যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা – ৭

চৈতালী ঘরে তৈরি হয়েই বসেছিল। বাসু তাকে নিয়ে সামনের ব্যাঙ্কে গেলেন। ব্যাঙ্ক ড্রাফটটা বানাতে বেশ সময় লাগল। যা হোক, কাজ সেরে বাসুসাহেব ড্রাফটটা চৈতালীকেই রাখতে দিলেন। বললেন, চল, এবার দুজনে আমার 321 নম্বর ঘরে ফিরে যাই। আমি চাই না তোমাকে এ হোটেলের বেশি লোক মুখ চিনে রাখুক। আমরা ঘরেই কিছু খাবার আনিয়ে খেয়ে নেব। তারপর আমি তোমার নামে বুক করা ঘরে চলে যাব। এ ঘরের চাবিটা নিয়ে। তুমি ঠিক একটা নাগাদ খালি হাতে, অর্থাৎ শুধু ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে, দরজাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে যেও। নিচে নেমে গিয়ে একটা ট্যাক্সি নেবে। কেউ তোমাকে লক্ষ্য করছে কি না, ফলো করছে কি না, ভ্রূক্ষেপ করবে না। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা শেয়ালদহ স্টেশনে চলে যাবে। এ-কাউন্টার ও কাউন্টার ঘোরাঘুরি করে লেডিজ টয়লেটে ঢুকবে। সেখান থেকে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবে। একটা ফ্লাইং ট্যাক্সি ধরবে বিকাল সাড়ে তিনটে নাগাদ। সোজা চলে যাবে দমদম এয়ারপোর্ট। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স কাউন্টারে গিয়ে আমার নাম ছাপা এই কার্ডটা দেখালেই তুমি বাগডোগরার একটি টিকিট পেয়ে যাবে। তোমাকে নিয়ে ঐ সাতটা সতেরোর প্লেনে আমি শিলিগুড়ি যাব আজ। এনি কোশ্চেন?

—আজ্ঞে না।

দুজনে সেই মতো 321 নম্বর ঘরে এলেন। খাবারের অর্ডার দিলেন। আহার যখন মধ্যপথে তখন বেজে উঠল টেলিফোন। বাসু ধরলেন। ওপাশের ঘর থেকে সুজাতা ফোন করছে।

—ইয়েস। বল সুজাতা?

—ও টেলিফোন করেছিল। লোকটার নাম সত্যিই ঘিসিং। হীরালাল ঘিসিং। জৈন এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের সঙ্গে জানাশোনা আছে। নেপালি কিউরিও জোগাড় করে। চৈতালী তাকে চেনে না? কমিশন এজেন্টকে?

বাসু টেলিফোনে হাতচাপা দিয়ে প্রশ্নটা চৈতালীকে করলেন। চৈতালী বলল, হ্যাঁ, চিনি বৈ কি। কাঠমাণ্ডুতে থাকেন। রঞ্জনাদি ওর রাখী বহিন। উনি কলকাতায় এসেছেন কবে? কেন?

বাসু সেকথার জবাব না দিয়ে সুজাতাকে প্রশ্ন করেন, কৌশিক কি ওর ঠিকানা জেনে এসেছে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। লিটল-রাসেল স্ট্রিটে একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের সাত তলায় থাকেন। অ্যাপার্টমেন্ট 7/3। নতুন অ্যাপার্টমেন্ট হাউস। বাড়ির নম্বর 132/A; বাড়িটার নাম ‘স্কাইলার্ক’।

বাসু বললেন, আমি এখনি ওঘরে আসছি, অপেক্ষা কর। টেলিফোন নামিয়ে রাখতেই চৈতালী জানতে চায় মিস্টার ঘিসিং কি এখন কলকাতার বাসিন্দা? আর রঞ্জনাদি?

—রঞ্জনাদির কথা আমি জানতে চাইনি। তবে ঘিসিং থাকেন লিট্ল রাসেল স্ট্রিটের ‘স্কাইলার্কে’। 132/A; তা সে যাই হোক, তুমি স্রেফ ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে এয়ারপোর্টে চলে যাবে। দেখ, কেউ যেন তোমাকে এয়ারপোর্টে ফলো না করে। তোমার স্যুটকেসটা নিয়ে আমি এ ঘর থেকে চেক আউট করে যাব। সুজাতা কাল চেক আউট করবে চিত্রলেখা ব্যানার্জির পরিচয়ে।

চৈতালী ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

বাসু ফিরে এলেন 315 নম্বরে। দেখলেন সুজাতাও সাহস করে ডাইনিং হলে যায়নি। তার ভুক্তাবশিষ্ট প্লেট পড়ে আছে দরজার কাছে। বাসুসাহেব ভিতরে এসে দরজাটা বন্ধ করে দেবার পর সুজাতা জানতে চায়, ব্যাঙ্কের কাজ মিটল?

—হ্যাঁ! কালো টাকা আবার শাদা টাকা হয়ে গেছে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন।

—আপনার কি মনে হয় মামু, মেয়েটি সত্যিই বিপদে পড়েছে?

—ঠিক বুঝতে পারছি না, সুজাতা। হীরালাল ঘিসিং তাহলে আমার কাছে মিথ্যা পরিচয় দেয়নি! সে ওদের নেপালের এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের কাজ দেখে। চৈতালী বলল, রঞ্জনা ওর রাখী বহিন। সে হরিমোহনকে ব্ল্যাকমেলিং করছে কেন? কী বাবদে? হরিমোহনই বা অত টাকা কোথায় পেল? রিভলভারটাই বা তার হেপাজতে ছিল না কেন? অনেক… অনেকগুলো প্রশ্নের সদুত্তর পাইনি। তাই বোঝা যাচ্ছে না, চৈতালী কতটা বিপদে পড়েছে …

সুজাতা কী একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল তার আগেই কে যেন দ্বারে করাঘাত করল।

সুজাতা বলে, ঘিসিং ফিরে এল নাকি?

বাসু মাথা নাড়লেন, না! সে এলে বেল বাজাত। এ করাঘাতে ঔদ্ধত্যের প্রকাশ। হয় হোটেলের হাউস ডিটেকটিভ, নয় পুলিশ। ঘরটা তোমার— তুমিই দরজাটা খুলবে। কিন্তু কথাবার্তা আমাকে বলবার সুযোগ দিও।

সুজাতা গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকল দুজন শাদা পোশাকের পুলিশ। দুজনেরই মুখচেনা। নাম দুটো মনে পড়ল না বাসুসাহেবের। ওদের মধ্যে বয়স্ক পুলিশ অফিসারটি বলে ওঠেন, এ কী। বাসুসাহেব! আপনি এখানে?

বাসু বললেন, প্রশ্নটা আমরাও করতে পারি! আপনারা এখানে?

দুজনে এগিয়ে এল। দরজাটা বন্ধ করে গুছিয়ে বসল দুটি চেয়ারে। বয়স্ক পুলিশ অফিসারটি বুক পকেট থেকে সনাক্তিকরণ কার্ডটা দেখিয়ে বললেন, ক্যালকাটা পুলিশ। লালবাজার থেকে আসছি –

বাসু বলেন, কী ব্যাপার?

বয়স্ক অফিসারটি তার সহকারীকে বললেন, কাগজটা পড়ে দেখ তো গণেশ। কী লিখেছে? বয়স কুড়ি, রঙ ফর্সা, পাঁচ ফুট দুই, দেড়শ পাউন্ড? শেষ দেখা গেছে নীল শাড়ি, নীল ব্লাউজ, নীল চুড়ি, নীল লকেট। তাই তো?

গণেশ সুজাতাকে আপাদমস্তক একনজর দেখে নিয়ে এক গাল হেসে বললে, ইউক্লিডের ভাষায় ‘সমানুপাত’!

বয়ঃজ্যেষ্ঠ পুলিশ ধমকে ওঠেন: ইউক্লিড। সে আবার কে? সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান স্মাগলার ছোকরা?

—আজ্ঞে না স্যার। বলছি কি, হুবহু মিলে গেছে।

ইউক্লিড-না-চেনা পুলিশ অফিসারটি এবার সুজাতাকে প্রশ্ন করেন, মালক্ষ্মীর নামটা নিশ্চয় চৈতালী বসু? শিলিগুড়ির বাসিন্দা?

বাসু বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, জাস্ট এ মিনিট। সর্বপ্রথমে বলুন, আপনারা দুজন পুলিশ এ ঘরে কেন হানা দিয়েছেন?

টাকসর্বস্ব রুখে ওঠেন, সে কথা আপনাকে বলতে যাব কেন?

—কারেক্ট। আমাকে বলবেন না, বলবেন ঐ মেয়েটিকে। যাকে প্রশ্নটা করছেন। আপনারা কি আন্দাজ করছেন ও কোন অপরাধ করেছে?

—করে থাকতে পারে, আবার নাও পারে, আমরা জানি না। আমরা এস. পি. শিলিগুড়ির অনুরোধমতো কিছু তথ্য সংগ্রহ করছি মাত্র।

—ঠিক কথা, কিন্তু শিলিগুড়ির পুলিশ কি সন্দেহ করছেন মেয়েটি কোন অপরাধ করেছে?

—কী অপরাধ তা আমরা কেমন করে জানব? ওরা যেটুকু জানতে চেয়েছে তাই আমরা তদন্ত করে জানাচ্ছি।

—সেক্ষেত্রে আপনাদের কর্তব্য হবে মেয়েটিকে তার সাংবিধানিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে প্রশ্নটা পেশ করা।

—উনি যেন তা জানেন না। ন্যাকা?

—ঐ প্রশ্নটা আপনাকে পেশ করতে হবে সুপ্রিম কোর্টে।

—কোন প্রশ্নটা?

—সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকদ্বয় ‘ন্যাকা’ কি না। তাঁরাই বিধানটা পাকা করেছেন!

—অল রাইট, অল রাইট। অবধান করুন, মিস বোস, আমরা বর্তমানে আপনাকে কোন বিশেষ অপরাধে অপরাধী বলে চিহ্নিত করছি না। আপনাকে গ্রেপ্তার করতেও আসিনি। আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের প্রশ্নের কোন জবাব নাও দিতে পারেন। বলতে পারেন যে, আপনার উকিলের উপস্থিতি ভিন্ন আপনি আমাদের কোনও প্রশ্নের জবাব দেবেন না। আপনি যদি নিজ বায়ে…

বাধা দিয়ে বাসু বলেন, মেয়েটির অ্যাটর্নি এখানে উপস্থিত। আমি নিজেই!

—অল রাইট! এবার বলুন মিস্ চৈতালী বাসু —আপনি এ হোটেলে এমন ছদ্মনামে কেন উঠেছেন?

জবাব দিলেন বাসু, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে।

—মিস্ বোস! আপনি কি জানেন যে, যে, কোম্পানিতে আপনি ক্যাশিয়ারের চাকরি করেন, তার তহবিল থেকে একটা বিরাট টাকার অঙ্ক তছরুপ হয়ে গেছে?

—নো কমেন্টস্! — এককথায় থামিয়ে দিলেন বাসুসাহেব।

আপনি ক্রমাগত ফোড়ন কাটছেন কেন মশাই? আপনি জানেন— কী বিরাট অঙ্কের গরমিল হয়েছে ওঁদের তহবিলে। পাক্কা দু-লাখ! বুঝলেন? টু ল্যাক্স!

এই প্রথম মনে হল বাসুসাহেব একটু ঘাবড়ে গেছেন।

অসতর্কভাবে প্রশ্ন করে বসেন: কী? কী বললেন?

—আপনি কি কানে খাটো নাকি মশাই? আমি বলেছি, দুই লক্ষ তঙ্কা। কেশিয়ার নিরুদ্দেশ হবার সঙ্গে সঙ্গে!

বাসু ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন। বলেন, আপনারা অথবা শিলিগুড়ির পুলিশ কি মনে করেন যে, আমার মক্কেল এই তহবিল তছরুপের জন্য দায়ী?

— আমি এখনো সেকথা বলিনি। আমি শুধু কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে চাইছি …

—কিন্তু আপনারা একবারও বলেননি যে, এই তহবিল তছরুপের অপরাধে আপনারা আমার মক্কেলকে দায়ী করবেন না।

—আজ্ঞে না, তা বলিনি। আবার একথাও বলিনি যে, তিনিই দায়ী। নদার্ন সার্কেলের ডি. সি.-র অনুরোধ অনুসারে আমরা কিছু তথ্য সংগ্রহ করছি মাত্র।

—সে ক্ষেত্রে ওর আইন পরামর্শদাতা হিসাবে আমি ওকে পরামর্শ দেব কোনও প্রশ্নের জবাব না দিতে।

দুই পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়ায়। সুজাতার দিকে ফিরে বলে, কাজটা ভাল করলে না, চৈতালী দিদি। আচ্ছা চলি।

ওরা ঘর ছেড়ে চলে যায়।

বাসু বলেন, সুজাতা। পারতপক্ষে এ ঘরের বাইরে যেও না। কারণ তোমার অনুপস্থিতির সুযোগে ওরা এ ঘরে কনসিড্ মাইক্রোফোন বসিয়ে দিতে পারে। তুমি পারত পক্ষে টেলিফোনও ব্যবহার কর না। ওরা যতক্ষণ বিশ্বাস করবে চৈতালী বসু এ ঘরে বন্দী আছে ততক্ষণই আমরা দুজন নড়াচড়ার সুযোগ পাব। কৌশিক যদি ফোন করে তাকে বলবে, পরে কথা হবে। কারণ ওরা তোমার ফোন ট্যাপ করে ইন-কামিং কল মনিটার করবে। হয়তো টেপরেকর্ড করবে।

—চুপচাপ বসে থাকব? এ ঘরে টি. ভি. পর্যন্ত নেই?

—হোটেল স্টেশনারি তো রয়েছে। বসে বসে পদ্য লেখ না।

—পদ্য? মানে কবিতা? আমি জীবনে লিখিনি! সে আপনার ভাগ্নে হলে পারত।

—ছেলেবেলায় গঙ্গাস্তোত্র কিছু মুখস্ত করেছিলে? তাহলে সেটা ঝালিয়ে নিতে থাক। ভুল না, ‘দে অসো সার্ভ হ ওনলি স্ট্যান্ড অ্যান্ড ওয়েইট।’