যেমনটি-তেমনটি
ছেলেবেলায় যিনি আমাদের অঙ্ক শেখাতেন তিনিই শেখাতেন অঙ্কন। একবার তিনি আমাকে একটা অশ্বত্থের পাতা দিয়ে বলেন, যেমনটি দেখছ তেমনটি এঁকে নিয়ে এসো। আমি সেই পাতাটাকে পাতলা কাগজ দিয়ে অবিকল ট্রেস করি। মাস্টারমশাই তো মহাখুশি। যেমনটি দেখতে তেমনটি দেখিয়েছি। আর কী চাই? অঙ্কনের জন্যে সে-বার আমি পুরো মার্ক পাই। আমিও মহাখুশি।
বড়ো হয়ে বুঝতে পারলুম যে অঙ্কের বেলা যেটা খাটে অঙ্কনের বেলা সেটা খাটে না। মাস্টারমশাই আসলে অঙ্কের লোক। অঙ্কনের ভার তাঁর উপর দেওয়া হয়েছিল অধিকন্তু। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে দুই আর দুই মিলে যেমন চার হয় তেমনি গাছের পাতা আর খাতার পাতা মিলে এক হয়। বড়ো হয়ে জ্ঞান হল যে প্রকৃতির অনুকৃতির নাম আর্ট নয়। অশ্বত্থের পাতার হুবহু নকল যারা করে তারা শিল্পী নয়। আমি যে পুরো মার্ক পেয়েছিলুম সেটা আমার পাওনা নয়। তখন আমি মহা দুঃখিত হই।
অনেকের স্মরণশক্তি এত প্রখর যে তাঁরা অশ্বত্থের পাতা সামনে না রেখেও বিলকুল তেমনিটি আঁকতে পারেন। সেটাও অনুকৃতি। এক্ষেত্রে সামনে রাখা না রাখাটা পয়েন্ট নয়। পয়েন্ট হচ্ছে যেমনটি-তেমনটি। সেটা হয়তো আমার খাতার অশ্বত্থ পাতার মতো জালিয়াতি নয়। কিন্তু সেটাও একপ্রকার কেরামতি, যার জন্যে স্মরণশক্তি থাকলেই যথেষ্ট।
ধরো একজনের স্মরণশক্তি নেই। তা বলে কি সেশিল্পকর্ম করবে না? শিল্পী হবে না? নিশ্চয়ই হবে। যাঁরা প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চান তাঁরা নিরাশ হয়ে বলবেন, অশ্বত্থ পাতা এরকম তো হয় না। অতএব ফেল। যাঁরা মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন মনে করেন না তাঁরা বলবেন, গাছের পাতা গাছেই সুন্দর। ছবিতে তাকে না এনে তার ভিতরের সুষমাটুকু ফোটাও। তা হলেই পাস।
এ জগৎ যেমনটি তাকে তেমনিটি দেখতে হবে, একথা ঠিক। কিন্তু একে তেমনিটি দেখতে হবে, একথা ঠিক নয়। যদি বলি তেমনিটি দেখাতে হবে তবে কথাটার একটা বিশেষ অর্থ আছে যে-অর্থে সেটা ঠিক। সেই বিশেষ অর্থটা যাঁরা বোঝেন তাঁরাই শিল্পী, বাদবাকি ফোটোগ্রাফার।
ডাক্তারদের মতো শিল্পীরাও অ্যানাটমি ফিজিয়োলজি শিখতে পারেন, কিন্তু আঁকবার সময় সে-বিদ্যা ভুলে যেতে হবে। অঙ্কনের কাজ প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া নয়, তার রহস্য ভেদ করা। রিয়্যালিটি তার আড়ালে রয়েছে। তাকে ছাড়িয়ে রয়েছে। তাকে ধরতে পারাটাই আসল। সহজে কি সেধরা দেয়? দিব্যদৃষ্টির শরণ নিতে হয়। তখন যা ফোটে তা সাধারণ অর্থে যেমনটি-তেমনটি নয়, বিশেষ অর্থে যেমনটি-তেমনটি।
সাধারণের চেনা জগতের সঙ্গে শিল্পীর আঁকা জগতের ষোলো আনা মিল আশা করাই অন্যায়। আশা যাঁরা করেন তাঁরা ধরে নেন যে আর্ট মানে মিল রাখা বা মিল দেওয়া। যে যত মেলাতে পারবে তারই তত বাহাদুরি। এই যে বদ্ধমূল সংস্কার এটাকে ভেঙে দিতে গিয়ে একালের শিল্পীরা অনেক সময় ইচ্ছে করেই অমিল উদ্ভাবন করছেন। যে যত না মেলাতে পারবে সেতত বাহাদুর। আদৌ যদি না মেলে তো পুরো মার্ক পাওনা।
এইসব বিদ্রোহীরা বিপরীত দিকে দৌড়োতে দৌড়োতে ইতিমধ্যে এতদূর চলে গেছেন যে প্রকৃতির দিকে ফিরেও তাকান না। কিংবা অনুকৃতির অপবাদ খন্ডনের জন্যে সংকেতের বা ফ্যানটাসির আশ্রয় নেন। এদের দিব্যদৃষ্টি যে বস্তুর অন্তর্ভেদী তাও নয়। এঁরা বরং বস্তুকে ব্যবচ্ছেদ করেন ও টুকরোগুলিকে নতুন করে সাজান।
যেমনটি দেখব তেমনিটি দেখাব এ তত্ত্বে এঁদের বিশ্বাস নেই। সাধারণ অর্থে তো নয়ই, বিশেষ অর্থেও না। রিয়্যালিটির সঙ্গে ষোলো আনা অমিল না থাকলে আর্ট হয় না, এটাই মনে হয় এঁদের পালটা তত্ত্ব। সাদৃশ্যের রেশটুকুও থাকবে না তবেই সেটা হবে আর্ট, নইলে হবে না; এটাই বোধ হয় এদের পালটা দাবি।
প্রকৃতির জগৎ ও আর্টের জগৎ যে এক নয় তা মানতেই হবে। কিন্তু এক নয় বলে কি তাদের ষোলো আনা বিসদৃশ হওয়া চাই? আর্টের কি তবে প্রকৃতির কাছে পাঠ নেবার দায় নেই? চোখ মেললেই প্রকৃতিকে দেখতে পাই, প্রকৃতির প্রতিবিম্ব মনের মুকুরে পড়বেই। তাকে কি আমি সচেতনভাবে বহিষ্কার করব? অতখানি আত্মসচেতন হলে কি আমি রূপধ্যান করতে পারব? রূপসৃষ্টি করতে পারব?
আর্ট হবে প্রকৃতিছুট এমন কোনো তত্ত্ব, যদি কেউ প্রচার করেন তবে সেটা হবে একপ্রকার ডগমা। চোখ বুজে সেটা মেনে নিলে আর চোখ খোলা রাখতে পারব না। অথচ শিল্পীকে সর্বক্ষণ চোখ খোলা রাখতে হয়। তা না করে যদি কেউ সর্বক্ষণ চোখ বন্ধ রাখেন তবে হয় তিনি একজন ধ্যানী, যাঁর ধ্যানদৃষ্টি সক্রিয়, আর নয়তো তিনি একজন পাতালচারী, যাঁর বিহার অচেতন বা অবচেতন রাজ্যে।
বলা বাহুল্য রিয়্যালিটির অন্বেষণ কতক শিল্পীকে পাতালে নিয়ে গেলেও সেটা বৃহত্তর অন্বেষণের শামিল। পাতালও রিয়্যালিটির এলাকার বাইরে নয়। সেক্ষেত্রে ষোলো আনা অমিল অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু সেটা যেন আত্মসচেতনভাবে জাহির করা না হয়। আপনা হতে যতটা অমিল আসে তাকে আসতে দাও। জোর করে টেনে না আনলেই হল। রিয়্যালিটিকে ধরতে ছুঁতে না পারলে শুধুমাত্র আকার অবয়ব শুদ্ধভাবে আঁকাই কি আর্ট? রূপ কি কেবল যেমনটি দেখতে?
পাশ্চাত্য ভূখন্ডে রেনেসাঁসের পর যুক্তির যুগ এসে এমন এক গাণিতিক বিশ্বের রূপ বর্ণনা করে যে, আর্টও বেশিদিন পিছিয়ে থাকতে পারে না। আর্টকেও নতুন রিয়্যালিটির সঙ্গে পা মিলিয়ে নিতে হয়। অঙ্কের নিয়ম অঙ্কনেও প্রভাব বিস্তার করে। এখন গাণিতিক বিশ্বের উপর নির্ভরতা টলেছে। প্রকৃত বিশ্ব যে একান্ত গাণিতিক নয় এ সংশয় জেগেছে। মধ্যযুগের শাস্ত্রীয় বিশ্ব যেমন একদিন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের আলোয় অবাস্তব ঠেকেছিল, আধুনিক যুগের গাণিতিক বিশ্বও তেমনি গভীরতর অনুসন্ধানের আলোয় নিরবচ্ছিন্ন নিয়মশৃঙ্খলাবদ্ধ ও কার্যকারণ শাসিত বলে প্রতিভাত হচ্ছে না।
আমরা আবার এক যুগসন্ধিতে পৌঁছেছি। রিয়্যালিটির স্বরূপ সম্বন্ধে সংশয়মোচন না হলে সে-সংশয়ের ছায়া আর্টের উপরেও পড়বে। সংশয়ই এ যুগের বাদী সুর। বৈজ্ঞানিক বা অর্থনৈতিক বা বৈপ্লবিক সাফল্য এর কন্ঠরোধ করতে পারছে না।
বিজ্ঞান তথা বিপ্লবী মতবাদ মিলে খোদার উপর খোদকারি করতে পারে, মহাশূন্য অভিযান ও গ্রহগ্রহান্তর জয় করতে পারে। আত্মকলহে নির্বাণলাভ না করলে মানবজাতি আক্ষরিক অর্থে অপার্থিভ হতে পারে। এমনি কতরকম মধুর স্বপ্ন আমাদের জীবনে। কিন্তু রিয়্যালিটির স্বরূপ সম্বন্ধে নতুন করে যে সংশয় জন্মেছে তার কন্ঠস্বর দিন দিন জোরালো হয়ে উঠছে। যুক্তির যুগ ধীরে ধীরে নিযুক্তির যুগে পরিণত হচ্ছে। এর লক্ষণ চারদিকে।
বাইরে যদি নিযুক্তির রাজত্ব হয় তবে আর্টের ঘরে তার পদসঞ্চার অপরিহার্য। আর্টের ঘর তো সংসারের বাইরে নয়। আর্ট বড়োজোর স্বাতন্ত্র্য দাবি করতে পারে, কিন্তু বিচ্ছিন্নতা দাবি করতে পারে না। তার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হাওয়া তার দেহের বাইরের সঙ্গে, তার এলাকার বাইরের সঙ্গে ওতপ্রোত।
নির্যুক্তির যুগে বাস করলে আর্টের ভিতরেও তার অনুপ্রবেশ মেনে নিতে হয়। কিন্তু ছেলেবেলায় অশ্বত্থ পাতার গায়ে দাগা বুলিয়ে আমি যে ভুল করেছিলুম সেই ভুলই আবার করা হবে যদি নির্যুক্তির জগতের গায়ে আর্টের দাগা বুলোতে যাই। প্রকৃতির অনুকৃতি যদি ভ্রম হয় তবে নির্যুক্তির অনুকৃতিও ভ্রম। যেমনটি দেখেছি তেমনিটি দেখাব বলতে কি এই বোঝায় যে দুনিয়াটা একটা পাগলাগারদ বা মানসিক হাসপাতাল? না, এক্ষেত্রেও সেই বিশেষ অর্থে বুঝতে হবে। সাধারণ অর্থে যেমনিটি-তেমনিটি মানে নির্যুক্তির অবিকল অনুকৃতি। আর বিশেষ অর্থে যেমনটি-তেমনটি মানে নির্যুক্তির আড়ালে যে উচ্চতর সত্য আছে তার সঙ্গে সত্যরক্ষা। আর্টে যে জিনিস কোনোমতেই নকলনবিশি হতে পারে না।
দুনিয়াতে যদি নিয়ম বলে কিছু না থাকে, সমস্তটাই হয় অনিয়ম, তা হলেও আর্ট তার নিজের নিয়ম মেনে চলবে, নিয়মভ্রষ্ট হবে না। আর্টের শাসন গতকাল যেমন কঠোর ছিল আজও তেমনি কঠোর, আগামীকালও তেমনি কঠোর হবে। বাইরে নির্যুক্তির যুগ এসেছে বলে ও প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনগুলোর সম্বন্ধে সংশয় দেখা দিয়েছে বলে আর্ট তার আপনার নিয়মনিষ্ঠতা বিসর্জন দেবে না। আর্ট এক জায়গায় স্থির থাকবে। সেটা তার ঘরের শাসন।
এর মানে অবশ্য এমন নয় যে আর্টের নিয়মাবলি বদলায় না। নিশ্চয় বদলায়, বার বার বদলায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেনিয়মশৃঙ্খলার দ্বারা শাসিত। নিয়মশৃঙ্খলা এক্ষেত্রে আর্টের স্বকীয়। পরকীয় নিয়মশৃঙ্খলার বেলা সেসত্যাগ্রহী।
এমন যে আর্ট সেনিযুক্তির যুগেও স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবে না, যেমন যুক্তির যুগেও স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়নি। অঙ্কনের বেলা যেমন অঙ্কের নিয়ম খাটেনি তেমনি খাটবে না অগাণিতিক নিয়ম। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চোখে জগতের চেহারা যেমনই হোক-না কেন আর্ট হুবহু তেমনিটি ফুটবে না। তবে তার যেটা স্পিরিট সেটা ফুটতে পারে।
প্রধানত অনুভূতি ও কল্পনা নিয়েই আর্টের আপনার সংসার। যুক্তি কিংবা নিযুক্তি কোনোটাই সেখানে মুখ্য নয়। যুক্তি ও জীবনকে গন্ডিবদ্ধ করতে পারে, সেইজন্যে তার মুক্তির জন্যে নির্যুক্তিকে স্বাগত জানাতে পারে। আবার নির্যুক্তি যে মুক্তি দেয় সে-মুক্তিও জীবনকে পাগলাগারদে কোণঠাসা করতে পারে। তার বাইরে পা দিলেই সেগাড়িচাপা পড়তে পারে।
যাতে সবচেয়ে কম সংকোচন ও সবচেয়ে বেশি প্রসারণ সেইরূপ জীবনই আর্টের কাম্য। জীবন যদি মোটের উপর সংকোচনশীল হয়ে ওঠে আর্ট ত্রাহি ত্রাহি করবে। আর যদি মোটের ওপর প্রসারণশীল থাকে তবে সেই আওতায় আর্ট তার আপনার বিকাশে মন দেবে। বিকাশের পক্ষে প্রসারণশীলতাই শ্রেয়।
তা বলে শিল্পীর উপরে জীবনকে প্রসারণশীল করার ভার অর্পণ করা হয়নি। আর্ট যদিও জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে, জীবনের গতিনির্দেশ করতে পারে, তবু সে-কাজ সচেতনভাবে করতে যাওয়াও একপ্রকার উদ্দেশ্যসাধন। সেউদ্দেশ্য আর্টের ঘরোয়া উদ্দেশ্য নয়। রিয়্যালিটিকে জানতে চাও, বুঝতে চাও, ধরতে চাও, ছুঁতে চাও—বেশ। কিন্তু তাকে নিজের হাতে বানাতে যেয়ো না। অন্তত সচেতনভাবে নয়। তা করতে গেলে এতদূরে সরে যাবে যে অনায়াসে স্বক্ষেত্রে ফিরে আসতে পারবে না। স্বক্ষেত্র ত্যাগ স্বধর্ম ত্যাগের মতোই ভয়াবহ।
আধুনিক মানুষ রিয়্যালিটিকে বানিয়ে নেবার স্পর্ধা রাখে। তা বলে শিল্পী যেন স্বস্থানচ্যুত না হয়। স্বস্থানে পা ঠিক রেখে টাল সামলে সুস্থির হয়ে তার পরে অন্য কথা।