পাঁচ – পরামর্শ
আমি বললুম, ”মড়ার মাথা কি করে চুরি গেল, বিমল!”
বিমল বললে, ”জানি না। সকালে উঠে দেখলুম, আমার পড়বার ঘরের দরজাটা খোলা, রাত্রে তালা—চাবি ভেঙ্গে কেউ ঘরের ভেতরে ঢুকেচে! বুকটা অমনি ধড়াস করে উঠল! মড়ার মাথাটা আমি টেবিলের টানার ভেতরে চাবি বন্ধ করে রেখেছিলুম। ছুটে গিয়ে দেখি, টানাটাও খোলা রয়েচে, আর তার ভেতর মড়ার মাথা নেই!”
আমি বলে উঠলুম, ”এ নিশ্চয়ই করালী মুখুয্যের কীর্ত্তি। সেই—ই লোক পাঠিয়ে মড়ার মাথা চুরি করেছে। কিন্তু এই ভেবে আমি আশ্চর্য্য হচ্ছি, করালী কি করে জানলে যে, মড়ার মাথাটা তোমার বাড়ীতে আছে?”
বিমল বললে, করালী নিশ্চয়ই চারিদিকে চর রেখেচে! আমরা কি করচি না করচি, সব সে জানে!”
আমি বললুম, ”কিন্তু খালি মড়ার মাথাটা নিয়ে সে কি করবে? সঙ্কেতের মানে তো সে জানে না!”
বিমল বললে, ”কুমার, শত্রুকে কখনো বোকা মনে কোরো না। আমরা যখন সঙ্কেত বুঝতে পেরেচি, তখন চেষ্টা করলে করালীই বা তা বুঝতে পারবে না কেন?”
আমি বললুম, ”কিন্তু সঙ্কেতের সবটাও যে আর মড়ার মাথার ওপরে নেই! মনে নেই, আমার হাত থেকে পড়ে কাল মড়ার মাথাটা চটে গিয়েচে!”
বিমল কি যেন ভাবতে ভাবতে বললে, ”তবু বিশ্বাস নেই!”
হঠাৎ আমার আর একটা কথা মনে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলুম, ”আচ্ছা ঠাকুরদার পকেট—বইখানাও কি চুরি গেছে?”
বিমল বললে, ”না, এইটুকু যা আশার কথা। পকেট—বইখানা কাল রাত্রে আমি আর একবার ভালো করে পড়বার জন্যে উপরে নিয়ে গিয়েছিলুম। ঘুমোবার আগে সেখানে আমার মাথার তলার বালিসের নীচে রেখে শুয়েছিলাম—চোর তা নিতে পারনি।”
আমি কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বললুম, ”যাক—তবু রক্ষে ভাই। যকের ধনের ঠিকানা আছে সেই পকেট—বইয়ের মধ্যে। ঠিকানা না জানলে করালী সঙ্কেত জেনেও কিছু করতে পারবে না! কিন্তু খুব সাবধান বিমল! পকেট—বইখানা যেন আবার চুরি না যায়।”
বিমল বললে, ”সে বন্দোবস্ত আজকেই করব। পকেট—বইয়ের যেখানে পথের কথা আর ঠিকানা আছে, সে—সব জায়গা আমি কালি দিয়ে এমন করে কেটে দেব যে কেউ তা পড়তে পারবে না!”
আমি বললুম, ”তাহলে আমরাও মুস্কিলে পড়ব যে!”
বিমল হেসে বললে, ”কোন ভয় নেই। ঠিকানা আর পথের কথা আর—একখানা আলাদা কাগজে নতুন একরকম সাঙ্কেতিক কথাতে আমি টুকে রাখব,—সে সঙ্কেত আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকবার পর আমি বললুম, ”এখন আমরা কি করব?”
বিমল বললে, ”আগে মড়ার মাথাটা উদ্ধার করতে হবে!”
আমি আশ্চর্য্য হয়ে বললুম, ”কি করে?”
বিমল বললে, ”যেমন করে তারা মড়ার মাথা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছে!”
আমি বললুম, ”চোরের উপর বাটপাড়ি?”
বিমল বললে, ”তাছাড়া আর উপায় কি? আজ রাত্রেই আমি করালীর বাড়ীতে যেমন করে পারি ঢুকব। আমার সঙ্গে থাকবে তুমি।”
আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, ”কিন্তু করালী যদি জানতে পারে, আমাদের চোর বলে ধরিয়ে দেবে যে! সেই যে মড়ার মাথাটা চুরি করেচে, তারও তো কোন প্রমাণ নেই!”
বিমল মরিয়ার মত বললে, ”কপালে যা আছে তা হবে। তবে এটা ঠিক আমি বেঁচে থাকতে করালী আমাদের কারুকে ধরতে পারবে না।”
মনকে তবু বোঝ মানাতে না পেরে আমি বললুম, ”না ভাই, দরকার নেই। শেষটা কি পাড়ায় একটা কেলেঙ্কারী হবে?”
বিমল বেজায় চটে গিয়ে বললে, ”দূর ভীতু কোথাকার, এই সাহস নিয়ে তুমি যাবে রূপনাথের গুহায় যকের ধন আনতে? তার চেয়ে মায়ের কোলের আদুরে খোকাটি হয়ে বাড়ীতে বসে থাকো—তোমার পকেট—বই এখনি আমি ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছি”—এই বলেই বিমল হন হন করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল!
আমি তাড়াতাড়ি বিমলকে আবার ফিরিয়ে এনে বললুম, ”বিমল, তুমি ভুল বুঝচ—আমি একটুও ভয় পাইনি। আমি বলছিলুম কি—”
বিমল আমাকে বাধা দিয়ে বললে, ”তুমি কি বলচ, আমি তা শুনতে চাই না। স্পষ্ট করে বল, আজ রাত্রে আমার সঙ্গে তুমি করালীর বাড়ীতে যেতে রাজি আছ কি না?”
আমি জবাব দিলুম—”আছি।”
বিমল খুসি হয়ে আমার হাতদুটো আচ্ছা করে নেড়ে দিয়ে বললে, ”হু এই তো শুড বয়ের মত কথা। যদি মানুষ হতে চাও, ডানপিটে হও!”
আমি হেসে বললুম, ”ডানপিটের মরণ যে গাছের আগায়!”
বিমল বললে, ”বিছানায় শুয়ে থাকলেও মানুষ তো যমকে কলা দেখাতে পারে না! মরতেই যখন হবে, তখন বিছানায় শুয়ে মরার চেয়ে বীরের মত মরাই ভালো! তোমরা যাদের ভালো ছেলে বল—সেই গোবর—গণেশ মিনমিনে ননির পুতুলগুলোকে আমি দু—চোখে দেখতে পারি না! সায়েবের জুতো খেয়ে তাদেরই পিলে ফাটে, বিপদে পড়লে তারাই আর বাঁচে না, মরে বটে—তাও কাপুরুষের মত। এরাই বাঙালীর কলঙ্ক। জগতে যে—সব জাতি আজ মাথা তুলে বড় হয়ে আছে—বিপদের ভেতর দিয়ে, মরণের কুছপরোয়া না রেখে তারা সবাই শ্রেষ্ঠ হতে পেরেচে। বুঝলে কুমার? বিপদ দেখলে আমার আনন্দ হয়!”
ছয় – চোরের উপর বাটপাড়ি
সেদিন অমাবস্যা! চারিদিকে অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে আছে। কেবল জোনাকিগুলো মাঝে মাঝে পিট পিট করে জ্বলছে—ঠিক যেন আঁধাররাক্ষসের রাশি রাশি আগুন—চোখের মতন।
আমাদের বাড়ী কলকাতার প্রায় বাইরে, সেখানটা এখনো সহরের মতন ঘিঞ্জি হয়ে পড়েনি। বাড়ী—ঘর খুব তফাতে তফাতে,—গাছপালাই বেশী, বাসিন্দা খুব কম। অর্থাৎ আমরা নামেই কলকাতায় থাকি, এখানটাকে আসল কলকাতা বলা যায় না।
আমাদের বাড়ীর পরে একটা মাঠ, সেই মাঠের একপাশের একটা কচুঝোপের ভিতর বিমল আর আমি সুযোগের অপেক্ষায় লুকিয়ে বসে আছি। মাঠের ওপার করালীর বাড়ী।
মশারা আমাদের সাড়া পেয়ে আজ ভারি খুশি হয়ে ক্রমাগত ব্যাণ্ড বাজাচ্ছে—বিনি পয়সার ভোজের লোভে! সে তল্লাটে যত মশা ছিল, ব্যাণ্ডের আওয়াজ শুনে সবাই সেখানে এসে হাজির হোলো এবং আমাদের সর্ব্বাঙ্গে আদর ক’রে শুঁড় বুলিয়ে দিতে লাগল। সেই সাংঘাতিক আদর আর হজম করতে না পেরে আমি চুপি চুপি বিমলকে বললুম, ”ওহে, আর যে সহ্য হচ্ছে না!”
বিমল খালি বললে, ”চুপ!”
—”আর চুপ করে থাকা যে কত শক্ত, তা কি বুঝচ না?”
—”বুঝচি সব! আমি চুপ করে আছি কি করে?”
এ কথার উপরে আর কথা চলে না। অগত্যা চুপ করেই রইলুম!
ক্রমে মুখ—হাত—পা যখন ফুলে প্রায় ঢোল হয়ে উঠল তখন নিশুত রাতের বুক কাঁপিয়ে গির্জ্জের ঘড়ীতে ‘টং’ করে একটা বাজল!
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ”এইবার সময় হয়েছে!”
আমি তৈরি হয়েই ছিলুম—এক লাফে ঝোপের বাইরে এসে দাঁড়ালুম!
বিমল বললে, ”আগে এই মুখোসটা পরে নাও!”
বিমল আজ দুপুর বেলায় রাধাবাজার থেকে দুটো দামী বিলাতী মুখোস কিনে এনেছে। দুটোই কাফ্রীর মুখ,—দেখতে এমন ভয়ানক যে রাত্রে আচমকা দেখলে বুড়ো—মিন্সেদেরও পেটের পিলে চমকে যাবে! পরার উদ্দেশ্য, কেউ আমাদের দেখলেও চিনতে পারবে না।
মুখোস পরে দুজনে আস্তে আস্তে করালীর বাড়ীর দিকে এগুতে লাগলুম। তার বাড়ীর পিছন দিকে গিয়ে বিমল চুপি চুপি বললে, ”মালকোঁচা মেরে কাপড় পরে নাও!”
আমি বললুম, ”কিন্তু এদিকে তো বাড়ীর ভেতরে ঢোকবার দরজা নেই!”
বিমল বললে, ”দরজা দিয়ে ঢুকবে কে? আমরা কি নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি? এদিকে একটা বড় বটগাছ আছে, সেই গাছের ডাল করালীর বাড়ীর দোতালার ছাদের ওপরে গিয়ে পড়েচে। আমরা ডাল দিয়ে বাড়ীর ভেতরে যাব!” বিমল তার হাতের চোরা—লণ্ঠনটা উঁচু করে ধরলে,—একটা আলোর রেখা ঠিক আমাদের সামনের বটগাছের উপরে গিয়ে পড়ল!
বাড়ীতে ঢুকবার এই উপায়ের কথা শুনে আমার মনটা অবশ্য খুসি হোলো না—কিন্তু মুখে আর কিছু না বলে, বিমলের সঙ্গে গাছের উপর উঠতে লাগলুম।
অনেকটা উঁচুতে উঠে বিমল বললে, ”এইবার খুব সাবধানে এস! এই দেখ ডাল! এই ডাল বেয়ে গিয়ে ছাতের উপর লাফিয়ে পড়তে হবে।”
আবছায়ার মতন ডালটা দেখতে পেলুম। বিমল আগে ডালটা ধরে এগিয়ে গেল—একটা অস্পষ্ট শব্দে বুঝলুম, সে ছাদের উপর লাফিয়ে পড়ল।
আমি দু—পা রেখে আর দু—হাতে প্রাণপণে ডালটা ধরে ধীরে ধীরে এগুতে লাগলুম—প্রতি মুহূর্তেই মনে হয়, এই বুঝি পড়ে যাই! সেখান থেকে পড়ে গেলে স্বয়ং ধন্বন্তরিও আমাকে বাঁচাতে পারবেন না।
হঠাৎ বিমলের অস্পষ্ট গলা পেলুম—”ব্যাস! ডাল ধরে ঝুলে পড়।”
আমি ভয়ে ভয়ে ডাল ধরে ঝুলে পড়লুম!
—”এইবার ডাল ছেড়ে দাও।”
ডাল ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ধুপ করে ছাদের উপরে গিয়ে পড়লুম। বিমল আমার পিঠ চাপড়ে বললে, ”সাবাস!”
আমি কিন্তু মনের মধ্যে কিছুমাত্র ভরসা পেলুম না! এসেছি চোরের মত পরের বাড়ীতে, ধরা পড়লেই হাতে পরতে হবে হাতকড়া! তারপর আর এক ভাবনা—পালাব কোন পথ দিয়ে? লাফিয়ে তো ছাদে নামলুম, কিন্তু লাফিয়ে তো আর ঐ উঁচু ডালটা ফের ধরা যাবে না! বিমলকেও আমার ভাবনার কথা বললুম।
বিমল বললে, ”সদর দরজা ভিতর থেকে বন্ধ বলেই আমাদের গাছে চড়তে হোলো। পালাবার সময় দরজা খুলেই পালাব।”
—”কিন্তু বাড়ীতে দারোয়ান আছে যে!”
—”তার ব্যবস্থা পরে করা যাবে। এখন চল, দেখি নীচে নামবার সিঁড়ি কোন দিকে! পা টিপে টিপে এস।”
ছাদের পশ্চিম কোণে সিঁড়ি পাওয়া গেল। বিমল আগে আগে নামতে লাগল, আমি রইলুম পিছনে। সিঁড়ি দিয়ে নেমেই একটা ঘর। বিমল দরজার উপরে কান পেতে চুপি চুপি আমাকে বললে, ”এ ঘরে কে ঘুমোচ্ছে, তার নাক ডাকচে।”
চোরা—লণ্ঠনের আলোয় পথ দেখে আমরা দালানের ভিতরে গিয়ে ঢুকলাম। একপাশে তিনটে ঘর—সব ঘরই ভিতর থেকে বন্ধ। বিমল চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। আমি তো একেবারে হতাশ হয়ে পড়লুম। এত বড় বাড়ী, ভিতরকার খবর আমরা কিছুই জানি না, এতটুকু একটা মড়ার মাথা কোথায় লুকানো আছে, কি করে আমরা সে খোঁজ পাব? বিমলও যেমন পাগল! আমাদের খালি কাদা ঘেঁটে মরাই সার হোলো!
হঠাৎ বিমল বললে, ”ওধারকার দালানের একটা ঘরের দরজা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে! চল ঐদিকে!”
বিমল আস্তে আস্তে সেই দিকে গিয়ে ঘরের সামনে দাঁড়াল। দরজাটা ঠেলাতেই একটু খুলে গেল! ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে বিমল খানিকক্ষণ কি দেখলে, তারপর ফিরে আমার কানে কানে বললে, ”দেখ!”
দরজার ফাঁক দিয়ে যা দেখলুম, তাতে আনন্দে আমার বুকটা নেচে উঠল! টেবিলের উপর মাথা রেখে করালী নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, আর তার মাথার কাছেই পড়ে রয়েচে—আমরা যা চাচ্ছি তাই—সেই মড়ার মাথাটা! করালী নিশ্চয় সঙ্কেতগুলোর অর্থ বুঝবার চেষ্টা করছিল—তারপর কখন হতাশ ও শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে! করালী তাহলে সত্যিই চোর।
বিমল খুব সাবধানে দরজাটা আর একটু খুলে, পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে ঘরের ভিতর গেল। তারপর ঘুমন্ত করালীর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে মড়ার মাথাটা টেবিলের উপর থেকে তুলে নিল। তারপর হাসতে হাসতে ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। এত সহজে যে কেল্লা ফতে হবে, এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
এইবার পালাতে হবে। একবার বাইরে যেতে পারলেই আমরা নিশ্চিন্ত—তবে আমাদের পায় কে!
দুজনেই একতলায় গিয়ে নামলুম। উঠান পার হয়েই সদর দরজা। কিন্তু কি মুস্কিল বিমলের চোরা—লণ্ঠনের আলোতে দেখা গেল, একটা খুব লম্বা—চওড়া জোয়ান দরোয়ান দরজা জুড়ে চিৎপাত হয়ে শুয়ে, দিব্য আরামে নিদ্রা দিচ্ছে!
বিমল কিন্তু একটুও ইতস্ততঃ করলো না, সে খুব আস্তে আস্তে দরোয়ানকে টপকে দরজার খিল খুলতে গেল। ভয়ে আমার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল—একটু শব্দ হলেই সর্ব্বনাশ!
কিন্তু বিমল কি বাহাদুর! সে এমন সাবধানে দরজা খুললে যে, একটুও আওয়াজ হোলো না।
হঠাৎ আমার নাকের ভিতর কি একটা পোকা ঢুকে গেল—সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁচ্চেচা করে খুব জোরে আমি হেঁচে ফেললুম।
দরোয়ানের ঘুম গেল ভেঙে! বাজখাঁই গলায় সে চেঁচিয়ে উঠল—”কোন হ্যায় রে!”
লণ্ঠনটা তখন ছিল আমার হাতে। তার আলোতে দেখলুম, বিমল বিদ্যুতের মতন ফিরে দাঁড়াল, তারপর বাঘের মতন দরোয়ানের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার গলা টিপে ধরল। খানিকক্ষণ গোঁ গোঁ করেই চোখ কপালে তুলে দরোয়ানজী একেবারে অজ্ঞান।
তারপর আর কি—দে ছুট তো দে ছুট! ঘোড়াদৌড়ের ঘোড়াও তখন ছুটে আমাদের ধরতে পারত না—একদমে বাড়ীতে এসে তবে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম।
সাত – জানলায় কালো মুখ
এক এক গেলাস জল খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে, বাইরের ঘরে গিয়ে বসলুম। রাত তখন আড়াইটে।
বিমল বললে, ”আজ রাতে আর ঘুম নয়। কাল বৈকালের গাড়ীতে আমরা আসাম যাব।”
আমি আশ্চর্য্য হয়ে বললুম, ”সে কি! এত তাড়াতাড়ি!”
বিমল বললে, ”হুঁ তাড়াতাড়ি না করলে চলবে না। করালী রাস্কেল আমাদের ওপরে চটে রইল—মড়ার মাথা যে আমরাই আবার তার হাত থেকে ছিনিয়ে এনেচি, এতক্ষণে নিশ্চয়ই সে তা টের পেয়েচে! কখন কি ফ্যাসাদ বাধিয়ে বসবে কে তা জানে? কালই দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়তে হবে!”
আমি আপত্তি জানিয়ে বললুম, ”মা গেছেন শান্তিপুরে, মামার বাড়ীতে। তাঁকে না জানিয়ে আমি কি করে যাব?”
বিমল বললে, ”তাঁকে চিঠি লিখে দাও—আমার সঙ্গে তুমি আসামে বেড়াতে যাচ্চ, বড় তাড়াতাড়ি বলে যাবার আগে দেখা করতে পারলে না!”
আমি চিন্তিত মুখে বললুম, ”চিঠি যেন লিখে দিলুম, কিন্তু এত বড় একটা কাজে যাচ্ছি, অনেক বন্দোবস্ত করতে হবে যে! কালকের মধ্যে সব গুছিয়ে উঠতে পারব কেন?”
বিমল বিরক্ত স্বরে বললে, ”তোমাকে বিশেষ কিছুই করতে হবে না, বন্দোবস্ত যা করবার তা আমিই করব অখন। তুমি খালি কাপড়—চোপড় আর গোটাকতক কোট—প্যাণ্ট নিও—বুঝলে অকর্ম্মার ধাড়ী?”
—”কেন? কোট—প্যান্ট আবার কি হবে?”
—”যেতে হবে পাহাড়ে আর জঙ্গলে। সেখানে ফুলবাবুর মত কাছাকোঁচা সামলাতে গেলে চলবে না—তাহলে পদে পদে বিপদে পড়তে হবে।”
আমি চুপ করে ভাবতে লাগলুম।
বিমল বললে, ”ভেবেছিলুম দুজনেই যাব। কিন্তু তুমি যেরকম নাবালক গোবেচারা দেখচি, সঙ্গে আর একজনকে নিলে ভালো হয়।”
—”কাকে নেবে?”
—”আমার চাকর রামহরিকে। সে আমাদের পুরানো লোক; বিশ্বাসী, বুদ্ধিমান আর তার গায়েও খুব জোর। আমার জন্যে সে, হাসতে হাসতে প্রাণ দিতে পারে।”
—”আচ্ছা, সে কথা মন্দ নয়। আমিও বাঘাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। তাতে তোমার আপত্তি—”
—”চুপ!” বলেই বিমল একলাফে দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর ছুটে গিয়ে হঠাৎ ঘরের একটা জানলা দু—হাট করে খুলে দিলে। স্পষ্ট দেখলুম জানলার বাহির থেকে একখানা বিশ্রী কালো—কুচকুচে মুখ বিদ্যুতের মতন একপাশে সরে গেল। জানলায় কান পেতে নিশ্চয় কেউ আমাদের কথাবার্ত্তা শুনছিল। বিমলও দাঁড়াল না—ঘরের কোণ থেকে একগাছা মাথা—সমান উঁচু মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে একছুটে বেরিয়ে গেল। আমি ঘরের দরজায় খিল লাগিয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলুম!
খানিক পরে বিমল ফিরে এসে আমাকে ডাকলে। আমি আবার দরজা খুলে দিয়ে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলুম, ”ব্যাপার কি? লোকটাকে ধরতে পারলে?”
লাঠিগাছা ঘরের কোণে রেখে দিয়ে বিমল হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ”না” পিছনে তাড়া করে অনেকদূর গিয়েছিলুম, কিন্তু ধরতে পারলুম না!”
—”লোকটা কে বল দেখি?”
—”কে আবার—করালীর লোক, খুব সম্ভব ভাড়াটে গুণ্ডা। কুমার, ব্যাপার কি রকম গুরুতর, তা বুঝচ কি? লোকটা আমাদের কথা হয়ত সব শুনেচে!”
—”বিমল, তুমি ঠিক বলেচ, আমাদের আর দেরি করা উচিত নয়। আমরা কালকেই বেরিয়ে পড়ব।”
—”তা তো পড়ব, কিন্তু বিপদ হয়তো আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই যাবে।”
—”তার মানে?”
—”করালী বোধ হয় তার দলবল নিয়ে আমাদের সঙ্গে যাবে।”
আমি একেবারে দমে গেলুম। বিমল বসে বসে ভাবতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে সে বললে, ”যা—থাকে কপালে। তা বলে করালীর ভয়ে আমরা যে কেঁচোর মতন হাত গুটিয়ে ঘরের কোণে বসে থাকব, এ কিছুতেই হতে পারে না। কালকেই আমাদের যাওয়া ঠিক।”
আমি কাতর ভাবে বললুম, ”বিমল গোঁয়ার্ত্তুমি কোরো না।”
বিমল চৌকির উপরে একটা ঘুসি মেরে বললে, ”আমি যাবই যাব। তোমার ভয় হয় বাড়ীতে বসে থাকো। আমি নিজে যকের ধন এনে তোমার বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে যাব—দেখি করালী হারে কি আমি হারি।”
আমি তার হাত ধরে বললুম, ”বিমল, আমি ভয় পাইনি। তুমি যাও তো আমিও নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে যাব। কিন্তু ভেবে দেখ, শেষটা বন—জঙ্গলের ভেতরে একটা খুনোখুনি হতে পারে। করালীরা দলে ভারি, আমরা আর কিছু করতে পারব না।”
বিমল অবহেলার হাসি হেসে বললে, ”করালী নিকুচি করেছে। কুমার, আমার গায়েই খালি জোর নেই—বুদ্ধির জোরও আমার কিছু কিছু আছে। তুমি কিছু ভেব না, আমার সঙ্গে চল, করালীকে কি রকম নাকানি—চোবানি খাওয়াই একবার দেখে নিও।”
আমি বিমলকে ভালো—রকম চিনি। সে মিছে জাঁক কাকে বলে জানে না। সে যখন আমাকে অভয় দিচ্ছে, তখন মনে মনে নিশ্চয় কোন একটা নূতন উপায় ঠিক করেছে। কাজেই আমিও নিশ্চিন্ত ভাবে বললুম, ”আচ্ছা ভাই, তুমি যা বল আমি তাতেই রাজি।”
আট – শাপে বর
সারারাত জিনিস—পত্তর গুছিয়ে, ভোরের মুখে ঘণ্টাখানেক গড়িয়ে, যথাসময়ে আমরা বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়লুম। আমাদের দলে রইল বিমলের পুরানো চাকর রামহরি ও আমার কুকুর বাঘা। দুটো বড় বড় ব্যাগ, একটা ‘সুটকেস’ ও একটা ‘ইকমিক কুকার’ ছাড়া বিমল আর কিছু সঙ্গে নিতে দিলে না।
ব্যাগ—দুটোর ভিতরে কিন্তু, ছিল না এমন জিনিস নেই। ছুরি, ছোরা, কাঁচি, নানারকম ওষুধ—ভরা ছোট একটি বাক্স, ফোটো তুলবার ক্যামেরা, ইলেকট্রিকের ‘টচ্চর্চ’ বা মশাল, ‘ফ্লাস্ক’ (যার সাহায্যে দুধ, জল বা চা ভরে রাখলে চব্বিশ ঘণ্টা সমান ঠাণ্ডা বা গরম থাকে), গোটাকতক বিস্কুট, ফল ও মাছ—মাংসের টিন। (অনেক দিনে যা নষ্ট হবে না।) আসাম সম্বন্ধে খানকয়েক ইংরাজী বই, খাতা, ছোট ছোট দুটো বালিশ আর সতরঞ্চি ও কাফ্রির সেই দুটো মুখোস (বিমলের মতে পরে ও দুটোও কাজে লাগতে পারে) প্রভৃতি কতরকমের জিনিসই যে এই ব্যাগ দুটোর ভিতরে ভরা হয়েছে, তা আর নাম করা যায় না। ‘সুটকেসের’ ভিতরে আমাদের জামা—কাপড় রইল। আমরা প্রত্যেকেই এক এক গাছা মোটা দেখে লাঠি নিলুম—দরকার হলে এ লাঠি দিয়ে মানুষের মাথা খুব সহজেই ভাঙ্গা যেতে পারবে। অবশ্য, বিমল বন্দুক—দুটোও সঙ্গে নিতে ভুললে না।
বাড়ী ছেড়ে বেরুবার সময় মনটা যেন কেমন করতে লাগল। দেশ ছেড়ে কোথায় কোন বিদেশে, পাহাড়ে—জঙ্গলে বাঘ—ভাল্লুক আর শত্রুর মুখে পড়তে চললুম, যাবার সময়ে মায়ের পায়ে প্রণাম পর্য্যন্ত করে যেতে পারলুম না—কে জানে এ জীবনে আর কখনো ফিরে এসে মাকে দেখতে পাব কিনা! একবার মনে হল বিমলকে বলি যে, ”আমি যাব না!” কিন্তু পাছে সে আমাকে ভীরু ভেবে বসে, সেই ভয়ে মনকে শক্ত করে রইলুম।
বিমলও আমার মুখের পানে তাকিয়ে মনের কথা বোধ হয় বুঝতে পারলে। কারণ হঠাৎ সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, ”কুমার, তোমার মন কেমন করচে?”
আমি সত্য কথাই বললুম,—”একটু একটু করচে বৈ কি!”
—”মায়ের জন্য?”
—”হুঁ।”
—”ভেবো না। খুব সম্ভব আজকেই হয়তো তোমার মাকে তুমি দেখতে পাবে!”
আমি আশ্চর্য্য হয়ে বললুম, ”কি করে? আমরা তো যাচ্চি আসামে!”
—”তা যাচ্চি বটে!”—বলেই বিমল একবার সন্দেহের সঙ্গে পিছন দিকে চেয়ে দেখলে—তার চোখ—মুখের ভাব উদ্বিগ্ন। সে নিশ্চয় দেখেছিল শত্রুরা আমাদের পিছু নিয়েছে কি না! কিন্তু কারুকেই দেখতে পাওয়া গেল না।
বিমলের বাড়ীর—গাড়ী আমাদের ষ্টেশনে নিয়ে যাবার জন্যে অপেক্ষা করছিল।
আমরা গাড়ীতে গিয়ে চড়ে বসলুম। গাড়ী ছেড়ে দিল। বিমল সারা—পথ অন্যমনস্ক হয়ে রইল। মাঝে মাঝে তেমনি উদ্বেগের সঙ্গে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পিছন—পানে চেয়ে দেখতে লাগল।
শিয়ালদহ ষ্টেশনে পৌঁছে আমরা গাড়ী থেকে নামলুম। একবার চারিদিকে সতর্ক চোখে চেয়ে দেখে আমি বললুম, ”বিমল, আপাতত আমাদের কোন ভয় নেই। করালীরা আমাদের পিছু নিতে পারেনি।”
বিমল সে কথার জবাব না দিয়ে বললে, ”তোমরা এইখানে দাঁড়িয়ে থাক, আমি টিকিট কিনে আনি।”
টিকিট কিনে ফিরে এসে, বিমল আমাদের নিয়ে ষ্টেশনের ভিতর গিয়ে ঢুকল; বাঘাকে জন্তুদের কামরায় তুলে দিয়ে এল। বাঘা বেচারী এত লোকজন দেখে ভড়কে গিয়েছিল। সে কিছুতেই আমার সঙ্গ ছাড়তে রাজী হল না। শেষটা বিমল শিকলি ধরে তাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল।
গাড়ী ছাড়তে এখনো দেরি আছে। কামরার মধ্যে বেজায় গরম দেখে আমি গাড়ী থেকে নেমে পড়ে প্লাটফর্মের উপর পায়চারি করতে লাগলুম। ঘুরতে ঘুরতে গাড়ীর একেবারে শেষ দিকে গেলুম। হঠাৎ একটা কামরার ভিতর আমার নজর পড়ল—সঙ্গে সঙ্গে আমার সারা দেহে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি সভয়ে দেখলুম, কামরার ভিতরে করালী বসে আছে। দুজন মিশ—কালো গুণ্ডার মত লোকের সঙ্গে হাত—মুখ নেড়ে করালী কি কথাবার্ত্তা কইছিল—আমাকে দেখতে পেলে না। আমি তাড়াতাড়ি ছুটে নিজের গাড়ীতে এসে উঠে পড়লুম!
বিমল বললে, ”কিহে কুমার, ব্যাপার কি? চোখ কপালে তুলে ছুটতে ছুটতে আসছ কেন?”
আমি বললুম, ”বিমল! সর্ব্বনাশ হয়েচে।”
বিমল হেসে বললে, ”কিছুই সর্ব্বনাশ হয়নি! তুমি করালীকে দেখেচ তো? তা আর হয়েচে কি? সে যে আমাদের সঙ্গ ছাড়বে না আমি তা অনেকক্ষণই জানি! যাক, তুমি ভয় পেও না, চুপ করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকো!”
বিমল যত সহজে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলে, আমি তা পারলুম না। আস্তে আস্তে এক কোণে গিয়ে বসে পড়লুম বটে, মন কিন্তু বিমর্ষ হয়ে রইল। বিমল আমার ভাব দেখে মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল। এদিকে গাড়ী ছেড়ে দিলে।
জানি না, কপালে কি আছে! জঙ্গলের ভিতরে অপঘাতেই মরতে হবে দেখছি! করালীর সঙ্গে কত লোক আছে তা কে জানে? সে যখন আমাদের পিছু নিয়েচে, তখন সহজে কি আর ছেড়ে দেবে? আমি খালি এই সব কথা ভেবে ও নানা রকমের বিপদের কল্পনা করে শিউরে উঠতে লাগলুম।
বিমল কিন্তু দিব্যি আরামে সামনের বেঞ্চে পা তুলে দিয়ে বসে নিজের মনে কি একখানা বই পড়তে লাগল।
গাড়ী একটা ষ্টেশনে এসে থামল। বিমল মুখ বাড়িয়ে ষ্টেশনের নাম দেখে আমাকে বললে, ”কুমার, প্রস্তুত হও! পরে ষ্টেশন রাণাঘাট। এইখানেই আমরা নামব!”
এ আবার কি কথা! আমি আশ্চর্য্য হয়ে বললুম, ”রাণাঘাটে নামব! কেন?”
—”সেখান থেকে শান্তিপুরে, তোমার মামার বাড়ীতে মায়ের কাছে যাব।”
—”হঠাৎ তোমার মত বদলালো কেন?”
—”মত কিছুই বদলায়নি,—আজ কি করব, কাল থেকেই আমি তা জানি। কিন্তু তোমাকে কিছু বলিনি। এই দেখ, আমি শান্তিপুরের টিকিট কিনেচি। এর কারণ কিছু বুঝলে কি?”
—”না।”
—”আমি বেশ জানতুম, করালী আমাদের পিছু নেবে! কালকেই তার চর শুনে গেছে, আমরা আসামে যাব! আজও সে জানে, আমরা আসাম ছাড়া আর কোথাও যাব না। সে তাই ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে গাড়ীর ভিতরে বসে থাকুক, আর সেই ফাঁকে আমরা রাণাঘাটে নেমে পড়ি! দিন—কয়েক তোমার মামার বাড়ীতে বসে বসে আমরা তো মজা করে পোলাও কালিয়া খেয়েনি! আর ওদিকে করালী যখন জানতে পারবে আমরা আর গাড়ীর ভিতরে নেই, তখন মাথায় হাত দিয়ে একেবারে বসে পড়বে! নিশ্চয় ভাববে যে আমরা তাকে ভুলিয়ে অন্য কোন ঠিকানায় যকের খোঁজে গেছি! সে হতাশ হয়ে কলকাতার দিকে ফিরবে, আর আমরা তোমার মায়ের আশীর্ব্বাদ নিয়ে আসামের দিকে যাত্রা করব। আর কেউ আমাদের পিছু নিতে পারবে না।”
আমার পক্ষে এটা হল শাপে বর! ওদিকে করালীও জব্দ আর এদিকে আমারও মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল—একেই বলে লাঠি না ভেঙ্গে সাপ মারা! বিমলের দুখানা হাত চেপে ধরে আমি বলে উঠলুম, ”ভাই তুমি এত বুদ্ধিমান? আমি যে অবাক হয়ে যাচ্ছি!”
গাড়ী রাণাঘাটে এসে থামতেই আমরা টপাটপ নেমে পড়লুম—কেউ আমাদের দেখতে পেলে না।
নয় – নতুন বিপদের ভয়
তিন দিন মামার বাড়ীতে খুব আদরে কাটিয়ে মায়ের কাছ থেকে আমি বিদায় নিলুম। মা কি সহজে আমাকে ছেড়ে দিতে চান? তবু তাঁকে আমরা যকের ধন আর বিপদ—আপদের কথা কিছু বলিনি, তিনি শুধু জানতেন আমরা আসামে বেড়াতে যাচ্ছি।
যাবার সময় বিমলকে ডেকে মা বললেন, ”দেখো বাবা, আমার শিব রাত্রির সলতেটুকুকে তোমার হাতে সঁপে দিলুম, ওকে সাবধানে রেখ।”
বিমল বললে, ”ভয় কি মা, কুমার তো আর কচি খোকাটি নেই, ওর জন্যে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।”
মা বললেন, ”না বাছা, কুমারকে তুমি কোথাও একলা ছেড়ে দিও না—ও ভারি গোঁয়ার গোবিন্দ, কি করতে কি করে বসবে কিছুই ঠিক নেই। ও যদি তোমার মত শান্ত—শিষ্টটি হত তাহলে আমাকে আর এত ভেবে মরতে হত না।”
বিমল একটু মুচকে হেসে বললে, ”আচ্ছা মা, আমি তো সঙ্গে রইলুম, কুমার যাতে গোঁয়ার্ত্তুমি করতে না পায়, সেদিকে আমি চোখ রাখব।”
আমি মনে মনে হাসতে লাগলুম। মা ভাবছেন আমি গোঁয়ার—গোবিন্দ আর বিমল শান্ত—শিষ্ট। কিন্তু বিমল যে আমার চেয়ে কত বড় গোঁয়ার আর ডানপিটে, মা যদি তা ঘুণাক্ষরেও জানতেন।
মায়ের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে আমি, বিমল আর রামহরি দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়লুম—বাঘা আমাদের পিছনে পিছনে আসতে লাগল। কিন্তু শান্তিপুরের ষ্টেশনের ভিতর এসে, রেলগাড়ীকে দেখেই বাঘা পেটের তলায় ল্যাজ গুঁজে একেবারে যেন মুষড়ে পড়ল। সে বুঝল, আবার তাকে জন্তুদের গাড়ীর ভিতরে নিয়ে গিয়ে একলাটি বেঁধে আসা হবে।
রাণাঘাটে নেমে আবার আমরা আসল গাড়ী ধরলুম। বিমল খুসি মুখে বলল, ”যাক, এবারে আর করালীর ভয় নেই। সে হয়তো আসামে বসে নিজের হাত কামড়াচ্ছে, আর আমাদের মুণ্ডুপাত করচে।”
আমি বললুম, ”আসাম থেকে করালী এখন কলকাতায় ফিরে থাকতেও পারে।”
বিমল বললে, ”কলকাতায় কেন, সে এখন যমালয়ে গেলেও আমার আপত্তি নেই। চল, গাড়ীতে উঠে বসা যাক।”
অনেক রাতে গাড়ী সারাঘাটে গিয়ে দাঁড়াল। আমি যে সময়ের কথা বলছি, পদ্মার উপর তখনো সারার বিখ্যাত পুলটি তৈরি হয়নি। সারাঘাটে সকলকে তখন গাড়ী থেকে নেমে ষ্টিমারে করে পদ্মার ওপারে গিয়ে আবার রেলগাড়ী চড়তে হত। কাজেই সারায় এসে আমাদেরও মাল—পত্তর নিয়ে গাড়ী থেকে নামতে হল।
আগেই বলেছি, আমি কখনো কলকাতার বাইরে পা বাড়াইনি। ষ্টিমারে চড়ে চারিদিকের দৃশ্য দেখে আমার যেন তাক লেগে গেল। কলকাতার গঙ্গার চেয়েও চওড়া নদী যে আবার আছে এই পদ্মাকে দেখে প্রথম সেটা বুঝতে পারলুম। আকাশে চাঁদ উঠেছে আর গায়ে জ্যোৎস্না মেখে পদ্মা নেচে, দুলে বেগে ছুটে চলচে—রূপোর জল দিয়ে তার ঢেউগুলি তৈরি। মাঝে মাঝে সাদা ধবধবে বালির চর চোখের সামনে কখনো জেগে উঠেছে, কখনও মিলিয়ে যাচ্ছে—স্বপ্নের ছবির মতন। আমার মনে হল ঐ নিরিবিলি বালির চরগুলির মধ্যে হয়তো এতক্ষণ পরীরা এসে হাসি—খুসি, খেলাধূলা করছিল। ষ্টিমারের গর্জ্জন শুনে দৈত্য বা দানব আসছে ভেবে এখন তারা ভয় পেয়ে হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে মিশিয়ে গেছে।
বালির চর এড়িয়ে ষ্টিমার ক্রমেই অন্য তীরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, খালাসীরা জল মাপছে আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি বলছে। ষ্টিমারের একদিকে নানা জাতের মেয়ে—পুরুষ একসঙ্গে জড়াজড়ি করে বসে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে গোলমাল করছে, আর একদিকে ডেকের উপর উজ্জ্বল আলোতে চেয়ার—টেবিল পেতে বাহার দিয়ে ব’সে সাহেব—মেমরা খানা খাচ্ছে! খানিকক্ষণ পরে অন্যদিকে মুখ ফেরাতেই দেখি, একটা লোক আড়চোখে আমার পানে তাকিয়ে আছে। তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হতেই সে হন হন করে এগিয়ে ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ষ্টিমার ঘাটে এসে লাগলো। আমরা সবাই একে একে নীচে নেমে ষ্টেশনের দিকে চললুম। আসাম মেল তখন আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ভোঁস ভোঁস করে ধোঁয়া ছাড়ছিল,—আমরাও তার পেটের ভিতর ঢুকে নিশ্চিত হয়ে বসলুম।
কামরার জানলার কাছে আমি বসে ছিলুম। প্লাটফর্মের ওপাশে আর একখানা রেলগাড়ী—সেখানাতে দার্জ্জিলিঙের যাত্রীদের ভিড়। ফার্ষ্ট ও সেকেণ্ড ক্লাসের সাহেব—মেমেরা কামরার ভিতরে বিছানা পাতছিলো—এক ঘুমে রাত কাটিয়ে দেবার জন্যে। তাদের ঘুমের আয়োজন দেখতে দেখতে আমারও চোখ ঢুলে এল। আমিও শুয়ে পড়বার চেষ্টা করছি—হঠাৎ আবার দেখলুম, ষ্টিমারের সেই অচেনা লোকটা প্লাটফর্মের উপরে দাঁড়িয়ে তেমনি আড়চোখে আমাদের দিকে বারে বারে চেয়ে দেখছে।
এবারে আমার ভারি সন্দেহ হল। বিমলের দিকে ফিরে বললুম, ”ওহে, দেখ দেখ।”
বিমল বেঞ্চির উপর কম্বল পাততে পাততে বললে, ”আর দেখাশুনো কিছু নয়—এখন চোখ বুজে নাক ডাকিয়ে ঘুমোবার সময়।”
—”ওহে, না দেখলে চলবে না। ষ্টিমার থেকে একটা লোক বরাবর আমাদের ওপর নজর রেখেছে—এখনো সে দাঁড়িয়ে আছে, যেন পাহারা দিচ্ছে।”
শুনেই বিমল এক লাফে জানালার কাছে এসে বলল, ”কৈ কোথায়?”
—”ঐ যে।”
কিন্তু লোকটাও তখন বুঝতে পেরেছিল যে আমরা তার উপর সন্দেহ করেছি। সে তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে সেখানে থেকে সরে পড়ল।
বিমল চিন্তিতের মত বললে, ”তাই তো এ আবার কে?”
—”করালীর চর নয় তো?”
—”করালী? কিন্তু সে কি করে জানবে আজ আমরা এখানে আছি?”
—”হয় তো করালী আমাদের চালাকি ধরে ফেলেচে! সে জানত আমরা দু—চার দিন পরেই আবার আসামে যাব। আসামে যেতে গেলে এ পথে আসতেই হবে। তাই সে হয়তো এইখানেই এতদিন ঘাঁটি আগলে ব’সেছিল।”
—”অসম্ভব নয়। আচ্ছা, একবার নেমে দেখা যাক, করালী এই গাড়ীর কোন কামরায় লুকিয়ে আছে কিনা?”—এই বলেই বিমল প্লাটফর্মের উপর নেমে এগিয়ে গেল।
গাড়ী যখন ছাড়ে—ছাড়ে, বিমল তখন ফিরে এল।
আমি বললুম, ”কি দেখলে?”
—”কিন্তু না। প্রত্যেক কামরায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেচি—করালী কোথাও নেই। বোধ হয় আমরা মিছে সন্দহ করেচি।”
বিমলের কথায় অনেকটা নিশ্চিন্ত হলুম—যদিও মনের মধ্যে কেমন একটা খটকা লেগে রইল।
গাড়ী ছেড়ে দিলে। বিমল বললে, ”ওহে কুমার, এই বেলা যতটা পারো ঘুমিয়ে নাও—আসামে একবার গিয়ে পড়লে হয়তো আমাদের আহার—নিদ্রা একরকম ত্যাগ করতেই হবে।”
বিমল বেঞ্চির উপরে ”আঃ” বলে সটান লম্বা হল, আমিও শুয়ে পড়লুম। সুখের বিষয়, এ কামরায় আর কেউ ছিল না, সুতরাং ঘুমে আর ব্যাঘাত পড়বার ভয় নেই।