৬
বাসু বিছানার একপ্রান্তে গিয়ে বসলেন। সুজাতাকেও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বললেন। চৈতালী বেরিয়ে যাবার পর দরজার ইয়েল-লকে ঘর আপনিই অর্গলবদ্ধ হয়ে গেছে। বাসু জানতে চাইলেন, কৌশিক কোথায়?
—ঠিক জানি না। কাছেপিঠেই আছে বোধহয়। আমাকে আপনার গাড়িটায় হোটেল থেকে কিছু দূরে নামিয়ে দিয়ে বোধহয় ফুটপাতের ওদিকে কোন চায়ের দোকানে ঢুকেছে।
—রিভলভারটা কার কাছে? তোমার না কৌশিকের?
—আমার কাছে।
সুজাতা নিজে থেকেই জানতে চায়, যে লোকটা আমার কাছে— মানে চৈতালীর কাছে—ব্ল্যাকমেলের টাকা আদায় করতে আসছে সে কি চৈতালীকে চেনে?
—ও পক্ষের সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না, সুজাতা। তাই তার কাছে তুমি প্রথমটা চিত্রলেখা ব্যানার্জির পরিচয়ে কথা বলবে। ভাবখানা : ও যাকে ব্ল্যাকমেল করতে আসছে তুমি তার প্রিয়জন। তোমার অনেক টাকা, সেই টাকার কিছুটা দিয়ে তুমি হতভাগ্যটাকে বাঁচাতে চাইছ। কিন্তু টাকাটা তুমি সাহস করে হোটেলে নিয়ে আসনি। ওর সঙ্গে আর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট কর। এই সুযোগে লোকটাকে চাক্ষুষ দেখে রাখা যাবে। ও কোথায় সেকেন্ড অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে সেটাও আমাদের জেনে নেওয়া দরকার। তৃতীয়ত, ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে জানতে চেও ও যে আবার টাকার দাবি নিয়ে আসবে না, তার গ্যারান্টি কী! এনি কোশ্চেন?
সুজাতা জবাব দেবার সুযোগ পেল না। কারণ ঠিক তখনই বেলটা বেজে উঠল। বাসু হাতের ইঙ্গিতে সুজাতাকে চুপচাপ বসে থাকতে বলে এগিয়ে গেলেন। দ্বার খুলে দেখলেন করিডোরে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। বেঁটে, মোটা, কালো। কিন্তু বেশবাসের পারিপাট্য নিখুঁত। থ্রি পিস স্যুট। কণ্ঠলগ্ন সিল্কের জোডিয়াক মার্কা টাই।
বাসু বললেন, ইয়েস? কাকে চাইছেন?
লোকটি বাসুসাহেবকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললে, একটা বিজ্ঞপ্তি দেখে এসেছি দৈনিক সঞ্জয় উবাচ-তে …
—কে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল?
—36-24-36!
—বিজ্ঞাপনটা যে এই ঘর থেকে দেওয়া তা জানলেন কী করে?
—বিজ্ঞাপনটা যে এই ঘর থেকে দেওয়া নয়, এটা জানিয়ে দিলেই বিদেয় হই।
বাসু বললেন, ভিতরে আসুন। বসুন।
খর্বকায় আগন্তুক ঢুকতে গিয়েই থমকে গেলেন। বললেন, ও আয়াম সরি। আপনি একা নন দেখছি। এসব আলোচনা তো জনান্তিকে ছাড়া হয় না মিস্টার ….
—নাম-টামও উহ্য থাক না। যে কথা বলতে এসেছেন তা যদি জনান্তিকে বলতে চান তাহলে ওকে আপাতত বিদায় করে দিই?
— এ ছাড়া তো উপায় দেখছি না। তুমি কিছু মনে কর না, মা। আমাদের কিছু বিজনেস- টক আছে। সেটা নিতান্ত …
সুজাতা বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে।
হঠাৎ বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বললে, আমি তাহলে চলি ডক্টর সরকার? বিকালে টেলিফোনে …
বাসু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সুজাতাকে ধমকে ওঠেন, ইউ গেট আউট।
সুজাতা থতমত খেয়ে যায়। মাথা নিচু করে ঘর ছেড়ে চলে যায়।
প্রৌঢ় লোকটি বললে, আপনি নাম-টাম উহ্য রাখতে চেয়েছিলেন, ডক্টর সরকার। সেটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। আপনি আমার নামটাও জানতে পারেন। আমার নাম : মিঃ ঘিসিং। তাহলে বিজ্ঞাপনটা আপনিই দিয়েছিলেন? কী, ডক্টর সরকার?
—না। আমি নই। আমার মক্কেল। আপনি যার প্রতীক্ষায় আছেন। বলুন, কী বলতে চান?
—মক্কেল! মক্কেল কেন? আপনি কি উকিল?
—দেখুন মিস্টার ঘিসিং, আমি চাইনি যে, আমরা পরস্পরের নাম-ঠিকানা জানি। ঘটনাচক্রে কিছুটা জানাজানি হয়ে গেছে। তাতে খুব কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। এখন বলুন, আপনি কী জন্য এসেছেন?
—সে কথা নিশ্চয় আপনার মক্কেল আপনাকে বলেছে, ডক্টর … ওয়েট এ মিনিট আপনার মুখখানা তো আমার অচেনা নয়। আমি আপনাকে আগেও কোথাও দেখেছি, অথবা আপনার ফটো …
—তা তো হতেই পারে। হয়তো খবরের কাগজে দেখেছেন।
—ড্যাম ইট। ঐ মেয়েটি ধোঁকাবাজি না করলে আমি আরও আগেই আপনাকে চিনে ফেলতাম। আপনি পি. কে. বাসু – ব্যারিস্টার।
—দ্যাটস্ কারেক্ট!
—গুড গড! আপনার সঙ্গে তো আমার কোনও কারবার নেই। আপনার মক্কেল যদি সামার সঙ্গে সরাসরি কারবার করতে না চায় তা হলে গুড বাই!
—অল রাইট! গুড বাই!
নাটকে যাকে ‘প্রস্থানোদ্যত’ ভঙ্গি বলে তেমন একটা ভঙ্গি করে দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এল লোকটা। বললে, আপনি জানেন নিশ্চয় দেনা পাওনাটা কিসের, কেন, এবং কী পরিমাণ? আপনার মক্কেল সেই ‘ছিপে-রুস্তম’-এর পালানোর সব পথ বন্ধ। আমাকে খুশি করে দিলেই তার গোপন কথা চিরকাল গোপন থাকবে।
—আপনাকে নিশ্চয় মাসে-মাসে চিরটাকাল আমার মক্কেলকে এ ভাবে খুশি করে যেতে হবে?
—না, নিশ্চয় নয়। সেকথা আমি চুপে-রুস্তমকে আগেই জানিয়েছি। এই ছ্যাঁচড়া কারবার আমার ভাল লাগে না। এতে বিপদও আছে। তাই এবারের এই লেনদেনটাই আমাদের শেষ কারবার। এরপর আমি আর একটা বিজনেস খুলে বসব যে বিজনেসটা আটকে আছে নগদ টাকার অভাবে। আপনার মক্কেল এসব কথা আপনাকে বলেনি?
— বলেছে। সে রাজিও হয়েছে টাকাটা মেটাতে। ইন ফ্যাক্ট, টাকাটা সে আমাকে হস্তান্তরিত করার পরে ঐ বিজ্ঞাপনটা ছাপতে দিয়েছে।
—তাহলে মাঝে থেকে আপনি বাগড়া দিচ্ছেন কেন?
—আমি শুনে যাচ্ছি। বলে যান!
—দেখুন মিস্টার বাসু। এটা আপনি যা ভাবছেন তা নয় …
—আমি আবার কী ভাবছি?
—স্পষ্ট করেই বলি : এটা ব্ল্যাকমেলিং আদৌ নয়। খেসারত! জাস্ট কম্পেনসেশন! আপনার মক্কেল তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে মাত্র।
—তাহলে অবশ্য আমার আপত্তি নেই টাকাটা দিতে
—পুরো পঞ্চাশ? কমিশন না রেখে?
—কিসের কমিশন? মক্কেল যখন ব্ল্যাকমেলিং-এর টাকা দিচ্ছে না, প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে খেসারত দিচ্ছে। তার কাছে ফি যা নেবার তা আমি পৃথকভাবে নেব।
—তাহলে এখনই দিয়ে দিন নগদানগদি!
এখনই কেমন করে দিই। টাকাটা ব্যাঙ্কে জমা দিই। আপনার নামে অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক বানিয়ে আনি। খেসারতের ড্রাফটটা বানাই। আপনার তরফের উকিল …
—কী বকছেন মশাই পাগলের মতো! আপনার মক্কেল আপনাকে কতটা বলেছে বলুন তো? অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকে আমি এই খেসারতটা নিতে পারি?
—তাহলে আপনি যে আবার নতুন দাবি নিয়ে আমার মক্কেলকে বিরক্ত করবেন না, তার গ্যারান্টি কোথায়?
—কোন ভদ্রলোক তা করে না।
—কারেক্ট। কিন্তু ভদ্রলোকেরা খেসারতের টাকা অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকে গ্রহণ করে থাকেন!
—আপনি আমাকে ল্যাজে খেলাবার চেষ্টা করলে ঐ পঞ্চাশ হাজার কিন্তু এক লাফে এক লাখে উঠে যাবে।
বাসু একগাল হেসে বললেন, জানি, লেজ নিয়ে যারা খেলে তারা অমন ড্রিং ত্ৰিং লাফ মারার চেষ্টা করে। মুখ থুবড়ে পড়েও!
লোকটা গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ঠিক আছে! আপনার সঙ্গে আমার কোনও কারবার নেই। আপনার মক্কেলকে জানাবেন, বাহাত্তর ঘণ্টার ভিতর আমার দাবি পূরণ না হলে আমি যা চেয়েছি তার দ্বিগুণ খেসারত দাবি করব।
কিন্তু আমার মক্কেল যদি আমার পরামর্শ না শুনে সরাসরি আপনাকে খেসারতটা
মেটাতে চায় তাহলে কোথায় আপনার পাত্তা পাবে?
আপনি বেশি চালাকি করবেন না, মিস্টার বাসু। আপনার ফোন নম্বর টেলিফোন গাইডে আছে। আমিই ফোন করে আপনাকে জানাব কোথায় খেসারতটা পৌঁছে দিতে হবে।
—কখন?
—যখন আমার মন চাইবে …
—তার চেয়ে সরাসরি আমার মক্কেলকে ফোন করলেই ভাল হয় না কি? ওর ফোন নম্বরটা দেব?
—একবার বলেছি, আবার বলছি, বেশি চালাকি করবেন না।
লোকটা গটগট করে এবার সত্যিই বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
বাসু টেলিফোনটা তুলে নিয়ে 321 নম্বর ঘরে রিং করলেন। ওপ্রান্তে চৈতালী ধরতেই প্রশ্ন করলেন : আমি বাসু মামু বলছি। শোন চৈতালী, ব্ল্যাকমেলার এসেছিল। তার দৈহিক বর্ণনা আর পোশাকের বিবরণ দিচ্ছি। দেখতো, লোকটাকে চিনতে পার?
চৈতালী ধরতে পারল না।
বাসু বললেন, একটু পরেই আমি তোমার ঘরে আসছি। তুমি তৈরি হয়ে নাও। ব্যাঙ্কে যেতে হবে। টাকাটা জমা দিতে!
ঠিক তখনই আবার কে ডোর বেল বাজালো।
বাসু টেলিফোন নামিয়ে এগিয়ে এসে খুলে দেখেন সুজাতা ফিরে এসেছে। বললেন, তোমার অভিনয়টা ভালই হয়েছিল, কিন্তু কাজে লাগেনি। ডক্টর সরকার সেজে আত্মগোপনের সুযোগ পাওয়া গেল না। লোকটা আমাকে চিনতে পেরে গেল।
—আর আপনি ওকে …?
—কী করে চিনব? ওর উপাধি নিশ্চয়ই ঘিসিং নয়।
—না, নয়। কিন্তু ওর আসল নাম-ঠিকানা আপনি একটু পরেই জানতে পারবেন।
—কী ভাবে?
—আমি নিচে নেমে যেতেই আপনার ভাগ্নের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমার কাছে সব কথা শুনে সে গাড়িতে গিয়ে বসল। আমাকে বলল, পাশের সিটে বসতে। ঐ লোকটা হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেই ওকে চিহ্নিত করে আমি যেন গাড়ি থেকে নেমে যাই। আপনাকে এসে
খবর দিই যে, ও লোকটাকে ফলো করতে গেছে।
বাসু খুশি হয়ে বললেন, গুড ওয়ার্ক! তারপর?
—লোকটার সঙ্গে আপনার কী কথাবার্তা হয়েছে জানি না, কিন্তু মনে হল সে খেপে আগুন হয়ে আছে। ডাইনে বাঁয়ে তাকালো না, বুনো মোষের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে ওর মারুতি সুজুকি গাড়িতে গিয়ে বসল। নম্বরটা টুকে এনেছি।
—ভেরি গুড। আমি বরং ওঘরে গিয়ে দেখি চৈতালী কী করছে। এতক্ষণে ওর স্যুটকেস গোছানো হয়ে গেছে নিশ্চয়। ব্যাঙ্ক আওয়ার্সের মধ্যে টাকাটা জমা না দেওয়া পর্যন্ত আমার প্রাণটা ঠাণ্ডা হচ্ছে না। আমি ওকে নিয়ে ব্যাঙ্কে যাচ্ছি। তুমি ইতিমধ্যে এ. এ. ই. আই-তে একটা ফোন কর। কল্যাণকে। কল্যাণ ভদ্র। আমাকে খুব শ্রদ্ধা করে। আমার নাম করে জিজ্ঞেস কর ঐ নম্বরের গাড়ির মালিক কি এ. এ. ই. আই.-এর মেম্বার? আমি জানতে চেয়েছি। তাহলে নাম- ধাম-ফটো সব পাওয়া যাবে।