রহস্যময় উপত্যকা – ১

ঝিনুকের ইদানীং একটা নতুন ঝোঁক চেপেছে। খবরটা এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। গোপনীয়তার কারণ, একটা কাজও সে এখনও কমপ্লিট করতে পারেনি। সম্পূর্ণ না করে কোন স্পর্ধায় সে ঘোষণা করবে, আমি একজন সম্ভাবনাময় ডিটেকটিভ গল্পের রাইটার! গোয়েন্দার নাম ঠিক হয়ে গেছে, আদিত্য রায়। জম্পেশ নাম।

দীপঙ্কর বাগচীর চেয়ে অনেক ভাল। চেহারাও দীপকাকুর তুলনায় অনেক হ্যান্ডসাম। সাড়ে ছ’ফুটের মতো হাইট, ফরসা টকটকে গায়ের রং। ক্লিন শেভেন। চোখে চশমার বালাই নেই। মার্শাল আর্টে ওস্তাদ। তেমনই বন্দুকের নিশানা। মানে জাস্ট অপজিট দীপকাকু। আদিত্য রায়ের সহকারী ওঁর কলেজ মেট কানাই ঘোষ৷ ভীষণ ভালবাসেন আদিত্যকে। শার্লক হোমসের অ্যাসিস্ট্যান্ট ওয়াটসনের মতো সমস্ত ঘটনাপঞ্জি লিখে রাখেন তিনি।

চরিত্রের কাঠামো একদম তৈরি। এই ফ্রেমে তিনটে অসমাপ্ত গল্প লিখে ফেলেছে ঝিনুক। রহস্যের জট এতটাই পাকিয়ে গেছে যে, নিজেই খুলতে পারেনি। এসব গল্প কাউকে পড়ানো যাবে না। কেউ হাসবে, কেউ বা দেবে স্তোক, সান্ত্বনা। যার কোনওটাই ঝিনুকের কাম্য নয়। ক’দিন হল খুব হতাশ লাগছে। মনে হচ্ছে এ লাইন আমার নয়।

আজ সকাল থেকে চার নম্বর গল্পটা চেষ্টা করছে ঝিনুক। মাঝে কম্পিউটার ক্লাস, ক্যারাটে ক্লাব ঘুরে এসেছে। এখন সন্ধে, পাতা ছয়েক লেখাও হয়ে গেছে গল্পটা। ভাবা রয়েছে অনেক দূর। একটু

আগে ভাবনাটা খতিয়ে দেখতে গিয়ে হোঁচট খেল প্রবল।

প্লটটা মোটামুটি এরকম, কলকাতার এক বড়লোক বনেদি বাড়ির অষ্টধাতুর একটি মূর্তি চুরি গেছে। বিষ্ণু মূর্তিটার হাইট এক ফুট, ওজন এক কেজি। এ-বাড়িতে আদিত্য রায় আগে এসেছেন, তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয়র বাড়ি এটা।

বাড়ির লোক আদিত্য রায়কে তদন্তের ভার দেন। আত্মীয়র মধ্যে এত বড় ডিটেকটিভ থাকতে খামোখা পুলিশের কাছে কেন যাবেন। তদন্ত করতে গিয়ে আদিত্য রায়ের ধারণা হয়, মূর্তিটা এখনও এবাড়িতেই আছে, সরিয়ে ফেলা হয়নি। চোর এ-বাড়িরই কেউ। কোথায় লুকিয়েছে, সেটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা আদিত্য দাঁড়িয়েছিলেন নাচঘরের ঝাড়বাতির নীচে। বাড়ির গা দিয়ে বয়ে গেছে হুগলি নদী। হাওয়া আসছিল এলোমেলো। ঝাড়বাতি দুলছিল রিনঠিন শব্দে। হঠাৎই কপালে ভাঁজ পড়ে আদিত্য রায়ের। এ-বাড়ির ঝাড়বাতির শব্দ তিনি আগেও শুনেছেন, আজ যেন কেমন অন্যরকম আওয়াজ।

আসলে চুরি যাওয়া মূর্তিটা লুকোনো আছে ওখানেই। সেটাই আবিষ্কার করবেন আদিত্য রায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, অত উঁচুতে ঝাড়বাতির মধ্যে জিনিসটা রাখল কে? যদি ছুড়ে দিয়ে থাকে, জিনিসটা আটকে না গিয়ে, পড়ে ভেঙে যেতে পারত। তাতে চোরের কোনও লাভ হত না। ভাবনা এখানে এসেই থেমে গেছে ঝিনুকের। এক ইঞ্চিও এগোতে পারছে না। এতটা লেখা পাতা কি শুধুই পণ্ডশ্রম?

পেনটা খাতার উপর নামিয়ে রাখে ঝিনুক। চেয়ারে ঠেস দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। গোয়েন্দা গল্প লেখা যে এত কঠিন কাজ, আগে বুঝতে পারলে কিছুতেই চেষ্টা করত না। তাকে এ কাজে প্রবৃত্ত করেছে একজনের উপেক্ষা। তিনি এখন ড্রয়িং রুমে

বসে বাবার সঙ্গে দাবা খেলছেন। অর্থাৎ দীপকাকু। মিশরের রানির চিঠি উদ্ধারের পর থেকে তিনি আর কোনও কাজেই ঝিনুককে সহকারী করেননি। জিজ্ঞেস করলে বলেছেন, ‘এখন সব আজেবাজে কাজ নিয়ে আছি। তোমার ভাল লাগবে না।

“কী ধরনের কাজ?” জানতে চেয়েছিল ঝিনুক।

উত্তরে দীপকাকু বলেছেন, “যেমন ধরো, এক ভদ্রলোক রোজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন, তাঁর পাঞ্জাবির পিঠে কালি ছিটোনোর দাগ। কে যে কোথায়, অফিসে না বাসে কাজটা করছে, ধরা যাচ্ছে না। আর একটা কেস, বরানগরে ঘোষালবাড়ির সামনে প্রত্যেক শনিবার সিঁদুর লাগানো ফুল, বেলপাতা, কাচ ভাঙা ছোট্ট আয়না পড়ে থাকতে দেখা যায়। এটা হচ্ছে তুক করা। ঘোষালবাড়ির অনিষ্ট কামনা করছে কেউ বা কারা। “”

আরও কেসের কথা বলতে যাচ্ছিলেন দীপকাকু, বাবা সামনেই ছিলেন, বলে ওঠেন, “কেন এসব ফালতু কেস নাও, দর কমে যাবে তোমার। বুদ্ধিতে জং ধরে যাবে। যারা এসব কেসের অপরাধী, খুবই অল্প বুদ্ধির মানুষ। এদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া কি তোমার মতো জিনিয়াসের মানায়!”

প্রশংসাটা হজম করে দীপকাকু বলেছিলেন, “উপায় নেই দাদা, এগুলোই আমার নেট প্র্যাকটিস। নেমে পড়েছি যখন এ লাইনে, মাথাটাকে সচল রাখতে হবে, চালাতে হবে খরচও। আমি তো আর শখের ডিটেকটিভ নই।”

সত্যি বলতে কী, কেসগুলো শুনে ঝিনুকেরও খুব একটা ভক্তি জাগেনি। তবু তারও তো প্র্যাকটিস দরকার। রানির চিঠি উদ্ধারের পর কাগজ টিভিতে ঝিনুকের নাম, ফোটো সবই বেরিয়েছে, দীপকাকু ছিলেন অন্তরালে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা তারপর থেকে ঝিনুককে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, ‘তোদের পরের এক্সপিডিশন কী?’

শুনে শুনে বোর হয়ে গিয়েছে ঝিনুক। কেন যে দীপকাকুর কাছে বড়সড় কেস আসে না, কে জানে!

না আসার যথেষ্ট কারণও আছে, যা গেটআপ! সিঁথি কাটা চুল, মোটা গ্লাসের চশমা, অ্যাভারেজ হাইট, পায়ে চটি, শার্ট ইন করেন আলেকালে। তাই তো ঝিনুক সৃষ্টি করেছে আদিত্য রায়কে। সমস্যা হচ্ছে, আদিত্য রায় যতই স্মার্ট হন, মাথার গ্রে ম্যাটারটা তো ঝিনুকের। বুদ্ধির দৌড় তাই সংক্ষিপ্ত।

দীপকাকুর উপর অভিমান করেই গোয়েন্দা গল্প লিখতে আরম্ভ করেছিল ঝিনুক, একটা লেখা কমপ্লিট করে সবাইকে চমকে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। বোঝা গেল হবে না। আজকের লেখাটার জন্য আপশোস হচ্ছে, প্রায় মেরে এনেছিল।

চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে ঝিনুক, দীপকাকুর কাছেই যেতে হবে মনে হচ্ছে। একটু যদি গাইড করেন, দাঁড়িয়ে যাবে গল্পটা।

নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংয়ে আসে ঝিনুক। বাবা, দীপকাকু জগৎ সংসার ভুলে দাবার বোর্ডে নিমগ্ন।

ঝিনুক বাবার সোফার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাবা হয়তো টেরই পাননি। গলা ঝেড়ে ঝিনুক বলে, “দীপকাকু, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।”

বোর্ড থেকে চোখ না তুলেই দীপকাকু বলেন, “গল্পটা কোথাও এসে আটকে গিয়েছে?”

স্বাভাবিক কারণেই চমকায় ঝিনুক। যদিও এরকম পরিস্থিতিতে দীপকাকু তাকে আগেও অনেকবার ফেলেছেন। প্রতিবারের মতো এবারেও কৌতূহলী হয় সে। জানতে চায়, “কী করে বুঝলেন?”

মাথা নিচু, দীপকাকু বলে যান, “বউদি বলছিলেন, তুমি নাকি লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে এসে ক’দিন খুব পড়াশোনা করছ, লিখছ। কাল একবার ঢুকেছিলাম তোমার ঘরে। টেবিলে দেখলাম, আর্থার কোনাল ডয়েল, গিলবার্ট কিথ চেস্টারটন, কার্টার ডিক্সন, আগাথা ক্রিস্টি, একসঙ্গে এত পড়লে মাথা তো গুলিয়ে যাবেই। তা বলো, কোথায় আটকেছে গল্পটা?”

মেজাজটা পুরো বিগড়ে গেল ঝিনুকের। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই ছুটে যায় নিজের ঘরে, ছিঁড়ে ফেলে আজ সকাল থেকে লেখা ছ’টা পাতা। পরক্ষণে মায়া জাগে নিজের লেখার উপর। আহা রে, গল্পটা প্রায় হয়ে এসেছে।

অগত্যা বড় একটা ঢোক গিলে ঝিনুক বলতে থাকে নিজের গল্প। মাঝপথে বাবা বলে ওঠেন, “দারুণ হচ্ছে, এগিয়ে যা।” দীপকাকু কোনও মন্তব্য করেন না। হোঁচটের জায়গায় এসে থামে ঝিনুক। দীপকাকুকে জিজ্ঞেস করে, “কে হতে পারে চোর, কী উপায়ে রাখবে মূর্তিটা, অত উঁচুতে ঝাড়বাতির মধ্যে?”

দীপকাকুর এক্সপ্রেশনে কোনও পরিবর্তন নেই। বোঝাই যাচ্ছে না, ঝিনুকের প্রশ্নটা শুনেছেন কিনা। চেয়ে আছেন দাবার বোর্ডের দিকে। গুটি তুলে একটা দানও দিলেন। চালটায় বাবা পড়েছেন বেকায়দায়, ভুলেই গেছেন, এইমাত্র ঝিনুক একটা গল্প বলছিল। নিজেকে কেমন যেন বোকাবোকা লাগে ঝিনুকের।

এমন সময় ডোরবেল বেজে ওঠে। নিশ্চয়ই মা। গড়িয়াহাটে শপিংয়ে গিয়েছিলেন। বাবার পাশ থেকে এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলে ঝিনুক। দ্যাখে, কুরিয়ারের লোক। তার মানে বাবার চিঠি। এসময় প্রায়ই আসে। লোকটা কিছু বলার আগেই ঝিনুক বাবার উদ্দেশে বলে ওঠে, “বাবা, তোমার চিঠি।”

“তুই সই করে নিয়ে নে।” চাল দিতে দিতে বলেন বাবা।

কুরিয়ারের লোকটা বলে, “চিঠিটা আঁখি সেনের নামে…

ভ্রু কুঁচকে যায় ঝিনুকের, তাকে কুরিয়ার করে কে চিঠি পাঠাবে! বন্ধুরা কার্ডফার্ড পাঠাতে পারে, কিন্তু এখন তো কোনও উপলক্ষ নেই। প্রায় কুড়ি দিন হতে চলল বাংলা নববর্ষ গিয়েছে। তা ছাড়া বন্ধুরা এত খরচা করে কার্ড পাঠাবেই না।

সই করে খামটা হাতে নিয়ে ঝিনুক টের পায়, কার্ড নয়, পাতলা কোনও কাগজ। ডেলিভারিম্যান চলে গেলে, দরজা বন্ধ করে ঝিনুক। ফিরে এসে বসে সোফায়। খামটা খুলতে যাবে, দাবার বোর্ডে মন রেখে হাত বাড়ান বাবা। ঝিনুক বলে, “তোমার নয়, আমার চিঠি।”

মুখ ফেরান বাবা। অবাক গলায় বলেন, “তোকে আবার কে কুরিয়ার করে চিঠি পাঠাল ?”

একটু যেন গর্ব ভরে খামটা খুলতে থাকে ঝিনুক। বেরিয়ে আসে পার্সোনাল প্যাডের পাতায় লেখা চিঠি। কাগজের মাথায় ছাপার অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা ড. বিপুল নন্দী, বায়োটেকনোলজিস্ট, অ্যাড্রেস ডোভার লেনের, আর ফোন নম্বর।

বাবা ফের জানতে চান, “কে?”

চিঠির ব্যাপারে দীপকাকুর কোনও কৌতূহল নেই, বাবাকে তাড়া দেন, “চাল দিন রজতদা।”

দাবার ধাঁধায় ডুবে যান বাবা। ঝিনুক চিঠিটা পড়তে থাকে। জীবনে এই প্রথমবার কেউ তাকে কুরিয়ারে চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠি শুরু হয়েছে এরকমভাবে –

স্নেহের আঁখি,

লেটারহেড প্যাডের উপরের লেখা পড়ে আমার পরিচয় জানলে। বয়সটা বলি, ৬২। একটা বিশেষ প্রয়োজনে দীপঙ্কর বাগচীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। মি. বাগচীর কর্মকুশলতা সম্বন্ধে জানতে পারি মিশরের রানির চিঠি উদ্ধারের খবর পড়ে। যে অভিযানে তুমিও সঙ্গে ছিলে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমি যে সমস্যায় এখন পড়েছি, একমাত্র মি. বাগচীর মতো মেধাসম্প গভীর মনের ডিটেকটিভ আমাকে উদ্ধার করতে পারেন।

দীপঙ্করবাবুর ঠিকানা, ফোন নম্বর কোনওটাই আমার জানা নেই। যে কাগজে তোমাদের অনুসন্ধানের বিবরণ বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছিল, তাদের অফিসে ফোন করে তোমার ঠিকানা, ফোন নম্বর পাই। ফোন করতে পারতাম, যদি উড়ো ফোন ভেবে গুরুত্ব না দাও, সেই ভেবেই এই চিঠি।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মি. বাগচীকে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এসো। আগে একটা ফোন করে নিতে পারো। আমি বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকি। সমস্যা খুবই গুরুতর বলে জেনো। এর সঙ্গে শুধু আমি জড়িয়ে নেই, গোটা মনুষ্যকুল জড়িত।

ড. বিপুল নন্দী

ঝিনুককে লেখা হলেও চিঠিটা আসলে দীপকাকুর। তার জন্য মোটেই খারাপ লাগে না ঝিনুকের। আশা করাই যায়, এই তদন্তে দীপকাকু তাকে সঙ্গে নেবেন।

চিঠিটা দীপকাকুর দিকে বাড়িয়ে ঝিনুক বলে, “নতুন কেস।”

কেস শব্দটা দীপকাকুর একাগ্রতায় চিড় ধরায়। কপালে ভাঁজ ফেলে ঝিনুকের হাত থেকে চিঠিটা নেন। মন দিয়ে পড়তে থাকেন। বাবা কিছুটা বিস্মিত। বলেন, “কী হল দীপঙ্কর, তুমি ওর চিঠি পড়ছ কেন?”

উত্তর না দিয়ে চিঠি পড়া শেষ করেন দীপকাকু। উলটে পালটে কাগজটা দেখেন। তারপর চিন্তায় ডুবে যান। বাবা কিছু বুঝতে না পেরে দীপকাকুর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়তে থাকেন। ঝিনুক চেয়ে আছে দীপকাকুর মুখের দিকে। পরের সিদ্ধান্তটা কী নেন, সেটাই দেখার।

বাবা বলে ওঠেন, “আরে, এ চিঠি নিয়ে এত চিন্তার কী আছে!”

“কেন এ কথা বলছেন?” জানতে চান দীপকাকু।

“ঝিনুকের বন্ধুরা প্ল্যান করে এটা পাঠিয়েছে, ওকে ঠকানোর জন্য। তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার পর থেকে খুব জাহির করে হয়তো নিজেকে।”

বাবার কথা পুরোপুরি ফেলে দিতে পারে না ঝিনুক, সত্যিই সে একটু হাইট নিয়ে চলে বন্ধুদের মধ্যে। হেনস্থা করার একটা চেষ্টা নিতেই পারে ওরা। শ্রবণা, রুদ্রাণী, এলা, রাহুল, অয়ন…সবার মুখ মনে পড়ে পরপর, মহাবিচ্ছু সবক’টা।

ঠোঁট উলটে দীপকাকু বলেন, “না রজতদা, এই চিঠি অরিজিনাল।’ “”

“কী করে বুঝলে?” জানতে চান বাবা।

“হ্যান্ডরাইটিং আর চিঠির বয়ান দেখে। বয়স্ক এবং শিক্ষিত মানুষের লেখা। চিঠির ভাষাই সেটা বলে দিচ্ছে।” বলে, ঝিনুকের দিকে ফেরেন দীপকাকু। নির্দেশ দেন, “যাও, ভদ্রলোককে একটা ফোন করো।’ “

“ফোন করে কী বলব, কবে দেখা করছি আমরা?” জানতে চায় ঝিনুক।

দীপঙ্কর বলেন, “আগে কথা বলে দেখে নিই, সমস্যাটা ঠিক কী রকম, আদৌ আমার এক্তিয়ারের মধ্যে কিনা। তারপর দেখা করার “”

ঝিনুকদের কথোপকথনে রজতও আগ্রহী হয়েছেন। বলেন, “দ্যাখ না রিং মেরে কী বলে। সায়েন্টিস্ট মানুষ, মনে তো হচ্ছে উঁচুমানের কেস পেতে যাচ্ছে দীপঙ্কর।”

দীপকাকুর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে ঘরের কর্নারে ফোনস্ট্যান্ডের সামনে যায় ঝিনুক। চিঠিতে লেখা নম্বরে ডায়াল করে। ও প্রান্তে রিং হচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। একসময় থেমে গেল রিং।

দীপকাকু বললেন, “ধরছে না?” মাথা নাড়ে ঝিনুক।

“আবার করো।” বলেন দীপকাকু।

দ্বিতীয়বারও কেউ ধরল না। ঝিনুক খানিকটা হতাশ। দীপকাকু বলেন, “চিঠিতে লিখছেন সবসময় বাড়িতে থাকি, এখন কেন নেই?”

“ওটা কথার কথা। গিয়েছেন হয়তো আশপাশের দোকানে অথবা বাথরুমেও থাকতে পারেন।” বলে দাবার বোর্ডে মনোনিবেশ করেন রজত। ঝিনুক দ্যাখে, দীপকাকুও গিয়ে বসছেন খেলায়। আবার কতক্ষণ পর বিপুল নন্দীকে ফোন করা হবে ঠিক করা হল না। মনটা ছটফট করে ঝিনুকের। অস্থিরতা কাটাতে ঝিনুক ফিরে যায় নিজের গল্পের সমস্যায়। ছোট্ট করে কেশে নিয়ে দীপকাকুর উদ্দেশে বলে, “তা হলে আমার ব্যাপারটা কী হল? কে হতে পারে…’ “

কথা শেষ হওয়ার আগেই দীপকাকু বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, “ডিটেকটিভ গল্প লেখার মতো সহজ কাজ খুব কম আছে। অপরাধ, ব্লু, অপরাধী সবই তার হাতে। মাঝে শুধু কিছুটা ধাঁধা তৈরি করতে হয়। তুমি সেটা আগেই করে ফেলেছ। খুবই ইনোসেন্ট রাইটারের লক্ষণ এটা।”

এটা যে প্রশংসা নয়, ভালভাবেই টের পায় ঝিনুক। দীপকাকুর গোঁফের আড়ালে লুকিয়ে আছে মিচকে হাসি। গল্পের স্বার্থে বিদ্রুপটা অগ্রাহ্য করে ঝিনুক বলে, “বলুন না একটা সলিউশন।’ “”

চাল দিতে দিতে দীপকাকু বলতে থাকেন, “প্রাচীন আমলের বাড়ি। ঝাড়বাতি যখন আছে, অন্যান্য ল্যাম্পশেড থাকার কথা। বাড়ির একটি চাকর এক সপ্তাহ অথবা পনেরো দিন অন্তর ঘড়াঞ্চিতে উঠে বাতিদানগুলো পরিষ্কার করে। দোষটা তার ঘাড়েই চাপিয়ে দাও। ঘড়াঞ্চি জিনিসটা কী, জানো তো? সিঁড়ি উইথ স্ট্যান্ড।”

ঘড়াঞ্চি বস্তুটা চেনে ঝিনুক। ইলেকট্রিশিয়ানরা ব্যবহার করে। গল্পের সমস্যাটা এত অনায়াসে সমাধান হয়ে যাবে, আশা করেনি ঝিনুক। এখন তার উৎফুল্ল হওয়ার কথা। হচ্ছে না মোটেই। গল্পটা আর নিজের বলে মানতে ইচ্ছে করছে না। আজ সকাল থেকে লেখা পাতাগুলো ফেলেই দেবে ঝিনুক।

কুরিয়ারে আসা চিঠি ফের পড়তে শুরু করে ঝিনুক, কাগজে ভেসে ওঠে আর্ত অসহায় এক বিজ্ঞানীর মুখ। নিশ্চয়ই গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে এই কেসে। যার পুরোটাই অজানা, ঝিনুকের গল্পের মতো বানানো নয়।

“আর-একবার ট্রাই করো তো নম্বরটা।” বললেন দীপকাকু। তার মানে খেলায় মন নেই, চিঠিটা নিয়ে উনিও উদগ্রীব।

ঝিনুক উঠে গিয়ে ফের ডায়াল করে, সেই একই ব্যাপার, রিং হয়েই যাচ্ছে। বারতিনেক রি-ডায়াল টিপেও লাভ হল না। হতাশ ভঙ্গিতে ঝিনুক ফিরে আসছে, সোফা ছেড়ে উঠে পড়েন দীপকাকু। বাবাকে বলেন, “রজতদা, বোর্ডের যা সিচুয়েশন, আপনি প্রায় জিতেই গেছেন। আমি বরং ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে ঘুরেই আসি।”

ঝিনুক চট করে একবার দাবার বোর্ডে চোখ বুলিয়ে নেয়, দীপকাকু মিথ্যে অজুহাত দিচ্ছেন। খেলা ওঁর অনুকূলে। বাবা অবাক গলায় বলে ওঠেন, “তুমি তো আশ্চর্য হ্যাংলা গোয়েন্দা, দীপঙ্কর। ভদ্রলোক লিখেছেন ফোন করে আসতে, আগ বাড়িয়ে পৌঁছে যাবে! তা ছাড়া চিঠিটা যে সত্যিকারের, সেটা তোমার ধারণামাত্র। ভুলও তো হতে পারে।”

“চিঠিটা হয়তো ফল্স, তবু বিষয়টা একবার খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ, চিঠির শেষ কথাগুলো খুবই সিরিয়াস, ‘সমস্যার সঙ্গে শুধু আমি জড়িয়ে নেই, গোটা মনুষ্যকুল জড়িত।’ যদি সত্যিই তাই হয়!” বলে হঠাৎ দরজার দিকে ঘুরে গেলেন দীপককাকু। ভূতগ্রস্তের মতো ছিটকিনি খুলে বেরিয়েও গেলেন।

রজত হতভম্ব হয়ে তাকান মেয়ের দিকে। ঝিনুক হাত তুলে বাবাকে আশ্বস্ত করে। মুখে বলে, “এখনই ফিরে আসবেন। ততক্ষণ ড্রেসটা চেঞ্জ করে নিই। আমাকেও তো যেতে হবে দীপকাকুর সঙ্গে।”

“কী করে বুঝলি, ফিরে আসবে?” জানতে চান রজত।

নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সবজান্তা ভঙ্গিতে ঝিনুক বলে, “বুঝলাম।”

ঘরে এসে জিনস্, টপ পরতে না-পরতেই ঝিনুক শুনতে পেল ডোরবেলের আওয়াজ। তারপরই দীপকাকুর গলা, “রজতদা, চিঠিটা কোথায় রেখে গেলাম। চিঠি ছাড়া তো ভদ্রলোক আমার সঙ্গে কথাই বলবেন না। “”

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ব্রাশ করতে করতে হাসে ঝিনুক। মনেমনে বলে, ‘এত ভুলো মন নিয়ে কী করে যে জটিল সব সমস্যার সমাধান করেন, কে জানে!’

চিঠিটা রয়ে গিয়েছিল ঝিনুকের কাছে। হাতে নিয়ে ড্রয়িংয়ে আসে সে। চিঠিটা দেখিয়ে দীপকাকুকে বলে, “এটা আমাকে অ্যাড্রেস করে লেখা, তাই আমিও যাব আপনার সঙ্গে।”

দীপকাকু আর না করতে পারেন না। বাবা বলেন, “হ্যাঁরে, তোর মা এলে কী বলব?”

“বলে দিয়ো কাছাকাছি কোথাও গেছি!”

“বন্ধুর বাড়ি?”

“তুমি যেমন ভাল বুঝবে বলে দিয়ো।”

বলে দীপকাকুর সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছিল ঝিনুক। বাবা বলেন, “গাড়িটা নিয়ে তোর মা ফিরুক। তারপর না হয় তোরা গাড়িতেই যা।”

‘তোমার মাথা খারাপ? মাকে বুঝিয়ে রাজি করাতেই রাত কাবার হয়ে যাবে।”

বাড়ির বাইরে এসে ট্যাক্সি নিলেন দীপকাকু। রাস্তায় এখন গিজগিজ করছে গাড়ি। অফিস ছুটির টাইম। মুর অ্যাভিনিউ থেকে ডোভার লেন কমপক্ষে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। ট্রাফিক স্মুথ থাকলে কুড়ি মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। দেরি নিয়ে ঝিনুকের কোনও মাথাব্যথা নেই। বাবা ঠিকঠাক মাকে ম্যানেজ দিতে পারলেই হল। ঝিনুকের এখন আপশোস হচ্ছে, খামোখা কাছাকাছি কথাটা বলতে বলল বাবাকে। ‘বন্ধুর বাড়ি’ কথাটাতেও না করেনি। বাবা যদি সবচেয়ে কাছের বন্ধু শ্রবণার বাড়ির নাম করে দেন, মা তক্ষুনি ফোন করবেন। ডিটেকটিভের অ্যাসিস্ট্যান্টের এই মিস্টেকটা করা উচিত হয়নি।

আড়চোখে দীপকাকুর দিকে তাকায় ঝিনুক, গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন। কেসটা না জেনেই এত চিন্তা কীসের কে জানে!

বুকপকেট থেকে মোবাইল বের করলেন দীপকাকু। নম্বর টিপতে থাকলেন। ঝিনুক আন্দাজ করতে পারে। আবার একবার ফোন করা হচ্ছে ভদ্রলোককে।

ঝিনুকের আন্দাজ মিলল না। দীপকাকু কানে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, “বাপ্পা, দীপঙ্কর বলছি।”

……

“বায়োটেকনোলজির উপর রিসেন্ট কী কী ব্যাপারে রিসার্চ হচ্ছে বলতে পারিস?”

“ঠিক আছে। আপাতত আমার কাজ চলে যাবে। তুই রাতে একবার ইন্টারনেটটা সার্ফ করে রাখিস তো। আমি কাল সকালে তোকে একটা ফোন করব।”

অপর প্রান্তের কোনও কথা শুনতে পেল না ঝিনুক। এটুকু বুঝতে পারল, দীপকাকু হোমওয়ার্ক করতে শুরু করে দিয়েছেন। ড. বিপুল নন্দী বায়োটেকনোলজিস্ট, বিষয়টার লেটেস্ট পজিশন জেনে না নিলে চলবে কেন! বায়োটেকনোলজি নিয়ে ঝিনুকের ধারণা খুবই সীমিত। সে যতটুকু জানে, তা হচ্ছে, জীবকোষ নিয়ে নানা কারিকুরি করাই জৈবপ্রযুক্তির কাজ। চাহিদামতো ফল ফুল ফলানো। মানুষের দেহকোষের জিন বিশ্লেষণ করে, রদবদল ঘটিয়ে রোগ প্রতিহত করা, এরকম বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে পৃথিবী জুড়ে। এসব ভারী ব্যাপারে ঝিনুকের কোনও ইন্টারেস্ট নেই। তার একটাই চাওয়া, কেসটা যেন বেশ রোমহর্ষক হয়।