যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা – ১২

১২

দমদম এয়ারপোর্টে ডোমেটিক অ্যারাইভাল দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল কৌশিক। রাত তখন নয়টা। ডিকিতে ওঁর সুটকেসটা তুলে দিয়ে কৌশিক রওনা হল নজরুল সরণি ধরে। জিজ্ঞাসা করল, ও দিকে কিছু সুরাহা হল?

—না, সুরাহা কিছু হয়নি। তবে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা গেছে। কিছু দুঃসংবাদও আছে — হরিমোহন কাল মারা গেছে।

—আর চৈতালী?

—হ্যাঁ, তার পাত্তা পাওয়া গেছে। আরও জানা গেছে ঘাটতির পরিমাণ দুই লাখ নয়। এক লাখ। কারণ সিনিয়ার পার্টনার স্বীকার করেছেন কাউকে কিছু না বলে তিনি এক লাখ টাকা ক্যাশ থেকে বার করেছিলেন। ফেরত দিয়েছেন।

—ওমা! এমনও হয় নাকি?

—হয়। ওদের কারবারটা অদ্ভুত। এদিককার খবর কী বল?

—সুজাতার ধারণা সে নজরবন্দি হয়ে আছে। সে ফোন করেছিল নিজে থেকেই। একবার দুপুরে ট্যাক্সি নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরেছিল। ওর মনে হল কেউ ওকে ক্রমাগত অনুসরণ করে চলেছে একটা জিপে চেপে।

বাসু বললেন, ঠিক আছে। তুমি সরাসরি হোটেল পান্নায় চল। আমাকে নামিয়ে দিয়ে লিটল রাসেল স্ট্রিটে গিয়ে হীরালাল ঘিসিং-এর সঙ্গে দেখা কর। আমার নাম করে বল, তার রাখী বহিন রঞ্জনা থাপার একটা প্রচণ্ড বিপদের আশঙ্কা করছি আমি। রঞ্জনাকে একটা বিষয়ে সাবধান করা দরকার। রঞ্জনার ঠিকানা অথবা টেলিফোন নাম্বারটা সংগ্রহ করার চেষ্টা কর।

কৌশিক ওঁকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল লিটল রাসেল স্ট্রিটের দিকে। বাসু উঠে এলেন লিফটে করে 315 নম্বর ঘরে। কোড-নক্-এর সঙ্কেত জানানোই ছিল। সুজাতা দরজা খুলে দিল।

বাসুকে দেখে নিশ্চিন্ত হল সুজাতা। বলল, আমার এই বিনাশ্রম কারাদণ্ডের মেয়াদ কখন কাটবে?

—এখনই। পুলিশ আর চৈতালীকে খুঁজছে না। সে আছে শিলিগুড়িতে। তুমি গুছিয়ে নাও। চল, চেক-আউট করে আমরা বেরিয়ে যাই।

—আমি চেক-আউট করব চিত্রলেখা ব্যানার্জির পরিচয়ে?

—অফ কোর্স। এ ঘরটা তো চিত্রলেখার নামে বুক করা।

—কিন্তু আমার সই হয়তো মিলবে না।

—ন্যাচারালি। কিন্তু এ তো আর চেক নয়। চিত্রলেখার নামটা লিখে দিলেই হবে। টাকা যখন তুমি নগদে মিটিয়ে দিচ্ছ তখন ওরা সই মেলাবে না। তাছাড়া আমি তো সঙ্গে থাকবই।

ঠিক তখনই কে যেন কড়া হাতে দরজায় করাঘাত করল। বাসু বললেন, ঘরটা তোমার নামে ভাড়া নেওয়া…

সুজাতা এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। দুজন শাদা পোশাকের পুলিশ অফিসার প্রবেশ করল ঘরে। সেদিনের সেই দুজন নয়। একজন একটা কার্ড বাড়িয়ে ধরল সুজাতার দিকে। বললে, এটা আপনার? খোয়া গেছিল?

সুজাতা হাত বাড়িয়ে প্লাস্টিক খাপে মোড়া ছোট্ট কার্ডটা নিল। সুজাতা জবাব দেবার আগেই পুলিশ অফিসারের নজর পড়ল বাসুসাহেবের দিকে। সুজাতাকে জিজ্ঞেস করে, এ ভদ্রলোকটি কে?

সুজাতা বললে, আপনি দুটি প্রশ্ন পর-পর করেছেন। কোনটার জবাব আগে চান? বলতে বলতেই সে লাইব্রেরি-কার্ডটা বাসুসাহেবের হাতে গুঁজে দেয়। বাসু দেখলেন সেটা হাতে নিয়ে। ‘শিলিগুড়ি কেন্দ্রীয় সাধারণ পাঠাগার’ -এর মেম্বারশিপ কার্ড। চৈতালী বসুর নামাঙ্কিত।

অফিসারটি বললে, অলরাইট, প্রথমে প্রথম প্রশ্নটার জবাব দিন, এটা আপনার কার্ড? আপনি শিলিগুড়ি সাধারণ পাঠাগারের সভ্য?

বাসু বললেন, অফিসার! এ প্রশ্ন আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন?

অফিসার বাসুসাহেবের মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়ায়। বলে, আপনি কে মশাই হরিদাস পাল? পুলিশি তদন্তে নাক গলাচ্ছেন?

বাসু বললেন, কারেক্ট। পুলিশি তদন্ত! আপনারা তাহলে শাদা-পোশাকি পুলিশ-পুঙ্গব। তা অপরাধটা কী জাতীয় সে কথা তো বলতে হবে। অর্থাৎ ঐ মেয়েটিকে কোন্ অপরাধে অভিযুক্ত করতে চান ওর জবাব শুনে?

— আপনি কি উকিল?

—আজ্ঞে না, উকিল নই আমি। কিন্তু আপনি তো হবুচন্দ্র লালবাজারের গবুচন্দ্র পুলিশ নন; আপনার তো জানা উচিত প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের সীমা।

এতক্ষণে দ্বিতীয় অফিসারটি এগিয়ে আসে। প্রথম অফিসারকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে, সরি মিস্টার বাসু। আমার সঙ্গী আপনাকে চিনতে পারেনি। ইয়েস, আমরা দুজন হোমিসাইড থেকে আসছি। এ মহিলাটি নিশ্চয় আপনার মক্কেল। আমরা এখনই ওঁকে গ্রেপ্তার করছি না; আমরা কিছু খবর সংগ্রহ করতে এসেছি মাত্র। কথা বলতে বলতেই অফিসারটি তার ইনসাইড পকেট থেকে সনাক্তিকরণ কার্ডটা বার করে বাসুসাহেবকে দেখালো।

বাসু বললেন, ও. কে.! হোমিসাইড! তা খুনটা কে হয়েছে?

প্রথম অফিসার বললে, সেকথা বলতে আমরা বাধ্য নই!

বাসু বললেন, কারেক্ট! সেটা আপনাদের পুলিশি অধিকার। যেমন এই মেয়েটির সাংবিধানিক অধিকার কোনও প্রশ্নের জবাব না দেওয়া। যতক্ষণ আপনারা না জানাচ্ছেন যে কে খুন হয়েছে!

—কেন? ওঁর লিগল কাউন্সেল তো হাজির?

—সে তো আপনারা ধরে নিয়েছেন। উনি বা আমি তো তা বলিনি। আপনারা সহযোগিতা না করলে আমরাও করব না।

দ্বিতীয় অফিসার প্রথমকে ধমক দেন, তুমি চুপ করবে, দত্ত? কথাবার্তা যা বলার তা আমাকে বলতে দাও। ইয়েস স্যার, খুন হয়েছেন হীরালাল ঘিসিং, কাল বিকালে বা সন্ধ্যায় লিটল রাসেল স্ট্রিটে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। একটি মাত্র বুলেট উন্ড। এবার কি আমরা আমাদের প্রশ্নের জবাবটা পাব? উনি আপনার মক্কেল তো?

বাসু বললেন, হ্যাঁ, ও আমার লোক। তুমি তোমার আইডেন্টিটি কার্ডটা ওঁদের দেখাও, সুজাতা।

সুজাতা হাত বাড়িয়ে তার ভ্যানিটি ব্যাগটা খুলবার উপক্রম করতেই অফিসারটি ঝাঁপিয়ে পড়ে বাধা দিল। বললে, ধীরে, দিদি, ধীরে। আমি ব্যাগটা এক নজর দেখে নিই প্রথমে।

ব্যাগটা সে খুলল না। তপসে মাছের পেট টিপে খদ্দের যেমন বুঝে নেয় সেটা ‘অ্যান্ডালা’ কি না, সেভাবে অফিসারটি সমঝে নিল ব্যাগের ভিতরে পিস্তল আছে কি না। বলল, এবার দেখান।

সুজাতা তার ব্যাগ থেকে সনাক্তিকরণ কার্ডটা বার করে দেখাল। লালবাজারের ছাপ মারা সুকৌশলী ডিটেকটিভ এজেন্সির পার্টনারের আইডেন্টিটি কার্ড।

বাসু বললেন, একটা অপরাধের বিষয়ে তদন্ত করতে আমি সুজাতাকে এই ঘরটিতে লুকিয়ে থাকতে বলেছিলাম চিত্রলেখা ব্যানার্জির ছদ্ম পরিচয়ে …

—আর চিত্রলেখা ব্যানার্জি হচ্ছে শিলিগুড়ির বাসিন্দা শ্রীমতী চৈতালী বসুর ছদ্মনাম। তাই তো?

—আমি সে কথা বলিনি।

—আপনার বলার অপেক্ষায় আর নেই ও তথ্যটা। এবার বরং বলুন সুকৌশলীর সুজাতাকে কী কারণে এই হোটেলে আপনি ছদ্মনামে লুকিয়ে থাকতে বলেছিলেন?

—নো কমেন্টস।

— শিলিগুড়ির শ্রীমতী চৈতালী বসুও নিশ্চয় আপনার মক্কেল?

—প্রশ্নটা উঠছে কেন? শিলিগুড়ির শ্রীমতী চৈতালী বসুকে কি আপনারা কোন কারণে খুঁজছেন?

—লুক হিয়ার মিস্টার বাসু। পুলিশ যখন তদন্তে আসে তখন প্রশ্ন তারাই করে। জবাব দেয় না। এবার বলুন, চৈতালী বসু কি আপনার মক্কেল?

—নো কমেন্টস।

—অলরাইট, স্যার। শুনে রাখুন: হীরালাল ঘিসিং-এর হত্যাকাণ্ডের জন্য আমরা চৈতালী বসুকে খুঁজছি। আপনাকে জানিয়ে রাখছি – তার পূর্বে আপনি যদি তার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন তবে সেটাকে পুলিশের কাজে বাধা দান করা হচ্ছে বলে গণ্য করা হবে।

বাসু কোনও জবাব দিলেন না। ওরা দুজন চলে যেতেই বাসু টেলিফোনটা তুলে নিলেন। বললেন, দিস্ ইজ রুম নম্বর 315, আমাকে শিলিগুড়ির একটা নম্বর দিন এস. টি. ডি.-তে।

—315 স্যার? ও ঘরটা তো মিস্ ব্যানার্জি বুক করেছেন।

—হ্যাঁ তাই। এই নিন্, মিস্ ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলুন। বাসু রিসিভারটা সুজাতার হাতে দিলেন।

টেলিফোন অপারেটার বললে, সরি ম্যাডাম! পুলিশের অর্ডারে এই ফোন থেকে কোনও আউটস্টেশন কল করা যাবে না। আপনি নিচে নেমে এসে এখন থেকে ফোন করতে পারেন।

সুজাতা বলল, দরকার নেই। সেক্ষেত্রে আমি এখনই চেক-আউট করব। আমার বিলটা রেডি রাখুন।

— ইয়েস মিস ব্যানার্জি।

—মিস ব্যানার্জি নয়। মিস চিত্রলেখা ব্যানার্জি আমাকে টাকা মিটিয়ে দিয়ে অনেক অগেই চলে গেছেন। আমি তাঁর তরফে পেমেন্টটা করছি মাত্র। আমার নাম মিসেস সুজাতা মিত্র। আজ্ঞে হ্যাঁ … লালবাজারের পুলিশ তা জানে।

টেলিফোন রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সুজাতা।

সুজাতাকে বাসু বললেন, লেটস্ গো।