যকের ধন – ২৫

পঁচিশ – অদৃশ্য বিপদ

ঘরের ভিতর ঢুকে আমরা সাগ্রহে চারিদিকে চেয়ে দেখলুম।

ঘরটা ছোট—ধুলো আর দুর্গন্ধে ভরা।

আসবাবের মধ্যে রয়েছে খালি এক কোণে একটা পাথরের সিন্দুক—এ রকম সিন্দুক কলকাতায় যাদুঘরে একবার দেখেছিলুম।

বিমল এগিয়ে গিয়ে সিন্দুকের ডালাটা তখনই খুলে ফেললে, আমরা সকলেই একসঙ্গে তার ভিতরে তাড়াতাড়ি হুমড়ি খেয়ে উঁকি মেরে দেখলুম—কিন্তু হা ভগবান,সিন্দুক একেবারে খালি।

আমাদের এত কষ্ট, এত পরিশ্রম, এত আয়োজন—সমস্তই ব্যর্থ হল!

কেউ আর কোন কথা কইতে পারলুম না, আমার তো ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল।

অনেকক্ষণ পরে বিমল একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, ”আমাদের একূল—ওকূল দুকূল গেল! যকের ধনও পেলুম না, প্রাণেও বোধ হয় বাঁচব না!”

আমি বললুম, ”বিমল, আগে যদি আমার মানা শুনতে! কতবার তোমাকে বলেচি ফিরে চল, যকের ধনে আর কাজ নেই।”

রামহরি বললে, ”আগে থাকতেই মুষড়ে পড়চ কেন? খুঁজে দেখ, হয়তো আর কোথাও যকের ধন লুকানো আছে!”

বিমল বললে, ”আর খোঁজাখুঁজি মিছে। দেখছ না আমাদের আগেই এখানে অন্য লোক এসেচে, সে কি আর শুধু—হাতে ফিরে গেছে?”

আমি বললুম, ”এ কাজ করালীর ছাড়া আর কারুর নয়!”

—”হুঁ।”

—”কিন্তু সে কি করে খোঁজ পেলে?”

—”খুব সহজেই। কুমার, আমরা বোকা—গাধার চেয়েও বোকা! করালী পালিয়েছে ভেবে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে পথ চলছিলুম—সে কিন্তু নিশ্চয়ই লুকিয়ে লুকিয়ে পিছু নিয়েছিল। তারপর কাল যখন আমরা সুড়ঙ্গের মুখ খুলেছিলুম, সে তখন কাছেই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে বসেছিল। কাল রাতেই সে কাজ হাসিল করেচে, আমরা যে কোন রকমে পিছু নিয়ে তাকে আবার ধরব, সে উপায়ও আর রেখে যায়নি। বুঝেছ কুমার, করালী গর্ত্তের মুখ বন্ধ করে দিয়ে গেছে!”

—”কিন্তু শম্ভুকে খুন করলে কে?”

—”করালী নিজেই!”

—”কেন সে তা করবে?”

—”পাছে যকের ধনে শম্ভু ভাগ বসাতে চায়!”

হঠাৎ আমাদের কানের উপরে আবার সেই ভীষণ অট্টহাসি বেজে উঠল— ”হা—হা—হা—হা—হা!”

আমি আর্ত্তনাদ করে বলে উঠলুম, ”বিমল, শম্ভুকে খুন করেচে এই যক!”

আবার আবার সেই হাসি!

আমার হাত থেকে বিজলী—মশালটা কেড়ে নিয়ে বিমল যে দিক থেকে হাসি আসছিল সেই দিকে ঝড়ের মতন ছুটে গেল—তার পিছনে ছুটল রামহরি!

ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে একলা বসে আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলুম—বিমল এত তাড়াতাড়ি চলে গেল যে আমিও তার পিছু নিতে পারলুম না।

উঃ, পৃথিবীর বুকের মধ্যকার সে অন্ধকার যে কি জমাট, লেখায় তা প্রকাশ করা যায় না—অন্ধকারের চাপে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।

হঠাৎ আমার পিঠের উপরে ফোঁস করে কে নিশ্বাস ফেললে! চেঁচিয়ে বিমলকে ডাকতে গেলুম, কিন্তু গলা দিয়ে আমার আওয়াজই বেরুল না! সামনের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে মাটির উপর পড়ে গেলুম।

উঠে বসতে না বসতেই আমার পিঠের উপরে কে লাফিয়ে পড়ল এবং লোহার মতন শক্ত দুখানা হাত আমাকে জড়িয়ে ধরলে!

আমি তার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করলুম—সে কিন্তু অনায়াসে আমাকে শিশুর মতন করে ধরে ঘরের মেঝের উপর চিত করে ফেললে—প্রাণপণে আমি চেঁচিয়ে উঠলুম—”বিমল, বিমল, বাঁচাও—আমাকে বাঁচাও!”

আমার বুকের উপরে বসে হা—হা—করে হাসতে লাগল! কিন্তু তারপর মুহূর্ত্তের সে হাসি আচম্বিতে বিকট এক আর্ত্তনাদের মতন বেজে উঠল—সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের উপর থেকে সেই ভূত না মানুষটা—ভগবান জানেন কি—মাটির উপর ছিটকে পড়ল।

তাড়াতাড়ি আমি উঠে বসলুম—অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলুম না বটে, কিন্তু শব্দ শুনে বেশ বুঝলাম, ঘরের ভিতরে বিষম এক ঝটাপটি চলেছে।

ছাব্বিশ – ভূত, না জন্তু, না মানুষ

কি যে করব, কিছুই বুঝতে না পেরে দেয়ালে পিঠ রেখে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলুম—ওদিকে ঘরের ভিতর ঝটাপটি সমানে চলতে লাগল!

তারপরেই সব চুপচাপ!

আলো নিয়ে বিমল তখনো ফিরল না, অন্ধকারে আমিও উঠতে ভরসা করলুম না! ঘরের ভিতরে যে খুব একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটেছে তাতে আর কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু সে কাণ্ডটা যে কি, অনেক ভেবেও আমি তা ঠাউরে উঠতে পারলুম না!

হঠাৎ আমার গায়ের উপরে কে আবার ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললে। আঁতকে উঠে এক লাফে আমি পাঁচ হাত পিছনে গিয়ে দাঁড়ালুম! প্রাণপণে সামনের দিকে চেয়ে দেখলুম, অন্ধকারের মধ্যে দুটো জ্বলন্ত চোখ আমার পানে তাকিয়ে আছে! খানিক পরেই চোখ—দুটো ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল!

এবারে প্রাণের আশা একেবারেই ছেড়ে দিলুম। পায়ে পায়ে আমি পিছন হটতে লাগলুম—সেই জ্বলন্ত চোখ—দুটোর উপরে স্থির রেখে! হঠাৎ কি একটা জিনিসে পা লেগে আমি দড়াম করে পড়ে গেলুম এবং প্রাণের ভয়ে যত—জোরে—পারি চেঁচিয়ে উঠলুম…তারপরেই কিন্তু বেশ বুঝতে পারলুম—আমি একটা মানুষের দেহের উপর কাত হয়ে পড়ে আছি!

সে দেহ কার, তা জীবিত না মৃত, এ সব ভাববার কোন সময় নেই—কারণ গেল—বারের মতন এবারেও হয়তো আবার কোন শয়তান আমার পিঠে লাফিয়ে পড়বে—সেই ভয়েই কাতর হয়ে তাড়াতাড়ি চোখ তুলতেই দেখি, সুড়ঙ্গের মধ্যে বিজলী—মশালের আলো দেখা যাচ্ছে! আঃ, এতক্ষণ পরে!

আলো দেখে আমার ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল, তাড়াতাড়ি চেঁচিয়ে উঠলুম—”বিমল, বিমল, শীগগির এস!”

—”কি হয়েচে কুমার, ব্যাপার কি?” বলতে বলতে বিমল ঝড়ের মত ছুটে এল—তার পিছনে রামহরি!

বিজলী—মশালের আলো ঘরের ভিতর পড়তেই দেখলুম, ঠিক আমার সামনে মাটির উপরে দুই থাবা পেতে বসে বাঘা জিভ বার করে অত্যন্ত হাঁপাচ্চেচ! তার মুখে, সর্ব্বাঙ্গে টাটকা রক্তের দাগ।

বুঝলুম, এই বাঘার চোখ—দুটো দেখেই এবারে আমি মিছে ভয় পেয়েছি! কিন্তু তার মুখে আর গায়ে অত রক্ত কেন?

হঠাৎ বিমল বিস্মিত—স্বরে বললে, ”কুমার, কুমার, তুমি কিসের উপরে বসে আছ!”

তখন আমার হুঁশ হল—আমার তলায় যে একটা মানুষের দেহ!

এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে যা দেখলুম, তা আর জীবনে কখনো ভুলব না।

ঘরের মেঝের উপরে মস্ত লম্বা একটা কালো কুচকুচে মানুষের প্রায় উলঙ্গ দেহ চিত হয়ে সটান পড়ে আছে। লম্বা লম্বা জটপাকানো চুল আর গোঁফদাড়িতে তার মুখখানা প্রায় ঢাকা পড়েছে—তার চোখ দুটো ড্যাব—ডেবে, দেখলেই বুক চমকে ওঠে, হাঁ করা মুখের ভিতর থেকে বড় বড় দাঁতগুলো দেখা যাচ্চেচ—কে এ? সেই অদ্ভুত মূর্ত্তি দেখে সহজে বোঝা শক্ত যে, সে ভূত না জন্তু, না মানুষ!

বিমল হেঁট হয়ে বললে, ”এর গলা দিয়ে যে হু হু করে রক্ত বেরুচ্চেচ!”

আমি শুষ্ক স্বরে বললুম, ”বিমল, একটু আগে এই লোকটা আমাকে খুন করবার চেষ্টা করেছিল।”

—”বল কি, তারপর! তারপর!”

—”তারপর ঠিক কি যে হল অন্ধকারে আমি তা বুঝতে পারিনি বটে, কিন্তু বোধ হয় বাঘার জন্যেই এ—যাত্রা আমি বেঁচে গেছি।”

—”বাঘার জন্যে?”

—”হ্যাঁ, সেইই টুঁটি কামড়ে ধরে একে আমার বুকের উপর থেকে টেনে নামায়, বাঘার কামড়েই যে ওর এই দশা হয়েচে, এখন আমি বেশ বুঝতে পারচি! দেখ দেখি, ও বেঁচে আছে কি না?”

বিমল পরীক্ষা করে দেখে বললে, ”না, একেবারে মরে গেছে!”

রামহরি বাঘার পিঠ চাপড়ে বললে, ”সাবাস বাঘা, সাবাস।”

বাঘা আহ্লাদে ল্যাজ নাড়তে লাগল; আমি আদর করে তাকে বুকে টেনে নিলুম।

বিমল বললে, ”কিন্তু এ লোকটা কে?”

রামহরি বললে, ”উঃ, কি ভয়ানক চেহারা! দেখলেই ভয় হয়!”

আমি বললুম, ”আমার তো ওকে পাগল বলে মনে হচ্ছে।”

বিমল বললে, ”হতে পারে। নইলে অকারণে তোমাকে মারবার চেষ্টা করবে কেন?”

আমি বললুম, ”এতক্ষণে একটা ব্যাপার বুঝতে পারচি। শম্ভু বোধ হয় এর হাতেই মারা পড়েচে।”

রামহরি বললে, ”কিন্তু এ সুড়ঙ্গের মধ্যে এল কি করে?”

বিমল চুপ করে ভাবতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে সে বললে, ”দেখ কুমার, হাসি শুনে কে হাসচে খুঁজতে গিয়ে আমরা সুড়ঙ্গের এক জায়গায় কতকগুলো জ্বলন্ত কাঠ আর পোড়া মাংস দেখে এসেছি। এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এ লোকটাই এ সুড়ঙ্গের মধ্যে বাস করত। আমাদের দেখে এইই এতক্ষণ হাসছিল—এ যে পাগল তাতে আর কোন সন্দেহ নাই!”

আমি বললুম, ”কিন্তু সুড়ঙ্গের চারিদিক যে বন্ধ!”

বিমল লাফ মেরে দাঁড়িয়ে আনন্দভরে বলে উঠল, ”কুমার, আমরা বেঁচে গেছি! এই অন্ধকূপের মধ্যে আমাদের আর অনাহারে মরতে হবে না!”

আমি আশ্চর্য্য হয়ে বললুম, ”হঠাৎ তোমার এতটা আহ্লাদের কারণ কি?”

বিমল বললে, ”কুমার, তুমি একটি নিরেট বোকা। এও বুঝচ না যে এই পাগলটা যখন সুড়ঙ্গের মধ্যে বাসা বেঁধেছে তখন কোথাও না কোথাও বাইরে যাবার একটা পথও আছে। সুড়ঙ্গের যে মুখে ঢুকেছি, সে মুখ তো বরাবরই বন্ধ ছিল, সুতরাং সেখান দিয়ে নিশ্চয়ই এই পাগলটা আনাগোনা করতো না! যদি বল সে বাইরে যেত না, তাহলে সুড়ঙ্গের মধ্যে জ্বালানি কাঠ আর মাংস এলো কোত্থেকে?”

আমি বললুম, ”কিন্তু অন্য পথ থাকলেও আমরা তো তার সন্ধান জানি না।”

বিমল বললে, ”সেইটেই আমাদের খুঁজে দেখা দরকার। সুড়ঙ্গের সবটা তো আমরা দেখিনি।”

আমি বললুম, ”তবে চল, আগে পথ খুঁজে বার করতে হবে, যকের ধন তো পেলুম না, এখন কোন—গতিকে বাইরে বেরুতে পারলেই বাঁচি।”

বিমল বললে, ”যকের ধন এখনো আমাদের হাতছাড়া হয়নি। পথ যদি খুঁজে পাই, তাহলে এখনো করালীকে ধরতে পারব। এখানে আর দেরি করা নয়,—চলে এস!”

বিমল আরো এগিয়ে গেল, আমরা তার পিছনে চললুম।

সুড়ঙ্গটা যে কত বড়, তার মধ্যে যে এত অলিগলি আছে, আগে আমরা সেটা বুঝতে পারিনি। প্রায় দু—ঘণ্টা ধরে আমরা চারিদিকে আতিপাতি করে খুঁজে বেড়ালুম, কিন্তু পথ তবুও পাওয়া গেল না। সেই চির—অন্ধকারের রাজ্যে আলো আর বাতাসের অভাবে প্রাণ আমাদের থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠছিল, কিন্তু উপায় নেই, কোন উপায় নেই!

শেষটা হাল ছোড় দিয়ে আমি বললুম, ”বিমল, আর আমি ভাই পারছি না, পথ যখন পাওয়াই যাবে না, তখন এখানেই শুয়ে শুয়ে আমি শান্তিতে মরতে চাই!”

এই বলে আমি বসে পড়লুম।

বিমল আমার হাত ধরে নরম গলায় বললে, ”ভাই কুমার, এত সহজে কাবু হয়ে পড়লে চলবে না! পথ আছেই, আমরা খুঁজে বার করবই!”

আমি সুড়ঙ্গের গায়ে হেলান দিয়ে বললুম, ”তোমার শক্তি থাকে তো পথ খুঁজে বার কর—আমার শরীর আর বইচে না।”

হঠাৎ বাঘা দাঁড়িয়ে উঠে কান খাড়া করে একদিকে চেয়ে রইল—বিমলও আলোটা তাড়াতাড়ি সেই দিকে ফেরালে। দেখলুম খানিক তফাতে একটা শেয়াল থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে আমাদের পানে তাকিয়ে আছে।

বাঘা তাকে রেগে ধমক দিয়ে তেড়ে গেল, শেয়ালটাও ভয় পেয়ে ছুট দিলে—ব্যাপার কি হয় দেখবার জন্যে বিমল বিজলী—মশালের আলোটা সেই দিকে ঘুরিয়ে ধরলো।

অল্পদূরে গিয়েই শেয়ালটা সুড়ঙ্গের উপর দিকে একটা লাফ মেরে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাঘা হতভম্বের মত সেইখানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

শেয়ালটা কি করে পালাল দেখবার জন্যে বিমল কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল। তারপর আলোটা মাথার উপর তুলে ধরে সেখানটা দেখেই মহা আহ্লাদে চেঁচিয়ে উঠল, ”পথ পেয়েচি কুমার, পথ পেয়েচি!”

বিমলের কথায় আমার দেহে যেন নূতন জীবন ফিরে এল, তাড়াতাড়ি উঠে সেইখানে ছুটে গিয়ে বললুম, ”কৈ, কৈ?”

—”এই যে!”

সত্যই তো! দেওয়ালের একেবারে উপর দিকে ছোট একটা গর্ত্তের মত, তার ভিতর দিয়ে বাইরের আলো রূপোর আভার মত দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ পরে পৃথিবীর আলো দেখে আমার চোখ আর মন যেন জুড়িয়ে গেল।

বিমল বললে, ”নিশ্চয় পাহাড় ধ্বসে এই পথের সৃষ্টি হয়েছে। কুমার, তুমি সকলের আগে বেরিয়ে যাও। রামহরি, তুমি আলোটা নাও, আমি কুমারকে গর্ত্তের মুখে তুলে ধরি!”

বিমল আমাকে কোলে করে তুলে ধরলে, গর্ত্ত দিয়ে মুখ বাড়াতেই নীলাকাশের সূর্য্য, স্নিগ্ধ—শীতল বাতাস আর ফলে—ফুলে ভরা সবুজ বন যেন আমাকে চিরজন্মের বন্ধুর মতন সাদরে অভ্যর্থনা করলে!

সাতাশ – করালীর আর এক কীর্ত্তি

বাইরের আলো—হাওয়া যে কত মিষ্টি, পাতালের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে সেদিন তা ভালো করে প্রথম বুঝতে পারলুম।

কারুর মুখে কোন কথা নেই। সকলে মিলে নীরবে বসে খানিকক্ষণ ধরে সেই আলো—হাওয়াকে প্রাণ ভরে ভোগ করে নিতে লাগলুম।

হঠাৎ বিমল একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, ”আলো—হাওয়া আজও আছে, কালও থাকবে! কিন্তু করালীকে আজ না ধরতে পারলে এ জীবনে আর কখনো ধরতে পারব না! ওঠ কুমার, ওঠ রামহরি!”

আমি কাতরভাবে বললুম, ”কোথায় যাব আবার?”

—”যে পথে এসেছি, সে পথে! করালীকে ধরব—যকের ধন কেড়ে নেব।”

—”কিন্তু এখনো যে আমাদের খাওয়া—দাওয়া হয়নি!”

বিমল হাত ধরে একটানে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললে, ”খাওয়া—দাওয়ার নিকুচি করেচে! আগে তো বেরিয়ে পড়, তারপর ব্যাগের ভেতরে বিস্কুটের টিন আছে, পথ চলতে চলতে তাই খেয়েই পেট ভরাতে পারবে!—এস এস, আর দেরি নয়!”

বন্দুকটা ঘাড়ে করে বিমল অগ্রসর হল, আমরাও তার পিছনে চললুম।

বিমল বললে, ”সুড়ঙ্গের মুখে পাথর চাপা দিয়ে করালী নিশ্চয় ভাবচে, আর কেউ তার যকের ধনে ভাগ বসাতে আসবে না। সে নিশ্চিন্ত মনে দেশের দিকে ফিরে চলেচে, আমরা একটু তাড়াতাড়ি হাঁটলে আজকেই হয়তো আবার তাকে ধরতে পারব, এরি—মধ্যে সে বেশী দূর এগুতে পারেনি।”

আমি বললুম, ”কিন্তু করালী তো সহজে যকের ধন ছেড়ে দেবে না!”

—”তা তো দেবেই না!”

—”তা হলে আবার একটা মারামারি হবে বল?”

—”হবে বৈকি! কিন্তু এবারে আমরাই তাকে আগে আক্রমণ করব।”

এমনি কথা কইতে কইতে, বৌদ্ধমঠ পিছনে ফেলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে পড়লুম। ক্রমে সূর্য্য ডুবে গেল, চারিধারে অন্ধকারের আবছায়া ঘনিয়ে এল, বাসামুখো পাখীরা কলরব করতে করতে জানিয়ে দিয়ে গেল যে, পৃথিবীতে এবার ঘুমপাড়ানী মাসীর রাজত্ব শুরু হবে!

আমরা পাহাড়ের সেই মস্ত ফাটলের কাছে এসে পড়লুম,—সরল গাছ কেটে সাঁকোর মত করে যেখানটা আমাদের পার হতে হয়েছিল। সাঁকোর কাছে এসে বিমল বললে, ”দেখ কুমার, আমি যদি করালী হতুম, তাহলে কি করতুম জানো?”

—”কি করতে?”

—”এই গাছটাকে যে কোন রকমে ফাটলের মধ্যে ফেলে দিয়ে যেতুম। তাহলে আর কেউ আমার পিছু নিতে পারত না।”

—”কিন্তু করালী যে জানে তার শত্রুরা এখন কবরের অন্ধকারে হাঁপিয়ে মরচে, তারা আর তার কিছুই করতে পারবে না!”

—”এত বেশী নিশ্চিন্ত হওয়াই ভুল, সাবধানের মার নাই! দেখ না, এই এক ভুলেই করালীকে যকের ধন হারাতে হবে।…কিন্তু কে ও—কে ও?”

আমরা সকলেই স্পষ্ট শুনলুম, স্তব্ধ সন্ধ্যার বুকের মধ্য থেকে ক্ষীণ আর্ত্তনাদ জেগে উঠেছে—”জল, একটু জল!”

—”কুমার কুমার, ও কার আর্ত্তনাদ?”

—”একটু জল, একটু জল!”

সকলে মিলে এদিকে—ওদিকে খুঁজতে খুঁজতে শেষটা দেখলুম, পাহাড়ের একপাশে একটা খাদলের মধ্যে যেন মানুষের দেহের মত কি পড়ে রয়েছে! জঙ্গলে সেখানটা অন্ধকার দেখে আমি বললুম, ”রামহরি, শীগগির লণ্ঠনটা জ্বালো তো!”

রামহরি আলো জ্বেলে খাদলের উপর ধরতেই লোকটা আবার কান্নার স্বরে চেঁচিয়ে উঠল—”ওরে বাবা রে, প্রাণ যে যায়, একটু জল দাও—একটু জল দাও!”

বিমল তাকে টেনে উপরে তুলে, তার মুখ দেখেই বলে উঠল, ”একে যে আমি করালীর সঙ্গে দেখেচি!”

লোকটাও বিমলকে দেখে সভয়ে বললে, ”আমাকে আর মেরো না, আমি মরতেই বসেচি—আমাকে মেরে আর কোনো লাভ নেই!

এতক্ষণে দেখলুম, তার মুখে বুকে হাতে পিঠে বড় বড় রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন—ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেউ তাকে বার বার আঘাত করেছে!”

বিমল বললে, ”কে তোমার এ দশা করলে?”

—”করালী!”

—”করালী!”

—”হ্যাঁ মশাই, সেই সয়তান করালী।”

—”কেন সে তোমাকে মারলে?”

—”সব বলচি, কিন্তু বাবু, তোমার পায়ে পড়ি, আগে একটু জল দাও—তেষ্টায় আমার ছাতি ফেটে যাচ্ছে!”

রামহরি তাড়াতাড়ি তার মুখে জল ঢেলে দিলে। জলপান করে ‘আঃ’ বলে লোকটা চোখ মুদে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল।

বিমল বললে, ”এইবার বল, করালী কেন তোমাকে মারলে?”

—”বলচি বাবু, বলচি, আমি তো আর বাঁচব না, কিন্তু মরবার আগে সব কথাই তোমাদের কাছে বলে যাব!” আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে বলতে লাগল, ”বাবু, তোমাদের পাথর চাপা দিয়ে করালীবাবু আর আমি তো সেখান থেকে চলে এলুম। যকের ধনের বাক্স ছিল করালীবাবুর হাতেই। তারপর এখানে এসে করালীবাবু বললে, ‘তুই কিছু খাবার রান্না কর, কাল সারারাত খাওয়া হয়নি, বড্ড ক্ষিধে পেয়েচে।—আমাদের সঙ্গে চাল—ডাল আর আলু ছিল, বন থেকে কাঠ—কুটো যোগাড় করে এনে আমি খিচুড়ি চড়িয়ে দিলুম।…করালীবাবু আগে খেয়ে নিলে, পরে আমি খেতে বসলুম। তারপর কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ আমার পিঠের ওপরে ভয়ানক একটা চোট লাগল, তখনি আমি চোখে অন্ধকার দেখে চিত হয়ে পড়ে গেলুম। তারপর আমার বুকে আর মুখেও ছোরার মতন কি এসে বিঁধল—আমি একেবারে অজ্ঞান হয়ে পড়লুম। কে যে মারলে তা আমি দেখতে পাইনি বটে, কিন্তু করালীবাবু ছাড়া তো এখানে আর জনমনিষ্যি ছিল না, সে ছাড়া আর কেউ আমাকে মারেনি। বোধ হয় পাছে আমি তার যকের ধনের ভাগীদার হতে চাই, তাই সে একাজ করেচে”—এই পর্য্যন্ত বলেই লোকটা হাঁপাতে লাগল।

বিমল ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করল, ”এ ব্যাপারটা কতক্ষণ আগে হয়েচে?”

—”তখন বোধ হয় বিকেল বেলা।”

—”করালীর সঙ্গে আর কে আছে?”

—”কেউ নেই। আমরা পাঁচজন লোক ছিলুম। আসবার মুখেই দুজন তো তোমাদের তাড়া খেয়ে অন্ধকার রাতে ঐ ফাটলে পড়ে মরেচে। শম্ভুকে সুড়ঙ্গের মধ্যে ভূত না দানো কার মুখে ফেলে ভয়ে আমরা পালিয়ে এসেচি। এইবার আমার পালা, জল—আর একটু জল!”

রামহরি আবার তার মুখে জল দিলে, কিন্তু সেবারে জল খেয়েই তার চোখ কপালে উঠে গেল।

বিমল তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলে, ”যকের ধনের বাক্সে কি ছিল?”

কিন্তু লোকটা আর কোন কথার জবাব দিতে পারলে না, তার মুখ দিয়ে গাঁজলা উঠতে লাগল ও জোরে নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। তার পরেই গোটা—কতক হেঁচকি তুলে সে একেবারে স্থির হয়ে রইল।

বিমল বলল, ”যাক, এ আর জন্মের মত কথা কইবে না! এখন চল, করালীকে ধরে তবে অন্য কাজ!”

চোখের সামনে একটা লোককে এ—ভাবে মরতে দেখে আমার মনটা অত্যন্ত দমে গেল, আমি আর কোন কথা না বলে বিমলের সঙ্গে সঙ্গে চললুম এই ভাবতে ভাবতে যে, পৃথিবীতে করালীর মতন মহা—পাষণ্ড আর কেউ আছে কি?

আঠাশ – ভীষণ গহ্বর

অল্প—অল্প চাঁদের আলো ফুটেছে, সে আলোতে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না—অন্ধকার ছাড়া! প্রেতলোকের মতন নির্জ্জন পথ। আমাদের পায়ের শব্দে যেন চারিদিকের স্তব্ধতা চমকে উঠছে! আশ—পাশের কালি—দিয়ে—আঁকা গাছপালাগুলো মাঝে মাঝে বাতাস লেগে দুলছে আর আমাদের মনে হচ্ছে, থেকে থেকে অন্ধকার যেন তার ডানা নাড়া দিচ্ছে।

আমি বললুম, ”দেখ বিমল, আমাদের আর এগুনো ঠিক নয়।”

—”কেন?”

—”এই অন্ধকারে একলা পথ চলতে করালী নিশ্চয় ভয় পাবে। খুব সম্ভব, সে এখন কোন গুহায় শুয়ে ঘুমুচ্চেচ আর আমরা হয়তো তাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাব। তার চেয়ে আপাততঃ আমরা কোথাও মাথা গুঁজে কিছু বিশ্রাম করে নি এস, তারপর ভোর হলেই আবার চলতে সুরু করা যাবে।”

বিমল বললে, ”কুমার, তুমি ঠিক বলেচ! করালীকে ধরবার আগ্রহে এসব কথা আমার মনেই ছিল না।”

* * *

রক্ত—জবার রঙে—ছোবানো উষার প্রখর আলো সবে যখন পূর্ব—আকাশের ধারে পাড় বুনে দিচ্ছে, আমরা তখন আবার উঠে পথ চলতে সুরু করলুম।

চারিদিকে নানা জাতের পাখীরা মিলে গানের আসর জমিয়ে তুলেছে, গাছের সবুজ পাতারাও যেন মনের সুখে কাঁপতে কাঁপতে মর্ম্মর—সুরে সেই গানে যোগ দিয়েছে, আর তারই তালে তালে ঝরে পড়ে ঝরনার জল নাচতে নাচতে নীচে নেমে যাচ্ছে! আকাশে বাতাসে পৃথিবীতে কেমন একটি শান্তিভরা আনন্দের আভাস! এরি মধ্যে আমরা কিন্তু আজ হিংসাপূর্ণ আগ্রহে ছুটে চলেছি…এটা ভেবেও আমার মন বার বার কেমন সঙ্কুচিত হয়ে পড়তে লাগল!

পাহাড়ের পর পাহাড়ের মাথার উপরে সূর্য্যের মুখ যখন জ্বলন্ত মুকুটের মতন জেগে উঠল, আমরা তখন পথের একটা বাঁকের মুখে এসে পড়েছি।

বাঘা এগিয়ে এগিয়ে চলছিল, বাঁকের মুখে গিয়েই হঠাৎ সে ঘেউ ঘেউ করে চেঁচিয়ে উঠল।

আমরা সবাই সতর্ক ছিলুম, সে চ্যাঁচালে কেন, দেখবার জন্যে তখনি সকলে ছুটে বাঁকের মুখে গিয়ে দাঁড়ালুম।

দেখলুম, খানিক তফাতে একটা লোক দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে! দেখবামাত্র চিনলুম, সে করালী! তার হাতে একটা বড় বাক্স—যকের ধন!

আমাদের দেখেই করালী বেগে এক দৌড় মারলে—সঙ্গে সঙ্গে বিমলও তীরের মতন তার দিকে ছুটে গেল। আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম!

ছুটতে ছুটতে বিমল একেবারে করালীর কাছে গিয়ে পড়ল : তারপর সে চেঁচিয়ে বললে, ”করালী, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও তবে থামো! নইলে আমি গুলি করে তোমাকে মেরে ফেলব!”

কিন্তু করালী থামলে না, হঠাৎ পথের বাঁ—দিকে একটা উঁচু জায়গায় লাফিয়ে উঠেই অদৃশ্য হয়ে গেল—বিমল সেখানে থমকে দাঁড়াল—এক মুহূর্ত্তের জন্যে। তার পরেই সেও লাফিয়ে উপরে উঠল, আমরা তাকেও আর দেখতে পেলুম না।

ততক্ষণে আমাদের হুঁশ হল—”রামহরি, শীগগির এস” বলেই আমিও প্রাণপণে দৌড়ে অগ্রসর হলুম।

সেই উঁচু জায়গাটার কাছে গিয়ে দেখলুম, সেখানে পাহাড়ের গায়ে রয়েছে একটা গুহার মুখ। আমি এক লাফে উপরে উঠতেই একটা বিকট চীৎকার এসে আমার কানের ভিতর ঢুকল—সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম বিমলের কণ্ঠস্বরে উচ্চ আর্ত্তনাদ। তারপরেই সব স্তব্ধ।

আমার বুকের ভিতরটা যেন কেমন করে উঠল—বেগে ছুটে গিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকে পড়লুম। ভিতরে গিয়ে দেখি কেউ তো সেখানে নেই। অত্যন্ত আশ্চর্য্য স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম।

পর—মুহূর্তে রামহরিও এসে গুহার মধ্যে ঢুকে বললে, ”কে অমন চেঁচিয়ে উঠল? কৈ, খোকাবাবু কোথায়?”

—”জানি না রামহরি, আমি শুনলুম গুহার ভেতর থেকে বিমল আর্ত্তনাদ করে উঠল। কিন্তু ভেতরে এসে কারুকেই তো দেখতে পাচ্ছি না।”

গুহার একদিকটা আঁধারে ঝাপসা। সেইদিকে গিয়েই রামহরি বলে উঠল, ”এই যে, ভেতরে আর একটা পথ রয়েছে।”

দৌড়ে গিয়ে দেখি, সত্যিই তো! একটা গলির মত পথ ভিতর দিকে চলে গেছে—কিন্তু অন্ধকার সেখানে, একটুও নজর চলে না।

আমি বললুম, ”রামহরি, শীগগির বিজলী—মশাল বের কর, বন্দুকটা আমাকে দাও!”

বন্দুকটা আমার হাতে দিয়ে রামহরি বিজলী—মশাল বার করলে, তারপর সাবধানে ভিতরে গিয়ে ঢুকল। আমিও বন্দুকটা বাগিয়ে ধরে সতর্ক চোখে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে তার সঙ্গে সঙ্গে চললুম।

উপরে, নীচে, এ—পাশে, ও—পাশে গুহার নিরেট পাথর, তারই ভিতর দিয়ে যেতে আবার আমার মনে পড়ল সেই যকের ধনের সুড়ঙ্গের কথা!

আচম্বিতে রামহরি দাঁড়িয়ে পড়ে আঁতকে উঠে বললে, ”সর্ব্বনাশ!”

আমি বললুম, ”ব্যাপার কি?”

রামহরি বললে, ”সামনেই প্রকাণ্ড একটা গর্ত্ত!”

—বিজলী—মশালের তীব্র আলোতে দেখলুম, ঠিক রামহরির পায়ের তলাতেই গুহার পথ শেষ হয়ে গেছে, তারপরেই মস্ত বড় একটা অন্ধকার—ভরা ফাঁক যেন হা হা করে আমাদের গিলতে আসছে! বিমল কি ওরই মধ্যে পড়ে গেছে?”

যতটা পারি গলা চড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাকলুম, ”বিমল, বিমল, বিমল!

পৃথিবীর গর্ভ থেকে করুণ স্বরে কে যেন সাড়া দিলে, ”কুমার, কুমার! বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও!”

গহ্বরের ধারে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে রামহরির হাত থেকে বিজলী—মশালটা নিয়ে দেখলুম, গর্ত্তের মুখটা প্রায় পঞ্চাশ—ষাট হাত চওড়া! তলার দিকে চেয়ে দেখলুম, প্রায় ত্রিশ হাত নীচে কি—যেন চকচক করছে! ভালো করে চেয়ে দেখি, জল!

আবার চেঁচিয়ে বললুম, ”বিমল, কোথায় তুমি?”

অনেক নীচে থেকে বিমল বললে, ”এই যে জলের ভেতরে। শীগগির আমাকে তোলবার ব্যবস্থা কর ভাই, আমার হাতে—পায় খিল ধরেচে, এখনি ডুবে যাব।”

—”রামহরি, রামহরি! ব্যাগের ভেতর থেকে দড়ির বাণ্ডিল বের কর জলদি!”

রামহরি তখনি পিঠ থেকে বড় ব্যাগটা নামিয়ে খুলতে বসে গেল। আমি বিজলী—মশালটা নীচু—মুখো করে দেখলুম, কালো জলের ভিতরে ঢেউ তুলে বিমল সাঁতার দিচ্ছে।

তাড়াতাড়ি দড়ি নামিয়ে দিলুম, বিমল সাঁতরে এসে দড়িটা দু—হাতে চেপে ধরলে।

আমি আবার চেঁচিয়ে বললুম, ”বিমল, দেওয়ালে পা দিয়ে দড়ি ধরে তুমি উপরে উঠতে পারবে, না, আমরা তোমায় টেনে তুলব?”

বিমলও চেঁচিয়ে বললে, ”বোধ হয় আমি নিজেই উঠতে পারব।”

আমি আর রামহরি সজোরে দড়ি ধরে রইলুম, খানিক পরে বিমল নিজেই এসে উঠল, তারপর আমার কোলের ভিতরে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে অজ্ঞান হয়ে গেল।

আমরা দুজনে তাকে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এলুম।

ঊনত্রিশ – পরিণাম

বিমলের জ্ঞান হলে পর আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ”কি করে তুমি গর্ত্তের মধ্যে গিয়ে পড়লে?”

বিমল বললে, ”করালীর পিছনে পিছনে যেই আমি গুহার মধ্যে গিয়ে ঢুকলুম, সে অমনি ঐ অন্ধকার গলির মধ্যে সেঁধিয়ে পড়ল। আমিও ছাড়লুম না, গলির ভেতরে ঢুকে সেই অন্ধকারেই আমি তাকে জড়িয়ে ধরলুম, তারপরে দুজনে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু হল। কিন্তু আমরা কেউ জানতুম না যে ওখানে আবার একটা গহ্বর আছে, ঠেলা—ঠেলি জড়াজড়ি করতে করতে দুজনে হঠাৎ তার ভেতরে পড়ে গেলুম।”

আমি শিউরে বলে উঠলুম, ”অ্যাঃ! করালী তাহলে এখানো গহ্বরের মধ্যে আছে?”

—”হ্যাঁ, কিন্তু বেঁচে নেই।”

—”সে কি!”

—”যদিও অন্ধকারে সেখানে চোখ চলে না, তবু আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি, সে ডুবে মরেচে। কারণ আমরা জলে পড়বার পর ঠিক আমার পাশেই দু—চারবার ঝপাঝপ শব্দ হয়েই সব চুপ হয়ে গেল। নিশ্চয়ই সাঁতার জানত না, জানলে জলের ভেতরে শব্দ হত।”

আমি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করলুম, ”আর যকের ধনের বাক্সটা?”

বিমল একটা বিষাদ ভরা হাসি হেসে মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, ”আমি যখন করালীকে জড়িয়ে ধরি, তখনও সে বাক্সটা ছাড়েনি। আমার বিশ্বাস, বাক্সটা নিয়েই সে জলপথে পরলোক যাত্রা করেচে।

—”কিন্তু বাক্সটা যদি গলির ভেতরে পড়ে থাকে?” বলেই আমি বিজলী—মশালটা নিয়ে আবার গুহার ভিতরকার গলির মধ্যে গিয়ে ঢুকলুম। কিন্তু মিছে আশা, সেখানে বাক্সের চিহ্নমাত্রও নেই! আর একবার সেই বিরাট গহ্বরের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলুম, অনেক নীচে অন্ধকার মাখা জলরাশি মৃত্যুর মতন স্থির ও স্তব্ধ হয়ে আছে, এই একটু আগেই সে যে একটা মানুষের প্রাণ ও সাত রাজার ধনকে নিষ্ঠুরভাবে গ্রাস করে ফেলেছে, তাকে দেখে এখন আর সে সন্দেহ করবারও উপায় নেই।

হতাশভাবে বাইরে এসে অবসন্নের মতন বসে পড়লুম!

বিমল সুধোলে, ”কেমন, পেলে না তো!”

মাথা নেড়ে নীরবে জানালুম—”না।”

—”তা আমি আগেই জানি। করালী প্রাণে মরেচে বটে, কিন্তু যকের ধন ছাড়েনি। শেষ জিত তারই!”

স্তব্ধ হয়ে বসে রইলুম। দুঃখে ক্ষোভে, বিরক্তিতে মনটা আমার ভরে উঠল; এত বিপদ, এত কষ্টভোগের পর এত—বড় নিরাশা! আমার ডাক ছেড়ে কাঁদবার ইচ্ছা হতে লাগল!

বিমল হতাশভাবে মাটির দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইল। অনেকক্ষণ পরে রামহরি বললে, ”তোমরা দুজনে অমন মন—মরা হয়ে থাকলে তো চলবে না! যকের ধন ভাগ্যে নেই, তাতে হয়েচে কি? প্রাণে বেঁচ্ছে এই ঢের! যা হাতে না আসতেই এত বিপদ, এত ঝঞ্ঝাট, যার জন্যে এতগুলো লোকের প্রাণ গেল, তা পেলে না জানি আরো কত মুস্কিলই হত! এখন ঘরের ছেলে ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরে চল!”

বিমল মাথা তুলে হেসে বললে, ”ঠিক বলেচ রামহরি! আঙুর যখন নাগালের বাইরে, তখন তাকে তেতো বলেই মনকে প্রবোধ দেওয়া যাক। যকের ধন কি মানুষের ভোগে লাগে? করালী ভুত হয়ে চিরকাল তা ভোগ করুক—দরকার নেই আর তার জন্যে মাথা ঘামিয়ে! আপাততঃ বড়ই ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে কুমার! তুমি একবার চেষ্টা করে দেখ, পাখীটাখি কিছু মারতে পারো কি না। ততক্ষণে রামহরি ভাত চড়িয়ে দিক, আর আমি ওষুধ মালিস করে গায়ের ব্যথা দূর করি।”

আমি বললুম, ”কাজেই।”

বিমল বললে, ”আহারের পর নিদ্রা, তারপর দুর্গা বলে স্বদেশের দিকে যাত্রা, কি বল?”

আমি বললুম, ”আগত্যা।”

আমার কথা ফুরুলো।

প্রকাশিত—১৯২৩

সমাপ্ত