৮
কাল রাত্রে বাসুসাহেব শিলিগুড়ির সেবক রোডের ‘নূরজাহান’ হোটেলে এসে উঠেছেন। রাত নয়টা নাগাদ। আছেন সাততলার একটা এ. সি. ডিলাক্স সুইটে। হোটেলটা আনকোরা নতুন। এখনো উপরতলায় কাজ হচ্ছে। শিলিগুড়ি ব্যবসাক্ষেত্র হিসাবে দিন দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে। সমানতালে লাভজনক হচ্ছে হোটেল ব্যবসায়। হোটেলে ‘বার’ আছে। বাসু সুটকেসে ওঁর প্রিয় হুইস্কি নিয়েই এসেছেন। শ্যিভাস রিগ্যাল’ আবার সর্বত্র পাওয়াও যায় না। বেল বয়কে দিয়ে কিছু চিকেন কাবাব আর বরফ আনিয়ে নিয়েছেন। ফোনটা তুলে নিয়ে কলকাতায় বাড়িতে এস. টি. ডি. করলেন। ধরল কৌশিক। জানতে চাইল, শিলিগুড়ির হোটেল থেকে বলছেন তো?
বাসু বললেন, হুঁ। সুজাতা কি এখনো হোটেলে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। 315 নম্বর ঘরটা সে কুম্ভের মতো রক্ষা করছে।
—কুম্ভ? কোন কুম্ভ? অ্যাকুইরাস?
—আজ্ঞে না। কুম্ভরাশি নয়। ‘একা কুম্ভ রক্ষা করে নকল বুঁদিগড়।’ আমি গেছিলাম। বেল বাজালাম। নো সাড়াশব্দ। টেলিফোন করলাম নো সাড়াশব্দ। রুদ্ধদ্বার কক্ষে সে নির্বিকল্প দিব্যি আছে।
—আর তোমার গৃহিণী এ নাটকে যে চরিত্রটা অভিনয় করছে তার খবর কিছু জান?
—সে কী! সে খবর তো আপনিই আমাদের জানাবেন।
— না। জানাতে পারছি না। ঐ ফ্লাইটে ও আসেনি। টিকিটও কালেক্ট করেনি। প্রথম দিনই ও বলেছিল নিরুদ্দেশ হতে চায়। এতদিনে সে সফলকাম হয়েছে মনে হচ্ছে। সে কোথায় জানি না।
—কাল সকালে ওখানকার একটা অফিসে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। সেটা রাখছেন তো?
—হ্যাঁ, এলামই যখন তখন অফিসটা একনজর দেখে যাই। হাসপাতালেও একবার যাব। তারপর বিকাল পাঁচটা পঁচিশের ফ্লাইট ধরে ফিরে যাব। তুমি গাড়িটা নিয়ে দমদম এয়ারপোর্টে এস।
—ঠিক আছে। লাইনটা একটু ধরুন। মামিমা কী যেন কথা বলবেন।
—তিনি আবার কী বলবেন?
একটু পরেই রানী দেবীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল টেলিফোনে, তুমি বোতলটা বার করে ফেলে রেখে গেলে কেন? তুমি চলে যাবার পর দেখি শ্যিভাস-রিগালের বোতলটা স্যুটকেস থেকে বার করে…
বাসু কথার মাঝপথেই বলে ওঠেন, নাঃ! ভাবলাম বিদেশ-বিভুঁয়ে একরাত না হয় নাই খেলাম! এক-আধ দিন বাদ দিলে অভ্যাসটা …
ধমক দিয়ে ওঠেন রানী, ন্যাকামী কর না! সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। আমি মেপে দুই পেগ বোতলে ভরে রেখেছিলাম বলে ওটা নামিয়ে রেখে গেছ, এটুকু বুঝবার মতো বুদ্ধি তোমার রানুর আছে। শোন, কলকাতা থেকে উড়বার আগেই কোন খানদানি লিকার শপ থেকে নতুন যে বোতলটা কিনেছ তা থেকে তিন পেগের বেশি খেও না যেন!
বাসু হতাশ হয়ে বলেন, বাড়িশুদ্ধ সবাই যদি গোয়েন্দা হয়ে ওঠে …
কথাটা শেষ হল না। তার আগেই রানু লাইনটা কেটে দিলেন।
পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলেন অফিস কমপ্লেক্সে। ঠিকানা খুঁজে বার করতে অসুবিধা হল না। এটাও বেশ বড় অফিস বাড়ি। – ‘সেবক মার্কেন্টাইল বিল্ডিং কমপ্লেক্স’। বড় সাইন বোর্ডে জৈন কিউরিও শপের বিজ্ঞপ্তি। সামনে প্লেট-গ্লাসের ডিসপ্লে উইন্ডো। তার সামনে রোলিং শাটার্স। পাশে বন্দুকধারী পাহারা। ডিসপ্লে উইন্ডোতে নানান জাতের কিউরিও। হাতির দাঁতের কাজ, রূপার উপর ফিলিগ্রি, সিল্ক স্ক্রোল, নানান জাতের পেন্টিং। এদেশী-ওদেশী। হঠাৎ বাসুসাহেবের নজর হল এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে ওঁর মক্কেল চৈতালী সাবধানে বড় রাস্তা পার হচ্ছে। বাসু দু-পা এগিয়ে গেলেন। অফিসের প্রধান প্রবেশদ্বারের থেকে একটু দূরে।
চৈতালী ওঁকে দেখতে পেল। বাসু ভেবেছিলেন প্রচণ্ড একটা ধমক দেবেন। দেওয়া হল না। এক রাত্রে চৈতালী যেন আমূল বদলে গেছে। তাকে চেনাই যায় না। মেরি আঁতোয়ানেতের কর্মবহুল জীবনের শেষ রাত্রিটা যেন ও কাটিয়ে এসেছে। প্রসাধনের চিহ্নমাত্র নেই। চুলগুলো ঝড়ে বিধ্বস্ত পাখির বাসা। বাসু ওর দুই বাহুমূল চেপে ধরে বলেন, কী হয়েছে চৈতালী?
—হরি … হরি … কাল রাত একটার সময় …
বাকিটা বলতে পারল না। বৃদ্ধের কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল।
বাসু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, লক্ষ্মীটি, চৈতালী, কাঁদে না। রাস্তার মাঝখানে এভাবে…
হাত দিয়ে ইঙ্গিত করতেই একটা ট্যাক্সি এগিয়ে এল। লোকটার হাতে একটা বিশটাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, কাছাকাছি কোনও পার্কে নিয়ে চল, সর্দারজী।
পঞ্চাশোর্ধ্ব ট্যাক্সি-ড্রাইভার বিয়োগান্ত নাটকটাতে অভিভূত হয়েছে। নিঃশব্দে ওঁদের দুজনকে নিয়ে এসে দাঁড় করালো একটা ফাঁকা উদ্যানে। বাসু ট্যাক্সিটাকে অপেক্ষা করতে বলে ওকে নিয়ে নামলেন। বেঞ্চে গিয়ে বসলেন। বললেন, শেষ সময়ে কি তুমি উপস্থিত ছিলে?
চৈতালী ইতিবাচক গ্রীবা সঞ্চালন করলেন।
—ওর জ্ঞান কি ফিরেছিল শেষ পর্যন্ত?
দুদিকে মাথা নেড়ে এবার জানাল : না।
—এখনো কি হাসপাতালে আছে?
এবার রুমালে চোখ মুছে চৈতালী বললে, না। ধ্রুব, সতীশ, নিমাই, মদনলাল—ওরা সবাই ওকে নিয়ে গেছে শ্মশানে। হিন্দু সৎকার সমিতির গাড়িতে আমাকে যেতে বারণ করল। ধ্রুবই ওর সবচেয়ে প্রাণের বন্ধু ছিল। সেই শ্মশানে ইয়ে করতে… আমাকে কিছুতেই সঙ্গে নিল না।
—ওরা ঠিকই করেছে। ওরা বোধ হয় হরির বন্ধু ছিল তাই নয়?
—আমারও বন্ধু। আমরা তো যমজ।
—মনটাকে শক্ত কর, চৈতালী। এদিকেও তোমার অনেক কাজ বাকি।
—জানি। সেই জন্যেই তো ছুটে চলে এসেছি। প্লেনটা ধরতে পারলাম না। রাত আটটায় একটা চার্টার্ড প্লেনে এসেছি। একটা টিকিট খামোকা নষ্ট হল। কী আর করা যাবে?
—তা তো বটেই, কিন্তু প্লেনটা তুমি ধরতে পারলে না কেন? যথেষ্ট মার্জিন নিয়ে তো হোটেল থেকে বের হয়েছিলে। আমি যখন হোটেল ছাড়ি তখন বেলা তিনটে দশ। তুমি তো তার আগেই …
—হ্যাঁ। তার আগেই আমি কী জানেন? আমার ক্রমাগত মনে হচ্ছিল কে যেন আমাকে ফলো করছে। তাছাড়া একটা টেলিফোন বুথে গিয়ে আমি এই শিলিগুড়ির হাসপাতালে এস. টি. ডি. করেছিলাম। ওরা বলল ওরা জানাল হরির অবস্থা … আমার আর কোন জ্ঞান ছিল না, মামু।
বাসু ওর পিঠে চাপড় মেরে বললেন, লুক হিয়ার, চৈতালী, যা হবার হয়ে গেছে। হরি যে তোমার কতখানি ছিল তা আমি বুঝছি। কিন্তু তোমার বিপদও কাটেনি এখনো। শিলিগুড়ি পুলিশ তোমাকে খুঁজছে …
—এখন আর আমার কোন ভয় নেই। জেলে যেতে বা ফাঁসি হলে তাই তো সোজা অফিসে যাচ্ছিলাম …
—বোকার মতো কথা বল না, চৈতালী। হরি যে চোর নয়, তুমি যে তহবিল তছরুপ মাসিমা করনি, এটা প্রমাণ না করে তুমি মরেও শান্তি পাবে না। স্বর্গ থেকে তোমার বাবা-মা, এমনকি হরি …
চৈতালী দুহাতে মুখ ঢাকল।
বাসু বললেন, বাড়ি যাও চৈতালী। দরজা-জানলা বন্ধ করে লম্বা একটা ঘুম দাও। স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়ে নিও। ঘণ্টা চার-পাঁচ ঘুমাতে পারলে তোমার শরীর ঠিক হয়ে যাবে। এদিকটা আমি সামলাচ্ছি, তুমি নিশ্চিত্ত থেক। এস, আগে তোমাকে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিই।
চৈতালী রাজি হল। ট্যাক্সি করে বাসুসাহেব ওকে পৌঁছে দিলেন ওর বাড়িতে। এস. বি. আই-এর ব্যাঙ্ক ড্রাফটা ওর কাছ থেকে নিয়ে নিলেন। ঐ ট্যাক্সিতেই ফের ফিরে এলেন অফিসে।