দী কি তার হেফাজতে আছেন? আমরা তদন্তে নেমেছি, সে কীভাবে খবর পেল?”

খুব বেশি ভাবতে হয় না, উত্তর পেয়ে যায় ঝিনুক। বলে, “এই কেসে আপনি একমাত্র অমিতেশবাবুকে আপনার ফোন নম্বর দিয়েছেন। সন্দেহ তাঁকেই করা উচিত।”

যুক্তি শুনে সন্তুষ্ট হননি দীপকাকু। বলেছিলেন, “অমিতেশবাবু আমাদের দেওয়া তাঁর বাবার চিঠি পড়েছেন, জানেন, ওঁর বাবা আমার ফোন নম্বর জানেন না। এর পরেও ফোন করার মতো কাঁচা কাজ উনি করবেন না। তবে এটুকু ধরে নেওয়াই যায়, আমার সেলএর নম্বরটা ওঁর থেকেই কেউ জেনেছে। ফল্স ফোনটার পরেই ডায়াল করলাম ডক্টর নন্দীর নম্বরে। অমিতেশবাবু তুললেন। জিজ্ঞেস করলাম, আমার নম্বরটা আর কাউকে জানিয়েছেন কিনা। বললেন, ছোটভাই ফিরে এসেছে, তাকে একবার মাত্র আমার কার্ডটা দেখিয়ে যত্ন করে তুলে রেখেছেন।”

“বললাম, একবার দেখুন তো, যেখানে রেখেছিলেন, সেটা এখনও সেখানে আছে কিনা?”

“যা ভেবেছিলাম তাই, অমিতেশবাবু ফোনে জানালেন, কার্ডটা নেই। মিথ্যেও বলতে পারেন, নয়তো কেউ চুরি করেছে অথবা করিয়েছেন বাড়ির কাউকে দিয়ে। মোটমাট যা দাঁড়াল, অপরাধী আমাদের আশপাশে আছে, তাকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি অথবা করিনি।”

দীপকাকুর কথার পর ঝিনুক বলেছিল, “আমরা এখন অবধি ডক্টর নন্দীর ছোটছেলেকে দেখিনি। তার সঙ্গে একবার আলাপ করে নিলে হত না! ডোভার লেনের বদলে আমরা কেন ভবানীপুরে যাচ্ছি?”

উত্তরে দীপকাকু বললেন, “তদন্ত সবসময় স্টেপ বাই স্টেপ করতে হয়। আমরা এখন পর্যন্ত জানি না ডক্টর নন্দী কেন অপহৃত হলেন। সেটা যতক্ষণ না পরিষ্কার হচ্ছে, কাউকে সন্দেহ করার কোনও মানে হয় না।”

ঝিনুক বলেছিল, “কাল ডক্টর নন্দীর ঘর থেকে যেসব জিনিস নিলেন, তার থেকে কোনও সূত্রই কি পাওয়া গেল না?”

“গিয়েছে। তবে খুব সামান্য। ফ্লপি দুটো বাপ্পার কম্পিউটারে ফেলে বোঝা গেল, উদ্ভিদ নিয়ে কোনও জটিল গবেষণা করছিলেন নন্দী। যা বোঝার মতো ক্ষমতা আমার ও বাপ্পার কারওই নেই। আমার কথামতো বাপ্পা ইন্টারনেট সার্ফ করে বায়োটেকনোলজির লেটেস্ট পজিশন দেখে রেখেছে। যার সঙ্গে কোনও সঙ্গতি নেই ফ্লপির ম্যাটারের। এর থেকে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল, অমিতেশবাবুর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ওঁর বাবা সবার অগোচরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মোটেই অবসর যাপন করছিলেন না। এমনও হতে পারে, অমিতেশবাবু সবই জানেন, বিশেষ কারণে গোপন করেছেন আমাদের কাছে।”

দীপকাকুর অ্যানালিসিস শুনে ঝিনুক ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে বলেছিল, “তার মানে গবেষণার কারণেই কিডন্যাপ্‌ড হয়েছেন ডক্টর নন্দী?”

“এখন পর্যন্ত এটুকু ধারণা করা যেতেই পারে। রিসার্চ কী বিষয়ে করছিলেন, সেটা জানার জন্য ভবানীপুরে ডক্টর নন্দীর বন্ধু রামেন্দু মল্লিকের বাড়ি যাচ্ছি। ওঁরা অনেকদিন পর্যন্ত এক সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। রামেন্দুবাবু জানলেও জানতে পারেন ডক্টর নন্দীর গবেষণার বিষয়।” বলে সেই যে চুপ করেছেন দীপকাকু, মিনিটকুড়ি হয়ে গেল মুখে কোনও কথা নেই।

এখনও দুটো ব্যাপার জানার আছে ঝিনুকের, উসখুস করতে করতে জিজ্ঞেস করেই ফেলে, “ডক্টর নন্দীর নোটটার কি সমাধান হল? কাটা অক্ষরগুলো উদ্ধার করতে পারলেন?”

নীচের ঠোঁট উলটে মাথা নাড়েন দীপকাকু। অর্থাৎ এখনও সম্ভব হয়নি। পরের প্রশ্নে যায় ঝিনুক, “ঘড়ির অ্যালার্মের সুইচে হাতের ছাপ পাওয়া গেল?”

“এখনও রিপোর্ট পাইনি। দেওয়া আছে পরীক্ষা করতে। যেকোনও সময় ফোনে রিপোর্ট আসবে।”

জগুবাবুর বাজার পেরিয়ে এলগিন রোডে ঢুকে পড়েছে ঝিনুকদের গাড়ি। একটু দূরে দ্যাখা যাচ্ছে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হসপিটাল। সাহেবি আমলের বাড়ি। লাল রং করা। হাসপাতালের মেন গেটের পাশে গাড়ি দাঁড় করায় আশুদা। ঝিনুক, দীপকাকু নেমে আসে। অমিতেশবাবু বলেছিলেন, শম্ভুনাথ পণ্ডিতের উলটো দিকের গলিতে রামেন্দু মল্লিকের বাড়ি।

দু’পাশের গাড়ি দেখে রাস্তা ক্রস করতে যাবে ঝিনুক, চোখে পড়ে একটা কালো অলটো কার ঝিনুকদের গাড়ির ঠিক পিছনে এসে দাঁড়াল। গাড়িটা থেকে কেউ নামল না। ফলো করছিল নাকি?

দীপকাকু রাস্তার ওপারে চলে গিয়েছেন। সন্দেহ মাথা থেকে ঝেড়ে ঝিনুক অনুসরণ করে।

গলির মুখে এসে বাজারের ব্যাগ হাতে থাকা এক ভদ্রলোককে ধরলেন দীপকাকু। রামেন্দু মল্লিকের বাড়িটা কোথায় জানতে চাইলেন। ভদ্রলোক এক চান্সে হাত তুলে দেখিয়ে দিলেন।

উঁচু পাঁচিলঘেরা পুরনো দোতলা বাড়ি। সদর লক্ষ করে ঝিনুকরা এগোতে থাকে। এমন সময় কাছাকাছি কার যেন মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। এদিক-ওদিক দেখতে গিয়ে ঝিনুক দ্যাখে, দীপকাকুই পকেট থেকে ফোন বের করে কানে দিয়েছেন। যাক, রিং টোনটা ভদ্রস্থ হয়েছে, আগের মতো বিদঘুটে নয়।

ফোনে কথা বলতে বলতে দীপকাকুর মুখটা কেমন যেন নিভে যাচ্ছে। পাশে গিয়ে দাঁড়ায় ঝিনুক। কথা শেষ হয়েছে। সুইচ অফ করার আগে নম্বর সেভ করে নেন দীপকাকু। ঝিনুকের প্রথমে মনে হয়েছিল হাতের ছাপের রিপোর্ট এল বুঝি। নম্বর সেভ করা মানে অচেনা কারও ফোন। ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, “কার ফোন?”

অন্যমনস্ক গলায় দীপকাকু বললেন, “আবার ফল্স ডক্টর নন্দীর ফোন।”

“কী বলছে এখন?” ভ্রু কুঁচকে জানতে চায় ঝিনুক।

কোনওভাবে টের পেয়েছে, তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। বারণ করছে খুঁজতে। অজ্ঞাতবাসে থাকাটা তার পার্সোনাল ব্যাপার। আমরা অনধিকার চর্চা করছি। এটা আইনি হিসেবে এক ধরনের অপরাধ।” বলে, রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবতে লাগলেন দীপকাকু। চেহারায় হতোদ্যম ভাব। একটু পরে বলেন, “কী করে জানতে পারছে বলো তো? ইনভেস্টিগেশনে বেরিয়েছি, তুমি আর আমি ছাড়া তো কেউ জানে না। খুবই বুদ্ধি খাটিয়ে আমাদের ফলো করা হচ্ছে।”

বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝিনুকের চোখে ভেসে ওঠে কালো অলটো কার। একটু আগে তাদের গাড়ির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

হসপিটালের দিকে ঘুরে জোর কদমে হেঁটে যায় ঝিনুক। গাড়িটা

এখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ডার্ক উইন্ডো গ্লাস বন্ধ। ঝিনুক শিয়োর, ওর মধ্যে বসে আছে অনুসরণকারী, যে একটু আগে ফোন করেছিল দীপকাকুকে।

ঝিনুকের হাঁটা দৌড়োনোর মতো হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য কালো গাড়ি, চলন্ত ট্রাফিকের কারণে রাস্তা ক্রস করার আগে থামতে হল একটু। ঠিক তখনই কালো গাড়িটা ঝিনুকদের গাড়ির পিছন থেকে বেরিয়ে এগোতে শুরু করল। তার মানে টের পেয়েছে ঝিনুকের উদ্দেশ্য, কেটে যাচ্ছে। এবার সত্যিকারের দৌড় শুরু করে দেয় ঝিনুক। তার পায়ে স্নিকার্স, দীপকাকুর সঙ্গে প্রথম অভিযানের পর গিফট করেছিলেন বাবা। আজ কাজে লাগছে। স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে কালো গাড়ি। ঝিনুক প্রাণপণে স্পিন্ট টানতে থাকে। উলটো দিক থেকে আসছে মিনিবাস। ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে কী যেন বলে, শোনা যায় না। মিনিটখানেকের মধ্যে অন্যান্য ট্রাফিকের আড়ালে উধাও হয়ে যায় গাড়িটা।

দৌড় থামিয়ে দেয় ঝিনুক। বড়বড় নিশ্বাস পড়ছে, টান ধরেছে পেটে। দু’-চার জন পথচারী দাঁড়িয়ে পড়েছে ফুটপাতে, অসম প্রতিযোগিতাটা দেখছিল এতক্ষণ।

ফিরতে হবে। কোমরে দু’হাত রেখে ঘুরে দাঁড়ায় ঝিনুক। দ্যাখে, আশুদা গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে।

দরজা খুলে নেমে এলেন দীপকাকু। শাসনের গলায় বললেন, “হঠাৎ দৌড় প্র্যাকটিসের কথা মাথায় এল কেন?”

“ওই গাড়ি থেকে আমাদের ফলো করা হচ্ছিল।” দম নিয়ে বলে ঝিনুক।

“তা বলে তুমি গাড়ির সঙ্গে কম্পিটিশন করবে!” বলে, সুর পালটে ফেলেন দীপকাকু, টিভিতে দেখেছি, বড়বড় দৌড়বাজরা ট্রেনের সঙ্গে রানের মহড়া নিচ্ছে।”

খেপাচ্ছেন দীপকাকু। মাথা নিচু করে নেয় ঝিনুক। আশুদা গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে। গাড়িতে গিয়ে বসে ঝিনুক। দীপকাকু উঠে আসেন।

এবার গাড়ি রাখা হল রামেন্দু মল্লিকের বাড়ির সামনে। পাঁচিলের গায়ে আর্চ টাইপ সদর দরজা। পিছন থেকে বোগেনভেলিয়ার ঝাড় উঁকি মারছে। .

গাড়ি থেকে নেমে এল ঝিনুকরা। দীপকাকু এগিয়ে গিয়ে ডোরবেল টিপলেন ।

দরজার পাল্লায় পেতলের প্লেটে শুধু মল্লিক আর ঠিকানা লেখা। বেশ খানিকক্ষণ পর দরজা খুলল। স্যান্ডো গেঞ্জি পরা ষণ্ডামার্কা একটা লোক। কাজের লোক সম্ভবত। সে কিছু বলার আগেই দীপকাকু জিজ্ঞেস করেন, “রামেন্দু মল্লিক বাড়িতে আছেন?”

“আছেন, আপনারা?”

পরিচয় জানতে চাইছে লোকটা। উত্তরে দীপকাকু বলেন, “উনি আমাদের চিনবেন না। একটা বিশেষ প্রয়োজনে দেখা করতে এসেছি।”

“ফোন করে নিয়েছিলেন আগে?” জানতে চায় লোকটা অর্থাৎ অ্যাপয়ন্টমেন্টের কথা বলছে। ঝিনুক ভাবে, এত ফর্মালিটির কী আছে, কে জানে! পরক্ষণেই খেয়াল হয়। রামেন্দুবাবু একজন বিদেশ ফেরত বিজ্ঞানী। এটুকু ওজন তো দেখাতেই হবে।

দীপকাকু পকেট থেকে নিজের কার্ড বের করে লোকটাকে

দিলেন। বললেন, “বাবুকে গিয়ে দেখাও। আমরা অপেক্ষা করছি।” কার্ড নিয়ে চলে গেল লোকটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল। বলল, “আসুন।”

সদর ডিঙোলে বাগান। গাছপালা ঝোপঝাড়ের আকার নিয়েছে। পরিচর্যার অভাব। একটা পরির স্ট্যাচুও আছে বাগানের মাঝখানে।

মোরামের রাস্তা ধরে এগোতে থাকে ঝিনুকরা, সামনে দোতলা বাড়িটার গায়ে প্রাচীন বনেদিয়ানার ছাপ স্পষ্ট।

বৈঠকখানায় গিয়ে পৌঁছোয় ঝিনুকরা। কাজের লোকটা বলে, “আপনার বসুন। বাবুকে খবর দিচ্ছি।”

লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে না-যেতে দীপকাকু পৌঁছে যান তালা দেওয়া বুককেসের সামনে। বাইরে থেকে দেখতে থাকেন বইয়ের নাম।

ক্লান্ত ঝিনুক সোফায় বসে চোখ বোলায় ঘরের আসবাবে। সবই বেশ পুরনো আমলের। খানিক পরে ঘরে ঢোকেন রামেন্দু মল্লিক। পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। অভিজাত চেহারা। সপ্রতিভ কণ্ঠে বলে ওঠেন, “কী ব্যাপার? হঠাৎ আমার বাড়িতে গোয়েন্দা হানা!”

দীপকাকু ইতিমধ্যে সোফায় এসে বসেছিলেন। সম্মান জানাতে উঠে দাঁড়ান। রামেন্দু মল্লিকের মৃদু রসিকতার উত্তরে বলেন, “ঠিক হানা নয়, শরণাপন্ন হওয়া বলতে পারেন। “

“ওঃ বাবা, তাই নাকি! আমার সৌভাগ্য।” বলে রামেন্দুবাবু হাতের ইশারায় দীপকাকুকে বসতে বলেন, নিজেও বসেন সোফায়। ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলেন, “এই স্মার্ট মিষ্টি মেয়েটি কি আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট?”

“প্রায় তাই। শিক্ষানবিশ বলতে পারেন।”

রামেন্দুবাবুর কমপ্লিমেন্ট, দীপকাকুর স্বীকৃতি দিতে কিপ্‌টেমি, দুটোতেই সমান বিব্রত বোধ করে ঝিনুক।

রামেন্দুবাবু বলেন, “ভাল, ভাল। আমেরিকায় দেখেছি গোয়েন্দার অ্যাসিস্ট্যান্ট বেশির ভাগ মহিলারাই হন। আমরা কলকাতার লোকেরা পিছিয়ে থাকব কেন!” একটু থেমে রামেন্দুবাবু আসল প্রসঙ্গে ফিরতে চান, “তা বলুন, আমি আপনাদের কী কাজে লাগতে পারি?”

দীপকাকু শুরু করেন, “আপনি নিশ্চয়ই এতক্ষণে খবরটা পেয়েছেন। আপনার বন্ধু ডক্টর বিপুল নন্দী বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন।”

“হ্যাঁ, পেয়েছি। ওর বড়ছেলে ফোন করেছিল আমায়। জানতে চাইল, বিপুল আমার কাছে আছে কিনা। বলার পর চোখ নামিয়ে নেন রামেন্দুবাবু, মন খারাপের গলায় বলেন, “ভেরি স্যাড, বিপুল যে এরকম একটা কাণ্ড করবে ভাবতে পারিনি।”

কথাটা খচ করে কানে লাগল ঝিনুকের, রামেন্দুবাবু কি অন্য কোনওরকম কাণ্ডের প্রত্যাশা করছিলেন? দীপকাকুর প্রতিক্রিয়া সম্ভবত একই, সেই কারণে হয়তো ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনার বন্ধু কি খামখেয়ালি? কখন কী কাণ্ড করে বসেন কোনও ঠিক নেই?

“না, তেমনটা নয়। আসলে ও অনেক বদলে গেছে।”

“কীরকম? জানতে চান দীপকাকু। রামেন্দুবাবুর মুখে চিন্তা ঘনায়। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করেন। সেই বিদেশি সিগারেট, যার ফিল্টার পাওয়া গিয়েছিল ডক্টর নন্দীর ঘরের অ্যাশট্রেতে। দীপকাকুর দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে দেন রামেন্দুবাবু।

দু’জনেই সিগারেট ধরান। রামেন্দুবাবু বলতে থাকেন, “আমার প্ল্যান ছিল রিটায়ার্ড লাইফটা কলকাতায় নিজের বাড়ি ফিরে এসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে কাটাব। বিয়ে-থা করিনি, কোনও পোষ্য নেই। বন্ধুরা আমার কাছে অনেকখানি। কিন্তু কোথায় কী, এখানে ফিরে দু’-তিনটে পুরনো বন্ধুকে পেলাম। বাকিরা নয় মারা গিয়েছে অথবা শহর• ছেড়ে চলে গিয়েছে অন্য কোথাও। আমার পুরনো বন্ধুদের মধ্যে বিপুল ছিল খুব ঘনিষ্ঠ। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি আমরা।”

“হ্যাঁ, সেটা ওঁর বড়ছেলে আমাদের বলেছেন।” বললেন দীপকাকু।

রামেন্দুবাবু ফের বলতে থাকেন, “কলকাতায় চলে আসার পর বেশ কয়েকবার ওর বাড়ি গেলাম, সেই আগের বিপুল নেই। খুব হাসিখুশি ইয়ারবাজ ছিল।”

“বদলের কারণ হিসেবে আপনার কী মনে হয়?” জানতে চান দীপকাকু।

রামেন্দুবাবু বলেন, “আন্দাজ করা মুশকিল। বাড়ির লোকের সঙ্গেই ভাল করে কথা বলত না বিপুল। আমি গেলে এড়িয়ে যেত।”

“কোনও মেন্টাল প্রবলেম?”

“হলেও হতে পারে। তবে সেটা পুরোপুরি মানসিক রোগ নয়। অত্যধিক ব্লাডসুগার আছে ওর, উপসর্গ হিসেবে কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।”

রামেন্দুবাবুর কথার পিঠে দীপকাকু বলেন, “তার একটা প্রমাণ অবশ্য উনি রেখে গেছেন। নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে বাড়ির লোকের উদ্দেশে লেখা একটা চিঠি। খুবই এলোমেলো ভাষা।”

“ও, তাই নাকি? এটা অবশ্য অমিতেশ আমাকে জানায়নি। ফোনে আর কত কথাই বা বলবে। আমারই একবার ওদের বাড়ি যাওয়া উচিত। বলে অ্যাশট্রেতে সিগারেটের শেষ অংশ গুঁজে দেন রামেন্দুবাবু। মৌজ করে দুটো টান মেরে দীপকাকুও তাই করেন। হঠাৎই ঘরের তিনজনকে চমকে দিয়ে বাসন পড়ার শব্দ ভেসে আসে ভিতর বাড়ি থেকে। বিরক্তির ভাঁজ পড়ে রামেন্দুবাবুর মুখে। হাঁক পাড়েন, “সনাতন! সনাতন!”

একটু পরে সনাতন, মানে কাজের লোকটি দরজায় এসে দাঁড়ায়। রামেন্দুবাবু ধমক দেন, “ফের বাসন ফেললি!” “

কাঁচুমাচু মুখে সনাতন বলে, “আমি নই, বিড়াল।”

এক পরদা গলা তুলে রামেন্দুবাবু বলেন, “সবসময় বিড়ালটার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছিস, ওটা তোর চেয়ে অনেক স্মার্ট।”

রসিকতা শুনে আর একটু হলে হেসে ফেলছিল ঝিনুক। রামেন্দুবাবু ফের ধমকে বলে ওঠেন, “বাবুরা কতক্ষণ হল এসেছেন, চা-টা কিছু দিলি না তো!”

দীপকাকু বারণ করতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই আদেশ নিয়ে সনাতন চলে গেছে। আবার আগের কথায় ফিরে আসেন দীপকাকু, “ডক্টর নন্দী কি কোনও বিষয়ে রিসার্চ করছিলেন বলে আপনার মনে হয়? মানে, আলোচনা টালোচনা করেছিলেন আপনার সঙ্গে?”

“রিসার্চ করলেও করতে পারে। আমার সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন হবে না। দু’জনের সাবজেক্ট গোড়ায় এক হলেও, পরের দিকে আলাদা। আমি কাজ করেছি মানুষের কোষ নিয়ে, বিপুল উদ্ভিদের।” বলে কী যেন একটু ভেবে নিলেন রামেন্দুবাবু। তারপর বললেন, “একটা তথ্য আপনাকে আমি দিতে পারি।”

শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুক নিজের নোটবুক বার করে ফেলল, অনেকক্ষণ কোনও নোট নেওয়া হয়নি। রামেন্দুবাবু বলতে থাকেন, “এক কবিরাজের সঙ্গে বিপুলের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। কারণটা আমি জানি না। সম্পর্কটা ইদানীং একটু তিক্ত হয়েছিল, সেটা টের পাই হঠাৎ একদিন বিপুলের বাড়ি গিয়ে। ঘরের বাইরে থেকে শুনছিলাম কোনও একটা ব্যাপার নিয়ে ওরা দু’জনে খুব ঝগড়া করছে। আমি ঘরে ঢুকতেই চুপ করে গেল। বুঝলাম সিক্রেট কিছু। কবিরাজ চলে যেতে বিপুলকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী নিয়ে ঝগড়া হচ্ছিল?’ ‘ও কিছু না’ বলে এড়িয়ে গেল বিপুল। সত্যি কথা বলতে কী, তারপর থেকে বিপুলের উপর আমার একটু রাগই হয়ে যায়। আর ওর বাড়ি যাইনি।” থামলেন রামেন্দুবাবু, হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে বলে ওঠেন, “হ্যাঁ, আর-একটা কথা। কবিরাজ লোকটিকে আমার সাধারণ মানের পর্যবেক্ষণে বেশ ধড়িবাজ বলেই মনে হয়েছে। ওর উসকানিতে বিপুল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারে। আপনারা পারলে একবার কবিরাজের সঙ্গে দেখা করে নিন।”

তিন কাপ চা, বিস্কুট, চানাচুর, অনেক কিছু নিয়ে এল সনাতন। ঝিনুক ঠিক করে, খেয়েই নেবে চা, কত আর লোকের বাড়ি গিয়ে বলা যায়, খাই না।

চা খেতে খেতে খোশ গল্পে মেতে গেলেন দীপকাকু। রামেন্দুবাবুর কাছে জানতে চাইলেন, বিদেশে কোথায় কোথায় গিয়েছেন, ভারতের কোন রাজ্য, শহর সবচেয়ে ভাল লাগে? … ঝিনুক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। অচেনা পাখির ডাক ভেসে আসছে বাগান থেকে। এত বড় বাড়িটা ভীষণ নিঝুম লাগে। সনাতন আর রামেন্দুবাবু ছাড়া আর কেউ থাকে না বলেই মনে হয়। এই ধরনের বাড়িতে থাকতে হলে ভারী বিরক্ত লাগবে ঝিনুকের।

“আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টের বয়স কিন্তু খুবই অল্প। ইনটেলিজেন্সি কেমন?”

রামেন্দুবাবুর কথায় সংবিৎ ফেরে ঝিনুকের। মিটিমিটি হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছেন ঝিনুকের দিকে। বললেন, “ছোট্ট একটা অঙ্কের পরীক্ষা নিই?”

ঝিনুকের ভীষণ অস্বস্তি লাগে। একই সঙ্গে নাভাস। এ কী অন্যায় কথা, এসেছে বিপুল নন্দীর অন্তর্ধানের কারণ অনুসন্ধানে, খামোখা তাকে পরীক্ষা দিতে হবে কেন? কোন কথা প্রসঙ্গে পরীক্ষার ব্যাপারটা এল কে জানে!

“তোমাকে আমি একটা আশ্চর্য যোগ করা দেখাব। প্রথমেই বলে দিচ্ছি যোগফল ১৯৯৮। নোটবুকে লিখে নাও।”

এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই, যোগফলটা লেখে ঝিনুক। অঙ্কে সে খুব একটা খারাপ নম্বর পায় না। এখনই হার মানবে কেন!

“তুমি তিন অঙ্কের একটা সংখ্যা বলো।” বলেন রামেন্দুবাবু।

ঝিনুক বলে, “৩১৫।”

“লিখে ফেলো। তার তলায় লেখো ৬৮৪, এটা আমার সংখ্যা।” ঝিনুক লিখে নেয়। রামেন্দুবাবু বলেন, “আবার তিন অঙ্কের একটা সংখ্যা বলো।”

ঝিনুক বলে এবং লিখে নেয়, ৭৯৯।

“ভেরি গুড। আমার সংখ্যা ২০০। এবার যোগ করে দ্যাখো ১৯৯৮ হয় কিনা।”

ঝিনুক যোগ করে দ্যাখে, সত্যিই মিলে গেল। রীতিমতো অবাক হয়েছে ঝিনুক। আত্মতুষ্টির হাসি নিয়ে রামেন্দুবাবু বলেন, “দেখলে, তুমি কী সংখ্যা বলবে আমি তো জানি না, উত্তরটা আগেই বলে দিয়েছিলাম।”

ঝিনুক দীপকাকুর মুখের দিকে তাকায়, এমন বিভোর হয়ে বসে আছেন, যেন এতক্ষণের কথোপকথন কিছুই শুনতে পাননি। হয়তো অভিনয়। অঙ্কের ধাঁধাটা ওঁর বেশ কঠিন ঠেকেছে। দীপকাকুর দিকে তাকিয়ে আছেন রামেন্দুবাবু, মুখের হাসিতে মৃদু চ্যালেঞ্জ।

ঘোর কাটিয়ে ঝিনুকের দিকে তাকান দীপকাকু। বলেন, “১৯৯৮কে ৯৯৯ করে দু’ভাগে ভাগ করেছেন, তুমি যে তিন অঙ্কের সংখ্যা বলেছ, ৯৯৯ থেকে মাইনাস করে উনি নিজের সংখ্যা বলেছেন। দু’বার শূন্যস্থান পূরণ করে উনি পৌঁছে গেছেন ১৯৯৮–এ।” ঝট করে হিসেবটা কষে নিয়ে ঝিনুক অবাক। রামেন্দুবাবুও উচ্ছ্বসিত। বলেন, “ধাঁধাটা আপনি জানতেন?”

মাথা নেড়ে ‘না’ বলেন দীপকাকু। ফের অন্যমনস্ক হতে হতে বলেন, “শূন্যস্থান পূরণ!”

ঝিনুকরা বেরিয়ে এসেছে রামেন্দুবাবুর বাড়ি থেকে। দীপকাকু গম্ভীর। মেজাজ খিঁচড়ে আছে ঝিনুকের। খামোখা রামেন্দুবাবু তাকে হেনস্তা করলেন। কিছু মানুষ এরকম হন, স্টুডেন্টদের খাপছাড়া প্রশ্ন করে মজা পান খুব। রামেন্দুবাবুর মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষের এই রোগ থাকা উচিত নয়।

গাড়ির কাছে পৌঁছে দীপকাকু আর-একবার রামেন্দুবাবুর পুরনো দোতলা বাড়ির দিকে তাকান। গভীরভাবে চিন্তা করছেন কিছু। ধাঁধার উত্তর পারেনি ঝিনুক, ভর্ৎসনা করতেও ভুলে গেছেন।

“চলো, শিয়ালদায় যাওয়া যাক।” বলে গাড়িতে গিয়ে বসলেন দীপকাকু। ঝিনুকও উঠে আসে। ড্রাইভার আশুদার মুখ ব্যাজার। দীপকাকুর সঙ্গে গত অভিযানের অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেছে হয়তো। প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে হয়েছিল।

এলগিন রোড ছেড়ে বাঁ দিকে টার্ন নিল আশুদা। ঝিনুক দীপকাকুর কাছে জানতে চায়, “আমরা শিয়ালদায় কেন যাচ্ছি?”

“কবিরাজ নরনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে।”

ঝিনুকের মনে পড়ে, অমিতেশবাবু অস্পষ্ট একটা ঠিকানা দিয়েছিলেন কবিরাজের। তার মানে বিস্তর খোঁজাখুঁজি করতে হবে। রোদ বাড়ছে, কপালে দুঃখ আছে ঝিনুকদের।

জানলার বাইরে ব্যস্ত শহর, ঝকঝকে অফিস, দোকান, অসংখ্য গাড়ি, মানুষ সব কিছুই কত স্পষ্ট প্রকাশিত। এর মধ্যে একটা মানুষ অন্তর্হিত হয়ে গেলে, তাকে খুঁজে পাওয়া মুখের কথা নয়। কাজটা ক্রমশ অসাধ্যসাধন মনে হচ্ছে ঝিনুকের। দীপকাকুর মাথায় এখন কী ঘুরছে কে জানে! ঝিনুক অপেক্ষায় আছে দীপকাকুর মোবাইল বেজে ওঠার। দুটো ফোন আসার সম্ভাবনা আছে, অ্যালার্ম ঘড়ির ফরেনসিক রিপোর্ট আর নকল ডাক্তার নন্দীর ফোন। রিপোর্টে যার হাতের ছাপ পাওয়া যাবে, তাকে ধরলেই তদন্তের দ্রুত নিষ্পত্তি …

হবে। রহস্য উদ্ঘাটন হবে ফল্স ফোনটার। কোথা থেকে যে লোকটা ঝিনুকদের গতিবিধির উপর নজর রাখছে, বোঝাই যাচ্ছে না। কথাটা খেয়াল হতে গাড়ির পিছনের দিকে তাকায় ঝিনুক, খোঁজে কালো গাড়িটাকে, পায় না। পাশ থেকে দীপকাকু বলে ওঠেন, “তুমি ভুল সন্দেহে গাড়িটাকে তাড়া করেছিলে। ফলো করার হলে অন্য গাড়ি নিয়ে সে এখনও আমাদের পিছু নিত। একটু থেমে বলেন, গাড়ি থেকে নয়, আলাদা কোনও পদ্ধতিতে আমাদের উপর নজর রাখা হচ্ছে। “

আর কী পদ্ধতি হতে পারে, ভেবে দিশা পায় না ঝিনুক। দীপকাকু ফের বলেন, “এই কেসটা মোটেই তেমন জটিল নয়। মুশকিল হচ্ছে, যাদের সাক্ষ্য নিচ্ছি, তারা কিছু না-কিছু গোপন করে যাচ্ছে। জট পাকিয়ে যাচ্ছে গোটা ব্যাপারটা। “”

‘কীরকম?” জানতে চায় ঝিনুক।

দীপকাকু বলেন, “অমিতেশবাবু চেপে যাচ্ছেন, বাবার সঙ্গে কী নিয়ে তাঁদের মনোমালিন্য হত। ওঁদের বাড়ির কাজের লোক কেশব ভালমানুষ সেজে থাকলেও, অনেক কিছু জানে, বোঝে। আমাদের কাছে সব কথা বলছে না। রামেন্দুবাবু এড়িয়ে গেলেন দরকারি বেশ কিছু তথ্য। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোন রাজ্য এবং শহর ওঁর বিশেষ পছন্দ? বললেন, কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি ছাড়া অন্য কোনও বড় শহরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই। তিনের মধ্যে কলকাতা বেস্ট। অথচ ওঁর বইয়ের র‍্যাকে ওড়িশা নিয়ে প্রচুর বই দেখলাম।” থামেন দীপকাকু। বড় নিশ্বাস ফেলে বলেন, “এখন দেখা যাক নরনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় কতটা কী বলেন! এঁদের সকলের সঙ্গে কথা বলে বিপুল নন্দীর নোটটার কেটে দেওয়া অক্ষরগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। অনেকটা শূন্যস্থান পূরণের মতো।’

রামেন্দুবাবুর বাড়িতে বসে শূন্যস্থান পূরণ কথাটা অঙ্কের প্রসঙ্গে বলেছিলেন দীপকাকু। একবার রিপিটও করেন। কেন করেছিলেন এখন বুঝতে পারছে ঝিনুক।

দীপকাকুর আক্ষেপ, সবাই কিছু না-কিছু গোপন করছে তাঁকে। উনিও পাত্রবিশেষে তথ্যের রকমফের করছেন। ঝিনুক লক্ষ করেছে, ‘বিপুল নন্দী কিডন্যাপ্‌ড হয়েছেন’ এই স্থির ধারণার কথা দীপকাকু একবারের জন্যও রামেন্দুবাবুকে বলেননি। ফল্স ফোন আসার কথাটাও চেপে গিয়েছেন। যা বোঝা যাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত বিপুল নন্দীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এমন কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না দীপকাকু। এদিকে রামেন্দুবাবু সন্দেহের তির কবিরাজের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। লোকটা নাকি ভীষণ ধড়িবাজ। কল্পনায় ধড়িবাজ কবিরাজের ছবিটা আঁকতে গিয়ে ঝিনুক দ্যাখে, মোবাইল বের করে দীপকাকু নম্বর টিপছেন। কানে নিলেন ফোনসেট। একটু পরে বললেন, “কানেকশন অফ করে দিয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক।”

ঝিনুক আন্দাজ করতে পারে, দীপকাকু ফল্স কলারের নম্বরে ডায়াল করেছেন। শেষ ফোনের নম্বর সেভ করে রেখেছিলেন দীপকাকু।

আরও দু’-তিনবার ট্রাই করলেন নম্বরটা। ফলাফল একই। দীপকাকু এবার ফোন করলেন লালবাজার কন্ট্রোলে। এক চান্সেই পাওয়া গেল রঞ্জনকাকুকে। নম্বরটা দিয়ে দীপকাকু বললেন, “যত তাড়াতাড়ি পারিস ফোন কোম্পানি থেকে নম্বরটা আইডেন্টিফাই কর। লাস্ট ফোন কোথা থেকে করা হয়েছিল, সেটাও খবর নে।”