নিউইয়র্কের উডসাইডে এক তেতলা অ্যাপার্টমেন্টে
ভোরবেলা এলো তোমার টেলিফোন। হাজার হাজার মাইল
উজিয়ে-আসা তোমার কণ্ঠস্বর
মর্মমূলে পৌঁছতেই আমার চিত্ত ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁর
সেতারের বসন্ত বাহার। তোমার কণ্ঠস্বর আমাকে
চুম্বন করার সঙ্গে সঙ্গেই
বিশ্বের সকল রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হয়
আমার একচ্ছত্র অধিকার,
জাতিসংঘের সকল রাষ্ট্রদূত
আমাকে কুর্ণিশ করেন এক সারিতে দাঁড়িয়ে।
টেলিফোনে তোমার উচ্চারিত কথামালা
সাঁতার কাটছিল জলকন্যাদের ধরনে আর তক্ষুণি
ভ্রাম্যমাণ দরবেশ শামস্-আল তাবরেজ
তাঁর মরমী উষ্ণীষ অর্পণ করলেন আমাকে, লালন শাহ
আমার হাতে তুলে দিলেন তাঁর নিজস্ব দোতারা
এবং দুনিয়ার তাবৎ প্রধান কবি
আমাকে পাঠালেন রাশি রাশি পুষ্পস্তবক।
রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, কীটস, ইয়েটস, রিল্কে এলুয়ার আর
নেরুদার পঙ্ক্তিমালা আমাকে ঘিরে
এক অপরূপ ব্যালে রচনা করে, যখন
তোমার কথা পুষ্পিত হতে থাকে টেলিফোনে।
যখন তোমার টেলিফোন আসে কোনো রূপসী
স্নানার্থিনীর মতো সরোবর-তীরে আলতো পা ফেলে,
যেন ব্যালোরিনা, তখন সকল যুদ্ধবাজ
রাষ্ট্রের সমর নায়কেরা সই করে শান্তির দলিলে,
তখন সকল সন্ত্রাসের নির্দয় বেলেল্লাপনা,
বুলেটের বেহায়া রকবাজি নিভে যায় এক ফুৎকারে, তখন
নিদারুণ অপুষ্টিজনিত জীবন্ত সকল শিশু-কংকাল
হয়ে ওঠে জ্বলজ্বলে স্বাস্থ্যবান, অন্ধজন ফিরে পায় আলো,
তখন হাসপাতালসমূহে সকল অসুস্থজন আরোগ্য লাভ করেন, তখন
হায়নাগুলো হরিণ হয়ে বিচরণ করে হরিৎ শোভায়।
তখন ধর্মান্ধদের হিংস্র উন্মত্ততা পোকামাকড়ের উঠরে যায়,
প্রতিক্রিয়াশীলদের অমাবস্যা রাতের ষড়যন্ত্র থাকে মুলতবি।
হে আমার হৃদয় নন্দনবনচারিণী, টেলিফোনে
তোমার কণ্ঠস্বর নিয়ে আসে বাংলার হৃদয়ের ধ্বনি।
কখনো কখনো মুহূর্তের জন্যে মনে হয়, কে তুমি?
কে তুমি আমার চেতনায় বইয়ে দিচ্ছ অমিয়ধারা?
তুমি কি স্বর্গীয় কোনো পাখি, যার কণ্ঠসুর
আমি ছাড়া অন্য কেউ শোনেনি কখনো
এই চরাচরে? যখন তুমি আমার উপস্থিতির
বহুদূরের ওপার থেকে কথা বলো, নীরবতা
আমাকে জাপটে ধরে, কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে আমার।
আমার নিভৃততম ভেতরে জালালউদ্দিন রুমি
হয়ে উঠতে চান দুর্বার কথক।
নিউইয়র্ক, ১১ অক্টোবর ৯৫