যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা – ১৬

১৬

সোমবার সকালে কৌশিক আর সুজাতা বাসুসাহেবের গাড়িটা নিয়ে দমদম এয়ারপোর্টে এসে হাজিরা দিল। ওরা দুজনে নিউ আলিপুরের বাড়িতে ফিরে এল বেলা নয়টা নাগাদ। কথা ছিল জৈন খুড়ো ভাইপোকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে সুমিত্রাকে নিয়ে ওরা বাড়িতে ফিরে আসবে। তাই এল ওরা। ওঁরা তিনজনেই এসেছেন। বিজয়রাজ জানিয়েছেন যে, নির্দিষ্ট সময়ে তিনি ভাইপোকে নিয়ে দায়রা জজের আদালতে উপস্থিত থাকবেন।

সুমিত্রা গাড়ি থেকে নেমে এসে বাসুসাহেব এবং রানীকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। বাসুসাহেবকে বলল, আমাদের কখন আদালতে যেতে হবে?

—আধঘণ্টার মধ্যেই। তুমি ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিলেই …..

—আমি তো প্লেনেই সে পর্ব সেরেছি। আর কিছু খাব না এখন। কিন্তু আপনি তো আমাকে তালিম দেবার সময় পাবেন না…

বাসু বললেন, তালিম আবার কী? তোমাকে আমি সাক্ষীর মঞ্চে তুলব। তারপর একের পর এক প্রশ্ন করে যাব। তুমি তোমার জ্ঞানমতো তার জবাব দিয়ে যাবে—ট্রুথ, হোল ট্রুথ অ্যান্ড নাথিং বাট দ্য ট্রুথ। তারপর হয়তো পুলিশের পক্ষ থেকে তোমাকে ক্রস-একজামিন করবে। সেখানেও সত্য কথা বলে যাবে। কোনও কিছু গোপন করার চেষ্টা কর না।

—আপনাকে দু-একটা কথা গোপনে বলতে চাই।

—বেশ তো। চল আমরা লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে বসি।

দুজনে লাইব্রেরি ঘরে এসে বসলেন।

বাসু বলেন, এবার বল।

—আপনি কি আমার দিদির সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন করবেন? আই মিন, হরিমোহন আর রঞ্জনাদি তাঁর চেম্বারে এসেছিল—দিদি যে ওদের স্বামী-স্ত্রী ভেবেছিল …. মাঝপথেই সুমিত্রা থেমে যায়।

বাসু বললেন, এখনই কিছু বলতে পারছি না। বাস্তবে ঠিক কী ঘটেছে তার সঠিক ধারণা এখনো করে উঠতে পারিনি। তার একটা ক্ষীণ সন্দেহ জেগেছে মনে। আমার মনে হয় আদালতে বিভিন্ন লোকের সাক্ষী চলতে থাকা কালে …

সুমিত্রা বাধা দিয়ে বললে, আমার বদলে যদি আপনি রঞ্জনাদিকে সাক্ষী হিসাবে পেতেন তাহলে খুব সুবিধা হত। তাই নয়? আমি যতটা জানি, রঞ্জনাদি আমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি খবর রাখে। নেপাল থেকে অনেক দামী জিনিস সে হীরালালজীর মাধ্যমে স্মাগল করেছে। ওরা দুজনেই বিজয়রাজজীর খুব প্রিয়পাত্র।

—আর মাধবরাজজী? তার সঙ্গে রঞ্জনার সম্পর্কটা কেমন ছিল?

—ভাল নয়। তার একমাত্র কারণ রঞ্জনা ছিল বড়কর্তার পেয়ারের। তাছাড়া মাধবরাজজী তাঁর স্ত্রীকে দারুণ ভয় পান। কোনও মহিলা কর্মী বা এজেন্টের সঙ্গে একটু মেলামেশা করলেই সন্দেহবাতিক মিসেস ওর হেনস্থা শুরু করেন।

বাসু বলেন, সে যাই হোক, তুমি আমাকে এ ঘরে ডেকে নিয়ে এলে কেন? গোপন কথাটা কী?

—রঞ্জনা থাপা এখন কোথায় আছে আপনি জানেন?

—নিশ্চয় না। তা জানলে তো তাকে সমন ধরাতাম।

—শুনুন স্যার! তার প্রয়োজন হবে না। রঞ্জনাদি এখন কলকাতায় আছে। শুধু তাই নয়, আজ আদালতে সে উপস্থিত থাকবে।

রীতিমতো অবাক হয়ে যান বাসুসাহেব। বলেন তুমি কেমন করে জানলে?

—আমার সঙ্গে তার আজ সকালে দেখা হয়েছে। ঐ দমদম এয়ারপোর্টেই। ও আজই কাঠমাণ্ডু-কলকাতা ফ্লাইটে কলকাতায় এসেছে। লেডিজ টয়লেটে ঘটনাচক্রে দেখা হয়ে গেল। হীরালালজী যে খুন হয়ে গেছে এ খবরটা ও পোখরা গ্রামে বসে সে সময় জানতে পারেনি। মাত্র গত পরশু জানতে পারে। ও হীরালালজীর রাখী-বহিন।

—তা রঞ্জনা কলকাতা এসেছে কেন?

—ভাইয়ের শ্রাদ্ধশান্তি করে যাবে। ও আমাকে বলেছে, ওর দৃঢ় বিশ্বাস চৈতালী ওর দাদাকে খুন করেনি। কে করেছে ও জানে না, আন্দাজ করতে পারে মাত্র। ও আমাকে আরও বলেছে আজ সকালে সে আদালতে উপস্থিত থাকবে প্রথম থেকেই। আপনি যদি প্রয়োজন বোধ করেন এবং নকিবকে দিয়ে ওর নাম ঘোষণা করেন তাহলে সে সাক্ষী দিতেও উঠবে। ওর ভাইকে যে খুন করেছে তাকে যদি আপনি খুঁজে বার করতে পারেন তাহলে ও আপনাকে সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত।

বাসু অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। বলেন, এ তো দারুণ খবর! তা সে তোমার সঙ্গে এখানে চলে এল না কেন?

—কারণ ও চায় না বিজয়রাজ বা মাধবরাজ জানতে পেরে যান যে, ও সাক্ষী দিতে ইচ্ছুক!

—আই সি! কিন্তু সেটাই বা কেন?

—আমি জানি না। কারণটা সে আমাকে জানায়নি।

এই সময়ে লাইব্রেরির বদ্ধদ্বারে কে টোকা দিল।

বাসু দরজা খুলে মুখ বাড়াতেই কৌশিক বললে, আর দেরি করা চলবে না, মামু। ট্রাফিক- জ্যাম হলে আদালতে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে

—অল রাইট। লেটস প্রসিড!

কৌশিক, সুজাতা আর সুমিত্রাকে নিয়ে যখন বাসুসাহেব দায়রা জজের আদালতে এসে পৌঁছালেন তখনও আদালত বসতে মিনিট দশেক বাকি। প্রবেশদ্বারের বাইরেই ওঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ইন্সপেক্টর রবি বসুর। দু’হাত তুলে নমস্কার করল সে। বাসু বললেন, থ্যাঙ্কস!

রবি বুঝল। বলল, এ আর এমন কী? আপনি আমার যে উপকার করেছেন আরও যদি কোনো প্রয়োজন হয়—

হ্যাঁ, আজই কিছু নাটকীয় ঘটনা আদালতে ঘটতে পারে। চারিদিকে নজর রেখ। মানে…

—বুঝেছি স্যার, কেউ পালাবার উপক্রম করলেই আদালত চৌহদ্দির বাইরে …

কথাটা তার শেষ হল না। বাসুসাহেব বললেন, জাস্টিস গাঙ্গুলি এসে গেলেন মনে হচ্ছে।

ঠিক তাই। একটা ঝকঝকে অ্যাম্বাসাডার এল দাঁড়ালো আদালতের দোরগোড়ায়। কোর্টের এক উর্দিধারী পেয়াদা মস্ত সেলাম করে গাড়ির পিছনের পাল্লাটা খুলে ধরল। জজসাহেব নামলেন। ডানে-বাঁয়ে তাকালেন না। নিজের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেলেন। আদালি পিছন পিছন গেল থার্মো টিফিন ক্যারিয়ারের ঝোলা আর জলের বোতলটা নিয়ে।

বাসুসাহেবের সঙ্গে দোরগোড়াতেই দেখা হয়ে গেল বিজয় রাজের। দুজনে করমর্দন করলেন। বিজয়রাজ অনুচ্চকণ্ঠে বললেন, আমি আমার কথা রেখেছি স্যার। আশা করি …

বাসু হেসে বললেন, উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। বসুন গিয়ে দর্শকের আসনে। আমিও আমার কথা রাখব। গিভ অ্যান্ড টেক!

দর্শকদলের সামনের সারিতেই বসেছিল মাধবরাজ। লক্ষ্য করছিল সবই; কিন্তু না-দেখার একটা ভান করে বসেই রইল। ইতিমধ্যে কৌশিক, সুজাতা আর সুমিত্রা বসেছে দর্শকাসনে। বাসু দর্শকদের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে দেখলেন। রঞ্জনা থাপাকে চেনেন না। শনাক্ত করতে পারলেন না।

ওপাশে শুধু এ. পি. পি. নন, আজ পাবলিক প্রসিকিউটার নিরঞ্জন মাইতি স্বয়ং এসে বসেছেন। তাঁর মতে মামলাটা ক্রমশ বাসুসাহেবের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই তাঁর উৎসাহ ক্রমবর্ধমান।

বাসুসাহেবের সঙ্গে সুমিত্রার চোখাচোখি হল। উনি তাকে কাছে ডাকলেন। সুমিত্রা এগিয়ে এল। বাসু তার কর্ণমূলে প্রশ্ন করেন, মাথা না ঘুরিয়ে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। দর্শকদলে কি রঞ্জনা থাপা এসে বসেছে?

সুমিত্রা বলল হ্যাঁ, প্রায় পিছনের সারিতে। একটা শাদা সিল্কের …

কথাটা শেষ হল না তার। জজসাহেব তাঁর খাশ কামরা থেকে আদালতে প্রবেশ করলেন। সবাই উঠে দাঁড়ালো। জাস্টিস গাঙ্গুলী আসন গ্রহণ করে প্রথামাফিক জেনে নিলেন নির্ধারিত প্রথম মামলার বাদী-প্রতিবাদী উপস্থিত কি না, আসামী আদালতে হাজির আছে কি না। তিনি লক্ষ্য করলেন আজ পি. পি. স্বয়ং এসেছেন। জজসাহেব বললেন, স্টেট ভার্সেস শ্রীমতী চৈতালী বসুর মামলা। আগের দিন প্রসকিউশন তাঁদের তালিকা শেষ করেছিলেন। এখন প্রতিবাদী তাঁর সাক্ষীদের একে একে ডাকতে পারেন।

বাসু বললেন, তার পূর্বে আমি প্রসিকিউশনের একজন সাক্ষীকে ক্রস করতে চাই।

তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেন পি. পি. মাইতি সাহেব। বলেন, দিস ইজ প্রিপস্ট্রাস্, য়োর অনার। বাদীপক্ষ তাঁদের সাক্ষীদের একে একে তুলেছেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মাননীয় সহযোগীকে আদালত সুযোগ দিয়েছেন জেরা করবার জন্য। উনি তা করেননি। এখন তা করতে চাইলে সেটা বে-নজির হয়ে যাবে। হি হ্যাজ মিড্ দ্য বাস।

বাসু আদালতকে সম্বোধন করে বললেন, ইতিমধ্যে প্রতিবাদী পক্ষ কয়েকটি তথ্য জানতে পেরেছেন যে-কথা পূর্বদিন জানা ছিল না। প্রথমে ক্রস না করে বিশেষ কারণে পরে ক্রস একজামিন করা আদৌ বে-নজির নয়। আমি হাফ-এ ডজন নজিরের তালিকা নিয়ে এসেছি আশঙ্কা করে যে মাননীয় সহযোগী আপত্তি করতে পারেন। তার ভিতর একটি মাসছয়েক আগে এই আদালত থেকেই মঞ্জুর করা হয়েছিল যখন বিচারকের আসনে বসেছিলেন য়োর অনার হিমসেলফ এবং আমি ছিলাম প্রতিবাদী : স্টেট ভার্সেস নবীন খাশনবিশের মামলা— এ. পি. নওলখার মার্ডার কেসে।

বিচারক বলেন, অল রাইট! আদালত অনুমতি দিচ্ছেন। আপনি বাদীপক্ষের কোন্ সাক্ষীকে জেরা করতে চান?

—হোমিসাইড ইন্সপেক্টর মিস্টার কামাল হুসেন, যিনি লোকাল থানার অনুরোধে সরেজমিনে তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

আদালতের নির্দেশে কামাল হুসেন পুনরায় সাক্ষীর মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়। বিচারক তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ইতিপূর্বেই সে হলফ নিয়েছে বলে দ্বিতীয়বার তাকে দিয়ে হলফনামা পড়ানো হল না। বাস্তবে সে জেরায় যা বলবে তা হলফ নিয়ে জবানবন্দি বলেই ধরা হবে।

কামাল মাথা নেড়ে বলল, আই নো, য়োর অনার।

মাইতি আর নিজেকে সামলাতে পারেন না। দাঁতে দাঁত চেপে স্বগতোক্তি করে ওঠেন : দিস ইজ রিডিকুলাস!

জাস্টিস গাঙ্গুলী তৎক্ষণাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, বেগ য়োর পার্ডন পি. পি.! কী বললেন আপনি?

মাইতি ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন। বললেন, না, কিছু নয়!

জাস্টিস গাঙ্গুলী বলেন, অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন এটা আদালত, অভিনয়-মঞ্চ নয়। দ্বিতীয়বার কোনও স্বগতোক্তি আদালতের কানে এলে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইয়েস, মে প্রসিড মিস্টার ডিফেন্স কাউন্সেল।

বাসু উঠে দাঁড়ালেন। কামালকে প্রশ্ন করলেন, হীরালাল ঘিসিং-এর ঘর থেকে আপনি যেসব জিনিস থানায় নিয়ে যান, তার ভিতর একটা ডাকব্যাকের রেইনকোট ছিল কি?

মাইতি গর্জে ওঠেন, অবজেকশন। দ্যাটস্ এ লিডিং কোশ্চেন!

জজসাহেব বলেন, অবজেকশন ওভাররুম্ভ। নাউ মিস্টার পি. পি. আই সাজেস্ট আপনি একটু মুখে-চোখে জল দিয়ে আসুন। ডোন্ট লুজ য়োর টেম্পার। সাক্ষী বাদীপক্ষের। প্রতিবাদী জেরায় তো লিডিং কোশ্চেন করতেই পারেন, আন্ডার সেকশন 143।

মাইতি রুমাল দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে বলেন, আয়াম সরি, য়োর অনার।

জজসাহেব সাক্ষীর দিকে ফিরে বলেন, সওয়ালের জবাব দিন।

সাক্ষী বললে, আমার স্মরণ হচ্ছে না, হুজুর।

বাসুসাহেব একখণ্ড কাগজ বাড়িয়ে ধরে বলেন, এইটা আপনার সিজার লিস্ট, যার এক কপি আপনি কেয়ারটেকারকে দিয়ে এসেছিলেন। ওর তের নম্বর আইটেমটা দেখুন তো? কিছু মনে পড়ছে?

কামাল এতক্ষণে স্বীকার করে, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। ছিল বটে।

—আপনি সেটা থানায় নিয়েই বা গেলেন কেন, আর যদি নিয়ে গেলেন তো আদালতে দাখিলই বা করলেন না কেন?

কামাল চট-জলদি জবাব দিল, আমি ওটা সিজ’ করেছিলাম ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখতে যে, ওতে রক্তের কোন দাগ লেগেছে কি না। পরে দেখা গেল যে, ব্যাতিটাতে কোনও রক্তের দাগ লাগেনি। ফলে ওটা মামলায় উপস্থাপিত করা হয়নি।

— আপনি ঐ রেইন কোর্ট-এর উপস্থিতিতে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছেন কি?

—অস্বাভাবিক? না। অস্বাভাবিক কিছু দেখব কেন? ওটা কিছু লেডিজ ওয়াটার প্রুফ নয়। একজন সিউডো-ব্যাচিলারের এককামরা ঘরে বর্ষাতি বস্তুটাকে অস্বাভাবিক মনে হবে কেন?

— আপনার মনে হয়নি যে ওঠা হীরালালজীর বর্ষাতি নয়?

—আজ্ঞে না। তা মনে হবে কেন?

জজসাহেব এখানে বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, মিস্টার ডিফেন্স কাউন্সেল, হত্যা মামলার সঙ্গে ঐ বর্ষাতিটা কীভাবে সংশ্লিষ্ট তা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন ….

বাসু বললেন, মৃত হীরালাল ঘিসিং-এর দেহ-দৈর্ঘ্য ছিল পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি। আমার অনুমান ঐ বর্ষাতিটা যার মাপে কেনা সে অন্তত পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা। সেটা আকারে এত বড় যে, হীরালালজী সেটা পরলে এক বিঘৎ পর্যন্ত মাটিতে লোটাতো। এটা কীভাবে হোমিসাইড ইন্সপেক্টার লক্ষ্য করলেন না, তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আদালতের কাছে আর্জি পেশ করছি ঐ বর্ষাতিটা এখানে উপস্থাপিত করা হোক, প্রতিবাদীর একজিবিট হিসাবে।

বিচারক সেইভাবে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু প্রশ্ন করলেন, ধরা যাক বর্ষাতিটা মৃতব্যক্তির নয়। তাতেই বা কী প্রমাণ হল?

বাসু বললেন, বর্ষাতিটা আসুক, তারপর সে বিষয়ে আলোচনা করা যাবে। আপাতত আদালত যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি বর্তমান সাক্ষীকে পরবর্তী প্রশ্নটা পেশ করতে পারি।

জজ বললেন, শিওর। য়ু মে প্রসিড!

—আপনি হীরালাল ঘিসিং এর হত্যা মামলার তদন্তকারী অফিসার। দমদম এয়ারপোর্টে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স কাউন্টারের সেই মহিলার এবং টি বোর্ডের অফিসারের জবানবন্দি আপনি নিশ্চয় নিয়েছেন? তাই নয়?

—নিয়েছি।

—তাঁরা কি দুজনেই বলেছিলেন আসামীর হ্যান্ডব্যাগে এমন কিছু ছিল যাতে সেটা বেঢপ হয়ে গেছিল?

—বলেছিলেন। দুজনেই। ‘এমন-কিছু’ নয়, স্পষ্টাক্ষরে বলেছিলেন ওঁদের ধারণা সেটা একটা রিভলভার।

— তদন্তকারী অফিসার হিসাবে আপনার থিয়োরি তাহলে এই যে আসামী ভ্যানিটি ব্যাগে তার ভাইয়ের রিভলভারটি ভরে নিয়ে হীরালালের ঘরে ঢুকেছিল। তাই নয়?

— তা তো বটেই। তবে সেখানেই শেষ নয়। ঐ ভ্যানিটি ব্যাগ থেকেই রিভলভারটি বার করে সে ঘিসিং-কে হত্যা করে।

—এই আপনার থিয়োরি?

—থিয়োরি নয়। এটাই বাস্তব ঘটনা।

বাসু নীরবে এগিয়ে গেলেন। আদালতের ভারপ্রাপ্ত অফিসারের অনুমতি নিয়ে তিনি বাদীপক্ষের জমা দেওয়া দুটি জিনিস উঠিয়ে নিয়ে এলেন। রিভলভারটি এবং চৈতালীর ভ্যানিটি ব্যাগটা। রিভলভারের চেম্বার খুলে দেখে নিলেন যে তাতে কোনও টোটা ভরা নেই। এবার তিনি সাক্ষীর কাছে ফিরে এসে বললেন, মিস্টার হুসেন, আপনি কি পরীক্ষা করে দেখেছেন এই ব্যাগে ঐ রিভলভারটা আদৌ ঢোকানো সম্ভবপর কি না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, দেখেছি এবং এও লক্ষ্য করে দেখেছি যে তখন ব্যাগটা সত্যিই বেঢপ দেখায়।

—আপনি অনুগ্রহ করে এই রিভলভারটা ঐ ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে আদালতকে দেখাবেন কি যে কতটা বেঢপ দেখায়?

—ঠিক আছে, দিন দেখাচ্ছি।

রিভলভারটা প্লাস্টিক ভ্যানিটি ব্যাগে ঢোকাতে রীতিমতো কসরৎ করতে হল। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ঢোকানো গেল। জিপচেন টেনে ব্যাগটা বন্ধও করা গেল। কামাল হুসেন সেটা বাড়িয়ে ধরে বললে, এই দেখুন।

বাসু বললেন, অল রাইট। প্রমাণ হল, অস্ত্রটা ঐ ব্যাগে ঢোকানো যায়। এবার আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওটা ব্যাগ থেকে টেনে বার করুন দেখি। দেখি, আপনার কতটা সময় লাগে।

হাতঘড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বাসু বলেন, নাউ স্টার্ট

হোমিসাইড ইন্সপেক্টর জিপটা খুলবার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যাগটা এমনই বেঢপ হয়ে গেছে যে একটানে তা খোলা গেল না। বাসু বলে চলেছেন, পাঁচ সেকেন্ড… দশ সেকেন্ড… এগারো, বারো সেকেন্ড! এই তো আপনি বার করে ফেলেছেন, কিন্তু রিভলভারের বাঁটটা ষৈ উল্টো দিকে ধরা। ওটা ঘুরিয়ে ফায়ার করতে আরও তিন-চার সেকেন্ড লাগবে আপনার। তাঁই নয়?

জজসাহেব অসহিষ্ণু হয়ে বলেন, আপনি ঠিক কী প্রমাণ করতে চান বলুন তো, মিস্টার ডিফেন্স কাউন্সেল?

বাসু বিচারকের দিকে ফিরে বললেন, বাদীপক্ষের বক্তব্য, আসামী ডোর বেল বাজানোতে হীরালাল এসে দরজা খুলে দেয়। সে ক্ষেত্রে যদি আসামী তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে রিভলভারটা বার করতে দশ-পনের সেকেন্ড সময় নেয় তাহলে হীরালাল তখন কী করছিল? স্বাভাবিকভাবেই সে কি আততায়ীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না? বাধা দেবে না? হীরালালের মতো একটা জোয়ান মানুষ লেম-ডাকের মতো অপেক্ষা করবে কখন অস্ত্রটা বার করে ফায়ার করা হবে?

জজসাহেব বললেন, আই সি!

মাইতি দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, বাট আই ডোন্ট। বাস্তবে হয়তো আসামী ডোর বেল বাজানোর আগেই নির্জন করিডোরে তার ভ্যানিটিব্যাগ খুলে রিভলভারটা বার করে বাগিয়ে ধরেছিল। তার পরে সে ডোর বেল বাজায়। দোর খুলেই হীরালাল উদ্যত রিভলভারের সামনে পড়ে।

বাসু সহাস্যে বললেন, সে ক্ষেত্রে একনম্বর : আততায়ী আর নিহত ব্যক্তির মধ্যে দূরত্ব এক মিটারের চেয়ে কম হত যেটা বাদীপক্ষের ব্যালিস্টিক এক্সপার্টের মতের সঙ্গে মেলে না। দুনম্বর : হীরালালের মৃতদেহ দোরগোড়াতেই পড়ে থাকত। ব্যাক-গিয়ারে পাঁচ-পা গিয়ে নিজের বিছানায় উঠে মরার সৌভাগ্য তার হত না।

এই সময়ে বর্ষাতিটা আদালতে এসে পৌঁছালো।

বাসুসাহেব বললেন, উইথ য়োর পার্মিশন, য়োর অনার, আমি বর্তমান সাক্ষীর জেরা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে আমার পরবর্তী সাক্ষীকে ডাকতে চাই। যাতে বর্ষাতিটার প্রাসঙ্গিকতা বোঝা যায়।

বিচারক অনুমতি দিলেন। বাসুসাহেব মাধবরাজ জৈনকে সাক্ষীর মঞ্চে উঠে আসতে বললেন।

তৎক্ষণাৎ সামনের সারির একটি চেয়ার ছেড়ে গাউন পরা একজন উকিল বিচারকের মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। একখণ্ড সিলমোহর করা কাগজ বাড়িয়ে ধরে বললেন, হুজুর আমি হচ্ছি প্রাণনাথ পতিতুণ্ড—আডভোকেট। আমাকে আমমোক্তারনামা দিয়েছেন বর্তমান সাক্ষী মিস্টার মাধবরাজ জৈন, তাঁর এবং তাঁর কোম্পানির স্বার্থ দেখবার জন্য।

আদালত কাগজটি গ্রহণ করলেন।

বাসু সাক্ষীকে প্রথম প্রশ্নটিই করলেন একটু বেয়াড়া ধরনের : মিস্টার জৈন, আপনি একটি হত্যা মামলায় সাক্ষী দিতে এসেছেন, এক্ষেত্রে আপনার স্বার্থ দেখবার জন্য একজন কাউন্সেলার নিযুক্ত করার প্রয়োজন হল কেন?

মাধবরাজ বললেন, আসামী আমাদের কোম্পানির এমপ্লয়ি এবং নিহত ব্যক্তি আমাদের কোম্পানিরই একজন এজেন্ট—সংগ্রাহক। এ ক্ষেত্রে কোম্পানি এবং তার মালিকের স্বার্থ দেখবার জন্য একজন আইনজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ করাই তো স্বাভাবিক।

বাসু জানতে চান, আসামীর যমজ ভাই—হীরালালজীর মৃত্যুর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যে শিলিগুড়ির হাসপাতালে মারা যায়—সেই হরিমোহন বসুও কি আপনাদের কোম্পানির এমপ্লয়ি ছিল?

মাধবরাজ সেকথা স্বীকার করলেন। বাসুসাহেবের প্রশ্নোত্তরে প্রতিষ্ঠিত হল ওঁদের .কোম্পানির নাম এবং তাঁরা কী জাতের কাজ করেন। হরিমোহনকে কী জাতীয় কাজ করতে

হত। সে কত টাকা মাইনে পেত। মাধবরাজ একথাও স্বীকার করলেন যে, হরিমোহন প্রায়ই শিলিগুড়ি থেকে কোম্পানির নির্দেশে কলকাতা যেত দামী কিউরিও ডেলিভারি দিতে এবং নগদ, টাকা সংগ্রহ করে আনতে। অথবা নগদ টাকা নিয়ে কলকাতা যেত নিলাম থেকে দামী কিউরিও ক্রয় করে আনতে। এজন্য হরিমোহনকে রেলওয়ের প্রথম শ্রেণীর ভাড়া কোম্পানির থেকে দেওয়া হত এবং তার নিরাপত্তার জন্য তাকে একটি রিভলভারও কিনে দেওয়া হয়েছিল। মাধবরাজ আদালতে দাখিল করা তথাকথিত মার্ডার ওয়েপন’টা পরীক্ষা করে, এবং তার নম্বর নোটবুক দেখে মিলিয়ে নিয়ে শনাক্ত করলেন যে, ঐটাই হরিমোহনের রিভলভার।

তারপর বাসু-সাহেব জানতে চান, গতবছর গ্রীষ্মকালে এপ্রিল-মে-জুন মাস নাগাদ আপনি কি কিছু নেপালি কিউরিও কিনতে হরিমোহনকে নিয়ে প্লেনে করে কাঠমাণ্ডু গিয়েছিলেন?

— হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।

— সে সময় হরিমোহনের রিভলভারটা কোথায় ছিল? প্লেনে করে সে তো সেটা কাঠমাণ্ডু নিয়ে যেতে পারেনি?

—আমি জানি না। আমার জানার কথাও নয়। হয়তো সে কোম্পানির স্ট্রং রুমে অস্ত্রটা জমা দিয়ে গেছিল।

—ঐ সময় কাঠমাণ্ডু থেকে বাই রোড আপনি কিছু কিউরিও দেখতে পোখরা গ্রামে গিয়েছিলেন কি?

মাধবরাজ তাঁর উকিলের দিকে দৃকপাত করেন। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেন অ্যাডভোকেট প্রাণনাথ পতিতুণ্ড: অবজেকশন, য়োর অনার। ইররেলিভ্যান্ট অ্যান্ড ইন্‌কম্পিট্যান্ট। আলোচ্য হত্যা মামলার সঙ্গে এ প্রশ্নের কোনও সম্পর্ক নেই। নো ফাউন্ডেশন হ্যাজ বিন লেইড। তাছাড়া এটি লিডিং কোশ্চেনও বটে!

বিচারক বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বলেন, আপনি প্রশ্নটার প্রাসঙ্গিকতা একটু বুঝিয়ে বলবেন?

বাসু হেসে বলেন, প্রশ্নটার প্রাসঙ্গিকতা পরবর্তী প্রশ্নে নিশ্চয় বোঝা যাবে। কিন্তু প্রশ্নটা ওঁদের কাছে এত আপত্তিকরই বা মনে হচ্ছে কেন? পোখরা গ্রাম নেপালের একটা টুরিস্ট স্পট। কোন নিয়িদ্ধ এলাকা নয়। সাক্ষীর জবাব হতে পারে, হ্যাঁ, না, অথবা মাত্র একবছর আগেকার নেপাল ভ্রমণের কথা আমার স্মরণে নেই!

বিচারক বললেন, অবজেকশন ওভার রুলড!

মাধবরাজ বললেন, না, আমার স্মরণে আছে। আমি পোখরা গ্রামে কিছু কিউরিও খরিদ করতে গেছিলাম।

বাসুসাহেব এবার তাঁর আক্রমণের গতিমুখ পরিবর্তন করলেন। জানতে চাইলেন, পথদুর্ঘটনায় যেদিন হরিমোহন বসু শিলিগুড়ির রাস্তায় মারাত্মকভাবে আহত হন সেদিন সন্ধ্যায় কি অফিসের কাজে তাঁর কলকাতা আসার কথা ছিল?

এবারও আপত্তি জানালেন অ্যাডভোকেট পতিতুণ্ড। বাসুসাহেব প্রশ্নটির প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, য়োর অনার, হরিমোহনকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তার পকেটে ঐ সন্ধ্যার ফ্লাইটে শিলিগুড়ি-বাগডোগরার একখানা এয়ার-টিকিট ছিল, প্যাসেঞ্জার লিস্ট-এও ওর নাম ছিল। এগুলি ফ্যাক্ট। আমরা প্রমাণ দেব। হরিমোহনের যা উপার্জন তাতে নিজের পয়সায় সে প্লেনে করে কলকাতা যাবে না। ফলে সে নিশ্চিতভাবে অফিসের খরচেই কলকাতা আসছিল। আমি জানতে চাইছি তথ্যটা কি সাক্ষী জানতেন?

অ্যাডভোকেট পতিতুণ্ডের আপত্তি গ্রাহ্য হল না। মাধবরাজ জৈনকে স্বীকার করতে হল, হ্যাঁ তিনি জানতেন অফিসের একটা কাজে হরিমোহন কলকাতা যাচ্ছে—

আপনি তো জানতেন, কিন্তু অফিস বোধহয় জানত না। কারণ হরিমোহন আপনার গোপন নির্দেশে কলকাতা আসছিল। তাই নয়?

এবার অ্যাডভোকেট পতিতুণ্ডের আপত্তি গ্রাহ্য হল। মাধবরাজকে জবাব দিতে হল না। বাসুর পরবর্তী প্রশ্ন : এবারও তো হরিমোহন প্লেনে করে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল।’ তাহলে তার রিভলভারটা সে কোথায় রেখে গেল?

মাধবরাজ অসহিষ্ণুর মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, আমি জানি না। আমার জানার কথাও নয়।

বাসুসাহেব হাসি-হাসি মুখে বললেন, এবার তো ঐ তৃতীয় পংক্তিটা আপনি যোগ করলেন না, মিস্টার জৈন? অর্থাৎ হয়তো সে কোম্পানির স্ট্রংরুমে অস্ত্রটা জমা দিয়ে গেছিল।’— কেন জৈন সাহেব? যেহেতু আপনার কাকার অনুপস্থিতিতে স্ট্রংরুমের চাবিটা আপনার জিম্মায় ছিল?

বলা বাহুল্য, এ প্রশ্নটাও বাতিল হয়ে গেল। তা হোক, দেখা গেল সাক্ষী ক্রমশ নার্ভাস হয়ে পড়ছেন। বারে বারে পকেট থেকে রুমাল বার করে কপাল আর ঘাড়ের ঘাম মুছছেন!

বাসুসাহেব সেটা লক্ষ্য করে হঠাৎ সাক্ষীর দিকে এগিয়ে এলেন। টেবিলের উপর থেকে ঐ ওয়াটারপ্রুফটা তুলে নিয়ে সাক্ষীর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। বললেন, মিস্টার জৈন, আপনি কি দয়া করে এই ওয়াটার প্রুফটা গায়ে দিয়ে দেখবেন? এটা আপনাকে কেমন ফিট করে?

সাক্ষী রীতিমতো চমকে ওঠে। উত্তেজনায় সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, কেন? হঠাৎ ওটা আমি গায়ে দিতে যাব কেন?… না! সার্টেনলি নট! অপরের জামা আমি গায়ে দেব না। আই কান্ট ওবলাইজ য়ু। আয়াম সরি।

বাসু হাসিমুখেই বললেন, তাহলে বরং আমিই না হয় এটা গায়ে দিয়ে দেখি, আমাকে এটা কেমন ফিট করে। বাই দ্য ওয়ে, আমার হাইট পাঁচ ফুট দশ। আপনার হাইট কত? মিস্টার জৈন?

ইতিমধ্যে বাসুসাহেব ওয়াটার প্রুফটা গায়ে চড়িয়েছেন।

পতিতুণ্ড যথারীতি আপত্তি দাখিল করেন। প্রশ্নটি নাকি অপ্রাসঙ্গিক। জজসাহেব তাঁর মতামত জানানোর পূর্বেই বাসু বলেন, আমি প্রশ্নটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। আদালতসুদ্ধ সবাই স্বীকার করবেন যে, আপনার উচ্চতা পাঁচ-নয়ের কম নয় এবং পাঁচ এগারোর বেশি নয়। আপনি দাঁড়িয়ে ওঠায় আমাদের আন্দাজ করতে সুবিধা হল, থ্যাংকস্!

বিচারক বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বললেন, মিস্টার ডিফেন্স কাউন্সেল, আপনি বারে বারে বলছেন, ঐ ওয়াটার প্রুফটার প্রাসঙ্গিকতা আদালতকে বুঝিয়ে বলবেন। কিন্তু সেটা নানান কারণে মুলতবি হয়ে যাচ্ছে। এবার কি সেটা ব্যাখ্যা করে বলবেন?

—বলব, য়োর অনার। তার আগে মিস্টার জৈনকে জানাই যে, তাঁর সাক্ষী দেওয়া শেষ হয়েছে। বাদীপক্ষ তাঁকে জেরা করতে না চাইলে তিনি দর্শকদের আসনে গিয়ে বসতে পারেন

বাদীপক্ষ জৈনকে ক্রস করলেন না। মাধবরাজ জৈন মাথা নিচু করে দর্শকাসনে ফিরে এলেন। তাঁর কাকার পাশের আসনটিতে কী জানি কেন এবার এসে বসলেন না। অ্যাটাচি কেসটা উঠিয়ে নিয়ে পিছনের একটা আসনে গিয়ে বসলেন। বাসু বিচারকের দিকে ফিরে বললেন, য়োর অনার, বর্ষাতিটার প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা করতে হলে এ আদালতের টেবিলে আমার সবগুলি তাস চিত করে বিছিয়ে দিতে হবে। আমার স্ট্রাটেজির ব্যাখ্যা দিতে হবে। বর্তমান অবস্থায় তাতে আপত্তি নেই। আমি আদালতকে এই পর্যায়ে জানিয়ে দিতে চাই আমি কী প্রমাণ করতে চাইছি। বাদীপক্ষ তা জানুন, আমার থিয়োরিটাকে ভুল প্রমাণিত করে যদি সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন আমি খুশি হব। আমার সিদ্ধান্ত : আসামী, চৈতালী বসু ঘটনার দিন বেলা তিনটে সওয়া তিনটার সময় হীরালালের অ্যাপার্টমেন্টে যায়। বেল বাজানোর প্রয়োজন হয় না তার। কারণ সে দেখতে পায়, দরজাটা ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে আছে। সে নক করে ঘরে ঢোকে এবং দেখতে পায় খাটের উপর গুলিবিদ্ধ হয়ে হীরালাল ঘিসিং মরে পড়ে আছে। মেঝেতে জমাট বাঁধা রক্তের মধ্যে পড়ে আছে তার ভাইয়ের রিভলভারটা। সেটা সে কুড়িয়ে নেয়। বাথরুমে গিয়ে রক্তের দাগটা ধুয়ে ফেলে। তার ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে নেয়। এই সময়ে তার ব্যাগ থেকে লাইব্রেরি কার্ডটা অসতর্কভাবে পড়ে যায়। তারপর নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। দরজাটা আগের মতোই খোলা পড়ে থাকে। ইন ফ্যাক্ট, আমার মক্কেল আমাকে এই জবানবন্দিই দিয়েছে, এবং আমি সেটা বিশ্বাস করেছি।

মাইতি বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, সহযোগী কি তাঁর ডিফেন্সটা আর্ত্ত করছেন? আমরা সাম- আপ করার আগেই?

বাসু জবাব দেবার আগেই জাস্টিস গাঙ্গুলী বলে ওঠেন, না! উনি আদালতের নির্দেশে ঐ বর্ষাতিটার প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছেন শুধু।

মাইতি বলেন, কিন্তু সহযোগী তো বর্ষাতির কথা আদৌ কিছু বলছেন না?

বাসুসাহেব বললেন, এবার বলব। এ পর্যন্ত যা বলেছি তা আমার থিয়োরির ফাউন্ডেশন মাত্র। আমি যা বলেছি, তা ধরে নিতে হলে এটাও ধরে নিতে হবে যে, চৈতালী ঐ ঘরে প্রবেশ করার পূর্বে বেলা তিনটার আগে — আর একজন ঐ ঘরে ঢুকেছিল। যে ব্যক্তি খুনটা করে। সে এসে ডোরবেল বাজায়। কারণ তখন দরজা ছিল বন্ধ। হীরালাল ম্যাজিক-আই দিয়ে দেখে কে এসেছে। আগন্তুক হীরালালের পরিচিত। তাই সে দরজার লক খুলে আগন্তুককে ভিতরে আসতে দেয়। নিজে গিয়ে খাটে বসে এবং আগন্তুক বসে ডিভানে। দুজনের মধ্যে ব্যবধান—ব্যালিসটিক এক্সপার্ট যা বলেছিলেন—এক মিটারের কিছু বেশি। কী কথাবার্তা হয় আমরা জানি না। মত-পার্থক্য কিছু হয়েছিল। একেবারে আচমকা তার পরিকল্পনামতো আগন্তুক হাতটা তোলে এবং ফায়ার করে। রিভলভারটা তার ডান হাতে ধরাই ছিল।

মাইতি বলেন, ও! এবার বুঝি ‘লেম ডাক’ হতে হীরালালের আপত্তি হল না। আগন্তুকের হাতে রিভলভারটা দেখে সে আত্মরক্ষার কোনও চেষ্টাই করল না?

বাসু মাইতির দিকে ফিরে বললেন, এইখানেই বর্ষাতিটার প্রাসঙ্গিকতা। আগন্তুকের হাতে ছিল কড্ রিভলভার, কিন্তু তার নিজের ব্যাতিতে হাতের রিভলভারটা সযত্নে ঢাকা দেওয়া ছিল। হীরালাল তা জানত না, দেখতে পায়নি। হীরালাল দুভার্গ্যবশত খেয়াল করে দেখেনি আকাশ নির্মেঘ হওয়া সত্ত্বেও আগন্তুক কেন ঐ বর্ষাতিটা হাতে করে এনেছে।

আদালতে আলপিন-পতন নিস্তব্ধতা। বাসুই আবার কথা বলে ওঠেন, আমার এ অনুমান সত্য হলে—এক : আগন্তুক হীরালালের পরিচিত ব্যক্তি। দুই : আগন্তুকের উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির কাছাকাছি। তিন : সে পুরুষমানুষ। চার : হীরালালজীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার একটা জোরালো ইচ্ছা আগন্তুকের ছিল। প্রসঙ্গত বলি, আসামীর হত্যা-উদ্দেশ্য নিয়ে বাদীপক্ষ কোনও ইঙ্গিত এখনো পর্যন্ত দেয়নি। আদালত অনুমতি করলে আমি ঐ অজ্ঞাত আগন্তুকের হত্যা-উদ্দেশ্যটা এবার প্রতিষ্ঠা করব—যা থেকে আগন্তুকের পরিচয়টাও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শুড আই প্রসিড উইথ দ্য কেস, য়োর অনার?

নিশ্চয়ই। আপনি পরবর্তী সাক্ষীকে এবার ডাকতে পারেন।

মাইতি নিম্নকণ্ঠে কামাল হুসেন আর শিবেন গুহর সঙ্গে কী সব আলোচনা করতে থাকেন। বাসুসাহেবের নির্দেশে কোর্ট পেয়াদা হাঁকল: মিসেস্ রঞ্জনা থাপা হা—জি—র?

 দর্শকদলের পিছন থেকে একটি সুতনুকা মহিলা ধীরপদে মঞ্চের দিকে এগিয়ে এলেন। তাঁর পরিধানে শাদা শিল্কের শাড়ি, শাদা ব্লাউজ। কিন্তু তাঁর দক্ষিণ বাহুমুলে একটা কালো রঙের রিবন জড়ানো। সুন্দরী। খুব ফর্সা। নেপালি। বয়স আন্দাজ ত্রিশ। ভারপ্রাপ্ত কর্মী তাঁকে দিয়ে শপথবাক্য পাঠ করালো। রঞ্জনা বসল সাক্ষীর চেয়ারে।

বাসু জানতে চাইলেন, আপনার হাতে একটা কালো রিবন জড়ানো রয়েছে মোৰ্নিঙে আছেন, মিসেস থাপা?

—ইয়েস স্যার। আমার কাজিন ব্রাদার হীরালাস ঘিসিং-এর আকস্মিক মৃত্যুতে।

—আপনি কি শিলিগুড়ির ঐ জৈন কিউরিও শপের স্টাফ?

— আজ্ঞে না। ছিলাম। এখন নই। মাসতিনেক আগে ছুটি নিই। তারপর রেজিস্ট্রি ডাকে রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দিই। সেটা ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছে কি না আমি জানি না বটে, কিন্তু আমি নিজেকে ওঁদের এমপ্লয়ি বলে মনে করি না।

— মাস-তিনকে আগে আপনি ছুটি নিয়েছিলেন কেন?

—মেডিক্যাল গ্রাউন্ডস্-এ।

—গল-ব্লাডার অপারেশন করাতে কি?

পতিতুণ্ড আপত্তি করেন : লিডিং কোশ্চেন। জজসাহেব মতামত জানানোর আগেই বাসু বলেন, অল রাইট। আই উইথড্র। বলুন, অসুখটা কী ছিল?

—’অসুখ’ কিছু নয়। ‘ন্যাচারাল ফেনোমেনা।’ আমি ‘মা’ হতে যাচ্ছিলাম। ছুটি নিয়ে দেশে চলে যাই। কাঠমাণ্ডুতে একটি নার্সিং হোমে সন্তান প্রসব করি।

বাসু একটু ইতস্তত করে প্রশ্ন করেন, আপনার স্বামী কোথায়?

অসঙ্কোচে রঞ্চনা জবাব দেয়, প্রায় পাঁচ বছর আগে তিনি স্বর্গে গেছেন।

—সে ক্ষেত্রে আপনার সন্তান হওয়ায় কোনও সামাজিক আলোড়ন কি হয়নি?

—না! আমি যে সমাজের মেয়ে সেই পাহাড়িয়াদের কাছে কুমারী বা বিধবার সন্তানকে বলা হয় ‘ভুলা-হুয়া’। ভুল করে হওয়া। ভুল ভুলই, কোনও অপরাধ নয়। মায়ের পরিচয়েই সন্তান সমাজে স্বীকৃতি পায়।

—আপনার এই সন্তানের পিতা কে তা আমি জানতে চাইছি না, কিন্তু বাস্তব সত্যটা কি আপনি হীরালালজীকে জানিয়েছিলেন?

—হ্যাঁ, জানিয়েছিলাম। সে বলেছিল, আমাকে খেসারত আদায় করে দেবে। পঞ্চাশ হাজার টাকা! আমি আপত্তি করি। কিন্তু ও আমার কথা বোধহয় শোনেনি, আর সেই ভুলের জন্যই …

কান্নায় বুজে এল সাক্ষীর কণ্ঠস্বর।

বাসু ওকে সামলে নিতে দিয়ে বললেন, আপনার সন্তান এখন কোথায় আছে?

—আমার গ্রামে। আমার মায়ের কাছে। পোখরায়।

—পোখরা? আপনাদের আদি নিবাস কি নেপালের ‘পোখরা’ গ্রাম?

— ইয়েস স্যার।

—আপনার শিশুসন্তানটি ছেলে না মেয়ে?

—মেয়ে।

—তার বাবা কি মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন?

—আজ্ঞে না। তিনি বহাল তবিয়তে জীবিত আছেন।

—তিনি কি এই আদালতে আছেন?

রঞ্জনা তৎক্ষণাৎ বলে, পাঁচ মিনিট আগেও তাঁকে দেখেছি। কিন্তু এখন দেখছি তাঁর চেয়ারটা ফাঁকা।

বাসু কিছু বলার আগেই আদালতের বাইরে থেকে একটা ধস্তাধস্তি চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ ভেসে এল। বিচারক ঘন ঘন তাঁর হাতুড়িটা টেবিলে ঠুকলেন। তাতে দর্শকদলের চাঞ্চল্য আদৌ প্রশমিত হল না। যারা দরজার কাছাকাছি ছিল তারা ছুটে বেরিয়ে গেল, বাইরে কী হয়েছে জানতে।

একজন কোর্ট-পেয়াদা দৌড়ে এসে বিচারকের কর্ণমূলে কী যেন নিবেদন করল। তিনি উচ্চৈস্বরে ঘোষণা করলেন : কোর্ট ইজ অ্যাডজনড ফর হাফ-অ্যান-আওয়ার!

দৃঢ় পদক্ষেপে তিনি নিজের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেলেন। চৈতালী ঝুঁকে পড়ে জানতে চাইল, বাইরে গণ্ডগোলটা কিসের?

বাসু মৃদু হেসে বলেন, যে ব্যক্তি তোমার কাছ থেকে চার্জ বুঝে নিয়ে তোমার চেয়ারে বসবে!

—মানে?

—সম্ভবত আদালত থেকে কেউ পালাতে চাইছিল, আর আদালত চৌহদ্দির বাইরে যেতেই পুলিশে তাকে পাকড়াও করেছে!

চৈতালী চোখ বড় বড় করে জানতে চায় : রঞ্জনাদির মেয়ের বাবা?

বাসু কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে বলেন, সেই সামান্য কৃতিত্বটুকুই পলায়মানের একমাত্র পরিচয় নয়। এখনি তোমাকে বললাম না, এ আদালত এলাকায় তার চেয়ে বড় পরিচয় : মাধবরাজ জৈনই হীরালাল ঘিসিং-এর হত্যাকারী।

***

পরদিন সকালে প্রাতভ্রমণ সেরে ফিরে এসে বাসু দেখলেন, যথারীতি শীতের সকালের রোদটুকু উপভোগ করতে সবাই বাগানে বসেছে চায়ের টেবিল পেতে। ইতিমধ্যে খবরের কাগজ দিয়ে গিছে। কাগজের বান্ডিলটা কুড়িয়ে নিয়ে বাসু এসে বসলেন তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে। রানী বললেন, খবরের কাগজ থাক। ও তো পালিয়ে যাচ্ছে না। কাল সুজাতা আর কৌশিকের মুখে সব কথা বুঝতে পারিনি। রাতে আর জিজ্ঞেস করিনি তুমি ক্লান্ত ছিলে। আর তাছাড়া ওরা দুজনও যে একই রকম কৌতূহলী।

—তোমাদের কী বিষয়ে সন্দেহটা রয়েছে এখনো?

—প্রথম কথা তুমি মাধবরাজকে সন্দেহ করতে শুরু করলে কখন থেকে?

—সে প্রশ্ন করলে বলব : ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’! ওর অফিসের দোরগোড়াতেই। সে যেন আমাকে তাড়াতে পারলে বাঁচে। ঠিক তখনি আমার মনে খটকা বাধল। তারপর সুমিত্রার চিরকুট— চৈতালীকে ‘এরা’ ফাঁসাতে চায়! ‘এরা’ তো গৌরবে বহুবচন—একবচনে সেটা কে? সুমিত্রার মাধ্যমেই জানতে পারি রঞ্জনা মা হ’তে বসেছিল। হরিমোহন যদি অজাত সন্তানের পিতা হয়, আর রঞ্জনা যখন ভ্রূণহত্যা, করতে চায় না, তখন হরিমোহন তো অনায়াসে রঞ্জনাকে বিয়ে করতে চাইতে পারত। আপত্তিটা কিসের? বয়সের? সেটা তো ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। দেখা গেল সুটকেসে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে, রিভলভারটা অফিসের স্ট্রংরুমে জমা দিয়ে হরিমোহন প্লেনে করে কলকাতা যাচ্ছিল। নিজের পয়সায় নয়, অত টাকা তার নেই। আবার অফিসের অফিশিয়াল নির্দেশেও নয়। তাহলে কার নির্দেশে? বিপত্নীক বিজয়রাজের নির্দেশেও নয়। তিনি রঞ্জনার সন্তানের পিতা হলে পুনর্বিবাহ করতেন। একজন বিধবা অপরজন বিপত্নীক—কোনও তরফেই আপত্তি হত না।

নেতি-নেতি করতে করতে ছাঁকনিতে পড়ে রইল মাধবরাজ। তার স্ত্রী বর্তমান। ধর্মান্তর করে মুসলমান না হলে সে রঞ্জনাকে বিবাহ করতে পারে না। ধর্মান্তরিত হলে সে নির্ঘাৎ প্রথম স্ত্রীর ডিভোর্সের সম্মুখীন হত। ভবিষ্যতে অগাধ সম্পত্তির আশা—মানে শশুরমশায়ের দেহান্তে … যেটা সে প্রত্যাশা করছে,—বিসর্জন দিতে হয়। মাধবরাজ চেয়েছিল অ্যাবর্শন—সন্তান তার কাছে অবাঞ্ছিত আপদ। বঞ্চিত মাতৃত্ব রঞ্জনার দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐ ভুলা-হুয়া’ এক কাঙ্ক্ষিত সম্পদ। যে কোনও কারণেই হোক রঞ্জনা পুনর্বিবাহ করতে চায় না। অথচ সে সন্তান চায়। ওর ভুল হয়েছিল হীরালালের কাছে সত্যিকথাটা স্বীকার করা। কী জানি—হয়তো টাকার প্রয়োজনটাও ছিল। হীরালাল ব্ল্যাকমেলিং করছিল—এটাও আন্দাজে বলা—হয়তো রাখী বহিনের উপকার করতেই। নিজের স্বার্থে নয়। সে যা হোক, হরিমোহন মাধবের ডান হাত। শিলিগুড়িতে সে লেডি গাইনোকলজিস্ট দিয়ে রঞ্জনাকে পরীক্ষা করায়। মাধবের নির্দেশানুসারে। সুমিত্রা ভুল বোঝে। চৈতালী তো জানতেই পারে না।…হীরালালের তাগাদায় মাধবরাজ ভল্ট থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে হরিমোহনকে দিয়ে তাকে প্লেনে করে কলকাতা পাঠানোর ব্যবস্থা করে। দুর্ভাগ্যবশত হরিমোহন অ্যাকসিডেন্টে পড়ে। মাধব অ্যাটাচি কেসটার সন্ধান পায় না। আন্দাজ করে, সেটা নিয়ে চৈতালী কেটে পড়েছে। তাতেই ও পুলিশে খবর দিয়ে চৈতালীকে টাকাসহ ধরবার চেষ্টা করে। নিজে ভল্ট থেকে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে, মালখানা থেকে হরিমোহনের রিভলভারটা নিয়ে কলকাতা চলে যায়। … বাকিটা তোমরা জানই!

রানী বললেন, না, জানি না। সে ফিরল কেমন করে? সন্ধ্যার প্লেনে তুমি দমদম বাগডোগরা ফ্লাইটে গেছ, রাত্রের চাটার্ড প্লেনে গেছে চৈতালী, কিন্তু তোমরা তো কেউ ওকে দেখতে পাওনি।

ঠিক তখনই বেজে উঠল টেলিফোনটা।

আজকাল সবার আগে টেলিফোনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশে। শুনে নিয়ে বললে, সাহেবের ফোন। লালবাজার থেকে। বাসু ইতিমধ্যে একটা কর্ডলেস অ্যাটাচমেন্ট নিয়েছেন। বিশু টেলিফোনটা উঠিয়ে নিয়ে বাগানে এলো। বাসু তার ‘কথা মুখে’ বললেন, বাসু স্পিকিং।

— গুড মর্নিং স্যার। আমি রবি। ইন্সপেক্টার রবি বসু। দু-দুটো ভাল খবর আছে, স্যার। শুনবেন?

—বল? শুভ সংবাদ শীঘ্রই শুনতে হয়।

— এক নম্বর : আপনার মক্কেলকে জেনানা-ফাটক থেকে এইমাত্র ছেড়ে দেওয়া হল। জামিন নয়। পার্মানেন্টলি। কেসটা আমরা উইথড্র করছি। দু-নম্বর খবর : মাধবরাজ থার্ড ডিগ্রিতে ভেঙে পড়েছে। বড়লোকের ছেলে, আদরে-গোবরে মানুষ—চাপ সহ্য করতে পারল না। সে আদ্যন্ত কবুল করেছে। হীরালাল তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছিল। হরিমোহনের হাতে মাধবরাজ পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠাবার ব্যবস্থাও করেছিল। কিন্তু বিধি বাম। হরিমোহন গেল হাসপাতালে আর তার যমজ বোন অ্যাটাচি কেসটা উঠিয়ে নিয়ে উধাও! মাধবরাজ ভল্ট থেকে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা বার করে নিয়ে, স্ট্রং রুম থেকে হরির রিভলভারটা সংগ্রহ করে ট্রেনে করে কলকাতা চলে আসে। হীরালালের ঘরে ঠিক কী নিয়ে দুজনের ঝগড়া-বিবাদ হয় জানি না। সম্ভবত টাকার অঙ্ক নিয়ে। যাই হোক, মাধব ওর ব্ল্যাকমেলিঙের খেলা চিরতরে খতম করে দিয়ে ফিরে যায়।

—কিন্তু সে পরদিন সকালে শিলিগুড়িতে ফিরল কী করে? সন্ধ্যার ফ্লাইটে আমি নিজে গিয়েছি। লেট নাইট চাটার্ড প্লেনে এসেছে চৈতালী। আমরা কেউই তো ওকে মিট করিনি।

—এর তো সহজ উত্তর, স্যার। মাধব খুনটা করে দুপুরে। শেয়ালদহ থেকে অনায়াসে রাত সাতটার দার্জিলিঙ মেল ধরে পরদিন ভোরবেলা পৌঁছায় নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে বাই – রোড ট্যাক্সি করে অফিস টাইমের আগেই শিলিগুড়ি। অসুবিধাটা কী?

বাসু বললেন, থ্যাঙ্কু! আমার মক্কেল এখন কোথায়?

—ট্যাক্সি নিয়ে আপনার বাড়ির দিকেই রওনা দিয়েছে। আর মিনিট পনেরোর ভিতরেই পৌঁছে যাবে আশা করি।

যন্ত্রটা বিশের হাতে দিয়ে বাসুসাহেব সুখবরটা সবাইকে জানাতে গেলেন। কিন্তু আবার বাধা পড়ল। আবার বেজে উঠল টেলিফোন।

—বাসু স্পিকিং।

—গুড মর্নিং মিস্টার বাসু। দিস ইজ জৈন, দ্য সিনিয়ার ওয়ান — বিজয়রাজ।

— ইয়েস? বলুন? আপনি কি আপনার ভাইপোর ডিফেন্স বিষয়ে…

হঠাৎ বাধা দিয়ে বিজয়রাজ বলে ওঠেন : নো! অ্যান এমফ্যাটিক নো। যতদিন ছোট ছিল বুকের পাঁজরের মতো তাকে আগলে রেখেছিলাম। এখন সে সাবালক। আমার বিজনেস পার্টনার। নিজের ভাল-মন্দ সে নিজেই স্থির করে। প্রাণনাথ পতিতুণ্ডকে সে এমপ্লয় করেছিল আমাকে না জানিয়ে। নো—ব্যারিস্টার সাহেব—ভাইপোর ডিফেন্সের জন্য এই সাত-সকালে আপনাকে বিরক্ত করিনি।

— তাহলে?

—আমি আজই সন্ধ্যার ফ্লাইটে বাগডোগরায় ফিরে যাব। ভাইপোটা অপোগণ্ড, কিন্তু তার স্ত্রীর, বৌমার দায়িত্বটা তো এখন আমার! আপনি আজ সারাদিনে আমাকে কিছু সময় দিতে পারবেন?

—কেন? কাজটা কী?

—দুটো কাজ। এক নম্বর আমার উইলটা পালটাতে চাই। আমার সমস্ত সম্পত্তি ভাইপোর বদলে তার স্ত্রীকে দিয়ে যেতে চাই।

—দুটো কাজ বলেছিলেন। দ্বিতীয়টা?

—চৈতালী বসুর একটা হেভি ড্যামেজ ক্লেম ডিউ হয়েছে। টাকার অঙ্কটা আপনি নির্ধারণ করবেন। হীরালালের কোনও নিকট আত্মীয় আছে কি না জানি না — খোঁজ নিচ্ছি। সে ক্ষেত্রে তাকেও খেসারত দিতে হবে। বলুন, কখন আপনার সময় হবে?

—এখনই। আপনি সোজা আমার অফিসে চলে আসুন। আপনার এমপ্লয়ি চৈতালী বসুও আসছে। সামনা-সামনি কথা হয়ে যাবে।

—থ্যাঙ্কু!

***