২
হতভম্ব মহারাজকে বিদায় দিয়া ব্যোমকেশ নিজেও বাহির হইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল, জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এত বেলায় তুমি আবার কোথায় চললে?’
সে বলিল, ‘বেরুতে হবে। জেলের কিছু পুরনো কাগজপত্র দেখা দরকার। তাছাড়া অন্য কাজও আছে। কখন ফিরব কিছু ঠিক নেই। যদি সময় পাই, হোটেলে খেয়ে নেব।’ বলিয়া ছাতা ও বর্ষাতি লইয়া বিরামহীন বৃষ্টির মধ্যে বাহির হইয়া পড়িল।
যখন ফিরিয়া আসিল, তখন বেলা তিনটা। জামা, জুতা খুলিতে খুলিতে বলিল, ‘বেজায় ক্ষিদে পেয়েছে, কিছু খাওয়া হয়নি। স্নান করে নিই। পুঁটিরাম, চট্ করে কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা কর।—আজ ম্যাটিনি—ঠিক চারটের সময় অভিনয় আরম্ভ হবে।’
বিস্মিতভাবে বলিলাম, ‘সে কি! কিসের অভিনয়?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ভয় নেই—এই ঘরেই অভিনয় হবে। অজিত, দর্শকের জন্যে আরও গোটাকয়েক চেয়ার এ ঘরে আনিয়া রাখ।’ বলিয়া স্নান-ঘরে ঢুকিয়া পড়িল।
স্নানান্তে আহার করিতে বসিলে বলিলাম, ‘সমস্ত দিন কি করলে বল।’
ব্যোমকেশ অনেকখানি অমলেট মুখে পুরিয়া দিয়া তৃপ্তির সহিত চিবাইতে চিবাইতে বলিল, ‘জেল ডিপার্টমেন্টের অফিসে আমার এক বন্ধু আছেন, প্রথমে তাঁর কাছে গেলুম। সেখানে পুরনো রেকর্ড বার করে দেখা গেল যে, আমার অনুমান ভুল হয়নি।’
‘তোমার অনুমানটা কি?’
প্রশ্নে কর্ণপাত না করিয়া ব্যোমকেশ বলিতে লাগিল, ‘সেখানকার কাজ শেষ করে বুদ্ধুবাবু—থুড়ি—বিধুবাবুর কাছে গেলুম। হরিপদর খুনটা তাঁরই এলাকায় পড়ে। কেসের ইনচার্জ হচ্ছেন ইন্সপেক্টর পূর্ণবাবু। পূর্ণবাবুকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে এবং বিধুবাবুর পদদ্বয়ে যথোচিত তৈল প্রয়োগ করে শেষ পর্যন্ত কার্যোদ্ধার হল।’
‘কিন্তু কার্যটা কি তাই যে আমি এখনও জানি না।’
‘কার্যটা হচ্ছে প্রথমত রমানাথ নিয়োগীর ঠিকানা বার করা এবং দ্বিতীয়ত তাকে গ্রেপ্তার করে তার বাসা খানাতল্লাস করা। ঠিকানা সহজেই বেরুল, কিন্তু খানাতল্লাসে বিশেষ ফল হল না। অবশ্য রমানাথের ঘর থেকে একটা ভীষণাকৃতি ছোরা বেরিয়েছে; তাতে মানুষের রক্ত পাওয়া যায় কি না পরীক্ষার জন্যে পাঠান হয়েছে। কিন্তু যে জিনিস পাব আশা করেছিলুম তা পেলুম না। লোকটার লুকিয়ে রাখবার ক্ষমতা অসামান্য।’
‘কি জিনিস?’
‘মহারাজের নীলাটা!’
‘তারপর? এখন কি করবে?’
‘এখন অভিনয় করব। রমানাথের কুসংস্কারে ঘা দিয়ে দেখব যদি কিছু ফল পাই—ঐ বোধ হয় মহারাজ এলেন। বাকি অভিনেতারাও এসে পড়ল বলে।’ বলিয়া ঘড়ির দিকে তাকাইল।
‘আর কারা আসবে?’
‘রমানাথ এবং তার রক্ষীরা।’
‘তারা এখানে আসবে?’
‘হ্যাঁ, বিধুবাবুর সঙ্গে সেই রকম ব্যবস্থাই হয়েছে।—পুঁটিরাম, খাবারের বাসনগুলো সরিয়ে নিয়ে যাও।’
আর কিছু জিজ্ঞাসা করিবার অবসর পাইলাম না, মহারাজ আসিয়া প্রবেশ করিলেন। ঘড়িতে ঠং ঠং করিয়া চারিটা বাজিল। দেখিলাম, মহারাজ রাজোচিত শিষ্টতা রক্ষা করিয়াছেন।
মহারাজকে সমাদর করিয়া বসাইতে না বসাইতে আরও কয়েকজনের পদশব্দ শুনা গেল। পরক্ষণেই বিধুবাবু, পূর্ণবাবু ও আরও দুইজন সাব-ইন্সপেক্টরের সঙ্গে রমানাথ প্রবেশ করিল।
রমানাথের চেহারায় এমন কোন বিশেষত্ব নাই যাহা দৃষ্টি আকর্ষণ করে; চুরি বিদ্যায় পারদর্শী হইতে হইলে বোধহয় চেহারাটি নিতান্ত চলনসই হওয়া দরকার। রমানাথের মাথায় ছোট করিয়া চুল ছাঁটা, কপাল অপরিসর, চিবুক ছুঁচালো—চোখে সতর্ক চঞ্চলতা। তাহার গায়ে বহু বৎসরের পুরাতন (সম্ভবত জেলে যাইবার আগেকার) চামড়ার বোতাম আঁটা পাঁচ মিশালি রঙের স্পোর্টিং কোট ও পায়ে অপ্রত্যাশিত একজোড়া রবারের বুট জুতা দেখিয়া সহসা হাস্যরসের উদ্রেক হয়। ইনি যে একজন সাংঘাতিক ব্যক্তি সে সন্দেহ কাহারও মনে উদয় হয় না।
ব্যোমকেশ অঙ্গুলি নির্দেশে তাহাকে দেখাইয়া বলিল, ‘মহারাজ, লোকটিকে চিনতে পারেন কি?’
মহারাজ বলিলেন, ‘হ্যাঁ, এখন চিনতে পারছি। এই লোকটাই সেদিন ভিক্ষে চাইতে গিয়েছিল।’
‘বেশ। এখন তাহলে আপনারা সকলে আসন গ্রহণ করুন। বিধুবাবু, মহারাজের সঙ্গে নিশ্চয় পরিচয় আছে। আসুন, আপনি মহারাজের পাশে বসুন। রমানাথ, তুমি এইখানে বস।’ বলিয়া ব্যোমকেশ রমানাথকে টেবিলের ধারে একটা চেয়ার নির্দেশ করিয়া দিল।
রমানাথ বাঙ্নিষ্পত্তি না করিয়া উপবেশন করিল। দুই জন সাব-ইন্সপেক্টর তাহার দুই পাশে বসিলেন। বিধুবাবু অভ্রভেদী গাম্ভীর্য অবলম্বন করিয়া কট্মট্ করিয়া চারিদিকে তাকাইতে লাগিলেন। এই সম্পূর্ণ আইন-বিগর্হিত ব্যাপার ঘটিতে দিয়া তিনি যে ভিতরে ভিতরে অতিশয় অস্বস্তি বোধ করিতেছেন তাহা তাঁহার ভাবভঙ্গীতে প্রকাশ পাইতে লাগিল।
সকলে উপবিষ্ট হইলে ব্যোমকেশ টেবিলের সম্মুখে বসিল। বলিল, ‘আজ আমি আপনাদের একটা গল্প বলব। অজিতের গল্পের মত কাল্পনিক গল্প নয়—সত্য ঘটনা। যতদূর সম্ভব নির্ভুল ভাবেই বলবার চেষ্টা করব; যদি কোথাও ভুল হয়, রমানাথ সংশোধন করে দিতে পারবে। রমানাথ ছাড়া আর একজন এ কাহিনী জানত, কিন্তু আজ সে বেঁচে নেই।’
এইটুকু ভূমিকা করিয়া ব্যেমকেশ তাহার গল্প আরম্ভ করিল। রমানাথের মুখ কিন্তু নির্বিকার হইয়া রহিল। সে মুখ তুলিল না, একটা কথা বলিল না, নির্লিপ্তভাবে আঙ্গুল দিয়া টেবিলের উপর দাগ কাটিতে লাগিল।
‘রমানাথ জেলে যাবার পর থেকেই গল্প আরম্ভ করছি। রমানাথ জেলে গেল, কিন্তু মহারাজের নীলাটা সে কাছছাড়া করলে না, সঙ্গে করে নিয়ে গেল। কি কৌশলে সকলের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে নিয়ে গেল—তা আমি জানি না, জানবার চেষ্টাও করিনি। রমানাথ ইচ্ছে করলে বলতে পারে।’
পলকের জন্য রমানাথ ব্যোমকেশের মুখের দিকে চোখ তুলিয়াই আবার নিবিষ্ট মনে টেবিলে দাগ কাটিতে লাগল।
ব্যোমকেশ বলিতে লাগিল, ‘রামানাথ অনেক ভাল ভাল দামী জহরত চুরি করেছিল। কিন্তু তার মধ্যে থেকে কেবল মহারাজের রক্তমুখী নীলাটাই যে কেন সঙ্গে রেখেছিল তা অনুমান করাই দুষ্কর। সম্ভবত পাথরটার একটা সম্মোহন শক্তি ছিল; জিনিসটা দেখতেও চমৎকার—গাঢ় নীল রঙের একটা হীরা, তার ভেতর থেকে রক্তের মত লাল রঙ ফুটে বেরুচ্ছে। রমানাথ সেটাকে সঙ্গে নেবার লোভ সামলাতে পারেনি। পাথরটা খুব পয়মন্ত একথাও সম্ভবত রমানাথ শুনেছিল। দুর্নিয়তি যখন মানুষের সঙ্গ নেয়, তখন মানুষ তাকে বন্ধু বলেই ভুল করে।
‘যা হোক, রমানাথ আলিপুর জেলে রইল। কিছুদিন পরে পুলিস জানতে পারল যে, নীলাটা তার কাছেই আছে। যথাসময়ে রমানাথের ‘সেল’ খানাতল্লাস হল। রমানাথের সেলে আর একজন কয়েদী ছিল, তাকেও সার্চ করা হল। কিন্তু নীলা পাওয়া গেল না। কোথায় গেল নীলাটা?’
‘রমানাথের সেলে যে দ্বিতীয় কয়েদী ছিল তার নাম হরিপদ রক্ষিত। হরিপদ পুরনো ঘাগী আসামী, ছেলেবেলা থেকে জেল খেটেছে—তার অনেক গুণ ছিল। যাঁরা জেলের কয়েদী নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন তাঁরাই জানেন, এক জাতীয় কয়েদী আছে যারা নিজেদের গলার মধ্যে পকেট তৈরি করে। ব্যাপারটা শুনতে খুবই আশ্চর্য কিন্তু মিথ্যে নয়। কয়েদীরা টাকাকড়ি জেলে নিয়ে যেতে পারে না; অথচ তাদের মধ্যে বেশির ভাগই নেশাখোর। তাই, ওয়ার্ডারদের ঘুষ দিয়ে বাইরে থেকে মাদকদ্রব্য আনাবার জন্যে টাকার দরকার হয়। গলায় পকেট তৈরি করবার ফন্দি এই প্রয়োজন থেকেই উৎপন্ন হয়েছে; যারা কাঁচা বয়স থেকে জেলে আছে তাদের মধ্যেই এ জিনিসটা বেশি দেখা যায়। প্রবীণ পুলিস কর্মচারী মাত্রই এসব কথা জানেন।
‘হরিপদ ছেলেবেলা থেকে জেল খাটছে, সে নিজের গলায় পকেট তৈরি করেছিল। রমানাথ যখন তার সেলে গিয়ে রইল তখন দু’জনের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেল। ক্রমে হরিপদর পকেটের কথা রমানাথ জানতে পারল।
‘তারপর একদিন হঠাৎ পুলিস জেলে হানা দিল। সেলের মধ্যে নীলা লুকোবার জায়গা নেই; রমানাথ নীলাটা হরিপদকে দিয়ে বললে, তুমি এখন গলার মধ্যে লুকিয়ে রাখ। হরিপদকে সে নীলাটা আগেই দেখিয়েছিল এবং হরিপদরও সেটার উপর দারুণ লোভ জন্মেছিল। সে নীলাটা নিয়েই টপ্ করে গিলে ফেলল; তার কণ্ঠনালীর মধ্যে নীলাটা গিয়ে রইল। বলা বাহুল্য, পুলিস এসে যখন তল্লাস করল তখন কিছুই পেল না।
‘এই ঘটনার পরদিনই হরিপদ হঠাৎ অন্য জেলে চালান হয়ে গেল, জেলের রেকর্ডে তার উল্লেখ আছে। হরিপদর ভারি সুবিধা হল। সে বিশ্বাসঘাতকতা করল—যাবার আগে নীলাটা রমানাথকে ফিরিয়ে দিয়ে গেল না। রমানাথ কিছু বলতে পারল না—চোরের মা’র কান্না কেউ শুনতে পায় না—সে মন গুমরে রয়ে গেল। মনে মনে তখন থেকেই বোধ করি ভীষণ প্রতিহিংসার সঙ্কল্প আঁটতে লাগল।’
এই সময় লক্ষ্য করিলাম, রমানাথের মুখের কোন বিকার ঘটে নাই বটে, কিন্তু রগ ও গলার শিরা দপ্দপ্ করিতেছে, দুই চক্ষু রক্তাভ হইয়া উঠিয়াছে।
ব্যোমকেশ বলিয়া চলিল, ‘তারপর একে একে দশটি বছর কেটে গেছে। ছ’মাস আগে হরিপদ জেল থেকে মুক্তি পেল। মুক্তি পেয়েই সে মহারাজের কাছে এল। তার ইচ্ছে ছিল মহারাজের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ক্রমে নীলাটা তাঁকে ফেরত দেবে। বিনামূল্যে নয়—দু’হাজার টাকা পুরস্কারের কথা সে জানত। ও নীলা অন্যত্র বিক্রি করতে গেলেই ধরা পড়ে যেতে হবে, তাই সে-চেষ্টাও সে করল না।
‘কিন্তু প্রথম থেকেই মহারাজ তার প্রতি এমন সদয় ব্যবহার করলেন যে, সে ভারি লজ্জায় পড়ে গেল। তবু সে একবার নীলার কথা মহারাজের কাছে তুলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নীলার বদলে মহারাজের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে তার বিবেকে বেধে গেল। মহারাজের দয়ার গুণে হরিপদর মত লোকের মনেও যে কৃতজ্ঞতার সঞ্চার হয়েছিল, এটা বড় কম কথা নয়।
‘ক্রমে হরিপদর দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল। দশদিন আগে রমানাথ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বেরুল। হরিপদ কোথায় তা সে জানত না, কিন্তু এমনি দৈবের খেলা যে, চারদিন যেতে না যেতেই মহারাজের বাড়িতে রমানাথ তার দেখা পেয়ে গেল। রমানাথকে দেখার ফলেই হরিপদ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়বার তার আর কোনও কারণ ছিল না।
‘যে প্রতিহিংসার আগুন দশ বছর ধরে রমানাথের বুকে ধিকি ধিকি জ্বলছিল, তা একেবারে দুর্বার হয়ে উঠল। হরিপদর বাড়ির সন্ধান সে সহজেই বার করল। তারপর সেদিন রাত্রে গিয়ে—’
এ পর্যন্ত ব্যোমকেশ সকলের দিকে ফিরিয়া গল্প বলিতেছিল, এখন বিদ্যুতের মত রমানাথের দিকে ফিরিল। রমানাথও মন্ত্রমুগ্ধ সর্পের মত নিষ্পলক চক্ষে ব্যোমকেশের পানে তাকাইয়া ছিল; ব্যোমকেশ তাহার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া চাপা তীব্র স্বরে বলিল, ‘রমানাথ, সে-রাত্রে হরিপদর গলা ছিঁড়ে তার কণ্ঠনালীর ভেতর থেকে তুমি নীলা বার করে নিয়েছিলে। সে নীলা কোথায়?’
রমানাথ ব্যোমকেশের চক্ষু হইতে চক্ষু সরাইতে পারিল না। সে একবার জিহ্বা দ্বারা অধর লেহন করিল, একবার চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিল, তারপর যেন অসীম বলে নিজেকে ব্যোমকেশের সম্মোহন দৃষ্টির নাগপাশ হইতে মুক্ত করিয়া লইয়া বিকৃত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘আমি, আমি জানি না—হরিপদকে আমি খুন করিনি—হরিপদ কার নাম জানি না। নীলা আমার কাছে নেই—’ বলিয়া আরক্ত বিদ্রোহী চক্ষে চাহিয়া সে দুই হাত বুকের উপর চাপিয়া ধরিল।
ব্যোমকেশের অঙ্গুলি তখনও তাহার দিকে নির্দেশ করিয়া ছিল। আমাদের মনে হইতে লাগিল যেন একটা মর্মগ্রাসী নাটকের অভিনয় দেখিতেছি, দুইটা প্রবল ইচ্ছাশক্তি পরস্পরের সহিত মরণান্তক যুদ্ধ করিতেছে; শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হইবে তাহা দেখিবার একাগ্র আগ্রহে আমরা চিত্রার্পিতের মত বসিয়া রহিলাম।
ব্যোমকেশের কণ্ঠস্বরে একটা ভয়ঙ্কর দৈববাণীর সুর ঘনাইয়া আসিল; সে রমানাথের দিকে ঈষৎ ঝুঁকিয়া পূর্ববৎ তীব্র অনুচ্চ স্বরে বলিল, ‘রমানাথ, তুমি জানো না কী ভয়ানক অভিশপ্ত ওই রক্তমুখী নীলা। তাই ওর মোহ কাটাতে পারছ না। ভেবে দ্যাখ, যতদিন তুমি ঐ নীলা চুরি না করেছিলে, ততদিন তোমাকে কেউ ধরতে পারেনি—নীলা চুরি করেই তুমি জেলে গেলে। তারপর হরিপদর পরিণামটাও একবার ভেবে দ্যাখ। সে গলার মধ্যে নীলা লুকিয়ে রেখেছিল, তার গলার কী অবস্থা হয়েছিল তা তোমার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। এখনও যদি নিজের ইষ্ট চাও, ঐ সর্বনাশা নীলা ফেরত দাও। নীলা নয়—ও কেউটে সাপের বিষ। যদি হাতে সে নীলা পর, তোমার হাতে হাতকড়া পড়বে; যদি গলায় পর, ঐ নীলা ফাঁসির দড়ি হয়ে তোমার গলা চেপে ধরবে।’
অব্যক্ত একটা শব্দ করিয়া রমানাথ উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মনের ভিতর কিরূপ প্রবল আবেগের সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহা আমরাও সম্যক বুঝিতে পারি নাই। পাগলের মত সে একবার চারিদিকে তাকাইল, তারপর নিজের কোটের চামড়ার বোতামটা সজোরে ছিঁড়িয়া দূরে ফেলিয়া দিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘চাই না—চাই না! এই নাও নীলা, আমাকে বাঁচাও!’ বলিয়া একটা দীর্ঘ শিহরিত নিশ্বাস ফেলিয়া অজ্ঞান হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।
ব্যোমকেশ কপাল হইতে ঘাম মুছিল। দেখিলাম তাহার হাত কাঁপিতেছে—ইচ্ছাশক্তির যুদ্ধে সে জয়ী হইয়াছে বটে, কিন্তু অবলীলাক্রমে নয়।
রমানাথের নিক্ষিপ্ত বোতামটা ঘরের কোণে গিয়া পড়িয়াছিল, সেটা তুলিয়া লইয়া তাহার খোলস ছাড়াইতে ছাড়াইতে ব্যোমকেশ স্খলিত-স্বরে বলিল, ‘মহারাজ, এই নিন আপনার রক্তমুখী নীলা।’