যক্ষপতির রত্নপুরী – ১

প্রথম পরিচ্ছেদ । চিনে হোটেলে

অনেকে অভিযোগ করেন, আমার জীবন নাকি অস্বাভাবিক!

তাঁদের মতে, স্বাভাবিক মানুষের জীবন এমন ঘটনাবহুল হতে পারে না।

যদিও নিজেকে আমি পাগল বা গণ্ডমূর্খের মতো নেপোলিয়নের সঙ্গে তুলনা করছি না, তবে তর্কের খাতিরে এখানে কেবল এই প্রশ্ন বোধহয় করতে পারি,—নেপোলিয়ন কি স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন না? তিনি মাত্র বাহান্ন বৎসর বেঁচে ছিলেন। তার ভেতর থেকে প্রথম পঁচিশ বৎসর অনায়াসেই বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু বাকি মাত্র সাতাশ বৎসরের মধ্যে নেপোলিয়নের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল যে ঘটনার—পর—ঘটনার প্রচণ্ড বন্যা, তাদের অবলম্বন করে কি অসংখ্য নাটক ও উপন্যাস রচনা করা চলে না?

না হয় নেপোলিয়নের মতন মহামানুষ ও দিগ্বিজয়ী সম্রাটের কথা ছেড়ে দি, কারণ তাঁর জীবনে ঘটনা ঘটবার স্বাভাবিক সুযোগ ছিল প্রচুর। তাঁর বদলে আমি মধ্যযুগের এক শিল্পীর কথা উল্লেখ করতে চাই। তাঁর নাম বেনভেনুতো শেলিনি। তিনি ছিলেন ইতালির এক বিখ্যাত ভাস্কর ও ওস্তাদ স্বর্ণকার। তিনি একখানি প্রসিদ্ধ আত্মচরিতও লিখে গেছেন। সাধারণত শিল্পীদের জীবনের সঙ্গে ‘অ্যাডভেঞ্চার’—এর সম্পর্ক থাকে না বললেই চলে। কিন্তু বেনভেনুতোর ঘটনাবহুল জীবনকাহিনি জোগাতে পারে বহু বিস্ময়কর, রোমাঞ্চকর ও প্রায় অসম্ভব উপন্যাসের উপকরণ। এজন্যে তাঁর আত্মচরিতকে অস্বাভাবিক বলে অভিযোগ করা চলে না। কারণ, তাঁর জীবনের ঘটনাবলি সত্য বলেই প্রমাণিত হয়েছে।

এক—একজন মানুষের জীবনই হচ্ছে এমনি বিচিত্র! হয় ঘটনাপ্রবাহ আকর্ষণ করে তাদের জীবনকে, নয় তাদের জীবনই আকর্ষণ করে ঘটনাপ্রবাহকে।

বরাবরই লক্ষ করে দেখছি, আমি স্বেচ্ছায় কোনও রোমাঞ্চকর আবহ সৃষ্টি করতে না চাইলেও, কোথা থেকে আচম্বিতে আমার জীবনের ওপরে এসে ভেঙে পড়েছে অদ্ভুত সব ঘটনার প্রবাহ। আমার বন্ধু কুমার হয়তো এসব ঘটনাচক্রের বাইরেই পড়ে থাকত, কিন্তু সে হচ্ছে আমার নিত্যসঙ্গী, তার সঙ্গে আমার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক, কাজেই তাকেও জড়িয়ে পড়তে হয় এইসব ঘটনার পাকে—পাকে। অর্থাৎ প্রবাদে যাকে বলে—’পড়েছ মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।’

এবারেও কেমন করে আমরা নিজেদের অজান্তেই হঠাৎ এক আশ্চর্য ঘটনাপ্রবাহের দ্বারা আক্রান্ত হলুম, এইখানে সেই কথাই লিখে রাখছি :

সেদিন সন্ধ্যায় কুমার এসে বললে, ‘কী সব বাজে বই নিয়ে মেতে আছ? চলো, আজ কোনও হোটেলের দিকে যাত্রা করি।’

বই মুড়ে বললুম, ‘আপত্তি নেই। কিন্তু কোন হোটেলে?’

‘সেটা তুমিই স্থির করো।’

‘চৌরঙ্গির দিশি আর বিলিতি হোটেলে খেয়ে—খেয়ে অরুচি হয়ে গেছে। চলো আজ ছাতাওয়ালা গলির চিনে—পাড়ায়।’

‘ন্যানকিনে? সেও তো বিলিতির নকল।’

‘না—হে—না, আমরা যাব খাঁটি চিনে হোটেলে, খাঁটি চিনে খানা খেতে।’

‘উত্তম প্রস্তাব। রাজি!’

বাইরে বেরুবার জামাকাপড় পরছি দেখে বাঘাও গাত্রোত্থান করে গৃহত্যাগের জন্যে প্রস্তুত হল।

কুমার বললে, ‘ওরে বাঘা, আজ আর তুই সঙ্গে আসিস নে। হোটেলওয়ালারা বদ—রসিক রে, কুকুর—খদ্দের হয়তো পছন্দ করবে না!’

কিন্তু বাঘা মানা মানতে রাজি নয় দেখে রামহরিকে স্মরণ করলুম।

রামহরি এসে বললে, ‘দুই স্যাঙাতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?’

‘চিনে হোটেলে খানা খেতে।’

‘সর্বনাশ! চিনেরা তো তেলাপোকা খায়! তোমাদেরও খাবার শখ হয়েছে নাকি?’

‘রামহরি, চিনেম্যানদের নামে ও—অপবাদটা একেবারেই মিথ্যে। তারা তেলাপোকা খায় না, তবে পাখির বাসার ঝোল খায় বটে!’

‘রাম—রাম! পাখির বাসাও আবার খাবার জিনিস নাকি?’

‘তবু তুমি তাদের আর একটা খানার নাম শোনোনি। তারা পঞ্চাশ, ষাট, আশি, একশো বছরের পুরোনো ডিম খেতে ভারী ভালোবাসে।’

‘ওয়াক! ও খোকাবাবু, শুনেই যে আমার নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত উঠে আসছে। ওয়াক!’

‘হাঙরও তাদের কাছে সুখাদ্য!’

‘পায়ে পড়ি খোকাবাবু, আর বোলো না! ছি—ছি, ওইসব ছিষ্টিছাড়া খাবার তোমরা খেতে চাও?’

‘না রামহরি, হাঙর বা একশো বছরের পচা ডিম খাবার সৎসাহস আজও আমাদের হয়নি। তবে বাঘা বোধহয় হাঙর পেলে ছাড়বে না, ওকে তুমি সামলাও।’

আমি আর কুমার বেরিয়ে পড়লুম।

চিনে—পাড়ার খাঁটি চিনে—হোটেলে বাঙালির দেখা পাওয়া যায় না। আর কিছুই নয়, রামহরির মতন অধিকাংশ বাঙালিরই আসল চিনে হোটেল সম্বন্ধে ভয়াবহ কুসংস্কার আছে—তাই তাদের দৌড় বড়জোর ‘ন্যানকিন’ বা ‘চাঙ্গুয়া’ পর্যন্ত।

কিন্তু আমরা যে চিনে—হোটেলে গেলুম সেখানে ভয় পাওয়ার বা বমন ওঠবার মতন কিছুই ছিল না। চারিধার সাজানো—গোছানো, পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন। খাবারগুলিও সুস্বাদু—যদিও আমাদের দেশি—বিলাতি খাবারের সঙ্গে তাদের কিছুই মিল নেই। পরিবেশন করছিল একটি চিনে মেয়ে।

সর্বশেষে মেয়েটি নিয়ে এল চিনে চা। এ চা তৈরি করবার পদ্ধতিও অন্যরকম। মেয়েটি দুটি কাচের বা পোর্সিলিনের বাটি আনলে। একটি বাটিতে গরম জল ঢেলে তাতে শুকনো বা পাকানো একখণ্ড চায়ের পাতা দিয়ে ওপরে দ্বিতীয় বাটিটি চাপা দিয়ে চলে গেল। মিনিট তিন—চার পরে সে ফিরে এসে উপুড় করা বাটিটি নামিয়ে দিতেই দেখি, সেই গুটানো চায়ের পাতাখানি সমস্ত বাটি ভরে ছড়িয়ে পড়ে জলের ওপরে ভাসছে। ব্যস, চা প্রস্তুত—এখন খালি চিনি মেশাও আর চুমুক দাও। কিন্তু এ চায়ের স্বাদ অধিকাংশ বাঙালিরই ধাতে সইবে না।

কুমার চায়ের পেয়ালা তুলে বললে, ‘বিমল, চিনে—হোটেলের ভেতর বসে চিনে খানা খেতে—খেতে আর চুং চাং—চুং চিং কথা শুনতে—শুনতে মনে হচ্ছে, আমরা যেন আরব্য উপন্যাসের মায়া—গালিচায় চেপে হঠাৎ বাংলা ছেড়ে চিনদেশেই এসে পড়েছি। ও পাশের ঘরে ওই চিনেম্যানদের দেখছ? ওরা খাচ্ছে—দাচ্ছে কথাবার্তা কইছে বটে, কিন্তু ওদের মুখে কোনও ভাবের ছাপ নেই—ওরা যেন, রহস্যময় মূর্তি।’

কুমারের কথা ফুরুতে—ফুরুতেই আমার মন অন্যদিকে আকৃষ্ট হল।

ঠিক আমাদের পাশের ঘরেই জাগল হঠাৎ এক ক্রুদ্ধ গর্জন—সঙ্গে—সঙ্গে বিষম হুড়োহুড়ি ও চেয়ার—টেবিল উলটে পড়ার শব্দ। তারপরেই এক আর্তনাদ!

রাত্রিবেলায় এই চিনে—পাড়া মারামারি হানাহানির জন্যে বিখ্যাত। পাছে অন্যের হাঙ্গামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হয় সেই ভয়ে আমরা দুজনেই উঠে দাঁড়ালুম।

পরমুহূর্তেই একটা মাঝবয়সি রক্তাক্ত চিনেম্যানের মূর্তি টলতে—টলতে আমাদের কামরার কাছ বরাবর এসে হেলে পড়ে গেল এবং তার দেহটা এসে পড়ল কামরার ভেতরে একেবারে কুমারের বুকের ওপরে।

তারপরেই দেখলুম আমাদের কামরার সামনে এসে ভিড় করে দাঁড়াল প্রায় আট—দশজন চিনেম্যান—তাদের চেহারা দেখলে ভালোমানুষের প্রাণ ধড়ফড় করে উঠবে। কিন্তু আমরা দুজনেই ভালোমানুষ নই।

সব আগে রয়েছে, লম্বায় না হোক চওড়ায় মস্ত বড় এক মূর্তি, তার ডানহাতে একখানা আধ হাত লম্বা রক্তমাখা ছোরা। সেইখানা উঁচিয়ে সে আমাদের ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়বার উপক্রম করলে!

মারলুম এক ঘুসি ঠিক চোয়ালের ওপরে—আমার গায়ের সব শক্তি ছিল সেই মুষ্টির পিছনে। কারণ, আমি জানি, মারামারির সময়ে দরদ করে মারলে ঠকতে হয় নিজেকেই।

লোকটা ঠিকরে পড়ে গেল ঠিক বজ্রাহতের মতোই।

তারপরেই শুনলুম অনেকগুলো ভারী—ভারী জুতোর দ্রুত শব্দ! চোখের পলক পড়তে—না—পড়তেই আমাদের ঘরের সামনে থেকে সমস্ত জনতা হল অদৃশ্য! কিন্তু পরমুহূর্তেই হোটেলের অন্যদিকে আবার নতুন গোলমাল উঠল—কাদের সঙ্গে আবার কাদের মারামারি ঝটাপটি চলছে! খুব সম্ভব পুলিশ এসে পড়েছে।

এতক্ষণে কামরার ভেতরে নজর দেওয়ার সময় হল।

কুমার তখন আহত লোকটাকে মাটির ওপরে শুইয়ে দিয়েছে।

কিন্তু তার দিকে একবার তাকিয়েই বুঝলুম, আর কোনও আশা নেই।

লোকটাও বুঝেছিল। তবু সেই অবস্থাতেও সে চোখ নেড়ে আমাকে তার কাছে যাওয়ার জন্যে ইশারা করলে। আমি তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেলুম।

নিশ্বাস টানতে—টানতে অস্ফুট স্বরে ইংরেজিতে সে বললে, ‘আমি আর বাঁচব না। আমার জামার বোতাম খুলে ফ্যালো।’

তাই করলুম।

‘আমার গলায় ঝুলছে একখানা লকেট। সেটা তাড়াতাড়ি বার করে নাও।’

লকেটখানা বার করতেই সে বললে, ‘লুকিয়ে রাখো! ছুন—ছিউ দেখতে পেলে তুমিও বাঁচবে না।’

‘ছুন—ছিউ কে?’

সে প্রথমটা উত্তর দিতে পারলে না, কেবল হাঁপাতে লাগল। তারপর অনেক কষ্টে থেমে থেমে বললে, ‘যে আমাকে মেরেছে।…কিন্তু আমি যখন মরবই…গুপ্তধন তাকেও ভোগ করতে দেব না…হ্যাঁ, এই আমার প্রতিশোধ…মাটির ভেতরে…গুপ্তধন—’ তার কথা বন্ধ হল, সে চোখ মুদলে।

ভাবলুম, লোকটা বোধহয় এ জন্মের মতন আর কথা কইতে পারবে না। কুমার বললে, ‘এ কী বলছে, বিমল? কিছুই তো বোঝা গেল না! গুপ্তধন কোথায় আছে?’

লোকটা আবার চোখ খুললে। অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে টেনে—টেনে বললে, ‘কি—পিন…কি—পিন…সেখানে যেও…কি—পিন—।’ হঠাৎ তার বাক্যরোধ করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল এক ঝলক রক্ত এবং সঙ্গে—সঙ্গে তার চোখ কপালে উঠে স্থির হয়ে গেল!…

বুকে হাত দিয়ে দেখলুম, তার হৃৎপিণ্ড আর নড়ছে না।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ । কি—পিন কাহিনি

খুনোখুনি, হানাহানি বা কোনওরকম রোমাঞ্চকর কাণ্ডের কথা পর্যন্ত আমি ভাবিনি, কিন্তু দ্যাখো একবার ব্যাপারখানা! এখানেও ছোরাছুরি, প্রাণ নিয়ে টানাটানি? আবার গুপ্তধন—আবার দুর্বোধ্য হেঁয়ালি, ‘কি—পিন’? আবার বুঝি আমার চির—চঞ্চল দুষ্টগ্রহটি সজাগ হয়ে উঠেছে—কলুর বলদের মতো আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে মারবার জন্যে?

কুমার ব্যস্তভাবে বললে, ‘চটপট সরে পড়ি চলো ভায়া। নইলে পুলিশ—হাঙ্গামে জড়িয়ে পড়তে হবে।’

হোটেলের একদিক থেকে তখনও আসছিল প্রচণ্ড ছুটোছুটি হুড়োহুড়ির শব্দ, নিশ্চয় গুন্ডাদের সঙ্গে চলছে পুলিশের দাঙ্গা।

সেই ফাঁকে আমরা সরে পড়লুম। সদর দরজার কাছেও পুলিশের লোক ছিল, বোধহয় আমাদের বাঙালি দেখেই বাধা দিল না।

একেবারে সিধে বাড়িতে এসে উঠলুম।

হতভাগা রামহরি বুড়ো হয়েছে, তবু তার চোখের জেল্লা কি কম? আমাদের দেখেই বললে, ‘কার সঙ্গে মারামারি করে আসা হল শুনি?’

‘কে বললে আমরা মারামারি করেছি?’

‘থামো খোকাবাবু, মিছে কথা বলে আর পাপ বাড়িও না। নিজেদের জামাকাপড়ের দিকে একবার চেয়ে দ্যাখো দেখি। ও আবার কি? কুমারের জামায় যে রক্তের দাগ!’

কুমার হেসে বললে, ‘ধন্যি তুমি রামহরি! পাহারাওয়ালার চোখকে ফাঁকি দিয়ে এলুম, কিন্তু।’

‘কী সর্বনাশ! এর মধ্যে আবার পাহারাওয়ালাও আছে? এই বুঝি তোমাদের খেতে যাওয়া? এমন সব খুনে ডাকাত নিয়ে আর যে পারা যায় না। হাড় যে ভাজা—ভাজা হয়ে গেল। জামা—টামা খুলে ফ্যালো, দেখি কোথায় লাগল?’

বাঘাও ঘরের কোণে বসে আমাদের লক্ষ করছিল। রামহরির কথাবার্তা শুনে ও হাবভাব দেখে তারও মনে বোধহয় কেমন সন্দেহ জাগল, তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে আমাদের জামাকাপড় শুঁকতে শুরু করে দিলে।

কোনওগতিকে মানুষ রামহরি ও পশু বাঘার কবল ছাড়িয়ে, জামাকাপড় বদলে বাইরের ঘরে গিয়ে বসলুম।

কুমার বললে, ‘এইবার ধুকধুকিখানা বের করো দেখি।’

কুমারের মুখের কথা বেরুতে—না—বেরুতেই হোটেলের সেই হতভাগ্য চিনেম্যানের দেওয়া লকেটখানা আমি বার করে ফেললুম—সেখানাকে ভালো করে পরীক্ষা করবার জন্যে আমারও মনের কৌতূহল রীতিমতো অশান্ত হয়ে উঠেছিল। সাধারণত ধুকধুকি বা লকেটের আকার যেরকম হয়, এখানা তার চেয়েও বড়। রুপোয় তৈরি এই ধুকধুকির ওপরকার কারুকার্য দেখলেই বুঝতে বিলম্ব হয় না যে, এ হচ্ছে বিখ্যাত হুনুরি চিনে কারিগরের কীর্তি!’

কারিকুরির মধ্যে মাঝখানে একটি মূর্তি আঁকা রয়েছে। মূর্তিটি এত ছোট যে, ভালো করে দেখবার জন্যে অণুবীক্ষণের সাহায্য নিতে হল।

পাকা শিল্পী এতটুকু জায়গার মধ্যে অতি সূক্ষ্মরেখায় সম্পূর্ণ নিখুঁত পাকা মূর্তি এমন কায়দায় খুদে ফুটিয়ে তুলেছে যে, দেখলে অবাক হতে হয়। কিন্তু কী কুৎসিত মূর্তি! মস্ত ভুঁড়িওয়ালা মোটাসোটা এক চেহারা, দুই চোখ দিয়ে বেরুচ্ছে যেন ঐশ্বর্যের বা ক্ষমতার দর্প, মুখের ফাঁক দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে বড়—বড় আটটা দাঁত এবং পা রয়েছে তিনখানা!

বললুম, ‘কুমার, এ হচ্ছে কোনও খেয়ালি শিল্পীর উদ্ভট কল্পনা, এর মধ্যে কিছু বস্তু নেই। এইবার ধুকধুকির ভেতরটা দেখা যাক।’

আঙুলের চাপ দিতেই ধুকধুকির ডালা খুলে গেল। ভেতরে রয়েছে একখানা ভাঁজ করা খুব পুরু কাগজ—প্রায় কার্ড বললেও চলে।

কাগজখানা হাতে নিয়ে মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলুম না। যদিও তার ওপরে কোনও লেখা নেই, তবু একটা নতুনত্ব আছে বটে!

চামড়ার বা ধাতুর চাদরের ওপরে যেমন নকশা emboss করা থাকে, এর ওপরেও রয়েছে তেমনি উঁচু—করে তোলা কতকগুলো ‘ডট’ বা বিন্দু। কোথাও একটা, কোথাও দুটো, কোথাও চারটে বা আরও বেশি বিন্দু।

কুমার বিস্মিত স্বরে বললে, ‘ও বিমল, এ আবার কীরকম ধাঁধা হে?’

‘চিনে ধাঁ—ধাঁ হওয়াই সম্ভব। বাঙালির মাথায় ঢুকবে না।’

ধুকধুকির ভেতর থেকে আর কিছুই আবিষ্কার করা গেল না।

কিন্তু বিন্দুগুলোর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও অর্থ আছে, নইলে এত যত্নে কেউ এই কাগজখানাকে ধুকধুকির ভেতরে পুরে রেখে দিত না। সেই মৃত চিনেম্যানটা মরবার আগে যে দু—তিনটে কথা বলে গিয়েছিল তার দ্বারা বেশ বোঝা যায় যে, ছুন—ছিউ নামে কোনও দুরাত্মা তাকে আক্রমণ করেছিল এই ধুকধুকির লোভেই। সে এমন ইঙ্গিতও দিয়ে গেছে, ‘কি—পিন’ নামক স্থানে গেলে গুপ্তধন পাওয়া যাবে, আর তার রহস্য এই ধুকধুকির মধ্যেই লুকোনো আছে।

কুমার বললে, ‘বিমল, প্রথমে যখন আমরা রূপনাথ গুহায় গুপ্তধন (আমার লেখা ‘যকের ধন’ উপন্যাস দ্রষ্টব্য। ইতি—লেখক) আনতে যাই, তখন মড়ার মাথায় সাঙ্কেতিক লিপির পাঠ উদ্ধার করেছিলে তুমিই। এ বিষয়ে তোমার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। ভালো করে ভেবে দ্যাখো, এবারেও তুমি সফল হবে।’

এক ঘণ্টা গেল, দু—ঘণ্টা গেল, বিন্দুগুলো নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া করলুম, কিন্তু ব্যর্থ হল আমার সকল চেষ্টাই।

শেষটা সব চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে বললুম, ‘চুলোয় যাক ধুকধুকির রহস্য! তার চেয়ে ”কি—পিন” কথাটা নিয়ে আলোচনা করি এসো। ”কি—পিন” কোথায়?’

কুমার বললে, ”’কি—পিন” হয়তো চিনে মুল্লুকের কোনও জায়গা।’

‘অসম্ভব। যাও তো কুমার, আমার লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এসো ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ আর ‘গেজেটিয়ার’!’

কুমার তখনি ছুটে গেল আর বই নিয়ে ফিরে এল। দুজনে মিলে অনেক খোঁজাখুঁজি করলুম, কিন্তু কোনও ফলই হল না। কোথাও ”কি—পিন” নামে কোনও দেশের কথাই লেখা নেই।

কুমার বললে, ‘মরবার সময়ে সেই চিনে বুড়ো যে আমাদের সঙ্গে ‘প্র্যাকটিক্যাল জোক’ করে গেছে, এ কথা বিশ্বাস হয় না! ‘কি—পিন’ বলে কোনও জায়গা নিশ্চয়ই আছে।’

আমি বললুম, ‘থাকতে পারে। কিন্তু হয়তো সেটা তুচ্ছ গণ্ডগ্রাম। বাইরের কেউ তার কথা জানে না।’

সেদিন এই পর্যন্ত। কুমার বাড়ি ফিরে গেল। আমিও খেয়ে—দেয়ে শুয়ে পড়লুম। ঘুমের ঘোর এসে মুছে দিলে ‘কি—পিন’, ধুকধুকি আর গুপ্তধনের রহস্য!

পরের দিন সকালবেলা। আমি আর কুমার চা পান করছি, বাঘাও এসে টেবিলের তলায় আশ্রয় নিয়েছে তার প্রভাতী দুধের বাটির লোভে।

এমন সময়ে কমলকে নিয়ে বিনয়বাবু এলেন। যাঁরা আমাকে চেনেন এ দুজনের সঙ্গেও নিশ্চয়ই তাঁদের পরিচয় আছে। সকালবেলায় পরীক্ষা করতে—করতে ধুকধুকিখানা চায়ের টেবিলের ওপরে রেখে দিয়েছিলুম, বিনয়বাবু এসেই সেখানা দেখতে পেয়ে বললেন, ‘ওটা কিহে, বিমল?’

সঙ্গে—সঙ্গে আমার মনে পড়ল বিনয়বাবুর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের কথা। সারাজীবন ধরে তিনি জ্ঞানসমুদ্রের ডুবুরির কাজ করে আসছেন। আজ বয়সে পঞ্চাশ পার হয়েছেন, তবু বিদ্যাচর্চা ছাড়া আর কোনও আনন্দই তাঁর নেই। তিনি হচ্ছেন আশ্চর্য এক বৃদ্ধ ছাত্র এবং এই বিশ্ব হচ্ছে তাঁর কাছে বিদ্যালয়ের মতো। দর্শন, বিজ্ঞান, রসায়ন, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব—যে—কোনও বিষয় নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছি, কখনও সঠিক উত্তরের অভাব হয়নি। কুমার তো তাঁর নাম রেখেছে—’জীবন্ত অভিধান’। কাজেই তাঁকে পেয়ে আশান্বিত হয়ে ধুকধুকিটা তাড়াতাড়ি তাঁর হাতে তুলে দিলুম।

বিনয়বাবুর দুই চোখ ধুকধুকির দিকে চেয়েই কৌতূহলে প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। বললেন, ‘আরে, এরকম লকেট তো কখনও দেখিনি। এটা তো এদেশে তৈরি নয়! হুঁ, চিনের জিনিস। কোথায় পেলে?’

‘এক চিনেম্যানের দান। কিন্তু ওপরের ওই মূর্তিটা কি অদ্ভুত দেখেছেন?’

‘অদ্ভুত? হ্যাঁ, মূর্তির মুখখানা চিনে ছাঁদের বটে, কিন্তু আসলে এ হচ্ছে আমাদেরই পৌরাণিক মূর্তি!’

সবিস্ময়ে বিনয়বাবুর মুখের পানে তাকিয়ে রইলুম।

তিনি বললেন, ‘এ হচ্ছে হিন্দু যক্ষরাজ কুবেরের চেহারা। অষ্টদন্ত, তিনপদ। উদ্ভট, কুৎসিত চেহারার জন্যেই যক্ষরাজের নাম হয়েছে কুবের। তবে ঐশ্বর্যের মহিমায় তাঁর শ্রীহীনতার দুঃখ বোধহয় দূর হয়েছে।’

কুমার বললে, ‘বিনয়বাবু, আপনি কুবেরকে তো চিনলেন। কিন্তু বলতে পারেন, ”কি—পিন” বলে কোনও জায়গা আছে কি না?’

বিনয়বাবু ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন, ‘ ”কি—পিন”?…”কি—পিন”। হুঁ, নামটা শুনেছি বোধ হয়। বুড়ো হয়েছি, ফস করে সব কথা স্মরণ হয় না। রোসো ভায়া, মনে করবার জন্যে একটু সময় দাও।’

আগ্রহভরে অপেক্ষা করতে লাগলুম।

মিনিট তিনেক পরেই সমুজ্জ্বল মুখে বিনয়বাবু বললেন, ‘মনে পড়েছে, মনে পড়েছে! কিন্তু ‘কি—পিন’ নিয়ে তোমাদের এমন আশ্চর্য মাথাব্যথা কেন? তোমরা কি আজকাল ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছ?’

‘ ”কি—পিন” বা ”কা—পিন” হচ্ছে অনেক শতাব্দী আগেকার নাম। নামটি দিশিও নয়, চিনে। সপ্তম শতাব্দীতে ”কি—পিন” বলতে বোঝাত উত্তর—পূর্ব আফগানিস্তানের ”কপিশ” নামে জায়গাকে। তার আগে আর—এক সময়ে ভারত সীমান্তের গান্ধার প্রদেশকেও ”কি—পিন” বলে ডাকা হত। চিনে লেখকরা ভারতের আরও কোনও—কোনও দেশকে ”কি—পিন” বা ”কা—পিন” নামে জানতেন। তোমরা কোন ”কি—পিনে”র কথা জানতে চাও বুঝতে পারছি না। তবে সপ্তম শতাব্দীর ”কি—পিন” সম্বন্ধে বড়—বড় ঐতিহাসিক একটি অদ্ভূত গল্প বলেছেন, তোমাদের ধুকধুকির ওপরে কুবেরের মূর্তি দেখে সেটা আমার মনে পড়ছে।’

আমি বললুম, ‘আচ্ছা বিনয়বাবু, আগে গল্পটাই শুনি।’

বিনয়বাবু চেয়ারের ওপরে হেলে পড়ে বলতে লাগলেন, ‘এই ঐতিহাসিক গল্প নিয়েও অল্পবিস্তর মতান্তর আছে, ও সব গোলমালের মধ্যে ঢুকে দরকার নেই। চিনা পর্যটক হুয়েন সাংয়ের ভ্রমণ আর জীবনকাহিনিতে যে গল্পটি আছে, সেইটিই তোমাদের কাছে বলব। ভিনসেন্ট এ, স্মিতের “Early History of India” নামে বিখ্যাত ইতিহাসেও (২৭৯ পৃ.) এ. গল্পটি পাবে। কিন্তু গল্পটি বলবার আগে আমাকে আরও কয়—শতাব্দী পিছিয়ে যেতে হবে।

‘শক’ জাতীয় কণিষ্ক তখন ভারত সম্রাট। দ্বিতীয় শতাব্দীর কথা। তখন সারা এশিয়ায় চিনাদের বড় প্রভুত্ব। শকেরা ভারত দখল করেও চিনাদের কর দিতে বাধ্য ছিল। দু—একবার বিদ্রোহ প্রকাশ করেও চিনাদের কাছে তারা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। সম্রাট কণিষ্কই সর্বপ্রথমে চিনাদের জাঁক ভেঙে দিলেন। তিনি কেবল কর দেওয়াই বন্ধ করলেন না, তিব্বত ছাড়িয়ে চিনা সাম্রাজ্যের ভেতরে ঢুকে পড়ে দেশের পর দেশ জিতে তবে ফিরে এলেন এবং আসবার সময়ে জামিনস্বরূপ সঙ্গে করে নিয়ে এলেন চিনাদের কয়েকজন রাজপুত্রকে—কেউ—কেউ বলেন, তাঁদের মধ্যে চিন—সম্রাটের এক ছেলে ছিলেন।

‘আফগানিস্তানকে সে সময়ে ভারতেরই এক প্রদেশ বলে ধরা হত। চিন রাজপুত্ররা শীতের সময়ে পাঞ্জাবে থাকতেন, আর গরমের সময়ে থাকতেন আফগানিস্তানে, ‘শা—লো—কা’ নামে বৌদ্ধ হীনযান সম্প্রদায়ের এক মঠে। এই মঠটি ছিল ‘কপিশ’ পাহাড়ের এক ঠান্ডা উপত্যকায়। একথা বোধহয় না বললেও চলবে যে, তখন পৃথিবীতে মুসলমান ধর্মের সৃষ্টি হয়নি। আফগানিস্তানে তখন বাস করত হিন্দু আর বৌদ্ধরাই। আজও আফগানিস্তানের চারিদিকে তখনকার বৌদ্ধমঠের বহু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়।

‘কিছুকাল পরে চিন—রাজপুত্রদের দেশে ফিরে যেতে দেওয়া হল। যাওয়ার সময়ে তাঁরা ‘শা—লো—কা’ বা ‘কপিশ’ মঠকে দান করে গেলেন বিপুল বিত্ত, তাল—তাল সোনা, কাঁড়ি—কাঁড়ি মণিমুক্তা! সেকালের সেই ঐশ্বর্যের পরিমাণ একালে হয়তো হবে কোটি—কোটি টাকা! চিন—রাজপুত্ররা কেবল টাকা দিয়েই গেলেন না, ভারতকে শিখিয়ে গেলেন নাসপাতি ও পিচফল খেতেও। তাঁরা আসবার আগে এ অঞ্চলে ও দুটি ফলের ফসল ফলত না।

‘এইবার হুয়েন সাংয়ের কথা। তিনি ভারতে বেড়াতে এসেছিলেন সপ্তম শতাব্দীতে। ‘শা—লো—কা’ বা ‘কপিশ’ মঠে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে গিয়ে বর্ষাকালটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন। অত দিন পরেও মঠের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা দ্বিতীয় শতাব্দীর সেই চিন—রাজপুত্রদের অসাধারণ দানের কথা নিয়ে হুয়েন সাংয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভোলেননি।

‘সন্ন্যাসীরা আর—এক বিষয় নিয়ে হুয়েন সাংয়ের কাছে ধরনা দিলেন। সন্ন্যাসীরা বললেন, ‘কপিশ’ মঠে যক্ষরাজ কুবেরের প্রকাণ্ড এক পাথরের মূর্তি আছে। এবং তাঁরই পায়ের তলায় পোঁতা আছে চিন—রাজপুত্রদের দেওয়া অগাধ ঐশ্বর্য।

‘সেই ঐশ্বর্য উদ্ধার করবার জন্যে হুয়েন সাংকে অনুরোধ করা হল। হুয়েন সাং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা যখন গুপ্তধনের সন্ধান জানেন, তখন আমাকে অনুরোধ করছেন কেন?’ সন্ন্যাসীরা জানালেন, ‘ভয়াবহ যকেরা ওই গুপ্তধনের ওপরে পাহারা দেয় দিন—রাত! একবার এক অধার্মিক রাজা গুপ্তধন অধিকার করতে যান। কিন্তু যকেরা এমন উৎপাত শুরু করে যে রাজা প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। আমরাও যতবার গুপ্তধন নেওয়ার চেষ্টা করেছি ততবারই ভৌতিক উৎপাত হয়েছে। রাজপুত্ররা অর্থ দিয়েছিলেন মঠের উন্নতির জন্যে। কিন্তু সংস্কারের অভাবে মঠের আজ অতি দুর্দশা হলেও ধনভাণ্ডারে হাত দেওয়ার উপায় নেই। আপনি সাধু ব্যক্তি। আপনার ওপরে হয়তো যকেরা অত্যাচার করবে না।’

‘হুয়েন সাং রাজি হয়ে ধূপ—ধুনো জ্বেলে উপাসনা করে যক্ষদের উদ্দেশ করে বললেন, ‘হে যক্ষ, হে গুপ্তধনের রক্ষক! আমার ওপরে প্রসন্ন হও! আমি মন্দির মঠের মেরামতির জন্যে যে অর্থের দরকার কেবল তাই নিয়ে বাকি সব ঐশ্বর্য যথাস্থানে রেখে দেব!’

‘যকেরা হুয়েন সাংকে বাধা দিলে না। গুপ্তধনের অধিকাংশই হয়তো এখনও মাটির তলায় লুকোনো আছে। আমার গল্প ফুরুল।’

আমি বললুম, ‘কিন্তু আমাদের গল্প এইবার শুরু হবে!’

বিনয়বাবু জিজ্ঞাসু চোখে আমার পানে তাকিয়ে বললেন, ‘তার মানে?’

‘পরে সব বলছি। আপনার এই ঐতিহাসিক গল্পটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। অন্ধকারের মধ্যে একটু—একটু আলো দেখতে পেয়েছি বটে, কিন্তু সেইটুকুই যথেষ্ট নয়। ধাঁধায় পড়ে আছি এই কাগজখানা নিয়ে। এর রহস্য উদ্ধার করতে পারেন কি?’ বলেই আমি ধুকধুকির ভেতর থেকে পুরু কাগজখানা বার করে তাঁর হাতে দিলুম।

বিনয়বাবু কাগজখানার ওপরে চোখ বুলিয়েই সহজ স্বরে বললেন, ‘এ তো দেখছি’ ‘ব্রেল’ পদ্ধতিতে লেখা!’

কুমার লাফিয়ে উঠে বললে, ‘ব্রেল পদ্ধতিতে লেখা? অর্থাৎ যে পদ্ধতিতে অন্ধেরা লেখাপড়া করে?’

‘হ্যাঁ, এই পদ্ধতিতে এক থেকে ছয়টি মাত্র বিন্দুকে নানাভাবে সাজিয়ে বর্ণমালা প্রভৃতির সমস্ত কাজ সারা যায়। আমি অন্ধ না হলেও কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে এ—পদ্ধতিটা শিখে নিয়েছি।’

আমি উৎসাহিত হয়ে বললুম, ‘তাহলে লেখাটা আপনি এখনি পড়তে পারবেন?’

‘নিশ্চয়! খুব সহজেই!’

কুমার আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলে উঠল, ‘জয় বিনয়বাবুর জয়!’

তৃতীয় পরিচ্ছেদ । ছুন—ছিউ

আমরা সবাই কৌতূহলী চোখে বিনয়বাবুর মুখের পানে তাকিয়ে রইলুম।

ধুকধুকির ডালা খুলে বাঁ—হাতের ওপরে সেখানা রেখে বিনয়বাবু আগে সেই emboss করা বিন্দুগুলোর ওপরে ডান হাতের আঙুল বুলিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘এর ওপরে ইংরেজি ভাষায় লেখা রয়েছে—’শা—লো—কা : পশ্চিম দিক : ভাঙা মঠ : কুবের মূর্তি : গুপ্ত গুহা :’—ব্যস, আর কিছু নেই!’

আমি খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে কথাগুলো মনে—মনে নাড়াচাড়া করে দেখলুম, তারপর বললুম, ‘বিনয়বাবু, আপনার মতে শা—লো—কা, কি—পিন, কা—পিন, কপিশ বলতে এক জায়গাকেই বোঝায়?’

‘আমার মত নয় বিমল, এ হচ্ছে ঐতিহাসিকদের মত।’

‘ওখানে গুপ্তধন আছে, এটাও ঐতিহাসিক সত্য?’

‘একে ঐতিহাসিক সত্য না বলে ঐতিহাসিক গল্প বলা উচিত। এ গল্প বলেছেন বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হুয়েন সাং। ঐতিহাসিকরা গল্পটির উল্লেখ করেছেন মাত্র। অর্থাৎ এর সত্য—মিথ্যার জন্যে ঐতিহাসিকরা দায়ী নন।’

‘তাহলে শা—লো—কা বা কপিশ মঠের কথাও গল্পের কথা?’

‘না, কা—পিন, কি—পিন, শা—লো—কা বা কপিশ—যে নামেই ডাকো, ও মঠের ধ্বংসাবশেষ আজও আছে।’

‘উত্তর—পূর্ব আফগানিস্তানে?’

‘হ্যাঁ। ও জায়গাটির আধুনিক নাম হচ্ছে কাফ্রিস্থান।’

কুমার বললে, ‘কাফ্রিস্থান? ও বাবা, সে যে হিন্দুকুশ পাহাড়ের ওপারে! সেখানেও বৌদ্ধ মঠ, হিন্দু দেবতা কুবের!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘কুমার, আজকের দিনে ভারতবাসী পাশ্চাত্য জ্ঞান—বিজ্ঞানে শিক্ষা পেয়ে নিজেকে সভ্যতায় অগ্রসর হয়েছে বলে মনে করে বটে, কিন্তু স্বদেশ আর স্বজাতি সম্বন্ধে হয়েছে রীতিমতো অন্ধ। তোমাদের শিক্ষাগুরু ইংরেজরা আফগানিস্তানের এপারেই ভারতের সীমারেখা টেনেছে বলে সেইটেকেই সত্য বলে মেনে নেওয়ার কারণ নেই। এক সময় ভারত সম্রাটের সাম্রাজ্য যতদূর বিস্তৃত ছিল, ইংরেজরা আজও ততদূর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। আফগানিস্তান নামে কোনও দেশের নাম কেউ তখন স্বপ্নেও শোনেনি। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত গ্রিকদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন হিন্দুকুশেরও ওপারে। আজ বিলাতি জিওগ্রাফি যাকে আফগানিস্তান বলে ডাকে, তখনকার পৃথিবী তাকে ভারতবর্ষ বলেই জানত, আর সেখানে বাস করত ভারতের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনরাই। ওখানে যে বৌদ্ধ মঠ আর হিন্দু দেবতা থাকবে, এ আর আশ্চর্য কথা কি? ভারতের গৌরবের দিনে উত্তরে চিনদেশে, দক্ষিণে জাভা, বালি, সুমাত্রা দ্বীপে আর পূর্বে কাম্বোডিয়া প্রভৃতি স্থানে হিন্দু দেবতাদের যাতায়াত ছিল। তোমরা সত্যিকার ভারতের ইতিহাস পড়ো ভাই, নিজেদের এমন ছোট করে দেখো না!’

আমি বললুম, ‘উত্তম! তাহলে দু—চার দিনের মধ্যেই আমরা কাফ্রিস্থানে ভারতের পূর্বগৌরব দেখবার জন্যে যাত্রা করব, আর আমাদের পথপ্রদর্শক হবেন আপনিই!’

বিনয়বাবু সবিস্ময়ে আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীরে—ধীরে বললেন, ‘তোমাদের এই আকস্মিক উৎসাহ অত্যন্ত সন্দেহজনক।’

‘কেন?’

‘বিমল ভায়া, আমাকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা কোরো না, আমি তোমাদের খুব ভালো করেই চিনি! ধুকধুকির ওপরে ব্রেল পদ্ধতিতে লেখা এই অদ্ভুত কথাগুলো আর কা—পিন, কি—পিন বা কপিশ মঠ সম্বন্ধে তোমাদের আগ্রহ দেখেই বুঝতে পেরেছি, আবার তোমরা নতুন কোনও ‘অ্যাডভেঞ্চার’—এর গন্ধ পেয়েছ। আসল ব্যাপারটা কী বলো দেখি?’

আমি তখন হাসতে—হাসতে চিনে—হোটেলের ঘটনাটা বর্ণনা করলুম।

সমস্ত শুনে বিনয়বাবু হা—হা করে হেসে উঠে বললেন, ‘বিমল! কুমার! তোমাদের মাথা নিশ্চয়ই খারাপ হয়ে গিয়েছে।’

‘কেন?’

‘কণিষ্ক ছিলেন দ্বিতীয় শতাব্দীর মানুষ। গুপ্তধনের কথা যদি সত্য বলে মেনে নেওয়াও যায়, তাহলেও আমি বলতে বাধ্য যে, এতকাল পরে সেখানে গিয়ে কিছু পাওয়া যাবে না।’

‘কারণ?’

‘কারণ, ঐতিহাসিক গল্পেই প্রকাশ, প্রাচীন কালেও ওই গুপ্তধনের কাহিনিটি ছিল অত্যন্ত বিখ্যাত, তাই আরও অনেকে তা লাভ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল।’

‘কিন্তু সপ্তম শতাব্দীতেও হুয়েন সাং স্বচক্ষে সেই গুপ্তধন দেখেছিলেন। দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে সপ্তম শতাব্দী বড় কম দিনের কথা নয়।’

‘তারপর কত বিদেশি দস্যু দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে ঠিক ওই অঞ্চল দিয়েই ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে, এ কথা ভুলে যাচ্ছ কেন? তারা কি ওই গুপ্তধনের কথা শোনেনি?’

‘না শোনাও আশ্চর্য নয়! তারপর ভারতে কতবার অন্ধযুগ এসেছে। বার বার কত রাজ্যের, কত ধর্মের উত্থানপতন হয়েছে। মঠ গেছে ভেঙে, সন্ন্যাসীরা গেছে পালিয়ে, বিপ্লবের পর বিপ্লবের মধ্যে পড়ে লোকে গুপ্তধনের কথা না ভুললেও ঠিকানা হয়তো ভুলে গিয়েছে। পৃথিবীতে এমন অনেক বিখ্যাত গুপ্তধনের গল্প শোনা যায়, যার কথা সকলেই জানে কিন্তু যার ঠিকানা কেউ জানে না!’

কুমার বললে, ‘তারপর আরও একটা কথা ভেবে দেখুন, বিনয়বাবু! আপনি ইতিহাসের যে গল্পটা বললেন আমরা কেউই তা জানতুম না। কিন্তু সেই হতভাগ্য চিনেম্যানের কাছ থেকে আমরা যে ধুকধুকিটা পেয়েছি, তার সঙ্গে ওই গল্পের প্রধান কথাগুলো অবিকল মিলে যাচ্ছে। যেমন শা—লো—কা, ভাঙা মঠ, কুবের মূর্তি। আপনি বলেছেন, শা—লো—কা বা কপিশ মঠ ছিল পাহাড়ের উপত্যকায়, ধুকধুকির লেখাতেও রয়েছে গুপ্তগুহার কথা, আর গুহা থাকে পাহাড়েই। তারপর সেই চিনাম্যান মরবার আগে কি—পিন—এরও নাম করেছিল। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, যেমন করেই হোক একালের কেউ—কেউ ওই প্রাচীন ঐতিহাসিক গুপ্তধনের ঠিকানা জানতে পেরেছে।’

বিনয়বাবু ঘাড় নাড়তে—নাড়তে বললেন, ‘না ভায়া, আমি তোমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারব না। তোমরা যতই যুক্তি দেখাও, বুনো হাঁসের পিছনে ছোটবার বয়স আর আমার নেই। তারপর অত লোভও ভালো নয়। ভগবান আমাদের যা দিয়েছেন তাই যথেষ্ট। আবার গুপ্তধনের উদ্দেশে দেশ—দেশান্তরে ছুটাছুটি করা কেন?’

বিনয়বাবু আমাদের ভুল বুঝেছেন দেখে আমি আহত স্বরে বললুম, ‘বিনয়বাবু, আপনি তো জানেন, টাকাই আমাদের ধ্যানজ্ঞান নয়! এ—গুপ্তধন হচ্ছে আমাদের ঘর ছেড়ে পথে বেরুবার একটা ওজর বা উপলক্ষ্য মাত্র। গেল জন্মে আমি আর কুমার নিশ্চয়ই বেদুইন ছিলুম—শান্ত শ্যামলতার সুখ—স্বপ্নের চেয়ে অশান্ত মরুভূমির বিভীষিকাই আমাদের কাছে লাগে ভালো। দখিন বাতাসের চেয়ে কালবৈশাখীর ঝড়ই আমরা বেশি পছন্দ করি।’

এমন—সময়ে রামহরি ঘরের ভেতর ঢুকে বললে, ‘খোকাবাবু, চারটে চিনেম্যান এসেছে এ—বাড়ির বাবুর সঙ্গে দেখা করতে।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘চিনেম্যান? আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়?’

কুমার চিন্তিত স্বরে বললে, ‘চিনে হোটেলের কর্তারা নয়তো? হয়তো পুলিশ—হাঙ্গামে পড়ে আমাদের সাক্ষী মানতে এসেছে।’

আমি বললুম, ‘অসম্ভব। তারা আমার ঠিকানা জানবে কেমন করে?’

কুমার বললে, ‘তাও বটে!’

‘তাই তো, কে এরা? কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়? কলকাতায় ভদ্র—অভদ্র কোনও চিনেম্যানের সঙ্গেই তো আমার আলাপ—পরিচয় নেই!’

রামহরি বললে, ‘কী গো, ওদের কী বলব?’

‘এখানে আসতে বলো।’

রামহরি চলে গেল। ধুকধুকিটা টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিয়ে আমি জামার পকেটে রেখে দিলুম।

ঘরের ভেতরে প্রথমেই যে মূর্তিটা এসে দাঁড়াল তাকে দেখেই চিনতে আমার একটুকুও বিলম্ব হল না। কাল রাত্রে হোটেলে এই লোকটাই ছোরা হাতে করে সেই চিনে বুড়োকে মারাত্মক আক্রমণ করেছিল!

আমি হতভম্বের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে সে একগাল হেসে ইংরেজিতে বললে, ‘কী বাবু, তুমি কি আমাকে চিনে ফেলেছ? হা—হা—হা—হা—আমরা পুরোনা বন্ধু, কী বলো?’

আমি রুক্ষস্বরে বললুম, ‘এখানে তোমার কী দরকার?’

‘বলছি। আগে ভালো করে একটু বসি।’ তারপর আমার সম্মতির অপেক্ষা না রেখেই সে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল। এবং তার আরও তিনজন সঙ্গীও ঘরের ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইল ঠিক তিনটে পাথরের মূর্তির মতো।

কুমার ক্রুদ্ধস্বরে বললে, ‘তোমরা হচ্ছ হত্যাকারী। এখনি পুলিশে খবর দেব।’

প্রথম চিনেম্যানটা আবার একগাল হেসে বললে, ‘বেশ বাবু, তাই দিও। কিন্তু এতটা তাড়াতাড়ি কেন? আগে আবার কথাই শোনো।’

আমি বসে—বসে লোকটাকে ভালো করে লক্ষ করতে লাগলুম। আগেও দেখেছিলুম এখনও দেখলুম, মাথায় সে পাঁচ ফুটও উঁচু হবে না, কিন্তু তার দেহটা চওড়ায় সাধারণ মানুষের দ্বিগুণ। অসম্ভব চওড়া দেহের ওপরে মঙ্গোলীয় ছাঁচে গড়া মুখ—আমার সামনে বসে আছে যেন মানুষের ছদ্মবেশে বীভৎস একটা ওরাং—উটান!

সে হাসতে—হাসতে বললে, ‘বাবু, হোটেলে কাল তুমি আমার মুখের ওপরে যে ঘুসিটা চালিয়েছিলে, আমি এখনও তা ভুলিনি!’

আমি বললুম, ‘ও, সেইজন্যেই কি তুমি আজ প্রতিশোধ নিতে এসেছ?’

‘মোটেই নয় বাবু, মোটেই নয়! আমি তোমার ঘুসির তারিফ করি!’

জবাব না দিয়ে ভাবতে লাগলুম, লোকটার উদ্দেশ্য কী?

সে বললে, ‘ভগবান আমাকে ঢ্যাঙা করেননি, কিন্তু আমার গায়ে শক্তি দিয়েছেন। এজন্যে ভগবানকে ধন্যবাদ। একহাতে আমি তিন মণ মাল মাথার ওপরে তুলে ষোলো হাত দূরে ছুড়ে ফেলে দিতে পারি। কিন্তু আমার মতন লোককেও তুমি এক ঘুসিতে কাবু করেছ! যদিও আমি তোমার জন্যে প্রস্তুত থাকলে এমন অঘটন ঘটত না, তবু তুমি বাহাদুর!’

‘তোমার নাম কি ছুন—ছিউ?’

সে চমকে উঠল। তারপর বললে, ‘তাহলে তুমি আমার নাম পর্যন্ত আদায় করেছ? ভালো কথা নয়—ভালো কথা নয়’ বলতে—বলতে ধাঁ করে পকেটের ভেতরে হাত চালিয়ে দিয়ে বার করলে একটা রিভলভার।

তার পিছনের তিন মূর্তিও সঙ্গে—সঙ্গেই এক—একটা রিভলভার বার করে ফেললে!

আমাদের চোখের সামনে স্থির হয়ে রইল চার—চারটে রিভলভারের চকচকে নলচে!

চতুর্থ পরিচ্ছেদ । রামহরির ভীমরতি হয়নি

ছুন—ছিউ—র রিভলভারটার লক্ষ্য ঠিক আমার দিকেই!

এভাবে চোখের সামনে রিভলভার তুললে কারুরই মনে স্বস্তি হয় না, আমারও হল না।

কুমার, বিনয়বাবু ও কমলের মুখের পানে একবার আড়চোখে চেয়ে দেখলুম। রিভলভারের মহিমায় তাদের কারুরই ভাবান্তর হয়নি দেখে বিস্মিত হলুম না। আমরা সকলেই একই বিপদ—পাঠশালার পাঠ গ্রহণ করেছি বহুবার, রিভলভার দেখেই আর্তনাদ করবার অভ্যাস আমাদের নেই।

ঘরের এদিকে—ওদিকেও একবার চোখ বুলিয়ে নিলুম। আমাদের পিছনে ঘরের দেওয়াল। আমার ডানপাশে কুমার, বাঁ—পাশে বিনয়বাবু, তাঁর পাশে কমল বসে আছে। আমার সামনেই একটা গোল মার্বেলের টেবিল। তার ওপাশে বসে ছুন—ছিউ এবং তার পিছনে এক সারে দাঁড়িয়ে আছে আর তিনটে চিনেম্যান। তাদের পিছনেই এ ঘর থেকে বেরুবার একমাত্র দরজা। পিছনে হটবার উপায় নেই, চিনেদের এড়িয়ে দরজার দিকে যাওয়াও অসম্ভব। নিজের ঘরেই ফাঁদে পড়ে গিয়েছি, পালাবার পথ একবারে বন্ধ।

টেবিলের তলায় স্থির হয়ে বসে আছে বাঘা। অন্য কোনও কুকুর হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই গর্জন করে তেড়ে যেত। কিন্তু রিভলভারের সামনে গর্জন করলে বা তেড়ে গেলে যে মহা বিপদের সম্ভাবনা, এটা বুঝতে তার দেরি লাগল না—এমনি শিক্ষিত কুকুর সে!

ছুন—ছিউ হাসতে—হাসতে বললে, ‘বাবু কী দেখছ, কী ভাবছ? বুঝতে পারছ তো এ বাড়ির মালিক হচ্ছি এখন আমি?’

হতভাগার বাঁদুরে মুখে হাসি দেখে গা যেন জ্বলে গেল। বললুম, ‘ছুন—ছিউ, তোমার রিভলভার নামাও। তুমি ভুলে যাচ্ছ এটা চিনদেশ নয়।’

ছুন—ছিউ বললে, ‘না বাবু, ভুলিনি। আমি জানি এটা বাংলাদেশ, আর এখানে বাস করে কাপুরুষ বাঙালিরা।’

‘আমরাও সশস্ত্র হলে এ—কথা বলবার সাহস তোমার হত না।’

‘চুপ করো বাবু! তোমার সঙ্গে আমি গল্প করতে আসিনি। কাল হোটেল থেকে তোমরা একটা লকেট চুরি করে এনেছ। ভালো চাও তো সেখানা ফিরিয়ে দাও।’

‘ছুন—ছিউ, তুমি চন্ডু খেয়ে স্বপ্ন দেখছ। লকেট! সে আবার কী?’

‘আকাশ থেকে খসে পড়বার চেষ্টা কোরো না বাবু! তুমি কি বলতে চাও তোমার কাছে একখানা রুপোর লকেট নেই?’

আমার যুক্তি হচ্ছে, চোর ডাকাত খুনেকে ঠকাবার দরকার হলে মিথ্যে কথা বললে পাপ হয় না। অতএব কোনওরকম দ্বিধা না করে বললুম, ‘না। সোনার বা রুপোর বা পিতলের কোনওরকম লকেট—ফকেটের ধার আমি ধারি না।’

কুমার মস্ত একটা হাই তুলে বললে, ‘ওহে ছুন—ছিউ, তোমার ছাতা—পড়া দাঁতগুলো দেখে আমার গা বমি—বমি করছে। তুমি দাঁত বার করে আর না হাসলেই বাধিত হব।’

বিনয়বাবু টেবিলের ওপর থেকে একখানা বই তুলে নিয়ে খুব মনোযোগের সঙ্গে পড়তে শুরু করে দিলেন।

কমলও কম দুষ্ট নয়। বললে, ‘ছুন—ছিউ, তুমি একটা লক্ষ্নৌ ঠুংরি শুনবে?’

বাঘা যেন নাচারের মতন লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে সামনের দিকে দুই থাবা বাড়িয়ে দিয়ে তার ওপরে নিজের মুখ স্থাপন করলে—কিন্তু তার দৃষ্টি রইল চিনেম্যানদের দিকেই।

ছুন—ছিউ বললে, ‘ওহে বাবু, আমার সঙ্গে রসিকতা করা নিরাপদ নয়। মানুষ খুন করতে আমি ভালোবাসি, চোখে দেখবার আগেই আমি মানুষ খুন করে বসি।’

আমি বললুম, ‘কিন্তু চোখে দেখেও তুমি দয়া করে আমাদের খুন করছ না কেন শুনি!’

‘লকেটখানা কোথায় রেখেছ এখনও টের পাইনি বলে।’

‘তহালে লকেটখানা পেলেই তোমরা আমাদের খুন করবে?’

‘না। তোমরা ভদ্র ব্যবহার করো, আমরাও ভদ্র ব্যবহার করব।’

‘ধন্যবাদ। কিন্তু লকেট আমাদের কাছে নেই।’

‘নেই নাকি? কিন্তু হোটেলে কাল তুমি যখন মরোমরো বুড়ো চ্যাংয়ের গলা থেকে লকেটখানা খুলে নিচ্ছিলে, আমাদের লোক তা দেখেছিল। তারপর তোমাদের পিছু ধরে এসে আমাদের লোক এই বাড়িখানাও দেখে গিয়েছে। বুঝেছ? আমরা বুনো হাঁসের পিছনে ছুটে এখানে আসিনি!’

ঠিক সেই সময়ে দেখলুম, দরজার বাইরে রামহরির মুখ একবার উঁকি মেরেই সাঁৎ করে সরে গেল! আগেই বলেছি, দরজার দিকে পিছু ফিরে তিনটে চিনেম্যান এক সারে দাঁড়িয়েছিল এবং তাদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল ছুন—ছিউ। সুতরাং তারা কেউ এই দৃশ্যটা দেখতে পেলে না।

আমি অত্যন্ত আশ্বস্ত হলুম—এবং কুমার ও কমলের মুখ দেখে বুঝলুম, তারাও দেখেছে এই দৃশ্যটা।

বিনয়বাবু হঠাৎ হাতের বইখানা টেবিলের ওপরে ছুড়ে ফেলে দিলেন। তাঁর গোঁফদাড়ির ফাঁকে একটুখানি হাসির ঝিলিক ফুটেই মিলিয়ে গেল। হুঁ, বিনয়বাবু তাহলে বই পড়তে—পড়তে চোরা চোখেও তাকাতে পারেন!

বাঘা টপ করে উঠে পড়ে একটা ডন দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল এবং ঘন—ঘন নাড়তে লাগল তার ল্যাজটা।

ছুন—ছিউ আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘আরে, আরে, কুকুরটা খামোকা দাঁড়িয়ে উঠে ল্যাজ নাড়তে শুরু করে দিলে কেন?’

আমি বললুম, ‘এতক্ষণ পরে ও তোমাকে বন্ধু বলে চিনে ফেলেছে!’

ছুন—ছিউ চট করে একবার পিছনদিকটা দেখে নিয়ে বললে, ‘আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে! আমি বিপদের গন্ধ পাচ্ছি! না, আর দেরি নয়! হয় লকেট দাও, নয় মরো!’ সে রিভলভারটা বাগিয়ে ধরে দুই পা এগিয়ে এল।

কুমার বললে, ‘অতটা এগিয়ে এসো না ছুন—ছিউ, অতটা এগিয়ে এসো না! তাহলে আমি খপ করে হাত বাড়িয়ে রিভলভারটা কেড়ে নিতে পারি!’

ছুন—ছিউ আবার পিছিয়ে পড়ে বললে, ‘কেড়ে নিবি? দানব—মানব, ভগবান—শয়তান— ছুন—ছিউর হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নেবে কে? ওরে, এই বাঙালি—বাবুদের কেউ একটা আঙুল নাড়লেই তোরা গুলি করে তার খুলি উড়িয়ে দিবি, বুঝেছিস?’

তারা চারজনে আমাদের এক—একজনের দিকে লক্ষ্য স্থির করে রিভলভার তুলে ধরলে।

এইবারে সত্য—সত্যই ছুন—ছিউর দুই চক্ষে ফুটে উঠল হত্যাকারীর জ্বলন্ত দৃষ্টি! দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সে বললে, ‘এই আমি তিন গুনছি। এরমধ্যে লকেট না দিলে আর তোদের রক্ষে নেই!…এক…দুই।’

ছুন—ছিউ দুই গোনবার সঙ্গে—সঙ্গে দ্বারপথে আবার রামহরির আবির্ভাব! পা টিপে—টিপে সে ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়াল—এক গাছা লম্বা, মোটা দড়ির দুই মুখ দুই হাতে ধরে! তারপর সে—গাছাকে ‘স্কিপিং’ দড়ির মতন শূন্যে তুলেই সে একসঙ্গে তিন চিনে—মূর্তির মাথার ওপর দিয়ে ফেলে খুব জোরে মারলে এক প্রচণ্ড হ্যাঁচকা টান! বয়সে রামহরি পঞ্চান্ন পার হলেও এখনও সে শক্তিহীন হয়নি—পরমুহূর্তেই তিন চিনে মূর্তি একসঙ্গে ঠিকরে পপাত ধরণীতলে! বিনয়বাবুর সঙ্গে কুমার ও কমলও সেই মুহূর্তেই এক—এক লাফে সেই ভূপতিত দেহ তিনটের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল!

এদিকে শব্দ শুনে চমকে ছুন—ছিউ যেই ভুলে মুখ ফিরিয়েছে, অমনি বাঘা তড়াক করে লাফ মেরে তার রিভলভারশুদ্ধু ডান হাতের কবজিতে কামড় মেরে ঝুলে পড়ল এবং সঙ্গে—সঙ্গে আমি ধাক্কা মেরে সামনের টেবিলটা সরিয়ে ছুন—ছিউর চোয়ালের ওপরে দিলুম বিষম এক ‘নক—আউট ব্লো’! হঠাৎ গোড়াকাটা গাছের মতো ছুন—ছিউ সটান লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ঘরের মেঝের ওপরে!

সমস্ত ব্যাপারটা বলতে এতগুলো লাইনের দরকার হল বটে, কিন্তু এগুলো ঘটতে এক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগেনি!

হাতে মুষ্টিযুদ্ধের দস্তানা পরে চোয়ালের ঠিক জায়গায় ঘুসি মারতে পারলে প্রতিপক্ষ তখনি কিছুক্ষণের জন্যে অজ্ঞান হয়ে পড়বেই পড়বে! কিন্তু দস্তানাহীন হাতে চোয়ালের যথাস্থানে ঘুসি মারলেও প্রায়ই দেখা যায়, চোয়াল ভেঙে রক্তাক্ত হয়ে গেলেও এবং কাবু হয়ে পড়লেও প্রতিপক্ষ জ্ঞান হারায়নি!

ছুন—ছিউও জ্ঞান হারাল না। মাটিতে পড়েই সে আবার ওঠবার উপক্রম করছে দেখে আমি তারই হাত থেকে খসে পড়া রিভলভারটা তুলে নিয়ে ধমক দিয়ে বললুম, ‘চুপ করে শুয়ে থাক চিনে—বাঁদর! নড়লেই মরবি—তোকে মারলে আমার ফাঁসি হবে না!’

আচ্ছন্ন হতভম্বের মতো আমার হাতের রিভলভারের দিকে তাকিয়ে সে আড়ষ্ট হয়ে রইল।

ফিরে দেখি, বিনয়বাবু, কুমার ও কমলেরও হাতে গিয়ে উঠেছে তিন চিনেম্যানের তিন রিভলভার! রামহরি আনন্দে আটখানা হয়ে হাততালি দিচ্ছে এবং বাঘা ‘ঘেউ—ঘেউ’ রবে ঘরময় ছুটে নৃত্য করে বেড়াচ্ছে!

বললুম, ‘রামহরি, নিয়ে এসো আরও খানিকটা দড়ি! এই চার বেটার হাত—পা বেঁধে ফ্যালো!’

রামহরি তখন আরও দড়ি নিয়ে এসে চিনেম্যানগুলোকে বাঁধতে বসল।

কুমার বললে, ‘একেই ইংরেজিতে বলে টেবিল উলটানো! চিনেদের হলদে হাতের রিভলভারগুলোই এসেছে এখন আমাদের বাদামি হাতে!’

কমল বললে, ‘দানব—মানব, ভগবান—শয়তান—ছুন—ছিউর হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নেবে কে?—কেড়ে নেবে আমাদের প্রিয়তম বাঘা! দানব—মানব, ভগবান—শয়তানের যা অসাধ্য কুকুর বাঘার এক কামড়ে তা সাধ্য হল!’

ছুন—ছিউ রাগে ফুলতে—ফুলতে বললে, ‘তোমরা এখন আমাদের নিয়ে কী করতে চাও?’

আমি বললুম, ‘রামহরি, ও ঘরে গিয়ে থানায় ‘ফোন’ করে দিয়ে এসো তো!’

রামহরি বললে, ‘খোকাবাবু, তুমি আমাকে মনে করো কী? বুড়ো হলেও এখনও ভীমরতি হয়নি—আর লেখাপড়া না জানলেও বুদ্ধিতে আমি তোমাদের কারুর চেয়ে কম নই! এই চার চিনে হনুমানের রকমসকম উঁকি মেরে দেখেই আমি খানিক আগে থানায় ‘ফোন’ করে দিয়েছি—পুলিশ এসে পড়ল বলে!’

বিনয়বাবু উচ্ছ্বসিত স্বরে বললেন, ‘ধন্য রামহরি, ধন্য! আজকের এই নাট্যাভিনয়ে নায়কের ভূমিকায় তোমার কৃতিত্ব দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি!’