যতিনের বাবা তাকে এক জোড়া জুতো কিনে দিয়ে আচ্ছা করে শাসিঁয়ে কইলেন, “এইবারে যদি জুতো ছেঁড়ো, তাহলে ছেঁড়া জুতোই পড়ে থাকতে হবে।”
প্রতি মাসে যতিনের নতুন জুতোর দরকার হয়। তার জামা কিছুদিন যেতে না যেতেই ছিঁড়ে যায়। সে সব কিছুতেই উদাসীন। তার সব বই এর মলাট ছেঁড়া, কোনাগুলো মোড়ানো, স্লেটের আদ্যপান্ত চীড় ধরা। তার হাত থেকে চক পেন্সিল পড়ে পড়ে সেগুলো আর আস্ত নেই একটিও। তার আর একটি বদ অভ্যেস হল, পেন্সিলের গোড়া কামড়ানো। এই কারণে পেন্সিলের গোড়া গুলো দেখতে বাদামের ছিবড়ে ছাড়ানো খোসার মত হয়ে গেছে। তার ক্লাসের পন্ডিত মশাই সেগুলো দেখে বলেন, “আজ বাড়িতে ভাত খাও নি বুঝি!”
নতুন জুতো নিয়ে কিছুদিন যতিন বেশ সাবধানে চলাফেরা করল; ধীরে ধীরে সিঁড়ি থেকে নামে, দরজার বেড়ী সাবধানে ডিঙ্গোয়, সদা সতর্ক থাকে যেন হোঁচট না খায়। কিন্তু অতটুকুই সার। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার সেই পুরোনো যতিন। জুতোর মাহাত্য তার মনে থাকে না-সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে নামা আর পাথরে হোঁচট খাওয়া নিত্য ব্যাপার। এক মাসের মধ্যে তার জুতোর সামনের দিক ছিঁড়ে গেল। যতিনের মা বললেন, “মুচি ডেকে এইবারে জুতোটা সেলাই করিয়ে নে, নইলে আর পড়তে পারবি নে।” কিন্তু মুচি ডাকা যতিনের কর্মের মধ্যে পড়ে না। ফল স্বরূপ জুতোর ছেঁড়া আরো বারতেই থাকে।
যতিনের যে একদমই কোনো কিছুর প্রতি দরদ নেই তা না, যে জিনিসটা যতিনের চিন্তা চেতনায় আছে সেটি হল তার ঘুড়ি। অতি যত্ন সহকারে সে ফাটা ঘুড়ি জোড়া লাগায় এবং যতদিন সম্ভব সেটি ওড়ানোর চেষ্টা করে। খেলার সময়টা তার বেশিরভাগই ঘুড়ি উড়িয়ে কাটে। এই ঘুড়ির কারণে তার রান্না ঘর হতে তাড়া খেতে হয়। ঘুড়ি ছিঁড়ে গেলে রান্না ঘরের আসে পাশে ঘুরঘুর করে, আঠা নেওয়ার জন্য। ঘুড়ির ল্যাজ লাগাতে হলে কিংবা কাঁচির দরকার হলে তার মায়ের সেলাই বাক্সের ওপর হামলা চলে। একবার ঘুড়ি ওড়াতে বের হলে নাওয়া খাওয়া তার মাথায় ওঠে। সেইদিন যতিন ইস্কুল থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি আসল। গাছে উঠতে গিয়ে নতুন জামাটা ছিঁড়ে ফেলেছে। বই খাতা রাখার পর সে পায়ে জুতো গলাতে গেছে-দেখে সেটি এমনি ছিঁড়ে গেছে যে সেলাইয়েরও অযোগ্য। কিন্তু সিড়ি দিয়ে নামতে নামতেই ভাবনাটি তার মাথা থেকে বেমালুম হাওয়া! দু-তিন ধাপ সিঁড়ি একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগল। শেষতক তার জুতো জোড়ার দশা এমনি হল যে দেখলে মনে হবে বেচারা কষ্টে সব কটা দাঁত বের করে আছে। শেষ তিন ধাপ যেই সে নামতে যাবে, মনে হল যেন তার পায়ের তলায় আর মাটি নেই, ছেঁড়া জুতো তাকে শূন্যে ভাসিয়ে অজানা দেশে নিয়ে চলেছে।
যখন তার জুতো জোড়া থামল, যতিন চেয়ে দেখে কোন এক অজানা দেশে এসে সে পৌঁছেছে। অনেক মুচি এখানে ওখানে বসে আছে। যতিনকে দেখেই ছুটে এল তারা, তার জুতো জোড়া খুলে সাবধানে ঝাড়তে শুরু করে দিল। তাদের মধ্যে যে নেতা গোছের ছিল, যতিনকে বলল, “শুনেছি তুমি নাকি ভারি দুষ্টু? দেখ, কি করেছ জুতো জোড়ার হাল! দেখ, জুতো জোড়া তো মরমর আবস্থায় আছে!” ততক্ষণে যতিন একটু ধাতস্ত হয়েছে, বললে, “জুতোর কি প্রাণ আছে নাকি যে মরবে?” মুচি জবাব দিলে, “নয় ত কি? কি ভেবেছ হে বাপু? যখন দৌড়ে বেরাও তখন ত মনে থাকে না যে জুতো কষ্ট পায়, কিন্তু কষ্ট পায় বটে। সে কারনেই চিৎকার করে কাঁদে। যখন পড়িমড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে বেরাও, তখন পায়ের চাপে জুতোর পাশ ক্ষয়ে যায়। ঠিক এই কারনেই জুতো তোমাকে আমাদের কাছে এনেছে। আমরা এখানকার সব ছেলেদের জিনিসপত্রের দেখাশোনা করি। যখন তারা তাদের জিনিসের ঠিক মত দেখাশোনা করে না, তখন তাদের উচিত শিক্ষা দেই।” মুচি তার জুতো ফেরত দিয়ে বললে, “ঝট্পট্ সেলাই করতে লেগে পড় তো।” যতিনের খুব রাগ হল-তীব্র স্বরে বললে, “আমি জুতো সারাই না, মুচিরা সারায়।” মুচি মুচকি মুচকি হেসে বলে, “এটা কি মামাবাড়ি পেয়েছ? ভেবেছ যে বলবে করব না-ওমনি পার পেয়ে যাবে? এই নাও সুঁই আর সুতো-সেলাই করতে লেগে পড়।”
যতিনের রাগ ভয়ে পরিনত হয়ে গেছে ততক্ষণে। ভয়ে ভয়ে বললে, “কি করে সেলাই করতে হয় জানি নে।” মুচি বললে, “দেখাচ্ছি, কি করে করতে হয়।” যতিন ভয়ে ভয়ে বসল জুতো সেলাই করতে। হাতে সুঁই ফুটল, জুতোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘার ব্যাথা হয়ে গেল-অনেক্ষণ চেষ্টা করে একপাটি জুতো মাত্র সারতে পেরেছে। তখন মুচির কাছে কেঁদে কেঁদে বল্ল, “আমি কালকে বাকিটা করব, খিদে পাচ্ছে খুব।” মুচি বলল, “কি বলছ বাপু! পুরো কাজ শেষ না করলে খেতেও পাবে না ঘুমুতেও পারবে না। ঐটে এখনও সেলাই করা বাকি আছে। ওটি শেষ করলে শিখতে হবে কিভাবে হাঁটতে হবে যাতে পরে জুতোর কষ্ট না হয়। তারপর দর্জির কাছে যেতে হবে-জামা সেলাই করতে। তারপর আমরা দেখব আর কি কি ভেঙ্গেছ।”
যতিনের চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল। কোনো মতে দ্বিতীয় পাটি জুতো সারাল। ভগবানের অসীম দয়া, এটা এতটা বাজে ভাবে ছেঁড়েনি। তারপর মুচি তাকে এক পাঁচতলা বাড়িতে নিয়ে গেল। সেটাতে আবার সিঁড়ি মাটি থেকে সোজা ছাত পর্যন্ত। যতিনকে নিচে দাঁড় করিয়ে বললে, “একেবারে উপরে উঠে আবার নিচে নেমে এস ত দেখি। আর শোনো, একবারে একটা সিঁড়ির বেশি ভাংবে না।” যতিন কথা মতই সিঁড়ি ভাংল। মুচি বলল, “হল না, তিন বার দুটো সিঁড়ি ভেঙ্গেছ, পাঁচ বার লাফিয়েছ, আর দু বার তিনটে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়েছ।” এতটা সিঁড়ি ভেঙ্গে যতিনের পা ব্যাথা করছিল। সে আর কোনো ছলচাতুরি করল না। ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠল আর নামল। মুচি বল্ল, “এবার ঠিক হয়েছে, নাও এবার দর্জির কাছে চল।”
তারা একটা বিশাল মাঠের কাছে এল, সেখানে শুধু দর্জি আর দর্জি-বসে বসে সেলাই করে যাচ্ছে। তারা যখন যতিনকে দেখল বল্ল, “কি ছিড়েছ?” তার ধুতির দিকে তাকিয়ে কইল “ইকি! ভালো জায়গাটাই ছিঁড়েছ!” বিরক্তি ভরে মাথা নাড়িয়ে বল্ল, “ভারী অন্যায়, ভারী অন্যায়! চট্পট্ সেলাই কর এখন।” যতিনের না করার কোনো সাহস আর ছিল না। সে সুঁই সুতো নিয়ে সেলাই করতে বসে গেল। মাত্র দু ফোঁড় দিয়েছে-ওমনি দর্জি চেঁচিয়ে উঠল, “ইকি! একে তুমি সেলাই বল? আবার কর-আবার শুরু থেকে কর।” শেষতক যতিন আর পারল না-কেঁদেই ফেল্ল, “আমার খিদে পেয়ছে, আমি বাড়ি যাব। আমি আর কক্ষণ জামা ছিঁড়ব না, আর কক্ষণ ছাতা ভাংব না।” তার কথা শুনে সবাই হাঃ হাঃ করে হাসতে লাগল, “খিদে পেয়েছে? আমাদের কাছে অনেক আছে খাওয়ার মত” বলে তারা যে পেন্সিল দিয়ে কাপড়ে দাগ কাটে সে সব কিছু এনে দিল। “পেন্সিল চিবোতে পছন্দ কর না! এই নাও এগুলো চেবাও বসে বসে। এছাড়া আর কিছু পাবে না।”
যতিন কে ওভাবে ছেড়েই তারা যে যার মত কাজে লেগে গেল। খিদে-তেষ্টায় মাঠে শুয়ে শুয়ে যতিন কাঁদতে লাগল। ঠিক সে সময়ে আকাশে কিছু একটা ফর্ফর্ করে উঠল-যে ঘুড়িটা যতিন যত্ন করে সাড়িয়েছিল, সেটি এসে তার কোলের কাছে পড়ল। ফিস্ ফিসিয়ে বল্ল, “তুমি আমার খুব যত্ন করেছ, সে কারনেই আমি তোমার সাহায্য করতে এসেছি। আমার লেজ ধর-শিগগিরি।” আর কথা না বাড়িয়ে যতিন ঘুড়ির লেজ ধরল। হুস্ করে ঘুড়ি তাকে আকাশে উঠিয়ে নিল। শব্দ শুনে দর্জিরা ছুটে এল, ঘুড়ির সুতো কাটার জন্য। আচমকা, যতিন ও তার ঘুড়ি গোঁত্তা খেয়ে আকাশ থেকে নামতে লাগল।
নামছে ত নামছেই-ঠিক যখন মাটিতে মাথা ঠেকব ঠেকব করছে তখনই, যতিন ধড়মড় করে উঠে বসল। ভগবান ই জানেন ঘুড়ির কি হল, যতিন দেখল সে শুয়ে আছে সিড়ির নিচে আর মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা।
কিছুদিন ভুগে, যতিন যখন সেরে উঠল, তার মা বললে, “সিঁড়ি থেকে পড়ে আমার যতিন খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর ছুটোছুটি করে না। একদম ছট্ফটানি নেই! তা না হলে তার জুতো চার মাস টেকে কি করে!”
সত্যি বলতে-যতিন মুচি আর দর্জিকে এখনো ভোলেনি।