ম্যানহাটানে মিস্ত্রি মার্ডার – ২

দিলীপ কাপাদিয়া আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন এক সপ্তাহও হয়নি, এর মধ্যেই প্রমথ ওঁর সম্পর্কে অজস্র খবর জোগাড় করে ফেলেছে! দূরদর্শনের জন্য ডকুমেন্টারি ছাড়াও উনি নাকি একটা বড়ো বাজেটের ফিচার ফিল্ম করছেন। তার শুটিং ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। কিছুটা হচ্ছে নিউ ইয়র্কে, বাকিটা ওয়াশিংটন ডিসি-তে। দিলীপ কাপাদিয়ার আগের ছবিগুলোর থিম ছিল এথনিক, অর্থাৎ এখানকার ভারতীয়রাই ছিল মুখ্য চরিত্র। নতুন ছবিতে বেশ কয়েক জন আমেরিকান অভিনেতা-অভিনেত্রী আছে। যিনি হিরোইন, তিনি এদেশের একটি পপুলার টেলিভিশন সিরিয়ালে খুবই পরিচিত মুখ— জামাইকান, কিন্তু ভারতীয় বংশোদ্ভূত। দিলীপ কাপাদিয়া এটা নিয়ে এতই এক্সাইটেড, আশা করছেন অস্কার পাবার মতো ছবি হবে। একটাই নট সো গুড নিউজ, অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও হলিউডের কোনো কোম্পানিকে দিয়ে ছবিটা প্রোডিউস করানো যায়নি। হলিউডের প্রোডাকশন হলে ছবির ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করতে হয় না। ফাইনান্স, পাবলিসিটি, প্রোমোশন সব ওরাই ম্যানেজ করে। 

“উনি কি ভেবেছিলেন হলিউড এটা প্রোডিউস করবে? এটা আশা করাই তো অবাস্তব!” প্রমথকে বললাম। 

“কেন স্যার?” প্রশ্নটা একেনবাবুর। এতক্ষণ খুব মন দিয়ে টেলিফোন-বিল চেক করছিলেন। লিস্ট থেকে কোন কোন কল ওঁর করা, খুঁজে খুঁজে সেগুলোতে দাগ দিচ্ছিলেন। সেই অনুযায়ী উনি ওঁর অংশ দেবেন। ইন্টারন্যাশনাল কলও নয় যে টাকার অঙ্ক বড়োসড়ো কিছু। স্রেফ দু-দশ ডলার বাঁচাবার জন্যে কেউ এত পরিশ্রম করতে পারে, প্রথম বার দেখে বিশ্বাস করতে পারিনি! আমি আর প্রমথ যখন সাতাশ ডলারের লং ডিস্টেন্স কল-এর চার্জকে তিন দিয়ে ভাগ করে ন’ডলার করে দিতে যাচ্ছি, উনি বলে উঠলেন, “আমার ভাগটা স্যার সাত ডলার আঠাশ সেন্ট।”

“হোয়াট!” প্রমথ প্রায় আঁতকে উঠেছিল। 

“এই যে স্যার,” বলে দাগ দেওয়া বিল-এর ডিটেল কল-লিস্টটা দেখালেন।

ন’-এর বদলে সাত ডলার আঠাশ! এক ডলার বাহাত্তর সেন্ট বাঁচানোর জন্য কত পরিশ্রম! 

“আপনি মশাই সামথিং!” প্রমথ না বলে পারেনি। 

“না না স্যার, হিসেব ঠিক থাকাই ভালো। এর পরের বার হয়তো আমার চার্জ বারো ডলার হবে। আপনারা কেন বেশি দেবেন!”

“ঠিক আছে, আপনি সাত ডলারই দিন, শুধু শুধু আর খুচরো বার করবেন কেন?”

“কী যে বলেন স্যার।”

এটা বিস্তারিত লিখলাম এই জন্য যে, বিলের ডিটেলস চেক করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে পুরোপুরি মন না দিয়ে উনি যে আমাদের কথায় কান দিচ্ছিলেন সেটা বুঝিনি। 

“আপনি কি বিল চেক করছেন না আমাদের কথা শুনছেন?” জিজ্ঞেস করলাম। 

“দুটোই স্যার,” ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে উত্তর দিলেন একেনবাবু। “যাই বলুন স্যার, এখানকার টেলিফোন কোম্পানিগুলো কিন্তু অ্যামেজিং! কবে কখন ক’মিনিটের জন্য ফোন করেছি— সব খবর রাখে। ফাঁকি দেবার উপায় নেই। ও কথা থাক স্যার, আগে আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিন।”

“কোন প্রশ্ন?”

“ওই যে বললেন স্যার, হলিউড প্রোডিউস করবে না…”

“ও হ্যাঁ, যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, হলিউড ইজ ফুল অফ প্রেজুডিসড পিপল। হোয়াইট আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান ডিরেক্টর না হলে, ব্যাকিং পাওয়া ইম্পসিবল।”

“জিনিসটা ঠিক ক্লিয়ার হল না স্যার।”

“কী ক্লিয়ার হল না?”

“ক্লিয়ার হল না এই জন্য, আমি আমি ধরে নিচ্ছি প্রোডিউসাররা লাভ করার জন্য ছবিতে টাকা ঢালেন। মিস্টার কাপাদিয়ার ছবি যদি প্রমিসিং হয়, তাহলে সেটা করবেন না কেন?”

একেনবাবুর মাথায় যদি একটা কথা ঢোকে! “সেটাই তো আপনাকে বোঝাবার চেষ্টা করছি, বিকজ দে আর প্রেজুডিসড!”

“কিন্তু আরেকটা সম্ভাবনা আছে স্যার। হলিউডের প্রোডিউসাররা জানেন, আমেরিকানরা মুখে যাই বলুক না কেন, এটা একটা রেসিস্ট কান্ট্রি, মানে কিনা বর্ণবিদ্বেষী। সাদা চামড়ার ডিরেক্টর না থাকলে বাজারে বই চলবে না। যেটা বলতে চাইছি স্যার, হলিউড ইজ নট নেসেসারিলি প্রেজুডিসড, ওরা শুধু নিজেদের লাভ- লোকসান দেখছে। কিন্তু আমেরিকানস আর ডেফিনিটলি রেসিস্ট।”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “আপনি মশাই সব সময়ে আমেরিকার খুঁত ধরতে ব্যস্ত। এতই যদি বাজে জায়গা মনে হয়, তবে আবার ফিরে এলেন কেন?”

“এই দেখুন স্যার, আপনি চটে গেলেন! আমি তো শুধু একটা পসিবিলিটির কথা বলছি।”

“বাপিটা দিনকে দিন প্রো-আমেরিকান হয়ে যাচ্ছে! কোনদিন দেখব সিটিজেনশিপ নিয়ে আমেরিকান এয়ারফোর্সে ঢুকে ভারতের ওপরেই বোমা ফেলছে!”

“বাজে কথা বলিস না।”

“বলব না, কিন্তু হলিউড সম্পর্কে তোর ধারণা ভুল।”

“কী ভুল?”

“হলিউড এখন অনেক কালো ডিরেক্টর, কালো অ্যাক্টর নিয়ে ফিল্ম প্রোডিউস করে। স্পাইক লি, বিল ক্রসবি, রিচার্ড প্রায়র… এঁদের ছবি হচ্ছে না? তবে এটা ঠিক এশিয়ানদের ছবি তেমন হচ্ছে না।”

“কিন্তু স্যার, হলিউডের বড়ো বড়ো অনেক কোম্পানি তো এখন জাপান, মানে এশিয়ানদের হাতে… ভুল বললাম কি স্যার?”

“আপনার পয়েন্টটা কী?”

“তুই একটা ইডিয়ট! এটাও বুঝছিস না!” প্রমথ ধমক দিল। “প্রোডিউসার এশিয়ান হলেও এশিয়ানদের হিরো-হিরোইন করে ছবি করছে না, কারণ এদেশে সে ছবি চলবে না। সেই রেসিজিমের ব্যাপার। 

আমাকে লজ্জা থেকে বাঁচাবার জন্যেই বোধহয় একেনবাবু বললেন, “ও কথা থাক স্যার, আমরা তো ফিল্ম তুলতে বা অভিনয় করতে যাচ্ছি না। 

“দাঁড়ান মশাই, বহুবচন ব্যবহার করলেন কেন? আমি বা বাপি নিশ্চয় যাচ্ছি না, কিন্তু আপনি তো যাচ্ছেন! ইউ হ্যাভ আলরেডি সাইনড আপ ফর এ ফিল্ম! তবে ভালোকথা, ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার আগে আপনার আদ্যিকালের ঘিয়ে-কোটটা বিসর্জন দিন। আজকেই চলুন মেসিজ-এ সেল চলছে, ভদ্র-গোছের কিছু কিনবেন। 

“কেন স্যার, কোটটা খারাপ কী?”

“প্রথমত, ওটা আর ঘিয়ে রঙের নয়… কেচ-আপ, ঝোল, তেল ইত্যাদি পড়ে মাল্টি-কালার হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, ওটা অন্তত তিরিশ বছরের পুরোনো, তৃতীয়ত…।”

“কী যে বলেন স্যার, ওটা আমার বিয়ের সময়ে বানানো কোট!”

“তাহলে তো একশো বছর! না, সিরিয়াসলি, একটা নতুন কোট এবার কিনে ফেলুন। লক্ষ লক্ষ লোক আপনাকে দেখবে। কিপ্টেমির জন্য যদি না পারেন, তাহলে বলুন। আমি আর বাপিই না হয় চাঁদা তুলে কিনে দেব।”

“আপনারা না স্যার, সত্যি! এমন সিরিয়াসভাবে কথা বলেন যে ঠাট্টা বুঝতে সময় লাগে! আচ্ছা বাপিবাবু, আপনি বলুন তো— কোটটা কি একেবারেই আন- অ্যাকসেপ্টেবল?”

কী আর বলি, ভদ্রতা করলাম, “এক বার ধুয়ে নিলে বোধহয় মন্দ হয় না।”

“এটা ঠিক বলেছেন স্যার, আপনি বলায় মনে পড়ে গেল কয়েক বছর হল ওটা ড্রাই ক্লিনিং করা হয়নি।”

“এখন আর ড্রাই ক্লিনিং-এ চলবে না,” প্রমথ বলল, “বয়েলিং ওয়াটারে সুপার-স্ট্রং ডিটারজেন্ট দিয়ে হেভি-ডিউটি ওয়াশিং মেশিনে ধুতে হবে।”

“তুই সত্যি লোকের পেছনে লাগতে পারিস!” প্রমথকে ধমকালাম। 

“পেছনে লাগছি মানে! একেনবাবু বন্ধু বলে উপদেশ দিচ্ছি। তোর মতো গা বাঁচিয়ে আমি চলি না। আরেকটা কথা একেনবাবু, আপনিও বাপির মতো বড্ড ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলছেন। দেশের লোকেরা ওরকম ফট ফট ইংরেজি শুনলে চটবে।”

“এটা কিন্তু ঠিক বলেছেন স্যার, সেদিন ফোনে ইংরেজি শুনে ফ্যামিলি রাগ করেছিল!”

“একটু রাগ, না ধাতানি?”

“ধাতানিই স্যার। আসলে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট সাহেবের সঙ্গে একটা মিটিং-এ যেতে হয়েছিল, তাই টাই পরেছিলাম। টাই-ফাই পরলেই মুখ থেকে ইংরেজিটা বেশি বেরোয়। 

“তাহলে তো বাপির উলটো। বাপির আবার টাই পরলে গলায় ইংরেজি আটকে যায়! যাই হোক, প্রবলেমের তাহলে সহজ সলিউশন… ধুতি-পাঞ্জাবি পরে শুটিং-এ যাবেন, তাহলে আর ইংরেজি বেরোবে না, আর আপনার ঘিয়ে কোর্টের সমস্যাও মিটে যাবে!”