৩
শুক্রবার সকালে বাসুসাহেব একাই সরেজমিন তদন্তে এলেন। কিন্তু তার পূর্বে ধাপে ধাপে ‘সুকৌশলী’ তাঁকে নানান তথ্য সরবরাহ করেছে।
আগের দিন বেলা বারোটা নাগাদ একটা ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে এসেছিল সুজাতা। বাসু সাহেবের সম্মুখীন হতেই বলল, আপনার মক্কেলের নাম চিত্রলেখা ব্যানার্জি। রুম নম্বর 315; এর বেশি আমি আর কিছু জানি না। আপনার ভাগ্নে গেছে বাকি সংবাদের সন্ধানে।
বাসু বললেন, তুমি কেমন করে জানলে ওর নাম চিত্রলেখা বন্দ্যোপাধ্যায়?
রানী বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, ওসব কথা পরে। তুমি খেতে এস, সুজাতা।
সুজাতা বলে, আমি লাঞ্চ করে এসেছি, মামিমা।
কৌশিক এল বেশ রাত করে। আরও খবর সংগ্রহ করে। না, মেয়েটির নাম চিত্ৰলেখা নয়, পদবীও ব্যানার্জি নয়, বসু। হোটেলে এসে ছদ্মনাম লিখিয়েছে। ওর নাম চৈতালী বসু। বাসু জানতে চাইলেন, ও যে চিত্রলেখা বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, চৈতালী বসু, এটা জানলে কী করে?
কৌশিক তার অভিজ্ঞতা বিস্তারিত জানায়। হোটেল পান্না থেকে বের হয়ে সে একটা ফোন বুথ থেকে ওর শিলিগুড়ির ‘লিংক-ম্যান’কে ফোন করে। সুকৌশলী এখন পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলি শহরে এজাতীয় লিংক-ম্যান’ রেখেছে। তাতে দৌড়াদৌড়িটা কমে এবং খরচও কম হয়। কৌশিকের ফোন পেয়ে সুকৌশলীর শিলিগুরির এজেন্ট হাসপাতালে গিয়ে সব কিছু জেনে এসে ওকে বিস্তারিত জানিয়েছে। হাসপাতালে ডক্টর সামন্তের চিকিৎসাধীনে যে রোগীটি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে তার নাম হরিমোহন বসু। শিলিগুড়ির প্রখ্যাত ‘জৈন কিউরিও এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইম্পোর্ট কোম্পানি’-র একজন দক্ষ কর্মী। বছর বিশেক বয়স। দিন কয়েক আগে অফিসের কী একটা কাজে কী কাজ তা অফিসের কেউ বলতে পারল না কলকাতা যাবার জন্য তৈরি হয়। মালপত্র গুছিয়ে রেখে সন্ধ্যাবেলা সদর দরজায় তালা দিয়ে সে ট্যাক্সি ডাকতে বেরিয়েছিল। রাস্তায় এক মদ্যপ ড্রাইভার পিছন থেকে ওকে ধাক্কা মারে। পালাতে পারেনি। ধরা পড়ে। পাড়ার লোকেরাই হরিমোহনকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। হরিমোহন একটি দু-কামরার বাড়িতে থাকত, তার যমজ বোনকে নিয়ে। সে অবিবাহিত। বোনও তাই। বাবা-মা বা আর কোন ভাই বোন নেই। ওর বোনও একই কোম্পানিতে কাজ করে। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে সদরের তালা খুলবার আগেই প্রতিবেশীদের কাছে দুর্ঘটনার খবর পায়। ছোটে হাসপাতালে।
অফিসের খবর: ওর বোন চৈতালী ছুটিতে আছে। যমজ ভাইয়ের দেখাশোনা করার জন্য। অথচ হাসপাতালের খবর : চৈতালী ভিজিটিং আওয়ারে দেখা করতে আসছে না। কেন, তা কেউ জানে না।
সুকৌশলীর এজেন্ট হরিমোহনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পরিচয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছে চৈতালী বসু আজ তিনদিন রাত্রে তালা খুলে বাড়ি ঢোকেনি। সম্ভবত সে দ্বিতীয়বার হরিমোহনের অফিসে খোঁজ নিতে গিয়েছিল। ঢুকতে পারেনি। গুজব : ক্যাশ সেফ থেকে বিরাট একটা টাকার অঙ্ক কী করে বুঝি তছরুপ হয়েছে। কত টাকা তা তখনো জানা যায়নি। অ্যাকাউন্টেন্টবাবু মালিকের সঙ্গে বসে ক্যাশ মেলাচ্ছেন।
এই সমস্ত খবর সংগ্রহ করে পরদিন সকাল আটটা নাগাদ বাসুসাহেব হোটেল পান্নায় সরেজমিন তদন্তে এলেন।
হোটেলটার অবস্থান সম্পর্কে বাসুসাহেবের ধারণা ছিল না। তিনি ট্যাক্সি নিয়ে বেলা আটটা নাগাদ এসে উপস্থিত হলেন। রিসেপশন কাউন্টারে এসে দেখলেন এক প্রৌঢ়া অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা বসে আছেন। তাঁর কাছে জানতে চান, আপনাদের হোটেলে মিস্ চিত্রলেখা ব্যানার্জি নামে একজন বোর্ডার আছেন কি?
রিসেপশনিস্ট বললেন, জাস্ট এ মোমেন্ট, স্যার …
একটা রেজিস্টারে চোখ বুলিয়ে বললেন, ইয়েস। রুম 315 …
—উড য়ু কাইন্ডলি অ্যানাউন্স মি, প্লিজ?
মহিলাটি ইংরেজিতে জানতে চান, কী নাম বলব?
—নাম বললে উনি আমাকে চিনতে পারবেন না। ওঁর একটা ম্যাচিওর্ড ইন্সিওরেন্স পলিসির ক্লেম কেসের বিষয়ে কথা বলতে এসেছি। পলিসি নম্বরটা ওঁকে বললেই ওঁর মনে পড়বে: থ্রি-সিক্স-টু-ফোর-থ্রি-সিক্স।
প্রৌঢ়া একটু অবাক হলেন। যা হোক অনুরোধ মত টেলিফোন তুলে তিনশ পনেরো নম্বর ঘরে রিং করলেন। ওপ্রান্ত উৎকর্ণ হতেই বললেন, একজন ভদ্রলোক ইন্সিওরেন্স কোম্পানী থেকে এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে…কী? … আজ্ঞে হ্যাঁ, ইন্সিওরেন্স কোম্পানী থেকে। আপনার একটা ম্যাচিওর্ড পলিসির ব্যাপারে … কী বললেন? … ও আচ্ছা …ওঁকে তাই বলছি….
বাঁ-হাতে টেলিফোনটা ধরাই রইল, রিসেপশনিস্ট বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বললেন, সার, উনি দেখা করবেন না, ওঁর কোনও ইন্সিওর পলিসি ম্যাচিওর করেনি।
বাসু উচ্চ কণ্ঠস্বরে বললেন, কিন্তু পলিসি নাম্বারটা তো আপনি ওঁকে বললেন না : 36-24-36?
ভদ্রমহিলার হাতে ধরা রিসিভারটা কঁক কঁক্ করতে শুরু করেছে ততক্ষণে। ভদ্রমহিলা শুনে নিয়ে বাসুকে বললেন, ঠিক আছে। আপনি উপরে যান। রুম 315; আপনি যে পলিসি নাম্বারটা বলেছেন উনি তা শুনতে পেয়েছেন।
বাসু লিফটে করে তিনতলায় চলে এলেন। পনেরো নম্বর চিহ্নিত দ্বারে নক্ করতেই ভিতর থেকে সেটা খুলে গেল। বাসু ঘরে প্রবেশ করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন ভিতর থেকে।
দুরত্ত বিস্ময়ে মেয়েটি শুধু বললে : এ কী! আপনি?
—উপায় কী? মহম্মদ যদি রাজি না হন তখন পর্বতকেই মহম্মদের কাছে আসতে হয়!
—কিন্তু কী করে? মানে আপনি কীভাবে …
—কী আশ্চর্য! তুমি তো সেদিন বলেছিলে ‘কৌতূহলী কনের কাঁটা’ বইটা তোমার পড়া! সুতরাং তোমার বোঝা উচিত ছিল, তোমার সঠিক পরিচয় আমি পাবই। তা সে যাই হোক, তোমার নাম তাহলে চিত্রলেখা?
—সে তো আপনি জেনেই হোটেলে এসেছেন।
—পুরো নামটা কী? চিত্ৰলেখা কী?
—ব্যানার্জি।
—এটা তো ঠিক হল না, চৈতালী! অহেতুক মিথ্যা বলছ কেন?
—বিশ্বাস না হয় নিচে গিয়ে কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে দেখুন।
—কাউন্টারে ঘুরেই তো আসছি আমি। কিন্তু তুমিই আমাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাও ‘বাঁড়ুজ্জে’র যমজ ভাই কেমন করে ‘বসু’ হতে পারে? হরিমোহন বসুর অবিবাহিতা যমজ বোন : মিস্ ব্যানার্জি?
মেয়েটি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, আপনি কি এখন আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে চান?
—কী পাগলের মতো কথা বলছ, চৈতালী। মক্কেলকে বাঁচানোই আমার ধর্ম।
—তাহলে এভাবে আমার অতীত জীবনের অন্ধকারের ঘটনা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন কেন?
—যাতে তোমার ভবিষ্যৎ জীবন আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তুমি জান না, আমি জানি তুমি একটা প্রচণ্ড বিপদের মধ্যে পড়েছ।
—কী বিপদ?
—‘জৈন কিউরিও এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইম্পোর্ট কোম্পানি’ কি জানে তুমি কোথায়?
—আমি জানি না। হয়তো ওরা এটুকু জানে যে, আমি শিলিগুড়িতে নেই।
—ঐ অ্যাটাচি কেসটায় কী আছে তা তারা জানে নিশ্চয়?
চৈতালী ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে। বলে, অসংখ্য ধন্যবাদ! আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। এবার যান। য়ু আর ফায়াৰ্ড!
—তা হয় না চৈতালী। আমাকে ওভাবে বরখাস্ত করা যায় না। হয় তুমি আমার মক্কেল, নয় নও। মক্কেল হলে তখন তোমার সব কথা আমি গোপন রাখতে বাধ্য। যে মুহূর্তে তুমি আমাকে বরখাস্ত করবে সেই মুহূর্ত থেকে আমি একজন আদালতের অফিসার। তৎক্ষণাৎ আমার কর্তব্য হবে পুলিশকে ফোন করে জানানো যে, ঐ ব্যাগটা ব্ল্যাক মানিতে ভর্তি। কী? ভুল বলছি কিছু?
হ্যাঁ, বাসুসাহেব জ্ঞাতসারে ভুলই বলছেন। কুইন্স-বেঞ্চের সিদ্ধান্ত ( Bullock vs Crone তাঁর স্মরণে আছে। কিন্তু ওঁর আশা পূর্ণ হল। চৈতালী বুঝতে পারল না এটা ডাহা case) মিথ্যা কথা। ডাইভোর্স হয়ে গেলেও প্রাক-বিচ্ছেদ বিবাহিত জীবনের গোপন কথা যেমন জীবনসাথীর বিনা অনুমতিতে পুলিশকে জানানো যায় না, ঠিক তেমনি বরখাস্ত হবার পর বাসুও পারেন না ঐ গোপন কথাটা পুলিশকে জানাতে।
কিন্তু চৈতালী সেকথা জানে না। সে মাথা নিচু করে নীরবই রইল।
বাসু পুনরায় বলেন, তুমিই তহবিলটা তছরুপ করেছ?
—না! নিশ্চয় নয়! এসব কী বলছেন আপনি?
—তাহলে তোমার যমজ ভাই হরিমোহন করেছে?
—না! হরি চেষ্টা করলেও ক্যাশ সরাতে পারবে না, পারত না। ক্যাশের তিন সেট চাবি আছে। এছাড়া আছে একটা কোড নাম্বার। এক সেট চাবি থাকে আমার কাছে। আমিই হেড ক্যাশিয়ার। বাকি দু সেট চাবি থাকে কোম্পানির দুই পার্টনারের কাছে। আমরা তিনজন ছাড়া কেউ ক্যাশে হাত দিতে পারে না। ঐ কোড নাম্বারটাও জানি শুধু আমরা তিনজন।
—ঐ ব্যাগটায় কত টাকা আছে?
—পঞ্চাশ হাজার।
—তুমি যদি ক্যাশ থেকে না সরিয়ে থাক, তাহলে ও টাকা তোমার হেপাজতে এল কী করে?
চৈতালী নতনেত্রে ভাবতে থাকে। বাসু বলেন, শোন চৈতালী, সব কথা খুলে বললে আমার কাজের সুবিধা হয়। তুমি যদি আমাকে বল ‘আমি টাকাটা ক্যাশ থেকে সরাইনি’—ব্যস! আমি তা বিশ্বাস করব। তুমি যদি বল যে, হরিমোহনকে তুমি চাবিটা হস্তান্তরিত করে সেফ-ভল্টের নাম্বারটা বলে দাওনি, তাহলে আমি তাও বিশ্বাস করব। তারপর আমি এ রহস্যের কিনারায় সর্বশক্তি নিয়োগ করব। সেটাই আমার ধর্ম। ‘ধর্ম’ মানে এখানে ‘রিলিজন’ নয়। ধর্ম মানে, ‘জাসটিফিকেশন অব ওয়ান্স এক্সিস্ট্যান্স।’ কিন্তু তুমি যদি সব কথা খুলে না বল, তাহলে আমার অর্ধেক শক্তি ব্যয়িত হবে সেই তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে। শত্রুপক্ষ হ্যান্ডিক্যাপ পাবে। এমনিতেই দেখ, দু’দুটো দিন আমি নষ্ট করেছি তোমার নাম-পরিচয় সংগ্রহ করতে।
চৈতালী এখনো মনস্থির করে উঠতে পারছে না।
বাসু পুনরায় বলেন, তুমি কি জান যে, তোমার কোম্পানির ক্যাশে একটা বিরাট ঘাটতি ধরা পড়েছে? মালিকেরা অডিট করাচ্ছেন? ক্যাশ মেলাচ্ছেন?
চৈতালী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলে ওঠে, না, না, তা কী করে হবে?
—সহজেই। হয়তো ঘাটতিটা ঠিক পঞ্চাশ হাজার টাকার। তোমার ঐ অ্যাটাচিতে যত টাকা আছে তার ঠিক সমান।
মেয়েটি মনস্থির করে। বলে, ঠিক আছে! সব কথা খুলে বলব। তারপর আপনি যা ভাল -বোঝেন
—সংক্ষেপে। মোদ্দা তথ্যগুলো। কারণ হয়তো আমাদের হাতে সময় খুব কম। হয়তো পুলিশে ইতিমধ্যেই তোমাকে খুঁজছে। নাও শুরু কর।