যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা – ৫

প্রায় একঘণ্টা পরে বাসুসাহেব ফিরে এলেন। ইতিমধ্যে তিনি সামনের বাজার থেকে একটি বড় স্যুটকেস কিনে হোটেল পান্নায় একটা ঘর ভাড়া নিয়েছেন। নিজের নামে। একতলা বা দোতলায় নাকি রাস্তার শব্দে ওঁর অসুবিধা হয় আবার পাঁচ- ছয় তলা উঠতে চান না বৃদ্ধ ওঁর ভার্টিগো আছে। জানলা দিয়ে বা বারান্দা দিয়ে নিচের রাস্তায় তাকালে মাথা ঘুরে উঠতে পারে। রিসেপশনিস্ট অনেক বুদ্ধি-বিবেচনা করে তিন তলার একুশ নম্বর ঘরতা এঁকে দিয়েছে : 3211

বাসুসাহেব স্যুটকেস নিয়ে সেখানে এসে উঠলেন। তোয়ালে, সাবান, চাবি সব নিয়ে ঘর তালাবন্ধ করে এসে নক্ করলেন চৈতালীর ঘরে।

চৈতালী কোড-নক্ শুনে দরজা খুলে দিল।

— ইতিমধ্যে কোন ফোন বা দর্শনার্থী আসেনি?

—আজ্ঞে না। কিন্তু স্যার, আমি এতক্ষণ একটা কথা ভাবছিলাম। আমি আপনাকে মাত্র একশ টাকা রিটেইনার দিয়ে এসেছি …

—দ্যাটস্ অল রাইট। ঝামেলাটা আগে মিটুক তারপর সে সব কথা হবে। কী জান চৈতালী, তোমার বয়সী আমার একটি মেয়ে ছিল। সে যদি আজ

ঠিক সেই সময়েই কে-যেন নক্ করল দরজায়। বাসু বললেন, দাঁড়াও। আমি দেখছি।

—চৈতালী চলে গেল বাথরুমের দিকে। বাসু এসে দরজাটা খুলে দিলেন। ঘরে ঢুকল সুজাতা।

এস সুজাতা, বস। তুমিও এগিয়ে এস চৈতালী, আমি আলাপ করিয়ে দিই। এ হচ্ছে শিলিগুড়ির চৈতালী বসু। এ হোটেলের চিত্রলেখা ব্যানার্জি। যার চরিত্রে দিন কয়েক তোমাকে অভিনয় করতে হবে। চৈতালী বসুর কাছ থেকে একজন ব্ল্যাকমেলার হয়তো টাকা আদায় করতে চাইবে। তোমার কাজ হচ্ছে যতদূর সম্ভব নাম-ধাম-পরিচয় সংগ্রহ করা। বলবে, টাকাটা এখন তোমার কাছে নেই; কিন্তু দেবার ইচ্ছে না থাকলে ব্ল্যাকমেলারের নির্দেশমতো কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে এ হোটেলে তুমি অপেক্ষা করবে কেন—ইত্যাদি।

সুজাতা জানতে চায়, চৈতালী বা আমি তো ব্ল্যাকমেলারকে চিনি না। সে কি চৈতালীদেবীকে চেনে?

—না, সে হয়তো আশা করছে একজন পুরুষমানুষ ব্ল্যাকমেলের টাকা মেটাতে আসবে। তোমায় হয়তো জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে? তুমি নিজের পরিচয় দেবে চিত্রলেখা ব্যানার্জি নামে। তুমি শিলিগুড়ি থেকে আসছ একজনের নির্দেশে। এনি কোশ্চেন?

—আজ্ঞে না।

চৈতালী জানতে চায়, আমি কী করব?

—তুমি আমার এই 321 নম্বর ঘরের চাবিটা নিয়ে ও ঘরে চলে যাও। তোমার কালো অ্যাটাচি সমেত। আমি সুজাতাকে কিছু ইনস্ট্রাকশন দিয়ে তোমার বড় স্যুটকেসটা নিয়ে ওঘরে আসছি। আধঘণ্টার মধ্যেই। তারপর তোমার কাজ হবে ঐ অ্যাটাচিটা নিয়ে নিচে রিপন স্ট্রিটের ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াতে গিয়ে নিজের নামে একটা ব্যাঙ্ক-ড্রাফ্‌ট বানানো-–পে-এবল্ অ্যাকাউন্ট পেয়ি টু চৈতালী বসু। ব্যাঙ্ক-ড্রাফ্‌টা হবে শিলিগুড়ির এস. বি. আই-এর ওপর। চল। আমিও তোমার সঙ্গে ব্যাঙ্কে যাব। যাতে ব্যাঙ্কের দোরগোড়ায় ওটা ছিনতাই না হয়ে যায়।

চৈতালী বলে, কেন? ব্যাঙ্ক ড্রাফ্‌ট করতে বলছেন কেন?

বাসু ধমকে ওঠেন, বুঝলে না? জৈন কোম্পানি যদি পুলিশে খবর দেয় যে, ওদের ক্যাশিয়ার পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে নিখোঁজ হয়েছে তখন তোমার বিরুদ্ধে একটা পাকা চার্জ খাড়া হবে, যেহেতু এখানে তুমি ছদ্মনামে এসে উঠেছ এক স্যুটকেস টাকা নিয়ে। কিন্তু ব্যাঙ্ক ড্রাফটটা করা থাকলে তোমার ডিফেন্সটা হয়ে যাবে অন্য জাতের। তুমি বলতে পারবে, হরিমোহনকে তুমি এ টাকা ক্যাশ থেকে বার করে দিয়েছিলে কলকাতায় এসে কিছু কেনার জন্য। যেহেতু হরি আহত হয়ে হাসপাতালে তাই তুমি নিজেই চলে এসেছিলে কোম্পানির স্বার্থে। ঘটনাচক্রে লেনদেনটা হল না। তাই টাকাটা তুমি নিজের নামে ব্যাঙ্ক-ড্রাফট্ করে শিলিগুড়িতে ফিরে যাচ্ছ। ইন ফ্যাক্ট আজ সন্ধ্যা পাঁচটা সতেরর ফ্লাইটে তুমি আর আমি বাগডোগরা যাব। টিকিট আমিই কাটব। কাউন্টারে অপেক্ষা করব। রিপোর্টিং টাইমের মার্জিনের মধ্যে তুমি চলে আসবে। ও. কে.?

—আমি চেক-আউট করব নিজের নামেই ….

—গুড গড! তুমি চেক আউট আদৌ করবে না। তোমার স্যুটকেসের মালপত্র সব আমার খালি স্যুটকেসে ভর্তি করে তুমি খালি হাতে বেরিয়ে যাবে। তোমার ভাড়া নেওয়া ঘরে 315-এর বোর্ডার চিত্রলেখা ব্যানার্জি তো ঘরের মধ্যেই থাকল। সে মহড়া সুজাতা নেবে। বুঝলে? ও হ্যাঁ, তোমার আর একটা কাজ বাকি আছে। তুমি প্রথম যে দিন আমার কাছে এসেছিলে, সেদিন যে শাড়িখানা পরে এসেছিলে নীল শাড়ি, নীল চুড়ি, নীল লকেট সে সব সুজাতাকে বার করে দাও। কোন মামলা মোকদ্দমা হলে প্রত্যক্ষদর্শীদের গুলিয়ে দেওয়া দরকার। সুজাতা …

—বুঝেছি, মামু। পঞ্চতন্ত্রের গল্পটা আমার মনে আছে : ‘ধূর্ত শৃগাল নীলীবৰ্ণ সঞ্জাত।’

—আর দেরি কর না চৈতালী, এবার রওনা দাও তুমি।

চৈতালী নির্দেশ-মতো তার কোবাল্ট-ব্লু-রঙের শাড়ি, মালা, চুড়ি, টিপ ইত্যাদি বার করে সুজাতাকে দিল। বাথরুম থেকে টুথব্রাশ, টুকিটাকি গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল।

বাসু সুজাতাকে বললেন, এইগুলো পরে তুমি দু-একবার কাউন্টারে গিয়ে কথাবার্তা বলবে। জানতে চাইবে, মাসিক ভাড়া নিলে ওরা রেট কমাতে রাজি আছে কি না, কারণ তোমাকে চাকরির প্রয়োজনের তিন-চার সপ্তাহ কলকাতাতেই থাকতে হবে। এ হোটেলটা তোমার পছন্দ হয়েছে। কাউন্টার গার্ল হয়তো বলবে, ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করে জানাব। এই সূত্রে অনেকে তোমাকে চিত্রলেখা ব্যানার্জি হিসাবে মনে রাখবে তোমার চেহারা, নীল সজ্জা আর ঐ সব প্রশ্ন তালগোল পাকিয়ে যাবে কাঠগড়ায় উঠে।

চৈতালী বাসুসাহেবের হাত থেকে 321 নম্বর ঘরের চাবিটা নিয়ে বললে, এবার একটা কথা বলব, মামু?

— মামু? ও সুজাতার দেখাদেখি? বল?

—এখন তো আর আমি অজ্ঞাতকুলশীলা নই। একটা প্রণাম করি?

—কর! মামু বলে ডেকে বসেছ যখন!

চৈতালী প্রণাম করে বিদায় নিল। বাসু দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।