ম্যানহাটানে মিস্ত্রি মার্ডার – ১

[প্রথমেই বলে নিই, এই কাহিনিটি একেনবাবুর নিউ ইয়র্কে ফিরে আসার অল্প কিছুদিন পরের ঘটনা। বহুদিন আগে এটি নোটবুকে লিখে রেখেছিলাম। ওখানেই পড়েছিল এতদিন, ছাপানো হয়নি।] 

.

বাইরে বেশ ঝুর ঝুর করে বরফ পড়ছে… ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে আমি আর প্রমথ আলোচনা করছি স্নো-ডে বলে আজ ইউনিভার্সিটি ছুটি দিয়ে দেবে কিনা। একেনবাবুর মুখ দেখতে পাচ্ছি না, খুব মন দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস পড়ছেন, মাঝে মাঝে ঠ্যাং দুটো নাচছে। আলোচনায় ছেদ পড়ল ডোর বেলের ডিং-ডং আওয়াজে। 

“এই সাতসকালে বরফের মধ্যে আবার কে এল?” একরাশ বিরক্তি নিয়ে সোফা থেকে উঠে প্রমথ দরজা খুলতে গেল। বাইরে কিছুক্ষণ কথা বলার পর যাঁকে নিয়ে ঘরে ঢুকল তাঁর মুখটা কোথায় জানি দেখেছি। কাঁচা-পাকা চুল, মুখে-চোখে অকাল বার্ধক্যের ছাপ। দুর্দান্ত শীতেও গায়ে সিল্কের সার্টের ওপর ডেনিমের জ্যাকেট। কারণটা আর্থিক অসচ্ছলতা নয়, জ্যাকেটের ওপর ‘গুচি’-র লেবেল দেখেই বোঝা যাচ্ছে। 

প্রমথ পরিচয় করিয়ে দিল, “ইনি হচ্ছেন মিস্টার দিলীপ কাপাদিয়া।”

দিলীপ কাপাদিয়া! নো ওয়ান্ডার কেন এত চেনা-চেনা লাগছিল! দিলীপ কাপাদিয়া নিউ ইয়র্কের একজন ভারতীয় ফিল্ম প্রোডিউসার। ইসমাইল মার্চেন্টের মতো নামকরা না হলেও নিউ ইয়র্কের ভারতীয়দের প্রায় সবাই দিলীপ কাপাদিয়ার নাম জানে। এই ক’দিন আগেও ইন্ডিয়া অ্যাব্রড-এ ওঁকে ফিচার করে ছবি দিয়ে বড়ো একটা লেখা বেরিয়েছে! 

মিস্টার কাপাদিয়া আমাকে নমস্কার করে বললেন, “খবর না দিয়ে হুট করে চলে এলাম! উপায় ছিল না, আপনার ফোন নম্বরটা জানতাম না।”

আমি প্রাণপণ বোঝার চেষ্টা করছি, আমাকে ওঁর কেন দরকার! প্রমথর কথায় ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। 

“মিস্টার কাপাদিয়া, আপনি লোক ভুল করছেন। একেনবাবু হচ্ছেন ইনি, বলে একেনবাবুকে দেখিয়ে দিল।”

মিস্টার কাপাদিয়াকে দোষ দেওয়া যায় না। একেনবাবুর চেহারা বা পোশাক- আশাক কোনোটাই ভক্তির উদ্রেক করে না। উশকোখুশকো চুল, খাবলা খাবলা দাড়ি, বিচ্ছিরিভাবে কোঁচকানো হলুদ ছোপে ভরতি সাদা পাঞ্জাবি— মাতব্বরি করে ক’দিন আগে ডালে সম্বার দিতে যাবার ফল! 

প্রমথর কথা শুনে একমুহূর্তের জন্য দিলীপ কাপাদিয়ার মুখের যে অবস্থা হল সেটা ক্যামেরা-বন্দি করে রাখার মতো। চট করে নিজেকে সামলে নিলেন। 

“আই অ্যাম সরি, মিস্টার সেন। হাজাররকম চিন্তা নিয়ে ঘুরছি। কখন কাকে দেখছি, কাকে কী বলছি, কিচ্ছু ঠিক নেই।”

একেনবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কী যে বলেন স্যার, আসুন আসুন, বসুন।

প্রমথ বলল, “একেনবাবু, আপনি জানেন কিনা জানি না, মিস্টার কাপাদিয়া কিন্তু নিউ ইয়র্কের ফেমাস ফিল্ম মেকার।”

“ফিল্ম মেকার!” একেনবাবুর গলায় উত্তেজনার ভাবটা স্পষ্ট। “তার মানে আপনি স্যার মুভি তোলেন?”

দিলীপ কাপাদিয়া মনে হয় এইরকম রিয়্যাকশন দেখে অভ্যস্ত। শান্তভাবে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ।”

এই সংক্ষিপ্ত উত্তরে একেনবাবুর সন্তুষ্টি হল না। “মানে স্যার যেগুলো সিনেমা হল-এ দেখানো হয়!”

এবার দিলীপ কাপাদিয়ার ঠোঁটে মুচকি হাসি। “তা মাঝে মাঝে দেখানো হয় বই কী!”

প্রমথ বলল, “ওঁর ইমগ্রেন্ট’স ড্রিম’ তো কয়েক মাস আগেই ভিলেজ সিনেমাতে চলছিল।”

“দিস ইজ অ্যামেজিং স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং!” মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন একেনবাবু। “জানেন স্যার। আমার ফ্যামিলি শুনলেও বিশ্বাস করবে না আপনার মতো ফেমাস ফিল্ম মেকারের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে! সত্যি স্যার, ওর আবার ভীষণ সিনেমার শখ।”

‘ফ্যামিলি’ কথাটার তাৎপর্য দিলীপ কাপাদিয়ার কাছে স্পষ্ট নয়, চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম। তাই বুঝিয়ে দিলাম, “উনি ওঁর স্ত্রীর কথা বলছেন।”

এবার আর মৃদু হাসি নয়, হো-হো করে হেসে উঠলেন। “আপনার স্ত্রীকে বলবেন, শুধু আলাপ হয়নি— আমি আপনাকে সিনেমাতেও নামাতে চাই।”

“ঠাট্টা করছেন স্যার!” চোখ কপালে তুলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে পিছিয়ে যাবার ভান করলেন একেনবাবু।

“একদমই নয়!”

“দাঁড়ান স্যার, দাঁড়ান!” এবার চোখ কুঁচকে, ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে একেনবাবু বললেন, “আপনি বলছেন আমি আপনার মুভি-তে একটা ক্যারেক্টার হব? সেটা সিনেমা হলে দেখানো হবে, আর হাজার হাজার লোক সেটা দেখবে!”

“এক্ষেত্রে হয়তো লক্ষ লক্ষ, কারণ এটা টিভি-তে দেখানো হবে।”

“উইথ দ্য গ্রেটেস্ট রেসপেক্ট অ্যাবাউট ইওর ট্যালেন্ট,” একেনবাবু নাটকীয় ভঙ্গিতে হাতজোড় করে বললেন, “অ্যালাও মি টু সে স্যার, ইউ আর আউট অফ ইওর মাইন্ড!”

“কেন বলুন তো?”

“গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করতে পারবেন, কিন্তু আমাকে দিয়ে অ্যাক্টিং করাতে পারবেন না! একেবারে ইমপসিবল টাস্ক স্যার।”

“যদি আপনাকে বলি আপনাকে অ্যাক্টিং করতে হবে না, আপনি নিজেই হবেন নিজের ক্যারেক্টার।”

“তার মানে?”

“বুঝিয়ে বলছি, দূরদর্শন আমাকে একটা ডকুমেন্টারি তোলার ভার দিয়েছে। এদেশে এসে যেসব ভারতীয় অল্প সময়ে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁদের নিয়ে ডকুমেন্টারি। আমি চার জনকে কভার করব ভেবেছি। পলিটিক্যাল ফিল্ডে রবি চেরিয়ান, বিজনেসে বল্লভ শাহ, সায়েন্সে কুমার ব্যানার্জি, আর আমেরিকার একমাত্র ভারতীয় গোয়েন্দা হিসেবে আপনি। বেসিক্যালি আপনার একটা ইন্টারভিউ থাকবে, আর আপনার কয়েকটা বিখ্যাত কেস, যেমন ‘মুনস্টোন মিস্ট্রি’র টিভি কভারেজ থেকে কিছু ইনসার্ট, ব্যস।”

“দিস ইজ আনবিলিভেবল স্যার!” আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন একেনবাবু! 

“বাট ইট ইজ ট্রু, এবার বলুন আপনি রাজি কিনা। আমার হাতে বিশেষ সময় নেই, দশ দিনের মধ্যে পাইলট সাবমিট করতে হবে।”

একেনবাবু মাথা চুলকোচ্ছেন দেখে, প্রমথ বলল, “আলবাত উনি রাজি। আপত্তি করার অজুহাত কোথায়?”

আমিও বললাম, “অ্যাবসোলিউটলি। রাজি হয়ে যান একেনবাবু, আপনি ‘না’ বললে আপনার ফ্যামিলির কাছে ফোন যাবে।”

একেনবাবু অসহায় মুখ করে বললেন, “এরকম প্রেশারের পরে আর ‘না’ বলি কী করে!”

“চমৎকার!” খুশি হলেন মিস্টার কাপাদিয়া। “আর এক জন শুধু বাকি, তাঁর অনুমতি পেলেই আমার প্রিলিমিনারি কাজ খতম! 

“সেটা কার?” আমি প্রশ্ন করলাম। 

“মিস্টার বল্লভ শাহর। ভদ্রলোক কিছুতেই মত দিতে চাইছেন না।”

“সে কী! কেন?”

“আর বলবেন না, ভদ্রলোকের মাথায় ভূত চেপেছে, কেউ ওঁকে খুন করার চেষ্টা করছে। তাই লোকজন খুব অ্যাভয়েড করছেন।”

“বল্লভ শাহ কে স্যার?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন। 

“ওঁকে চেনেন না!” অবাক হলেন দিলীপ কাপাদিয়া, “উনি হচ্ছেন ‘রাজারানি’ রেস্টুরেন্টের মালিক!”

একেনবাবু এখানে বেশিদিন থাকেননি, নইলে বল্লভ শাহকে চেনে না, এমন লোক এখানকার দেশি মহলে খুব বেশি নেই। ম্যাকডোনাল্ড, বার্গার কিং, উইম্পি-র মতো বাঘা বাঘা ফাস্ট-ফুড চেইন-এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওঁর ‘রাজারানি’ এখন নিউ ইয়র্ক শহরে প্রায় ডজন খানেক। শুরু হয়েছিল মাত্র আট বছর আগে ছোট্ট একটা দোকান দিয়ে! 

কথাটা শুনে একেনবাবু লজ্জা পেলেন, “দেখুন দেখি স্যার, রাজারানি আমার ফেভারিট দোকান, অথচ মালিকের নাম জানতাম না। দিস ইজ ব্যাড স্যার, নট গুড অ্যাট অল।” তারপর দিলীপ কাপাদিয়াকে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা স্যার, মিস্টার শাহ কেন অত ভয় পাচ্ছেন জিজ্ঞেস করেছিলেন?”

“করেছিলাম, কিন্তু সঠিক উত্তর পাইনি। ইন ফ্যাক্ট আপনার কথাও বলেছিলাম। পুলিশকে না হোক, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু ওঁকে এ ব্যাপারে খুব সিক্রেটিভ মনে হল। হয়তো বিজনেস রিলেটেড কিছু হবে।”

“দ্যাটস নট গুড স্যার।”

“আই নো, আশাকরি ওঁর ভয়টা অহেতুক। কিন্তু এ ব্যাপারে মুখ না খুললে কী করা যায় বলুন?”

“তা তো বটেই স্যার।”

“আচ্ছা আজ চলি, নেক্সট উইকের মধ্যেই যোগাযোগ করব। শুটিং-এর ডেটগুলো তখনই ঠিক করা যাবে। ভালোকথা, আপনার ফোন নম্বরটা যদি লিখে দেন।”

.

দিলীপ কাপাদিয়া চলে যেতেই প্রমথ একেনবাবুকে নিয়ে পড়ল, “কী মশাই, এবার তো দেখছি একেবারে ফিল্মস্টার হতে চললেন! আমাদের কথা মনে রাখবেন তো?” আমি বললাম, “ভুলে যাবেন না, নিউ ইয়র্কে আপনার প্রথম বন্ধু কিন্তু আমি।”

“আপনারা দু-জন স্যার বড্ড টিজ করেন।”

“টিজ! একেনাদ্বিতীয়মকে? 

“সেটা আবার কী স্যার?”

“মানে হল একেন অদ্বিতীয়ম, অদ্বিতীয় একেনবাবু!”

লজ্জা-লজ্জা মুখে একেনবাবু বললেন, “কী যে বলেন স্যার!”

“কেন মশাই, আপনি অদ্বিতীয় নন! আর ক’টা একেনবাবু আছেন আমাকে দেখান!”

“ঘাট মানছি স্যার আপনার কাছে। 

“আচ্ছা, একেনবাবু,” এবার আমি প্রশ্ন করলাম, “আপনার কি মনে হয় বল্লভ শাহ সত্যি সত্যিই খুন হবেন বলে ভয় পাচ্ছেন, না ডকুমেন্টারিতে না নামার ফন্দি!”

“প্রশ্নটা বোকার মতো করলি… তোর কাছ থেকে অবশ্য আর কী আশা করব,” প্রমথ আমাকে ঠুকল। “শোন, কোনো ব্যবসায়ীই ফ্রি পাবলিসিটির সুযোগ হারায় না। তেমন ভয় থাকলে ফিল্ম ক্রু-দের ঘরে ঢুকতে দেবার আগে সিকিউরিটি চেক করে নিলেই তো হয়!”

“আমারও স্যার তাই মনে হচ্ছিল, কিন্তু ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!”

“একদম ঠিক,” প্রমথ টিপ্পনী কাটল, “দেশে দেশে কত না খুন-রাহাজানি!”