১১
বেলা দুটোর সময় টেলিফোন করল মেয়েটি।
—হ্যাঁ, বলো, সুমিত্রা। তুমি কখন আসতে পারবে?
—আপনার অসুবিধা না হলে এখনি। আমাদের অফিসে একটার সময় ছুটি হয়ে গেছে। চৈতালীর অনুপস্থিতিতেই আমরা এক্ষুনি একটা ছোট্ট কনডোলেন্স মিটিং শেষ করলাম।
—তুমি যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছ সে কথা অফিসের আর কেউ জানে কি?
—আজ্ঞে না।
—ও. কে.! চলে এস। আমি অপেক্ষা করব।
একটু পরেই সুমিত্রা এল নূরজাহান হোটেলে।
বাসু বললেন, কী খাবে বল? আমি তোমার অপেক্ষায় এখনো লাঞ্চ সারিনি।
—ওমা! সে কী কথা! আমি তো সকালে ভাত খেয়ে অফিসে এসেছি।
—এতক্ষণে তা হজম হয়ে গেছে। বস, অর্ডার দিই।
বাসু খাবারের অর্ডার দিলেন। ঘরেই। খেতে খেতে কথাবার্তা হতে থাকে। সুমিত্রার বিশ্বাস : দুই পার্টনারের অগোচরে একটা তৃতীয় পাপচক্র অফিসে কাজ করছে। তারাই তহবিল থেকে এক লাখ টাকা সরিয়েছে। চৈতালী বেচারি মাঝখান থেকে ফেঁসে গেছে। চৈতালী টাকা সরিয়েছে এটা ওরা কেউই বিশ্বাস করে না। তবে মরণাপন্ন ভাইকে হাসপাতালে ফেলে রেখে তার রাতারাতি কলকাতা চলে যাওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণও ওরা কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। সে সত্যিই কোনও হোটেলে ছদ্মনামে উঠেছিল কি না তা সুমিত্রা জানে না। অফিসের কেউ তা বিশ্বাস করে না।
বাসু ফিশ ফিঙ্গারের প্লেটটা ওর দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, কিন্তু চৈতালী না নিলে ক্যাশ থেকে একলাখ টাকা কে সরালো? মাধবরাজ? যেহেতু বিজয়রাজ অনুপস্থিত?
সুমিত্রা লাইম-উইথ-জিন-এ একটা চুমুক দিয়ে এক পিস ফিশ ফিঙ্গার তার ম্যানিকিওর করা আঙুলে তুলে নিয়ে বললে, দেখুন স্যার, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না মাধবরাজজী একলাখ টাকা সরিয়েছেন। কেন সরাবেন বলুন? টাকা তো তাঁরই। বিজয়রাজ বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান। দু’দিন পরেই তো মাধবই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হয়ে পড়বেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর স্ত্রী নেপাল রাজপরিবারের মেয়ে। বাপের একমাত্র সন্তান। সেই সূত্রেও হয়তো কোটি টাকা আসবে ওঁর হাতে। উনি কেন মাত্র একলাখ টাকা সরিয়ে ছুঁচো মেরে হাতে গন্ধ করবেন?
বাসু বললেন, ঠিক কথা। যুক্তিসঙ্গত কথা। কিন্তু তোমার মতে চৈতালী চুরি করেনি, করতে পারে না। বিজয়রাজ অনুপস্থিত। তিনি যাবার সময় বেহিসাবী এক লাখ টাকা নিয়ে গেছিলেন, ফিরে এসে জমা দিয়েছেন। তাহলে বাকি এক লাখ টাকা ভল্ট থেকে উড়ে গেল কীভাবে? যুক্তিসঙ্গত কারণ তো কিছু দেখাবে?
—দেখাব। শুনুন। মাধবরাজের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর ঝগড়া-ঝাঁটি লেগেই থাকে। শুনেছি, মাঝে মাঝে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়। কোন কোন দিন মাধবরাজ সন্ধ্যার পর থেকে প্রচুর মদ্যপান করেন। বেহুঁশ হয়ে গেলে ওঁর দুজন খানসামা ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। দু-একবার এমনও হয়েছে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে উনি হোটেলে গিয়ে রাত কাটিয়েছেন। সেই সব সুযোগে যখন মাধবরাজ বেহুঁশ তখন তাঁর খানসামা বা ড্রাইভার অনায়াসে ওঁর চাবির গোছা থেকে ক্যাশভল্ট চাবির মোমের ছাপ তুলে নিয়ে থাকতে পারে
—পারে। কিন্তু কম্বিনেশন নম্বরটা?
—ওটা আমরা বুঝতে পারিনি।
—এই কোড-নাম্বারটা কখনো শুনেছ : 3, 62, 436
—হ্যাঁ শুনেছি। এটা কোন একজন এজেন্টের কোড নম্বর।
—এজেন্ট। কিসের এজেন্ট?
—এখানে যেসব কেনাবেচা হয় তা, সবসময় সরলপথে আসে না। কিছু স্মা, কিছু চোরাই মালও হাত ফিরি হয়। যারা করে, তাদের নাম-ধাম খাতাপত্রে থাকে না। মালিকরা। জানেন। তাঁদের চিঠিপত্র আসে ‘কনফিডেন্সিয়াল’ ছাপ মারা, গালা-মোহর করা খামে। স্পিড পোস্টে, রেজিস্ট্রি ডাকে অথবা কুরিয়ার সার্ভিসে। সেসব খাম আমরা খুলতে পারি না। ডাকে তার কোনও এন্ট্রিও হয় না। যথাপ্রাপ্তি মাধবরাজের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি কিছু নিজেই ডিসপোজ করেন, কিছু হাতে হাতে দিয়ে আসেন বড়সাহেবকে। এ রকম অনেক কোড নাম্বার লেখা লিড্ খামের চিঠি আমরা পাই। তার ভিতর ঐ বিশেষ নম্বরের চিঠিও আসে। টাইপ-করা ঠিকানা, কোণে টাইপ করা 3, 62, 436!
বাসু বললেন, তোমার স্মরণশক্তি তো ভাল।
দেড়পেগ জিনের আমেজ নিয়ে মেয়েটি হাসল। বলল, আপনি নাম করা ডিটেকটিভ; কিন্তু ঐ বিরাট নম্বরটার বিশাল তাৎপর্যটা ধরতে পারেননি। এটা তিন লাখ বাষট্টি হাজার চারশ ছত্রিশ নয় স্যার …
—তবে?
—বলতে একটু সঙ্কোচ হচ্ছে!
সঙ্কোচ কিসের সুমিত্রা? তোমার নিজের ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স নয় যখন, তখন তো এটা একটা অ্যাকাডেমিক ডিসকাশন। তোমাদের অফিসে যে কয়জন মহিলা কর্মী আছেন তাঁদের মধ্যে কারও মাপের সঙ্গে ওটা মেলে? ঐ 36-24-36?
সুমিত্রা অবাক হল, অপ্রস্তুত হল। জিনের গ্লাসটা নাড়াচাড়া করতে করতে আড়চোখে ঐ নির্বিকার বৃদ্ধকে একনজর দেখে নিয়ে বললে, না, এমপ্লয়ি নয়, এজেন্ট। মহিলা এজেন্ট একজন।
—আই সি! তা রঞ্জনা থাপার কোন ফটোগ্রাফ আছে তোমার অ্যালবামে? বার্থডে পার্টি বা গ্রুপ ফটো?
সুমিত্রা আর এক চুমুক পান করতে যাচ্ছিল। একথায় একটু সচকিত হয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বললে, ফটো দেখার দরকার হবে না, স্যার। ঠিকই ধরেছেন কীভাবে আন্দাজ করলেন জানি না। তবে রঞ্জনার মাপ ঐ রকমই বটে।
বাসু মুখ নিচু করে চিকেন কাবাব চিবোতে ব্যস্ত। চোখে চোখে না তাকিয়ে নির্বিকারভাবে বললেন, ছিল। এখন নয়। তাই নয়?
—কী?
—রঞ্জনার ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স। ও তো গল-ব্লাডার অপারেশন করাতে ছুটি নেয়নি। তাই মাঝের চব্বিশটা এখন আর তাই নয়?
সুমিত্রা রীতিমতো চমকে ওঠে। বলে, কী আশ্চর্য। আপনি তাও জানেন? কিন্তু আমি যদ্দুর জানি। আপনার মক্কেল তো জানে না।
চৈতালী জানে কি না জানি না। সে আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলেনি। আমার মনে একটা সম্ভাবনা জেগেছিল মাত্র। তোমার স্বীকৃতিতে এখন জানলাম। ফলে তোমার স্বীকৃতি মোতাবেক, আমরা তিনজন খবরটা জানি তুমি, আমি আর রঞ্জনা নিজে। অফিসে আর কেউ জানে?
সুমিত্রা একেবারে অন্য একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করল, আমি আর একটা জিন নেব স্যার…
শিওর!
বাসু কলবেল বাজালেন। বেল বয় দরজার ও পাশেই অপেক্ষা করছিল। ইতিপূর্বেই ভাল টিপস্ পেয়েছে। হুকুমমাত্র সে এক প্লেট চিজ-ফিশ ফিঙ্গার আর জিন-লাইম নিয়ে এল।
বাসু ইতিমধ্যে ন্যাপকিনে মুখ মুছে একটা ড্রাই মার্টিনি তুলে নিয়েছেন হাতে। বললেন, আমার প্রশ্নটা মুলতবি আছে, সুমিত্রা। আর কে জানে? তোমার কর্তা?
—না। সে জানে না। অফিসের সিক্রেট আমরা বাড়িতে আলোচনা করি না। ও-ও তার অফিসের কথা বলে না। আমিও বলি না।
—গুড। অফিসের আর কেউ কি জানে?
সুমিত্রা তার গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল, আরও একজন জানত। গতকাল পর্যন্ত। আজ আর সেও জানে না।
ভ্রুকুঞ্চন হল বাসুর। বললেন, আই সী। কিন্তু সে যে জানত তা তুমি কেমন করে জানলে? সে নিজেই স্বীকার করেছিল, না রঞ্জনা?
সুমিত্রা একটা মাথা ঝাঁকি দিল। যেন জিনের আমেজটা ঝেড়ে ফেলতে চাইল। বলল, কী দরকার স্যার, এসব অপ্রিয় আলোচনায়? এর সঙ্গে তহবিল তছরুপের তো কোনও সম্পর্ক নেই
বাসু বললেন, আছে কি নেই তা তুমি জান না। তবে সে ছেলেটার সব আনন্দ-বেদনার অবসান হয়ে গেছে। সে এখন নিন্দাস্তুতির ঊর্ধ্বে। রঞ্জনাও বোধহয় তার গল ব্লাডারের স্ফীতি থেকে মুক্তি পেয়েছে। প্রসঙ্গটা আদালতে উঠবে না; কিন্তু আমার জানা দরকার। বল সুমিত্ৰা, রঞ্জনার অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের জন্য যে হরিমোহনই দায়ী এ কথা তোমাকে কে বলেছিল? রঞ্জনা না হরিমোহন?
— না রঞ্জনা নয়, হরিমোহনও নয়। নিতান্ত ঘটনাচক্রে। মাধবরাজজীর সঙ্গে হরিমোহন নেপালে যায়। কিউরিও সংগ্রহে। সপ্তাহখানেক ওঁরা দুজনই ছিলেন রঞ্জনার বাড়িতে। কী করে কী হয়েছে ঠিক জানি না—মাসতিনেক পরে হরি আমার মাধ্যমে আমার এক দিদির সাহায্য চায়।
—তোমার দিদি? কে তিনি?
—শিলিগুড়িরই একজন প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার। গাইনি। দিদি ভেবেছিল ওরা স্বামী-স্ত্রী, রঞ্জনা যে বিধবা তা বুঝতে পারেনি। ওরাও কিছু বলেনি। না হলে হয় তো দিদি আমাকেও বলত না। প্রফেশনাল এথিক্সে। হরি বা রঞ্জনা জানত না যে, আমি জানি। রঞ্জনা এখনো জানে না।
—রঞ্জনা যখন এজেন্ট তখন তাকে ছুটি নিতে হল কেন?
—না, এজেন্ট ছিল। এখন নয়। মাস ছয়েক আগে ও টেম্পরারি হ্যান্ড হিসাবে জয়েন করেছে। পোস্টিং পোখরায়। ছুটি নিতে হয়েছে যেহেতু সে স্টেশন ছেড়ে কলকাতায় গেছে। অপারেশন করাতে।
—বুঝলাম। চৈতালী তাহলে কিছু জানে না?
—চৈতালী হয়তো কিছুটা আন্দাজ করেছিল। সে ভেবেছিল ওর ভাই কারও প্রেমে পড়েছে, কিন্তু মেয়েটি যে কে তা আন্দাজ করতে পারেনি। আমার একটা বিশেষ অনুরোধ স্যার —এসব প্রসঙ্গ আদালতে যেন না ওঠে। দেখুন, আমি আমার স্বামীকে পর্যন্ত এমন মুখরোচক কথাটা জানাইনি! হরি তো তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেই গেছে। আর সেই বিধবা মেয়েটাকে…
—হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, সুমিত্রা। আমি নিজে থেকে ও প্রসঙ্গ আদালতে আনব না। তাছাড়া কেসটা হয় তো আদালতে যাবেই না। তোমাদের বড়কর্তার হাবভাবে তাই মনে হল।