দশ – এ চোর কে?
আমরা খাসিয়া পাহাড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি—সামনে বুদ্ধদেবের এক পাথরের মূর্ত্তি। গভীর রাত্রি, আকাশে চাঁদ নেই, সব দিকে খালি অন্ধকার আর অন্ধকার! মাথার অনেক উপরে তারাগুলো টিপ টিপ করে জ্বলছে, তাদের আলোতে আশে—পাশে অনেকগুলো পাহাড়ের মাথা ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে—আমার মনে হ’ল সেগুলো যেন বড় বড় দানবের কালো কালো মায়ামূর্ত্তি। তারা যেন প্রেতপুরীর পাহারাওয়ালার মত ওৎ পেতে হুমড়ি খেয়ে রয়েছে—এখনি হুড়মুড় ক’রে আমাদের ঘাড়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে! চারদিক এত স্তব্ধ যে গাঁয়ে কাঁটা দেয়, বুক ছাঁৎ ছাঁৎ করে! শুধু রাত করছে—ঝিম ঝিম ঝিম তারা ভয়ে কেঁপে গাছপালা করছে—সর সর সর!
বিমল চুপি চুপি আমাকে বললো, ”এই বুদ্ধদেবের মূর্ত্তি। এইখানেই যকের ধন আছে।”
হঠাৎ কে খল খল ক’রে হেসে উঠল—সে বিকট হাসির প্রতিধ্বনি যেন পাহাড়ের মাথাগুলো টপকে লাফাতে লাফাতে কোথাও কতদূরে কোন চির অন্ধকারের দেশের দিকে চলে গেল!
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম, রামহরি আঁৎকে উঠে দু’হাতে মুখ ঢেকে ধুপ করে বসে পড়ল, বাঘা আকাশের দিকে মুখ তুলে ল্যাজ গুটিয়ে কেঁউ কেঁউ করে কাঁদতে লাগল।
বিমল সাহসে ভর করে বললে, ”কে হাসলে?”
আবার সেই খল খল করে বিকট হাসি। কে যে হাসছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবে সে হাসি নিশ্চয়ই মানুষের নয়—মানুষ কখনো এমন ভয়ানক হাসি হাসতে পারে না!
বিমল আবার বললে, ”কে তুমি হাসচ?”
—”আমি!” উঃ, সে স্বর কি গম্ভীর।
—”কে তুমি? সাহস থাকে আমার সামনে এস।”
—”আমি তোমার সামনেই আছি।”
—”মিথ্যে কথা! আমার সামনে খালি বুদ্ধদেবের মূর্ত্তি আছে।”
—”হাঃ, হাঃ, হাঃ, হাঃ! আমাকে বুদ্ধদেবের মূর্ত্তি ভাবচ? চেয়ে দেখ ছোকরা আমি যক!”
বুদ্ধদেবের সেই মূর্ত্তিটা একটু একটু নড়তে লাগল, তার চোখ দুটো ধ্বক ধ্বক করে জ্বলে উঠল।
বিমল বন্দুক তুললে মূর্ত্তিটা আবার খল খল করে হেসে বললে, ”তোমার বন্দুকের গুলিতে আমার কিছুই হবে না।”
বিমল বললে, ”কিন্তু হয় কিনা দেখাচ্চি।” সে বন্দুকের ঘোড়া টিপতে উদ্যত হল!
আকাশ—কাঁপানো স্বরে মূর্ত্তি চেঁচিয়ে বললে, ”খবর্দ্দার! তোমার গুলি লাগলে আমার গায়ের পাথর চ’টে যাবে। বন্দুক ছুঁড়লে তোমারি বিপদ হবে।”
—”হোক গে বিপদ—বিপদকে আমি ডরাই না।”
—”জানো, আমি আজ হাজার হাজার বছর ধরে এইখানে বসে আছি আর তুমি কালকের ছোকরা হয়ে আমার শান্তিভঙ্গ করতে এসেছ? কি চাও তুমি?”
—”গুপ্তধন!”
—”হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। গুপ্তধন চাও,—ভারি আশা যে! এই গুপ্তধন নিতে এসে এখানে তোমার মত কত মানুষ মরা পড়েচে তা জানো? ঐ দেখ তাদের শুকনো হাড়!
মূর্ত্তির চোখের আলোতে দেখলুম, এক দিকে মস্তবড় হাড়ের ঢিপি—হাজার হাজার মানুষের হাড়ে সেই ঢিপি অনেকখানি উঁচু হয়ে উঠেছে।
বিমল একটুও না দমে বললে, ”ও দেখে আমি ভয় পাই না—আমি গুপ্তধন চাই।’
—”আমি গুপ্তধন দেব না।”
—”দিতেই হবে।”
—”না, না, না!”
—”তা হলে বন্দুকের গুলিতে তোমার আগুন চোখ কানা করে দেব।”
গর্জ্জন করে মূর্ত্তি বললে, ”তার আগেই তোমাকে আমি বধ করব!”
—”তুমি তো পাথর, এক পা এগুতে পার না, আমি তোমার নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, তুমি আমার কি করবে?”
—”হাঃ, হাঃ, হাঃ, চেয়ে দেখ এখানে চারিদিকেই আমার প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে! আমার হুকুমে এখনি ওরা তোমাদের টিপে মেরে ফেলবে!”
—”কোথায় তোমার প্রহরী?”
—”প্রত্যেক পাহাড় আমার প্রহরী!”
—”ওরাও তো পাথর, তোমার মত নড়তে পারে না। ও—সব বাজে কথা রেখে হয় আমাকে গুপ্তধন দাও—নয় এই তোমাকে গুলি করলুম!”—বিমল আবার বন্দুক তুললে।
—”তবে মর। প্রহরী।” মূর্ত্তির আগুন চোখ নিবে গেল—সঙ্গে সঙ্গে পলক না যেতেই অন্ধকারের ভিতর অনেকগুলো পাহাড়ের মত মস্ত বড় কি কতকগুলো লাফিয়ে উঠে আমাদের উপরে এসে পড়ল। বিষম এক ধাক্কায় মাটির উপর পড়ে অসহ্য যাতনায় চেঁচিয়ে আমি বললুম—”বিমল—বিমল—”
আমার ঘুম ভেঙে গেল! চোখ মেলে দেখলুম, রেলগাড়ীর বেঞ্চের উপর থেকে গড়িয়ে আমি নীচে পড়ে গেছি, আর বিমল আমার মুখের উপরে ঝুঁকে বলছে, ”ভয় কি কুমার, সে রাস্কেল পালিয়েচে!”
তখনো স্বপ্নের ঘোর আমার যায়নি,—আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, ”যক আর নেই?”
বিমল আশ্চর্য্য ভাবে বললে, ”যকের কথা কি বলচ, কুমার?”
আমি উঠে বসে চোখ কচলে অপ্রস্তুত হয়ে বললুম, ”বিমল, আমি এতক্ষণ একটা বিদঘুটে স্বপ্ন দেখছিলুম। শুনলে তুমি অবাক হবে।”
বিমল বললে, ”আর গাড়ীর ভিতরে এখনি যে কাণ্ডটা হয়ে গেল, তা মোটেই স্বপ্ন নয়! শুনলে তুমিও অবাক হবে।”
আমি হতভম্বের মত বললুম, ”গাড়ীর ভেতরে আবার কি কাণ্ড হল?”
বিমল বললে, ”একটা চোর এসেছিল!”
—”চোর? বল কি?”
—”হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, একটা লোক আমাদের ব্যাগ হাতড়াচ্ছে! আমি তখনি উঠে তার রগে এক ঘুসি বসিয়ে দিলুম, সে ঠিকরে তোমার গায়ের উপর গিয়ে পড়ল—সঙ্গে সঙ্গে তুমিও আঁৎকে উঠে বেঞ্চির তলায় চিৎপাত হলে! লোকটা পড়েই আবার দাঁড়িয়ে উঠল, তারপর চোখের নিমেষে জানালা দিয়ে বাইরে এক লাফ মেরে অবশ্য অদৃশ্য হয়ে গেল।”
—”চলন্ত ট্রেন থেকে সে লাফ মারল? তা হলে নিশ্চয়ই মারা পড়েচে!”
—”বোধ হয় না। ট্রেন তখন একটা ষ্টেশনের কাছে আস্তে আস্তে চলছিল!”
—”আমাদের কিছু চুরি গিয়েছে নাকি?”
—”হুঁ। মড়ার মাথাটা!” বলেই বিমল হাসতে লাগল।
—”বিমল, মড়ার মাথাটা আবার চুরি গেল, আর তোমার মুখে তবু হাসি আসচে?”
—”হাসব না কেন, চোর যে জাল মড়ার মাথা নিয়ে পালিয়েচে।”
—”জাল মড়ার মাথা! সে আবার কি?”
—”তোমাকে তবে বলি শোনো। এ—রকম বিপদ যে পথে ঘটতে পারে, আমি তা আগেই জানতুম। তাই কলকাতা থেকে আসবার আগেই, আমাদের পাড়ার এক ডাক্তারের কাছ থেকে আর একটা নতুন মড়ার মাথা জোগাড় করেছিলুম। নতুন মাথাটার উপরেও আসল মাথায় যেমন আছে, তেমনি অঙ্ক ক্ষুদে দিয়েচি,—তবে এর মানে একেবারে উল্টো। এই নকল মাথাটাই ব্যাগের ভেতরে ছিল। আমি জানতুম মড়ার মাথা চুরি করতে আবার যদি চোর আসে, তবে নকলটাকে নিয়েই সে তুষ্ট হয়ে যাবে। হয়েচেও তাই!”
—”বিমল, ধন্যি তোমার বুদ্ধি! তুমি যে এত ভেবে কাজ কর, আমি তা জানতুম না। আসল মড়ার মাথা কোথায় রেখেচ?”
—”অনেকের বাড়ীতে যেমন চোর কুঠুরি থাকে, আমার ব্যাগের ভেতরেও তেমনি একটা লুকানো ঘর আছে। এ ব্যাগ আমি অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়েছি। মড়ার মাথা তার ভেতরেই রেখেছি।”
—”কিন্তু আমাদের পিছনে এ কোন নতুন শত্রু লাগল বল দেখি।”
—”শত্রু আর কেউ নয়—এ করালীর কাজ! সে আমার চালাকিতে ভোলেনি, নিশ্চয় এই গাড়ীতেই কোথাও ঘুপটি মেরে লুকিয়ে আছে।”
—”তবেই তো!”
—”কুমার, আবার তোমার ভয় হচ্চেচ নাকি?”
—”ভয় হচ্ছে না, কিন্তু ভাবনা হচ্চেচ বটে! এই দেখ না করালীর চর যদি আজই ঘুমন্ত অবস্থায় তোমার বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়ে যেত?”
—”করালী আমাদের সঙ্গে নেই, এই ভেবে আমরা অসাবধান হ’য়েছিলুম বলেই আজ এমন কাণ্ড ঘটল। এখন থেকে আবার সাবধান হব—রামহরি আর বাঘাকে সর্ব্বদাই কাছে রাখব, আর সকলে মিলে একসঙ্গে ঘুমবও না।”
—”করালী যখনি জানবে সে জাল মড়ার মাথা পেয়েছে, তখনি আবার আমাদের আক্রমণ করবে।”
—”আমরাও প্রস্তুত! কিন্তু সে যদি সাঙ্কেতিক লেখা এখনো পড়তে না পেরে থাকে, তবে এ জাল ধরা তার কর্ম্ম নয়।”
গাড়ী তখন ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটছে আর আমাদের চোখের সুমুখ দিয়ে চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল বন—জঙ্গল—মাঠের দৃশ্যের পর দৃশ্য ভেসে যাচ্ছে—ঠিক যেন বায়োস্কোপের ছবির পর ছবি! আমার আর ঘুমোবার ভরসা হল না—বাইরের দিকে চেয়ে ”বসে বসে আকাশ—পাতাল ভাবতে লাগলুম। প্রতি মিনিটেই গাড়ী আমাদের দেশ থেকে দূরে—আরও দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলছে, কত অজানা বিপদ আমাদের মাথার উপরে অদৃশ্যভাবে ঝুলছে! জানি না, এই পথ দিয়ে এ জীবনে আর কখনো দেশে ফিরতে পারব কি না!
এগারো – ছাতকে
আজ আমরা শ্রীহট্টে এসে পৌঁচেছি।
বিমল বললে, ”কুমার, এই সেই শ্রীহট্ট।”
আমি বললাম, ”হ্যাঁ, এই হচ্চেচ সেই কমলা—লেবুর বিখ্যাত জন্মভূমি!”
বিমল বললে, ”উঁহু, কমলা—লেবু ঠিক শ্রীহট্ট সহরে তো জন্মায় না, তবে এখানকার প্রধান নদী সুরমা দিয়েই নৌকায় চড়ে কমলা—লেবু কলকাতায় যাত্রা করে বটে! খালি কমলা—লেবু নয়, এখানকার কমলা—মধুও যেমন উপকারী, তেমনি উপাদেয়।”
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ”এ অঞ্চলে আরো কি পাওয়া যায়?”
—”পাওয়া যায় অনেক জিনিস, যেমন আলু, কুমড়ো, শশা, আনারস, তুলো, আখ, তেজপাতা, লঙ্কা, মরিচ, ডালচিনি ও চুণ প্রভৃতি। এ—সব মাল এ অঞ্চল থেকেই রপ্তানি হয়। কিন্তু এখানকার পান—সুপারির কথা শুনলে তুমি অবাক হবে!”
—”অবাক হব? কেন?”
—”বাংলাদেশের মত এখানে পানের চাষ হয় না, কিন্তু এদেশে পানের সঙ্গে সুপারির বড় ভাব। বনের ভেতরে প্রায়ই দেখবে, সুপারি—কুঞ্জেই পান জন্মেছে, সুপারি—গাছের দেহ জড়িয়ে পানের লতা উপরে উঠেচে! তাছাড়া, এখানকার ‘সফ লাং’ আর একটি বিখ্যাত জিনিস।”
—”সফ লাং! সে আবার কি?”
—”কেশুরের মত এক রকম মূল! খাসিয়ারা খেতে বড় ভালোবাসে।”
সারাদিন আমরা শ্রীহট্টেই রইলুম। এখান থেকে আমাদের গন্তব্য স্থান খাসিয়া পাহাড়কে দেখতে পেলুম। মনে হোলো এর বিশাল বুকের ভিতরে না জানি কত রহস্যই লুকান আছে, সে রহস্যের মধ্যে ডুব দিলে আর থই পাব কিনা, তাই বা কে বলতে পারে? এ তো আর কলকাতার রাস্তার কোন নম্বর জানা বাড়ীর খোঁজে যাচ্ছি না, এই অশেষ পাহাড়—বন—জঙ্গলের মধ্যে কোথায় আছে যকের ধন, কি করে আমরা তা টের পাব? এখন পর্য্যন্ত করালী বা তার কোন চরের টিকিটি পর্য্যন্ত দেখতে না পেয়ে আমরা তবু অনেকটা আশ্বস্ত হলুম। বুঝলুম, জাল মড়ার মাথা পেয়ে করালী এতটা খুসি হয়েছে যে, আমাদের উপরে আর পাহারা দেওয়া দরকার মনে করছে না! বাঁচা গেছে। এখন করালীর এই ভ্রমটা কিছুদিন স্থায়ী হলেই মঙ্গল। কারণ তার মধ্যেই আমরা কেল্লা ফতে করে দেশে ফিরে যেতে পারব।
মাঝ রাত্রে ষ্টিমারে চড়ে, সুরমা নদী দিয়ে পরদিন সকালে ছাতকে গিয়ে পৌঁছুলম।
সুরমা হচ্ছে শ্রীহট্টের প্রধান নদী। ছাতকও এই নদীর তীরে অবস্থিত। কলকাতায় ছাতকের চুণের নাম আমরা আগেই শুনেছিলুম। তবে এ চুণের উৎপত্তি ছাতকে নয়, চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে খাসিয়া পাহাড়ে এই চুণ জন্মে, সেখান থেকে রেলে করে ও নৌকা বোঝাই হয়ে ছাতকে আসে এবং ছাতক থেকে আরো নানা জায়গা রপ্তানি হয়। চেরাপুঞ্জিতে খালি চুণ নয়, আগে সেখানে লোহার খনি থেকে অনেক লোহা পাওয়া যেত, সেই সব লোহায় প্রায় আড়াই শ বছর আগে বড় বড় কামান তৈরি হত। কিন্তু বিলাতী লোহার উপদ্রবে খাসিয়া পাহাড়ের লোহার কথা এখন আর কেউ ভুলেও ভাবে না। চুণ ও লোহা ছাড়া কয়লার জন্যেও খাসিয়া পাহাড় নামজাদা। কিন্তু পাঠাবার ভালো বন্দোবস্ত না থাকার দরুণ, এখানকার কয়লা দেশ—দেশান্তরে যায় না।
ছাতক জায়গাটি মন্দ নয়, এখানে থানা, ডাক্তার, পোষ্ট—আপিস, বাজার ও মাইনর ইস্কুল কিছুরই অভাব নেই। একটি ডাক—বাংলোও আছে, আমরা সেইখানে গিয়েই আশ্রয় নিলুম। বিমলের মুখে শুনলুম, এখানে পিয়াইন নামে একটি নদী আছে, সেই নদী দিয়েই আমাদের নৌকায় চড়ে ভোলাগঞ্জ পর্য্যন্ত যেতে হবে—এ সময়ে নদীর জল কম বলে নৌকা তার বেশী আর চলবে না। কাজেই ভোলাগঞ্জ থেকে মাইল—দেড়েক হেঁটে আমরা থারিয়াঘাটে যাব, তারপর পাথর—বাঁধানো রাস্তা ধরে খাসিয়া পাহাড়ে উঠব। আজ ডাক—বাংলোয় বিশ্রাম করে কাল থেকে আমাদের যাত্রা আরম্ভ।
ছাতক থেকে খাসিয়া পাহাড়ের দৃশ্য কি চমৎকার! নীলরঙের প্রকাণ্ড মেঘের মত, দৃষ্টি—সীমা জুড়ে আকাশের খানিকটা ঢেকে খাসিয়া পাহাড় ছড়িয়ে আছে, যতদূর নজর চলে—পাহাড়ের যেন আর শেষ নেই! পাহাড়ের কথা আমি কেতাবে পড়েছিলুম, কিন্তু চোখে কখনো দেখিনি, পাহাড় যে এত সুন্দর তা আমি জানতুম না; আমার মনে হতে লাগল, খাসিয়া পাহাড় যেন ইশারা করে কাছে ডাকছে—ইচ্ছা হয় তখনি এক ছুটে তার কোলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি!
সন্ধ্যার সময় খানিক গল্পগুজব করে আমরা শুয়ে পড়লুম। বেশ—একটু শীতের আমেজ দিয়েছিল, লেপের ভিতরে ঢুকে কি আরামই পেলুম!
বিমলও তার লেপের ভিতরে ঢুকে বললে, ”ঘুমিয়ে নাও ভাই, নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে নাও, কাল এমন সময়ে আমরা খাসিয়া পাহাড়ে, এত আরামের ঘুম আর হয়তো হবে না।”
আমি বললুম, ”কিন্তু আমরা তো ঘুমবো, পাহারা দেবে কে?”
বিমল বললে, ”সে ব্যবস্থা আমি করেচি। দরজার বাইরে বারান্দায় রামহরি আর বাঘা শুয়ে আছে। তার ওপরে দরজা—জানলাগুলোও ভেতর থেকে আমি বন্ধ করে দিয়েছি।”
আমাদের উদ্বেগ দূর হল। যদিও শত্রুর দেখা নেই, তবু সাবধানে থাকাই ভালো।
বারো – বিনি—মেঘে বাজ
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম তা জানি না, হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল! উঠতে গিয়ে উঠতে পারলুম না, আমার বুকের উপর কে যেন চেপে বসে আছে। ভয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, ”বিমল, বিমল।”
অন্ধকারের ভিতর কে আমার গলা চেপে ধরে হুমকি দিয়ে বললে, ”খবর্দ্দার, চাঁচ্যালেই টিপে মেরে ফেলব!”
আমি একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেলুম, অনেক কষ্টে বললুম, ”গলা ছাড়ো, আমার দম বন্ধ হয়ে আসচে!”
আমার গলা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে সে বললে, ”আচ্ছা, ফের চ্যাঁচালেই কিন্তু মরবে!”
সেই ভীষণ ঘুট—ঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, আমার বুকের উপরে কে এ, ভূত না মানুষ? ঘরের অন্য কোণেও একটা ঝটাপট শব্দ শুনলাম, তার পরেই একটা গ্যাঁঙানি আওয়াজ—কে যেন কি দিয়ে কাকে মারলে—তারপর আবার সব চুপচাপ।
অন্ধকারেই হেঁড়ে গলায় কে বললে, ”শম্ভু ব্যাপার কি।”
আর একজন বললে, ”বাবু, এ ছোঁড়ার গায়ে দস্যির জোর, আর একটু হলেই আমাকে বুক থেকে ফেলে দিয়েছিল। আমি লাঠি দিয়ে একে ঠাণ্ডা করেছি।”
—”একেবারে শেষ হয়ে গেল নাকি?”
—”না, অজ্ঞান হয়ে গেছে বোধ হয়।”
—”আচ্ছা, তা হলে আমি আলো জ্বালি।” বলেই সে ফস করে একটা দেশলাই জ্বেলে বাতি ধরালে। দেখলুম এ সেই লোকটা ইষ্টিমারে আর ইষ্টিশানে যে গোয়েন্দার মত পিছু নিয়ে আমার পানে তাকিয়েছিল।
আমাকে তার পানে চেয়ে থাকতে দেখে সে হেসে বললে, ”কিহে স্যাঁঙাত, ফ্যাল—ফ্যাল করে তাকিয়ে আছ যে! আমাকে চিনতে পেরেচ নাকি?”
আমি কোন জবাব দিলুম না। আমার বুকের উপরে তখনো একটা লোক চেপে বসেছিল। ঘরের আর এক কোণে বিমলের দেহ স্থির হয়ে পড়ে আছে, সে দেহে প্রাণের কোন লক্ষণ নেই! দরজা—জানলার দিকে তাকিয়ে দেখলুম—সব বন্ধ। তবে এরা ঘরের ভিতর এল কেমন করে?
বাতি—হাতে লোকটা আমার কাছে এগিয়ে এসে বললে, ”ছোকরা, ভারী চালাক হয়েছ—না? যকের ধন আনতে যাবে? এখন কি হয় বল দেখি?”
আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, ”কে তোমরা?”
—”অত পরিচয়ে তোমার দরকার কিহে বাপু?”
—”তোমরা কি চাও?”
—”পকেট—বই চাই—পকেট—বই। তোমার ঠাকুর—দাদার পকেট—বইখানা আমাদের দরকার। মড়ার মাথা আমরা পেয়েচি, এখন পকেট—বইখানা কোথায় রেখেচ বল।”
এত বিপদেও মনে মনে আমি না হেসে থাকতে পারলুম না। এরা ভেবেছে সেই জাল মড়ার মাথা দিয়ে যকের ধন আনতে যাবে! পকেট—বইয়ের কথা এরা জানে! নিশ্চয় এরা করালীর লোক।
লোকটা হঠাৎ আমাকে ধমক দিয়ে বললে, ”এই ছোকরা, চুপ কর আছ যে? শীগগির বল পকেট—বই কোথায়—নইলে, আমার হাতে কি, দেখচ?” সে কোমর থেকে ফস করে একখানা ছোরা বার করলে, বাতির আলোয় ছোরাখানা বিদ্যুতের মত জ্বল জ্বল ক’রে উঠল।
আমি তাড়াতাড়ি বললুম, ”ঐ ব্যাগের ভেতর পকেট—বই আছে।”
লোকটা বলল, ”হু, পথে এস বাবা, পথে এস। শম্ভু, ব্যাগটা খুলে দ্যাখ—তো!”
শম্ভু, বিমলের দেহের পাশে বসে ছিল, লোকটার কথায় তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ঘরের অন্য কোণে গিয়ে আমাদের বড় ব্যাগটা নেড়ে—চেড়ে বললে, ”ব্যাগের চাবি বন্ধ।”
বাতি—হাতে লোকটা জিজ্ঞাসা করলে, ”ব্যাগের চাবি কোথায়?”
আমি, কিছু বলবার আগেই বিমল হঠাৎ এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, ”এই যে, চাবি আমার কাছে”—বলেই সে হাত তুললে—তার হাতে বন্দুক!
লোকগুলো যেন হতভম্ব হয়ে গেল! আমিও অবাক!
বিমল বন্দুকটি বাগিয়ে ধরে বললে, ”যে আর এক—পা নড়বে তাকেই আমি গুলি করে কুকুরের মত মেরে ফেলব।”
যার হাতে বাতি ছিল, হঠাৎ বাতিটা মাটির উপর ফেল দিলে—সমস্ত ঘর আবার অন্ধকার। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের ঝলক তুলে দুম করে বিমলের বন্দুকের আওয়াজ হল, একজন লোক ”বাবারে গেছিরে” বলে চীৎকার করে উঠল, আমার বুকের উপর যে চেপে বসেছিল, সেও আমাকে ছেড়ে দিলে,—তারপরেই ঘরের দরজা খোলার শব্দ, বাঘার ঘেউ ঘেউ, রামহরির গলা। কি যে হল কিছুই বুঝতে পারলুম না, বিছানার উপরে উঠে আচ্ছন্নের মতন আমি বসে পড়লুম।
বিমল বললে, ”কুমার, আলো জ্বালো—শীগগিরি!”
আমি আমতা আমতা করে বললুম, ”কিন্তু—কিন্তু—”
—”ভয় নেই, আলো জ্বালো, তারা পালিয়েচে!”
কিন্তু আমাকে আর আলো জ্বালাতে হল না—রামহরি একটা লণ্ঠন হাতে করে তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতরে এসে ঢুকল!
ঘরের ভিতরে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই!
বিমল মেঝের দিকে হেঁট হয়ে পড়ে বললে, ”এই যে রক্তের দাগ। গুলি খেয়েও লোকটা পালাল। বোধ হয় ঠিক জায়গায় লাগেনি—হাত—টাত জখম হয়েছে।”
রামহরি উদ্বিগ্ন মুখে বলল, ”ব্যাপার কি বাবু?”
বিমল সে কথায় কান না দিয়ে বললে, ”কিন্তু জানলা—দরজা সব বন্ধ—অথচ ঘরের ভেতর শত্রু। ভারি আশ্চর্য্য তো!” তারপরে একটু থেমে, আবার বললে, ”ও বুঝেচি। নিশ্চয় আমরা যখন ও ঘরে খেতে গিয়েছিলুম, রাস্কেলরা তখনি ফাঁক পেয়ে এ—ঘরে ঢুকে খাটের তলায় চুপটি মেরে লুকিয়েছিল!”
কথাটা আমারও মনে লাগল। আমি বললুম, ”ঠিক বলেচ। কিন্তু বিমল, তুমি তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে, হঠাৎ কি করে দাঁড়িয়ে উঠলে?”
বিমল বললে, ”আমি মোটেই অজ্ঞান হইনি, অজ্ঞান হওয়ার ভান করে চুপচাপ পড়েছিলুম। ভাগ্যে বন্দুকটা আমার বিছানাতেই ছিল!”
এমন সময়ে বাঘা ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ঘরের ভিতর এসে, আদর করে আমার পা চেটে দিতে লাগল। আমি দেখলুম বাঘার মুখে যেন কিসের দাগ। এ যে রক্তের মত! তবে কি বাঘা জখম হয়েছে? তাড়াতাড়ি তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখে বুঝলাম, না অন্য কারুর রক্ত! বাঘা নিশ্চয় সেই লোকগুলোর কারুকে না কারুকে তার দাঁতের জোর বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে!
তারিফ করে তার মাথা চাপড়ে আমি বললুম, ”সাবাস বাঘা, সাবাস!” বাঘা আদরে যেন গলে গিয়ে, আমার পায়ের তলায় পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল!
বিমল বললে, ”এবার থেকে বাঘাকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুমবো! বাঘা আমাদের কাছে ঘরের ভিতর থাকলে এ বিপদ হয়ত ঘটত না।”
আমি বললুম, ”তা তো ঘটত না, কিন্তু এখন ভবিষ্যতের উপায় কি? করালী নিশ্চয়ই আমাদের ছাড়ান দেবে না, এবারে তার চরেরা হয়তো দলে আরও ভারি হয়ে আসবে।”
বিমল সহজ ভাবেই বললে, ”তা আসবে বৈকি!”
আমি বললুম, ”আর এটাও মনে রেখো, কাল থেকে আমরা লোকালয় ছেড়ে পাহাড়ের ভেতর গিয়ে পড়ব! সেখানে আমাদের রক্ষা করবে কে!”
বিমল বন্দুকটা ঠক করে মেঝের উপরে ঠুকে, একখানা হাত তুলে তেজের সঙ্গে বললে, ”আমাদের এই হাতই আমাদের রক্ষা করবে! যে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, তাকে বাঁচাবার সাধ্য কারুর নেই!”
—”কিন্তু।”
—”আজ থেকে ‘কিন্তু’র কথা ভুলে যাও কুমার, ও হচ্ছে ভীরু, কাপুরুষের কথা!” বলেই বিমল এগিয়ে ঘরের একটা জানলা খুলে দিয়ে আবার বললে, ”চেয়ে দেখ কুমার!”
জানলার বাইরে আমার চোখ গেল। নিঝুম রাতের চাঁদের আলো মেখে স্বর্গের মায়ার মত খাসিয়া পাহাড়ের স্থির ছবি আঁকা রয়েছে! চমৎকার, চমৎকার! শিখরের পর শিখরের উপর দিয়ে জ্যোৎস্নার ঝরনা রূপোলী লহর তুলে বয়ে যাচ্ছে—কোথাও আলো, কোথাও ছায়া—ঠিক যেন পাশাপাশি হাসি আর অশ্রু! বিভোর হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলুম—এমন দৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি!
বিমল বললে, ”কি দেখচ?”
আমি বললুম, ”স্বপ্ন।”
বিমল বললে, ”না, স্বপ্ন নয়—এ সত্য! তুমি কি বলতে চাও এই স্বর্গের দরজায় এসে আবার আমরা ফিরে যাব?”
আমি মাথা নেড়ে বললুম, ”না বিমল, না,—ফিরব না, আমরা ফিরব না! আমার সমস্ত প্রাণ—মন ঐখানে গিয়ে লুটিয়ে পড়তে চাইচে! যকের ধন পাই আর না—পাই— আমি শুধু একবার ঐখানে যেতে চাই।”
বিমল জানলাটা আবার বন্ধ করে দিয়ে বললে, ”কাল আমরা ওখানে যাব! আজ আর কোন কথা নয়, এস এবার নাক ডাকানো যাক!”—বলেই সে বন্দুকটা পাশে নিয়ে বিছানার উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল! খানিক পরেই তার নাকের গর্জ্জন সুরু হল। তার নিশ্চিত ঘুম দেখে কে বলবে যে, একটু আগেই সে সাক্ষাৎ যমের মুখে গিয়ে পড়েছিল! বিমলের আশ্চর্য্য সাহস দেখে আমিও সমস্ত বিপদের কথা মন থেকে তাড়িয়ে দিলুম। তারপর খাসিয়া পাহাড় আর যকের ধনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লুম, তা আমি জানি না।
তেরো – খাসিয়া পাহাড়ে
আমরা চেরাপুঞ্জি পার হয়ে অনেকদূর এগিয়ে এসেছি। চেরাপুঞ্জি থেকে শিলং সহর প্রায় ষোল ক্রোশ তফাতে! এই পথটা মোটর—গাড়ী করে যাওয়া যায়। আমরা কিন্তু ও—মুখো আর হলুম না। কারণ জানা—পথ ধরলে শত্রুপক্ষের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা বেশী।
পাহাড়ের পর পাহাড়—ছোট, বড়, মাঝারি। যেদিকে চাই কেবলি পাহাড়—কোন কোন পাহাড়ের শৃঙ্গের আকার বড় অদ্ভুত, দেখতে যেন হাতীর শুঁড়ের মত, উপরে উঠে তারা যেন নীলাকাশকে জড়িয়ে ধরে পায়ের তলায় ফেলতে চাইচে! পাহাড়গুলিকে দূর থেকে ভারি কঠোর দেখাচ্ছিল, কিন্তু কাছে এসে দেখছি সবুজ ঘাসের নরম মখমলে এদের গা কে যেন মুড়ে দিয়েছে। কত লতাকুঞ্জে কত যে ফুল ফুটে রয়েছে—হাজার হাজার চুনী—পান্না—হীরা—জহরতের মত তাদের ‘আহা—মরি’ রঙের বাহার—এ যে ফুলপরীদের নির্জ্জন খেলাঘর! কোথাও ছোট ছোট ঝরনা ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে, তারপর পাথরের পর পাথরের উপরে লাফিয়ে পড়ে ঘুমপাড়ানি গান গাইতে গাইতে চোখের আড়ালে তলিয়ে গিয়েছে! কোথাও পথের দু’পাশে গভীর খাদ, তার মধ্যে শত শত ডালচিনির গাছ আর লতা—পাতার জঙ্গল শীতের ঠাণ্ডা বাতাসে থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে,—সে—সব খাদের পাশ দিয়ে চলতে গেলে প্রতি পদেই ভয় হয়—এই বুঝি টলে পা ফসকে অতল পাতালের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যাই! সবচেয়ে বিশেষ করে চোখে পড়ে সরল গাছের সার। এত সরল গাছ আমি আর কখনো দেখিনি—সমস্ত পাহাড়ই যেন তারা একেবারে দখল করে নিতে চায়! সে সব গাছে বেশী ডালপালা—পাতার জাল নেই; মাটি থেকে তারা ঠিক সোজা হয়ে উপরে উঠে যেন সদর্পে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
নির্জ্জন পাহাড়, মাঝে মাঝে কখনো কেবল দু—একজন কাঠুরের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কাঠুরেরা জাতে খাসিয়া, তাদের চেহারার সঙ্গে গুর্খাদের চেহারার অনেকটা মিল আছে—নাক থ্যাবড়া, গালের হাড় উঁচু, চোখ বাঁকা বাঁকা, মাথা ছোট ছোট।
এখানে এসে এক বিষয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হয়েছি। এতদিনেও করালীর দলের আর কোন সাড়া—শব্দ পাইনি। আমরা যে পথ ছেড়ে এমন অপথ ধরব, নিশ্চয় তারা কল্পনা করতে পারেনি। হয়তো তারা এখন আমাদের ধরবার জন্যে শিলং সহরে গিয়ে খুঁজে মরছে। কেমন জব্দ!
বিমল আজ দুটো বুনো মোরগ শিকার করেছে। সেই মোরগের মাংস কত মিষ্টি লাগবে তাই ভাবতে ভাবতে খুসি হয়ে পথ চলছি!
পশ্চিম আকাশে সিঁদুর ছড়িয়ে সূর্য্য অস্ত গেল। আমি বললুম, ”বিমল, সারাদিন পথ চলে পা টাটিয়ে উঠেছে, ক্ষিদেও পেয়েছে খুব। আজকের মত বিশ্রাম করা যাক।”
বিমল বললে, ”কেন কুমার, চারিদিকের দৃশ্য কি তোমার ভালো লাগছে না?”
—”ভালো লাগচে না আবার, এতো ভালো লাগচে যে দেখে দেখে আর সাধ মিটচে না! কিন্তু এই ক্ষিদের মুখে রামপাখীর গরম মাংস এর চেয়ে ঢের ভালো লাগবে বলে মনে হচ্ছে!”
এই বলাবলি করতে করতে আমরা একটা ছোট ঝরনার কাছে এসে পড়লুম। ঝরনার ঠিক পাশেই পাহাড়ের বুকে একটা গুহার মত বড় গর্ত্ত।
বিমল বললে, ”বাঃ, বেশ আশ্রয় মিলেচে। এই গুহার ভিতরেই আজকের রাতটা দিব্যি আরামে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। রামহরি, মোটঘাট এইখানেই রাখো।”
আমাদের প্রত্যেকের পিঠেই কম—বেশী মোট ছিল, সবাই সেগুলো একে একে গুহার ভিতরে নামিয়ে রাখলুম।—গুহাটি বেশ বড়—সড়, আমাদের আরো চার—পাঁচজন লোক এলেও তার মধ্যে থাকবার অসুবিধা হত না।
গুহার ভিতরটা ঝেড়ে—ঝুড়ে পরিষ্কার করে রামহরি বললে, ”খোকাবাবু, এইবার রান্নার উদ্যোগ করি?”
বিমল বললে, ”হ্যাঁ—দাঁড়াও, আমি তোমাদের একটা মজা দ্যাখাচ্ছি, এখানে আগুনের জন্য কিছু ভাবতে হবে না!” এই বলে একটা কুড়ুল নিয়ে বেরিয়ে গেল!
আমি আর রামহরি ছুরি নিয়ে তখনি মোরগ—দুটোকে রান্নার উপযোগী করে ছুলতে বসে গেলুম। বাঘাও সামনে দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে লোলুপ চোখে, ঘাড় বেঁকিয়ে একমনে আমাদের কাজ দেখতে লাগল, তার হাব—ভাবে বেশ বোঝা গেল, রামপাখীর মাংসের প্রতি তারও লোভ আমাদের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়!
খানিক পরেই বিমল একরাশ কাঠ ঘাড়ে করে ফিরে এল! আমি বললুম, ”এলে তো খালি কতকগুলো কাঠ নিয়ে। এর মধ্যে মজাটা কি আছে?”
—”এই দ্যাখ না” বলেই বিমল কিছু শুকনো পাতা জড়ো করে দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন জ্বাললে, তারপর একখানা কাঠ নিয়ে তার উপরে ধরতেই ধপ করে জ্বলে উঠল! বিমল কাঠখানা উঁচু করে মাথার উপরে ধরলে, আর সেটা ঠিক মশালের মতই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল!
আমি আশ্চর্য্য হয়ে বললুম, ”বাঃ, বেশ মজার ব্যাপার তো! অত সহজে জ্বলে, ওটা কি কাঠ?”
বিমল বললে, ”সরল কাঠ। এ কাঠে একরকম তেলের মত রস আছে, তাই এমন সুন্দর জ্বলে। এর আর এক নাম—ধূপকাষ্ঠ!”
রামহরি সেদিন সরল কাঠেই উনুন ধরিয়ে রামপাখীর মাংস চড়িয়ে দিলে। আমরা দুজনে গুহার ধারে বসে গল্প করতে লাগলুম।
তখন সন্ধ্যা উৎরে গেছে, একটা পাহাড়ের আড়াল থেকে চাঁদ—মামার আধখানা হাসিমুখ উঁকি মারছে—সেই আবছায়া—মাখা জ্যোৎস্নার আলোতে সামনের পাহাড়, বন আর ঝরনাকে কেমন যেন অদ্ভুত দেখাতে লাগল।
বিমল হঠাৎ বললে, ”কুমার, তুমি ভূত বিশ্বাস কর?”
আমি বললুম, ”কেন বল দেখি?”
বিমল বললে, ”আমরা যাদের দেশে আছি, এই খাসিয়ারা অনেকেই ভূতকে দেবতার মত পুজো করে। ভূতকে খুশি রাখবার জন্যে খাসিয়ারা মোরগ আর মুর্গীর ডিম বলি দেয়। যে মুল্লুকে ভূতের এত ভক্ত থাকে, সেখানে ভূতের সংখ্যাও নিশ্চয়ই খুব বেশী, কি বল?”
আমি বললুম, ”না, আমি ভূত মানি না।”
বিমল বললে, ”কেন?”
—”কারণ আমি কখনো ভূত দেখিনি। তুমি দেখেচ?”
—”না, তবে আমি একটি ভূতের গল্প জানি।”
—”সত্যি গল্প?”
—”সত্যি—মিথ্যা জানি না, তবে যার মুখে গল্পটি শুনেছি, সে বলে এর আগাগোড়া সত্যি।”
—”কে সে?”
—”আমদের বাড়ীর পাশে একজন লোক বাড়ী ভাড়া নিয়ে থাকত, এখন সে উঠে গেছে। তার নাম ঈশান।”
—”বেশ তো, এখনো রান্নার শেষ হতে দেরি আছে, ততক্ষণে তুমি গল্পটা শেষ করে ফেল—বিশ্বাস না হোক, সময়টা কেটে যাবে।”
একটা বেজায় ঠাণ্ডা বাতাসের দমকা এল। দুজনেই ভালো করে র্যাপার মুড়ি দিয়ে বসলুম। বিমল এমন ভাবে গল্প সুরু করলে, ঈশানই যেন তা নিজের মুখে বলছে :—
চৌদ্দ – মানুষ না পিশাচ
[ ঈশানের গল্প ]
আমাদের বাড়ী যে গ্রামে, তার ক্রোশ—দুয়েক তফাতেই গঙ্গা। কাজেই গাঁয়ে কোন লোক মারা গেলে, গঙ্গার ধারে নিয়ে গিয়েই মড়া পোড়ান হত।
সেবারে ভোলার ঠাকুরমা যখন মারা পড়ল—তখন আমরা পাড়ার জনপাঁচেক লোক মিলে মড়া নিয়ে শ্মশানে চললুম। শ্মশানে পৌঁছাতে রাত বারোটা বেজে গেল।
পাড়াগাঁয়ের শ্মশান যে কেমন ঠাঁই, সহরের বাসিন্দারা তা বুঝতে পারবেন না। এখানে গ্যাসের আলোও নেই, লোক—জন গোলমালও নেই। অনেক গাঁয়েই শ্মশানে কোন ঘরও থাকে না। খোলা, নির্জ্জন জায়গা, চারিদিকে বন—জঙ্গল, প্রতি পদেই হয়তো মড়ার মাথা আর হাড় মাড়িয়ে চলতে হয়। রাতে সেখানে গেলে খুব সাহসীরও বুক রীতিমত দমে যায়।
আমাদের গাঁয়ের শ্মশান—ঘাটে একখানা হেলেপড়া দরজাভাঙা কোঠাঘর ছিল। তার মধ্যেই গিয়ে আমরা মড়া নামিয়ে রাখলুম।
পাড়াগাঁয়ের শ্মশানে চিতার জ্বালানি—কাঠ তো কিনতে পাওয়া যায় না, কাজেই আশেপাশের বন—জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনতে হবে।
ভোলা বললে, ”আমি মড়া আগলে থাকি, তোমরা সকলে কাঠ আনো গে যাও!”
আমি বললুম, ”একলা থাকতে পারবে তো?”
ভোলা যেমন ডানপিটে, তার গায়ে জোরও ছিল তেমনি বেশী। সে অবহেলার হাসি হেসে বললে, ”ভয় আবার কি? যাও, যাও—দেরি করো না!”
আমরা পাঁচজনে জঙ্গলে ঢুকে কাঠ কাটতে লাগলুম। একটা চিতে জ্বালাবার মত কাঠ সে তো বড় অল্প কথা নয়! কাঠ কাটতেই কেটে গেল প্রায় আড়াই ঘণ্টা; বুঝলাম আজ ঘুমের দফার ইতি,—মড়া পোড়াতেই সকাল হয়ে যাবে।
সকলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে, শ্মশানের দিকে যাচ্ছি, এমন সময়ে আমাদের একজন বলে উঠল, ”ওহে দ্যাখ দ্যাখ, শ্মশানের ঘরের মধ্যে কি—রকম আগুন জ্বলছে!”
তাইতো, ঘরের ভিতর সত্যিই দাউ—দাউ করে আগুন জ্বলচে যে! অত্যন্ত আশ্চর্য্য হয়ে আমরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললুম। ঘরের কাছ বরাবর আসতেই লণ্ঠনের আলোতে দেখলুম, মাটির উপরে কে—একজন উপুড় হয়ে পড়ে আছে। লোকটাকে উল্টে ধরে লণ্ঠনটা তার মুখের কাছে নামিয়ে দেখলুম, সে আর কেউ নয়—আমাদের ভোলা! তার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠেচে, সে একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেছে!
ভোলা এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, আর ওখানে ঘরের ভিতর আগুন জ্বলছে—এ কেমন ব্যাপার! সকলে হতভম্ব হয়ে ঘরের দিকটায় ছুটে গেলুম। কাছে গিয়ে দেখি, ঘরের দরজার কাছটায় কে তাল তাল মাটি এনে ঢিপির মত উঁচু করে তুলেছে, আরো খানিকটা উঁচু হলেই দরজার পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে যেত! এ সব কি কাণ্ড কিছুই বুঝতে না পেরে আমরা ঘরের ভিতর উঁকি মেরে দেখলুম, এককোণে একরাশ কাঠ দাউ—দাউ করে জ্বলছে, একটা কাঁচা মাংস—পোড়ার বিশ্রী গন্ধ উঠেছে আর কোথাও মড়ার কোন চিহ্নই নেই।
ভয়, বিস্ময় আর দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আমরা আবার ভোলার কাছে ফিরে এলুম। তার মুখে ও মাথায় অনেকক্ষণ ধরে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দেবার পর আস্তে আস্তে সে চোখ চাইলে! তারপর উঠে বসে যা বললে, তা এই ঃ—
”তোমরা তো কাঠ কাটতে চলে গেলে, আমি মড়া আগলে বসে রইলুম। খানিকক্ষণ এমনি চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে আমার কেমন তন্দ্রা এল। চোখ বুঁজে ঢুলচি, হঠাৎ থপ করে কি একটা শব্দ হল। চমকে জেগে উঠে চারিদিকে চেয়ে দেখলুম, কিন্তু কেউ কোথাও নেই। আমারই মনের ভ্রম ভেবে খাটের পায়াতে মাথা রেখে আবার আমি ঘুমোবার চেষ্টা করলুম।
খানিকক্ষণ পরে আবার সেই থপ করে শব্দ! এবারে আমার সন্দেহ হল হয়তো মড়ার লোভে বাইরে শেয়াল—টেয়াল কিছু এসেছে! এই ভেবে অর চোখ খুললুম না—এমনি ভাবে আরো খানিকটা সময় কেটে গেল। ওদিকে সেই ব্যাপারটা সমানেই চলেছে—মাঝে মাঝে সব স্তব্ধ, আর মাঝে থপ করে শব্দ! শেষটা জ্বালাতন হয়ে আমি আবার চোখ চাইতে বাধ্য হলুম। কিন্তু একি! ঘরের দরজার সামনেটা যে মাটিতে প্রায় ভরতি হয়ে উঠেছে,—আর একটু পরেই আমার বাইরে যাবার পথও যে একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে! কে এ কাজ করলে, এ তো যে সে কথা নয়! আমার ঘুমের ঘোর চট করে কেটে গেল, সেই কাঁচা—মাটির পাঁচিল টপকে তখনই আমি বাইরে বেরিয়ে পড়লুম।
চাঁদের আলোয় চারিদিকে ধবধব করছে। ঘর আর গঙ্গার মাঝখানে চড়া। এদিকে—ওদিকে চাইতেই দেখলুম, খানিক তফাতে একটা ঝাঁকড়া—চুলো লোক হেঁট হয়ে একমনে দুই হাতে ভিজে মাটি খুঁড়ছে! বুঝলাম তারই এই কাজ। কিন্তু এতে তার লাভ কি? লোকটা পাগল নয় তো?
ভাবছি এদিকে সে আবার একতাল মাটি নিয়ে ঘরের দিকে অগ্রসর হল। মস্ত লম্বা চেহারা, মস্ত লম্বা চুল আর দাড়ি, একরকম উলঙ্গ বললেই হয়—পরণে খালি এক টুকরো কপনি! সে মাথা নীচু করে আসছিল, তাই আমাকে দেখতে পেলে না। কিন্তু সে কাছে আসবামাত্র আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম।
সে তখন মুখ তুলে আমার দিকে চাইলে—উঃ, কি ভয়ানক তার চোখ, ঠিক যেন দুখানা বড় বড় কয়লা দপদপ করে জ্বলছে। এমন জ্বলন্ত চোখ আমি জীবনে কখনো দেখিনি।
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ”কে তুমি?”
উত্তরে মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে নেড়ে সে এমন এক ভুতুড়ে চীৎকার করে উঠল যে আমার বুকের রক্ত যেন বরফ হয়ে গেল। মহা আতঙ্কে প্রাণপণে আমি দৌড় দিলুম, কিন্তু বেশীদূর যেতে না যেতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলুম। তারপর আর কিছু আমার মনে নাই।”
ভোলার কথা শুনে বুঝলাম, সে লোকটা পিশাচ ছাড়া কিছু নয়! দুষ্ট প্রেতাত্মারা সুবিধা পেলেই মানুষের মৃতদেহের ভিতরে ঢুকে তাকে জ্যান্ত করে তোলে। মরা মানুষ এই ভাবে জ্যান্ত হলেই তাকে পিশাচ বলে। এই রকম কোন পিশাচই ভোলার ঠাকুরমার দেহকে আগুন জ্বেলে আধপোড়া করে খেয়ে গেছে। ভোলাকেও নিশ্চয় সে ফলার করবার ফিকিরে ছিল, কেবল আমরা ঠিক সময়ে এসে পড়াতেই এ যাত্রা ভোলা কোন গতিকে বেঁচে গেল।
সেবারে আমাদের আর মড়া পোড়াতে হল না!