যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা – ১০

১০

বাসুসাহেব এপাশে ফিরে দেখলেন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় বৃদ্ধ একজন প্রৌঢ় সুপুরুষ। দেখতে পঞ্চাশের নিচে বলেই মনে হয়। নিখুঁত সাজপোশাক। মুখে মিষ্টি হাসি। মিস্টিক হাসিও বটে। যুক্তকরে বললেন, কী সৌভাগ্য আমাদের! আপনি সশরীরে আমাদের অফিসে! কী জানেন বাসুসাহেব? গোয়েন্দা গল্প আমার প্যাশন। ফাদার ব্রাউন বা এডগার এলেন পো থেকে শুরু করে স্ট্যানলি গার্ডনার সব আমার মুখস্থ। বাংলা এবং ইংরেজি। ব্যোমকেশের মহাপ্রয়াণের পর …

কথার মাঝখানেই মাধবরাজ বলে ওঠেন, আপনি এই চেয়ারটায় বসুন চাচাজী। মিস্টার বাসু এসেছেন আমাদের তহবিল তছরুপ…

— তছরুপ নয়, মাধব, ঘাটতি। তা সুকৌশলী দম্পতিকে সঙ্গে নিয়ে এলেন না কেন? আদালতের বাইরে ওরাই তো আপনার যাবতীয় ডিটেকটিভগিরি করে …

আবার কথার মাঝখানেই বাধা দেয় মাধবরাজ। বলে, আপনি ভুল করছেন, চাচাজী! কোম্পানি ওঁকে এনগেজ করেনি। উনি এসেছেন নিজে থেকে। ওঁর মক্কেল চৈতালী বসুর তরফে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে। আপনার মনে আছে নিশ্চয়, দিন পাঁচেক আগে যেদিন রাত্রে আপনি কাঠমাণ্ডু যান—সেদিন থেকে মিস বসু ছুটিতে আছে ….

—হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? সেদিন বিকালেই তো ওর ভাই হরিমোহন মোটর কারে ধাক্কা খায়। সে কেমন আছে এখন?

মাধব জবাব দেয়, একই রকম। এখনো জ্ঞান হয়নি

এতক্ষণে বাসু যোগদান করেন কথোপকথনে : ওটা পুরানো খবর। আপনাদের স্টাফ হরিমোহন বসু গতকাল রাত একটার সময় মারা গেছে।

খুড়ো-ভাইপোর দৃষ্টি বিনিময় হল। মাধবরাজ বললে, কী দুঃখের কথা।

খুড়ো বললেন, আমাদের অফিস থেকে কেউ যায়নি? অফিস কি জানে না? চৈতালী বেচারি একা কী করবে? আই মিন, সৎকারের ব্যবস্থা। মাধব তুমি এক্ষুনি একটা গাড়িতে তিন- চারজনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও। ক্যাশ থেকে কিছু টাকাও। চৈতালী বোধহয় একেবারে ভেঙে পড়েছে। ঝরনা অথবা সুমিত্রাকেও পাঠিয়ে দাও। ওদের তো আর কেউ নেই এখানে।

মাধব বললে, আমি দেখছি। মানে, সৎকারের ব্যবস্থাটা। তবে ইয়ে, চৈতালীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা বৃথা। সে শিলিগুড়িতে নেই …

বাসু নির্বিকারভাবে বলে ওঠেন, ওটাও পুরানো খবর। হরিমোহনের মৃত্যুর সময় চৈতালী তার শয্যার পাশে ছিল। তারপর হরিমোহনের বন্ধুরা হিন্দু সৎকার সমিতির গাড়িতে ওর মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করে। এতক্ষণে বোধহয় শ্মশানযাত্রীরা ফিরেও এসেছে। আর চৈতালীকে আমি নিজে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছি। সে ‘হেভি-সিডেশনে’ আছে। অনেকগুলো ঘুমের বড়ি খাইয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আমি আপনাদের অফিসে এসেছি। তাকে ঘণ্টা চার-পাঁচ ঘুমাতে দিন।

সিনিয়ার জৈন বললেন, অফ কোর্স! আমি দিন চার-পাঁচ অনুপস্থিত ছিলাম। ইতিমধ্যে অনেক কাণ্ড ঘটে গেছে দেখছি। তোমার কেন মনে হল, মাধব, যে চৈতালী শিলিগুড়িতে নেই?

—কাল দুপুরেও সে ছিল না। অন্তত কলকাতার লালবাজারের পুলিশ বলছে কাল দুপুরে সে ছিল রিপন স্ট্রিটের এক হোটেলে। ছদ্মনামে।

—ছদ্মনামে? চৈতালী। কেন? আর পুলিশে সে কথা বলবে কেন?

—সে কথা মিস্টার বাসু বলতে পারবেন? আপনি নেপাল রওনা হওয়ার পরেই আমি ক্যাশ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে দেখি ক্যাশে কিছু নেই। তারপরেই আমি একটা কুইক-অডিটের ব্যবস্থা করি। ইতিমধ্যে আপনি কাঠমাণ্ডু চলে গেছেন। অডিটার হিসাব করে বলল, রাফ্ল স্পিকিং, দু-লক্ষ টাকার ঘাটতি। বুঝতেই পারছেন আমার অবস্থা। আপনি নেই, কেশিয়ার ছুটিতে। ক্যাশের চাবি শুধু আমার কাছে। আর এদিকে দু-লাখ টাকার ঘাটতি!

—তাই তুমি সবার আগে পুলিশে খবর দিলে?

মাধবরাজ চুপ করে রইল। সিনিয়ার জৈন আবার বললেন, তুমি তো জান মাধব, কী ভাবে আমাদের কেনাবেচা হয়। আমরা যখন-তখন ক্যাশ থেকে টাকা বার করি কখনো স্লিপ রেখে, কখনো শুধু পার্সোনাল ডায়েরিতে লিখে—

মাধবরাজ বাধা দিয়ে বলে ওঠে, কিন্তু সেভাবে টাকা তোলেন আপনি আর আমি, আপনি নেই, আমি তুলিনি ফলে দু-লাখ টাকা ঘাটতি

—কিন্তু পুলিশে খবর দেবার আগে তোমার কেন মনে হল না, যাবার আগে আমিই দু- লাখ টাকা নিয়ে যেতে পারি?

মাধবরাজ নির্বাক তাকিয়ে রইল।

বিজয়রাজজী বললেন, ইন ফ্যাক্ট, আমি সত্যিই এক লাখ টাকা ক্যাশে নিয়ে কাঠমাণ্ডু গিয়েছিলাম। একটা দশম শতাব্দীর জম্ভল-মূর্তির সন্ধান পেয়ে। বজ্রযান আর জৈন বুদ্ধিজম্‌ আর্টের একটা বিচিত্র মিশ্রণ। লোকটা বেচতে রাজি হল না। এইমাত্র টাকাটা ক্যাশে রেখে দিয়ে তোমার ঘরে এলাম।

মাধবরাজের একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল। বলল, তাহলে দু-লাখ নয়। একলাখ টাকা তছরুপ হয়েছে।

বিজয়রাজ ধমকে ওঠেন, আবার বলছ ‘তছরুপ’। বল ঘাটতি’। ভাল করে হিসাব মেলাও, দেখ, হয়তো সবই ঠিক আছে।

বাসু বুঝতে পারেন পুলিশে খবর দেওয়াটায় সিনিয়ার পার্টনার আদৌ খুশি হতে পারেননি। হয়তো তছরুপ হলেও উনি তা চেপে যেতে চান। তার হেতু একটাই— ওঁদের ব্যবসায়ে এমন সব কাজ-কারবার হয় যার পুলিশি তদন্ত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

বিজয়রাজ ভাইপোর কাছে জানতে চান, তাছাড়া তুমি কেমন করে জানতে পারলে যে, মিস বোস কলকাতায় কোন হোটেলে একটা ছদ্মনামে উঠেছে?

মাধবরাজ ইতস্তত করতে থাকে। বিজয় তাকে তাগাদা দেন, না মাধব, মিস্টার বাসুর কাছ থেকে আমাদের লুকোবার কিছু নেই। সত্যিই যদি দেখা যায় যে, তহবিল থেকে একলাখ টাকার ঘাটতি হয়েছে; তা হলে আমরা সবার আগে পুলিশে যাব না। কেন যেতে পারি না তা তুমি জানো। আবার লাখটাকার ঘাটতি চোখ বুজে মেনেও নিতে পারব না। আমি স্থির করেছিলাম সেক্ষেত্রে ‘সুকৌশলী’-কে কাজের দায়িত্বটা দেব। ফলে বাসুসাহেবের কাছে আমাদের লুকোবার মতো কোন তাস নেই।

মাধবরাজ বললে, আমি খবর পেলাম মিস্ বসু ওঁর ভায়ের কাছে কিছুক্ষণ ছিলেন। তারপর ওকে এমার্জেন্সি ওয়ার্ড থেকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে সরিয়ে নেবার পর চৈতালী দেবী বাড়ি চলে যান।

—ন্যাচারালি। রাত্রে ওর মতো একটি কুমারী মেয়ে ওখানে থাকবে কোথায়? হাসপাতালের খোলা বারান্দায়?

—এবং তারপর থেকে মিস্ চৈতালী বসু আর একবারও হাসপাতালে আসেননি। তহবিলে দু-লাখ টাকা ঘাটতি পড়ায় আমি গোপনে খোঁজ নিতে থাকি। জানা গেল, চৈতালী দেবী শিলিগুড়িতে নেই। আমার মনে হল মিস. বোস যেখানেই যান না কেন, ভাইয়ের খোঁজ তাঁকে নিতে হবে। ওদের ভাই-বোনে খুব হৃদ্যতা। তাই হাসপাতালে খোঁজ নিলাম। জানা গেল, কোলকাতার একটা বিশেষ নম্বর থেকে হরিমোহনের বিষয়ে বার বার খোঁজ-খবর করা হচ্ছে। এখানকার সদর থানার একজন ইন্সপেক্টর আমার বন্ধুস্থানীয়। তার মাধ্যমে জানা গেল নম্বরটা কলকাতার রিপন স্ট্রিটের একটা হোটেলের। ফোনগুলো 315 নম্বর ঘরের বোর্ডার করেছেন। সেই বোর্ডারের দৈহিক বর্ণনা হুবহু চৈতালী বসুর মতো; কিন্তু তাঁর নাম নাকি চিত্রলেখা ব্যানার্জি। … আজ মিস্টার পি. কে. বাসু এসে বলছেন যে, লালবাজার থেকে দুজন পুলিশ এসে হোটেলে তত্ত্বতালাস নিয়েছে মানে চৈতালী বসু আর চিত্রলেখা ব্যানার্জি একই ব্যক্তি কিনা। তারা কী সিদ্ধান্তে এসেছে তা আমি এখনো জানি না। উনি হয়তো বলতে পারবেন

বিজয়রাজ নিঃশব্দে সবটা শুনে বাসুর দিকে ফিরে বললেন, চৈতালী বসু আপনার মক্কেল, ফলে আপনাকে একই ব্যাপারে আমরা এনগেজ করতে পারি না। আর আমি এও জানি, বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘সুকৌশলী’ ডিটেকটিভ এজেন্সি এ তদন্তের ভার নেবে না – নিতে পারে না। আমি শুধু বলব বিশ্বাস করুন, চৈতালীর মানহানি হয় এমন কোন কাজ আমরা কিছুতেই করব না। চৈতালীকে আমি অত্যন্ত বিশ্বাস করি। অত্যন্ত ভালবাসি। মাত্র পাঁচ বছরে তাকে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক থেকে আমরা চিফ কেশিয়ার করেছি। যে কাণ্ডটা ঘটে গেছে — বিশ্বাস করুন আমি শিলিগুড়িতে উপস্থিত থাকলে তা ঘটত না। তা সত্ত্বেও যদি আপনি এজন্য মানহানির মামলা আনতে চান, তাহলে আমাদের অনুরোধ আমার পার্সোনাল রিকোয়েস্ট হরিমোহনের শ্রাদ্ধের জন্য দশটা দিন সময় দিন। তার পরে ওকাজ করবেন।

বাসু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, থ্যাংক্‌স্। তাই হবে। তাছাড়া আমার মক্কেল এখনো মামলা করতে রাজি হয়নি। তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার সময়ও এটা নয়।

বিজয়রাজও উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আপনাকে কোনভাবে আপ্যায়ন করতে পারলাম না এ দুঃখ রইল। আপনি এসেছেন অ্যাগ্রিড্ পার্টি হিসাবে, তদুপরি আমরা বর্তমানে মোৰ্নিঙে আছি। আজ আমাদের একজন স্টাফ মারা গেছে। আমরা একটু পরেই অফিস ছুটি দিয়ে দেব। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে আপনাকে যথোচিত মর্যাদায় জৈন-কোম্পানি আপ্যায়ন করবে।

করমর্দন করে বেরিয়ে এলেন বাসু। মাধবরাজ করমর্দন করল না। গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল একপাশে।

হল-কামরা পার হয়ে নির্গমনদ্বারের কাছাকাছি আসতেই কে যেন পিছন থেকে বলে ওঠে: এক্সকিউজ মি, স্যার!

বাসু ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখলেন সেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটি।

সে বললে, আমার নাম সুমিত্রা। আমাকে যদি কাইন্ডলি একটা অটোগ্রাফ দিয়ে যেতেন।

—ও শিওর!—বুক পকেট থেকে কলমটা বার করে ওর হাত থেকে অটোগ্রাফ খাতাখানা নিলেন। মেয়েটি একটা বিশেষ পাতায় আঙুল দিয়ে রেখেছিল। সেটাই মেলে ধরল। বাসু দেখলেন তার ডানদিকের পাতাটা ফাঁকা; কিন্তু বাঁ দিকের পাতায় গোটা গোটা হরফে পেনসিলে লেখা:

“চৈতালীকে এরা ফাঁসাতে চায়। সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। আপনার শিলিগুড়ি হোটেলের নাম আর রুম নাম্বারটা লিখে দিন। আমি ফোন করে দেখা করব।”

বাসু বাঁ দিকের পাতায় লিখে দিলেন সেবক রোড-এর নূরজাহান হোটেলের নাম আর ঘরের নম্বরটা। ডানদিকের পাতায় দিলেন অটোগ্রাফ।

‘থ্যাঙ্কু’ বলে মেয়েটি অটোগ্রাফ খাতাখানা তার ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে নিল। বাসু লক্ষ্য করে দেখলেন, অনেকেই ওঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।