ম্যানহাটানে মিস্ত্রি মার্ডার – ৭

৭ 

দিলীপ কাপাদিয়া আমাদের নামিয়ে দিলেন বাড়ি থেকে মাত্র দু-ব্লক দূরে ওয়াশিংটন পার্কে। আমিই বললাম ওখানে নামাতে। বাড়ির সামনে নামাতে হলে ওয়ান-ওয়ের জন্য ওঁকে একটু ঘুরতে হত। রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে একেনবাবু হঠাৎ বলে উঠলেন, “বুঝলেন স্যার, একজনকে ভালোবাসলে তার জন্যে অনেক কিছু করা যায়।”

“কী বলতে চাইছেন আপনি?”

“এই অরুণ শেঠের কথা ভাবছি।”

“কী ভাবছেন?”

“মানে স্যার, ভাই-বোনের মধ্যে ভালোবাসা নিয়ে।”

“হোয়াট! অবৈধ প্রেম?”

“আরে না স্যার, ছি ছি!”

“তাহলে?”

“ভাবছিলাম উনি হয়তো সুজাতা দেবীকে সেদিন বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন, পুলিশ নিয়ে ওঁর চিন্তিত হবার কোনো কারণ নেই, সন্দেহের সব তির এখন ওঁর দিকে। কিন্তু জানেন স্যার, তার তো কোনো দরকারই ছিল না!”

“তার মানে! আপনি বলতে চান অরুণ খুন করেনি?”

“তা তো বলিনি স্যার।”

বাড়িতে যখন প্রায় এসে গেছি, তখন কথাটা ক্লিয়ার হল। ঠিক ঢোকার মুখে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে দেখা। একেনবাবুকে বললেন, “তোমাকে ফোন করতাম, কিন্তু যখন এ পথ দিয়েই যাচ্ছি, ভাবলাম খবরটা দিয়েই যাই। ইউ আর রাইট একেন্ড্রা, ইউ আর রাইট অ্যাবাউট অরুণ শেঠ।”

একেনবাবু উজ্জ্বল মুখে বললেন, “তার মানে হি হ্যাড অ্যান অ্যালিবাই?”

“ইয়েস, অ্যান্ড মাইট বি এ গুড ওয়ান। যখন ওকে বললাম সুজাতা শাহ-র একটা অ্যালিবাই আছে, সুজাতাকে জেরা করছি না, ওর মুখ-চোখ একেবারে উজ্জ্বল হয়ে গেল! তখন জেরা না করতেও নিজের থেকেই অনেক কিছু বলে ফেলল! যাই হোক, ব্যাপারটা হল অরুণ প্রায়ই ডক্টর আনান্ড শর্মা নামে এক ইন্ডিয়ান ডক্টরের বাড়ি যেত লাঞ্চ খেতে। নট এভরি ডে, কিন্তু ইট ওয়াজ অলমোস্ট এ রুটিন। এই ডক্টর শর্মার বাড়ি অরুণ শেঠের অফিস থেকে মাত্র ছ’ব্লক দূরে, সুতরাং হেঁটেই যাওয়া যায়। সেদিনও ও বেরিয়েছিল লাঞ্চে যেতে। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে এক ব্লক যেতে না যেতেই চোখে পড়ল ডক্টর শর্মার গাড়ি রাস্তায় পার্ক করা। ওটা ‘নো পার্কিং’ এরিয়া। একটু অবাকই হল, হয়তো ওঁর কোনো এমার্জেন্সি কল এসেছে ভেবে অরুণ একটা গ্রিক রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ খেয়ে ফিরে যায়। যদি ডক্টর শর্মার বাড়িতে লাঞ্চ খেত, তাহলে এতদিন ওকে আমাদের আটকে রাখার কোনো প্রয়োজনই হত না। চট করেই অ্যালিবাইটা বেরিয়ে পড়ত।”

একেনবাবু দেখলাম তুরু-টুরু কুঁচকে কী জানি তাছেন। 

“কিন্তু ডক্টর শর্মা তো বাড়ি ছিলেন না!”

“তা ঠিক।”

“আপনি স্যার গ্রিক রেস্টুরেন্টটা চেক করেছেন তো?”

“ইয়েস। লাকিলি একাধিক বার অরুণ ওখানে খেয়েছে। একজন ওয়েটার কনফার্ম করেছে।”

“আর আমার ইনফর্মেশনটা স্যার?”

“সেটাও আজ-কালের মধ্যে এসে যাবে। 

“কী ইনফর্মেশন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। 

একেনবাবু আর ক্যাপ্টেন দেখি দু-জনে দু-জনের দিকে তাকালেন। একেনবাবু বললেন, “ওটা স্যার, অন্য ব্যাপার।”

.

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট চলে যেতেই একেনবাবুকে বললাম, “কী ব্যাপার বলুন তো, জিনিসটা কি আরও পাজলিং হয়ে যাচ্ছে না?”

“ওয়াশিংটন ডিসি এখান থেকে যেতে কতক্ষণ লাগে, স্যার?”

“আমার প্রশ্নের পিঠে এই উলটো প্রণের পারম্পর্য ঠিক বুঝলাম না। কিন্তু তা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বললাম, “সেটা নির্ভর করছে কীভাবে যাবেন তার ওপর।”

“তাও তো বটে,” একেনবাবু ভুলটা বুঝতে পেরে মাথা নাড়লেন। “ধরুন স্যার, যদি গাড়ি করে যাই?”

“তাহলে সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো।”

“আর প্লেনে?”

“প্লেন আকাশে ওঠার পর মিনিট পঁয়ত্রিশ। কিন্তু তার সঙ্গে যোগ করুন এয়ারপোর্ট যাবার টাইম আর প্লেনের জন্য রিপোর্টিং টাইম। আরও যোগ করতে হবে টেক অফ আর ল্যান্ডিং-এ কতক্ষণ লাগবে…।”

“বুঝেছি, বুঝেছি স্যার, ভারি গোলমেলে হিসেব।”

.

বাড়িতে ঢুকেই “আসছি” বলে একেনবাবু নিজের ঘরে গিয়ে কাকে জানি ফোন করতে গেলেন। কিচেনে প্রমথ তেড়ে রান্না করছে। আমাকে দেখে ফাজলামি করে জিজ্ঞেস করল, “কী রে, তোদের সাসপেক্ট কে? পাঁচকড়ি দে?”

“মানে?”

“একেনবাবুকে ভাঙিয়ে গোয়েন্দা কাহিনি লেখার চেষ্টা করছিস, অথচ পাঁচকড়ি দে-র নাম শুনিসনি? বাংলাসাহিত্যের এক্কেবারে আদিযুগের গোয়েন্দা কাহিনিগুলো তো ওঁর হাত থেকেই বেরিয়েছে! ওসব থাক, সাসপেক্ট কে বল?”

“একেনবাবু কী উত্তর দেবেন জানি না, আমার মতে বাটলার, এক্ষেত্রে রাঁধুনি ব্যাটাই দোষী!”

“তার মানে তো আমি!” খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে প্রমথ হো-হো করে খানিকক্ষণ হাসল। তারপর বলল, “ফাজলামি নয়, একেনবাবুকে একটা পাকা খবর দিই। মার্ডারের সময় দিলীপ কাপাদিয়া কিন্তু ম্যানহাটানেই ছিলেন।”

“এটা তুই কী করে জানলি?”

আমাকে অবাক করতে পেরেছে দেখে প্রমথ মজা পেল। গম্ভীরভাবে বলল, “খবর রাখতে হয় বন্ধু, খবর রাখতে হয়।”

আসলে ব্যাপারটা খুবই সিম্পল। প্রমথ অচ্যুতের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়েছিল সোমবার, অর্থাৎ বল্লভ শাহের মৃত্যুর ঠিক দু-দিন আগে। অচ্যুত আমাদের কয়েক বছরের জুনিয়র। কিছুদিন হল ম্যানহাটানে ছোটোখাটো ট্র্যাভেল এজেন্সি খুলেছে। ক্লায়েন্টরা সব ভারতীয়। কোনো এক প্রসঙ্গে দিলীপ কাপাদিয়ার কথা যখন হচ্ছিল, অচ্যুত বলেছে খানিক আগেই ও দিলীপ কাপাদিয়ার জন্য ওয়াশিংটন ডিসি থেকে নিউ ইয়র্কে আসার প্রিপেড টিকিটের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। 

খবরের সোর্সটা জেনে বললাম, “তোর ইনফর্মেশন হয়তো ঠিক, কিন্তু কনক্লুশনটা ঠিক নয়।”

“তার মানে?”

“মানে হল, দিলীপ কাপাদিয়া বুধবার ওয়াশিংটন ডিসি-তে ছিলেন। আজ দুপুরেই ওঁর কাছ থেকে কথাটা জানলাম।”

“তাহলে হয়তো মঙ্গলবার উনি আবার ব্যাক করেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে শুধু প্রিপেড টিকিটের কথা বলেছিল। ওয়ান-ওয়ে না রিটার্ন খেয়াল করিনি। ঠিকই বলছিস, শুটিং-এর কাজে নিশ্চয় ওঁকে এরকম শর্ট-ট্রিপ নিতে হচ্ছে। আগের শনিবারও তো ওঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হল, বললেন ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ফিরেছেন। তার মানে রোববারও উনি ডিসি-তে গিয়েছিলেন।”

“ফিল্ম মেকারদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা! যাই হোক, আর কিছু জানলি এর মধ্যে?”

“বিশেষ কিছু নয়। তুই সেদিন কলেজে ছিলি… একেনবাবুকে দিলীপ কাপাদিয়া বলছিলেন, ডকুমেন্টারির জন্য রিসার্চ করতে গিয়ে বল্লভ শাহ সম্পর্কে উনি একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য আবিষ্কার করেছেন।”

“সেটা কী?”

“দিলীপ কাপাদিয়া জানার চেষ্টা করছিলেন বল্লভ শাহ ওঁর ফাস্ট-ফুড-এর ব্যাবসা অল্প সময়ের মধ্যে এত বিশাল করে ফেললেন কীভাবে? খুব সহজে নাকি ব্যাপারটা ঘটেনি— দু-দু বার দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল ওঁর কোম্পানি। তবে বল্লভ শাহ খুবই চালু ব্যবসায়ী, দুটো কোম্পানিই ছিল লিমিটেড লায়াবিলিটি কর্পোরেশন। কোম্পানি ডকে উঠলেও মার খেয়েছিল ইনভেস্টররা, যাদের বেশিরভাগই ছিল দেশি ভাই… ব্যবসায়ী, ডাক্তার, উকিল, অর্থাৎ— অর্থবান ভারতীয়রা। তাদের পুরো ইনভেস্টমেন্ট জলে গিয়েছিল! নতুন করে যখন বিজনেস শুরু করলেন, ওঁর ব্যাঙ্কাপ্টসি রেকর্ড দেখে ব্যাঙ্ক নাকি প্রথমে ধার দিতে চায়নি। নিজের অ্যাসেট আর স্ত্রীর ইনসিয়োরেন্স থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে ব্যাবসার মূলধন জোগাড় করেছিলেন। পরে ব্যাবসা মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেলে ব্যাঙ্ক আবার টাকা ধার দিতে শুরু করে। অর্থাৎ, একদিক থেকে ‘রাজারানি’ শুরু হয়েছিল একটা টুলি কমিউনিটি-বেসড ভেঞ্চার হিসেবে, কিন্তু কমিউনিটিকে ফাঁকি দিয়ে। তাই ইন্ডিয়ান কমিউনিটির টাকাওয়ালা অনেকেই ওঁর শত্রুর দলে।”

“এই বার বুঝতে পারছি, কেন সেদিন অবিনাশ পার্টিতে ওইরকম একটা হিন্ট দিয়েছিল।”

“শোন, এটাই শেষ নয়। দিলীপ কাপাদিয়ার আরও পাজলিং লেগেছে… ডক্টর আনন্দ শর্মা, যিনি ওঁর ফিল্ম কোম্পানির সবচেয়ে বড়ো অংশীদার, তিনি হঠাৎ বল্লভ শাহের সঙ্গে কম্পিটিশন করে ইন্ডিয়ান ফাস্ট-ফুড চেইন খোলার তোড়জোড় করছেন! সোজাসুজি না বললেও দিলীপ কাপাদিয়াকে একটা হিন্ট দিয়েছেন, রেস্টুরেন্ট বিজনেসে ওঁকে নামতেই হবে ওঁর পরলোকগত স্ত্রীর কথা ভেবে! কোনো রহস্য নিশ্চয় এর মধ্যে আছে। মৃত্যুভয় নয়, ডক্টর শর্মা এই ডকুমেন্টারির কো- প্রোডিউসার জানতে পেরেই বল্লভ শাহ ডকুমেন্টারিতে অংশ নিতে চাচ্ছিলেন না।”

“সেটা কেন?”

“বুঝতে পারছিস না! কমিউনিটির বন্ধুবান্ধবদের এইভাবে ফাঁকি দেবার কাহিনিগুলো যদি নতুন করে টিভি-তে প্রচারিত হয়ে যায়! নিশ্চর সেই ভয় থেকে।”