১৩
পরদিন সকালে লালবাজার হোমিসাইড সেকশন থেকে বাসুসাহেব একটি ফোন পেলেন, সরি টু ডিসটার্ব য়ু স্যার, কাল হোটেল পান্নায় যখন জানতে চেয়েছিলুম, মিস চৈতালী বসু আপনার মক্কেল কি না, তখন আপনি বলেছিলেন ‘নো কমেন্টস’ অথচ আজ লক-আপে ঐ মিস বসুই বলছেন যে, আপনি ওঁর অ্যাটর্নি। আপনার উপস্থিতি ভিন্ন উনি আমাদের কোনও প্রশ্নের জবাব দেবেন না। এখন আমরা কী করি বলুন, স্যার?
বাসু বললেন, ‘হোল টুথ অ্যান্ড নাথিং বাট দ্য ট্রুথ’ বলা অভ্যাস করুন। কাল যখন আপনি জানতে চেয়েছিলেন চৈতালী আমার মক্কেল কি না তখন আপনি জানাতে চাননি চার্জটা কী। কী কারণে তাকে খুঁজছেন। আজ গ্রেফতারের পর কি সেটা দয়া করে জানাবেন?
—ইয়েস স্যার। ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার চার্জ। হীরালাল ঘিসিংকে।
—ধন্যবাদ! সে ক্ষেত্রে চৈতালী আমার মক্কেল। আমি আধঘণ্টার ভিতরেই আসছি।
.
জেল-হাজতের একাত্তে আবার দেখা হল মেয়েটির সঙ্গে। কেঁদে কেঁদে এখনো তার চোখ দুটি লাল হয়ে আছে। বাসু জানতে চাইলেন, শিলিগুড়ি থেকে আসবার সময় পুলিশ কি কিছু দুর্ব্যবহার করেছে? এ কী চেহারা হয়েছে তোমার!
চৈতালী মাথা নেড়ে বললে, না। এমনিতেই হরির মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলাম। সামলে উঠতে না উঠতে এই হয়রানি। তাতেই হয় তো আমাকে পাগলী-পাগলী দেখাচ্ছে।
—তুমি কি পুলিশের কাছে কোনও জবানবন্দি দিয়েছ?
—না। আপনি তো প্রথম দিনই বারণ করেছিলেন।
—তা করেছিলাম। কিন্তু তুমি তো আমার সব নিষেধ মেনে চল না, চৈতালী। আমি তোমাকে বলেছিলাম হোটেল পান্না থেকে শেয়ালদহ স্টেশনে ট্যাক্সি করে যেতে। সেখানে ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে। তারপর একটা ফ্লাইং ট্যাক্সি ধরে দমদম চলে যেতে। তা তো তুমি যাওনি চৈতালী। তুমি প্রথম সুযোগেই চলে গেলে লিটল রাসেল স্ট্রিটে। কেন?
চৈতালী জবাব দিল না। গোঁজ হয়ে বসে রইল।
বাসু বললেন, তুমি বুদ্ধিমতী। সব কথা যদি আমাকে খুলে না বল তাহলে আমি কেমন করে তোমার কেস ডিফেন্ড করব, বল? তুমি হীরালালের অ্যাপার্টমেন্টে গেছিলে। না?
চৈতালী স্বীকার করল।
— তুমিই তাকে খুন করেছ?
সোজা হয়ে বসল চৈতালী। বলল, নিশ্চয় নয়!
—তাহলে?
আবার চুপ করে যায়।
বাসু বলেন, অল রাইট। আমি বলছি, তুমি শুনে যাও। যদি ভুল কিছু বলি তুমি প্রতিবাদ কর। ঠিক এক্ষণি যেমন বললে : নিশ্চয় নয়! কেমন?
অশ্রুআৰ্দ্ৰ দুটি চোখ মেলে চৈতালী তাকিয়ে থাকে।
—তুমি সন্ধ্যার ফ্লাইটটা ধরতে পারনি এজন্য নয় যে, তোমার মনে হয়েছিল কেউ তোমাকে ফলো করছে। আমি হীরালালের নাম-ঠিকানা তোমাকে বলে গেছিলাম। তুমি ভেবেছিলে দমদমে প্লেন ধরার আগে নিজেই একবার হীরালালের সঙ্গে দেখা করবে। তোমার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকার অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকটা তখন ছিল। তুমি ভেবেছিলে সেটা দেখিয়ে ওকে বলবে টাকার অভাব তোমার নেই; তবে ধীরে-ধীরে-মেটাবে। তুমি ওর কাছে কিছু সময় চেয়ে নেবে। তাই নয়?
এবার উপর-নিচ মাথা নেড়ে মেয়েটি স্বীকার করল।
—তাহলে তাই চাইলে না কেন? হীরালাল রাজি হল না?
হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে চৈতালী।
অনেক সান্ত্বনা দিয়ে, অনেক মিষ্টি কথা বলে ধীরে ধীরে ওর জবানবন্দিটা সংগ্রহ করলেন বাসুসাহেব। হ্যাঁ, সে ভেবেছিল হীরালালকে রাজি করাতে পারবে। হীরালালজীর ‘রাখী-বহিন’ রঞ্জনা ওর বিশেষ বন্ধু। প্রয়োজন হলে রঞ্জনাকে দিয়ে রাজি করাবে। হরি যখন টাকাটা ওকে দিতেই আসছিল তখন টাকাটা দিয়ে দেওয়াই মঙ্গল, অন্তত কিছু সময় চেয়ে নিয়ে চেষ্টা করতে দোষ কী?
স্কাইলার্ক অ্যাপার্টমেন্ট মস্ত প্রাসাদ। দুদিকে দুটো লিফট্। চৈতালী যখন ওখানে গিয়ে পৌঁছায় তখন বেলা সওয়া তিনটে। এলাকাটা ফাঁকা ফাঁকা। তবে লিফ্যান ছিল। চৈতালী নিচের বোর্ডে হীরালাল ঘিসিং-এর অ্যাপার্টমেন্ট নম্বরটা খুঁজছিল। লিফটম্যান নিজে থেকেই জানতে চাইল, নাম কেয়া? বাধ্য হয়ে ওতে বলতে হল নামটা, লিফটম্যান বললে, আইয়ে। সাত তলা। তিন নম্বর অ্যাপার্টমেন্ট।
সাততলায় প্যাসেজে নেমে চৈতালী জনমানব দেখতে পেল না। লিফটা নেমে গেল। করিডর দিয়ে একটু এগিয়েই দেখল একটা দরজায় তিন নম্বর লেখা। চৈতালী বার দুই বেল বাজায়। কোন সাড়া জাগে না। তবে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল। ও ঘরের ভিতরে ঢুকে একবার বলে, ভিতরে কে আছেন? শুনছেন?’
ভিতরটা আলো-আঁধারী। পর্দাগুলো টানা। হঠাৎ ওর নজর হয় ঘরের ও প্রান্তে একটা খাটে চিত হয়ে কে যেন শুয়ে আছে। ও কাছে এগিয়ে যেতে গিয়ে দেখল মেঝেটা পিছল। রক্ত। তখনই ও বুঝতে পারল লোকটা চিত হয়ে শুয়ে নেই। মরে গেছে।
বাসু জানতে চাইলেন, তুমি কী করে বুঝলে লোকটা মরে গেছে?
—ওর গায়ে হাত দিয়ে। একেবারে ঠাণ্ডা!
—তারপর?
—আমি পালিয়ে এলাম।
—না, চৈতালী! ঐ সময় তুমি তোমার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলেছিলে। না হলে তোমার ব্যাগ থেকে লাইব্রেরি কার্ডটা ও ঘরে পড়ে থাকত না। কেন খুলেছিলে ব্যাগ?
—ব্যাগ খুলেছিলাম? তা হবে। হয়তো রুমাল বার করতে। কপালের ঘাম মুছতে।
বাসুসাহেব ধমকে ওঠেন, অহেতুক মিছে কথা বল না, চৈতালী। সেই মর্মান্তিক মুহূর্তে কপালের ঘাম মুছবার প্রয়োজন হলে তুমি আঁচল ব্যবহার করতে, রুমাল নয়। বল? কেন খুলেছিলেন তোমার হাতব্যাগ?
—কী আশ্চর্য! আমি আদৌ ব্যাগ খুলেছিলাম কি না তা আমার মনেই পড়ছে না।
—তাহলে শিলিগুড়ি-লাইব্রেরির মেম্বারশিপ কার্ডটা ও ঘরে পাওয়া গেল কী করে? ও ঘরে ঐ মর্মান্তিক মুহূর্তে তুমি তোমার হাতব্যাগ খুলতে পার দুটো হেতুর যে কোন একটাতে। হয় রিভলভারটা ব্যাগ থেকে বার করতে, অথবা সেটা ভিতরে ঢোকাতে। বল, কোনটা?
—ওটা ব্যাগে ঢোকাতে।
—দ্যাটস্ বেটার। ওটা মেঝেতে পড়েছিল?
—হ্যাঁ। রক্তের মধ্যে।
—তুমি কী করে চিনতে পারলে যে ওটাই হরির রিভলভারটা?
চৈতালী স্বীকার করল, দেখেই ও চিনতে পেরেছিল। তুলে নিয়ে ও সংলগ্ন বাথরুমে যায়। আলো জ্বেলে নম্বরটা দেখে। বুঝতে পারে এটাই হরির হারানো রিভলভারটা। সেটাকে জলে ধুয়ে নিয়ে ও হাতব্যাগে ভরে ফেলে। ফেরার সময় ও লিফট্ দিয়ে নামে না। সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নামে। আর কারও সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। তারপর ও একটা ট্যাক্সি নিয়ে দমদমের দিকে যায়। মাঝপথে একটা টেলিফোনের বুথ দেখতে পেয়ে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দেয়। শিলিগুড়িতে ফোন করে। ডাক্তার সামন্তের সঙ্গে ওর কথা হয়। সামত্ত নাকি ওকে ধমকের সুরে শিলিগুড়ি ফিরে যেতে বলেন। হরি কেমন আছে জানতে চাওয়ায় রূঢ় স্বরে বলেন, এখনো বেঁচে আছে।
এই প্রথম ওর মনে হল হরি তাহলে বাঁচবে না। হরি যে মারা যেতে পারে এটা—কী জানি কেন –-ওর অন্তর থেকে বিশ্বাস হয়নি। যদিও ডাক্তারবাবু বলেছিলেন কেসটা খুবই খারাপ।
ডাক্তারবাবুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর চৈতালী সামনের পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে বসেছিল। কতক্ষণ সেখানে বসে বসে আবোল-তাবোল চিন্তা করেছে তা ওর মনে নেই। ইতিমধ্যে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ওকে পার্কের বেঞ্চিতে ঐভাবে অনেকক্ষণ একা সে থাকতে দেখে হঠাৎ একজন গুণ্ডামতো লোক ঘনিয়ে এসে বেঞ্চির অপরপ্রান্তে বসে। তখনই সংবিত ফিরে পায় চৈতালী। দেখে, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বাজে। তৎক্ষণাৎ ও ট্যাক্সি নিয়ে দমদমে এয়ারপোর্টের দিকে ছোটে; কিন্তু ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স কাউন্টারে গিয়ে খবর পায় বাগডোগরার প্লেন মিনিট দশেক আগে ছেড়ে গেছে।
চৈতালী দিশেহারা হরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে, কাউন্টারে তখন লোকজন বিশেষ ছিল না। এয়ারলাইন্স-এর কাউন্টারে বসা মেয়েটি জানতে চায়, ওর কী হয়েছে। কেন এভাবে ভেঙে পড়েছে সে।
চৈতালী তাকে জানায় যে, দুনিয়ায় তার কেউ নেই একমাত্র আছে এক যমজ ভাই। ও খবর পেয়েছে যে, সেই ভাইটি শিলিগুড়ি হাসপাতালে মরণাপন্ন। মটোর অ্যাকসিডেন্ট কেস। এইমাত্র ডাক্তারবাবুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। আজ রাত্তিরটা কাটে কি না কাটে।
কাউন্টারের মেয়েটির করুণা হয়। ওকে অপেক্ষা করতে বলে। বলে, দেখি আপনার জন্যে কী করতে পারি।
চৈতালী বলে, কী আর করবেন! বাগডোগরা যাবার প্লেন তো আবার কালকে পাব।
—জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি। কথা দিতে পারছি না, কিন্তু …
নিতান্তই ভাগ্য। উত্তরবঙ্গে টী-বোর্ড আর টী-প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে কী একটা অধিবেশন হচ্ছে। এজন্য ঐ সংস্থার তরফে একটা ছোট প্লেন চার্টার্ড করা হয়েছে। কাউন্টারের মেয়েটি তা জানত। সেটা রাত আটটায় ছাড়বে। ছোট প্লেন ত্রিশজনের আসন; কিন্তু ওঁরা যাচ্ছেন মাত্র তেইশ জন। ফলে স্থানাভাব হবে না। তবে অনুমতি জোগাড় করতে হবে।
কাউন্টার গার্ল মেয়েটি সত্যিই ভাল। যাঁরা প্লেনটা চার্টার করেছেন তাঁদের বড় কর্তাকে গিয়ে চৈতালীর বিপদের কথা সে জানায়। ইন্ডিয়ান টি বোর্ড-এর বড়কর্তার দয়া হয়। তিনি ওকে তাঁদের প্লেনে তুলে নিতে রাজি হয়ে যান। চৈতালী জানতে চেয়েছিল তাকে ভাড়া বাবদ কী দিতে হবে। জবাবে ওঁরা জানান যে, যেহেতু প্লেনে এখনো পাঁচ-ছয়টি ফাঁকা আসন আছে এবং যেহেতু চৈতালীর জন্য ওঁদের সংস্থাকে বাড়তি কিছু খরচ করতে হচ্ছে না, ফলে ওঁরা চৈতালীর কাছ থেকে কিছুই নেবেন না। চৈতালী ঐ প্লেনেই বাগডোগরা চলে আসে। ওঁদের একটি গাড়ি শিলিগুড়ি হাসপাতালের দিকে আসছিল। তাতেই ওঁরা চৈতালীকে লিফ্ট্ দেন। রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ চৈতালী হাসপাতালে এসে পৌঁছায়। হরিমোহন তখনো বেঁচেছিল, যদিও তার জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান ওর আদৌ হয়নি এই কয়দিনে।
বাসু জানতে চাইলেন, তোমার স্টেটমেন্ট অনুযায়ী যখন তুমি দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছাও তখনো তোমার ভ্যানিটি ব্যাগে ছিল হরিমোহনের রিভলভারটা। সিকিউরিটি চেকিং-এর আগে সেটা নিশ্চয় তুমি সরিয়ে ফেলেছিলে। কোথায়?
—লেডিজ টয়লেটে লিটারবিনে!
জেলখানার মেট্রন এগিয়ে এসে বলল, আপনাদের কথা কি এখনো শেষ হয়নি? সময় কিন্তু হয়ে গেছে, স্যার।
বাসু উঠে দাঁড়ান। বলেন, না, আমাদের কথাবার্তা শেষ হয়ে গেছে।
চৈতালীর দিকে ফিরে বলেন, মনকে শক্ত কর চৈতালী। আমাদের শেষ পর্যন্ত লড়তে হবে!
চৈতালী নতনয়নে নীরব রইল।