যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা – ১৪

১৪

দায়রা জজ রামেশ্বর গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে সেদিন কৌতূহলী মানুষের ভিড় মন্দ হয়নি। খবরটা মুখরোচকরূপেই সংবাদপত্রে প্রাকশিত হয়েছিল। হীরালাল ঘিসিং-এর হত্যা মামলার বিবরণ।

দায়রা জজ এজলাসে এসে বসলেন। আদালতের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে টেবিলের উপরে রাখা ফাইলটা তুলে নিয়ে বললেন, আজকের প্রথম মামলা হীরালাল ঘিসিং-এর অস্বাভাবিক মৃত্যু সম্পর্কিত। স্টেট ভার্সেস মিস চৈতালী বসু। প্রতিবাদী জামিন পাননি, এবং আদালতে উপস্থিত আছেন দেখছি। তাঁর তরফে ওকালতনামা দাখিল করেছেন ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু। ইজ দ্য ডিফেন্স রেডি, কাউন্সেলার?

বাসু ডান হাত তুলে গাত্রোত্থানের একটা উদ্যোগ দেখিয়ে বললেন, ইয়েস য়োর অনার

ওপাশ থেকে এ. পি. পি. শিবেন গুহও উঠে দাঁড়ান। বলেন, প্রসিকিউশনও প্রস্তুত, হুজুর। জজ সাহেব বললেন, অল রাইট। আপনি কি কোনও প্রারম্ভিক ভাষণ দিতে চান মিস্টার এ. পি. পি.?

একটি ‘বাও’ করে অ্যাডভোকেট গুহ বললেন, কেসটি জটিল নয় য়োর অনার। কোনও প্রারম্ভিক ভাষণ নিষ্প্রয়োজন। আদালত অনুমতি করলে আমি সরাসরি প্রথম সাক্ষীকে ডাকতে পারি।

—বেশ, ডাকুন।

বাসুসাহেবের কর্ণমূলে কৌশিক প্রশ্ন করে, বাদীপক্ষ প্রারম্ভিক ভাষণ না দিলে কি প্রতিবাদী পক্ষও দিতে পারেন না।

বাসু বললেন, থামো না বাপু। পরে জিজ্ঞেস কর। এখন শুধু শুনে যাও।

পুলিশপক্ষের প্রথম সাক্ষী স্কাইলার্ক অ্যাপার্টমেন্টের জনৈক লিম্যান : হরিকিষণ দোবে। শুক্রবার এগারোই ফেব্রুয়ারি রাত সাতটার সময় সেই প্রথম মৃতদেহ আবিষ্কার করে। এ. পি. পি. কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হয়ে সে নিজের পরিচয় দেয় এবং কীভাবে মৃতদেহ আবিষ্কার করে সে কথা বিস্তারিত জানায়। তার জবানবন্দি অনুযায়ী পোস্টাল পিয়ন স্কাইলার্ক অ্যাপার্টমেন্টের ঘরে ঘরে অথবা পৃথক পৃথক লেটার বাক্সে চিঠি ফেলে যায় না। সে কাজটা দুজন লিফটম্যানকে ভাগ করে করতে হয়। পোস্টাল পিয়ন একটা বড় লেটার বাক্সে সব চিঠি ঢেলে দিয়ে যায়। দোবে তালা খুলে সেগুলি ফ্লোর-ওয়াইজ সাজায়। যাঁদের নামে লেটার বাক্স আছে তাঁদের বাক্সে তাঁদের চিঠি ফেলে দেয়। ঘটনার দিন সন্ধ্যার ডাকে সাততলার বাসিন্দা হীরালাল ঘিসিং-এর নামে একটি চিঠি এসেছিল। হীরালাল ঘিসিং-এর কোনও লেটার বক্স নেই। অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানায় তাঁর চিঠিপত্র আসেও কদাচিৎ। এলে, লিম্যান ওঁর দরজার তলা দিয়ে চিঠিখানা ভিতরে ঠেলে দেয়। সেদিনও সে তাই করতে গিয়েছিল; কিন্তু ওর নজর হয় সদর দরজাটা বন্ধ নেই। ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে আছে। তাই সে বেল বাজায়। দু-তিন বার। কেউ সাড়া দেয় না। তখন সে ঠেলে দরজাটা খোলে। ঘর অন্ধকার। দেওয়ালের বাঁদিকে সুইচ বোর্ডটা কোথায় তা জানা ছিল দোবেজীর। সে আলোটা জ্বালে। তৎক্ষণাৎ দেখতে পায় বীভৎস দৃশ্যটা।

দোবেজী জানত পাশের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকেন একজন ডাক্তারবাবু। ঘটনাচক্রে তিনি বাড়িতে ছিলেন। দোবেজী তাঁকে ডেকে নিয়ে আসে। তিনি হীরালালকে স্পর্শমাত্র করেই বলেন, অনেকক্ষণ মারা গেছেন।

ডাক্তারবাবুর ঘর থেকেই আপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার এবং থানায় টেলিফোন করা হয়। পুলিশ এসে পৌঁছায় আধঘণ্টার মধ্যে।

শিবেন গুহ জিজ্ঞাসা করেন, হীরালাল ঘিসিংকে তুমি জীবিতাবস্থায় শেষ কখন দেখেছ?

—ওহি রোজ। সুবে করিব সাড়ে নও বাজে হজৌর। যব উন্‌হোনে দফতর গ্যয়ে—

—তারপর তিনি কখন ফিরে আসেন তা জান না? দেখনি?

—জী নহি।

শিবেন প্রশ্ন করেন, আসামীকে সাক্ষী পূর্বে কখনো দেখেছে কি না।

সাক্ষী বলে, হ্যাঁ দেখেছে। ঐ শুক্রবার এগারো তারিখেই, বেলা তিনটে সাড়ে তিনটার সময়। বর্ণনা দেয়, মাইজী নিচের বোর্ডে কোনও আবাসিকের নাম-ঠিকানা খুঁজছিলেন। দোবেজী তাঁকে প্রশ্ন করে জানতে পারে যে, তিনি হীরালালজীকে খুঁজছেন। সে মেয়েটিকে সাততলায় নামিয়ে দেয়। মাইজী কখন চলে যান তা সে জানে না। হয়তো তিনি লিফ্‌ট্ দিয়ে নামেননি।

শিবেন গুহ বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বলেন, য়োর উইটনেস।

বাসু বলেন, নো কোশ্চেন্স।

পরবর্তী সাক্ষী সাব-ইন্সপেকটার নৃপেন চৌধুরী। সে স্থানীয় থানা থেকে এসেছিল। সে জানায় যে, মৃতদেহ আবিষ্কার করা মাত্র সে লালবাজার হোমিসাইড সেকশনে খবর দেয়! আধঘণ্টা খানেকের মধ্যেই পুলিশ ফটোগ্রাফার আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টকে নিয়ে উপস্থিত হন হোমিসাইডের ইন্সপেক্টার কামাল হুসেন। তিনি কামরার একটি ম্যাপ আদালতে দাখিল করেন, বিভিন্ন আসবাবপত্রের অবস্থান দেখিয়ে। হীরালাল খাটের উপর কীভাবে পড়েছিল, তা এঁকে দেখানো হয়েছে। অনেকগুলি আলোকচিত্রকে সে দাখিল করে।

অ্যাডভোকেট গুহ প্রশ্ন করেন, আপনি কি ঘরের মেঝেতে আসামীর নামাঙ্কিত কোনো কিছু খুঁজে পান?

বাসুসাহেব আপত্তি দাখিল করেন : অবজেকশন য়োর অনার। লিডিং কোশ্চেন।

শিবেন বলেন, আমি আদালতের সময় সংক্ষেপ করতে চাইছি মাত্র। প্রশ্নটা আমি উইথড্র করে নতুনভাবে জানতে চাইছি: রক্তের মধ্যে আপনি অপ্রত্যাশিত কোনো বস্তু কি দেখতে পান?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। শিলিগুড়ির একটি লাইব্রেরির কোনও একজনের সভ্য-কার্ড।

—সেটি কি আপনি সঙ্গে করে এনেছেন? তাহলে কার্ডটা পড়ে দেখুন কার নামে ঐ সভ্যকার্ড ইস্যু করা হয়েছিল।

সাক্ষী তাঁর ব্রিফকেস খুলে প্লাস্টিকে জড়ানো একটি লাইব্রেরি কার্ড বার করে বলেন, এটি বর্তমান মামলার আসামী শ্রীমতী চৈতালী বসুর নামাঙ্কিত কার্ড। তাঁর এবং লাইব্রেরিয়ানের একাধিক স্বাক্ষর আছে।

বাসুসাহেবকে দেখিয়ে সেটি বাদীপক্ষের এগজিবিট হিসাবে আদালতে নথিবদ্ধ করা হল।

ইন্সপেক্টার কামাল হুসেনকেও বাসু কোনও প্রশ্ন করলেন না। এরপর ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট তাঁর সাক্ষ্যে জানালেন, ঐ ঘরে অনেকগুলি লেটেন্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট তিনি পেয়েছেন। হীরালালের, লিফটম্যান দোবেজীর এবং কয়েকটি অজানা ব্যক্তির।

—বর্তমান মামলার আসামী শ্রীমতী চৈতালী বসুর কোনও আঙুলের ছাপ কি পেয়েছেন?

—পেয়েছি। দুইটি। একটি বাথরুমের আয়নায় দ্বিতীয়টি ঐ ঘরের ডোর নবে। প্রথমটি আসামীর ডানহাতের মধ্যমার, দ্বিতীয়টি তাঁর ডানহাতেরই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের।

—আপনি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। যতগুলি পয়েন্ট অব সিমিলারিটি পাওয়া গেলে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়, তার চেয়ে বেশিই পাওয়া গেছে। আমি ফিঙ্গারপ্রিন্টের আলোকচিত্র সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছি। আপনারা চাইলে আদালতে দাখিল করতে পারি।

বাসুসাহেবের অনুমতি নিয়ে তাই করা হল।

এরপর সাক্ষী দিতে এলেন অটোন্সি-সার্জেন। তাঁর মতে মৃত্যুর কারণ একটি পয়েন্ট টু-টু রিভলভারের বুলেট। বাঁ-চোখের প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার উপরে তা কপালে আঘাত করে। তাতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।

— মৃত্যু কখন হয়েছিল বলে মনে হয়?

—আমার মতে ঘটনার দিন অর্থাৎ এগারোই ফেব্রুয়ারি বেলা দুটো থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে উনি মারা যান।

—গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে?

—না। আমার তা মনে হয় না। গুলিবিদ্ধ হয়ে হীরালালজী জ্ঞান হারিয়ে খাটের উপর লুটিয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁর হৃদপিণ্ডের কাজ বন্ধ হয় না অন্তর পনের মিনিট! না হলে এত রক্তপাত হত না। রক্ত বালিশ ভিজিয়ে মেঝেতে অনেকখানি জায়গা জুড়ে পড়েছিল।

—আপনি কি মৃতদেহের মস্তিষ্কের ভিতর থেকে বুলেটটি উদ্ধার করতে পেরেছিলেন?

—হ্যাঁ, দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে আমি তা ব্যালিটিক এক্সপার্টকে দিয়েছিলাম।

শিবেন গুহ এবার বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বললেন, আপনি এবার জেরা করতে পারেন।

বাসু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে বলুন, ডক্টর সান্যাল। আপনার মতে হীরালাল ঘিসিং যখন গুলিবিদ্ধ হন তখন আততায়ী তাঁর থেকে আন্দাজ কতটা দূরে ছিল?

—তা আমি কেমন করে জানব? হত্যামুহূর্তে আমি তো সেখানে উপস্থিত ছিলাম না।

তা ছিলেন না, কিন্তু এক্সপার্ট হিসাবে আপনি কি বলতে পারেন না যে, আততায়ীর রিভলভারটা ছয়-ইঞ্চি বা একফুট দূরে ছিল না?

—তা বলা যায়। কারণ অত কাছ থেকে ফায়ার হলে ক্ষতস্থানের আশেপাশে বারুদের চিহ্ন পাওয়া যেত।

—তার মানে দূরত্ব আন্দাজ মিটার খানেক হবে?

—হ্যাঁ। অন্তত মিটার-খানেক। তার বেশি হতে পারে, কম নয়।

—দ্যাটস্ অল য়োর অনার।

পরবর্তী সাক্ষী দমদমে বিমানপোতাশ্রয়ে অবস্থিত ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স কাউন্টারের মহিলা কর্মী। সে তার সাক্ষ্যে জানাল, আসামীকে সে ঘটনার দিন সন্ধ্যা সাতটা পনেরো মিনিট প্রথম দেখে। আসামী নাকি কাউন্টারে এসে জানতে চেয়েছিল সন্ধ্যা সাতটার বাগডোগরার প্লেনটা ছেড়ে গেছে কি না। আসামীর সঙ্গে তার যে কথোপকথন হয় তা সে বিস্তারিত জানায়। বাসু- সাহেব লক্ষ্য করলেন, চৈতালী তার জবানবন্দিতে যা বলেছিল এ মেয়েটি ঠিক তাই বলে যাচ্ছে। চৈতালী কিছু মিছে কথা বলেনি।

শিবেন গুহ জানতে চান, আপনি আসামীকে ভাল করে দেখুন। তারপর বলুন: মানুষ চিনতে আপনার ভুল হচ্ছে না তো? এঁকেই দেখেছিলেন সেদিন সন্ধ্যায়? ইনিই টি বোর্ডের চার্টার্ড প্লেনে রাত আটটায় বাগডোগরায় চলে যান?

—হ্যাঁ, তাই। মানুষ চিনতে আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। ওঁর যমজ ভাইয়ের অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে আমি ওঁকে বেশ লক্ষ্য করে দেখেছিলাম। তাছাড়া একটু পরে টী বোর্ডের অফিসার আমাকে জনান্তিকে যখন বললেন ….

—অবজেকশন, য়োর অনার। আসামীর অনুপস্থিতিতে সাক্ষীকে যেকথা তৃতীয় ব্যক্তি বলেন তা ‘হেয়ার-সে’।

—অবজেকশন সাসটেইন্ড।

এ. পি. পি. জানতে চান, চৈতালীর সঙ্গে লাগেজ কী ছিল?

—লাগেজ কিছুই ছিল না, ছিল শুধু একটা কালো ভ্যানিটি ব্যাগ।

—সেই ভ্যানিটি ব্যাগটিকে আপনি কি কোনো কারণে বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছিলেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার মনে হয়েছিল সেই ভ্যানিটি ব্যাগটায় ঠেলে ঠুলে এমন একটা কিছু ঢোকানো হয়েছে যার জন্য ওর শেপটাই বেঢপ হয়ে গেছে। আমার মনে হয়েছিল, সেটা একটা …

বাসুসাহেব বলে ওঠেন, অবজেকশন! সাক্ষীর অনুমান …

কিন্তু সাক্ষী সেকথায় কর্ণপাত না করে তার বাক্যটা শেষ করে : রিভলভার!

বিচারক প্রতিবাদীর আপত্তি মেনে নেন। মামলার নথি থেকে সাক্ষী-উচ্চারিত শেষ বাক্যটি কেটে বাদ দেওয়া হয়।

পরবর্তী সাক্ষী টি বোর্ডের সেই অফিসার, যাঁর অনুমতি অনুসারে চৈতালী সে রাত্রে চাটার্ড প্লেনের আরোহী হিসাবে দমদম থেকে বাগডোগরা যায়। তিনি ধুরন্ধর ব্যক্তি। বোধকরি আইনজ্ঞ। প্রতিবাদী ‘অবজেকশন’ দিতে পারেন এমন কথা তিনি আদৌ বললেন না; কিন্তু তাঁর সাক্ষ্যে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন আসামীকে তিনি প্রথম যখন ওঁদের সঙ্গে চাটার্ড প্লেনে বাগডোগরা যাবার অনুমতি দিলেন তার পরমুহূর্তেই ওঁর মনে হয়েছিল মেয়েটির ভ্যানিটি ব্যাগে এমন কিছু আছে যাতে সিকিউরিটি আপত্তি করবে। যাহোক, উনি অনুমতি দেবার পরেই মেয়েটি মহিলাদের চিহ্নিত টয়লেটে ঢুকে যায়। একটু পরে যখন সে টয়লেট থেকে বার হয়ে আসে তখন উনি লক্ষ্য করে দেখেন ভ্যানিটিব্যাগ ঐ রকম বিসদৃশভাবে বেঢপ হয়ে ছিল না।

পরবর্তী সাক্ষী এয়ারপোর্টের জনৈক জমাদার। সে তার সাক্ষ্যে জানালো যে, ঘটনার দিন রাত আটটার সময় সে লেডিজ টয়লেটের লিটার বিন থেকে একটি রিভলভার উদ্ধার করে। সে জানায়, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে যে দিদিমণি সে সময় বসেছিলেন তিনিই ওকে ঐ টয়লেটে লিটার বিনটা তল্লাশ করতে বলেছিলেন। সে আরও জানায় যে, দিদিমণির নির্দেশে সে এয়ারপোর্টের জনৈক সিকিউরিটি অফিসারকে মারণযন্ত্রটা হস্তান্তরিত করে।

পরবর্তী সাক্ষী এয়ারপোর্টের জনৈক সিকিউরিটি অফিসার। সার্জেন্ট পরেশ পাল। সে তার সাক্ষ্যে জানায় যে, ইন্ডয়ান এয়ারলাইন্স কাউন্টার থেকে জরুরি টেলিফোন পেয়ে সে ঐ কাউন্টারে এসে দেখে লেডিজ টয়লেটের লিটার বিন থেকে একটি রিভলভার পাওয়া গেছে। জমাদারের হাত থেকে সে যন্ত্রটা নেয়। চেম্বারটা খুলে দেখে ছয়টি বুলেটের একটি মাত্র ব্যয়িত, বাকি পাঁচটি স্বস্থানে রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি বুলেটই জলে ভেজা। যেটি ব্যয়িত বুলেট তার খালি কেসটা ইজেক্ট করা হয়নি। সার্জেন্ট পাল রিভলভারের নম্বরটা নোট করে নেয় এবং ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স কাউন্টারের মহিলাটিকেও বলে নম্বরটা তার ডিউটি বুকে টুকে রাখতে। এ. পি. পি. জানতে চান : রিভলভারটায় কি বারুদের গন্ধ পেয়েছিলেন?

—না। ময়লার টিনে থাকায় কিছু দুর্গন্ধই পাওয়া যাচ্ছিল।

—রিভলভারটিতে আর কিছু লক্ষ্য করেছিলেন কি?

—তখনই বোঝা যায়নি। পরে আমার ‘বস’-এর কাছে শুনেছি, ল্যাবরেটারিতে টেস্ট করে বোঝা যায় রিভলভারটা রক্তের মধ্যে অনেকক্ষণ পড়েছিল। তার চারদিকেই রক্তের চিহ্ন ছিল। শাদা চোখে তা দেখা যাচ্ছিল না; কিন্তু মাইক্রোস্কোপিক টেস্টে ধরা যাচ্ছিল।

—রক্তটা কোন্ জীবের তা কি পরীক্ষায় বোঝা গেছিল?

—অফ কোর্স। হিউম্যান ব্লাড—মানুষের রক্তই।

হেয়ার-সে অজুহাতে বাসুসাহেব কোনও আপত্তি দাখিল করেন না। সময় সংক্ষেপ করতে। যে বিজ্ঞানী পরীক্ষা করেছেন তাঁকে পুলিশ অনায়াসে আদালতে হাজির করতে পারবে।

—রিভলভারটা কি আপনি সঙ্গে করে এনেছেন?

— না! উপরওয়ালার নির্দেশে আমি সেটা হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে ব্যালিসটিক এক্সপার্টকে হস্তান্তরিত করে রসিদ নিয়েছিলাম।

এবারেও বাসু সাহেব জেরা করলেন না।

ব্যালিসটিক এক্সপার্ট জীতেন বসাক তাঁর সাক্ষ্যে জানালেন যে, কম্পারেটিভ মাইক্রস্কোপের পরীক্ষায় তিনি নিঃসন্দেহ হয়েছেন যে, হীরালাল ঘিসিং-এর মৃত্যুর হেতু যে বুলেট সেটি ঐ মারণযন্ত্র থেকেই নিক্ষিপ্ত। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ও আলোকচিত্র তিনি আদালতে দাখিল করলেন।

এ. পি. পি. জানতে চান, রিভলভারটির লাইসেন্স কার নামে তার কোনও খোঁজ কি পাওয়া গেছে?

—হ্যাঁ, পাওয়া গেছে। লাইসেন্সহোল্ডার ছিলেন আসামীর যমজ ভাই লেট হরিমোহন বসু।

এ. পি. পি. এবার বাসুসাহেবকে বললেন, আপনি জেরা করতে পারেন।

বাসু জানতে চান, আপনি কি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন হরিমোহন বসু কোন্ দোকান থেকে ঐ রিভলভারটি খরিদ করেছিল?

—হ্যাঁ, সে খোঁজও নিয়েছি আমরা। এটা রুটিন ব্যাপার। কোনও হত্যা মামলায় রিভলভার পাওয়া গেলে তার পূর্ণ ইতিহাস সংগ্রহ করা হয়। আমরা জেনেছি অস্ত্রটা কলকাতার সি. সি. বিশ্বাসের দোকান থেকে প্রায় তিন বছর আগে খরিদ করেন শিলিগুড়ির জৈন কিউরিও এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইম্পোর্ট কোম্পানি। তাঁদের কর্মচারী হরিমোহনের জন্য।

—তার মানে হরিমোহন ওটা নিজের টাকায় কেনেনি।

—আজ্ঞে না।

— তার মানে কি এই দাঁড়ালো যে, রিভলভারের লাইসেন্সটা কর্মচারী হরিমোহন বসুর নামে হলেও সেটার মালিকানা শিলিগুড়ির জৈন কিউরিও এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইম্পোর্ট কোম্পানির?

—তা আমি ঠিক জানি না।

—সে কী! মামলা খতম হলে রিভলভারটা কাকে ফেরত দেবেন? হরিমোহন বসুর ওয়ারিশকে না ঐ কোম্পানিকে?

—সেটা আমার জানার কথা নয়। আমার উপরওয়ালা স্থির করবেন সেটা।

—দ্যাটস অল, য়োর অনার।

এই পর্যায়ে এ. পি. পি. জানালেন যে, তাঁদের সাক্ষীর তালিকায় আর কেউ বাকি নেই।

দায়রা জজ বললেন, নুন রিসেস-এর সময় হয়ে গেছে। ও-বেলা আমার কিছু রুটিন কেস আছে। কাল-পশু আদালত বন্ধ। সোমবার বেলা দশটায় যদি পরবর্তী হিয়ারিঙ-এর দিন ধার্য করা হয় তাহলে আপনাদের আপত্তি নেই নিশ্চয়?

দু পক্ষই রাজি হলেন। আদালত বন্ধ হয়ে গেল। চৈতালী ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে জামিন পায়নি। তাকে জেনানা ফাটকে যেতে হল। যাবার আগে বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বললে, কী বুঝছেন?

—হতাশ হবার কিছু নেই। অপরাধটা তুমি যখন করনি তখন ভয় কী? বেকসুর ছাড়া পাবে নিশ্চয়।