যুদ্ধের আয়োজন

যুদ্ধের আয়োজন

কতক্ষণ পরে তার জ্ঞান ফিরে এল মানিক তা জানে না, কিন্তু চোখ মেলে দেখলে সুন্দরবাবু ও অমলবাবু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে তার দেহের দুই পাশে বসে আছেন এবং হাতি সিং বসে আছে তার মাথাটা নিজের কোলের উপরে টেনে নিয়ে৷

প্রথমটা কিছুই মনে পড়ল না৷ কিন্তু সে উঠে বসবার চেষ্টা করতেই অমলবাবু বলে উঠলেন, ‘না, না, আপনি আরও খানিকক্ষণ শুয়ে থাকুন!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, বিপদে পড়লুম আমরা, লড়াই করলুম আমরা, শত্রুদের তাড়ালুম আমরা৷ কিন্তু তুমি খামোকা অজ্ঞান হয়ে গেলে কেন বাপু?’

তখন মানিকের সব স্মরণ হল এবং তার কন্ঠদেশ যে বেদনায় টনটন করছে এটাও অনুভব করতে পারলে৷ সে বললে, ‘সুন্দরবাবু, পিছন থেকে হঠাৎ আক্রমণ করে কে আমার গলা টিপে ধরেছিল! আপনারা কি এখানে এসে কারুকে দেখতে পাননি?’

-‘হুম, তুমি বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল৷ স্বপ্ন দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে৷ এখানে এসে আমরা একটা টিকটিকির ল্যাজ পর্যন্ত দেখতে পাইনি৷ পেয়েছি কি অমলবাবু?’

-‘না৷’

মানিক বললে, ‘আমার গলায় ভয়ানক ব্যথা! সুন্দরবাবু, এটাও কি স্বপ্নদেখার ফল?’

-‘কই দেখি! তাই তো হে মানিক, তোমার গলার ওপরে যে অনেকগুলি আঙুলের লাল লাল দাগ রয়েছে! কে তোমার গলা টিপে ধরেছিল? কেন ধরেছিল? সে বেটা গেল কোথায়?’

অমলবাবু বললেন, ‘ব্যাপার তো কিছুই বুঝতে পারছি না! তোমাকে আক্রমণ করারও মানে হয় না, আমাদেরও আক্রমণ করার মানে হয় না৷’

-‘আপনাদের কে আক্রমণ করেছিল?’

-‘অনেকগুলো লোক৷ আক্রমণ করেছিল বললে ঠিক হয় না, কারণ তারা আমাদের কাছে আসেনি৷ তুমি তো এগিয়ে এলে, আমি সুন্দরবাবু সঙ্গে কথা কইতে কইতে আসছিলুম! হঠাৎ দূরে বনের ভিতর থেকে চার-পাঁচ জন লোক বেরিয়ে আমাদের দিকে ছুটে আসতে লাগল৷ আমরা বন্দুক ছুড়তেই তারা আবার অদৃশ্য হল! মিনিট খানেক পরে পথের আর একদিকে আবার চার-পাঁচ জন লোকের আবির্ভাব, আবার আমাদের বন্দুক ছোড়া-আবার তাদেরও অন্তর্ধান!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমার মনে হল, তারা আমাদের আক্রমণ করতে চায় না, কেবল আমাদের ভয় দেখাতে চায়!’

মানিক ধড়মড়িয়ে উঠে বসে তাড়াতাড়ি জামার বোতাম খুলে ভিতর দিকে হাত চালিয়ে দিয়ে কী যেন অনুভব করলে, তারপর আশ্বস্ত ভাবে বললে, ‘নাঃ, ঠিক আছে!’

সুন্দরবাবু বিস্মিত কন্ঠে শুধোলেন, ‘কী ঠিক আছে, মানিক?’

‘সেই চাবিটা৷ আমার জামার ভিতর দিককার পকেটে সেই চাবিটা রেখে পকেটের মুখটা সেলাই করে দিয়েছি৷ শত্রুরা কোনোগতিকে সন্দেহ করেছে চাবিটা আমার কাছেই আছে৷ এটা হাতাবার জন্যেই তারা আমাকে একলা পেয়ে মারবার, আর আপনাদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করেছিল৷’

অমলবাবু বললেন, ‘তার মানে?’

-‘মানে খুব সহজ৷ আমি বোকার মতো এগিয়ে আপনাদের চোখের আড়ালে এসে পড়েছিলুম৷ তখন এক জন কি দু-জন শত্রু অতর্কিতে আমাকে আক্রমণ করতে আসে৷ সেই সময়টায় আপনাদের অন্যমনস্ক রাখার জন্যে বাকি শত্রুরা আপনাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা খেলছিল!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘মানিক, তোমার কথাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে! কিন্তু তোমাকে গলা টিপে অজ্ঞান করে ফেলেও তারা ওই চাবিটা নিয়ে গেল না কেন?’

-‘এর একমাত্র কারণ হতে পারে, হয়তো চাবিটা খুঁজতে তাদের দেরি হয়েছিল৷ আপনারা এসে পড়াতে তারা পালিয়ে যায়৷’

-‘খুব সম্ভব তাই৷’

এমন সময়ে হাতি সিং জমির উপর থেকে কী একটা ছোটো চকচকে জিনিস তুলে নিয়ে মানিককে বললে, ‘বাবুজি, আপনি উঠে বসতেই এটা আপনার বুক থেকে মাটির ওপরে পড়ে গেল!’

সেই জিনিসটার দিকে তাকিয়েই সকলের দৃষ্টি যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতন হয়ে গেল৷ সেটা আর কিছু নয়, সেই নকশা আঁকা সোনার চাকতি!

কী অদ্ভুত রহস্য! চাকতি ছিল আগে হতভাগ্য জয়ন্তের কাছে, তারপর তাকে হত্যা করে শত্রুরা নিশ্চয়ই এই চাকতিখানাকে হস্তগত করেছিল, কিন্তু যে অমূল্যনিধির জন্যে এত খোঁজাখুজি, এত হানাহানি এমন অরক্ষিত অবস্থায় সেই জিনিসটাই মানিকের বুকের উপরে অযাচিতভাবে এসে পড়ল কেমন করে?

তাড়াতাড়ি চাকতিখানা নিয়ে লন্ঠনের আলোতে ভালো করে পরীক্ষা করে মানিক হতবুদ্ধির মতো বললে, ‘এ যে সেই চাকতি, তাতে আর কোনোই সন্দেহ নেই! কিন্তু-কিন্তু, নাঃ, আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, আমিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছি!’

খানিকক্ষণ সকলেই বিস্ময়ে স্তব্ধ! তারপর অমলবাবু ধীরে ধীরে বললেন, ‘হয়তো মানিককে যে আক্রমণ করেছিল, ধস্তাধস্তির সময়ে চাকতিখানা তার অজান্তেই পড়ে গিয়েছে!’

মানিক বললে, ‘আপাতত তাই মনে করা ছাড়া উপায় নেই! কিন্তু এ বড়ো আশ্চর্য?’

আচম্বিতে সুন্দরবাবু কী দেখে বেজায় চমকে উঠলেন৷ তাড়াতাড়ি একটা লন্ঠন তুলে ধরে জমির দিকে দৃষ্টিপাত করে বিপুল বিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘হুম! এ আবার কী?’

মানিক অবাক হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলে, তার পাশের জমির উপরে অনেকখানি রক্ত পড়ে রয়েছে,-খালি রক্ত নয়, সেই সঙ্গে রয়েছে একখানা বড়ো ছোরা বা ছোটো তরবারির মতো অস্ত্র এবং মানুষের হাতের সদ্য-কাটা আঙুল!

অমলবাবু এরকম ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন না, তিনি শিউরে উঠে দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেললেন!

সুন্দরবাবু মানিকের দুই হাতের উপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘মানিক, তোমার হাতের একটা আঙুলও তো হারিয়ে যায়নি দেখছি! তবে এ বেওয়ারিস আঙুলের অর্থ কী?’

মানিক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ ধরে আঙুলটা দেখে বললে, ‘আঙুলটা কিরকম লম্বা আর মোটা দেখছেন তো! এ আঙুল যারই হোক, তাকে খুব ঢ্যাঙা আর বলিষ্ঠ বলেই মনে হয়!’

অমলবাবু সচকিত কন্ঠে বললেন, ‘শত্রুদের দলে চ্যান আছে কি না জানি না, কিন্তু খুব ঢ্যাঙা আর বলিষ্ঠ লোক বললে চ্যানকেই আমার মনে পড়ে!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘ধরে নেওয়া যাক, চ্যান সকলের চোখে ধুলো দিয়ে কোনোরকমে এক জাহাজেই আমাদের সঙ্গে এসেছে! ধরে নেওয়া যাক, চ্যানই গলা টিপে মানিককে অকালে স্বর্গে পাঠাবার চেষ্টা করেছিল! কিন্তু চ্যানের আঙুল বলি দিলে কে? মানিক, অজ্ঞান হবার আগে তুমি কি লড়াই করেছিলে?’

মানিক বললে, ‘লড়াই করব কী, কে আমাকে আক্রমণ করেছিল তাও দেখতে পাইনি! আর দেখছেন না, ছোরাখানাও রক্তমাখা! নিশ্চয়ই ওই ছোরাতেই আঙুলটার উচ্ছেদ হয়েছে! ওরকম দু-ধারে ধার দেওয়া ছোরা কখনো আমার কাছে ছিল না! ও ছোরা কার? ওর মালিক ওখানা ফেলে রেখে গিয়েছে কেন? আমাকে বাঁচাবার জন্যেই সে যদি আমার শত্রুকে ছোরা নিয়ে আক্রমণ করে থাকে, তবে সেও পালিয়ে গেল কেন? তাকে তো আমরা বন্ধু বলে পরম সমাদর করতুম! আর এই অজানা মুল্লুকে বন্ধুই বা পাব কোত্থেকে, বন্ধু তো আকাশ থেকে খসে পড়েনি!’

অমলবাবু বললেন, ‘এক হতে পারে, পদ্মরাগ বুদ্ধের লোভে ওই সোনার চাকতিখানার জন্যে শত্রুরা নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি করেছিল!’

সুন্দরবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘ওসব বাজে কথা! শত্রুরা নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি করতে পারে, কিন্তু মানিককে বাঁচাবার জন্যে তাদের কারুরই মাথাব্যথা হতে পারে না! হুম, এসব হচ্ছে ডাহা ভূতুড়ে কাণ্ড৷ এ জায়গাটা হচ্ছে হাজার বছরের পুরোনো একটা মরা জাতের গোরস্থানের মতো! এখানকার আনাচেকানাচে ভূতের আড্ডা আছে!’

মানিক বিষণ্ণ কন্ঠে বললে, ‘এ যদি ভূতুড়ে কাণ্ড হয় আমি তাহলে বলব, জয়ন্তের প্রেতাত্মাই আমাকে আজ বাঁচিয়েছে, আর নিজের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছে!’

সুন্দরবাবু তখনি টপ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আর এখানে থাকা উচিত নয়৷ আমি অবশ্য জয়ন্তকে অত্যন্ত ভালোবাসি, কিন্তু তার প্রেতাত্মাকে ভালোবাসবার ইচ্ছে আমার নেই৷ আমার বাবা-মা স্বর্গে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের প্রেতাত্মা এলেও আমি আর দেখা করব না! ওঠো মানিক, উঠুন অমলবাবু!’

মানিক গাত্রোত্থান করে বললে, ‘হ্যাঁ, এখানে আর দেরি করে লাভ নেই৷ এই গভীর রহস্যের কিনারা না করেই আমাদের তাড়াতাড়ি যাত্রা করতে হবে৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘খালি ভূত নয়, এখানে চারিদিকে শত্রুরাও লুকিয়ে আছে৷ তারা আমাদের সমস্ত গতিবিধিই লক্ষ করছে! তারা যে সাহস করে আমাদের আক্রমণ করতে পারছে না, তার কারণ হচ্ছে আমরা সবাই সতর্ক আর আমাদের হাতে আছে চার-চারটে বন্দুক৷ . . . আরে গেল, এই হাতি সিং! তোমার নাম গাধা সিং হওয়া উচিত! তোমার বন্দুকের মুখনল আমার ভুঁড়ির দিকে নামিয়ে রেখেছ কেন? যদি ফস করে আওয়াজ হয়ে যায়? অমন করে বন্দুক ধরতে নেই, ওটা কাঁধে তোলো!’

আলোয়-ছায়ায়, মাঠে-জঙ্গলে, পথে-বিপথে আবার সবাই এগিয়ে চলল৷ রাত পোয়াল, উষার সিঁথায় দিবসবধূ সিঁদূর-লেখা লিখলে, মাঠ-ঘাটের উপর দিয়ে তপ্ত দুপুরে-হাওয়া তেষ্টায় হা-হা করে গহনবনের ঠান্ডা বুকের ভিতর গিয়ে নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ল, সন্ধ্যার মেঘ-মন্দিরে সূর্যচিতার রক্তশিখা জ্বলে উঠল, রাত্রি আবার তার অন্ধ কুঠুরির দরজা খুলে ছায়া-অনুচরদের পৃথিবী ভ্রমণে পাঠিয়ে দিলে! মাঝে মাঝে দেখা দেয় মাটির উপর চির-চলন্ত বৃহৎ জলসর্পের মতো নদী৷ তখন ওঠে নদী পার হবার সমস্যা! মাঝে মাঝে বিপুল অরণ্য বাহুবিস্তার করে পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ায়৷ তখন কুঠার নিয়ে বনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়৷ মাঝে মাঝে গিবন-বানরের দল গাছের নীচের ডাল থেকে মগডালে লাফ মেরে কিচিমিচির ভাষায় কী বলে ওঠে এবং কৌতূহলী চোখে নীচের দিকে তাকিয়ে এই নির্জন বনরাজ্যে প্রথম মানুষদের দেখে, আর বোধ করি আশ্চর্য হয়ে ভাবে-‘এরা আবার কোন দেশি বানর? এদের ল্যাজ নেই, গায়ে লোম নেই, এরা গায়ে জড়িয়ে থাকে কী কতকগুলো সাদা সাদা জিনিস, দু-পা দিয়ে হাঁটে, এরা আবার কোন দেশি বানর?’ মাঝে মাঝে বাঁশ বন দুলে দুলে ওঠে, মড়মড় করে শব্দ হয়, বোঝা যায় হাতির দল ওখানে জীবনযাত্রা নির্বাহ করছে! মাঝে মাঝে ধারাবাহিক ঝোপঝাপের উপর দিয়ে তীব্র একটা গতির রেখা সশব্দে চলে যায়-একটা চাপা গর্জনও শোনা যায়, বনের মধ্যে অশান্তিকর অনাহূত অতিথি দেখে বাঘ বা অন্য হিংস্র জন্তু দূরে সরে গেল! মাঝে মাঝে মানুষের ঘৃণ্য পায়ের শব্দে ঘাসের ভিতরে গোখরো সাপের ঘুম ভেঙে যায়, ফোঁস করে ফণা তোলে, তীক্ষ্ণ চক্ষে জ্বলন্ত হিংসার স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে পড়ে এবং পরমুহূর্তেই বিদ্যুতের মতো অদৃশ্য হয়৷ . . . এবং সর্বক্ষণ সারা বনে জেগে থাকে যাদের দেখা যায় না, বোঝা যায় না, তাদের অশ্রান্ত অস্তিত্বের ধ্বনি! কে যেন নিরালায় কানাকানি করছে; কে যেন আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখে ফিসফিস করে কথা বলছে; কে যেন শুকনো পাতা মাড়িয়ে অতি সন্তর্পণে পিছনে আসছে আবার থেমে পড়ছে, আসছে আবার থেমে পড়ছে৷

গভীর দূর-বিস্তৃত নানা শব্দময় প্রত্যেক অরণ্যই মানুষের পক্ষে ভয়াবহ! কোনো অরণ্যই আধুনিক নগরবাসী মানুষকে সাদর সম্ভাষণ জানায় না! বনবাসী কোনো জীবই মানুষকে বন্ধু বলে মনে করে না৷ কল্পনায় নির্জনতাকে মিষ্টি লাগে, কিন্তু অরণ্যের এই সশব্দ নির্জনতা মনকে দেয় দমিয়ে৷ পদে পদে বিপদের সম্ভাবনায় মানুষ চমকে ওঠে! বোধ হয়, প্রত্যেক শব্দই আসছে লুকানো মৃত্যুর কন্ঠ থেকে! সমস্ত অরণ্যকেই বিরাট একটা প্রেতাত্মা বলে সন্দেহ হয়৷ সূর্যালোক তাকে কতকটা বন্ধুর ছদ্মবেশ পরাতে চেষ্টা করে বটে, কিন্তু রাত্রির ঘোর অন্ধকারে মানুষের মন সেখানে ভয়ে কুঁকড়ে পড়ে এবং অস্পষ্ট চন্দ্রালোকে?-অরণ্যের মতো ভয়ংকর তখন আর কিছুই নেই! কারণ কেবল কানে তখন সন্দেহজনক শব্দ শোনা যায় না, চোখও তখন সভয়ে দেখে কাছে, দূরে, শত শত বিভীষিকাময় আনাগোনা! বিজন অরণ্যে চন্দ্রালোকের চেয়ে অন্ধকার সহনীয়!

আর একটা দুঃস্বপ্নময় রাত্রির পরে এল স্নিগ্ধ শান্ত প্রভাত৷

অমলবাবু বললেন, ‘আমরা খুব তাড়াতাড়ি চলছি৷ আজ সন্ধ্যার আগেই ভাঙা মন্দিরের কাছে পৌঁছোতে পারব৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘কিন্তু শত্রুদের আর কোনো সাড়াশব্দ নেই৷’

মানিক বললে, ‘কিন্তু তারা যে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই আছে, এটা সর্বদাই মনে রাখবেন৷ আমরা সশস্ত্র আর সাবধান বলেই তারা এখনও সামনে আসছে না৷ . . . কাল রাত্রেই আমি তাঁবুর বাইরে পায়ের শব্দ শুনেছি৷ কে যেন পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল৷ বাইরে বেরিয়ে তাকে ধরতে পারলুম না বটে, কিন্তু বেশ দেখলুম, একটা ছায়া ছুটে জঙ্গলের ভিতরে মিলিয়ে গেল!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তুমি আমাদের ডাকলে না কেন? এক বেটার আঙুল কাটা গেছে, এ বেটাকে ধরতে পারলে আমি এর নাকটা কচ করে কেটে নিতুম!’

মানিক বললে, ‘তার নাক নিয়ে আপনি কী করতেন, সুন্দরবাবু? যদিও আপনার নাকটি খ্যাঁদা, তবু তার নাক টিকোলো হলেও আপনার অভাব তো দূর হত না?’

সুন্দরবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘এরকম ঠাট্টা আমি পছন্দ করি না! আমার নাক খ্যাঁদা? কে বললে তোমাকে? আমার নাক খ্যাঁদা নয়!’

সকলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে একটা মাইল খানেক চওড়া মাঠের উপর এসে পড়ল! কেবল মাঠ নয়, মাঠের একপাশ দিয়ে ঝিরঝির করে বয়ে যাচ্ছে একটি ছোট্ট নদী এবং তার তীরে তীরে চরে বেড়াচ্ছে একঝাঁক পাখি!

সুন্দরবাবু খুশি গলায় বলে উঠলেন, ‘বনমুরগি! এসো মানিক, দেখা যাক ভগবান আজ আমাদের বনমুরগির মাংস খাওয়াতে পারেন কি না!’

মানিক মাথা নেড়ে বললে, ‘না সুন্দরবাবু! জয়ন্ত মুরগির মাংস খেতে ভালোবাসত! সে যখন নেই, আমার মুখে ও মাংস আজ আর রুচবে না!’

এদিকে মানুষের সাড়া পেয়ে মুরগিগুলো তখনি উড়ে পালাল! সুন্দরবাবু হতাশভাবে সেই উড়ন্ত, জ্যান্ত খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন৷

মানিক বললে, ‘দেখুন সুন্দরবাবু, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে!’

-‘হুম! সুবুদ্ধি, না কুবুদ্ধি?’

-‘আমাদের পক্ষে সুবুদ্ধি৷ ইচ্ছা করলে এখনি আমরা দেখতে পারি, শত্রুরা আমাদের পিছু পিছু আসছে কি না? সঙ্গেসঙ্গে তাদের কিঞ্চিৎ শিক্ষাও দিতে পারি!’

-‘কী করে শুনি?’

-‘এই মাঠটা দেখছেন তো? এর মধ্যে গাছপালা কিছুই নেই৷ এপারে গভীর বন, ওপারেও গভীর বন! আমরা এখনি ওপারের বনে গিয়ে ঢুকব৷ তারপর না এগিয়ে ঝোপের আড়ালে বন্দুক বাগিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকব৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘খাসা মতলব এঁটেছ ভায়া! শত্রুরা যদি আমাদের পিছনে লেগে থাকে, তাহলে তাদেরও এই মাঠ পার হতে হবে৷ এখানে লুকোবার যায়গা নেই, তারা এলেই আমরা দেখতে পাব! তারপরেই আমাদের বন্দুকগুলো গুড়ুম রবে গর্জন করে উঠবে,-কেমন, তাই নয় কি?’

-‘ঠিক তাই৷ কিন্তু আমরা তাদের পা লক্ষ করে গুলি ছুড়ব৷ নইলে নরহত্যার দায়ে পড়তে হবে!’

-‘ওসব শত্রুকে হত্যা করলেও পাপ নেই৷ ওরা তো আমাদের খুন করতেই চায়, আমরাও আত্মরক্ষা করব না কেন? চলো, এখন তোমার কথামতোই কাজ করা যাক!’

সকলে ওপারের বন লক্ষ করে দ্রুতপদে অগ্রসর হল৷ মাঠ শেষ হয়ে গেল৷

মানিক বললে, ‘এখানে বেশিরভাগই বাঁশ বন৷ গোটাকয়েক বট গাছও আছে৷ এদিকে বেত বন, নীচে সব জায়গা জুড়ে রয়েছে আগাছার জঙ্গল৷ এর মধ্যে লুকিয়ে থাকলে কেউ আমাদের দেখতে পাবে না৷ আসুন, গা-ঢাকা দেওয়া যাক! একটু পরেই হয়তো চ্যান আর ইনের খবর পাওয়া যাবে!’

সকলে একে একে ঝোপের ভিতর অদৃশ্য হল৷

সবুজ মাঠ ধু-ধু করছে৷ ওদিককার বনরেখার উপর থেকে এই অভিনব নাট্যলীলার দর্শকরূপে সূর্যদেব রাঙামুখে তাকিয়ে রইলেন, তাঁর সোনা হাসি ওপাশের নদীর লহরে লহরে নেচে নেচে খেলতে লাগল৷ গানের পাখিরাও নীরব হয়ে ছিল না৷