যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা – ৯

প্লে-গ্লাসের ডবল-দরজা। ভিতরটা বাতানুকূল করা। পাশেই বিজ্ঞপ্তি : ‘রিসেপশন’। একটি মেয়ে বসেছিল সুমিত্ৰা গৰ্গ না ঝরনা তামাং বুঝতে পারলেন না। মেয়েটি যান্ত্রিক হাসি হেসে বললে, মে আই হেল্‌প য়ু, স্যার?

—জৈন-সাহেব কি দপ্তরে এসেছেন? সিনিয়ার মিস্টার জৈন?

—আজ্ঞে না। তিনি বিজনেস ট্যুরে বাইরে গেছেন।

—তাহলে আমি মিস্টার মাধবরাজ জৈনজীর সঙ্গে দেখা করব।

—কী নাম জানাব তাঁকে?

—পি. কে. বাসু।

মেয়েটি একটু সচকিত হয়ে ওঠে, এক্সকিউজ মি স্যার, আপনি কাঁটা-সিরিজের — আই মিন আপনিই কি, ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু?

—হ্যাঁ, পেশায় আমি ব্যারিস্টারই বটে। ক্যালকাটা হাইকোর্টের।

মেয়েটি কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ভেতরের ঘর থেকে একজন এগিয়ে এসে বললে, বড়বাবু অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টারখানা চাইছেন।

মেয়েটি সেটা হস্তান্তরিত করার সঙ্গে সঙ্গে বাসু বলে ওঠেন, তোমার নামটা কী, মা? সুমিত্রা? না ঝরনা?

মেয়েটি অবাক হয়ে যায়। বলে, আপনি কেমন করে ….

বাসু আঙুল তুলে বললেন, মাধবরাজীকে খবরটা জানাও।

—ও ইয়েস, স্যার। ইনডিড।

মেয়েটি ইন্টারকমের দিকে সরে গিয়ে কাকে কী যেন বলল। যন্ত্রটা এমনভাবে বসানো, যাতে কাউন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে বাসু কিছু শুনতে পেলেন না। ওর ওষ্ঠাধরের কম্পনও দেখতে পেলেন না।

একটু পরে হল-কামরার বিপরীতে একটা দরজা খুলে গেল। ইতিমধ্যে আরও দু-চারজন করণিক শ্রেণীর লোক ‘হলে’ এসেছে। চেয়ারে গিয়ে বসতে শুরু করেছে। ভিতরের দিকে খোলা দরজার ও-প্রান্তে এসে যিনি দাঁড়ালেন তিনি নিশ্চয় মাধবরাজজী। দশাসই জোয়ান। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। পাঁচ দশ উচ্চতা। কপালটা চওড়া। সামনের দিকের চুল উঠে যাওয়ায় সেটা আরও প্রকট। দৃঢ়নিবদ্ধ ওষ্ঠাধর। ব্যক্তিত্বময় চেহারা। ওখান থেকেই বললেন, মিস্টার বাসু?

—রাইট!

—আমিই মাধবরাজ জৈন। আমার সঙ্গে কী উদ্দেশ্যে দেখা করতে এসেছেন, মিস্টার বাসু? আই মিন : পাপার্স অব য়োর ভিজিট?

—দু’জনের মধ্যে অন্তত দশ ফুটের ব্যবধান।

এপ্রান্ত থেকে বাসু বললেন : চৈতালী বসু।

—তার সম্বন্ধে কী কথা বলতে এসেছেন?

—চৈতালী বসু কি আপনাদের ক্যাশিয়ার?

—হ্যাঁ, কিন্তু সে এ অফিসে নেই। ছুটিতে আছে। ওর ভাইয়ের একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। শিলিগুড়ি সদর হাসপাতালে আছে। চৈতালী সম্ভবত তার ভাইয়ের কাছে আছে। সেখানে গেলে তার দেখা পেতে পারেন। বাট আয়াম নট শ্যিওর।

—আমি তো বলিনি যে, চৈতালীকে আমি খুঁজছি। বলেছি, চৈতালীর বিষয়ে আপনার সঙ্গে জনান্তিকে কিছু কথা বলতে চাই।

— ইজ দ্যাট সো? বলুন?

বাসু অতঃপর উচ্চকণ্ঠে বললেন, অল রাইট। আপনি যদি এখানেই আলোচনাটা এভাবে করতে চান, তাতে আমার তরফে আপত্তি নেই। আদালতে চেঁচিয়ে বক্তৃতা করার অভ্যাস আমার আছে। শুনুন মিস্টার জৈন! চৈতালী বসু, আপনাদের কেশিয়ার, আমার মক্কেল। আমি কলকাতা থেকে ব্যক্তিগতভাবে জানতে এসেছি, আপনারা কেন শিলিগুড়ির পুলিশকে বলেছেন যে, আমার মক্কেল দুই লক্ষ টাকার তহবিল তছরুপ করে নিখোঁজ হয়েছে?

মাধবরাজ দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দু-পা এগিয়ে আসেন। বলেন, প্লিজ স্টপ দেয়ার, মিস্টার বাসু! অমন কথা আমরা বলিনি।

—তাহলে ‘কেমন কথা’ শিলিগুড়ি পুলিশকে বলেছেন? যার ফলে লালবাজার থেকে দুজন পুলিশ হোটেলে এসে প্রকাশ্যে হামলা করে? আমার মক্কেলকে মানহানিকর প্রশ্ন করার সাহস পায়?

—মিস্টার বাসু! প্লিজ। অমন একটা বিষয়ে আলোচনা করার না এটা সময়, না পরিবেশ?

—কেন? সময়টা তো অফিস টাইম! আর পরিবেশটা তো আপনিই বেছে নিলেন। আমার জনান্তিক আলোচনার প্রস্তাবটা অগ্রাহ্য করে। তাই নয়? স্থান-নির্বাচন তো আমি করিনি।

—আয়াম সরি, মিস্টার বাসু। অনুগ্রহ করে আমার ঘরে এসে বসবেন কি?

বাসু মাধবরাজের নির্দেশমতো তাঁর ঘরে ঢুকে ভিজিটার্স চেয়ার দখল করে পাইপ ধরালেন।

মাধবরাজ তাঁর চেয়ারে বসে বললেন, কিছু মনে করবেন না, স্যার। আমার মাথার ঠিক ছিল না। একটু আগে অডিটার আমাকে জানিয়েছেন যে, তহবিলে যে ঘাটতি আছে তার পরিমাণ দুই লক্ষ টাকা।

—আজ্ঞে না। একটু আগে নয়। আপনার মাথা এখনো ঠিক হয়নি। গতকাল দুপুরে ক্যালকাটা পুলিশ জানত যে, ঘাটতির পরিমাণ দুই লক্ষ টাকা

—হ্যাঁ, তাই বটে। কাল সকালে। ফলে, বুঝতেই পারছেন আমরা কী পরিমাণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছি। ক্যাশের চাবি থাকে তিনজনের কাছে। চাচাজী, আমি আর মিস বসু। তা—চাচাজী আজ কদিন শিলিগুড়ির বাইরে, নেপালে। এদিকে মিস বসুকে ছুটি দেওয়া হয়েছে যেহেতু তার ভাই হাসপাতালে মরণাপন্ন। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেল মিস বসু শিলিগুড়িতে নেই। এক্ষেত্রে আমরা যদি ব্যস্ত হয়ে…

—চাবি তো আপনার কাকার কাছেও থাকে। কই? তাঁর পিছনে তো আপনারা পুলিশ লেলিয়ে দেননি!

—মিস্টার বাসু। আমার কাকা এমপ্লয়ি নন। তিনি এ ফার্মের পার্টনার—মালিক।

—তিনি ইচ্ছে করলে কাউকে না বলে ভল্ট থেকে দু-লাখ টাকা বার করে নিয়ে যেতে পারতেন—যেমন আপনিও পারেন ঠিক কি না?

—ঠিক। কিন্তু ক্যাশ থেকে কোন কারণে তিনি দু-লাখ টাকা বার করে নিলে নিশ্চয় আমাকে বলে যেতেন।

—আপনি নিজে দু-লাখ টাকা বার করে নিলে কাকে বলতেন? কাকাকে না ক্যাশিয়ারকে।

—সম্ভবত দু-জনকেই।

—সম্ভবত! অর্থাৎ রিয়্যাল এমার্জেন্সি থাকলে…

বাধা দিয়ে মাধবরাজ বলেন, আপনি অহতুক তিলকে তাল করে তুলছেন, মিস্টার বাসু!

—আয়াম সরি স্যার! আপনিই বেগতিক দেখে এখন তালকে টিপে-টুপে তিল করে তুলতে চাইছেন। আপনি কেমন করে জানলেন যে, আপনার কেশিয়ার ছুটিতে থাকা কালে কোলকাতার কোন্ হোটেলে উঠেছে, কী নামে উঠেছে?

—এক্সকিউজ মি, স্যার। সেটা কোম্পানির গোপন ব্যাপার। এ নিয়ে আপনার সঙ্গে আমি আলোচনা করতে পারি না।

বাসু বললেন, অল রাইট! আলোচনা করবেন না। আমি শুধু ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের জানাতে এসেছিলাম যে, মিস চৈতালী বসু আমার মক্কেল। আমরা মনে করি, আপনারা লালবাজারে অভিযোগ করে বলতে চেয়েছেন আমার মক্কেল দু-লাখ টাকা তহবিল তছরুপ করেছে। এটা মর্যাদাহানিকর অভিযোগ। মানহানিকর। আমরা যথারীতি লীগ্যাল অ্যাকশন নেব। এই আমার কার্ড, মিস্টার জৈন। আপনি বা আপনার কোম্পানি যদি আমার মক্কেলের সঙ্গে ঐ ক্যাশ-তহবিল সম্বন্ধে কোনও আলোচনা করতে চান তাহলে অনুগ্রহ করে তা আমার মাধ্যমে করতে হবে। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?

—আপনি কি বলতে চান যে, মিস বোস এ চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন?

— সে কথা তো আমি বলিনি। আমি বলেছি, আপনাদের ক্যাশের ঘাটতি বিষয়ে কোনও প্রশ্ন বা আলোচনা যদি আপনারা আমার মক্কেলের সঙ্গে করতে চান তাহলে তা আমার মাধ্যমে করতে হবে।

প্লিজ মিঃ বাসু। আপনি ব্যাপারটা ওভাবে নেবেন না। পুলিশ যদি হোটেলে কোনও মানহানিকর কথা বলে থাকে, সে তাদের দায়িত্ব। আমরা শুধু খোঁজ নিতে বলেছিলাম। মিস বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে যে, ঐ দুইলক্ষ টাকার ঘাটতি বিষয়ে তিনি কিছু জানেন কি না।

—ক্যাশে আপনাদের দুইলাখ টাকা নগদে থাকে কেন? শিলিগুড়িতে ভাল ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্ক নেই?

—আমাদের ব্যবসায়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নগদ টাকায় কেনাবেচা হয়। চেক বা ব্যাঙ্কড্রাফ্ট চলে না।

—যাতে কেনাবেচার কোনও প্রমাণ না থাকে? যে বেচছে সে বোধকরি স্ট্যাম্পড্ রসিদও দেয় না। তাই না?

—না, না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমরা, মানে … নগদে কেনাবেচাটা পছন্দ করি। তারপর লেনদেনটা সম্পূর্ণ হলে পরে সময় সুযোগমতো খাতাপত্রে বুঝেছেন না?

—আজ্ঞে না। আদৌ বুঝছি না। ইনকাম ট্যাক্স বা ওয়েল্থ্ ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া ছাড়া এর আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

—আরে না, না। এটা অন্য ব্যাপার। অনেক দেশ থেকে দুষ্প্রাপ্য মূর্তি, ছবি, ইত্যাদি আসে তো। সে সব দেশে হয়তো সীমান্তের ওপারে এ সব মালপত্র নিয়ে যাওয়াই নিষিদ্ধ …

— তার মানে স্মাগ্‌ল্‌ড্ গুড্‌স? অথবা চোরাই মাল?

—কী আশ্চর্য। তা কেন হবে? আমরা রাম-শ্যাম-যদুর কাছে এসব দুষ্প্রাপ্য কিউরিও কিনি না বা বেচি না। জেনুইন ডিলার। জেনুইন খদ্দের।

—জেনুইন ডিলার চেকে লেনদেন করতে রাজি নন! কেন?

—তাই তো বোঝালাম এতক্ষণ। আপনি না বুঝলে আমি নাচার।

—ন্যাচারালি। কিন্তু বিচারকও আমার মতো বোকা হলে আপনি ‘নাচার’ বলে পার পাবেন না মিস্টার জৈন—বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আপনাকে দিতে হবে: কী কারণে আপনাদের ক্যাশে দু-পাঁচ লাখ টাকা সবসময় নগদে রাখত হয়। কী কারণে চেকে লেনদেন হয় না।

—বিচারক মানে? কোন বিচারক?

—তা তো এখনি বলতে পারছি না। আমরা যখন মানহানির মামলাটা আনব তখন যে বিচারক সেটার বিচার করবেন

ঠিক এই সময়েই ইন্টারকম’ যন্ত্রটা জৈনসাহবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল। সুইচ টিপে জৈন বললেন : ইয়েস?

—সরি টু ডিসটার্ব য়ু স্যার! একটা খবর জানাতে বিরক্ত করছি। বড়সাহেব নেপাল থেকে ফিরে এসেছেন। এইমাত্র অফিসে এলেন।

—ও! আচ্ছা, তাঁকে বল, আমার ঘরে একবার পদধূলি দিতে। তাঁকে আরও বোলো যে, ক্যালকাটা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার মিস্টার পি. কে. বাসু আমার ঘরে বসে আছেন—ঐ তহবিলের ঘাটতির ব্যাপারে। আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইসার মিস্টার শ্রীবাস্তবকে টেলিফোনে পাও কি না দেখ। তাঁকে পেলে আমাকে লাইনটা দিও।

বাসু বললেন, আমিও তাই চাইছি। আপনাদের আইন সংক্রান্ত পরামর্শদাতার সঙ্গেই ঐ মানহানি মামলাটার বিষয়ে

—না, না না! সে জন্য নয়। …এই যে আমার চাচাজী এসে, গেছেন।