১৫
শুক্রবার সন্ধ্যায় আদালতে থেকে ফিরে এসে সবাই বসেছেন সান্ধ্য আড্ডায়। রানী আদালতে যেতে পারেন না। সচরাচর বাসুসাহেব আদালতে কী ঘটল তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাখিল করেন। কিন্তু আজ কী জানি কেন তিনি বেশ নিরুৎসাহ। কৌশিকই আদালতের ঘটনা বিস্তারিত জানালো। এবং সক্ষেদে নিজের ক্ষোভটাও প্রকাশ করল : জানি না, মামিমা, কেন এমনটা হলো। মামু আজ কাউকেই তেমনভাবে জেরা করলেন না। কিছু মনে করবেন না, মামু আমার মনে হচ্ছিল কোনও তৃতীয় শ্রেণীর আইনজীবীকে নিয়োগ করেছে ঐ হতভাগিনী ফাঁসির আসামী।
বাসু আজ পাইপ ধরাননি। বললেন, আই এগ্রি! আমি বিশ্বাস করেছি যে, চৈতালী খুনটা করেনি। কিন্তু এ ডিলে একটাও অনার্স কার্ড নেই আমার হাতে। ট্রাম্প কার্ডও নেই। সারিবদ্ধ দুরি-তিরি-ছক্কা। কী করে খেলব?
সুজাতা বলে, আমার কিন্তু বিশ্বাস চৈতালীই খুনটা করেছে। সে যে ঐ ঘরে ঢুকেছিল তার অকাট্য প্রমাণ আছে। রিভলভারটা তার ভায়ের। আর পঞ্চাশ হাজার টাকা তছরুপ করে সে যে ছদ্মনামে হোটেলে এসে উঠেছিল এটাও প্রতিষ্ঠিত।
বাসু বললেন, হুঁ! কিন্তু ওদের তহবিলে ঘাটতি শুধু পঞ্চাশ হাজার নয়, পুরো এক লাখ!
—সেটা চৈতালীই সরিয়েছে। আপনার ধমক খেয়ে পঞ্চাশ হাজারের ড্রাফট বানাতে বাধ্য হয়েছিল। বাকি পঞ্চাশ হাজার সে গায়েব করেছে। ও যেমন ডাইনে-বাঁয়ে মিথ্যে কথা বলে তাতে ওর একটা কথাও বিশ্বাস হয় না।
বাসুসাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কিন্তু ওর সলিসিটর হিসাবে আমাকে যে ধরে নিতে হবে ও অন্তত শেষ পর্যায়ে আমাকে মিথ্যা কথা বলেনি। দিস ইস্ অন প্লিডার্স এথিক্স।
কৌশিক বললে, ও, ভাল কথা! একটা বিষয়ে আপনাকে অবহিত করা হয়নি। রবিকে মনে আছে? ইন্সপেক্টার রবি বোস?
—শিওর। ‘ঘড়ির কাঁটা’য় যে লটারির টাকাটা পেয়েছিল। সে আমার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। কেন? রবি কিছু ক্লু দিতে পারছে?
—হ্যাঁ, একটা মাইনর ব্লু। সিজার লিস্ট’এ একটা ডাকব্যাকের রেইন কোট আছে, যেটা আদালতে দাখিল করা হয়নি।
—কী? ডাকব্যাক কোম্পানির রেইন-কোর্ট? জাস্ট এ মিনিট! সেটি কি ঘর সার্চ করার সময় ডিভানটার উপর পড়েছিল?
— হ্যাঁ তাই ছিল। আপনি কী করে জানলেন?
—বাঃ। ফটোগ্রাফে দেখলাম যে! প্রসিকিউশন একসিবিট নম্বর থার্টিওয়ান! ফটোটা দরজার কাছ থেকে তোলা। মনে হল, ডিভানের উপর পড়ে আছে একটা রেনকোট। ডাকব্যাকের কি না অবশ্য বোঝা যাচ্ছিল না। তখন মনে হয়নি; এখন মনে হচ্ছে ওটা ইনকমপ্যাটিবল’! স্থান-কালে একটা অসঙ্গতি। মাসটা ফেব্রুয়ারি। তিন-চার মাস কলকাতায় বৃষ্টি হয়নি। এমন সময়ে হীরালাল তার বর্ষাতিটা কেন বার করে ডিভানের ওপর রাখবে?
—না, মামু। সমস্যাটা আরও গভীর। রেনকোটটা হীরালালের নয়। হতে পারে না।
—তুমি কেমন করে জানলে?
—হীরালাল ঘিসিং-এর উচ্চতা পাঁচফুট দুই ইঞ্চি, মানে একশ সাতান্ন সে.মি.। রেন-কোটটার ঝুল তার চেয়ে বেশি। মানে, হীরালাল ওটা গায়ে দিলে এক বিঘৎ পরিমাণ মাটিতে লুটাতো। ওটা অন্য কারও।
তড়াক করে উঠে পড়েন বাসুসাহেব। প্রতিবর্তী প্রেরণায় হাতটা চলে যায় পকেটে। বার হয়ে আসে পাইপ আর পাউচ। ধীরে ধীরে কক্ষান্তরে চলে যান তিনি।
কেউ অবাক হয় না। এটা ওঁর স্বভাবসিদ্ধ ব্যবহার। এখন মিনিটদশেক উনি পদচারণা করবেন নির্জন ঘরে। ‘কার্য-কারণ ঘটনা’ পরম্পরার বিষয়ে যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্তে আসবেন। বাসু লাইব্রেরি ঘরে চলে গেলেন।
বিশে এসে জানালো খাবার তৈরি। জানতে চাইল, টেবিল সাজাবে কি না।
রানী দৃঢ় স্বরে বললেন, না। সব কিছু ঢাকা দিয়ে রাখ। রুটিগুলো ক্যাসারোলে। মনে হচ্ছে আজ রাত হবে।
তা হল না কিন্তু। মিনিট দশেক পরেই ফিরে এলেন বাসু। তাঁর হাতে ধূমায়িত পাইপ। বললেন, শিলিগুড়িতে একটা এস. টি. ডি. কর তো রানু। জৈন কিউরিও এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইম্পোর্টের বড় তরফ বিজয়রাজ জৈনের রেসিডেন্সে। হিয়ার্স দ্য নাম্বার।
রানী তাঁর অভ্যস্ত আঙুলে ধীরে ধীরে শিলিগুড়িতে এস. টি. ডি. করতে থাকেন। বাসু- সাহেব সুজাতার দিকে ফিরে বলেন, লেটস্ হোপ দ্য ওল্ড ম্যান ইজ অ্যাট হোম্।
সে আশা সাফল্যমণ্ডিত হল। অচিরেই ও প্রান্তে ভারী গলায় শোনা গেল, ইয়েস। বিজয়রাজ স্পিকিং
বাসু বললেন, গুড ইভনিং মিস্টার জৈন। দিস ইজ পি. কে. বাসু ফ্রম ক্যালকাটা।
—গুড ইভনিং। বলুন ব্যারিস্টার সাব, কী ভাবে আপনার সেবা করতে পারি?
—না, আমার নয়। আপনি সেবা করবেন জৈন এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইম্পোর্ট কোম্পানিকে। আপনাদের কোম্পানির কেশিয়ার আজ ফাঁসির আসামী। তাকে বাঁচানোর কর্তব্য আপনাদেরই। নয় কি?
বিজয়রাজ গম্ভীর ভাবে বললেন, দ্যাট ডিপেন্ডস্। লুক হিয়ার, ব্যারিস্টার-সাব। চৈতালীকে আমি খুবই স্নেহ করতাম। কিন্তু সে যদি সত্যিই খুনটা করে থাকে তাহলে তাকে বাঁচাবার চেষ্টা আমি আদৌ করব না। হীরালালও আমার প্রিয়পাত্র ছিল।
—কারেক্ট! কিন্তু খুনটা চৈতালী করেছে কি করেনি সেটা তো স্থির করবেন বিচারক। আপনি-আমি নই। যতক্ষণ বিচারক তাকে অপরাধীরূপে চিহ্নিত না করছেন ততক্ষণ সে ‘বেনিফিন-অব-ডাউটের’ খাতিরে আমার কাছে ক্লায়েন্ট, আপনার কাছে এমপ্লয়ি।
—হতে পারে। আমি কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছি না যে, ঐ মেয়েটি ক্যাশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা সরিয়ে কলকাতার একটা হোটেলে ছদ্মনামে উঠেছিল এমন একটা মর্মান্তিক সময়ে যখন তার যমজ ভাই শিলিগুড়িতে মৃত্যুশয্যায়।
—দ্যাটস্ কারেক্ট। কিন্তু কেন? কী মর্মান্তিক হেতুতে?
—আমি জানি না। একটি বিশ-বাইশ বছরের অবিবাহিতা মেয়ে কোন মর্মান্তিক হেতুতে ক্যাশ থেকে পঞ্চাশ হাজার …
— জাস্ট আ মিনিট—ফিগারটা কি পঞ্চাশ হাজার টাকা? এক লাখ নয়?
—না, পঞ্চাশ হাজার
—স্ট্রেঞ্জ! প্রথম শুনলাম দু লাখ, পরে আপনি বললেন ক্যাশ থেকে আপনিই এক লাখ নিয়ে গেছলেন, তাহলে ….
বাধা দিয়ে জৈন বললেন, বাকি পঞ্চাশ হাজারেরও হিসাব পাওয়া গেছে। মাধো নিয়েছিল। ওর মনে পড়ে গেছে!
বাসুসাহেব লুইস ক্যারলের সেই অনবদ্য ব্যাকরণ-বহির্ভূত বিস্ময়সূচক ধ্বনিটা উচ্চারণ করে বলেন ‘কিউরিঅসার অ্যান্ড কিউরিঅসার!’ তার মানে ক্যাশে এখন কোন ঘাটতিই নেই! তাই তো? যে হেতু চৈতালী তার পঞ্চাশ হাজারের ড্রাফটটা নিশ্চয় এতদিনে জমা দিয়েছে।
—সেটা বড় কথা নয়, বাসুসাহেব। আপনার মক্কেল যে কেন ক্যাশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদে সরিয়েছিল তার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ সে দেখাতে পারেনি। ফলে এটাকে ‘এম্বেমেন্ট’ বলা যাবে না। বাট ইট সার্টেনলি অ্যামউন্টস টু অ্যান অ্যাটেম্পট টু ইট!
—আপনি কি চান প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হোক?
—কেন চাইব না? যদি প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হলে বুঝতে পারি আমার ধারণাটা ভুল চৈতালী যা করেছে, তার পিছনে কোন অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না, তাহলে নিশ্চয় আমি খুশি হব। কিন্তু আপনি আমাকে হঠাৎ ফোনটা করলেন কেন বলুন তো?
—আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী।
—কী জাতীয় সাহায্য, বলুন? আমার ক্ষমতার মধ্যে হলে নিশ্চয় করব।
—আগামী সোমবার মামলার নেক্সট হিয়ারিং ডেট। সেদিন সকাল দশটায় আমি আপনাদের কর্মী সুমিত্রা গর্গকে সাক্ষীর মঞ্চে তুলতে চাই।
—সুমিত্রা? সুমিত্রা কী জানে? কী সাহায্য করবে আপনাকে?
—সেটা আমার বিবেচনাতেই ছেড়ে দিন না কেন?
—অল রাইট। তাকে ছুটি দিতে আমার আপত্তি নেই। তার যাতায়াতের ভাড়া আর রাহা- খরচের দায়িত্ব যদি আপনি নেন তবে সে যাবে, অবিশ্যি তার নিজের যদি কোনও আপত্তি না থাকে। সে তো আদালতের কোনও সমন পায়নি—
বাধা দিয়ে বাসুসাহেব বলেন, সেটুকু উপকার আপনাকে করতে হবে। তাকে রাজি করানোর কাজটা। শুধু তাই নয়, ঐ সঙ্গে আপনারা দুজনও আদালতে উপস্থিত থাকবেন এটাই আমার প্রার্থনা।
—আমরা ‘দুজন’ মানে?
—আপনি এবং আপনার জুনিয়ার পার্টনার, মাধবরাজ।
—দ্যাটস ইমপসিবল! সোমবার আমার অনেক কাজ। তাছাড়া
—আই নো, আই নো! আপনারা দুজনেই অত্যন্ত কর্মব্যস্ত মানুষ। কিন্তু আপনাদের প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে আমি সাজেস্ট করব আপনারা দুজন আপনাদের সব জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে সোমবার ভোরের ফ্লাইটে কলকাতায় চলে আসবেন। এয়ারপোর্টে আমার লোক থাকবে, আপনাদের হোটেলে পৌঁছে দেবে। তারপর আদালতে নিয়ে আসবে।
বিজয়রাজ একটু দম ধরে বললেন, ‘প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে’ মানে?
—দেখুন মিস্টার জৈন, মক্কেলকে বাঁচাতে আমাকে সব রকম চেষ্টাই করতে হবে। আপনাদের তিনজনকে সাক্ষী হিসাবে পেলে আমার কাজটা সহজ হবে। না পেলে, আমাকে অন্য দিক থেকে অনুসন্ধান করতে হবে। আমাকে দেখতে হবে হীরালাল খুন হবার দু চারদিন আগে হঠাৎ কেন দুইলাখ টাকা আপনাদের ক্যাশে ঘাটতি হয়েছিল, কী ভাবে সে টাকা ভল্টে ফিরে আসে, কী কারণে আপনাদের ক্যাশে সচরাচর ঐ জাতীয় বিশাল টাকার অঙ্ক জমা থাকে। আপনাদের কেনাবেচার কত শতাংশ চেকে হয়। কতটা ক্যাশে। কেন বেচাকেনার সিংহভাগ নগদে হয়ে থাকে। ইত্যাদি …
বিজয়রাজ বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, কিন্তু আমরা তো কোনো অভিযোগ করিনি যে আমাদের ক্যাশে কখনো কোনও ঘাটতি হয়েছে, বা এখনো আছে।
—করেছেন। মৌখিকভাবে। আমার কাছে। প্রথমে আপনার পার্টনার বলেন দু-লাখ। পরে শুনলাম এক লাখ, এখন শুনছি ঘাটতি নেই। কিন্তু আপনার পার্টনারের মৌখিক অনুরোধে ঐ তহবিল তছরুপের ব্যাপারে ডি. আই. জি. নদার্ন রেঞ্জ লালবাজারে ফোন করেছিলেন, এটা ফ্যাক্ট। দুজন শাদা-পোশাকের পুলিশ সেই অনুসারে রিপন স্ট্রিটের হোটেল পান্নায় আমার মক্কেলকে জেরা করতে যায়, এটাও ফ্যাক্ট। তাই নয়?
—আপনি ঠিক কী চান বলুন তো?
—গিভ অ্যান্ড টেক। কিছু দেওয়া কিছু নেওয়া। আপনারা তিনজনে সোমবার সকালে আদালতে উপস্থিত হন। যাতে আমি চেষ্টা করতে পারি আপনাদের বিজনেসের ঐ সব খুঁটিনাটি আদালতে না আলোচিত হয়। বুঝতেই পারছেন তাতে ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে আপনার কম্পিটিটর ফার্ম সবাই অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে পড়বে—
—অল রাইট! য়ু উইন। সোমবার সকালে আমরা যাচ্ছি।
—তিনজনেই?
—আমার কথার নড়চড় হয় না, মিস্টার বাসু।
—থ্যাঙ্কু। অ্যান্ড গুড নাইট!