যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা – ৪

চৈতালীর বাবা মহেন্দ্র বোস ছিলেন গয়াবাড়ি টী-এস্টেটের কাছাকাছি একটি চা-বাগানের ম্যানেজার। শহর থেকে দূরে’ একাই থাকতেন তিনি, খিদমৎগার পরিবৃত হয়ে। ওরা দুই যমজ ভাই-বোন থাকত শিলিগুড়িতে। এক বিধবা মাসির জিম্মায় দুজনে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়াশুনা করত। মাতৃহীন ওরা শৈশবেই যমজ সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে ওদের মা মারা যান। জন্ম থেকেই ওরা মাসির কাছে মানুষ। মাত্র বছর পাঁচেক আগে পাঙ্খাবাড়ি রোডে একটা জিপ দুর্ঘটনায় প্রয়াত হলেন মহেন্দ্রবাবু। ওরা দুজনে তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। মহেন্দ্রবাবুর অবশ্য মোটা ইন্সিওরেন্স ছিল। ভাই-বোনের পড়াশুনা বন্ধ হল না। কিন্তু দুর্ভাগ্য যখন আসে তখন সার দেওয়া গোগাড়ির মতো আসতে থাকে। বছর না ঘুরতেই দেহ রাখলেন মাতৃপ্রতিম মাসিমা।

জৈন কোম্পানির বড় তরফ বিজয়রাজ ছিলেন মহেন্দ্রবাবুর বন্ধুস্থানীয়। ওরা দুই অনাথ ভাইবোন ওঁর এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট বিজনেসে চাকরি পেল। চৈতালী প্রথমে ছিল কেরানি। ক্রমে কিছু সোপান অতিক্রম করে ক্যাশিয়ার। প্রচণ্ড দায়িত্ব তার। দুই বিজনেস পার্টনার ব্যতিরেকে একমাত্র তারই বটুয়ার খাঁজে থাকত ক্যাশের চাবি, আর মগজের খাঁজে আয়রন সেফের কম্বিনেশন কোড নম্বর

হরিমোহনের কাজ ছিল বাইরে বাইরে। তাকে প্রায়ই ট্যুরে যেতে হত পাঁচ-দশ হাজার নগদ নিয়ে কিছু কিনতে বা বেচতে। নেপাল, ভুটান, মায় তিব্বত পর্যন্ত ঘুরে এসেছে সে, মাধবরাজের সঙ্গে। সেদিক থেকে হরিমোহন হয়ে ওঠে মাধবরাজের ডানহাত। অপর পক্ষে চৈতালী ক্রমে প্রিয়পাত্রী হয়ে ওঠে সিনিয়ার জৈনের।

বাসু বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, জৈন কোম্পানির দুই বড়কর্তার একটু পরিচয় দাও দেখি : বাবা-ছেলে?

— আজ্ঞে না। খুড়ো-ভাইপো। বিজয়রাজ বিপত্নীক ও নিঃসন্তান। প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। খুড়ো-ভাইপো একই বাড়িতে থাকেন। গৃহকর্ত্রী জুনিয়ার পার্টনার মাধবরাজের ধর্মপত্নী। তিনি নেপালি। বস্তুত নেপাল রাজপরিবারের সঙ্গে কী একটা রক্তের সম্পর্কও আছে। বাপের একমাত্র আদুরে মেয়ে। অগাধ সম্পত্তির নাকি একমাত্র ওয়ারিশ।

—প্রেম করে বিয়ে?

—না, না। সম্বন্ধ করে। মিসেস জৈনের বাবা আবার জৈন নন, বৌদ্ধ। তবু বিবাহ আটকায়নি। বোধকরি অর্থকৌলিন্যে।

—মাধবরাজের বয়স কত? সন্তানাদি কী?

—মাধবরাজ চল্লিশের কাছাকাছি। বিয়ে হয়েছে বছর সাতেক। কিন্তু সত্তানাদি আজও কিছু হয়নি।

—মাধবরাজের স্ত্রীর সঙ্গে তোমার আলাপ আছে?

—না, আলাপ নেই। তবে দূর থেকে দেখেছি। অফিসের কোন কোন অনুষ্ঠানে। বছর ত্রিশ- বত্রিশ বয়স। সুন্দরী নন, কিছুটা পৃথুলা। তবে গায়ের রঙ খুব ফর্সা। শুনেছি শুচিবায়ুগ্রস্তা। স্বভাবেও সন্দেহবাতিক এবং দজ্জাল-টাইপ

—সেক্ষেত্রে জানতে হয় : তোমাদের অফিসে কতজন মহিলা কর্মী আছে?

—আমাকে নিয়ে পাঁচজন। কিন্তু এ কথা কেন?

—কেন, তা জানতে চেও না। বাকি চারজনের নাম আর পরিচয় দাও দিকি। কত বয়স, বিবাহিত কি না, কী কাজ করতে হয়। সবাই বাঙালি?

আজ্ঞে না। আমি ছাড়া সবাই অবাঙালি আর বিবাহিতা। সুমিত্রা গর্গ আর ঝরনা তামাং দুজনেই বিবাহিতা, ত্রিশের কোঠায়, সন্তানাদি আছে। এছাড়া আছেন মিসেস্ অ্যাগনেস, প্রৌঢ়া। আর আছেন রঞ্জনাদি রঞ্জনা থাপা বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, কিন্তু দেখলে মনে হয় পঁচিশের কম। সুন্দরী সুতনুকা, বিধবা এবং নিঃসন্তানা। তিনি অবশ্য মাস কয়েক আগে ছুটি নিয়ে দেশে চলে গেছেন গল ব্লাডার অপারেশন করাতে। সুমিত্রা ক্লার্ক, আর ঝরনাদি সেলস্ গার্ল। আমাদের অফিস কাউন্টারে নানান কিউরিও সাজানো আছে। ঝণাদি তার কাউন্টার সেলে আছে। সুমিত্রাদিও তাই তবে তাকে মাধবরাজ অথবা বিজয়রাজজীর স্টেনোর কাজও করতে হয়।

—সুমিত্রার বয়স কত? দেখতে কেমন? কটি সন্তান?

—বছর সাতাশ। দেখতে সুশ্রী। ওঁর দুটি সন্তান।

—অফিস ছুটির পরেও তাকে মাঝে মাঝে অফিসে বসে কাজ করতে হয় নিশ্চয়? ডিকটেশন নিতে?

—তা তো হয়ই।

—সে সময় খুড়ো-ভাইপোর কেউ কিছু অন্যায় সুযোগ নেবার চেষ্টা করে না? যাকে বলে Pawing?

—তা আমি কেমন করে জানব?

—ন্যাকামি কর না চৈতালী। কী করে জানবে তা তুমি ভাল রকমই জানো। তোমার দিকে ওদের কেউ হাত বাড়ায়নি?

চৈতালী ইতস্ততভাব ঝেড়ে ফেলে বলে, অনেক পুরুষমানুষ অমন করে বলে শুনেছি। আমার অবশ্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই। খুড়ো বিজয়রাজজী একটু টিজ করেন, লেগ পুলিং জাতীয়। কিন্তু ভাইপো মাধবরাজ এ বিষয়ে খুব স্ট্রিক্ট। তাঁর কোনও বেচাল কোনদিন কেউ দেখেনি।

—আর প্রৌঢ় বিজয়রাজজী কী জাতীয় লেগ পুলিং করেন?

—উনি স্বভাবতই ফূর্তিবাজ। মেয়েদের নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা ওঁর স্বভাব। মেয়েদের সাজপোশাকের প্রশংসা করা ওঁর এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মনেও রাখেন অদ্ভুত— কে কবে কী রঙের শাড়ি পরে এসেছে। নতুন শাড়ি পরে এলে নিউ পিঞ্চ দিতে ভুল হয় না। এই বৃদ্ধ বয়সেও।

—বাহুমূলে?

—গালেও! এমন কি বৃদ্ধা অ্যাগনেসকেও।

—আর মাধবরাজ?

— মেয়েদের সম্বন্ধ তিনি খুব সতর্ক। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। সুমিত্রাদিকে যদি অফিস ছুটির পরে ডিকটেশন নেবার জন্য থেকে যেতে হয়, তাহলে আমাদের মধ্যে অন্য কোনও মহিলা কর্মীকে ছুতোনাতায় ওভার-টাইম নিতে বাধ্য করেন।

—কেন বল তো? ভয়টা কাকে?

—ঠিক বলতে পারব না। হয়তো নিজেকেই। অথবা ওঁর সন্দেহবাতিকগ্রস্তা দজ্জাল স্ত্রীকে। কিন্তু একটা কথা, স্যার, এসব কথা এত খুঁটিয়ে জানতে চাইছেন কেন?

বাসু ওর প্রশ্নের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বলেন, ঐ যে বিধবা মেয়েটি, রঞ্জনা থাপা, যে ছুটিতে আছে, ও কী কাজ করত? ওর দেশ কোথায়?

—নেপাল। কাঠমাণ্ডুর কাছাকাছি পোখরা নামে একটা গ্রামে। সেও বড়লোকের মেয়ে। রঞ্জনাদি ঠিক আমাদের স্টাফ ছিল না। সে ছিল কমিশন এজেন্ট। হীরালাল ঘিসিংজীর ডান হাত। হীরালালজী থাকেন কাঠমাণ্ডুতে।

—তোমাদের কোম্পানির কাজটা কী?

—নামেতেই তার পরিচয়। দেশ-বিদেশের আর্ট-গুডস্‌, কিউরিয়ো সংগ্রহ করা এবং দেশ- বিদেশে বিক্রি করা। এজন্য অফিসের বাইরে অনেক স্টাফ আছেন। বিজয়রাজজীর শালা আছেন নিউইয়র্কে। তাঁকে আমি কোনদিন চোখেই দেখিনি। লন্ডনে একজন আছেন, সিঙ্গাপুরে আছে রাঘবন পিল্লাই, নেপালে আছেন, আগেই বলেছি, হীরালাল ঘিসিং, টোকিওতে মিস্টার . নোনাগাকি। এঁরা কেউই এমপ্লয়ি নন: কমিশন এজেন্ট। কিউরিও ডিলার।

বাসু বলেন, তোমাদের ক্যাশে সচরাচর দিনান্তে কত ব্যালেন্স থাকে? জেনারালি?

—তার কোনও স্থিরতা নেই। দু-পাঁচ লাখও থাকে।

—বল কী! অত টাকা ক্যাশে নগদ থাকে?

—হ্যাঁ, কারণ প্রায়ই খুব দামী কিউরিও — ছবি, টেরাকোটা মূর্তি, সিল্ক-স্ক্রোল বা অন্যান্য আর্ট গুড্‌ড নগদে কিনতে হয়। চেকে লেনদেন হয় না।

—কেন? চোরাই মাল? স্মাগল্ড?

—তা আমি জানি না। যা দেখেছি তাই বলেছি। এসব দুর্লভ কিউরিও নগদ টাকায় কেনা- বেচা হয়। তাই ক্যাশে সব সময়ই দেড়-দুলাখ কারেন্সি নোটে থাকে। আমাকে মাসে দুবার ক্যাশ মিলিয়ে টাকা গুনতি করতে হয়। কারণ দুজন পার্টনারই স্লিপ রেখে নগদে বিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে যান। যখন-তখন। আমাকে না বলেও হয়তো।

—তুমি শেষ কবে ক্যাশ মিলিয়েছ?

—দিন দশেক আগে। ক্যাশ ঠিক ছিল।

—এই টাকা ভর্তি কালো অ্যাটাচি তুমি কোথায় পেলে?

চৈতালী বিস্তারিত জানায়। ঘটনার দিন, হঠাৎ যেদিন সন্ধ্যায় হরিমোহনকে গাড়িতে ধাক্কা মারে সেদিন, বেলা তিনটা নাগাদ হরিমোহন চৈতালীর সঙ্গে অফিসে দেখা করে। জানায়, হঠাৎ একটা জরুরি প্রয়োজনে দিন পাঁচেকের জন্য অফিসের কাজে তাকে শিলিগুড়ির বাইরে যেতে হবে। প্লেনে করে। সচরাচর সে কাঠমাণ্ডুতে যায় হীরালালজী অথবা রঞ্জনাদির কাছ থেকে নেপালি কিউরিও সংগ্রহ করতে। তাই চৈতালী জানতে চেয়েছিল, ‘নেপাল যাচ্ছিস’? হরিমোহন বলেছিল, ‘না, ফিরে এসে সব কথা তোকে বলব।’ আর কিছু হরিমোহন বলে যায়নি। অফিস ছুটির পর ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে সদর দরজা খুলতে যাবার সময় ও খবর পায়, হরিমোহন হাসপাতালে। রাত এগারোটা পর্যন্ত সে হাসপাতালে ছিল। এমার্জেন্সি-ওয়ার্ড থেকে ইনটেসি কেয়ার য়ুনিটে রোগীকে অপরাসণ করার পর ও বাড়ি ফিরে আসে। তালা খুলে ঘরে ঢোকে। ওরা পাশাপাশি ঘরে শোয়। চৈতালী হরিমোহনের ঘরটা তালাবদ্ধ করতে এসে দেখে মেঝেতে মালপত্র সাজানো আছে। হরির স্যুটকেস, বিগ্‌পার ব্যাগ আর জলের বোতল। ঐ সঙ্গে একটা অচেনা কালো অ্যাটাচি। এটাকে ও আগে কখনো দেখেনি। চৈতালী কৌতূহলী হয়ে পড়ে। ও জানত, হরিমোহন কখনো কখনো অনেক টাকা নগদে নিয়ে ট্যুরে যায়, অফিসের কাজেই। দামী কিউরিও কিনতে। তাই তার আত্মরক্ষার কথা ভেবে অফিস ওর জন্য একটা রিভলভারের লাইসেন্স করিয়ে দিয়েছে। হরিমোহন সচরাচর সেটা মাজায় বেঁধে ট্রেনে যাতায়াত করে। ফার্স্ট ক্লাসে। কিন্তু আহত রোগীর যে সব জিনিসপত্র হাসপাতালে জমা আছে তার মধ্যে ঐ রিভলভারটা ছিল না। তাই চৈতালী অ্যাটাচিটা খুলবার চেষ্টা করে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর অ্যাটাচির স্প্রিং-লকটা খুলে যায়। চৈতালী স্তম্ভিত হয়ে যায়। স্যুটকেসে শুধু টাকা আর টাকা! সব পঞ্চাশ টাকার। গুতি করে দেখে মোটমাট পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। এত টাকা ও পেল কোথা থেকে? দুই মালিকের কেউই আজ অফিসে আসেননি। না মাধবরাজ, না বিজয়রাজ। চৈতালী নিজেও ভল্ট খোলেনি। পেটি ক্যাশবাক্সতে যে দেড় দু হাজার টাকা আছে তা নাড়ানাড়ি করেই সেদিনের কাজ চলে গেছে। তাহলে?

দ্বিতীয়ত, হরিমোহনের রিভলভারটা কোথায় গেল?

তখনই ওর নজর হল, স্যুটকেসের ওপরের খাপে একটি টাইপ করা ইংরেজি চিঠি। তাতে যা লেখা আছে অনুবাদ করলে তা দাঁড়ায় : ‘ওহে ছিপে রুস্তম! আমার ধৈর্যের একটা সীমা আছে! এই শেষ সুযোগ দিচ্ছি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে প্রতিশ্রুত পঞ্চাশ হাজার নগদে না পৌঁছে দিলে সংবাদটা আর গোপন থাকবে না। দৈনিক সঞ্জয় উবাচ কাগজের পার্সোনাল কলমে জানিও, কখন, কোথায় খেসারতটা দিচ্ছ। ফাঁদ পাতার চেষ্টা করলে তুমি নিজেই ফাঁদে পড়বে কিন্তু।

ইতি 36-24-36।

বাসু বললেন, কই, দেখি সেই চিঠিটা?

চৈতালী চিঠিখানা ওঁর হাতে দিল।

কাগজটা খুলে দেখলেন। মোটা বড় পেপার, ইলেকট্রিক টাইপরাইটারে ছাপা। তারিখহীন। বাসু বললেন, এ কাগজখানা থাক আমার কাছে। হরিমোহনের রিভলভারটার সন্ধান আর তারপর পাওনি?

—আজ্ঞে না।

—তোমার কী ধারণা?—এত টাকা নিয়ে হরিমোহন কোথায় যাচ্ছিল? তোমার অজ্ঞাতসারে দুই পার্টনারের কেউ কি ক্যাশ থেকে টাকাটা বার করে হরিমোহনকে দিয়েছিলেন? কাউকে পেমেন্ট করে আসতে?

চৈতালী বলল, আমার তা বিশ্বাস হয় না। প্রথম কথা, তাহলে ওঁদের দুজনের মধ্যে কেউ না কেউ আমাকে বলতেন, ‘খুঁজে দেখ, তোমার পদার ঘরে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। তা কেউ বলেননি। অথচ অ্যাকসিডেন্টের পর দুজনের সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে। রিভলভারের কথাও কেউ আমার কাছে জানতে চাননি।

—হরিমোহনের কি কোনও বদ নেশা আছে? স্মাগলার দলের সঙ্গে জানাশোনা আছে?

—আমি তো কোনদিন তা সন্দেহ করিনি। নেশা বলতে ‘ড্রাগ অ্যাডিক্ট’ নিশ্চয় নয়। সিগারেট খায়, মদও খায় কখনো-সখনো। জুয়ার নেশা আছে। তিন-চার তাসাডু বন্ধুর সঙ্গে তে- তাশ খেলে। বোর্ড মানি পঞ্চাশ টাকা উঠতে দেওয়া হয় না। তাতে মাসে বিশ পঞ্চাশ টাকা হারে অথবা জেতে। তবে দার্জিলিঙে গিয়ে সিজনে দু-একবার রেস খেলেছে। কাঠমাণ্ডুতে একবার রোলে-বোর্ডে সাতশ টাকা হেরে এসেছিল। সব কিছুই ও আমাকে খুলে বলে। কিছু গোপন করে না।

—কোনও মেয়ের সঙ্গে কি ওর সম্প্রতি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল? প্ৰেম-ট্রেম?

চৈতালী একটু চুপ করে ভাবল। তারপর বলল, আমার তাই সন্দেহ হয়েছে, কিন্তু ও স্বীকার করেনি। ইদানীং ও মনমরা হয়ে পড়েছিল।

— মেয়েটি ‘কে’ আন্দাজ করতে পারনি? তোমাদের অফিসের কেউ কি?

—আমাদের অফিসে তো দুজন বিবাহিতা, একজন বৃদ্ধা, একজন বিধবা। — সবাই ওর চেয়ে বয়সে বড়। হয়তো অন্য কোনও মেয়ে, যাকে আমি চিনি না।

—আর কিছু বলবে? কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর দিতে ভুলেছ কি?

—না, সব কিছুই তো বলেছি।

—না, বলনি। ব্ল্যাকমেলারের নির্দেশ মতো তুমি ‘দৈনিক সঞ্জয় উবাচ’ পত্রিকার পার্সোনাল কলমে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলে! তাই নয়? সেও একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। ট্যাক্সিতে অপেক্ষা করবে!

—ও হ্যাঁ। সেকথা আপনাকে বলা হয়নি বটে।

—ব্ল্যাকমেলার লোকটা ট্যাক্সি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তোমার দোরগোড়ায়, তবু তুমি তার সঙ্গে দেখা করলে না কেন?

—আপনি কেমন করে ও, আয়াম সরি…ও সব প্রশ্ন তো আমার করার অধিকার ।নেই। কী জানেন, স্যার, গগল্স পরা, টুপিমাথায় লোকটাকে দেখে আমার সন্দেহ হল আসল লোক নয়। আসল লোক যদি হয় তাহলে হোটেল রিসেপশনে এসে আমাকে চাইছে না কেন?

—তোমার নাম সে জানে?

—না, জানে না। সম্ভবত হরিমোহনের নাম জানে। অন্তত পক্ষে সে কোড়-নাম্বারটা তো জানে—আপনি যে ভাবে এলেন।

—তার মানে তুমিও তাকে চেন না?

—নিশ্চয় না!

বাসু বললেন, তোমার বলা যখন শেষ হয়েছে তখন আমি বলতে শুরু করি এবার। মন দিয়ে শোন : তুমি বর্তমানে একটা প্রচণ্ড বিপদের মধ্যে রয়েছ। শিলিগুড়ির অফিসে অডিটার যদি বলে, ক্যাশে পঞ্চাশ হাজার টাকার ঘাটতি আর হরিমোহনের জ্ঞান যদি আদৌ না ফেরে, তাহলে তোমার অবস্থা বুঝে দেখ। তোমাকে অফিস থেকে ছুটি দিয়েছে হরিমোহনের দেখভাল করার জন্য; অথচ তুমি ছদ্মনামে কলকাতার একটা হোটেলে লুকিয়ে বসে আছ। আর তোমার হেপাজতে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্ল্যাকমানি! ঠিক যে পরিমাণ ঘাটতির কথা বলেছে অডিটার!

চৈতালী মাথা নিচু করে শুনছিল। বলল, আপনি আমাকে কী করতে বলেন?

বাসু টেলিফোনটা তুলে নিয়ে অপারেটারকে ওঁর বাড়ির নম্বর দিতে বললেন। ফোন ধরল কৌশিক। বাসু তাকে বললেন, সুজাতাকে ফোনটা দিতে।

সুজাতা ফোনের ও প্রান্তে এলে বাসু বলেন, তুমি হোটেল পান্নায় চলে এস। শুধু একটা ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে। তোমার কি কোবাল্ট-ব্লু রঙের ব্লাউজ আছে? … দ্যাটস্ অল রাইট। সেটা নিয়ে এস। দু-একদিন তোমাকে হোটেলে থাকতে হতে পারে। কিন্তু আপাতত কোনও ওভার নাইট ব্যাগ নিয়ে এস না। সোজা এসে 315 নম্বর ঘরে নক্ কর!

টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে এবার চৈতালীকে বললেন, আমি হোটেলের বাইরে যাচ্ছি। একটা স্যুটকেস কিনে নিয়ে এখনি ফিরে আসব। তিন তলাতেই একটা ঘর ভাড়া নেব। তুমি এখানে অপেক্ষা কর, যতক্ষণ না আমি ফিরে আসি। ইতিমধ্যে যদি টেলিফোন বাজে তুলবে না। যদি কেউ দরজায় নক করে, খুলবে না। অর্থাৎ তুমি ঘরে নেই। আমি এসে দরজায় এই ভাবে নক্ করব টক্ টক্ … একটু থেমে তিনবার টক্-টক্-টক্! তখন দরজা খুলবে। ও. কে.?

চৈতালী মাথা নেড়ে সায় দিল।

বাসু প্রশ্ন করেন, তুমি বুঝতে পারছ, আমি কী করতে চাইছি?

চৈতালী মাথা নেড়ে জানায় : না!

—তোমাকে ইভাপোরেট করে দিতে। কর্পূরের মতো উবে যাওয়া। জাস্ট ফলো মাই ইনস্ট্রাকশনস্