রস আর আলো
উদ্ভিদ রস বিনা বঁাচে না, আলো বিনা বাড়ে না। আলো আর রস তার নিত্য আবশ্যক। জ্ঞানকে যদি বলি আলো আর আনন্দকে রস তাহলে আলো আর রস মানুষেরও নিত্য আবশ্যক।
মানুষের মন যেন আকাশের দিকে উন্মুখ হয়ে আছে, আলোর জন্যে, জ্ঞানের জন্যে। আকাশেরও সীমা নেই, আলোরও অবধি নেই। আবিষ্কারের পর আবিষ্কার মানুষের জ্ঞানের পিপাসা তৃপ্ত করছেও বটে, বৃদ্ধি করছেও বটে। এমনি করে মানুষ মনের দিক থেকে বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে পশু থেকে মানুষ হয়েছে, মানুষ থেকে সভ্য শিক্ষিত মানুষ।
তেমনি মানুষের হৃদয় যেন ধরিত্রীর বুকে মুখ রেখে স্তন্য অন্বেষণ করছে, রস অন্বেষণ করছে। অন্বেষণ করছে আনন্দ, কখনো-বা তার নাম বেদনা। পার্থিব জীবন তাকে নিত্য অভিষিক্ত করছে নানা বিচিত্র রসে। তৃপ্ত করছে তার তৃষা, অতৃপ্ত রাখছেও। অনুভূতির গাঢ়তা, গভীরতা ও বিচিত্রতা তাকে সহৃদয় করে, নতুবা সেহদয়হীন হয়, অসাড় হয়। পাষাণ হয়ে যায়। মানব রূপধারী জীবন্ত পাষাণকে মানুষ বলিনে। জড়পদার্থ বলি। হৃদয়ের দিক থেকে নীরস যারা তারা সভ্য শিক্ষিত হলেও অমানুষ। তাদের চেয়ে অসভ্য অশিক্ষিত ভালো, যদি সহৃদয় হয়, স-রস হয়। ধরিত্রীর স্নেহের দুলাল এরা। এরাই জানে বঁাচতে।
মানুষের রসের পিপাসা অনাদি কালের। প্রকৃতির কাছে পৃথিবীর কাছে পার্থিব জীবনের কাছে মানুষ যে রস পায় তাতেও সেতুষ্ট নয়। তাকে তুষ্ট করার ভার নিয়েছে কবি সংগীতকার ভাস্কর চিত্রকর নর্তকী ও নট। এরা দিচ্ছে এদের হৃদয়ের রস, দিচ্ছে কাব্য সংগীত ভাস্কর্যরূপে, নৃত্য নাটক চিত্ররূপে। আরও অনেক রূপ আছে। সব রূপই হৃদয়রসের রূপ। সব রূপই মানবহৃদয়ের সৃষ্টি। অনুভূতির তুলি দিয়ে আঁকা, অনুভূতির লেখনী দিয়ে লেখা। একের অনুভূতি এমনি করে অপরের হয়। কবির অনুভূতি পাঠকের, গায়কের অনুভূতি শ্রোতার, ভাস্করের অনুভূতি দর্শকের। জীবনের কাছে সরাসরি যা পায় পাঠক বা শ্রোতা বা দর্শক তাই যথেষ্ট মনে করে না, আরও চাই আর্টের মাধ্যমে। আর্ট তাকে এনে দেয় এমন একটা রস যেটা তার অনাস্বাদিত। অথবা এমন একটা রস যেটা আস্বাদিত হলেও আবার আস্বাদন করতে সাধ যায়। পরের অনুভূতির সঙ্গে নিজের অনুভূতি মিলে গেলেও আনন্দ, না মিললেও আনন্দ। তারপর যে অনুভূতি নিজে প্রকাশ করতে পারছিনে অপরে তা প্রকাশ করলেও আনন্দ।
আর্ট হল রসের যমুনা। আর বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস অর্থনীতি হল আলোর আকাশগঙ্গা। আলোর জন্যে আমরা আকাশগঙ্গার পথে ঘুরি। রসের জন্যে ফিরি যমুনাপুলিনে। রসের জন্যে বললে ঠিক বলা হয় না। বলতে হয় রূপঘন রসের জন্যে। বা রসঘন রূপের জন্যে। যে রসের রূপ নির্দিষ্ট হয়নি তা আর্ট হয়ে ওঠেনি। তার জন্যে যমুনার কূলে না ফিরে সোজাসুজি সাগরজলে ঝাঁপ দেওয়া ভালো। জীবনের সাগরজলে।
আর্ট হচ্ছে রসাত্মক রূপ বা রূপাত্মক রস। বাক্যং রসাত্মকং কাব্যং। যেখানে রূপ নেই সেখানে আর্ট নেই। যেখানে রস নেই সেখানে তো নেই-ই। কূল আর জল দুই নিয়েই নদী। রূপ আর রস দুই নিয়েই আর্ট। দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস প্রভৃতির এমন কোনো বন্ধন বা বঁাধ নেই, আলোকে ধরে রাখতে পারে এমন কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই। দর্শন বিজ্ঞানের ভাষা রূপহীন, অলংকারহীন। পক্ষান্তরে সাহিত্যের ভাষা রূপবান, সালংকার। ভাষা যেক্ষেত্রে রূপহীন ভাবও সেক্ষেত্রে রূপহীন, কারণ ভাব ও ভাষা অভিন্ন। দর্শন আমাদের আলোর দর্শন দেয়, বিজ্ঞান দেয় আলোর স্পর্শন। কিন্তু কোথাও তাকে ধরে রাখতে বেঁধে রাখতে গেলে দেখি সেধরাছোঁয়ার বাইরে। তাকে একটা চিহ্ন দিয়ে প্রতীক দিয়ে সাংকেতিক ভাষায় বোঝাতে হয়। সেক্ষেত্রে রূপসৃষ্টির চেষ্টা করা বৃথা। করলে সেটা সায়েন্স না হয়ে পপুলার সায়েন্স হবে। সূর্যের আলো নয়, চাঁদের আলো।
আলোর ধর্ম এই, সেবাক্যে ধরা দেয় না। বাক্য তাকে প্রকাশ করতে পারে না। যদি-বা কোনোমতে প্রকাশ করে তো আভাসে ইঙ্গিতে সংকেতে। সেইজন্যে আলো নিয়ে আর্ট হয় না। যদি হয় তবে তা সূর্যের আলো নয়, চাঁদের আলো। ইন্টেলেকচুয়াল উপন্যাস লিখতে গিয়ে দেখেছি সূর্যের আলোকে আকার দেওয়া যায় না। বড়োজোর মেঘের আড়াল দেওয়া যায়, আড়াল থেকে তাকে বিচিত্র দেখায়, আড়ালটাও বিচিত্র রূপ নেয়। তাতে মনের ক্ষুধা মেটে না। মন চায় মুক্ত আকাশ যার কোথাও কোনো ঝাপসা বা মেঘলা নেই, গোধূলি বা রাত্রি নেই। যার সবটাই আলো। নগ্ন আলো। আর্ট কি কখনো মেটাতে পারে এ ক্ষুধা? আর্ট বড়োজোর মানুষের আড়াল দিয়ে মানুষের উপর আলোর ক্রিয়া কেমনতরো তারই একটা বিবরণ বা বর্ণনা দিতে পারে। সেটার বিচিত্রতাই আর্টের আলোকসাধনার সীমা। তরুর আলোকসাধনা যেমন পত্রের শ্যামলতায় পর্যবসিত।
তা বলে তরু তার আলোকসাধনায় নিবৃত্ত হতে পারে না। আর্টকেও করতে হয় আলোর সাধনা আপন শক্তির সীমা কতটুকু তা জেনে ও মেনে। এমন কোনো মহাকাব্য নেই যাতে কেবল রসই আছে, আলো নেই। হৃদয়ের ভোজ্যই আছে, মনের ভোজ্য নেই। কাব্য প্রধানত রসাত্মক বটে, কিন্তু উপরন্তু জ্যোতির্ময় না হলে মহাকাব্য হতে পারে না। তমসো মা জ্যোতির্গময় মানবমনের এ আকিঞ্চন কি কেবল দার্শনিকের, বৈজ্ঞানিকের? এ কি শিল্পীরও নয়? রসিকেরও নয়? আর্টের যমুনার সঙ্গে বিজ্ঞান দর্শনের জাহ্নবী যদি যুক্ত হয় তো সেই যুক্তবেণী আর্টের মহিমা ক্ষুণ্ণ করে না, বৃদ্ধি করে বরং। যদি-না রূপ তার দ্বারা মগ্ন হয়, বঁাধ তার দ্বারা ভগ্ন হয়। আর্টের আত্মার সঙ্গে দর্শন বিজ্ঞানের আত্মা মিলিত হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু তনু যেন আর্টের থাকে; নইলে ক্ষতি। মহাকাব্য যদি অঙ্গহীন বা রূপহীন হয় তবে তা মহা অকাব্য। তখন তার কোনোখানে স্থান নেই। না দর্শন বিজ্ঞানের রাজ্যে। না আর্টের রাজ্যে। প্রথমে তাকে কাব্য হতে হবে, তারপরে সেমহান হতেও পারে না-হতেও পারে। কিন্তু মহান হতে গিয়ে কাব্য যদি না হয় তো মহত্ত্ব তাকে রক্ষা করবে না। কাব্যকে রক্ষা করে রস। মহান করে আলো। শিকড় আর পাতা এ দুয়ের মধ্যে শিকড়টাই আসল। কিন্তু পাতাটাও দামি। এ ভিন্ন আরও একটা জিনিস আছে, সেটা আকৃতি। তাইতেই চিনিয়ে দেয় যে এটা গাছ না আগাছা না পরগাছা না পানা। সেটা আগাগোড়া দরকারি।
রস যাকে বলা হচ্ছে সেও সত্য। আলো যাকে বলা হচ্ছে সেও। এক সত্য মনের গোচর। আরেক সত্য হৃদয়ের। উভয়ের মধ্যে বিরোধ বা বিচ্ছেদ নেই, কারণ হৃদয় যার আছে মনও আছে তার। একসঙ্গেই আছে। সত্য কথা বলতে কী, সত্য এক ও অবিভাজ্য। কিন্তু পূর্ণসত্য কেবলমাত্র মনের বা কেবলমাত্র হৃদয়ের ধারণাতীত। কিছু আমরা হৃদয় দিয়ে পাই, কিছু পাই মন দিয়ে। কিছু ইন্দ্রিয় দিয়ে, কিছু আত্মা দিয়ে। সমগ্রকে পাই সমগ্র সত্তা দিয়ে। আর্ট কিংবা বিজ্ঞান সমগ্রের বার্তা বহন করে না, করতে পারে না। তাদের কারও কাছে সমগ্র সত্য প্রত্যাশা করা যায় না। যার যত দূর দৌড় সেতত দূরের বার্তা বয়ে আনে, সেই পর্যন্ত তার স্বরাজ্য বা স্বধর্ম। তার ওপারে পররাজ্য বা পরধর্ম। হৃদয়গ্রাহ্য সত্য নিয়েই আর্টের দৌড়ঝাঁপ। মানসগ্রাহ্য সত্য নিয়ে দর্শন বিজ্ঞানের বিরোধের অবসর নেই। বিচ্ছেদেরও না। রস আর আলো পরস্পরবিরোধী বা পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। মানুষের হৃদয় ও মন তাদের একাধারে বিধৃত করতে যত্নবান। সেইজন্যে আর্টের রাজ্যে রস যদিও রাজা আলো তার মন্ত্রী। দর্শন বিজ্ঞানের রাজ্যে আলো যদিও রাজা রস একেবারে অজানা নয়। দার্শনিক বৈজ্ঞানিকদেরও হৃদয় আছে, অনুভূতি আছে। তাঁদের সত্যান্বেষণ যদি আনন্দরঞ্জিত বা বেদনালাঞ্ছিত হয় তাঁদের সিদ্ধান্ত বা আবিষ্কার কি তার প্রভাব এড়াতে পারে?
তা ছাড়া কল্পনা যাকে বলি সেরস ও আলো উভয়ের রাজ্যে আনাগোনা করে। কবিদের মতো বিজ্ঞানীরাও কল্পনাপ্রবণ। কল্পনার সাহায্য না নিলে বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিক বেশি দূর অগ্রসর হতে পারতেন কি না সন্দেহ। বড়ো বড়ো কবিদের আকাশচারী কল্পনা তাঁদের অনেক দূর অগ্রসর করে দেয়। এমনি করে আর্ট আর জ্ঞান-বিজ্ঞান উভয়েরই অগ্রগতি ঘটে। তারপর কল্পনার দ্বারা আর একটি কাজ হয়। আলো পরিণত হয় রসে। মানসগ্রাহ্য সত্য হৃদয়গ্রাহ্য সত্যে রূপান্তরিত হয়। আমি বিজ্ঞানী নই, তাই জোর করে বলতে পারছিনে, হয়তো রস পরিণত হয় আলোয়। হয়তো হৃদয়গ্রাহ্য সত্য মানসগ্রাহ্য সত্যে রূপান্তরিত হয়।
এটা সত্য, ওটা কল্পনা, প্রায়ই আমরা বলে থাকি। যেন সত্যের অভাবটাই কল্পনা। কিংবা কল্পনার অভাবটাই সত্য। কিন্তু কল্পনার পক্ষীরাজ না হলে সত্যের অন্বেষণ সুদূরপরাহত। তা সেহৃদয়ের সত্যই হোক আর মনের সত্যই হোক। রস আর আলো উভয়ের মাঝখানে যোজকের কাজ করে কল্পনা। শুধু যোজক নয়, যাদুকরও বটে। রূপান্তর ঘটায়। যেসব ব্যাপার নিতান্তই মানসিক বা মনস্তত্ত্বের এলাকাভুক্ত, নিপুণ সাহিত্যিকের হাতে কল্পনার ভোজবাজিতে সেসব ব্যাপার হৃদয়ের ভোজ্যরূপে পরিবেশিত হয়, অনুভূতির অধিকারে আসে। রসের প্রজা হয় আলো। তখন তাকে আলো বলে চেনা যায় না। সেও রস। সত্যকে আমরা অবিভাজ্য রূপে পাই, যদি কল্পনার আশ্রয় নিই। কল্পনা সত্যের অভাব নয়। সত্যের একত্ববিধায়ক।
তারপরে শিল্পী যখন রসকে রূপদান করে তখনও কল্পনার সহায়তা নিতে হয়। রস থেকে রূপে পৌঁছোতে হলে কল্পনাকে করতে হয় পথপ্রদর্শিকা তারা।