রহস্যময় উপত্যকা – ২

যতটা সময় লাগবে ভেবেছিল, লাগেনি। বাসন্তী দেবী কলেজের পাশের গলি দিয়ে ঝিনুকদের ট্যাক্সি ঢুকে পড়েছে ডোভার লেনে। আশপাশের বাড়ির নম্বর পড়ে বোঝা যাচ্ছে, ড. নন্দীর বাড়ি গলির শেষ প্রান্তে। একটা সিগারেট গুমটিতে জিজ্ঞেস করা হল উনিশ বাই ই এ বাড়িটা কোথায়? দোকানদার আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল।

দোতলা বাড়িটা বেশ পুরনো, তবে ওয়েল মেন্টেন্ড। ফুটপাথের উপর একটা ঝাঁকড়া গাছ। তার আড়ালে সদর দরজা। সন্ধের আলো আর ল্যাম্পপোস্টটা দূরে বলে কী গাছ বোঝা যাচ্ছে না। বাড়ির সামনেটায় একরাশ নির্জনতা থম মেরে আছে।

ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিলেন দীপকাকু। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলেন দরজার সামনে। ঝিনুকও পাশে এসে দাঁড়াল। দরজার উপর টিনের প্লেটে শুধু বাড়ির নম্বরটাই লেখা, কারও নাম লেখা নেই। চাপা গলায় দীপকাকু বললেন, “ভদ্রলোকের কোনও আত্মগরিমা নেই অথবা বাড়িতে ওঁর পজ়িশন খুব একটা ভাল নয়। এরকম একজন জ্ঞানী-গুণী মানুষের নেমপ্লেট অবশ্যই দরজায় থাকত।’

ডোরবেলে হাত রাখলেন দীপকাকু। বাড়ির ভিতর বেজে উঠল শব্দ। প্রত্যুত্তরে ভেসে এল টিয়াপাখির ট্যাঁ ট্যাঁ। ডেকেই যাচ্ছে পাখিটা, একটু পরে দরজা খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে ফরসা গোলগাল বছর পঁয়ত্রিশের একটা লোক। জিজ্ঞেস করলেন, “বলুন?”

“এটা কি ড. বিপুল নন্দীর বাড়ি?” জানতে চাইলেন দীপকাকু ! “হ্যাঁ।”

“উনি বাড়ি আছেন? আমরা একটু দেখা করতে চাই।”

ভদ্রলোক কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ঝিনুকদের দিকে। একটু পরে বলেন, “কেন দেখা করতে চান?”

প্রশ্নটার ধরন জেরার মতো। দীপকাকুর আচরণে অপ্রস্তুত ভাব। ঝিনুকের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ভদ্রলোককে বললেন, “প্রয়োজনটা কি আপনাকে বলতেই হবে? ডক্টর নন্দীকে বলা যাবে না?”

হঠাৎই হাবভাব বদলে গেল ভদ্রলোকের। একটু যেন তড়িঘড়ি করে বললেন, “আপনারা আসুন না, ভিতরে এসে বসুন।”

ঝিনুকরা ভদ্রলোককে অনুসরণ করে। ভিতরে বাড়ির টিয়াটা যেন বলে ওঠে, “কে এল রে, কে এল রে নাড়ু… ” উচ্চারণ মোটামুটি স্পষ্ট।

সদরের পর গলি। বাঁ দিকের প্রথম ঘরটায় ঢুকলেন ভদ্রলোক। এটাই ড্রয়িংরুম। পুরনো বাড়ির সঙ্গে মানানসই করে সোফাসেট, অন্যান্য আসবাব। ঝিনুকদের বসতে বলে, ভদ্রলোক বসলেন সোফায়। চোখে-মুখে কেমন যেন সংশয়-মেশানো অস্থিরভাব। বললেন, “ডক্টর নন্দী আমার বাবা। আপনারা কি আগে কখনও এসেছেন মানে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় আছে?”

প্রশ্নটা কেন করা হচ্ছে বুঝতে পারছেন না দীপকাকু, মাথা নেড়ে বললেন, “পরিচয় নেই। আজই প্রথম আসছি। উনি আমাদের আর্জেন্ট চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন।”

ভদ্রলোক সামান্য অবাক হয়ে বলেন, “বাবা চিঠি পাঠিয়েছেন, কাকে দিয়ে? কবেকার লেখা?”

“পরশুর ডেট দেওয়া। কুরিয়ার করে পাঠিয়েছেন।”

অবাক ভাব কমল। ডক্টর নন্দীর ছেলে বললেন, “ও, তা চিঠিটা একবার দেখতে পারি কি?”

“অফকোর্স৷” বলে বুকপকেট থেকে খামসুদ্ধু চিঠি বের করে ভদ্রলোকের হাতে দিলেন দীপকাকু। খাম থেকে চিঠি বের করে পড়তে থাকলেন ডক্টর নন্দীর ছেলে। কপালে তৈরি হল অজস্র ভাঁজ। পড়া শেষ করে দীপকাকুর দিকে বিষম বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। বললেন, “আপনি ডিটেকটিভ! বাবা গোয়েন্দা ডেকে পাঠিয়েছিলেন!”

ঝিনুক বুঝতে পারে না ভদ্রলোকের কোন ব্যাপারটা মানতে অসুবিধে হচ্ছে। দীপকাকুকে গোয়েন্দা বলে, নাকি বাবার চিঠিটা?

নিজের পরিচয় সুনিশ্চিত করতেই বোধহয় পকেট থেকে পার্সোনাল কার্ড বের করে ভদ্রলোককে দিলেন দীপকাকু। তারপর সন্দিগ্ধ স্বরে জানতে চাইলেন, “আপনি ‘ডেকে পাঠিয়েছিলেন’ বললেন কেন? আপনার বাবা কি কোথাও গেছেন? আউট অফ স্টেশন?”

“বাবা নিরুদ্দেশ হয়েছেন।” বলে ডক্টর নন্দীর ছেলে চিঠিটা ফেরত দিলেন দীপকাকুকে।

ঝিনুকের মাথা টাল খেয়ে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল “কবে?” “আজ ভোরবেলা। মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে আর ফেরেননি।”

হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে দীপকাকু জানতে চাইলেন, “নিরুদ্দেশ মানে কি স্বেচ্ছায়?”

“হ্যাঁ।”

“কী করে বুঝলেন?”

“একটা চিঠি রেখে গিয়েছেন।”

ক্ষণিক নীরবতা নেমে এল ঘরে। ঝিনুকের মন খারাপ। যদি বা একটা ভদ্রস্থ কেসের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, যিনি তদন্তের ভাব দেবেন, তিনি নিজেই উধাও! একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছে ঝিনুক, ডক্টর নন্দী যদি বাড়ি ছেড়ে চলেই যাবেন, ডেকে পাঠালেন কেন দীপকাকুকে? ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে।

দীপকাকু হঠাৎ বলে ওঠেন, “চিঠিটা একবার দেখাতে পারেন?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আপনারা বসুন, আমি এখনই নিয়ে আসছি।” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ডক্টর নন্দীর ছেলে।

ভীষণ গম্ভীর হয়ে দীপকাকু ঘরের চারপাশে চোখ বোলাচ্ছেন। ঝিনুকের মাথায় অনেক সম্ভাবনার কথা এলেও বলতে পারছে না। পাছে দীপকাকু বিরক্ত হন। নাকের ডগা দিয়ে কেসটা উড়ে গেল, · মেজাজ নিশ্চয়ই ভাল নেই। }

ট্রে-তে তিনটে ধোঁয়া ওঠা কাপ নিয়ে ঘরে ঢোকে কাজের লোক। ভিতর বাড়িতে টিয়াটা আবার চেঁচামেচি শুরু করেছে, এখন আর ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কী বলছে,

কাজের লোক ট্রে থেকে কাপগুলো নামিয়ে রাখল সেন্টার টেবিলে।

ঝিনুক বলে, “আমি কিন্তু চা খাই না।”

লোকটা কেমন যেন এক্সপ্রেশনলেস, ঝিনুকের দিকে একবার তাকিয়ে একটা কাপ তুলে নেয় ট্রে-তে। এগিয়ে যাচ্ছিল দরজার দিকে। দীপকাকু ডাকেন, “এই শোনো।”

লোকটা ঘুরে দাঁড়ায়। দীপকাকু বলেন, “তোমাদের পাখিটা তো খুব কথা বলে ! কী পাখি এটা?”

“চন্দনা।” জবাব দেয় লোকটা।

“পাখিটা কী যেন একটা বলছে। লালু বা নাড়ু, কার যেন নাম ধরে ডাকছে।”

কাজের লোকটি এবার হাসে। বলে, “ডাকছে লালুকে।”

“কে লালু?” জানতে চান দীপকাকু।

“বড়বাবুর কাজের লোক। পাখিটাকে খুব ভালবাসত। লালু চলে যাওয়ার পর থেকে পাখিটা বেশি ছটফট করছে। “”

দীপকাকু বলেন, “বড়বাবু মানে, তুমি বোধহয় ডক্টর নন্দীর কথা বলছ।”

“হ্যাঁ।”

“তাঁর আলাদা কাজের লোক!” কথাটা যেন নিজেকেই বললেন দীপকাকু। প্রায় নিশ্চিত হয়ে পরের কথাটা তুললেন, “বাবুর ফোনের লাইন নিশ্চয়ই আলাদা, আমরা ঘণ্টাখানেক আগে ফোন করেছিলাম। কেউ তুলল না। বড়বাবুর ঘরটা কি খুব দূরে?”

“না তো, বাবুর ঘরে ফোন বাজলে দিব্যি শোনা যায়। আমরা ফোনের আওয়াজ পাইনি।” বলল লোকটা।

দীপকাকু প্রসঙ্গ পালটান, “লালু গেল কোথায়?”

“দেশের বাড়ি।”

দীপকাকু পরের প্রশ্নে যাবেন, পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন ডক্টর নন্দীর ছেলে। চিঠিটা আনতে একটু যেন বেশিই সময় নিলেন। কাজের লোক ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সোফায় বসে দীপকাকুর দিকে একটা চিরকুট এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। লাইন টানা ছোট নোটবুকের পাতায় লেখা চিঠি। একবার চোখ বুলিয়ে দীপকাকু খুললেন ডক্টর নন্দীর কুরিয়ারে পাঠানো চিঠি। দুটো পাশাপাশি নিয়ে নিজের মোটা চশমায় প্রায় ঠেকিয়ে ফেলেছেন। ঝিনুক বুঝতে পারছে এত খুঁটিয়ে কী দেখছেন দীপকাকু, হাতের লেখা দুটো এক কিনা?

নিশ্চিত হয়ে দীপকাকু চিরকুটটা চালান করলেন ঝিনুকের হাতে। ডক্টর নন্দীর ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, “নোটটা কোথায় রাখা ছিল?”

“টেবিলের উপর পেপারওয়েট চাপা দেওয়া।” বললেন ভদ্রলোক।

একনিমেষে নোটটা পড়ে নিয়েছে ঝিনুক—

‘চললাম। পাহাড়ের ওপারে। যেখানে সর্বদা দিন। অপেক্ষা করছেন তিনি। জরা-ব্যাধি নিয়ে আর কোনও কষ্ট থাকবে না ।’

এই ক’টা লাইনের মাঝে অনেক অক্ষর পেন দিয়ে গোল পাকানো। শেষের দুটো লাইন তো পুরোপুরি কাটা। চিঠিটা কেমন যেন অসম্পূর্ণ, বেখাপ্পা লাগে ঝিনুকের। দীপকাকু ঠিক সেই কথাটাই তুললেন, “আচ্ছা মি. নন্দী, আপনার বাবার চিঠিটা কি একটু অসংলগ্ন নয়?”

নীচের ঠোঁট উলটে কী একটু ভেবে নিলেন ভদ্রলোক। বললেন, “কথাটা আপনি ভুল বলেননি। বাবার কথাবার্তা কখনওই এতটা এলোমেলো ছিল না। হাতের লেখা এক হলেও, কথাগুলো যেন অন্য কারও। আমার একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে।”

“কী ব্যাপারে?” চায়ে চুমুক দিতে দিতে জানতে চান দীপকাকু। বিষয়টা বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন ভদ্রলোক। হঠাৎ সুর পালটে বলতে শুরু করলেন, “দেখুন মি. বাগচী, আমার বাবা আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, আমি নই। আমরা ইতিমধ্যেই থানায় মিসিং ডায়েরি করেছি। পুলিশ খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে। আমি আর এ ব্যাপারে অন্য কারও সাহায্য নিতে চাই না।”

এ তো প্রায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হল। ঝিনুকের খুবই অপমানিত লাগে। দীপকাকুর তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। ঠান্ডা গলায় বলতে শুরু করেন, “আপনার বাবা বিপদে পড়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, তাঁর অনুপস্থিতি দেখে আমি কাজ বন্ধ রাখতে পারি না। বিশেষ করে যখন ওঁর নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনায় আমি অনেক অসঙ্গতি দেখতে পাচ্ছি।”

কথা বলতে বলতে সেলফোন বের করে ডায়াল করেছেন দীপকাকু। ফোন কানে দিয়ে বলেন, “হ্যালো, লালবাজার কন্ট্রোল? ইনস্পেক্টর রঞ্জন দত্তকে দিন না।” বলে একটু চুপ থাকলেন দীপকাকু। ডক্টর নন্দীর ছেলের মুখের ভাব নরম হচ্ছে। রঞ্জনকাকুকে চেনে ঝিনুক! আগের কেসে খুব হেল্প করেছিলেন। রঞ্জনকাকু ধরলেন মনে হয়, দীপকাকু বলছেন, “দীপঙ্কর বলছি, ডোভার লেনে একটা ইনভেস্টিগেশনে এসেছি। বালিগঞ্জ থানার ও সি-কে বলে রাখিস তো। দেখা করতে হতে পারে।”

অপর প্রান্তের কথা শুনতে শুনতে দীপকাকু ইশারায় ডক্টর নন্দীর ছেলেকে বলেন, “কথা বলবেন?”

ত্রস্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন ভদ্রলোক, দীপকাকু ফোন অফ করেন। ডক্টর নন্দীর ছেলে মোলায়েম গলায় বলতে থাকেন, “কিছু মনে করবেন না মি. বাগচী। আমার মনের অবস্থা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে বাবা আর ফিরলেন না। তারপর এই চিঠি। সকাল থেকে থানা, ফোন, পুলিশ করে বেড়াচ্ছি। আপনারা এসে আরও জটিল করে দিলেন পরিস্থিতি। বলছেন, বাবা আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন… এরপর কি আর মাথা ঠান্ডা রাখা যায়!”

সঙ্গে সঙ্গে মুড বদলে ফেললেন দীপকাকু, পরম শুভানুধ্যায়ীর মতো বলতে থাকেন, “মাথা আপনাকে ঠান্ডা রাখতেই হবে। ছেলে হিসেবে আপনারই দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি এক ছেলে? আর কোনও ভাইবোন?”

“আমার পরে একটা ভাই আছে। কালই টুরে গিয়েছে শিলিগুড়ি। ফোনে যোগাযোগ করেছি। আগামীকাল সকালের ফ্লাইটে এসে যাবে।”

“ভাইয়ের নাম?”

“অম্লান।” বলেই জিভ কাটলেন ভদ্রলোক, “সরি, এতক্ষণ নানারকম কথায় নিজের নামটাই বলা হয়নি, আমি হচ্ছি অমিতেশ।”

ঝিনুক একটা ছোট্ট নোটবুক, পেন, সঙ্গে এনেছে। আগের কেসে এ দুটোর প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিল। নোটবুকে পয়েন্ট লিখতে শুরু করে দিয়েছে ঝিনুক। দীপকাকু পরের প্রশ্নে যান, “আপনাদের পেশা?”

“অম্লান একটা ওষুধ কোম্পানির সেল্স ম্যানেজার। আমি ব্যাঙ্কে আছি।”

“আপনারা দুই ভাই কি ফ্যামিলি নিয়ে এই বাড়িতেই থাকেন?” “হ্যাঁ।”

“এ বাড়িটা শুধু আপনাদের? আর কোনও অংশীদার নেই তো?”

“না।”

“এবার আপনার বাবার পড়াশোনা এবং গবেষণার ব্যাপারে বলুন। “”

“বছরদুয়েক হল গবেষণা ছেড়ে দিয়েছেন বাবা। কলকাতার এক বায়োটেকনোলজি ইনস্টিটিউটের অধীনে রিসার্চ করতেন। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ফার্মাসি নিয়ে পড়াশোনা করার পর বায়োটেকনোলজি পড়েছিলেন নিউ ইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। কোর্স কমপ্লিট করার পর ফিরে আসেন দেশে, কলকাতার ইনস্টিটিউটে জয়েন করেন।”

“আর কখনও বিদেশ গিয়েছেন?”

“না।”

“বাড়িতে অবসর সময়টা কীভাবে কাটাতেন?”

“বই পড়া, ইন্টারনেট সার্ফ করা, এ-পাড়া ও-পাড়া হেঁটে চলে বেড়ানো। বাগান করা। কখনও সখনও বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া। প্রকৃত অবসর যাপন বলতে যা বোঝায় আর কী!”

একটু সময় নিয়ে ভ্রু কুঁচকে দীপকাকু জিজ্ঞেস করলেন, “গবেষণার সঙ্গে আর কোনওভাবেই যোগ ছিল না?”

“নাঃ, সত্যি বলতে কী, রিসার্চটা বাবা চাকরির মতোই করতেন। ইনস্টিটিউট থেকে রিটায়ারমেন্টের পর ও ব্যাপারে আর মাথা ঘামাননি।”

থাইয়ের উপর নোটবুক রেখে সমস্ত ইনফর্মেশন ছোট করে নোট করে নিচ্ছে ঝিনুক। হঠাৎ চোখ তুলে দেখে, দীপকাকু তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। মুখ ঘুরিয়ে নেন, অমিতেশবাবুকে বলেন, “আপনার বাবার ঘরটা কি একবার দেখতে পারি?”

“চলুন।” খুবই অনিচ্ছের সঙ্গে বলেন অমিতেশবাবু।

ড্রয়িং থেকে বেরিয়ে বিশাল ডাইনিং। এখানে এসে বাড়ির অন্য সদস্যদের দেখা গেল। কিছুটা সন্ত্রস্ত এবং চাপা কৌতূহলে সবাই ঝিনুকদের দেখছে। দু’জন ভদ্রমহিলা, সম্ভবত বিপুল নন্দীর দুই পুত্রবধূ। ঝিনুকের বয়সি একটি মেয়ে, তার চেয়ে ছোট একটি ছেলে। এরা নিশ্চয়ই নাতি-নাতনি। আর সেই কাজের লোক।

ঘরের আসবাব থেকে শুরু করে সবার মুখের উপর চোখ বুলিয়ে দীপকাকু অনুসরণ করলেন অমিতেশবাবুকে।

ডাইনিং পেরিয়ে লম্বা একফালি বারান্দায় এসে পড়ল ঝিনুকরা। অমিতেশবাবুর উদ্দেশে দীপকাকু বললেন, “আপনার মাকে তো দেখলাম না!”

“মা বছর পাঁচেক হল মারা গিয়েছেন।”

“ও, আই অ্যাম সরি।” বলে দীপকাকু হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। চোখ বারান্দা-লাগোয়া আবছা অন্ধকার বাগানের দিকে। বারান্দার কম ওয়াটের আলোয় যতটুকু সম্ভব আলোকিত হয়ে আছে গাছপালা। ঝিনুকের প্রথমে চোখেই পড়েনি বাগানটা। এখানে এসে বাড়ির আবহাওয়াটাই যেন পালটে গেল। বাইরে থেকে বোঝা যায় না, এতটা জমি নিয়ে এই বাড়ি।

পকেট থেকে টর্চ বার করে গাছপালার উপর আলো ফেললেন দীপকাকু। বড় গাছ তেমন নেই। ম্যাক্সিমাম হাইট পাঁচ ফুট। দীপকাকু বললেন, “অনেক ধরনের গাছ আছে দেখছি, নিয়মিত পরিচর্যাও হয়।”

“হ্যাঁ, বাবার শখ।” বললেন অমিতেশ।

“এই শখটা কি অবসর জীবনের, না আগেও ছিল?” জানতে চেয়ে টর্চ অফ করলেন দীপকাকু। প্রশ্নটা ঠিক কেন করা হল, বুঝল না ঝিনুক। অমিতেশবাবু উত্তর দিলেন, “আগে শখ থাকলেও সময় পেতেন না। ইদানীং বাগান নিয়ে খুব মেতেছিলেন।”

“নিজের হাতেই সব কাজ করতেন?”

“না, বাবার খাস কাজের লোক লালু বাবাকে হেল্প করত। সেও তো চারদিন হল কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।” তথ্যটা যেহেতু জানা, দীপকাকু নীরব থেকে হাঁটতে লাগলেন। বারান্দার একদম শেষে একতলা ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ালেন অমিতেশবাবু। এটাই তাঁর বাবার মানে ডক্টর বিপুল নন্দীর ঘর। দরজায় তালা মারা। অমিতেশবাবু পকেট থেকে চাবি বের করে খুললেন। পাল্লা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে যাবেন, বাধা দিলেন দীপকাকু। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ঘরের অন্ধকার মেঝেয় টর্চের আলো ফেললেন। ঝিনুক টের পাচ্ছে, তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির বাকি সদস্যরা।

টর্চ নিভিয়ে দীপকাকু বললেন, “মেঝেয় অনেকের পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে, ডক্টর নন্দী নিরুদ্দেশ হওয়ার পর আপনারা কি ওঁকে ঘরের মধ্যেই খুঁজছিলেন?”

খুবই শ্লেষমিশ্রিত প্রশ্ন, বারান্দার ঝিমোনো আলোয় অমিতেশবাবুর মুখটা বড়ই ফ্যাকাশে দেখাল।

দীপকাকুর পরবর্তী নির্দেশ, “যান, এবার ঘরের আলো জ্বালুন।”

ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালালেন অমিতেশবাবু। সামান্য অগোছালো ঘর। মনে হচ্ছে ডক্টর নন্দী কিছু সময়ের জন্য বাইরে গেছেন, এখনই ফিরে আসবেন।

ঘরটা স্বয়ংসম্পূর্ণ, কী নেই এখানে! চেয়ার-টেবিল, কম্পিউটারডেস্ক, র‍্যাক ভরতি বই, ছোট স্টিল-আলমারি। এমনকী, ঘরের কোণে টেবিলের উপর একটা হিটার এবং চায়ের সরঞ্জামও দেখা গেল।

দীপকাকুর চোখ সিঙ্গল বেডের উপর স্থির, দৃষ্টি অনুসরণ করে ঝিনুক দেখতে পায়, বিছানার উপর ফোনসেট। অস্ফুটে দীপকাকু বলেন, “আমাদের করা ফোনের আওয়াজ এই জন্যই বাড়ির লোক শুনতে পাননি।”

জিনস্-এর পকেট থেকে ফের নোটবুক বের করে ফেলেছে ঝিনুক। দীপকাকু চলে গিয়েছেন চা তৈরির টেবিলের সামনে। হিটারটা অন, অফ করে দেখে নিলেন চালু আছে। চায়ের আনুষঙ্গিক কৌটোগুলো পরীক্ষা করলেন। তারপর এলেন বইয়ের র‍্যাকের কাছে। বেশিরভাগ বই বায়োটেকনোলজির উপর। দু’-চারটে বই বের করে, উলটে পালটে দেখে রেখে দিলেন।

কম্পিউটার চালু করার চেষ্টা করলেন দীপকাকু, অন হল, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু করা গেল না। পাস ওয়ার্ডে এন্ট্রি নিতে হবে।

ডক্টর নন্দী ছাড়া সেটা নিশ্চয়ই আর কারও জানা নেই।

রিডিং টেবিলে গিয়ে পকেট থেকে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস বের করলেন, কাগজপত্তর চোখের সামনে তুলে পরীক্ষা করছেন। দীপকাকুর তদন্তের এই পর্যায়টা ভীষণ বোরিং। আবার এটাও ঠিক, এই সামান্য জিনিসগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে রহস্যের অনেক সূত্র।

টেবিলের ড্রয়ার খুলেছেন দীপকাকু। বেরোল ট্যাবলেটের ফয়েল, গোটাকয়েক পেন, খাম, পোস্টকার্ড, জোয়ানের শিশি। আতশকাচ পকেটে রেখে টেবিল থেকে তুলে নিলেন পেপারওয়েট, পেনস্ট্যান্ডের সঙ্গে ডেটচেঞ্জিং ক্যালেন্ডার। ঝিনুক লক্ষ করে, ডেটটা কালকের রয়ে গেছে, পালটানো হয়নি। টেবিলক্লকটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছেন দীপকাকু, দম দেওয়া পুরনো দিনের ঘড়ি। অমিতেশবাবুর উদ্দেশে বললেন, “আপনার বাবা মর্নিংওয়াকে ক’টায় বেরোতেন?”

“সকাল ছ’টা নাগাদ।” বললেন অমিতেশবাবু। বইপত্তরের আড়ালে থাকা অ্যাশট্রে বের করলেন দীপকাকু। ফিল্টারের টুকরোগুলো পরীক্ষা করতে করতে বললেন, “আপনার বাবা সম্ভবত স্মোক করতেন না।”

অমিতেশবাবু বিস্মিত কণ্ঠে সমর্থন করলেন কথাটা। বললেন, “ঠিকই ধরেছেন। সিগারেটের টুকরোগুলো বাবার বন্ধুদের। কেউ দেখা করতে এলে উনি অ্যাশট্রেটা বের করে দিতেন। আপনি বুঝলেন কী করে ব্যাপারটা?”

“কাল রাতের খাওয়া ফ্রেশ ফিল্টারের টুকরো নেই আর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফিল্টার দেখে।” বলে দীপকাকু জানতে চাইলেন, “শেষ কোন বন্ধু দেখা করতে এসেছিলেন?”

“আমি ঠিক বলতে পারব না। আমি তো সবসময় বাড়ি থাকি না।”

`কে বলতে পারবে?”

“কেশব, মানে আমাদের কাজের লোক জানতে পারে। দাঁড়ান, ডাকছি।”

ডাকতে হল না। দোরগোড়ার ভিড় থেকে কেশব ঘরে এসে হাজির। কেশবকে নতুন করে প্রশ্নটা করলেন দীপকাকু। সে মাথা চুলকে বলল, “মনে পড়ছে না।”

দরজায় ভিড়ের দিকে তাকালেন দীপকাকু। ডক্টর নন্দীর দুই পুত্রবধূ সরে গেলেন। অপার কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল নাতিনাতনি। তাদেরও বোধহয় উত্তরটা জানা নেই।

ফের অ্যাশট্রে নিয়ে পড়লেন দীপকাকু। ঘেঁটেঘুঁটে একটা ফিল্টার বের করলেন। গা ঘিনঘিন করছে ঝিনুকের। দীপকাকুর কোনও বিকার নেই। ফিল্টারটা আতশকাচের সামনে ধরে কিছুক্ষণ দেখে বললেন, “ডক্টর নন্দীর বন্ধুদের মধ্যে কে পান খান?”

ঝিনুক আশঙ্কিত হয়, অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণ চালাতে গিয়ে স্লিপ অফ টাং হয়ে যাচ্ছে দীপকাকুর, হাতে এক জিনিস, বলছেন অন্য কিছুর কথা। ঘরের বাকি দু’জন ঝিনুকের মতোই হতবাক। একটু পরে দীপকাকু নিজেই বলতে শুরু করেন, “এই সিগারেটটা যাঁর খাওয়া, তিনি পানও খান, লাল ছোপ লেগে রয়েছে ফিল্টারের শেষে। “”

কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেশব বলে ওঠে, “কবরেজমশাই। উনি বাবুর কাছে হপ্তায় এক-দু’বার অন্তত আসতেন।”

আজকাল কারও বাড়ি কবিরাজমশাই আসেন শুনে অবাক হল ঝিনুক। কেন আসতেন, বোঝা যাচ্ছে না। দীপকাকু বলে ওঠেন, “অমিতেশবাবু, আপনার বাবার হাই ব্লাডপ্রেশার, সুগার কি অনেক দিনের সঙ্গী?”

অমিতেশবাবুর এক্সপ্রেশন হল দেখার মতো, ম্যাজিক দেখে যেমন বোকা ও আনন্দিত হয় মানুষ। বলে উঠলেন, “মার্ভেলাস এতক্ষণে আমি মেনে নিচ্ছি, আপনি একজন বড় মাপের গোয়েন্দা। কী করে আন্দাজ করলেন বাবার এইসব রোগ আছে?”

নিরুত্তাপ গলায় দীপকাকু বলেন, “বেজায়গায় হাততালি দিচ্ছেন মি. নন্দী, ইট্স ভেরি সিম্পল, ট্যাবলেটের ফয়েলগুলো সুগার, প্রেশারের কমন ওষুধ, আর চায়ের সরঞ্জামের মধ্যে দেখলাম চিনির বদলে স্যাকারিন।”

সূত্রগুলো শুনে অমিতেশবাবুর বিস্ময় বাড়ল বই কমল না। দীপকাকু ফের বলেন, “অসুখে বোধহয় খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন, সেই কারণেই রেখে যাওয়া নোটে লিখেছেন জরাব্যাধির কথা।’ “

“হতেও পারে।” চিন্তান্বিত গলায় বললেন অমিতেশবাবু৷

“কবিরাজমশাই কি ডক্টর নন্দীর চিকিৎসার কারণে আসতেন?”

দীপকাকুর প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়েন অমিতেশবাবু। বলেন, “আমি ঠিক জানি না। ভদ্রলোককে একবার মাত্র দেখেছি। দুঃস্থ, অভাবী চেহারা। বাবার বন্ধু হিসেবে ঠিক মানা যায় না। হয়তো আর্থিক সাহায্য পেতে বাবার কাছে আসতেন। সরাসরি টাকা না দিয়ে, বাবা তাঁর কাছে ওষুধ নিতেই পারেন, খেতেন বলে মনে হয় না।”

“তা হলে চিকিৎসা করাতেন কার কাছে?”

“ডা. অমল চ্যাটার্জি। আমাদের হাউজ় ফিজ়িশিয়ান। এ পাড়াতেই থাকেন। বাবার বন্ধুর মতো। বাবার কাছে নিছক আড্ডা মারতেও আসেন।”

“কবিরাজমশাইয়ের প্রতি আপনার বাবার দুর্বলতার কারণ?”

“সরি, এ ব্যাপারেও আমি কিছু বলতে পারছি না। বাবা আমাদের কাছে ততটা খোলামেলা ছিলেন না, একদম ব্যক্তিগত কোনও ধরনের প্রশ্ন করতে সাহস পেতাম না আমরা।”

অমিতেশবাবুর কথার পর খানিকক্ষণ সময় নিয়ে কী যেন ভাবলেন দীপকাকু। তারপর বললেন, “খুব রিসেন্টলি আর-একজন আপনার বাবার কাছে আসতেন, যিনি কিংসাইজ় বিদেশি সিগারেট খান। চার- পাঁচদিন আগে এসেছিলেন। ফিল্টারগুলো দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। তিনি কে?”

অমিতেশবাবু জানেন না, কেশবের দিকে তাকান। কপাল কুঁচকে কেশব বলে, “বাবুর বন্ধুবান্ধব অনেকেই আসতেন। কে লম্বা সিগারেট খেতেন, খেয়াল করিনি। আমি তো এ ঘরে বড় একটা আসতাম না, লালুই বাবুর সব কাজ করত।”

উত্তর আসে দোরগোড়া থেকে, “রামেন্দুদাদু।”

গলাটা বাচ্চা ছেলেটির। দীপকাকু হাতের ইশারায় ছেলেটিকে ঘরের মধ্যে ডেকে নেন। বছর বারোর ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যায়, এমনিতে দুষ্টু, এখন একটু থতমত খেয়ে আছে।

সামনে এসে দাঁড়াতে দীপকাকু তার নাম জিজ্ঞেস করেন। সে বলে, “অনির্বাণ নন্দী।”

“ডক্টর বিপুল নন্দী তোমার দাদু?” বলেন দীপকাকু।

মাথা হেলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে অনির্বাণ। দীপকাকু জিজ্ঞেস করেন, “রামেন্দুদাদুকে তুমি লাস্ট কবে আসতে দেখেছিলে এ বাড়িতে?”

একটু ভেবে অনির্বাণ বলে, “তখন লালুদা ছিল। রামেন্দুদাদুর সিগারেট আনতে মোড়ের দোকানে গিয়েছিল লালুদা, আমিও গিয়েছিলাম সঙ্গে।”

“লালুদা তার মানে তোমাকে খুব ভালবাসত, দেশের বাড়ি চলে গেল কেন?” জানতে চান দীপকাকু।

“দাদু লালুদাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।” “কেন?”

“দাদুর জিনিসপত্তর খালি হারিয়ে যাচ্ছিল, লালুদা খুঁজে দিতে পারত না।”

“কী-কী জিনিস হারিয়ে যাচ্ছিল দাদুর?”

“চশমা, পেন, ডায়েরি, বিস্কুটের কৌটো, ফ্লপি, ফাইল আরও অনেক কিছু।”

“ও কে”, বলে দীপকাকু এবার দৃষ্টি ফেরালেন অমিতেশবাবুর দিকে। বললেন, “এ নিশ্চয়ই আপনার ভাইপো। দাদুর অনেক খবর রাখে দেখছি!”

অনির্বাণকে কাছে টেনে নেন অমিতেশ। স্নেহমিশ্রিত গলায় বলেন, “বাবা সবাইকে দূরে সরিয়ে রাখলেও, একে পারত না। সময় অসময় ঢুকে যেত দাদুর ঘরে। আমার তো মনে হয় বাবার জিনিসগুলো লুকিয়ে রাখত অনি। বকুনি খেত লালু।’ “

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে অনির্বাণ, “মোটেই আমি সব কিছু লুকোতাম না। দাদু নিজেই অনেক কিছু হারিয়ে ফেলে, পরে খুঁজে পেত।”

কথাগুলো দীপকাকুর কানে ঢুকছে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। ঠোঁটের নীচে আঙুল রেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন। ঘরের মধ্যে এখন শুধুই টেবিল ক্লকের টকটক শব্দ।

চিন্তা ভেঙে দীপকাকু অমিতেশবাবুকে বলেন, “রামেন্দুবাবুর সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবেন?”

“পারব। বাবার স্কুলবেলা থেকে বন্ধু। যাদবপুরেও একসঙ্গে পড়েছেন। তারপর সেই যে বিদেশ চলে যান, ফিরেছেন একমাস হল। আমি শুনেছি ইতিমধ্যে বাবার কাছে বেশ কয়েকবার এসেছেন। আমার সঙ্গে দেখা হয়নি।”

“ওঁর ঠিকানা?”

“ভবানীপুরে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হসপিটালের সামনের গলিতে ওঁর পৈতৃক বাড়ি। এখন ওখানেই আছেন কিনা জানি না। ওঁর পুরো নাম রামেন্দু মল্লিক।”

নাম, অ্যাড্রেস ঝিনুক নোট করে নিল। দীপকাকু আড়চোখে দেখে নিয়ে অমিতেশবাবুকে বললেন, “আর-একজনের নাম-ঠিকানা আমার লাগবে, কবিরাজমশাই।’ “”

“নাম আমি বলতে পারব, নরনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। শিয়ালদার কাছে কোথায় যেন চেম্বার আছে।”

“ফাইন।” বলে, স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন দীপকাকু। একটু পরে বললেন, “একটাই শুধু খচখচানি থেকে গেল…”

“কী?” জানতে চায় ঝিনুক।

“যে-পাতায় উনি নোট রেখে গিয়েছেন, সেই ছোট নোটবুকটা কোথাও দেখছি না।”

ঝট করে একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় আসে ঝিনুকের, দীপকাকুকে বলে, “ওটা আলমারিতে থাকতে পারে।”

“থাকার কথা নয়, পাতা ছিঁড়ে বিদায়ী চিঠি লেখার পর নোটবুক আলমারিতে তুলে রাখা একটু অস্বাভাবিক। তবু দেখা যেতে পারে। কারণ, চিঠির বয়ানটা মোটেই স্বাভাবিক নয়।”

দীপকাকুর কথা শেষ হতেই অমিতেশবাবু বলেন, “চাবি কোথায় আমি কিন্তু জানি না।”

“আমি জানি।” বলে ওঠে অনির্বাণ। অনুমতির তোয়াক্কা না করে সোজা চলে যায় বইয়ের র‍্যাকের সামনে। একটা মোটাসোটা বই বের করে, তার মধ্যে চাবি। ডক্টর নন্দী হয়তো ওকে লুকোনোর জন্যই চাবিটা ওখানে রেখেছিলেন।” “

চাবি নিয়ে দীপকাকু আলমারি খুলতে যাবেন, ঝিনুকের চোখে ভেসে উঠল একটা দৃশ্য, পাল্লা খোলার সঙ্গেসঙ্গে ডক্টর নন্দীর মৃতদেহ দীপকাকুর ঘাড়ে এসে পড়ছে।

তেমন কিছু ঘটল না। কাপড়-জামায় ঠাসা একটা সাধারণ আলমারি যেমন হয়, তেমনই। লকারটাও খুলে ফেললেন দীপকাকু। সেখানে বেশ কিছু ফ্লপি, ডিস্ক দেখা গেল, একটা ফোটো অ্যালবামও আছে। ফ্লপি, ডিস্ক নামিয়ে পিছন থেকে অ্যালবাম বের করলেন দীপকাকু। পাতা উলটে মন দিয়ে দেখতে লাগলেন ফোটোগুলো। ঝিনুক পাশে এসে দাঁড়ায়। বেশির ভাগই মিটিং কনফারেন্সের ফোটো, কিছু পারিবারিক ফোটোও আছে। অমিতেশবাবু এসে নিজের বাবাকে ফোটোর মধ্যে থেকে চেনালেন।

ছোটখাটো সম্ভ্রান্ত চেহারা ডক্টর নন্দীর। দু’-একটি ফোটোতে ডক্টর নন্দীর পাশে একটা গ্রাম্য লোককে দেখা যাচ্ছে। দীপকাকু বললেন, “এ নিশ্চয়ই লালু। এর দেশের বাড়ি কোথায়?”

“ওড়িশার বালাশোর জেলার কোনও একটা গ্রামে। বাবা আর বিশ্বনাথজেঠু চাঁদিপুরে বেড়াতে গিয়ে লালুকে নিয়ে আসেন। ওর তিনকুলে কেউ নেই।”

“বিশ্বানাথজেঠুর পরিচয়টা একটু দিন।” বলেন দীপকাকু।

“আমাদের দুটো বাড়ি পরেই থাকেন। বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ বাড়িতে উনিই বেশি আসতেন। ওঁর সঙ্গে মর্নিংওয়াকে যেতেন বাবা। বিশ্বনাথজেঠু আজ ভোরে বাবাকে রাস্তায় দেখতে পাননি।”

অমিতেশবাবুর কথার মাঝে অ্যালবাম থেকে ডক্টর নন্দীর সঙ্গে লালুর ‘সবচেয়ে স্পষ্ট ফোটোটা খুলে নিলেন দীপকাকু। বিছানায় নামিয়ে রাখা ফ্লপি ডিস্কগুলো থেকে না বেছে দুটো ফ্লপি তুলে নিলেন। কেশবকে বললেন, “একটা জুতোর ফাঁকা বাক্স দাও তো।” বায়না শুনে ঝিনুক অবাক। কেশব অবুঝ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দীপকাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে বাক্স আনতে গেল।

দীপকাকু ততক্ষণে টেবিল ঘড়িটা হাতে তুলে নিয়েছেন। অমিতেশবাবুকে বলেন, “আপনার বাবার রেখে যাওয়া নোট, ফোটো, ফ্লপি, ঘড়িটা, আপাতত আমার কাছে থাক। যথাসময়ে ফেরত দেব।”

মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে অমিতেশবাবুর তেমন সায় নেই, আমতা আমতা করে বলেন, “পুলিশ বাড়িতে ইনভেস্টিগেশনে এসে এগুলো যদি চায়…’ “”

“আমার কার্ড তো আপনাকে দেওয়া আছে, ফোন নম্বরে একবার ডায়াল করবেন, বাকিটা সামলে নেব।”

অসন্তুষ্টি নিয়ে চুপ করে গেলেন অমিতেশবাবু। কেশব জুতোর বাক্স নিয়ে এসেছে, ফোটো, ফ্লপি, ডক্টর নন্দীর রেখে যাওয়া নোট এবং সবশেষে টেবিল ঘড়িটা সন্তর্পণে বাক্সে রাখলেন দীপকাকু। একটা দড়ি চেয়ে জুতোর বাক্সটা বেঁধে নিলেন। এবার চলে গেলেন অন্য প্রসঙ্গে, “লালু কি এ ঘরেই শুত?”

“না, এ ঘরের পিছনে একটা ঘর আছে, ওখানেই আমি আর লালু শুতাম।” বলল কেশব।

“চলো, ওই ঘরটা একবার দেখা যাক।”

“কী আর দেখবেন, লালু নিজের জিনিসপত্তর সব বেঁধে নিয়ে চলে গেছে।” বলে কেশব।

দীপকাকু বললেন, “তবু একবার দেখি।”

দীপকাকু ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বিছানায় রাখা ফোন সেটের রিসিভারটা কানে নিলেন। দেখলেন কানেকশন আছে কিনা। দীপকাকুর মুখ দেখে মনে হল, আছে। ফোনসেট তুলে রাখলেন টেবিলে। অমিতেশবাবুকে বললেন, “একটু সজাগ থাকবেন। এ ঘরে ফোন আসতে পারে।”

দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন দীপকাকু। ঝিনুক নোটবুক পকেটে রেখে এগোতে যাবে, কে যেন আলতো করে কনুই ধরে টান মারে। ঘুরে তাকাতে ঝিনুক দেখে, তার বয়সি সেই মেয়েটা। কখন যেন ঘরে ঢুকে এসেছে! মেয়েটার মুখে আলাপি হাসি। বলে, “আমি পামেলা, তুমি?”

সৌজন্যের খাতিরে হাসিমুখে নিজের ভাল নাম বলে ঝিনুক। তার মন চলে গেছে দীপকাকুর পিছু পিছু। পামেলা ফের বলে, “তুমি বুঝি ডিটেকটিভের অ্যাসিস্ট্যান্ট?

মাথা হেলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে ঝিনুক। উৎসাহী গলায় পামেলা বলে, “কাজটা দারুণ এক্সাইটিং না? ভীষণ থ্রিলিং! তুমি নিশ্চয়ই গেম অ্যান্ড স্পোর্টসে দারুণ। কী কী জানো তুমি? ক্যারাটে, রাইফেলশুটিং… “

শুকনো হাসে ঝিনুক। লালুর ঘরে হয়তো এতক্ষণে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। অযথা তাকে আটকে রেখেছে পামেলা। হঠাৎই ঝিনুকের মাথায় আইডিয়া খেলে যায়, এই কেসের ব্যাপারে পামেলার একটা ছোট্ট করে ইন্টারভিউ নিলে কেমন হয়! দীপকাকুর স্টাইলে ঝিনুক বলে, “আচ্ছা পামেলা, তুমি ডক্টর নন্দীকে কালপরশু কেমন দেখেছ? কোনও অসংলগ্ন কথাবার্তা, আচার-আচরণ করছিলেন কি?”

“নাঃ, দাদু একদম নর্মাল ছিল, ইনফ্যাক্ট দাদু বাড়ির সবার চেয়ে বেশি স্বাভাবিক, ঠান্ডা মাথার মানুষ।”

“তোমার কী মনে হয়, দাদু কেন নিরুদ্দেশ হলেন?”

মুখে চিন্তা ঘনাল পামেলার। অন্যমনস্ক গলায় বলে, “বুঝতে পারছি না। তবে দাদুর সঙ্গে বাবা-কাকার একদম পটত না।” সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুক জানতে চায়, “ঝগড়া হত?”

“না, ঠিক ঝগড়া নয়, কোনও বিষয়েই মতের মিল হত না। রাতে ডাইনিং টেবিলে সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়া হয়। দাদু ইদানীং ঘরে খাবার পাঠিয়ে দিতে বলত। হতে পারে সংসারের উপর অভিমান করে দাদু চলে গেছে।”

তথ্যটা মনের মধ্যে নোট করে নেয় ঝিনুক। বলল, “তোমার সঙ্গে আর-একদিন ভাল করে গল্প করা যাবে, এখন যাই, দেখি লালুর ঘরে কী হচ্ছে।”

পামেলার বিস্ময়মুগ্ধ দৃষ্টি পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল ঝিনুক।

লালু-কেশবের ঘরে এসে ঝিনুক দেখে, দীপকাকুর হাতে বেশ ক’টা ড্রয়িংশিট। মন দিয়ে আঁকাগুলো দেখছেন দীপকাকু।

অপটু হাতে জঙ্গল, পাহাড়, নদীর পেনসিল স্কেচ। নিশ্চয়ই অনির্বাণের আঁকা। এত মন দিয়ে দেখার কী আছে ভাবতে গিয়ে দীপকাকুর কথায় হোঁচট খায় ঝিনুক, বলছেন, “রং ইউজ় করত না লালু?”

অনির্বাণ উত্তর দেয়, “না, দাদু ওকে শুধু স্কেচ করা শেখাছিল। লালুদার ভাল লাগত না, প্যাস্টেল কালার চাইত আমার কাছে।”

ঝিনুক বুঝতে পারে এসব ড্রয়িং লালুর। নিজের জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিয়ে গেলেও আঁকাগুলো ফেলে গেছে।

“লালুদাকে তোমার দাদু আর কী কী শেখাত?” অনির্বাণকে প্রশ্ন করলেন দীপকাকু।

“লেখাপড়া শেখাত।” বলে, ঘরের কোণে মেঝেয় রাখা বইখাতা নিয়ে এল অনির্বাণ। দীপকাকু উলটেপালটে দেখে অমিতেশবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “ডক্টর নন্দীর কি ড্রয়িংয়ের ঝোঁক ছিল?”

ঠোঁট উলটে মাথা নাড়েন অমিতেশ। বলেন,“ না, তেমন তো কিছু দেখিনি।”

বেশ বড় করে ‘হুম’ বললেন দীপকাকু, বই, খাতা, ড্রয়িংশিট কেশবকে দিয়ে, হাতের ধুলো ঝাড়লেন। তারপর বললেন, “আপাতত আমার ইনভেস্টিগেশন শেষ।”

“ঠিক বুঝলাম না।” বললেন অমিতেশবাবু৷

দীপকাকু বলেন, “আপনি যদি চান তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাই, সে ক্ষেত্রে আপনাকে আমার ক্লায়েন্ট হতে হবে। অর্থাৎ, যা কিছু খরচ…

কথা শেষ হতে না দিয়ে অমিতেশবাবু বলেন, “বুঝেছি।” তারপর কী যেন ভাবতে থাকেন। দীপকাকুর এরকম ব্যবসায়িক আচরণ দেখে খারাপ লাগে ঝিনুকের। অবশ্য এটাও ঠিক, দীপকাকু তো শখের গোয়েন্দা নন, এটাই ওঁর প্রফেশন।

ভাবনা শেষ করে অমিতেশবাবু গম্ভীরভাবে বলেন, “আপনি কী বুঝলেন, এক-দু’দিনের মধ্যে বাবা নিজের থেকে ফিরে আসবেন না?”

“না। শুধু তাই নয়, ডক্টর নন্দী স্বইচ্ছায় নিরুদ্দেশ হননি, কিডন্যাপ্‌ড হয়েছেন।”

দীপকাকুর কথায় ঘরের সবাই চমকে উঠল। প্রবল উৎকণ্ঠায় অমিতেশবাবু বলে উঠলেন, “আপনি শিয়োর?”

“হান্ড্রেড পারসেন্ট।” আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন দীপকাকু। ঝিনুক ভেবে কূল করতে পারছে না, কী করে দীপকাকু এত নিশ্চিত হচ্ছেন।

কী একটু ভেবে নিয়ে অমিতেশবাবু জানতে চান, “বাবাকে কেন কিডন্যাপ করা হল?”

“সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো টাকার জন্য।” চিন্তান্বিত অন্যমনস্ক গলায় বললেন দীপকাকু। অমিতেশবাবু বলেন, “কই, এখনও তো মুক্তিপণ নিয়ে কোনও ফোনটোন এল না।”

“আসবে, আবার না-ও আসতে পারে।” ভাবনার গভীরে ডুব দেওয়া অবস্থায় কথাটা বললেন দীপকাকু।

এবার অমিতেশবাবুর গলায় যেন একটু চ্যালেঞ্জের সুর। বলেন, “যদি সত্যিই বাবা কিডন্যাপ্ত হয়ে থাকেন, কেসটা আপনি নিন। আই উইল পে ফর দ্যাট। অ্যাডভান্স লাগবে কিছু?”

“দিলে ভাল।” নির্বিকার কণ্ঠে বললেন দীপকাকু। অমিতেশবাবু তড়িঘড়ি পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সম্ভবত চেকবই অথবা ক্যাশ আনতে।