যক্ষপতির রত্নপুরী – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ । রাতের আঁধারে

এইবারে বিনয়বাবুকে রাজি করিয়েছি।

তাঁর কাফ্রিস্থানে যেতে নারাজ হওয়ার প্রধান কারণই ছিল, প্রাচীন বৌদ্ধমঠের মধ্যে এখনও যে গুপ্তধন আছে এটা তিনি সত্য বলে মানতে পারছিলেন না। কিন্তু চিনেম্যানগুলোর কাণ্ড দেখে এখন তিনি মত বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বুঝেছেন, গুপ্তধনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে একেবারে নিশ্চিন্ত না হলে ওই চিনে দুরাত্মার দল এত মরিয়া হয়ে এমন সব সাংঘাতিক বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিতে পারত না।

এখন তিনি বলছেন, ‘ওহে, ওই লকেটের পিছনে সত্যই কোনও গুপ্তরহস্য আছে! গুপ্তধনের লোভ আমি করি না, কিন্তু রহস্যটা কী জানবার জন্যে ভারী আগ্রহ হচ্ছে।’

আগ্রহ নেই খালি রামহরির। সে থেকে থেকে বলে, ‘ছি—ছি! বিনয়বাবু, এই বয়সে কোথায় জপ—তপ আর হরিনাম নিয়ে থাকবেন, তা না করে আপনিও কিনা ওই গোঁয়ার ছোঁড়াগুলোর দলে গিয়ে ভিড়লেন।’

বিনয়বাবু যুৎসই জবাব খুঁজে না পেয়ে অসহায়ভাবে ঘাড় নাড়তে থাকেন।

কুমার বলে, ‘ভাংচি দিও না রামহরি, দল ভাঙাবার চেষ্ট কোরো না। তোমার যদি এতই অমত, তবে থাকো না তুমি কলকাতায় পড়ে। আমরা তো মাথার দিব্যি দিয়ে তোমাকে সাধাসাধি করছি না? কী বলিস রে বাঘা?’

বাঘা বোধ করি সায় দেওয়ার জন্যেই একবার কুমার আর একবার রামহরির মুখের পানে তাকিয়ে ল্যাজ নাড়তে থাকে।

‘আরে মোলো, পাজি কুকুর! তুইও ওই দলে?’ রামহরি রেগে চড় মারতে যায়, বাঘা কুমারের পিছনে গিয়ে আত্মরক্ষা করে।

আমাদের যাত্রার তোড়জোড় চলছে। এতদিনে আমরা বেরিয়েও পড়তুম, কিন্তু যেতে পারছি না কেবল ওই হতভাগা ছুন—ছিউয়ের জন্যে। এখনও তার বিচার শেষ হয়নি, আর আমরা হচ্ছি সরকার পক্ষের প্রধান সাক্ষী।

পুলিশের তদারকে প্রকাশ পেয়েছে, ছুন—ছিউ হচ্ছে চিনদেশের এক বিখ্যাত ডাকাতসর্দার, তার দলের লোক অনেক। সে যে কবে চিন থেকে ভারতে হাজির হয়েছে এবং তার এই আসার উদ্দেশ্যই বা কী, পুলিশ এখনও তা জানতে পারেনি।

কিন্তু আমরা আন্দাজ করছি, তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে গুপ্তধন।

পুলিশ আর একটা তথ্য সংগ্রহ করেছে। হোটেলে যে বুড়ো চিনেম্যানটা খুন হয়েছে, সেও নাকি আগে ছুন—ছিউর দলে ছিল। বোধহয় লকেটটা কোনরকমে হাতিয়ে সে দল ছেড়ে সরে পড়ে এবং তারপর ভারতে আসে। তাকে অনুসরণ করে এসেছে ছুন—ছিউ আর তার দলবল।

আমরা স্থির করেছি, ছুন—ছিউ যদি প্রকাশ না করে, তাহলে আমরাও আদালতে লকেটের কথা জাহির করব না।

এখন পর্যন্ত ছুন—ছিউ হাটে হাঁড়ি ভাঙেনি। কেবল এইটুকুই বলেছে, ওই লকেটখানা সে এত পবিত্র বলে মনে করে যে, ওর জন্যে একশোটা নরহত্যা করতেও তার আপত্তি নেই।

কিন্তু আমরা পুলিশের কাছে লকেটের কথা অস্বীকার করেছি। বলেছি, আমরা লকেট—ফকেটের ধার ধারি না—ছুন—ছিউ ভুল সন্দেহ করেছে।

তার এই লুকোচুরির মানে বোঝা যায়। ফাঁসিকাঠের ছায়ায় দাঁড়িয়েও সে আজ পর্যন্ত লকেটের আশা ছাড়তে পারেনি। তার বিশ্বাস, লকেটের লেখা ও তার মর্ম এখনও কারুর কাছে ধরা পড়েনি।

বিচার যেভাবে চলছে তাতে বেশ বলা যায় যে ছুন—ছিউর প্রাণদণ্ডই হবে।

এদিকে আমাদের থাকতে হয়েছে অতি সাবধানে। অনুমান করতে পেরেছি, ছুন—ছিউ হাজতে বাস করছে বটে, কিন্তু তার দলের লোকেরা আমাদের ওপরে তীক্ষ্নদৃষ্টি রাখতে ভোলেনি। কেননা আমাদের এ পাড়ায় আজকাল চিনেম্যানদের আনাগোনা হঠাৎ বেড়ে উঠেছে। কেউ খেলনা, কেউ চেয়ার, কেউ কাপড়ের বস্তা বেচতে এসে আমার বাড়ির কড়া নাড়তে থাকে, কিছু কিনব না বললেও সহজে নড়তে চায় না। একদিন একটা চিনেজোঁক চিনেম্যানকে তাড়াবার জন্যে বাঘাকে লেলিয়েও দিতে হয়েছিল! এইসব শুনে পুলিশ আমার বাড়ির দরজায় একজন পাহারাওয়ালা রাখবার ব্যবস্থা করেছে।

হঠাৎ বিনয়বাবু একদিন এলেন অদ্ভুত একটা সংবাদ নিয়ে।

উত্তেজিত মুখে ঘরে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘ও হে, আজকের কাগজ পড়েছ?’

‘না।’

‘ছুন—ছিউ হাজত থেকে পালিয়েছে!’

বিস্মিত হয়ে বললুম, ‘সে কী! কেমন করে?’

‘কাল আদালত থেকে তাকে হাজতে পাঠাবার জন্যে যখন নীচে নামিয়ে আনা হচ্ছিল, তখন হঠাৎ সে চোঁচাঁ দৌড় মারে। প্রহরীরা পিছনে তাড়া করে। পথে অপেক্ষা করছিল খুব দ্রুতগামী একখানা বড় মোটর। সে লাফ মেরে তার ওপরে গিয়ে ওঠে, আর গাড়িখানা যেন হাওয়ার আগে উড়ে চলে যায়। পুলিশ তখন অন্য গাড়িতে উঠে পিছনে অনুসরণ করে। খানিকক্ষণ এ—রাস্তায় ও—রাস্তায় ছোটাছুটির পর ছুন—ছিউর গাড়িখানা ধরা পড়ে। তার মধ্যে দুটো চিনেম্যান ছিল, কিন্তু ছুন—ছিউ ছিল না। সে কোন ফাঁকে কোথায় নেমে পড়ে পুলিশের চোখে বেমালুম ধুলো দিয়েছে!’

কুমার বললে, ‘এ তো ভারী বিপদের কথা!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘বিপদ? হুঁ, সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। ছুন—ছিউ হয়তো আবার লকেট উদ্ধারের চেষ্টা করবে। সাবধান বিমল, সাবধান!’

আমি বললুম, ‘ছুন—ছিউর সঙ্গে আমাদের দেখা হওয়ার সুযোগ হবে, এটাও আমি অনুমান করতে পারছি।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘লকেটখানা পুলিশের হাতে সমর্পণ করো, সব ঝঞ্ঝাট চুকে যাক।’

‘লকেটের কথা অস্বীকার করবার পর আর তা করা চলে না। আমাদের সামনে এখন খোলা আছে একমাত্র পথ।’

‘কী পথ?’

‘কাফ্রিস্থানে যাত্রা করবার পথ। ছুন—ছিউকে আমরা প্রস্তুত হওয়ার অবসর দেব না। কালকেই আমরা বেরিয়ে পড়ব। ছুন—ছিউ এসে দেখবে, খাঁচা খালি, পাখি নেই।’

কুমার উৎসাহিত কণ্ঠে বললে, ‘ঠিক, ঠিক! উত্তম প্রস্তাব।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘যুক্তিসম্মত প্রস্তাব বটে। কিন্তু তুমি কি মনে করো বিমল, ছুন—ছিউ আমাদের সঙ্গ নিতে পারবে না?’

জবাব দিতে যাব—হঠাৎ ঝনঝন করে জানলার একখানা শার্সি ভেঙে গেল এবং ঘরের মেঝের ওপর সশব্দে এসে পড়ল একখণ্ড পাথর, তার সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধা একখানা কাগজ!

সবিস্ময়ে তাকিয়ে আছি, কুমার ছুটে গিয়ে কাগজশুদ্ধ পাথরখানা কুড়িয়ে নিল। তারপর কাগজখানার দিকে চেয়েই বলে উঠল, ‘বন্ধুবর, ছুন—ছিউর চিঠি। ইংরেজিতে লেখা।’

”এখনও লকেট ফিরিয়ে দাও। নইলে মৃত্যু অনিবার্য!—ছুন—ছিউ।”

কুমার দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর ফিরে এসে বললে, না, রাস্তায় কেউ কোথাও নেই। পাহারাওলা বললে, এখানে সে কোনও চিনেম্যানকে দেখেনি।’

আমি বললুম, ‘ছুন—ছিউ এরই মধ্যে আবার জাল ফেলেছে! বেশ আমরাও অপ্রস্তুত নই। কালই আমাদের যাত্রার দিন।’

রামহরি নিশ্চয় ঘরের বাহির থেকে সমস্ত শুনছিল। সে চিৎকার করে উঠল, ‘হে মা কালী! হে মা দুর্গে! ও বাবা মহাদেব! খোকাবাবুর দিকে কৃপা—কটাক্ষে একটু নিরীক্ষণ কোরো!’

বোধ হয় রামহরির বিশ্বাস, খুব জোরে চেঁচিয়ে না ডাকলে সুদূর স্বর্গের দেবদেবীরা মানুষের প্রার্থনা শুনতে পান না!

পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আয়োজন করতে—করতে কেটে গেল। এর মধ্যে শত্রুপক্ষ আর কোনও সজাগতার লক্ষণ প্রকাশ করেনি। এমনকী পথের চিনে—জনতা পর্যন্ত একেবারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।

বিনয়বাবু বললেন, ‘এ হচ্ছে ঝড়ের আগেকার শান্তি!’

কমল বললে, ‘ঝড় উঠলেই বজ্রনাদ করবার জন্যে আমাদের বন্দুকগুলো তৈরি আছে!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘থামো ফাজিল ছোকরা! একফোঁটা মুখে অত বড়—বড় বুলি ভালো শোনায় না।’

সন্ধ্যার সময় স্টেশনে যাত্রা করা গেল। আমরা ফার্স্টক্লাস কামরা রিজার্ভ করেছি। মেল ট্রেন। পথে বা স্টেশনে একবারও সন্দেহ হল না যে, আমাদের গতিবিধি কেউ লক্ষ করেছে। স্টেশনের ভিড়ের মধ্যে একখানাও মঙ্গোলীয় ছাঁচের হলদে মুখ নজরে ঠেকল না। গাড়ির প্রত্যেক কামরায় উঁকি মেরে এসেছি। কোথাও সন্দেহজনক কিছুই নেই। আপাতত ছুন—ছিউকে ফাঁকি দিতে পেরেছি ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলুম।

ঘণ্টা দিলে। ট্রেন ছাড়ল।

কুমার বললে, ‘অজানার অভিমুখে আবার হল অভিযান শুরু! সুদূরের যাত্রী আমরা, অদৃষ্ট আমাদের জন্যে আবার কী নতুন উত্তেজনা সঞ্চয় করে রেখেছে, মনে—মনে সেইটেই আন্দাজ করবার চেষ্টা করছি।’

কমল ‘আইসক্রিম’ চুষতে—চুষতে বললে, ‘এবারে আমরা অদৃষ্টের ভাণ্ডার লুণ্ঠন করব!’

বিনয়বাবু কটমট করে তার দিকে তাকালেন।

রাত্রে খাওয়াদাওয়া সেরে গল্প করতে—করতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লুম। জেগে রইল কেবল রামহরি। রেলগাড়িতে তার ঘুম হয় না।

কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলুম জানি না, আচম্বিতে জেগে উঠেই অনুভব করলুম বিষম এক বেদনা। তারপরেই বুঝলুম, বিছানার ওপর থেকে ছিটকে নীচে পড়ে গিয়েছি।

রামহরি, কুমার, কমল ও বিনয়বাবুর দেহও নীচে পড়ে ছটফট করছে এবং বাঘা করছে প্রাণপণে চিৎকার!

হতভম্বের মতো উঠে বসেই আর এক সত্য উপলব্ধি করলুম। ট্রেন চলছে না—ঘুটঘুট্টে অন্ধকারে বাইরের দৃশ্য বিলুপ্ত। সঙ্গে—সঙ্গে শুনতে পেলুম বহু লোকের চিৎকার!

বিনয়বাবু চেঁচিয়ে বললেন—’অ্যাক্সিডেন্ট, অ্যাক্সিডেন্ট!’

রামহরি চ্যাঁচাল, ‘হে মা কালী, হে বাবা মহাদেব!’

কুমার বললে, ‘বিমল, বিমল, তোমার কপাল দিয়ে রক্ত পড়ছে।’

আমি তাড়াতাড়ি জানলার কাছে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলুম, ঝুপ ঝাপ করে বৃষ্টি পড়ছে এবং গাড়ি যেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই আবছায়ার মধ্যে দেখা যায় একটা উঁচু পাহাড়।

দূরে গাড়ির বাইরে ছুটোছুটি করছে কতকগুলো আলো—গোলমাল আসছে সেইদিক থেকেই।

তারপরেই কামরার পর কামরার দরজাগুলো দুমদাম করে করে খুলে রেলপথের ওপরে নেমে পড়তে লাগল দলে দলে যাত্রী!

ব্যাপার কী?

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ । বিপদগ্রস্ত পৈতৃক প্রাণ

এই অস্থানে কেন হঠাৎ গাড়ি থামল? আলো নিয়ে জলে ভিজেই বা অত লোক কেন ছুটোছুটি করছে?

পৃথিবীকে সশব্দ করে অন্ধকার আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরছিল হুড়হুড় এবং কামরার জানলা দিয়ে বেরিয়ে পড়া আলোকরেখার মধ্যে এসে সেই ঝরা জল উঠছিল চকচক করে। কিন্তু দেখতে—দেখতে বৃষ্টির তোড় এল কমে।

আমি তাড়াতাড়ি বর্ষাতি বার করে পরতে লাগলুম।

বিনয়বাবু শুধোলেন, ‘বিমল, তুমি কি বাইরে যাচ্ছ?’

‘হ্যাঁ, আপনারাও আসুন। কামরায় কেবল রামহরি থাক।’ বলেই আমি রিভলভারটাও বার করে পকেটের ভেতরে রাখলুম।

‘ও কি, ওটা নিয়ে আবার কী হবে?’

‘সাবধানের মার নেই।’

কুমার জিজ্ঞাসা করলে, ‘বাঘা সাজগোজ দেখে কীরকম উত্তেজিত হয়েছে দ্যাখো! ওকেও সঙ্গে নেব নাকি?’

‘নিতে চাও, নাও।’

সবাই সশস্ত্র হয়ে কামরা ছেড়ে বাইরে গিয়ে যখন দাঁড়ালুম, তখন ট্রেনের প্রত্যেক কামরা থেকে ভীত যাত্রীরা বেরিয়ে এসে প্রকাণ্ড জনতা সৃষ্টি করেছে। ট্রেনের অনেক কামরার ভেতর থেকে আর্তনাদ ও শিশুদের কান্নাও শোনা যাচ্ছে; অত্যন্ত আচমকা ট্রেনের গতি রুদ্ধ হওয়াতে হয়তো বহু লোক চোট খেয়েছে অল্পবিস্তর।

দূরের আলোকগুলো লক্ষ করে ভিড় ঠেলে আমরা দ্রুতপদে এগুতে লাগলুম। যথাস্থানে উপস্থিত হয়ে দেখলুম ট্রেনের ড্রাইভার, গার্ড ও আরও কয়েকজন কর্মচারী রেললাইনের ওপরে হেঁট হয়ে দাঁড়িয়ে কী পরীক্ষা করছে।

সেই সময়ে এক সাহেব যাত্রী এসে প্রশ্ন করাতে গার্ড বললে, ‘কারা এখানে গাড়ি উলটে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এই দেখুন, লাইনের দুখানা রেল একেবারে খুলে সরিয়ে ফেলা হয়েছে! ভাগ্যে ‘ড্রাইভার’ সতর্ক ছিল, তাই ‘ব্রেক’ কষে কোনওরকমে শেষ মুহূর্তে গাড়ি থামিয়ে ফেলতে পেরেছে!’

রেলপথের দিকে তাকিয়ে দেখে গা শিউরে উঠল! ট্রেন থেমে পড়েছে লাইনের ভাঙা অংশের মাত্র হাত কয়েক আগে! চালক যদি দেখতে না পেত বা একটু অন্যমনস্ক থাকত, তাহলে এই শত—শত পুরুষ—স্ত্রী ও শিশুতে পরিপূর্ণ দ্রুতগামী মেল ট্রেনের অবস্থা যে কী ভয়ানক হত, সেটা ভাবলেও স্তম্ভিত হয়ে যায় বুক!

অনেকে কৃতজ্ঞতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ছুটে গিয়ে সাদরে ড্রাইভারের করমর্দন করে তাকে ধন্যবাদ দিতে লাগল!

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সে ধন্যবাদের পাত্র! তার দৃষ্টি তীক্ষ্ন না হলে এতক্ষণে হয়তো আমাদের সমস্ত সম্পর্ক লুপ্ত হয়ে যেত মাটির পৃথিবীর সঙ্গে। বেঁচে থাকলেও হয়তো হাত বা পা হারিয়ে চিরজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে দিন কাটাতুম—মৃত্যুর চেয়ে সে অবস্থা ভয়ংকর।

কুমার বললে, ‘বিমল এ কাজ কার? এর মধ্যে ছুন—ছিউর হাত নেই তো?’

গোলমালে ছুন—ছিউর কথা ভুল গিয়েছিলুম, কুমারের মুখে তার নাম শোনবামাত্র আমার সারা মন চমকে উঠল।

বিনয়বাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘না, না, অসম্ভব!’

কুমার বললে, ‘অসম্ভব কেন? সে যে আমাদের ভোলেনি, গেল কালই তার প্রমাণ পেয়েছি! কে বলতে পারে, আমাদের গতিবিধির ওপরে সে তীক্ষ্নদৃষ্টি রাখেনি? হয়তো কাল যখন আমরা গাড়ি রিজার্ভ করতে স্টেশনে এসেছিলুম, তখনও তার চর ছিল আমাদের পিছনে পিছনে। টিকিটঘর থেকেই আমাদের গন্তব্যস্থানের খোঁজ নেওয়া কিছুই অসম্ভব নয়! হয়তো ছুন—ছিউ ভেবেছিল, ট্রেন দুর্ঘটনায় গাড়িশুদ্ধ লোক যখন হত বা আহত হবে, চারিদিকে যখন ভীষণ বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হবে, তখন সে সদলবলে সেই গোলে—হরিবোলে এসে আবার লকেটখানা উদ্ধার করবে!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘তোমার আজগুবি কল্পনাকে সংযত করো! তুচ্ছ একখানা লকেটের লোভে ছুন—ছিউর এতখানি বুকের পাটা কিছুতেই হতে পারে না।’

‘কেন হতে পারে না? ছুন—ছিউ কত বড় গোঁয়ার, ভেবে দেখুন দেখি! কলকাতার জনতায় ভরা হোটেলে মানুষ খুন করতে তার হাত কাঁপে না, কলকাতার মতো শহরে দিনের বেলায় আমাদের বাড়ি আক্রমণ করতে সে পিছপাও হয়নি, কলকাতার পুলিশ—কোর্ট থেকে সতর্ক পাহারা এড়িয়ে সে লম্বা দিয়েছিল—এমন সব দুঃসাহসের কাহিনি আর কখনও শুনেছেন? অদ্ভুত এই চিনে দস্যু! আমার বিশ্বাস সে সব করতে পারে!’

আমি এ তর্কে যোগ দিলুম না। আমি তখন ভাবছিলুম, ঘটনাস্থলে অদৃশ্য অপরাধী কোনও চিহ্ন রেখে গেছে কি না? বিজলি মশালের আলো ফেলে রেলপথটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলুম। সেখানে পাথর—ভাঙা নুড়িগুলোর ওপরে কোনও চিহ্নই নেই! উঁচু বাঁধের ঢালু গায়ে রয়েছে ঘাসের আগাছার আবরণ। সেখানেও কিছু পেলাম না। আঁধার রাত্রি তখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি বর্ষণ করছিল—বাঁধের তলায় দেখলুম কর্দমাক্ত জমি। অপরাধীরা নিশ্চয়ই পাখি হয়ে উড়ে পালায়নি। বাঁধের এপাশে কি ওপাশে মাটির ওপরে তাদের কোনও চিহ্নই কি পাওয়া যাবে না? ভাবতে—ভাবতে নীচে নামতে লাগলুম। বাঘা আমার অনুসরণ করলে। এরকম কাজ পেলে সে ভারী খুশি হয়, ল্যাজ নেড়ে—নেড়ে সেইটেই বোধ করি আমাকে জানিয়ে দিতে চাইলে!

বিনয়বাবু চেঁচিয়ে বললেন, ‘ওকী হে, ওদিকে কোথায় নামছ? শেষটা সাপের কামড়ে মারা পড়বে?’

কোনও জবাব দিলুম না। একেবারে সামনের দিকে চেয়ে দেখলুম। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, গোঁ—গোঁ করে ঝড় ডাকছে, অন্ধকার ফুঁড়ে দূর অরণ্যের কোলাহল ভেসে আসছে! অদৃশ্য কালো মেঘকে দৃশ্যমান করে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে মাঝে—মাঝে। খানিক তফাতে আঁধারপটে আরও আঁধার রং দিয়ে আঁকা রয়েছে একটা ছোট বন, নীচের দিকে কালি—মাখা ঝোপঝাপ, ওপর দিকে টলোমলো গাছ—যেন কতকগুলো শিকলে—বাঁধা দানব মুক্তিলাভের চেষ্টায় ছটফট করছে।

বাঁধের তলাতেই পেলুম আমি যা খুঁজছিলাম! কুমারকে ডাকতেই সে ছুটে নেমে এল।

সে বললে, ‘এ যে অনেকগুলো লোকের পায়ের দাগ! দাগ দেখে মনে হচ্ছে লোকগুলো মাঠের দিকে গিয়েছে!’

বাঘা গম্ভীরভাবে সশব্দে মাটি শুঁকতে লাগল! তারপর চাপা গলায় গর্জন করে বোধ করি পলাতক শত্রুদেরই ধমক দিলে।

বাঁধের ওপর থেকে কৌতূহলী গার্ডও নেমে এসে বললে, ‘বাবু, তোমরা কী করছ?’

আমি অঙ্গুলিনির্দেশে মাটির দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলুম।

গার্ড খানিকক্ষণ নীরবে দাগগুলো পরীক্ষা করে বললে, ‘দেখছি টাটকা পায়ের দাগ!’

বললুম, ‘হ্যাঁ, এদের বয়স বেশিক্ষণ নয়। সেইজন্যেই মনে হচ্ছে এই দাগগুলো অপরাধীদেরই পায়ের। কারণ, এমন দুর্যোগে এতগুলো লোক নিশ্চয়ই এখানে ফুর্তি করে হাওয়া খেতে আসেনি।’

গার্ড বললে, ‘বাবু, ওই কুকুরটা মাটির ওপরে কী শুঁকতে—শুঁকতে এগিয়ে যাচ্ছে!’

‘পায়ের চিহ্নর ভেতরে ও শত্রুদের গন্ধ আবিষ্কার করেছে।’

গার্ড বিস্মিতস্বরে বললে, ‘এটা তো দেখছি, দেশি কুকুর, ও আবার পায়ের দাগের কী মর্ম বুঝবে?’

কুমার বললে, ‘যত্ন আর শিক্ষা পেলে আমাদের দেশি কুকুর তোমাদের বিলিতি হাউন্ডের চেয়ে কম কাজ করে না। বাঘা শত্রুদের গন্ধ চেনে।’

বাঘার সঙ্গে—সঙ্গে আমরাও রেলপথের তারের বেড়া পার হয়ে অগ্রসর হতে লাগলুম। আমাদের পিছনে—পিছনে আসতে লাগল আরও অনেক কৌতূহলী লোক—তাদের ভেতরে সাহেব আছে, বাঙালি আছে, হিন্দুস্থানি আছে।

খানিক পরে একটা ঝোপ। গার্ডকে ডেকে বললুম, ‘এইবারে দাগগুলোর দিকে তাকিয়ে দ্যাখো।’

‘কী দেখব?’

‘খানিক আগে মুসলধারে বৃষ্টি পড়ছিল বলে পায়ের ছাঁচগুলো ছিল জলে ভরতি! কিন্তু এখানকার পায়ের ছাঁচ ভিজে হলেও জলে ভরতি নয়।’

‘তাতে কী বোঝায়?’

‘এই বোঝায় যে অপরাধীরা একটু আগেই ঝোপের আড়ালে ছিল দাঁড়িয়ে। বোধ হয় অপেক্ষা করছিল ট্রেনখানা ওলটাবার জন্যে। কিন্তু ট্রেন রক্ষা পেয়েছে আর আমরা আসছি দেখে তারা চটপট সরে পড়েছে।’

‘বাবু, তোমার যুক্তি বুঝলুম না।’

‘মুষলধারার পর যখন টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়, অপরাধীরা তখনই এখান থেকে পালিয়েছে। তাই এখান থেকে যেসব পায়ের ছাপ শুরু হয়েছে তাদের ভেতরটা এখনও জলে পূর্ণ হওয়ার সময় পায়নি।’

গার্ড বললে, ‘বাবু, তুমি কি পুলিশে কাজ করো?’

‘না।’

‘তবে তুমি এমন তীক্ষ্নদৃষ্টি পেলে কেমন করে?’

‘ভগবান দিয়েছেন বলে। ভগবান সাবইকে চক্ষু দেন বটে, কিন্তু সকলকেই তীক্ষ্নদৃষ্টি দেন না।’

গার্ড বললে, ‘ঠিক বাবু, তোমার কথা আমি স্বীকার করি। পায়ের দাগগুলো আমিও দেখেছি, কিন্তু বুঝতে পারিনি। অথচ এখন তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, এটুকু আমার অনায়াসেই বোঝা উচিত ছিল। বাবু, তুমি আর কিছু বুঝতে পেরেছ?’

‘এখান থেকে প্রায় দুশো গজ তফাতে একটা জঙ্গলের আবছায়া দেখা যাচ্ছে। পায়ের দাগগুলো ওইদিকেই গিয়েছ। অপরাধীরা নিশ্চয় ওই জঙ্গলের ভেতরে লুকিয়ে আছে।’

কুমার বললে, ‘এখন আমরা কী করব? ওইদিকে যাব?’

গার্ড বললে, ‘না, এখন আমাদের ফিরতে হবে।’

‘কেন?’

‘আমার ওপরে রয়েছে অপরাধী গ্রেপ্তার করার চেয়েও বড় কর্তব্যের ভার। রেললাইন ভেঙেছে, এই খবর দেওয়ার জন্যে আমাকে এখন গাড়ি নিয়ে পিছনের স্টেশনে ফিরে যেতে হবে। নইলে কোনও ডাউন—ট্রেন এসে পড়লে বিষম দুর্ঘটনার সম্ভাবনা, আর সেজন্যে দায়ী হব আমিই।’

গার্ডের কথা সত্য। তার ওপরে আমরা ঠিক প্রস্তুত হয়েও আসিনি, সঙ্গে যে লোকেরা রয়েছে তারা হয়তো এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ওই অচেনা জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতে ভরসা করবে না। আর এমন রাতে অপরাধীদের খুঁজতে যাওয়াও হবে হয়তো বুনো হাঁসের পিছনে এলোমেলো ছুটোছুটি করার মতো। খুব সম্ভব তাদের খুঁজে পাব না, আর খুঁজে পেলেও ছুন—ছিউ ও তার দলবলকে গ্রেপ্তার করা বড় চারটি খানিক কথা নয়! হয়তো তারা দলে ভারী আর সশস্ত্র।

বিনয়বাবু বললেন, ‘ওহে বাপু বিমল! চুপ করে ভাবছ কী? গোঁয়ারতুমি করবার ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?’

আমি হেসে বললুম, ‘মোটেই নয়! গার্ড—সাহেবের পিছু—পিছু আমি পলায়ন করতে চাই!’

কুমার বললে, ‘যঃ পলায়তি স জীবিতি! সেকালে কোন বুদ্ধিমান বাঙালিও বলে গেছেন, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। আমরা হচ্ছি পিতৃভক্ত পুত্র, বাপের নাম করবার সুযোগ পাব বলেই পৈতৃক প্রাণটা রক্ষা করা দরকার।’

আমি বললুম, ‘কিন্তু কুমার, বাঘা বোধহয় পশু বলেই পৈতৃক প্রাণের মর্যাদা বোঝে না। ওই দ্যাখো, সে আবার বনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে!’

বাঘা খালি এগুচ্ছে না, উচ্চস্বরে ঘেউ—ঘেউ চিৎকারও করছে। তার ওরকম চিৎকারের অর্থ আমরা বুঝি। মানুষের পক্ষে অসাধারণ বাঘার পশুদৃষ্টি তিমির—যবনিকা ভেদ করে নিশ্চয়ই কোনও শত্রু আবিষ্কার করেছে।

বাঘা ফিরতে রাজি নয় দেখে কুমার দৌড়ে গিয়ে তার বকলস চেপে ধরলে। কিন্তু তবু সে বাগ মানতে চাইলে না—বারবার জঙ্গলের দিকে ফিরে—ফিরে দেখে আর কুমারের হাত ছাড়াবার জন্যে টানাহ্যাঁচড়া করে। তার ক্রুদ্ধ চোখদুটো জ্বলছে আগুনের ভাঁটার মতো।

ওদিকে তাকিয়ে আমি কিন্তু খালি দেখলুম, বৃহৎ বৃহৎ—বাহু আকাশে আন্দোলিত করে জঙ্গল করছে মর্মর—হাহাকার। তবে এ সন্দেহটা বারংবারই মনের মধ্যে জাগতে লাগল যে, ওই অন্ধকার কেল্লার ভেতরে যারা গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, আমাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তারা একটুও অচেতন নয়—ঝোপঝাড়ের ফাঁকে—ফাঁকে নিশ্চয়ই জাগ্রত হয়ে আছে তাদের হিংস্র চক্ষুগুলো।

গার্ড বললে, ‘আর দেরি নয়, সবাই ফিরে চলো!’

কমল আপশোশ করে বললে, ‘হায় রে হায়, একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চার একেবারেই মাঠে মারা গেল!’

খাপ্পা হয়ে বিনয়বাবু বললেন, ‘চুপ, চুপ! একে মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ!’

হঠাৎ বাঘা জঙ্গলের দিকে চেয়ে একেবারে যেন হন্যে হয়ে চেঁচিয়ে উঠল—কুমার আর তাকে ধরে রাখতে পারে না।

গার্ড আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘কুকুরটা হঠাৎ এমন করছে কেন?’

তার প্রশ্নের উত্তর এল জঙ্গলের দিক থেকে। আচম্বিতে অন্ধকার রাত্রিকে কাঁপিয়ে গুড়ুম—গুড়ুম করে দুইবার বন্দুকের আওয়াজ হল—চোখের ওপরে জ্বলেই নিবে গেল দুটো বিদ্যুতের চমক!

যে কৌতূহলী যাত্রীগুলো আমাদের পিছু নিয়েছিল, তারা সভয়ে প্রাণপণে দৌড় মারলে রেলপথের দিকে, আমাদের চারজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইল খালি গার্ড ও একজন সাহেব।

আমি চেঁচিয়ে বললুম, ‘ওই ঝোপের আড়ালে চল—ঝোপের আড়ালে চল!’

ঝোপের পাশে গিয়ে গার্ড উত্তেজিত হয়ে বললে, ‘বাবু, বাবু, ওরা কি আমাদের আক্রমণ করতে চায়?’

কুমার বললে, ‘করতে চায় কি, আক্রমণ করেছে! ওই দ্যাখো, জঙ্গলের দিক থেকে কতগুলো সাদা কাপড় পরা মূর্তি ছুটে আসছে!’

আমি রিভলভার বার করে বললুম, ‘দেখছেন বিনয়বাবু, সঙ্গে কেন যন্ত্র আনতে বলেছিলুম?’

কুমার হাসতে—হাসতে বললে, ‘ভাই বিমল, আমাদের পৈতৃক প্রাণগুলো এ যাত্রা শনির দৃষ্টি বুঝি আর এড়াতে পারলে না।’

সপ্তম পরিচ্ছেদ । রামহরির ধূলিশয্যা

একটা ঝোড়ো দমকা হাওয়া আচমকা জেগে হুঙ্কার দিয়ে উঠল—সঙ্গে—সঙ্গে টলোমলো গাছপালাগুলো কেঁদে উঠল আরও বেশি উচ্চস্বরে। তারপরেই আবার এল ঝেঁপে বৃষ্টি। গড়গড়—গড়গড় বাজের ধমক—চকমক ঝকমক বিদ্যুৎ চমক!

একে মেঘে কাজলমাখা রাতের অন্ধকার, তার ওপরে সেই ঘন বৃষ্টিধারার পরদা। চোখ আর এদের ভেদ করে এগিয়ে যেতে পারল না। শত্রুরাও নিশ্চয় এখন আমাদের দেখতে পাচ্ছে না।

যে সাহেবটা শত্রুদের বন্দুকের ভয়ে পালায়নি সে বললে, ‘বাবু, এখন আমাদের কর্তব্য কী?’

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘তুমি কি নিরস্ত্র?’

‘না, আমার কাছে রিভলভার আছে।’

‘তাহলে এই ঝেপের আড়ালে আমাদের মতো হাঁটু গেড়ে বসে পড়ো। শত্রুদের আমাদের রিভলভারের নাগালের ভেতরে আসতে দাও। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে, আমরা নিতান্ত অসহায় নই।’

গার্ড বললে, ‘কিন্তু শত্রুদের কারুকেই তো দেখা যাচ্ছে না! তারা—’

তার মুখের কথা শেষ হতে—না—হতেই আবার শোনা গেল দুটো বন্দুকের শব্দ। কিন্তু সে হচ্ছে লক্ষ্যহীনের বন্দুক, গুলি যে কোন দিকে ছুটল আমরা তা টেরও পেলুম না।

কুমার বললে, ‘বন্দুকের শব্দ খুব কাছে এসে পড়েছে! ওরা বন্দুক ছুড়ছে আমাদের ভয় দেখাবার জন্যে!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘এই সুযোগে দৌড়ে আমাদের গাড়ির দিকে যাওয়া উচিত।’

কুমার বললে, ‘পিছনে সশস্ত্র শত্রু নিয়ে গাড়ির দিকে দৌড়োতে গেলে বিপদের সম্ভাবনা আছে।’

অন্ধকার বিদীর্ণ করে আকাশের বুকে জ্বলে উঠল একটা সুদীর্ঘ বিদ্যুৎ এবং তারই আলোকে দেখা গেল, খানিক তফাতে একদল লোক দ্রুতপদে অগ্রসর হচ্ছে!

গার্ড ত্রস্ত স্বরে বললে, ‘ওরা ট্রেনের দিকে যাচ্ছে—ওরা ট্রেনের দিকে যাচ্ছে! ওরা ভেবেছে আমরা আর এখানে নেই!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘কী সর্বনাশ! ওরা কি ট্রেন আক্রমণ করতে চায়?’

কুমার বললে, ‘বিমল, বিমল! ওদের দেখা যাচ্ছে! ওদের নাগালের মধ্যে পেয়েছি!’

আমি বললুম, ‘ছোড়ো রিভলভার!’

প্রায় একসঙ্গে আমাদের পাঁচটা রিভলভার গর্জন করে উঠল—এবং পরমুহূর্তেই জাগল একটা বিকট আর্তনাদ!

আবার ডাকল বাজ—আবার জ্বলল বিদ্যুৎ—শিখা! এবং আবার গর্জন করলে আমাদের রিভলভারগুলো!

কমল চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওরা পালাচ্ছে—ওরা পালাচ্ছে!’

আমি বললুম, ‘আবার ছোড়ো রিভলভার!’

আমাদের পাঁচটা রিভলভার আর একবার চিৎকার করে উঠল।

রাত্রের শরীরী অভিশাপের মতন অস্পষ্ট মূর্তিগুলো আবার মিলিয়ে গেল অন্ধকার ও বৃষ্টিধারার অন্তঃপুরে।

বাঘার উৎসাহিত গর্জনে কান পাতা দায়! ভাগ্যে কুমার তাকে সজোরে নিজেরই দুই হাঁটুর ভেতরে চেপে, বাঁ—হাতে তার বকলস টেনে ধরেছিল, নইলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই সে শত্রুদের মাঝখানে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত!

কমল আহ্লাদে নৃত্য করতে করতে বললে, ‘জয়, আমাদের জয়! বৎসগণ! ভেবেছিলে ফাঁকতালে করবে কেল্লা ফতে? হুঁ—হুঁ, ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ তো দ্যাখোনি!’

তখনি কমলের একখানা হাত ধরে বিনয়বাবু তার নৃত্যোচ্ছ্বাস থামিয়ে দিলেন।

আমি বললুম, ‘এই হচ্ছে সরে পড়বার সুযোগ! ছোটো সবাই ট্রেনের দিকে!’

অন্ধকার আর বৃষ্টিধারা কেবল শত্রুদেরই ঢেকে রাখেনি, তাদের আশ্রয় পেয়ে আমরাও নিরাপদে ট্রেনের কাছে গিয়ে পড়লুম।

যাত্রীরা কেউ বাইরে ছিল না। বন্দুক আর রিভলভারের শব্দ লুপ্ত করে দিয়েছে তাদের সমস্ত কৌতূহল। প্রত্যেক কামরার দরজা ও খড়খড়িগুলো বন্ধ করে দিয়ে তারা হয়তো তখন ইষ্টদেবতার নাম জপ করছিল।

আমাদের সঙ্গের সাহেব বললে, ‘ইন্ডিয়া কি ক্রমে আমেরিকা হয়ে উঠল! সশস্ত্র ডাকাত এসে ট্রেন আক্রমণ করে, এদেশে এমন কথা কে কবে শুনেছে?’

গার্ড বললে, ‘কামরায় গিয়ে ওসব কথা নিয়ে মাথা ঘামিয়ো! ইঞ্জিন এখনি গাড়িকে পিছনের স্টেশনে নিয়ে যাবে!’ বলেই সে দ্রুতপদে চলে গেল।

এমন সময়ে হঠাৎ উপরি—উপরি আরও কয়েকবার বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল এবং কাঠ—ফাটা শব্দ শুনে বুঝলুম, একটা গুলি ট্রেনের কোনও কামরার গায়ে এসে লাগল।

ডাকাতরা কি আমাদের উদ্দেশ্য ধরে ফেলেছে? তারা কি আবার আমাদের আক্রমণ করতে আসছে?

অন্য ক্ষেত্র হলে আমরা এইখানেই দাঁড়িয়ে আবার তাদের উচিতমতো অভর্থনার ব্যবস্থা করতুম। কামরার ভেতরেই আছে আমাদের ‘অটোমেটিক’ বন্দুকগুলো। তাদের প্রত্যেকটা মিনিটে পঁয়ত্রিশটা গুলি বৃষ্টি করতে পারে। সেগুলো হাতে থাকলে আমরা পাঁচজনে দুইশত শত্রুকেও বাধা দিতে পারি।

কিন্তু সে—সময় পেলুম না। দূর থেকে বেজে উঠল গার্ডের বাঁশি, গাড়ি ছাড়তে আর দেরি নেই! ‘টর্চে’র আলো ফেলে তাড়াতাড়ি আমাদের কামরা আবিষ্কার করতে বাধ্য হলুম। কোনওরকমে গাড়িতে উঠে পড়বার সময় মাত্র পেলুম।

গাড়ি ছাড়বার সঙ্গে—সঙ্গেই মাঠের ভেতর থেকে ভেসে এল একটা উচ্চ কোলাহল। সে হচ্ছে মুখের গ্রাস পালিয়ে গেল দেখে ডাকাতদের হতাশার চিৎকার! হতভাগারা অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছিল, সমস্তই ব্যর্থ হল।

ট্রেন পিছু হেঁটে চলেছে—তার গতি খুব দ্রুত নয়। আমাদের কামরার ভেতরেও ঘুটঘুট করছে অন্ধকার।

কুমার বললে, ‘ছি রামহরি, ছিঃ! তুমিও ভয়ে আলো নিবিয়ে অন্ধকারে ইঁদুরের মতন লুকিয়ে আছ!’

রামহরি কেমন যেন শ্রান্তস্বরে বললে, ‘মোটেই নয় কুমারবাবু, মোটেই নয়। একবার আলো জ্বেলে দ্যাখো না!’

কমল আলো জ্বাললে।

বিপুল বিস্ময়ে দেখলুম, কামরার মেঝের ওপরে শুয়ে রয়েছে রামহরি, তার হাত—পা দড়ি দিয়ে বাঁধা!

বিস্ফারিত চক্ষে তার দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘রামহরি, এ কী ব্যাপার!’

ম্লান হাসি হেসে রামহরি বললে, ‘খোকাবাবু, কামরা থেকে তোমরা বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি জানলায় মুখ বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছিলুম। ওদিকের জানলা দিয়ে জন তিনেক লোক কখন যে নিঃশব্দে কামরার ভেতরে ঢুকেছিল, আমি একটুও টের পাইনি। আমার অজান্তেই তারা আমাকে আক্রমণ করলে, আমি কোনওরকম বাধা দেওয়ার ফাঁক পর্যন্ত পেলুম না।’

‘কে তারা? চিনেম্যান!’

‘না, পশ্চিমের লোক, হিন্দুস্থানি।’

‘তারপর?’

‘একটা লোক ছোরা নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললে, ‘চ্যাঁচালেই মরবি!’ আর দুটো লোক আমাদের মোটঘাট, সুটকেসগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল।’

ফিরে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলুম, আমাদের অধিকাংশ মোটই মেঝেময় ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। প্রত্যেক সুটকেসের তালা খোলা।

রামহরি বললে, ‘ভয় নেই তোমাদের, তারা কিছু নিয়ে যায়নি। তাদের ভাব দেখে মনে হল, তারা যেন কোনও বিশেষ জিনিসেরই সন্ধান করছে!’

কুমার বললে, ‘তবে কি তারা সাধারণ চোর নয়? তারা কি সেই ধুকধুকিখানার লোভেই কামরার ভেতরে ঢুকেছিল?’

বিনয়বাবু বললে, ‘ধুকধুখিনা তো চিনেম্যানদের সম্পত্তি। আর রামহরি বলছে যারা এসেছিল, তারা হচ্ছে হিন্দুস্থানি।’

আমি রামহরির হাত—পায়ের বাঁধন খুলে দিতে—দিতে বললুম, ‘বিনয়বাবু, এই চিনে ডাকাতেরা বড় সহজ লোক নয়। তারা বেশ জানে, ভারতে এসে কাজ হাসিল করতে গেলে এদেশি লোকের সাহায্য না নিলে চলবে না। কারণ, কোনও ছদ্মবেশই চিনেদের মঙ্গোলীয় ছাঁচ ঢাকতে পারবে না, ভারতীয় জনতার মধ্যে তাদের দেখলেই সকলে চিনে ফেলবে। কাজেই তারা এদেশি গুন্ডাদেরও সাহায্য নিয়েছে। তাদের দলের লোক নিশ্চয় ট্রেনের মধ্যে ছিল, আমরা কামরা ছাড়বার পরেই সুযোগ পেয়ে এসেছিল রামহরির সঙ্গে আলাপ করতে।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এবার থেকে আমাদের দেশি—বিদেশি দুরকম শত্রুর সঙ্গেই যুঝতে হবে? ব্যাপারটা ক্রমেই সঙ্গিন হয়ে উঠছে যে!’

কুমার বললে, ‘উঠুক—আমরা থোড়াই কেয়ার করি। কিন্তু রামহরি, তোমার গল্পের শেষটা এখনও তো শোনা হয়নি।’

রামহরি উঠে বসে গায়ের ধুলো ঝাড়তে—ঝাড়তে বললে, ‘গল্পটা আরও কিছু বড় হতে পারত, কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ শেষ হয়ে গেল তোমাদের জন্যেই।’

আমি বললুম, ‘আমাদের জন্যেই?’

‘হ্যাঁ গো খোকাবাবু, হ্যাঁ। কামরার আলো নিবিয়ে ‘টর্চে’র আলোয় তারা একমনে খোঁজাখুঁজি করছে, এমন সময়ে বাইরে থেকে এল তোমাদের সাড়া। গার্ডের বাঁশিও শোনা গেল—সঙ্গে—সঙ্গে কামরার ভেতর থেকে তারাও তাড়াতাড়ি সরে পড়ল। আর আমার কথাও ফুরোল।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘ধুকধুকিখানা তারা খুঁজে পায়নি তো?’

আমি হাসতে—হাসতে নীচু গলায় বললুম, ‘ধুকধুকিখানা আছে কলকাতায়।’

বিনয়বাবু সবিস্ময়ে বললেন, ‘সে কী?’

‘ধুকধুকিখানা একেবারেই বাজে। আসল দরকার তার ভেতরের লেখাটুকু। আমি আর কুমার সেটুকু মুখস্থ করে রেখেছি।’

কমল খুশি হয়ে বলে উঠল, ‘বাহবা কি বাহবা। ধুকধুকির লেখা পড়তে হলে ছুন—ছিউকে এখন বিমলদা আর কুমারদার মনের ভেতরে ঢুকতে হবে!’

আরও খানিকক্ষণ পরে ট্রেন এসে স্টেশনে ঢুকে বিষম চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলে। চারিদিকে মহা হইচই, লোকজনের ছুটোছুটি!

রামহরিকে নিয়ে আমরাও গাড়ি থেকে নেমে পড়লুম। গার্ড আর পুলিশের সঙ্গে ট্রেনের প্রত্যেক কামরা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলুম, কিন্তু রামহরি সেই তিনজন লোককে কোথাও আবিষ্কার করতে পারলে না। নিশ্চয়ই তারা মাঠের মধ্যে নেমে গিয়েছে।

সকালবেলায় একদল পুলিশের লোক ঘটনাস্থলে গেল খানাতল্লাশ করবার জন্যে। কিন্তু মাঠ, জঙ্গল ও আশপাশের গ্রাম খুঁজে অপরাধীদের কারুকেই পেলে না। আমার বিশ্বাস, তারা কোনও পাহাড়ে উঠে আত্মগোপন করে আছে।

যথাসময়ে লাইন মেরামত হল। ট্রেন আবার ছাড়ল। দিন—রাত যক্ষপতির রত্নপুরীর সমুজ্জ্বল স্বপ্ন দেখতে—দেখতে আমরা ক্রমেই এগিয়ে চললুম, ভারতের উত্তর সীমান্তের দিকে।

ভারতের উত্তর সীমান্ত আমার মনে চিরদিনই জাগিয়ে তোলে বিচিত্র উত্তেজনা! আফগানিস্তান যখন ছিল হিন্দুস্থানেরই এক অংশ, তখন সেই রামায়ণ—মহাভারতের যুগ থেকে সেখানে হয়েছে কত না অদ্ভুত নাটকের অভিনয়! শক, তাতার, হূণ, মোগল, চিন, পারসি ও গ্রিক প্রভৃতি জাতির—পর—জাতি এই পথ দিয়েই মূর্তিমান ধ্বংসের মতন ছুটে এসেছে সোনার ভারত লুণ্ঠন করবার জন্যে। দেশরক্ষার জন্যে যুগে—যুগে ভারতের কত লক্ষ—লক্ষ বীর ঢেলেছে সেখানে বুকের রক্তধারা! ওখানকার আকাশছোঁয়া পাহাড়ের শিখরে—শিখরে আজ বাতাসে—বাতাসে যে অশ্রান্ত গান জেগে ওঠে, সে হচ্ছে এই প্রাচীন ভারতেরই অতীত গৌরবগাথা। ঐতিহাসিক ভারতের সর্বপ্রথম সম্রাট ও শ্রেষ্ঠ মহাবীর চন্দ্রগুপ্ত ওই পথ দিয়েই ভারতের শত্রু গ্রিকদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন আর্যাবর্তের বাইরে। যে পার্বত্যজাতি প্রচণ্ড রণোন্মাদ পৃথিবীজয়ী আলেকজান্ডারকেও ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল, তাদের সুযোগ্য বংশধররা আজও সেখানে বর্তমান আছে। এই বিংশ শতাব্দীর উড়োজাহাজ আর কলের কামানও তাদের যুদ্ধোন্মাদনা শান্ত বা তাদের অস্তিত্ব লোপ করতে পারেনি। দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ—সিংহ আজও সেখানে ঘুমোবার অবসর পায় না। আজকের ভারতে যারা সত্যিকারের ‘অ্যাডভেঞ্চার’ খুঁজে বেড়ায়, ভারতের উত্তর সীমান্ত পূর্ণ করতে পারে তাদের মনের প্রার্থনা।

বিনয়বাবুর মুখে শুনলুম, আফগানিস্তানের মধ্যে কাফ্রিস্থান হচ্ছে এক রহস্যময়, অদ্ভুত দেশ। ওখানকার লোকজন, আচার—ব্যবহার সমস্তই নতুনরকম। আমাদের যক্ষপতির ঐশ্বর্য আছে ওই কাফ্রিস্থানেই। ওইখানেই উঠবে পরের দৃশ্যের যবনিকা।

অষ্টম পরিচ্ছেদ । কাফ্রিস্থানের কথা

মালাকান্দ গিরিসঙ্কটের ভেতর দিয়ে আগে পড়লুম সোয়াট, তারপর ডির মুল্লুকে; তারপর উঠলুম লোয়ারি গিরিসঙ্কটের (দশ হাজার ফুটের চেয়েও উঁচু) ওপরে এবং তারপরে পৌঁছোলুম চিত্রল রাজ্যে।

এসব জায়গার বেশি বর্ণনা দেওয়ার দরকার নেই, কারণ আমাদের গন্তব্যস্থান হচ্ছে কাফ্রিস্থান। তবে অল্প দু—চার কথা বললে মন্দ হবে না।

এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে অপূর্ব, সে কথা বলা বাহুল্য। আমাদের মতন সমতল দেশের বাসিন্দাদের চোখ আর মন এই অসমোচ্চেচ পর্বত সাম্রাজ্যে এসে একেবারে অভিভূত হয়ে গেল। নানা আকারের শৈলমালার এমন বিচিত্র উৎসব আমি আর কখনও দেখিনি। এই চিত্রল যে কীরকম বন্ধুর দেশ, একটা কথা বললেই সকলে সেটা বুঝতে পারবেন। এ অঞ্চলে মোটঘাট স্থানান্তরিত করবার জন্যে কেউ মালগাড়ি ব্যবহার করে না, কারণ তা অসম্ভব। চিত্রলীদের অভিধানে নাকি গাড়ির চাকা বোঝায় এমন কোনও শব্দই নেই। তবে চিত্রলের শাসনকর্তার (Mehtar) দৌলতে আজকাল ওখানে খানকয় মোটরের আবির্ভাব হয়েছে বটে।

এ হচ্ছে কেবল পনেরো, ষোলো, সতেরো হাজার ফুট উঁচু আকাশছোঁয়া পাহাড়ের দেশ—খালি চড়াই আর উতরাই, খাদ আর উপত্যকা, শৈলশিখরের পর শৈলশিখরের নিস্পন্দ তরঙ্গ! দূরে—দূরে দেখা যায় আরও উঁচু শৈলমালার ওপরে চিরতুষারের শুভ্র সমারোহ। আমাদের একমাত্র সহায় এদেশি পনি ঘোড়া—অতি ভয়াবহ, উঁচু—নীচু সংকীর্ণ পথেও এসব ঘোড়ার পা একবারও পিছলোয় না—কিন্তু একবার পিছলোলে আর রক্ষা নেই, কারণ পরমুহূর্তে তোমাকে নেমে যেতে হবে হাজার—হাজার ফুট নীচে কোথায় কোন অতলে। ইহলোক থেকে একেবারে পরলোকে।

একদিন দুপুরবেলায় নিশ্চিন্তভাবে এগিয়ে চলেছি, নির্মেঘ আকাশ পরিপূর্ণ রৌদ্রে ঝলমল করছে, আচম্বিতে দূরে জাগলে ঘনঘোর মেঘগর্জন!

আমার বিস্মিত মুখের পানে তাকিয়ে গাইড হাসতে—হাসতে বললে, ‘বাবুজি, ও মেঘের ডাক নয়।’

‘তবে?’

‘পাহাড় ভেঙে পড়ছে।’

‘এদেশে প্রায়ই পাহাড় ভেঙে পড়ে নাকি?’

‘প্রায়ই। লোকজন হামেশাই মারা পড়ে। সময়ে—সময়ে গ্রামকে গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়।’

এই হিংস্র পাহাড়ের দেশে মানুষদেরও প্রকৃতি রীতিমতো বন্য। আমরা যে সোয়াট ও ডির দেশ পিছনে ফেলে এসেছি, সেখানকার মুসলমানদের ধর্মোন্মাদনা ভয়ংকর। বিধর্মীদের হত্যা করা বলতে তারা বোঝে, স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা সাফ করা।

সোয়াট আর ডির দেশের মধ্যে মারামারি হানাহানি লেগেই আছে। লড়তে মারতে ও মরতে তারা ভালোবাসে—রক্ত ও মৃত্যু যেন তাদের প্রিয় বন্ধু!

একদিন যেতে—যেতে দেখি এক জায়গায় দুই দল করছে মারামারি। বন্দুক গর্জন করছে, বনবন লাঠি ঘুরছে আর ঝকমক জ্বলছে তরবারি! দস্তুরমতো যুদ্ধ। মাটিতে পড়ে কয়েকটা আহত দেহ ছটফট করছে এবং কয়েকটা দেহ একেবরে নিস্পন্দ—অর্থাৎ এ জীবনে তারা আর নড়বে না।

কিন্তু তাদের কেউ তখন বিধর্মী বধ করে স্বর্গের রাস্তা পরিষ্কার করবার জন্যে আগ্রহ দেখালে না, বরং আমাদের দেখে অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আমাদের গাইড ভয়ে—ভয়ে তাদের কাছে এগিয়ে গেল। তারপর ছুটে এসে বললে, ‘বাবুজি, জলদি এখান থেকে চলে আসুন। পাছে আমরা জখম হই, তাই ওরা লড়াই করতে পারছে না।’

মনে—মনে ওদের সুবুদ্ধিকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললুম। তারপর রাস্তার মোড় ফিরে একটা পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে হইচই শুনেই বুঝলুম, ওদের যুদ্ধ আবার আরম্ভ হয়েছে।

কুমার বললে, ‘এরা লড়াই করছে কেন?’

গাইড বললে, ‘এক পয়সার পেঁয়াজের জন্যে!’

চিত্রলের পরেই হচ্ছে কাফ্রিস্থান। এদেশটি এখন আফগানিস্তানের আমিরের শাসনাধীন হয়ে মুসলমান প্রধান হয়ে পড়েছে বটে, কিন্তু এখানকার মুসলমানরা খুব বেশি গোঁড়াও নয়, তাদের আচার—ব্যবহারও একেবারে অন্যরকম। কিন্তু এখনও এদেশে পুরোনো কাফিদের এমন এক সম্প্রদায় বাস করে, যারা পৈতৃক রীতিনীতি ও পৌত্তলিকতা বর্জন করেনি। নানান দেবতার কাঠের মূর্তি গড়ে তারা পূজা করে এবং তাদের প্রধান—প্রধান দেবতার নাম হচ্ছে : ইম্র, মণি, গিষ, বাগিষ্ট, আরম, সানরু, সাতারাম বা সুদারাম। ওঁরা হচ্ছেন পুরুষ—দেবতা। দেবীদের নাম দিয়েছে ওরা সঞ্জীরক্তী, দিজোন, নির্মলী ও সুমাই প্রভৃতি। অনুমানে বেশ বোঝা যায়, এদের দেব—দেবী হচ্ছেন প্রাচীন হিন্দু দেব—দেবীরই রূপান্তর।

‘কাফ্রিস্থান’ বলতে বুঝায় কাফির অর্থাৎ অবিশ্বাসীদের দেশ। বলা বাহুল্য, এ নামটি মুসলমানদের দেওয়া। হিন্দুদের পরে একসময়ে এখানে ছিল চিনাদের প্রভুত্ব। তার কিছু—কিছু চিহ্ন আজও পাওয়া যায়। আমাদের চোখের সামনে নাচছে যে গুপ্তধনের স্বপ্ন, তারও মালিক ছিলেন এক চিনা রাজপুত্র। সেই গুপ্তধন আছে এক বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে। সুতরাং এ—অঞ্চলে আগে বৌদ্ধদেরও প্রাধান্য ছিল। তারপর মুসলমানরা বারে—বারে আক্রমণ করেছিল কাফ্রিস্থানকে। চেঙ্গিস খাঁ ও তৈমুর লং প্রভৃতি দিগ্বিজয়ীরাও নাকি এদিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের কারুর প্রাধান্যই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নিজের চারিদিকে মুসলমান প্রতিবেশী নিয়েও গত শতাব্দী পর্যন্ত কাফ্রিস্থান আপন স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পেরেছিল।

কাদিরা দেখতে সুন্দর। তারে গায়ের রং প্রায় গৌর, দেহ লম্বা, মুখ চওড়া, চোখ গ্রিকদের মতো। শীতপ্রধান দেশের বাসিন্দা বলে তারা স্নান করতে একেবারেই নারাজ। পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন হলে তাদের চেহারা যে আরও চমৎকার হত, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই!

কি মুসলমান ও কি পৌত্তলিক কাফির প্রত্যেকেই পরিবারের কেউ মারা পড়লে, গাঁয়ের প্রান্তে নির্দিষ্ট এক ঢালু পাহাড়ের গায়ে উঠে চার পায়াওয়ালা বড় সিন্দুকের ভেতরে মৃতদেহ রেখে আসে। তারা শবদেহ গোর দেয় না। এক—একটি পারিবারিক সিন্দুকের ভেতরে পরে—পরে দুটো, তিনটে বা চারটে মৃতদেহও রাখা হয়।

কাফিররা স্ত্রী—পুরুষ নির্বিশেষে অত্যন্ত নাচের ভক্ত। সামাজিক বা ধর্মসংক্রান্ত যে—কোনও অনুষ্ঠানে তারা নাচের আসর বসায় এবং মেয়ে ও পুরুষরা একসঙ্গে দল বেঁধে সারা রাত ধরে নাচের আমোদে মেতে থাকে। সঙ্গে—সঙ্গে চলে গান ও দামামা। অনেকে দুই আঙুল মুখে পুরে তীব্র স্বরে শিস দেয়। পরিদের ওপরে এদের অগাধ বিশ্বাস। নাচতে—নাচতে কেউ—কেউ পরি দেখে দশা পায়। তখন তারা নাকি ভাববাণী ও ভবিষ্যবাণী বলতে পারে! সবাই তাদের কাছে গিয়ে আগ্রহভরে এইরকম সব প্রশ্ন করে—’এবারে কীরকম ফসল হবে?’—’এ বছরে গাঁয়ে মড়ক হবে কিনা?’—’আমার খোকা হবে না খুকি হবে?’

পৌত্তলিক কাফিররা মুসলমানদের বিষম শত্রু। এর কারণ বোঝাও কঠিন নয়। মুসলমানরা—অর্থাৎ আফগান প্রভৃতি জাতের লোকেরা চিরদিনই তাদের ওপরে অমানুষিক অত্যাচার করে এসেছে, কাফিররাও তাই সুযোগ পেলেই ছলে—বলে—কৌশলে মুসলমানদের হত্যা করে। কেউ লুকিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত মুসলমানকে বধ করতে পারলে কাফির—সমাজে বীর বলে গণ্য হয়! তাদের মাথার পাগড়িতে গোঁজা পালকের সংখ্যা দেখেই বলে দেওয়া যায়, কে কয়জন মুসলমানকে হত্যা করেছে! আমরা যখন কাফ্রিস্থানে গিয়েছিলুম তখনই এ—শ্রেণির মুসলমান বিদ্বেষী কাফিররা দলে যথেষ্ট হালকা হয়ে পড়েছিল। আজ তাদের সংখ্যা বোধহয় নগণ্য, কারণ ওদেশে মুসলমান ধর্মের প্রভুত্ব বেড়ে উঠেছে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি।

কাফিরদের প্রত্যেক গ্রামেই স্থানীয় মৃত ব্যক্তিদের অশ্বারোহী কাঠের প্রতিমূর্তি দেখা যায়। পৌত্তলিক হোক, মুসলমান হোক, পূর্বপুরুষদের প্রতিমূর্তি স্থাপন করা প্রত্যেক কাফিরই কর্তব্য বলে মনে করে। যার যেমন সঙ্গতি, সে তত বড় মূর্তি গড়ায়। কিন্তু এসব হচ্ছে নামেই প্রতিমূর্তি, কারণ দেখতে সব মূর্তিই অবিকল একরকম!

কাফিররা মাছ খায় না, মাছে তাদের ভীষণ ঘৃণা। ব্যাং বা টিকটিকি খেতে বললে আমাদের অবস্থা যেরকম হয়, মাছ খেতে বললে তারাও এইরকম ভাব প্রকাশ করে। কাফিররা মুরগির মাংসও অপবিত্র মনে করে—কারণ, তা মুসলমানদের খাদ্য এবং কাফির নারীদের পক্ষে পুরুষ জন্তুর মাংস নিষিদ্ধ!

কাফিররা পরি মানে এবং কাফ্রিস্থানকে সত্য—সত্যই পরিস্থান বললে অত্যুক্তি হয় না। আমাদের দৃষ্টিসীমা জুড়ে দূরে বিরাজ করছে ২৫,৪২৬ ফুট উঁচু টেরিচ—মির পর্বত, বিরাট দেহ তার চিরস্থায়ী বরফে ঢাকা এবং তার শিখর উঠেছে মেঘরাজ্য ভেদ করে। নীচেও সর্বত্রই অচলভাবে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড় প্রহরীর দল। এখন শীতকাল নয়, নইলে এসব পাহাড়ও পরত তুষার পোশাক এবং তাদের উপত্যকা ও অলিগলি দিয়ে প্রবাহিত হত তুষারের নদনদী। শীতকালে এখানকার অনেক গ্রাম বাহিরের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে পারে না—তাদের মাথার ওপর দিয়ে বইতে থাকে বরফের ঝড়, তাদের চতুর্দিকে পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে বরফের স্তূপ!

কিন্তু গ্রীষ্মকালে সমস্ত কাফ্রিস্থান ছেয়ে যায় ফুলে—ফলে। কোথাও বেদানা ও আঙুরের ঝোপ, কোথাও মনোরম সবুজে ছাওয়া বনভূমি—তাদের ওপরে ঝরে পড়ছে নির্ঝরের কৌতুক হাসি এবং নীচে দিয়ে নেচে যাচ্ছে গীতিময়ী নদী। পাহাড়ের তলার দিকে ঢেকে থাকে জলপাই ও ওকগাছের শ্যামলতা এবং পাথরের ধারে—ধারে ফলে আছে আখরোট, তুঁত, খুবানী, দ্রাক্ষা ও আপেল গাছ। আরও ওপরে উঠলে দেখা যায় দেবদারু গাছের বাহার। ফুলও ফোটে যে কতরকম তার ফর্দ দেওয়া অসম্ভব।

এই হল গিয়ে কাফ্রিস্থানের মোটামুটি বর্ণনা।

নবম পরিচ্ছেদ । পাহাড়ে মেয়ে

চিত্রল থেকে উত্তর—পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আমরা একটি গ্রামে এসে আড্ডা গেড়েছি। এখানে দিন দুই—তিন থাকব স্থির করেছি—কেবল বিশ্রামের জন্যে নয়, দরকারি খবরাখবর নেওয়ার জন্যেও।

এ—গ্রামের বাড়িগুলোর অবস্থান বড় অদ্ভুত। দূর থেকে বাড়িগুলোকে দেখায় গ্যালারির মতো। পাহাড়ের ঢালু গায়ে বাড়িগুলো থাকে—থাকে ওপর থেকে নীচে নেমে এসেছে।

এখানে বাড়ি তৈরির নিয়মও আলাদা। তার প্রধান উপাদান হচ্ছে কাঠ, পাথর আর কাদা। কাঠের ফ্রেমের মধ্যে বসানো হয় বড়—বড় পাথরের—পর—পাথর এবং কাদা দিয়ে সারা হয় সুরকির কাজ। ছাদ মাটির। রাওলপিন্ডি ও পেশোয়ারেও আমি পাকা বাড়ির মাটির ছাদ দেখেছি। এর কারণ জানি না।

যে আমাদের আশ্রয় দিয়েছে সে হচ্ছে একটি আধাবয়সি স্ত্রীলোক, নাম গুমলি। বিধবা। এ—গ্রামে তার পসার প্রতিপত্তি বড় কম নয় দেখলুম।

রামহরি মুসলমানের বাড়িতে অতিথি হতে রাজি নয়—জাত খোয়াবার ভয়ে। সে—ই খুঁজে—খুঁজে গুমলিকে আবিষ্কার করেছে। গুমলি পুরোনো কাফির ধর্ম অর্থাৎ পৌত্তলিকতা—ত্যাগ করেনি।

গুমলি লোক ভালো, অতিথি সৎকার করতে খুব ভালোবাসে। আমাদের প্রধান খাদ্য হয়েছে ঘি—জবজবে চাপাটি আর খাসির মাংস। তার ওপরে পিঠা ও অন্যান্য খাবারেরও অভাব নেই।

কমল জানতে চাইলে, এখানে মুরগি পাওয়া যায় কি না?

গুমলি ঘৃণায় নাক তুলে থুতু ফেলে বললে, ‘ছি—ছি, মুরগি খায় মুসলমানরা, আমার বাড়িতে মুরগি ঢোকে না।’

সে পুস্তো ভাষায় যা বললে, বিনয়বাবু তা বাংলায় তরজমা করে আমাদের শোনালেন। এদেশে তিনিই আমাদের দোভাষীর কাজ করছেন।

রামহরি পরম শ্রদ্ধাভরে বললে, ‘গুমলি বড় পবিত্র মেয়ে, সে তোমাদের মতো ম্লেচ্ছ নয়।’

গুমলি বললে, ‘বাবুজিরা যদি গরুর মাংস খেতে চান, আমি খাওয়াতে পারি।’

রামহরি দুই চোখ ছানাবড়ার মতো করে বললে, ‘কী সর্বনাশ, এরা মুরগি খায় না, কিন্তু গরু খায় নাকি? অ্যাঁঃ, তবে তো এদের হেঁসেলে খেয়ে আমার জাত গিয়েছে! হে বাবা ভগবান, এ তুমি আমার কী করলে? লুকিয়ে—লুকিয়ে জাতটি কেড়ে নিলে?’

‘বাবা ভগবানে’র কাছ থেকে প্রশ্নের কোনও উত্তর বা সান্ত্বনা না পেয়ে রামহরি কাঁদো—কাঁদো মুখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। খানিক পরে সে ফিরে এল বটে, কিন্তু গুমলির বাড়িতে আর জলগ্রহণ করলে না।

কাফিররা দশজনকে খাওয়াতে ভারী ভালোবাসে। শুনলুম বড়—বড় ভোজ দিয়ে অনেকে ফতুর হতেও ভয় পায় না। অতিথি—সৎকারের আইনও এখানে বেজায় কড়া। যে ভোজ দেয় সে যদি ভালো খাবার না খাওয়ায়, তাহলে তার জরিমানা হয়!

সন্ধ্যার আগে সবাই মিলে বেড়াতে গেলুম। সেদিন কাফিরদের কী একটা উৎসব ছিল, তাই মেয়েপুরুষ মিলে নাচের আমোদে মেতেছে। খানিকক্ষণ নাচ দেখে চললুম নদীর ধারে। আমি আগে—আগে এগিয়ে গিয়ে নদীর জলে হাত দিলুম। উঃ, কী কনকনে ঠান্ডা জল! বুঝলুম কোনও বরফের পাহাড় থেকে নেমে আসছে এই নদী।

আচম্বিতে পিছনে দূর থেকে কুমারের চিৎকার জাগল—’বিমল, বিমল! পালিয়ে এসো—শিগগির পালিয়ে এসো।’

চমকে ফিরে দেখি, কোথা থেকে গুমলি আবির্ভূত হয়ে হাত—মুখ নেড়ে উত্তেজিতভাবে কথা কইছে! সে কী বলছে শুনতে পেলুম না, কিন্তু তারপরেই দেখলুম, বিনয়বাবুর সঙ্গে কুমার, কমল ও রামহরি বেগে দৌড় মারলে! বোঝা গেল ভয়েই তারা পালাচ্ছে, কিন্তু কেন পালাচ্ছে বোঝা গেল না।

তারপরেই শুনলুম বহু নারীকণ্ঠে বিষম চিৎকার! দেখি দলে—দলে কাফির নারী চ্যাঁচাতে—চ্যাঁচাতে ও ছুটতে—ছুটতে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে!

তবে কি এই নারীদের ভয়েই ওরা তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল? কী আশ্চর্য, এরা কি আমাদের আক্রমণ করতে চায়? আমাদের শত্রুরা কি নিজেরা আড়ালে থেকে এই নারী—সৈন্য নিযুক্ত করেছে? এখন আমার কী করা উচিত? পালাব? নারীর ভয়ে পালাব? হ্যাঁ, তা ছাড়া উপায় নেই! আত্মরক্ষার জন্যে মেয়েদের গায়ে তো আর হাত তুলতে পারি না।

কিন্তু এখন আর পালানোও অসম্ভব! সেই বিপুল নারীবাহিনী তখন পঙ্গপালের মতো চারিধার থেকে আমাকে ঘিরে ফেলেছে! আর নারী বলে তাদের কারুকে তুচ্ছ করবারও উপায় নেই! তাদের কেহই বাংলাদেশের ভেঙে—পড়া লতার মতন মেয়ে নয়, তাদের অধিকাংশই সাধারণ বাঙালি পুরুষেরও চেয়ে মাথা উঁচু—শক্ত ও বলিষ্ঠ তাদের দেহ!

আমি রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলুম—এমন অদ্ভুত সমস্যায় কখনও আর পড়িনি! বিকট স্বরে চেঁচিয়ে মেয়ের দল সবেগে আমাকে আক্রমণ করলে! আর সে এমন বিষম আক্রমণ যে, স্বয়ং ভীমসেন তাঁর বিরাট গদা ঘুরিয়েও নিজেকে বাঁচাতে পারতেন না।

ভীতু ভেড়ার মতন আমি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলুম। তারা ছিনেজোঁকের মতন আমাকে চেপে ধরে হিড়হিড় করে টানতে—টানতে নিয়ে চলল এবং তারপর আমি কিছু বোঝবার আগেই আমাকে প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে একেবারে নদীর ভেতরে ফেলে দিল!

ঝুপ করে জলে পড়লুম। নদী সেখানে গভীর নয় বটে, কিন্তু সেই বরফ—গলা জলে আমার সর্বাঙ্গ যেন হিম হয়ে গেল, নাকানিচোবানি খেয়ে অসাড় দেহটাকে কোনওরকমে টেনে ডাঙায় তুলে দেখি, মেয়ের পাল সকৌতুকে হাসতে—হাসতে আর একদিকে চলে যাচ্ছে! তবে কি এটা হচ্ছে ওদের ঠাট্টা? মেয়েমানুষ তেড়ে এসে জোয়ান পুরুষকে ধরে বেড়ালছানার মতন জলে ছুড়ে ফেলে দেয়—এ কীরকম সৃষ্টিছাড়া দেশ? প্রাচীন গ্রিক সৈনিকরা নাকি এক জাতের বীর নারীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, তাদের সঙ্গে প্রাচীন কাফির নারীদের কোনও সম্পর্ক নেই তো?

কাঁপতে—কাঁপতে বাসার দিকে চললুম। পথের চারিদিকেই মেয়ের দল হুড়োহুড়ি করে বেড়াচ্ছে, পাছে আবার তাদের পাল্লায় পড়তে হয়, সেই ভয়ে মানে—মানে আমি পাশ কাটিয়ে সন্তর্পণে অগ্রসর হতে লাগলুম—কিন্তু তারা কেউ আর আমার দিকে কৃপাদৃষ্টি নিক্ষেপ করলে না।

আর একটা ব্যাপার লক্ষ করলুম। আজ যেন এ দেশটা দস্তুরমতো মেয়ে—রাজ্যে পরিণত হয়েছে—পথে পুরুষ খুব কম, কেবল মেয়ে, মেয়ে আর মেয়ে! যে কয়জন পুরুষের সঙ্গে দেখা হল তাদের প্রত্যেকেরই জামাকাপড় ভিজে সপসপ করছে! একটু পরেই সব রহস্য বোঝা গেল।

বাসায় ঢুকতেই কুমার, কমল আর রামহরি অট্টহাস্য করে উঠল। বিনয়বাবুও বোধহয় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে খানিকটা হেসে নিলেন।

আমি ক্রুদ্ধ স্বরে বললুম, ‘যত সব কাপুরুষ! ভয়ে পালিয়ে এসে আবার দাঁত বার করে হাসতে লজ্জা করছে না?’

কুমার বললে, ‘স্বীকার করছি ভাই, আমরা হচ্ছি পয়লা নম্বরের কাপুরুষ। এই সব পাহাড়ে মেয়ের সঙ্গে হাতাহাতি করবার শক্তি আমাদের নেই! কিন্তু হে বীরবর, তোমার চেহারা এমন ভগ্নদূতের মতো কেন?’

কোনও জবাব না দিয়ে রাগে জ্বলতে—জ্বলতে আমি কাপড়চোপড় বদলাতে লাগলুম।

বিনয়বাবু বললেন, ‘ভায়া বিমল, কুমার তোমাকে সাবধান করে দিলে, তবু তুমি আমাদের সঙ্গে পালিয়ে এলে না কেন?’

‘কেমন করে আমি বুঝব যে ওই দজ্জাল মেয়েগুলো আমাকেই আক্রমণ করতে আসছে?’

‘আমরাও আগে বুঝতে পারিনি। ভাগ্যে গুমলি এসে সাবধান করে দিলে, তাই আমরা মানে—মানে মাথা বাঁচাতে পেরেছি।’

‘কিন্তু এ প্রহসনের অর্থ কী?’

‘আজ এখানে যে উৎসবটা হয়ে গেল, এর শেষে এখানকার মেয়েরা পুরুষদের ধরে নদীর জলে হাবুডুবু খাইয়ে দেয়। এটা হচ্ছে কাফিরদের লোকাচার—এর বিরুদ্ধে পুরুষদের কোনও জারিজুরিই খাটে না।’

‘তাই নাকি! তাহলে গুমলির কাছ থেকে জেনে রাখবেন, ওদের এরকম আরও লোকাচার আছে কিনা না?’

অজানা দেশের নানা বৈচিত্র্যের ও নিত্যনতুন দৃশ্য সমারোহের মধ্যে আমরা ছুন—ছিউ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলুম। তারা যে এখনও আমাদের পিছনে লেগে আছে, এমন সন্দেহ করবার কোনও কারণও পাইনি। অন্তত তারা যে আমাদের সঙ্গে আসতে পারেনি, এ বিশ্বাস আমার ছিল।

কিন্তু হঠাৎ বোঝা গেল, আমার বিশ্বাস ভ্রান্ত।

আজ বৈকালে মুখ অন্ধকার করে গুমলি এসে আমাদের ঘরে ঢুকল। খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল! তারপর যেন আপন মনেই বললে, ‘বার্মুক লোকটা মোটেই সুবিধের নয়!’

বিনয়বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বার্মুক? সে আবার কে?’

‘সে হচ্ছে এই গাঁয়ের ”জাস্ট”।’ (”জাস্ট”—অর্থাৎ সর্দার।)