যকের ধন – ১

এক – মড়ার মাথা

ঠাকুরদাদা মারা গেলে পর, তাঁর লোহার সিন্দুকে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে একটি ছোট বাক্স পাওয়া গেল। সে বাক্সের ভিতরে নিশ্চয়ই কোন দামী জিনিস আছে মনে করে মা সেটি খুলে ফেললেন। কিন্তু তার মধ্যে পাওয়া গেল শুধু একখানা পুরানো পকেট—বুক, আর একখানা ময়লা—কাগজে—মোড়া কি একটা জিনিস। মা কাগজটা খুলেই জিনিসটা ফেলে দিয়ে হাঁউ মাউ করে চেঁচিয়ে উঠলেন।

আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, ”কি, কি হোলো মা?”

মা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাটির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ”কুমার, শীগগীর ওটা ফেলে দে!”

আমি হেঁট হয়ে চেয়ে দেখলুম, একটা মড়ার মাথার খুলি মাটির উপরে পড়ে রয়েছে! আশ্চর্য হয়ে বললুম, ”লোহার সিন্দুকে মড়ার মাথা! ঠাকুরদা কি বুড়ো বয়সে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন?”

মা বললেন, ”ওটা ফেলে দিয়ে গঙ্গাজল স্পর্শ করবি চল।”

মড়ার মাথার খুলিটা জানলা গলিয়ে আমি বাড়ীর পাশের একটা খানায় ফেলে দিলুম। পকেট—বুকখানা ঘরের একটা তাকের উপর তুলে রাখলুম। মা বাক্সটা আবার সিন্দুকে রাখলেন।…

দিন—কয়েক পরে পাড়ার করালী মুখুয্যে হঠাৎ আমাদের বাড়ীতে এসে হাজির। করালী মুখুয্যেকে আমাদের বাড়ীতে দেখে আমি ভারি অবাক হয়ে গেলুম। কারণ আমি জানতুম যে ঠাকুরদাদার সঙ্গে তাঁর একটুও বনিবনাও ছিল না, তিনি বেঁচে থাকতে করালীকে কখনো আমাদের বাড়ীতে দেখিনি।

করালীবাবু বললেন, ”কুমার, তোমার মাথার ওপরে এখন আর কোন অভিভাবক নেই। তুমি নাবালক। হাজার হোক তুমি তো আমাদেরই পাড়ার ছেলে। এখন আমাদের সকলেরই উচিত, তোমাকে সাহায্য করা। তাই আমি এসেচি।”

করালীবাবুর কথা শুনে বুঝলুম, তাঁকে আমি যতটা খারাপ লোক বলে ভাবতুম, আসলে তিনি ততটা খারাপ লোক নন। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বললুম, ”যদি কখনো দরকার হয়, আমি আপনার কাছে আগে যাব।”

করালীবাবু বসে বসে এ কথা সে কথা কইতে লাগলেন। কথা প্রসঙ্গে আমি তাঁকে বললুম, ”ঠাকুরদাদার লোহার সিন্দুকে একটা ভারী মজার জিনিষ পাওয়া গেছে।”

করালীবাবু বললেন, ”কি জিনিস?”

আমি বললুম, ”একটা চন্দন—কাঠের বাক্সের ভেতরে ছিল একটা মড়ার মাথার খুলি—”

করালীবাবুর চোখ দুটো যেন দপ করে জ্বলে উঠল। তিনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ”মড়ার মাথার খুলি?”

—”হ্যাঁ, আর একখানা পকেট—বই।”

—”সে বাক্সটা এখন কোথায়?”

—”লোহার সিন্দুকেই আছে।”

করালীবাবু তখনই সে কথা চাপা দিয়ে অন্য কথা কইতে লাগলেন। কিন্তু আমি বেশ বুঝলুম, তিনি যেন অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠছেন। খানিক পরে তিনি চলে গেলেন।

সেদিন রাত্রে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। শুনলুম আমার কুকুর বাঘা ভয়ানক চীৎকার করছে। বিরক্ত হয়ে দু—চারবার ধমক দিলুম, কিন্তু আমার সাড়া পেয়ে বাঘার উৎসাহ আরো বেড়ে উঠল—সে আরো জোরে চ্যাঁচাতে লাগল।

তারপরেই, যেন কার পায়ের শব্দ পেলুম। কে যেন দুড়—দুড় করে ছাদের উপর দিয়ে চলে গেল। ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলুম। চারিদিকে খোঁজ করলুম, কারুকেই দেখতে পেলুম না। ভাবলুম আমারি ভ্রম। বাঘার গলার শিকল খুলে দিয়ে, আবার ঘরে এসে শুয়ে পড়লুম!…

সকাল বেলায় ঘুম ভেঙেই শুনি মা ভারি চ্যাঁচামেচি লাগিয়েছেন! বাইরে এসে জিজ্ঞাসা করলুম, ”ব্যাপার কি মা?”

মা বললেন, ”ওরে, কাল রাত্তিরে বাড়িতে চোর এসেছিল!”

তাহলে কাল রাত্রে যা শুনেছিলুম তা ভুল নয়!

মা বললেন, ”দেখবি আয়, বড় ঘরে লোহার সিন্দুক খুলে রেখে গেছে!”

ঘরে গিয়ে দেখি, সত্যিই তাই! কিন্তু চোর বিশেষ—কিছু নিয়ে যেতে পারেনি কেবল সেই চন্দন কাঠের বাক্সটা ছাড়া।

কিন্তু মনে কেমন একটা ধোঁকা লেগে গেল! সিন্দুকে এত জিনিস থাকতে চোর খালি বাক্সটা নিয়ে গেল? আরো মনে পড়ল, কাল সকালে এই বাক্সের কথা শুনেই করালীবাবু কি রকম উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন! তবে কি এই বাক্সের মধ্যে কোন রহস্য আছে? সম্ভব। নইলে, একটা মড়ার মাথার খুলি কে আর এত যত্ন করে লোহার সিন্দুকের ভিতরে রেখে দেয়?

মাকে কিছু না বলেই তাড়াতাড়ি বাইরে ছুটলুম। বাড়ীর পাশের খানাটার মুখে গিয়ে দেখলুম, মড়ার মাথার খুলিটা একরাশ জঞ্জালের উপরে কাৎ হয়ে পড়ে আছে! সেটাকে আর একবার পরখ করবার জন্য তুলে নিলুম। খুলির এক পিঠে গাঢ় কালো রং মাখানো ছিল—কিন্তু খানার জল লেগে মাঝে মাঝে রং উঠে গেছে! আর যেখানেই রং নেই, সেইখানেই আঁকের মতন কি কতকগুলো খোদা রয়েছে। অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে খুলিটাকে লুকিয়ে আবার বাড়ীতে আনলুম। সাবান—জলে সেটাকে বেশ করে ধুয়ে ফেলতেই কালো রং উঠে গেল। তখন আশ্চর্য্য হয়ে দেখলুম খুলির এক পিঠের সবটায় কে অনেকগুলো অঙ্ক খুদে রয়েছে। অঙ্কগুলো এই রকম :—

অঙ্কগুলো

দুই – যকের ধন

এই অদ্ভুত প্রশ্নগুলির মানে কি? অনেক ভাবলুম, কিন্তু মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলুম না।

হঠাৎ মনে পড়ল ঠাকুরদাদার পকেট—বইয়ের কথা। সে—খানাও তো এই খুলির সঙ্গে ছিল, তার মধ্যে এই রহস্যের কোন সদুত্তর নেই কি?

তখনি উপরে গিয়ে তাক থেকে পকেট—বইখানা পাড়লুম। খুলে দেখি, তার গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত লেখায় ভরতি। গোড়ার দিকের প্রায় ষোল—সতেরো পাতা পড়লুম, কিন্তু সে সব বাজে কথা। তারপর হঠাৎ এক জায়গায় দেখলুম :—

”১৩১০ সাল, আশ্বিন মাস। আসাম থেকে ফেরার মুখে একদিন আমরা এক বনের ভিতর দিয়ে আসছি। সন্ধ্যা হয়—হয়,—আমরা এক উঁচু পাহাড়ে—জমি থেকে নামছি। হঠাৎ দেখি খানিক তফাতে একটা মস্ত বড় বাঘ! সে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে যেন কার উপরে লাফিয়ে পড়বার জন্য তাগ করছে! আরও একটু তফাতে দেখলুম, একজন সন্ন্যাসী পথের পাশে, গাছের তলায় শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। বাঘটার লক্ষ্য তাঁর দিকেই!

আমি তখনি চীৎকার করে উঠলুম। আমার সঙ্গের কুলিরাও সে চীৎকারে যোগ দিল। সন্ন্যাসীর ঘুম ভেঙে গেল, বাঘটাও চমকে ফিরে আমাদের দেখে এক লাফে অদৃশ্য হল।

সন্ন্যাসী জেগে উঠেই ব্যাপারটা সব বুঝে নিলেন। আমার কাছে এসে কৃতজ্ঞ স্বরে বললেন, ”বাবা, তোমার জন্যে আজ আমি বাঘের মুখ থেকে বেঁচে গেলুম।”

আমি বললুম, ”ঠাকুর, বনের ভেতরে এমনি করে কি ঘুমোতে আছে?”

সন্ন্যাসী বললেন, ”বনই যে আমার ঘর—বাড়ি বাবা!”

আমি বললুম, ”কিন্তু এখনি যে আপনার প্রাণ যেত!”

সন্ন্যাসী বললেন, ”কৈ বাবা, গেল না তো। ভগবান ঠিক সময়েই তোমাকে পাঠিয়ে দিলেন।”

শুনলুম, আমরা যেদিকে যাচ্ছি, সন্ন্যাসীও সেই দিকে যাবেন। তাই সন্ন্যাসীকেও আমরা সঙ্গে নিয়ে চললুম।

সন্ন্যাসী দুদিন আমাদের সঙ্গে রইলেন। আমি যথাসাধ্য তাঁর সেবা করতে ত্রুটি করলুম না। তিন দিনের দিন বিদায় নেবার আগে তিনি আমাকে বললেন, ”দেখ বাবা, তোমার সেবায় আমি বড় তুষ্ট হয়েছি। তুমি আমার প্রাণরক্ষাও করেচ। যাবার আগে আমি তোমাকে একটি সন্ধান দিয়ে যেতে চাই।”

আমি বললুম, ”কিসের সন্ধান?”

সন্ন্যাসী বললেন, ”যকের ধনের।”

আমি আগ্রহের সঙ্গে বললুম, ”যকের ধন! সে কোথায় আছে ঠাকুর?”

সন্ন্যাসী বললেন, ”খাসিয়া পাহাড়ে।”

আমি হতাশভাবে বললুম, ”কোনখানে আছে আমি তা জানব কেমন করে?”

সন্ন্যাসী বললেন, ”আমি ঠিকানা বলে দিচ্ছি, খাসিয়া পাহাড়ের রূপনাথের গুহার নাম শুনেচ?”

আমি বললুম, ”শুনেচি। প্রবাদে আছে যে, এই গুহার ভেতর দিয়ে চীনদেশে যাওয়া যায়, আর অনেককাল আগে এক চীনাসম্রাট এই গুহাপথে নাকি সসৈন্যে ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে এসেছিলেন।”

সন্ন্যাসী বললেন, ”হ্যাঁ। এই রূপনাথের গুহা থেকে পঁচিশ ক্রোশ পশ্চিমে গেলে, উপত্যকার মাঝখানে একটি সেকেলে মন্দির দেখতে পাবে। সে মন্দির এখন ভেঙে পড়েছে, কিছুদিন পরে তার কোন চিহ্নও হয়ত আর পাওয়া যাবে না। এক সময়ে এখানে মস্ত এক মঠ ছিল, তাতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা থাকতেন। সেকালের এক রাজা বিদেশী শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করবার আগে এই মঠে নিজের সমস্ত ধন—রত্ন গচ্ছিত রেখে যান। কিন্তু যুদ্ধে তাঁর হার হয়। পাছে নিজের ধন—রত্ন শত্রুর হাতে পড়ে, সেই ভয়ে রাজা সে সমস্ত এক জায়গায় লুকিয়ে এক যককে পাহারায় রেখে পালিয়ে যান। তারপর তিনি আর ফিরে আসেননি। সেই ধন—রত্ন এখনো সেখানেই আছে”—তারপর সন্ন্যাসী আমাকে বৌদ্ধ মঠে যাবার পথের কথা ভালো করে বলে দিলেন।

আমি বললাম, ”কিন্তু এতদিনে আর কেউ যদি সেই ধন—রত্নের সন্ধান পেয়ে থাকে।”

সন্ন্যাসী বললেন, ”কেউ পায়নি। সে বড় দুর্গম দেশ, সেখানে যে বৌদ্ধ মঠ আছে, তা কেউ জানে না, আর কোন মানুষও সেখানে যায় না! মঠে গেলেও, সারা জীবন ধরে ধনরত্ন খুঁজলেও কেউ পাবে না। কিন্তু তোমাকে সেখানে গিয়ে খুঁজতে হবে না; ধনরত্ন ঠিক কোনখানে পাওয়া যাবে, তা জানবার উপায় কেবল আমার কাছে আছে।” এই বলে সন্ন্যাসী তাঁর ঝোলা থেকে একটা মড়ার খুলি বার করলেন।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললেম, ”ওতে কি হবে ঠাকুর?”

সন্ন্যাসী বললেন, ”যে যক ধনরত্নের পাহারায় আছে, এ তারই মাথার খুলি! এই খুলিতে আমি মন্ত্র পড়ে দিয়েছি, এ খুলি যার কাছে থাকবে, যক তাকে আর কিছুই বলবে না। খুলিতে এই যে অঙ্কের মত রেখা রয়েছে, এ হচ্চেচ সাঙ্কেতিক ভাষা। এই সঙ্কেত বুঝবার উপায়ও আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, তাহলেই তুমি জানতে পারবে ঠিক কোনখানে ধনরত্ন আছে।” এই বলে সন্ন্যাসী আমাকে সংকেত বুঝবার গুপ্ত উপায় বলে দিলেন।

তারপর এক বৎসর ধরে অনেক ভাবলুম। কিন্তু একলাটি সেই দুর্গম দেশে যেতে ভরসা হল না। শেষটা আমার প্রতিবেশী করালীকে বিশ্বাস করে সব কথা জানিয়ে বললুম, ”করালী, তোমার যোয়ান বয়স, তুমি যদি আমার সঙ্গে যাও, তবে তোমাকেও ধনরত্নের অংশ দেব।”

কিন্তু করালী যে বেইমান, আমি তা জানতুম না। সে ফাঁকি দিয়ে মড়ার মাথার খুলিটা আমার কাছ থেকে আদায় করবার চেষ্টায় রইল। দু—একবার লোক লাগিয়ে চুরি করবার চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু পারেনি। ভাগ্যে আমি তাকে যকের ধনের ঠিকানাটা বলে দিইনি।

কিন্তু খাসিয়া পাহাড়ে যাবার আশা আমি ছেড়ে দিয়েচি। এই বুড়ো বয়সে টাকার লোভে একলা সেই অজানা দেশে গিয়ে শেষটা কি বাঘ—ভাল্লুক—ডাকাতের পাল্লায় প্রাণ খোয়াব? অন্য কারুকে সঙ্গে নিতেও ভরসা হয় না,—কে জানে, টাকার লোভে বন্ধুই আমাকে খুন করবে কি না!

তবে এই পকেট—বইয়ে আমি সব কথা লিখে রাখলুম। ভবিষ্যতে এই লেখা হয়তো আমার বংশের কারুর উপকারে আসতে পারে। কিন্তু আমার বংশের কেউ যদি সত্যিই সেই বৌদ্ধ মঠে যাত্রা করে, তবে যাবার আগে যেন বিপদের কথাটাও ভালো করে ভেবে দেখে। এ কাজে পদে পদে প্রাণের ভয়।”

পকেট—বইখানা হাতে করে আমি অবাক হয়ে বসে রইলুম।

তিন – সঙ্কেতের অর্থ

উঃ! করালীবাবু কি ভয়ানক লোক! ঠাকুরদাদার সঙ্গে সে চালাকি করতে গিয়েছিল, কিন্তু পেরে ওঠেনি। তারপর এতদিনেও সে আশা ছাড়েনি। আমি বেশ বুঝলুম, এই মড়ার মাথাটা কোথায় আছে তা জানবার জন্যেই করালী কাল আমাদের বাড়ীতে এসে হাজির হয়েছিল! রাত্রে এইটে চুরি করবার ফিকিরেই যে আমাদের বাড়ীতে চোর এসেছিল, তাতেও আর কোন সন্দেহ নেই। ভাগ্যে মড়ার মাথাটা আমি বাড়ীর পাশের খানায় ফেলে দিয়েছিলুম!

এখন কি করা উচিত? গুপ্তধনের চাবি তো এই খুলির মধ্যেই আছে, কিন্তু অনেকবার উল্টেপাল্টে দেখেও আমি সেই অঙ্কগুলোর ল্যাজ—মুড়ো কিছুই বুঝতে পারলুম না। পকেট—বইখানার প্রত্যেক পাতা উল্টে দেখলুম, তাতেও ঠাকুরদাদা এই সঙ্কেত বুঝবার কোন উপায় লিখে রাখেননি। ঠাকুরদাদার উপরে ভারি রাগ হলো। আসল ব্যাপারটাই জানবার উপায় নেই।

তারপরে ভেবে দেখলুম, জেনেই বা কি আর এমন হাতী—ঘোড়া লাভ হত! আমার বয়স সতেরো বৎসর। সেকেণ্ড—ইয়ারে পড়চি। জীবনে কখনো কলকাতার বাইরে যাইনি। কোথায় কোন কোণে আসাম আর খাসিয়া পাহাড়, আবার তার ভেতরে কোথায় আছে ”রূপনাথের গুহা”—এ—সব খুঁজে বার করাই তো আমার পক্ষে অসম্ভব! তার উপরে সেই গভীর জঙ্গল, সেখানে দিন—রাত বাঘ—ভাল্লুক—হাতীরা হানা দিচ্ছে! সেকেলে এক বৌদ্ধ মঠ, আর ভিতরে যকের ধন—সেও এক ভুতুড়ে কাণ্ড! শেষটা কি একলা সেখানে গিয়ে আলিবাবার ভাই কাসিমের মতন টাকার লোভে প্রাণটা খোয়াব? এ—সব ভেবেও বুকটা ধুকপুক করে উঠল!

হঠাৎ মনে হল বিমলের কথা। বিমল আমার প্রাণের বন্ধু, আমাদের পাড়ার ছেলে। আমার চেয়ে সে বয়সে বছর—তিনেকের বড়, এ—বৎসরে বি.এ দেবে। বিমলের মত চালাক ছেলে আমি আর দুটি দেখিনি। তার গায়েও অসুরের মতন জোর, রোজ সে কুস্তি লড়ে—দুশো ডন, তিনশো বৈঠক দেয়। তার উপরে এই বয়সে সে অনেক দেশ বেড়িয়ে এসেছে—এই গেল বছরেই তো আসামে বেড়াতে গিয়েছিল। তার কাছে আমি কোন কথা লুকোতুম না! ঠিক করলুম, যাওয়া হোক, আর নাই হোক একবার বিমলকে এই মড়ার মাথাটা দেখিয়ে আসা যাক।

বৈকালে বিমলের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম—তখন সে বসে বসে বন্দুকের নল সাফ করছিল! আমাকে দেখে বললে, ”কিহে, কুমার যে! কি মনে করে?”

আমি বললুম, ”একটা ধাঁধা নিয়ে ভারি গোলমালে পড়েচি ভাই!”

বিমল বললে, ”কি ধাঁধা?”

আমি মড়ার মাথার খুলিটা বার করে বললুম, ”এই দেখ!”

বিমল অবাক হয়ে খুলিটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বললে, ”এ আবার কি?”

আমি পকেট—বইখানা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললুম, ”আমার ঠাকুরদার পকেট—বই। পড়লেই সব বুঝতে পারবে।”

বিমল বললে, ”আচ্ছা রোসো, আগে তাড়াতাড়ি বন্দুকটা সাফ করে নি। কাল পাখি—শিকারে গিয়েছিলুম। বন্দুকে ভারি ময়লা জমেছে।”

বন্দুক সাফ করে, হাত ধুয়ে বিমল বললে, ”ব্যাপার কি বল দেখি কুমার? তুমি কি কোন তান্ত্রিক গুরুর কাছে মন্ত্র নিয়েছ? তোমার হাতে মড়ার মাথা কেন?”

আমি বললুম, ”আগে পকেট—বইখানা পড়েই দেখ না!”

”বেশ” বলে বিমল পকেট—বইখানা নিয়ে পড়তে লাগল। খানিক পরেই দেখলুম, বিমলের মুখ বিস্ময়ে আর কৌতূহলে ভরে উঠেছে।

পড়া শেষ করেই বিমল তাড়াতাড়ি মড়ার মাথাটা তুলে নিয়ে সেটাকে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে দেখলে। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললে, ”ভারি আশ্চর্য্য—তো!”

আমি বললুম, ”অঙ্কগুলো কিছু বুঝতে পারলে?”

বিমল বললে, ”উহু!”

—”আমিও পারিনি।”

—”কিন্তু আমি এত সহজে ছাড়ব না। তুমি এখন বাড়ী যাও, কুমার! খুলিটা আমার কাছেই থাক। আমি এটার রহস্য জানবই! তুমি কাল সকালে এস।”

আমি বললুম, ”কিন্তু সাবধান।”

বিমল, বললে, ”কেন?”

আমি বললুম, ”করালী মুখুয্যে এই খুলিটা চুরি করবার জন্যে কাল আমাদের বাড়ীতে লোক পাঠিয়েছিল।”

বিমল বললে, ”করালী? তার কোন লোকের এত সাহস হবে না যে, আমার বাড়িতে মাথা গলাবে।”

—”তা আমি জানি। তবু সাবধানের মার নাই।” এই বলে আমি চলে এলুম।

পরের দিন ভোর না হতেই বিমলের কাছে ছুটলুম। তার বাড়িতে আমার অবারিত দ্বার। একেবারে তার পড়বার ঘরে গিয়ে দেখি, বিমল টেবিলের উপর হেঁট হয়ে এক মনে কি লিখছে, আর সামনেই মড়ার মাথাটা পড়ে রয়েছে। আমার পায়ের শব্দে চমকে তাড়াতাড়ি সে খুলিটাকে তুলে নিয়ে লুকিয়ে ফেলতে গেল—তারপর আমাকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে হেসে বললে, ”ওঃ, তুমি! আমি ভেবেছিলুম অন্য কেউ!”

—”কাল তো অতো সাহস দেখালে, আজ এত ভয় পাচ্ছ কেন?”

—”কাল? কাল সবটা ভালো করে তলিয়ে বুঝিনি। আজ বুঝচি, আমাদের এখন সাবধান হয়ে কাজ করতে হবে—কাকপক্ষী যেন টের না পায়।”

—”অঙ্কগুলো দেখে কিছু বুঝলে?”

—”যা বোঝা উচিত সব বুঝেচি।”

আনন্দে আমি লাফিয়ে উঠলুম! চেঁচিয়ে বললুম, ”সব বুঝতে পেরেচ! সত্যি?”

বিমল বললে, ”চুপ! চেঁচিয়ো না! কে কোথায় শুনতে পাবে বলা যায় না। ঠাণ্ডা হয়ে ঐখানে বোসো।”

আমি একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললুম, ”খুলিতে কি লেখা আছে, আমাকে বল।”

বিমল আস্তে আস্তে বললে, ”প্রথমটা আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। প্রায় চার ঘণ্টা চেষ্টা করে যখন আমি একেবারে হতাশ হয়ে পড়েচি, তখন হঠাৎ আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। অনেকদিন আগে একখানা ইংরাজী বই পড়েছিলুম। তাতে নানারকম সাঙ্কেতিক লিপির গুপ্তরহস্য বোঝানো ছিল। তাতেই পড়েছিলুম যে ইউরোপের চোর—ডাকাতরা প্রায়ই একরকম সঙ্কেত ব্যবহার করে। তারা Alphabet অর্থাৎ বর্ণমালাকে যথাক্রমে সংখ্যা অর্থাৎ ১, ২, ৩ হিসাবে ধরে। অর্থাৎ one হবে A, two হবে B, three হবে C ইত্যাদি। আমি ভাবলুম হয়তো এই খুলিটাতেও সেই নিয়মে সঙ্কেত সাজানো হয়েচে। তারপর দেখলুম, আমার অনুমান মিথ্যা নয়। তখন এই সঙ্কেতগুলো খুব সহজেই পড়ে ফেললুম।”

আমি আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠলুম, ”পড়ে কি বুঝলে বল?”

বিমল আমার হাতে একখানা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললে, ”খুলির সঙ্কেতগুলো ছাব্বিশটা ঘরে ভাগ করা। আমিও লেখাগুলো সেই ভাবেই সাজিয়েচি।”

কাগজের উপরে এই কথাগুলো লেখা ছিল :

”ভাঙা দেউলের পিছনে সরলগাছ মূলদেশ থেকে

পুবদিকে দশগজ এগিয়ে থামবে ডাইনে আটগজ

এগিয়ে বুদধদেব বামে ছয়গজ এগিয়ে তিনখানা

পাথর তার তলায় সাতহাত জমি খুঁড়লে

পথ পাবে”

আমি চিঠিখানা পড়ে মনে মনে বিমলের বুদ্ধির তারিফ করতে লাগলুম।

বিমল বললে, ”সাঙ্কেতিক লিপিটা তোমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দি, শোনো। আমাদের বাংলা ভাষায় ”অ” থেকে সুরু করে ” ৺/” পর্য্যন্ত বাহান্নোটি বর্ণ। সেই বর্ণগুলিকে ১, ২, ৩ হিসাবে যথাক্রমে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ ১ হচ্চেচ অ, ২ হচ্চেচ আ, ১৩ হচ্ছে ক, ৫২ হচ্চেচ ৺ প্রভৃতি।

যেখানে ‘আ’—কার বা ‘এ’—কার প্রভৃতি আছে, সেখানে বর্ণের যে—পাশে দরকার, সেইপাশে ব্রাকেটের ভেতর সংখ্যা লেখা হয়েচে। উদাহরণ দেখ :— ‘ভ’বর্ণের সংখ্যা ৩৬, আর ‘আ’—কারের সংখ্যা হচ্ছে ২। অতএব, ৩৬(২) সঙ্কেতে বুঝতে হবে ”ভা”। ‘দ’ বর্ণের সংখ্যা ৩০, ‘এ’—কারের সংখ্যা হচ্চেচ ৯। অতএব ”দে” বোঝাতে লিখতে হবে (৯) ৩০। ”উ”—কার বর্ণের তলায় বসে। সুতরাং ৩৫/৫ থাকলে বুঝতে হবে ”বু”। ”উ”—র মত ”উ”—কারেরও সংখ্যা হচ্চেচ ৫। চন্দ্রবিন্দুর সংখ্যা বাহান্নো, চন্দ্রবিন্দু উপরে বসে, কাজেই ”খুঁ”র সঙ্কেত ৫২/১৪ । যুক্ত—অক্ষরকে আলাদা করে ধরা হয়েছে, যেমন—”বুদধদেব।” যিনি এ সংখ্যাগুলি লিখেছেন, তাঁর বানান—জ্ঞান ততটা টনটনে নয়। কেননা ”মূল” ও ”পূব” তাঁর হাতে পড়ে হোয়েচে—”মুল” ও ”পুব”। উর মত উ—কারের সংখ্যা হচ্চেচ ৬। কিন্তু তিনি উ—কারের সংখ্যা ঊ—কারের ৬—এর স্থানে বসিয়েছেন—বর্ণের তলাকার ব্রাকেটে।”

আমি মড়ার মাথার খুলিটা আর একবার পরখ করবার জন্যে তুলে নিলুম—কিন্তু দৈবগতিকে হঠাৎ সেখানা ফসকে মার্ব্বেল বাঁধানো মেঝের উপরে সশব্দে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি সেটা উঠিয়ে নিয়ে, তার উপর একবার চোখ বুলিয়ে আমি বলে উঠলুম, ”ঐঃ যাঃ! খুলিটার খানিকটা চটে গিয়েছে।”

বিমল বললে, ”কোন খানটা?”

আমি বললুম, ”গোড়ার চারটে ঘর—ভাঙা দেউলের পিছনে সরলগাছ—পর্য্যন্ত।”

বিমল বললে, ”এই কাণ্ডটি যদি আগে ঘটত তাহলে সমস্তই মাটি হয়ে যেত। যাক, তোমার কোন ভয় নেই,—সঙ্কেতগুলো আমি কাগজে টুকে নিয়েচি। কিন্তু আমাদের সাবধান হতে হবে, অঙ্কগুলো রেখে কথাগুলো এখনি নষ্ট করে ফেলাই উচিত।”—এই বলে সে সঙ্কেতের অর্থ—লেখা কাগজখানা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললে।

যখন দরকার হবে, পাঁচ মিনিটের চেষ্টাতেই সঙ্কেতের অর্থ আমরা ঠিক বুঝতে পারব,—কিন্তু বাইরের কোন লোক খুলির সঙ্কেত দেখে কিছুই ধরতে পারবে না।

চার – সর্ব্বনাশ

আমি বললুম, ”বিমল, সঙ্কেতের মানে তো বোঝা গেল, এখন আমরা কি করব?”

বিমল বাধা দিয়ে বললে, ”এতে আর কিন্তু—টিন্তু নেই কুমার,—আমাদের যেতেই হবে! এত—বড় একটা অদ্ভুত ব্যাপার, এর শেষ পর্য্যন্ত না দেখলে আমার তৃপ্তি হচ্ছে না।”

আমি বললুম, ”আমাদের সঙ্গে কে কে যাবে?”

—”কেউ না। খালি তুমি আর আমি।”

—”কিন্তু সে বড় দুর্গম জায়গা। লোক—জন না নিয়ে কি যাওয়া উচিত?”

বিমল বললে, ”কিছুই দুর্গম নয়, পথঘাট আমি সব চিনি, ‘রূপনাথের গুহা’ পর্য্যন্ত ঠিক যাব। তার পরের পথ কি—রকম জানি না বটে, কিন্তু চিনে নিতে বেশী দেরি লাগবে না। তুমি বুঝি বিপদের ভয় করচ? ও ভয় করো না। বিপদকে ভয় করো না। বিপদকে ভয় করলে মানুষ আজ এত বড় হতে পারত না। সোজা পথ দিয়ে তো শিশুও যেতে পারে, তাতে আর বাহাদুরি কি? বিপদের অগ্নিপরীক্ষায় হাসিমুখে যে সফল হয়, পৃথিবীতে তাকেই বলি মানুষের মত মানুষ।”

আমি বললুম, ”কিন্তু গোঁয়ার্তুমি করে প্রাণ দিলে মানুষের মর্য্যাদা কি বাড়বে? আমি অবশ্য কাপুরুষ নই—তুমি যেখানে বল যেতে রাজি আছি! তবে অন্ধের মত কিছু করা ঠিক নয়—জানো তো, প্রবাদেই আছে—’লাফ’ মারবার আগে চেয়ে দেখ।”

বিমল বলল, ”যা ভাববার আমি সব ভেবে দেখেচি। এখন আর ভাবনা নয়।”

—”কবে যাবে?”

—”আমি তো প্রস্তুত। কাল বল, কাল, পর্শু বল, পর্শু।”

—”এত তাড়াতাড়ি! যাবার আগে বন্দোবস্ত করতে হবে তো!”

—”বন্দোবস্ত করব আর ছাই। আমরা তো সেখানে ঘর—সংসার পাততে যাচ্ছি না—এ—সব কাজে যতটা ঝাড়া—হাত—পায়ে যাওয়া যায়, ততই ভালো। গোটা—দুই ব্যাগ, আর আমরা দুটি প্রাণী—ব্যাস।”

—”কোন পথে যাবে?”

বিমল বললে, ”আমাদের কামরূপ পার হয়ে এই খাসিয়া পাহাড়ে উঠতে হবে। খাসিয়া পাহাড়ের ঠিক পাশেই যমজ ভাইয়ের মত আর একটি পাহাড় আছে—তার নাম জয়ন্তী। এদের উত্তরে আছে—কামরূপ আর নবগ্রাম। পূর্ব্বে আছে উত্তর কাছাড়, নাগা পর্ব্ব আর কপিলী নদী। দক্ষিণে আছে শ্রীহট্ট, আর পশ্চিমে গারো পাহাড়।”

—”খাসিয়া পাহাড় কি খুব উঁচু?”

—”হু”, উঁচু বৈকি। কোথাও চার হাজার, কোথাও পাঁচ হাজার, আবার কোথাও বা সাড়ে ছয় হাজার ফুট উঁচু। পাহাড়ের ভেতর অনেক জলপ্রপাত আছে—তাদের মধ্যে চেরাপুঞ্জি নামে জায়গার কাছে ‘মুসমাই’ আর শিলং সহরের কাছে ‘বীডনস’ প্রপাত দুইটিই বড়। প্রথমটির উচ্চতা এক হাজার আটশো ফুট, দ্বিতীয়টি ছয়শো ফুট। উচ্চতায় প্রথম প্রপাতটি পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয়। পাহাড়ের মধ্যে উষ্ণ প্রস্রবণও আছে—তার জল গরম। খাসিয়া পাহাড়ে শীত আর বর্ষা ছাড়া আর কোন ঋতুর প্রভাব বোঝা যায় না—বৃষ্টি আর ঝড় তো লেগেই আছে। বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠমাসে বৃষ্টি না হওয়া পর্য্যন্ত একটু বসন্তের আমেজ পাওয়া যায়। খাসিয়া পাহাড়ের চেরাপুঞ্জি তো বৃষ্টির জন্যে বিখ্যাত।”

আমি বললুম, ”সেখানে বাঘ—ভাল্লুকের ভয় আছে?”

বিমল হেসে বললে, ”খালি বাঘ—ভাল্লুক কেন, সেখানকার জঙ্গলে হাতী, গণ্ডার, বুনো মোষ আর বরাহ সবই পাওয়া যায়, কিন্তু সাপ খুব কম।”

আমি মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললুম, ”তবেই তো।”

বিমল আমার পিঠ চাপড়ে বললে, ”কুমার, তুমি কলকাতার বাইরে কখনো যাওনি বলে বন—জঙ্গলকে যতটা ভয়ানক মনে করচ, আসলে তা তত ভয়ানক নয়। আর আমি সঙ্গে থাকব—তোমার ভয় কি? জানো তো, আমি এই বয়েসেই ঢের বড় জন্তু শিকার করেচি? আমার দুটো বন্দুকের পাস আছে—একটা তোমাকে দেব। তুমি আজও কিছু শিকার করনি বটে, কিন্তু আমি তো তোমাকে অনেক দিন আগেই বন্দুক ছুঁড়তে শিখিয়ে দিয়েছি,—এইবার সে শিক্ষার পরীক্ষা হবে।”

সেদিন আর কিছু না ব’লে বাড়ীমুখো হলাম। মনে ভয় হচ্ছিল বটে, আনন্দও হচ্ছিল খুব। নতুন নতুন দেশ দেখবার সাধ আমার চিরকাল। কেতাবে নানা দেশের ছবি দেখে আর গল্প পড়ে সে—সব দেশে যাবার জন্যে আমার মন যেন উড়ু—উড়ু করত। কখনো ইচ্ছে হোতো রবিন্সন ক্রুশোর মতন এক নির্জ্জন দ্বীপে গিয়ে, নিজের হাতে কুঁড়েঘর বেঁধে মনের সুখে দিনের পর দিন কাটাই, কখনো ইচ্ছে হোতো সিন্দবাদ নাবিকের মত ‘রক’ পাখীর সঙ্গে আকাশে উঠি, তিমি মাছের পিঠে রান্না চড়াই, আর দ্বীপবাসী বৃদ্ধকে আছাড় মেরে জব্দ করে দিই। কখনো ইচ্ছে হোতো ডুবো—জাহাজে সমুদ্রের ভেতরে যাই আর পাতাল—রাজের ধন—ভাণ্ডার লুট করে নিয়ে আসি! এমনি কত ইচ্ছাই যে আমার হোতো তা আর বলা যায় না—বললে তোমরা সবাই শুনে নিশ্চয়ই ঠাট্টার হাসি হাসবে।

আসল কথা কি, যকের ধন পাওয়ার সঙ্গে নতুন দেশ দেখবার আনন্দ ক্রমেই আমাকে চাঙ্গা করে তুললে। মনে যা কিছু ভয়—ভাবনা ছিল, যেন কোথায় ভেসে গেল।

বাড়ীর কাছে আসতেই আমার আদরের কুকুর বাঘা আধ হাত জিভ বার করে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে আমাকে আগ বাড়িয়ে নিতে এল।

আমি বললুম, ”কি রে বাঘা, আমার সঙ্গে খাসিয়া পাহাড়ে বেড়াতে যাবি?”

বাঘা যেন আমার কথা বুঝতে পারলে। পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, সামনের দুই পায়ে সে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলে, তারপর আদর করে আমার মুখ চেটে দিতে এল। আমি তাড়াতাড়ি মুখ সরিয়ে নিয়ে তাকে নামিয়ে দিলুম!

আমার এই বাঘা বিলিতী নয়, দিশী কুকুর। কিন্তু তাকে দেখলে সে কথা বোঝবার যো নেই। ভালো রকম যত্ন করলে দিশী কুকুরও যে কেমন চমৎকার দেখতে হয়, বাঘাই তার প্রমাণ। তার আকার মস্ত—বড়, গায়ের রং হলদে, তার উপর কালো কালো ছিট, অনেকটা চিতাবাঘের মত, তাই তার নাম রেখেছি বাঘা। ভয় কাকে বলে বাঘা তা জানে না, আর তার গায়েও বিষম জোর। একবার হাউণ্ড জাতের প্রকাণ্ড একটা বিলাতী কুকুর তাকে তেড়ে এসেছিল, কিন্তু বাঘার এক কামড় খেয়েই সে একেবারে মরো—মরো হয়ে প’ড়েছিল। আমি ঠিক করলুম, বাঘাকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব।

পরের দিন সকালে তখনো আমার ঘুম ভাঙ্গেনি, হঠাৎ কে এসে ডাকাডাকি করে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে! চেয়ে দেখি বিমল আমার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আশ্চর্য্য হয়ে উঠে বসে বললুম, ”কিহে, সক্কালবেলায় হঠাৎ তুমি যে?”

বিমল হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ”সর্ব্বনাশ হয়েছে!”

আমি তাড়াতাড়ি বললুম, ”সর্ব্বনাশ হয়েছে! সে আবার কি?”

বিমল বললে, ”কাল রাত্রে মড়ার মাথাটা আমার বাড়ী থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে!”

—”অ্যাঁঃ, বল কি?”—আমি একেবারে হতভম্বের মত আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলুম!