ম্যানহাটানে মিস্ত্রি মার্ডার – ৪

বুধবার আমার ক্লাস শেষ হয় পাঁচটায়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধে। সাধারণত বাড়ি ফিরে আমার কাজ হল সাড়ে ছ’টার লোকাল নিউজ দেখা। আজকেও দেখব বলে টিভি খুলেছি, কিন্তু পেছনে রান্নাঘরে যে তাণ্ডব চলছে অ্যাটেনশনটা বার বার ওদিকেই চলে যাচ্ছে! তাণ্ডবের মূলে অবশ্য একেনবাবু। হঠাৎ ওঁর রান্না শেখার সাধ হয়েছে, গুরু ধরেছেন প্রমথকে। রান্নার ব্যাপারে প্রমথ হল পারফেকশানিস্ট, সুতরাং পদে পদে ধমকাধমকি চলছে। এইভাবে চললে আজ ডিনার সময়মতো হবে কিনা কে জানে! তাই টিভি দেখতে দেখতে ভাবছি ওদের দু-জনকে কিচেন থেকে তাড়িয়ে পিৎজা অর্ডার করব। ঠিক এমনি সময়েই মিশেল ব্রিঙ্কলির খবর পড়া শুরু হল। 

“আজকের সবচেয়ে বড়ো খবর হল লোকাল ফাস্ট-ফুড চেইন, ‘রাজারানি’র প্রতিষ্ঠাতা বল্লভ শাহের সন্দেহজনক মৃত্যু। মিস্টার শাহের মৃতদেহ পুলিশ বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওঁর ম্যানহাটান অ্যাপার্টমেন্টে আবিষ্কার করে। পুলিশ সন্দেহ করছে যে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ওঁকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের রিপোর্টার রেক্স রিড এই মুহূর্তে বল্লভ শাহের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে, ওঁর কাছে বিস্তারিত শোনা যাক…”

রেক্স রিডের ওপর ক্যামেরা ফোকাস করতেই দেখলাম জায়গাটা লোকে গিজগিজ করছে। বল্লভ শাহের মৃতদেহ তখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। রেক্স রিড তাঁর ইউজুয়াল নাটকীয় ভঙ্গিতে বলছে, “সেন্ট্রাল পার্কের উলটো দিকে এই হাইরাইজ অ্যাপার্টমেন্টগুলোর একটাতে থাকতেন দ্য কিং অফ এশিয়ান-ইন্ডিয়ান ফাস্ট-ফুড চেইন, বল্লভ শাহ। পনেরো বছর আগে বল্লভ শাহ যখন এদেশের মাটিতে প্রথম পা দিয়েছিলেন, তখন তাঁর পকেটে একটা পয়সাও ছিল না। আজ পনেরো বছর পরে উনি যে সম্পত্তি রেখে গেলেন তা কম করেও হবে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার! বল্লভ শাহ আমেরিকার জন্যে ভারত ছেড়েছিলেন বটে, কিন্তু ভারতীয় খাবার কোনোদিন ত্যাগ করেননি। সাধারণ নিউ ইয়র্কবাসীরা যাতে সে সুস্বাদু খাবারের আস্বাদ পায় সে সুযোগ তিনি করে দিয়ে গেছেন। তিন-তিন বার দেউলিয়া হয়েও তিনি তাঁর লক্ষ্য হারাননি, বার বার ফিরে এসেছেন ভারতীয় খাবারকে প্রত্যেকটি নিউ ইয়র্কবাসীর ফেভারিট খাবারের তালিকায় জায়গা করে দিতে। মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে এই উদ্যোগী পুরুষের জীবন শেষ হল। পুলিশ জানে না কে তার জন্য দায়ী। আমরা শুধু জানি যে এক জন কঠোর পরিশ্রমী দূরদর্শী ব্যবসায়ী, যিনি …।”

রেক্স রিড নিশ্চয়ই আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আরে, এ কী! হঠাৎ কোত্থেকে অরুণ শেঠ এসে রেক্স রিডকে ধাক্কা দিয়ে মাইক্রোফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে চেঁচাতে শুরু করেছে, “দ্যাটস এ লাই, দ্যাটস এ টোটাল লাই। বল্লভ শাহ ছিল একটা শয়তান। দ্যাটস হোয়াই আই হ্যাড টু কিল হিম। ইয়েস, অল দ্য ভিউয়ার্স, আই কিলড হিম…।”

অরুণ আর কী বলল শোনা গেল না। কেউ একজন টেলিভিশন ক্যামেরাটা আড়াল করে দিল। মাইক্রোফোনটা নিয়েও ধস্তাধস্তি হচ্ছে বোঝা গেল। কয়েক সেকেন্ড মাত্র, তারপরই টিভি স্ক্রিনে আবার ছবি ফুটে উঠল। দেখলাম পুলিশ অরুণ শেঠকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। 

মিশেল ব্রিঙ্কলি রেক্স রিডকে জিজ্ঞেস করলেন, “রেক্স, আর ইউ ওকে?”

রেক্স হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “ইয়েস মিশেল, আই অ্যাম ওকে।”

“লোকটা কে তোমার ধারণা আছে?”

“না, কোনো ধারণাই নেই। দেখে মনে হল ভারতীয়, উচ্চারণেও ভারতীয় টান স্পষ্ট। কিন্তু আমার ভুলও হতে পারে। পরিচয় জানতে পারলেই তোমাদের জানাব।”

“থ্যাংক ইউ রেক্স,” বলে মিশেল ব্রিঙ্কলি অন্য নিউজে চলে গেল। 

আমি এত মন দিয়ে খবর শুনছিলাম যে খেয়াল করিনি প্রমথকে নিয়ে একেনবাবু কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। 

প্রমথ রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে দিয়ে বলল, “আই কান্ট বিলিভ ইট! দিস ম্যান ইজ কমপ্লিটলি ইনসেইন! হোয়াই ডিড হি ডু দিস?”

জবাব দেব কী, আমিও ব্যাপারটা দেখে হতভম্ব! 

“কী মশাই, কিছু বুঝতে পারছেন?” প্রমথ একেনবাবুকে প্রশ্ন ছুড়ল।

“ভেরি কনফিউজিং স্যার।” একেনবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন।

কিন্তু ওঁর গলার স্বরে কিছু ছিল যাতে একটু সন্দেহ হল। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কী মনে হয়, অরুণ শেঠ সত্যি সত্যিই মার্ডার করেছে?”

“কে জানে স্যার, তবে উনি তো স্বীকার করলেন।”

“আলবাত খুনি, নইলে ওখানে ও গেল কী করে?” প্রমথ কনফিডেন্টলি বলল, “বাজি ধরে বলতে পারি মার্ডার করার পর পুলিশকে খবরও ওই-ই দিয়েছিল যাতে নাটকীয়ভাবে অপরাধটা সবাইকে জানাতে পারে! হি ওয়ান্টেড সেনসেশন! হোয়াট উড ইউ এক্সপেক্ট ফ্রম এ নাট?”

“দ্যাটস অ্যান ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট স্যার,” একেনবাবু বললেন। “ভেরি ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট।”

“কী ‘ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট’?” জিজ্ঞস করলাম। 

“ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট এই জন্য স্যার, পাগলে কী না বলে আর ছাগলে কী না খায়! অরুণ শেঠকে যদি আমরা পাগলই মনে করি, তাহলে ওঁর এই স্বীকারোক্তিকে কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত হবে না।”

“দাঁড়ান গোয়েন্দামশাই,” প্রমথ প্রশ্ন করল, “আপনি আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারেন হঠাৎ অরুণ শেঠের ওখানে আগমন হল কেন?”

“সেটা বোধহয় পারা যায় স্যার। অরুণ শেঠ সম্পর্কে গত দু-দিন একটু খোঁজ নিয়েছি। উনি কিছুদিন হল মেট্রোপলিটান মিউজিয়ামে পার্ট-টাইম কাজ করছেন। এও শুনেছি মিস্টার শাহের অ্যাপার্টমেন্ট মিউজিয়ামের ঠিক উলটো দিকে। হয়তো অফিস থেকে বেরোবার পথে ভিড় দেখে অরুণবাবু থেমেছিলেন। 

“ও, তার মানে আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছেন!” প্রমথ তির্যক মন্তব্য করল। 

“কী যে বলেন স্যার, তদন্ত আবার কী? কোনো ঘটনা ঘটলে তো তদন্ত!”

প্রমথ বলল, “তা বললে চলবে কেন, ঘটনা তো একটু আগেই দিব্যি ঘটে গেল! কিন্তু সে-কথা থাক, যেটা আমি বলতে চাই তা হল, অরুণ শেঠের স্বীকারোক্তিটা জাস্ট পাগলামি বলে উড়িয়ে দেওয়াটা ডাউন রাইট সিলি।”

“না, না, অরুণ শেঠের পক্ষেও দোষী হওয়া সম্ভব।” একেনবাবু স্বীকার করলেন। “তবে আমি শুধু আরেকটা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখার চেষ্টা করছিলাম।”

“গুড,” প্রমথ গম্ভীর মুখে বলল। “কিন্তু আপনি মশাই সব অ্যাঙ্গেল থেকেই দোষী।”

“কেন স্যার?”

“আপনার এই সিংকিং সিংকিং ড্রিংকিং ওয়াটারের হ্যাবিটটা ছাড়ুন তো! অত্যন্ত ধড়িবাজ লোক আপনি। গোপনে সব খবর জোগাড় করে আমাদের আগেই দোষী ধরে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছেন!”

“কী যে বলেন স্যার।”

“বেশ, তাহলে চটপট বলুন, লুকিয়ে লুকিয়ে এখন পর্যন্ত যা যা জেনেছেন।”

“স্যার, রান্নাটা আগে করে ফেললে হত না!” একেনবাবু কাঁচুমাচু মুখে বললেন। 

“আরে রাখুন আপনার রান্না! আমি পিৎজা অর্ডার করছি, হোম ডেলিভারি। আপনি শুরু করুন।”

“এক্সেলেন্ট আইডিয়া!” প্রমথও সায় দিল। 

“আমার ইনফর্মেশন কিন্তু খুব লিমিটেড স্যার, কনফার্মডও নয়।”

“আঃ, শুরু করুন তো মশাই ভণিতা না করে!” প্রমথ ধমক লাগাল। “না না, শুরু করছি স্যার। প্রথম খবর হল, অরুণ শেঠ বল্লভ শাহের শ্যালকপুত্র, মানে স্ত্রীর ভাইয়ের ছেলে।”

“এইটে ইন্টারেস্টিং। ক’দিন আগেই তো ইন্ডিয়া অ্যাব্রড-এ ওঁর ওপর একটা লেখা পড়লাম, স্ত্রীর কোনো উল্লেখ ছিল না তো সেখানে!”

“হি ওয়াজ এ উইডোয়ার। স্ত্রী প্রায় বছর সাতেক হল মারা গেছেন। ইন ফ্যাক্ট এদেশেই সাঁতার কাটতে গিয়ে ডুবে মৃত্যু।”

“মাই গড! খবরটা পেলেন কোত্থেকে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। 

“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কাছে শুনেছি স্যার। আসলে ওঁর মৃত্যুটা তখন রহস্যজনক বলে মনে হয়েছিল। তার একটা কারণ রুক্মিণী শাহ, মানে বল্লভ শাহের স্ত্রী বেশ ভালো সাঁতার জানতেন।”

“সাঁতার জেনেও মানুষ ডুবে মরতে পারে,” আমি বললাম। “আমার এক বন্ধুই তো রবীন্দ্র সরোবরে পায়ে ক্র্যাম্প ধরে মারা গিয়েছিল।”

“তা পারে স্যার, কিন্তু এ ছাড়াও আরেকটা কারণ ছিল। মিস্টার বল্লভ শাহ স্ত্রীর নামে একটা মোটা লাইফ ইন্সিয়োরেন্স করিয়েছিলেন, ম্যাডামের মৃত্যুর মাত্র মাস পাঁচেক আগে।”

“যাঃ, দিলেন তো ব্যাপারটাকে নিরামিষ করে!” প্রমথ হতাশ মুখ করে বলে উঠল, “কোথায় রগরগে একটা পরকীয়া কেচ্ছা শোনাবেন, না বস্তাপচা মোটিভ ‘ডলার’-কে টেনে আনলেন! কী বলতে চাচ্ছেন, হি কিলড হার টু গেট ইন্সিয়োরেন্স মানি?”

“এক্স্যাক্টলি, স্যার। কিন্তু তদন্তে কোনো ফাউল-প্লে পাওয়া যায়নি। ফলে বল্লভ শাহ ইন্সিয়োরেন্সের টাকাগুলো যথারীতি পেয়ে যান এবং সেই টাকা থেকেই নতুন করে ‘রাজারানি’ রেস্টুরেন্ট শুরু করেন। শেষটা অবশ্য আমার অনুমান স্যার। * 

“রুক্মিণী শাহের কোনো ছেলেপুলে ছিল না?” আমি প্রশ্ন করলাম। 

“হ্যাঁ স্যার, একটি মেয়ে ছিল। ঘটনাটা যখন ঘটে, মেয়েটি তখন হাই স্কুলে সিনিয়র ইয়ারে পড়ছে। আরও একটা খবর, অরুণ শেঠও তখন বল্লভ শাহের বাড়িতে থাকতেন। ম্যাডাম ওঁকে দেশ থেকে আনিয়েছিলেন আমেরিকান কলেজে পড়াবেন বলে।”

“এটা আপনি জানলেন কার কাছ থেকে?” প্রশ্ন করলাম। 

“আঃ, তুই চুপ কর তো! সোর্স জেনে তোর লাভ কী?” প্রমথ আমায় ধমকাল। “থামবেন না, চালিয়ে যান একেনবাবু।”

“থ্যাংক ইউ স্যার। … কী বলছিলাম জানি? ও, হ্যাঁ, রুক্মিণী শাহের মৃত্যুর অল্পদিনের মধ্যেই ওঁর মেয়ে ক্যালিফোর্নিয়াতে পড়াশোনা করতে চলে যায়। এখন বোধহয় আলাস্কা বা ওরকম কোনো একটা ঠান্ডা জায়গায় থাকে। নিউ ইয়র্কে কদাচিৎ আসে।”

প্রমথ টিপ্পনী কাটল, “শ্যালক-পুত্রের সঙ্গে বল্লভ শাহের পৈঠ খায় না সেটা তো নিজের চোখেই দেখেছি। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, মেয়ের সঙ্গেও সম্পর্কটা আহামরি নয়!”

“সেটাই মনে হয় স্যার। তবে অরুণ শেঠের সঙ্গে কিন্তু একসময় বল্লভ শাহের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ইন ফ্যাক্ট রুক্মিণী শাহের মৃত্যুর পরও বহুদিন পর্যন্ত অরুণ শেঠ বল্লভ শাহের কাছেই থাকতেন। শুধু তাই নয় স্যার, নিজের কোম্পানিতে মিস্টার শাহ ওঁকে ভালো কাজও দিয়েছিলেন।”

“ওইরকম একটা ছিটগ্রস্ত লোককে? হলই না হয় শ্যালকপুত্র!” আমি বললাম।

“আমার ধারণা স্যার, অরুণ শেঠকে উনি নিজের ছেলের মতোই দেখতেন।”

“তাই যদি হয়, তাহলে এ অবস্থাটা হল কী করে?”

“সেটা একটা রহস্য স্যার। বছর দুই আগে বল্লভ শাহ-র সঙ্গে অরুণ শেঠের এমন একটা তোলপাড় হয় যে অরুণকে উনি অন দ্য স্পট চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। দ্যাটস অল আই নো স্যার।”

“দ্যাটস নট ট্রু।” প্রমথ খুব গম্ভীর হয়ে বলল। 

“হোয়াট নট ট্রু স্যার?”

““দ্যাটস অল’ তো হতে পারে না, মিউজিয়ামের চাকরি পাবার কথাটা তো বললেনই না?”

“কী মুশকিল স্যার, ওটা তো একটু আগেই বলেছি। ঠিক আছে, বাকিটুকুও কমপ্লিট করে দিচ্ছি। ‘রাজারানি’ ছাড়ার পর অরুণ শেঠ এক বছরের মতো কেমিক্যাল ব্যাঙ্কে ছিলেন। সেখান থেকেও ওঁর চাকরি যায়। তারপর থেকে উনি নানা রকমের পার্ট-টাইম কাজ করে বেড়াচ্ছেন। আপাতত মেট্রোপলিটান মিউজিয়ামে কাজ করছেন। দ্যাটস অল স্যার, ব্যস!”

“হ্যাঁ, এই বার দ্যাটস অল,” প্রমথ বলল।